তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্প নিয়ে আলাপ



শামিম আহমেদ

গল্পটা আর পাঁচটা সাধারণ গল্পের মতো নয়। যদিও তেলেনাপোতা যে কেউ আবিষ্কার করতে পারেন, সে কথা কাহিনিকার বলেই রেখেছেন প্রথমে। কাজকম্মে হাঁফিয়ে ওঠা মানুষ যদি দু দিনেরর ছুটি পান এবং সঙ্গে ফুসলানি, তা হলে তিনি তেলেনাপোতা আবিষ্কার করতেই পারেন। তবে ভীষণ জরুরি একটা বিষয় আছে, যেটাকে অনিবার্য শর্ত বলা যেতে পারে, তা হল সৌভাগ্য।

একটি বাসে উঠে নামতে হবে ঘন্টা দুয়েক পরে। সেই বাসে থাকবে ঠাসাঠাসি ভীড়। তার পর যে রকম একটা জায়গায় এসে পৌঁছবেন এবং অনুসরণ করতে হবে এমন নির্দেশ যা টেনে নিয়ে যাবে আশ্চর্য এক জলার কাছে যেখানে পৃথিবীর সরলতম মাছেরা অপেক্ষা করে আছে আগন্তুকের।

সঙ্গী হবে আরও দু জন—এক জন পান-রসিক, অন্য জন নিদ্রাপ্রিয়। মশা, কাদাজল, জঙ্গল, বামনের দেশের গরুর গাড়ি, ম্যাজিক্যাল গাড়োয়ান, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে সেই ঘাটে পৌঁছে পাওয়া যাবে এক মেয়ের সন্ধান, আর তার পরেই শুরু হবে অন্য আর এক গল্প। ম্যালেরিয়ার মড়ক নিয়ে কথাগুলো আপনার কানে যাবে না।

মেয়েটির বয়স বোঝা যায় না। পান-রসিক বন্ধুর পরিচিত যামিনী নামের করুণনয়না মেয়েটির বাড়িতে হবে দুপুরের খাবারের আয়োজন। তাদের শ্রীহীন বাড়ির জীর্ণতা পীড়া দেবে খুব। ওরা আসলে নিরঞ্জনের অপেক্ষা করে আছে। আপনি কি নিরঞ্জন সাজবেন? যামিনীর প্রসাধন হবেন!

ভেবে দেখুন। মেয়েটির মা তার দূর সম্পর্কের বোনপো নিরঞ্জনের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে বলে প্রতীক্ষায় আছে। কিন্তু সে তো ধাপ্পা দিয়ে চলে গেছে। আপনার এখানে হিরো হওয়ার একটা সুযোগ আছে। হবেন কিনা, ভেবে দেখুন। যদি না হন, তা হলে গল্প শেষ এখানে। আর যদি রাজি থাকেন, তা হলে গল্প শুরু হবে এবার।

তেলেনাপোতায় অনেক গল্প আছে। তার কোনটা যে মূল গল্প, তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব আপনার, কারণ আপনিই এখানে মূল চরিত্র। আপনার দুই বন্ধু, যামিনীর মা--বাকি তিন উল্লেখযোগ্য চরিত্র। যামিনীকে আপনি প্রধানা চরিত্র বলবেন কিনা, সেটা আপনার ব্যাপার। তবে এই সব মানুষ ছাড়া কি আর চরিত্র নেই গল্পে? আছে। এবং আপনাদের বাদ দিয়ে তারাই সব জায়গা দখল করে বসে আছে। যেমন তেলেনাপোতা নিজেই এক অসামান্য চরিত্র। সরলতম পুঁটির মতো বাকিগুলোও আপনি পেয়ে যাবেন কিংবা গড়ে নেবেন, কারণ গল্পটি তো আপনারই লেখা।

