আল মাহমুদের 'জলবেশ্যা' গল্প নিয়ে আলাপ

মোমিনুল আজম
আল মাহমুদের গল্প 'জলবেশ্যা'  পেঁয়াজ রশুনের পাইকারি বাজার লালপুর হাটের বর্ণনা নয়, সাধারণ নরনারীর যাপিত জীবনের কোন কাহিনী নয়, হাটে আসা নানা শ্রেনীর মানুষের চরিত্র চিত্রনের অহেতুক কসরত নয়। এটি ভাসমান বেদে সম্প্রদায়ের ছলাকলায়পূর্ণ জৈবিক আকর্ষনের শিল্পিত উপস্থাপনার মাধ্যমে আমাদের লোকপুরাণের যে চিরন্তন চরিত্র বেহুলা-লখিন্দর তার নৈতিকতাকে ভেঙ্গে চুড়ে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করে অধঃপতনের দিকটি চিহ্নিত করI। আমরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করি কবি আল মাহমুদের লেখনিতে উঠে এসেছে দেহবৃক্ষের কামনা-বাসনার তাড়না, সেখানে শ্রেনী চরিত্র অনুযায়ী ভাষার যাদুময় ব্যবহার, গল্পের শৈল্পিক উপস্থাপনা,  উপমার ব্যঞ্জনা, যা গল্পটিকে বিশ্বসাহিত্যের একটি অনন্য সম্পদে পরিণত করেছে।

গল্পের শুরু ব্রাক্ষ্ণনবাড়িয়ার লালপুর হাটের বর্ণনার মধ্যদিয়ে। এ হাটে পাইকারি মসল্লাপাতি কিনতে আসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মহাজনরা। তাদের এ কাজে সহায়তা করে আবিদ ব্যাপারী। তার সহায়তা ছাড়া এ বাজারে কারো পক্ষেই বড় কোন মালামাল কেনা সম্ভব নয়। যে কারনে মহাজনরাও তাকে সন্মান করে। আবিদ ব্যাপারী অনেক রাত করে মহাজনের নৌকা থেকে বঙ্গেস্বরী সেবন করে মাতাল হয়ে নেমে হাঁটতে থাকে। এ সময় তার ভিতর উষ্ণ প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। হাট বারে নদীতে আসে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন, নদীর ঠিক মাঝামাঝি টিমটিম করে জ্বলতে থাকা নৌকার বহর থেকে একটি নৌকা আলাদা হয়ে আছে। সেই নৌকার কাছে যাওয়ার জন্য সে নৌকা খুঁজতে থাকে। নদীর পাড় ধরে  মাইল খানেক হাঁটার পর কাঁঠালী বটগাছের নীচে বাধা একটি নৌকা দেখতে পেয়ে সে খুশি হয়ে যায়। 

অন্ধকারে মনে হলো এখানেই তার মায়ের কবর। মায়ের কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে সে হাঁটা দেয় কবরস্থানের দিকে।  কিছুক্ষণ কবর আর নৈঃশব্দের মধ্যে দাড়িয়ে থাকার পর আবিদ ব্যাপারীর মনে হলো এখানে যারা থাকে তাদের কোন জীবন নাই অতএব প্রানহী কবরস্থানে থেকে তার কোন লাভ নেই। সে ফিরে এসে নৌকা নিয়ে চলে যায় নদীর মাঝামাঝি, যেখানে বেদে বহর থেকে একটি  কালো চোখের মতো নৌকা আলাদা হয়ে আছে। সে নৌকায় উঠে পড়ে আবিদ আলী। মুলত এখানেই গল্পের জমাট বাঁধা অংশের শুরু এবং শেষ। 

গল্পের মুল চরিত্র লালপুর হাটের তরুণ দালালদের নেতা আবিদ বেপারি। সে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মহাজনদের মালামাল কিনে দেয়। বাজারে তার একছত্র আধিপত্যের কারনে মহাজনরাও তাকে সমাদর করে, নৌকায় তুলে মুরগীর মাংশ দিয়ে ভাত খাওয়ায়, বঙেস্বরী সেবন করায় এবং দালালী বাবদ ভালো অঙ্কের একটি টাকা হাতে তুলে দেয়। সে টাকা নিয়ে সে পরবর্তী হাটবার পর্যন্ত আমোদ ফূর্তি করে বেড়ায়। গল্পে কর্মবিমুখ ও ভোগবিলাসে আকন্ঠ নিমজ্জিত একটি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে আবিদ ব্যাপারী উঠে এসেছে! পুরো গল্পে আবিদ ব্যাপারীর পারিবারিক অবস্থার কোন বর্ণনা নেই। সে যখন মায়ের কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে, জোরে চিৎকার করে বললো, ‘মায়ো, বাজান আবার এক বেডিরে বিয়া কইরা আমারে খেদাইয়া দিছে। জমি জিরাত কিছু দেয় নাই। আমি বাজারে ব্যবসা করি, দালালি করি। ভালাই আছি। তুই হুনছ মায়ো, আমার কতা? হুনছ?’ এই একটি মাত্র সংলাপে আবিদ ব্যাপারীর পুরো পারিবারিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়।

মায়ের কবর ও নৈঃশব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে আবিদ ব্যাপারীর মধ্যে একটা ভীতি কাজ করে। পয়ত্রিশ বছরের আবিদ ব্যাপারী সেখান থেকে পালিয়ে আসে বটগাছের তলায়। এই ভয় পাওয়ার কারন সে উপলদ্ধি করতে পারে না। তারপর সে একটা যুক্তি দাড় করাতে পেরে তৃপ্ত হয়, যে যুক্তি তার স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করে। প্রাপ্তি ছাড়া সে কোন সময় ব্যয় করতে আগ্রহী নয়। 

আল মাহমুদের গল্প জলবেশ্যার মুল আকর্ষন পাঠককে গল্পের ভিতর টেনে নিয়ে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যতটা কাহিনীর কারনে তার চেয়ে বেশী ভাষার কারুকাজ ও উপমার ব্যঞ্জনা। নর-নারীর আদিম ঈন্দ্রিয় অনুভুতির শৈল্পিক উপস্থাপনা কৌশল এবং পরিবেশ পরিস্থিতির এমন বাস্তব বর্ণনা বাংলা সাহিত্যের খুব কম গল্পেই আছে। 

জলবেশ্যা গল্পটি সম্পর্কে আল মাহমুদ বলেছেন-'জলবেশ্যা আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জেগে উঠেছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে আমি যা দেখেছি, তাই উঠে এসেছে গল্পটিতে। জলবেশ্যাদের তো আমি নিজের চোখে দেখেছি, কথা বলেছি। তারপর তাদের নিয়ে লিখেছি।’ গল্পটিতে তার ব্যক্তিগত আবেগ অনুভূতির কোন প্রকাশ নেই তবে তার যাদুকরি ভাষা ব্যবহারের যে আবেগ তা গল্পটিকে স্বাতন্ত্রতা দিয়েছে। গল্প যতো ভালোই হোক না কেন ভাষার মাধুর্য না থাকলে তা কখনও সুখপাঠ্য গল্প হয়ে ওঠে না। আবিদ আলী নৌকায় ওঠার পর গল্পের যে বর্ণনা তা কতোটা শ্লিল-অশ্লিল সে বিতর্ক আছে তবে লিবিডো তাড়িত নর-নারীর যে উচ্ছাস, আবেগ অনুভূতি তার সার্থক রুপায়ন ঘটেছে এখানে, শ্লিল-অশ্লিলের মাপ কাঠিতে তা বিচার্য নয়।

গল্পটি পড়তে থাকলে মনে হবে এটি মনো-বৈকোল্যের একটি আখ্যান যা নীতি নৈতিকতার ধার ধারে না কিন্তু গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে পাঠক থ হয়ে যান, কি করু পরিতি আবিদ ব্যাপারীর আর কি শান্ত সমাহিত আচরণ বেহুলারুপী বেদেনীর। গল্পের এই যে সমাপ্তি তা পাঠক কখনও কল্পনা করতে পারেনি। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতি পদেপদে যে টুইষ্টিং এবং গল্পের শেষে যে আকষ্মিক করুণ পরিণতি তা পড়ে পাঠককে বিস্মিত হতে হয়। তাছাড়া মায়ের কবরস্থানে যাওয়া, অন্ধকার ও নৈঃশব্দের মাঝে দাড়িয়ে থেকে নতুন ভাবোদয়ের উদয় হওয়া ইত্যাদি বিষয় হঠাৎ করেই গল্পে এসেছে কিন্তু তা মুল গল্পকে ছাপিয়ে গিয়েছে এমন কখনও মনে হয়নি। গলপের ডিটেইলস সবসময় মুল গল্পের সাথে সম্পৃক্ত থেকেছে।

বেদেনীর নৌকায় ওঠার পর  নিজেকে প্রেমের পুজারি বেহুলা হিসেবে দাবী করে আবিদ ব্যাপারীকে গ্রহণ করে লখিন্দর হিসেবে। তাদের সংলাপেও বিষয়টি এভাবেই উঠে আসে।
'নাম জিগাইয়া কি অইব? নাম আমার বেউলা সুন্দরী!’
আমার নাম আবিদ বেপারি। আমি অই হাডে দালালি করি।’ চিবুকটা চুলকাতে চুলকাতে বললো, আবিদ বেপারি।
‘অ আল্লাহ, আপনে তইলে লখিন্দর না! আর আমি ভাবতাছি, আমার নাওয়ে লখাই আইছে।’
কিন্তু মনসা মঙ্গলের বেহুলা লখিন্দরের সততার সাথে আবিদ ব্যাপারী আর বেদেনীর সম্পর্ক তুল্য নয়, এ সম্পর্কের পুরোটাই অর্থের উপর নির্ভরশীল, নীতি নৈতিকতা বর্জিত। লোক পুরাণের একটি সনাতন চরিত্রকে ভেঙ্গে চুড়ে ফেলার যে চেষ্টা তা এ সংলাপের মাধ্যমে সচেতনভাবেই করা হয়েছে।

আলোচনা করতে গিয়ে জলবেশ্যার প্রতিটি প্যারা উদ্বৃতি দিতে ইচ্ছে করে। সে ইচ্ছে অনেক কষ্টে দমন করেছি কিন্তু শেষের পুরো প্যারাটির উদ্বৃত করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। আমি মনে করি পাঠকরা এই বর্ণনার ঘনঘটা আর উপমার ব্যঞ্জনায় পুরো গল্পটি পড়তে উৎসাহিত হবেন।

"টাকার খুতিটা সামলানো হয়ে গেলে বেউলা গামছাটা দিয়ে বেপারির জ্ঞানহীন দেহের নগ্নতা ঢেকে বেশ সাহসের সাথে তাকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে নৌকার গলুইয়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। আবিদ বেপারির ভারি দেহের ভারে বেউলার মত শক্তিস্বরূপিণীও একটু বাঁকা হয়ে আছে। নদীর ওপর জোর বাতাস আর অনর্গল ঢেউ থাকায় আবিদ বেপারির জেলে নৌকার হালকা গুলুইটা মাছের মত লাফাচ্ছে। বেউলা নাওয়ের দাপানিতে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে একটা সুযোগের অপেক্ষায় নৌকার কিনারার কাঠে পা রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। কিন্তু আবিদ বেপারির ভারি দেহের ভার তার হাতে আর সইছিল না। শেষে ঢেউয়ের দুলুনির মধ্যেই সে জেলে নৌকার গুলুইয়ে পা রেখে চির অভ্যস্তের মত উঠে গেল। আর জেলে নৌকার দুটো তক্তার ওপর বেপারিকে শুইয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে নদীর পানি তুলে বেপারির চোখে একটা ঝাপটা মেরে দ্রুত ফিরে এলো নিজের নৌকায়। তারপর মুহূর্ত বিলম্ব না করে লগির বাঁধন খুলে নাও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো বেদে বহরটার দিকে। যেন মেঘনার ললাটের ওপর থেকে এক অতিকায় কালো চক্ষু স্বইচ্ছায় তার সহোদরা লোচনকে ত্যাগ করে ভেসে যাচ্ছে। আর ঢেউয়ের ওপর আটকে রাখা দোদ্যল্যমান পরিত্যক্ত নয়নটি এক নগ্ন গঙ্গামূর্তির চাতুরী দেখে অথৈ ঢেউয়ের ওপর ছল ছল করে কাঁদতে লাগলো।"

আলোচনাটি শেষ করবো তরুণ উপন্যাসিক ও গল্পকার স্বকৃত নোমান এর একটি সাম্প্রতিক মতামতের মধ্য দিয়ে। তিনি লিখেছেন-" আল মাহমুদের গল্পসমগ্রের মোট ৬৭টি গল্প পড়ে অসাধারণ চারটি গল্প খুঁজে পেলাম―জলবেশ্যা, পানকৌড়ির রক্ত, কালোনৌকা ও গন্ধবণিক। গল্পসমগ্রের সর্বশেষ গল্পটি পড়ে চোখ বন্ধ করি। কল্পনা করি একটি বিশাল আকাশ। আকাশটিতে পৃথিবীর বহু ভাষার বহু গল্প তারকারাজির মতো ফুটে আছে। সবচেয়ে উজ্জ্বল যে কটি তারা আছে তার মধ্যে ‘জলবেশ্যা’ একটি।"

পাদটীকাঃ 
আল মাহমুদের গল্প 'জলবেশ্যা' নিয়ে ওপার বাংলায় একটা সিনেমা হয়েছে, নাম 'টান', পরিচালক মুকুল রায় চৌধুরি। সিনেমায় আল মাহমুদের গল্পের লেশমাত্র নেই। নায়িকা ঋতুপর্ণার শরীর প্রদর্শনের জন্যই শুধু আল মাহমুদের জলবেশ্যা নামটি ব্যবহার করা হয়েছে। কেউ যদি মুকুল রায় চৌধুরি পরিচালিত 'টান' ছবি দেখে আল মাহমুদের গল্পের মুল্যায়ন করেন তাহলে তিনি আল মাহমুদের উপর অবিচার করবেন আবার কেউ আল মাহমুদের 'জলবেশ্যা' গল্পটি পড়ে টান ছবিটি দেখেন তাহলে তিনি চরমভাবে হতাশ হবেন।

লেখক পরিচিতি

মোমিনুল আজম
জন্মেছেন - ১৯৬৫ সালে, গাইবান্ধায়
পড়াশুনা করেছেন- শের ই বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে
কাজ করেন- বাংলাদেশ ডাক বিভাগে
বর্তমানে- কানাডায় থাকেন
ফিলাটেলি- ডাকটিকিট সংগ্রহের শখ নামে একটি প্রকাশনা আছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