এই গল্পটি আর পাঁচটি কাহিনির মতো নয়। তাই চরিত্রের সংঘাত এখানে তেমন প্রবল নয়, ওই মশার সঙ্গে মানুষের লড়াইটা বাদ দিলে। তবে নিরঞ্জন নামের ছোকরার ব্যাপারটা এখন ছেড়ে দিন। কারণ আপনি যখন নিজেই নিরঞ্জন সাজবেন তখন আপনার সঙ্গে নিরঞ্জনের আর একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। ধাপ্পাবাজ নিরঞ্জন বনাম আপ্নি-নিরঞ্জন। ধাপ্পাবাজ নিরু কথা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে। এমনকি পালিয়ে যে যায়নি, সেটা নিয়েও মিথ্যে বলেছে। এটাই গল্পের চরম জায়গা হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। ওই যামিনী নামের মেয়েটিই তার প্রধান কারণ, কেননা তেলেনাপোতার ধ্বংসপুরী, যামিনী ছাড়া সেখানে কিছুই নেই। আলো নেই, তাই দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েও থমকে আছে সভ্যতার মতো। একটু ভাবলে অবশ্য বুঝে যাবেন এ সবই আপনার দুর্বল মুহূর্তের অবাস্তব কুয়াশাময় কল্পনামাত্র। তা হলে কী হাতে কী রইল? শুধুই পেনসিল!

না। আপনার দুর্বল মুহূর্তই এই গল্পের প্রধান চরিত্র। ধ্যুর, তাই কখনও হয় নাকি? এমন প্রশ্ন তুলে ক্লাইম্যাক্স খুঁজতে যাবেন তো? এ বার তেলেনাপোতা চিরন্তন, নিরঞ্জন যামিনীর অতলে হারিয়ে যাবে। এই যামিনীকে আপনি রাত্রি ভাববেন, না মণি নামের বন্ধুর পরিচিতা, সে আপনিই জানেন। এটাকে ট্যুইস্টও ভাবতে পারেন।

এই গল্পে তেমন সংলাপ নেই। অল্প যেটুকু আছে তা কাহিনির স্বার্থে অনিবার্য ছিল। গোটা গল্পটা পরাবাস্তব, তাই সেই সংলাপ নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভাল। এই যে প্রকৃতি, পরিবেশ এবং বর্ণনা, তাই এই গল্পের মূল সম্পদ। গল্পকার যা বলতে চেয়েছেন তা আপনি নাও বুঝতে পারেন, কারণ আপনি জানেন না কাহিনিকার ঠিক কী উদ্দেশে এই গল্প রচনা করেছেন। বরং আপনি ভাবুন, এই গল্পটি

আপনার, আপনিই এখানে মূল চরিত্র, তা হলে সুবিধা হবে গল্পটিকে বুঝতে। প্রেমেন্দ্র মিত্র মনে হয় সেটাই চেয়েছিলেন।

দেখুন কোনও গল্প বানানো হতে পারে না। হতে পারে তা লঘু, কৃত্রিম; কিন্তু বানানো নয়। কৃত্রিম হলেও বানানো নয়। আসলে আমরা কী আদৌ কিছু বানাতে পারি? না, সেই ক্ষমতা আমাদের আছে? মণিময় পর্বতকে আপনি কৃত্রিম বলেন, কিন্তু তলিয়ে দেখুন তো, পর্বত আর মণি, এই দুটোই আপনি ধার করছেন বাস্তব জগত থেকে-- পরি থেকে মৎস্যকন্যা, পক্ষীরাজ থেকে ঈশ্বর; কাকে বলবেন কৃত্রিম? কাটাছেঁড়া করলে দেখবেন, আপনি শুধু এর ঘাড়ে তার মুণ্ড বসিয়েছেন, সেটাও আপনি করেছেন আর এক বাস্তব অনুষঙ্গের নিয়ম মেনে। কল্পনাকে নিয়ন্ত্রণ করার বাস্তব নিয়ম বিরাজমান! বিপুলা এ তেলেনাপোতার কতটুকু জানি!

এই গল্পের ভাষা চমৎকার। গল্পের ভেতরের আখ্যান এক অসামান্য ঘটনা, যা খুব জরুরি ছিল। গল্পকার-পাঠক নিজেই চরিত্র হয়ে ঢুকে আছেন, কারণ আপনিই পাঠক, আপনিই এখানে গল্পকার, তাই আপনিই মূল চরিত্র। ভীষণ আন্তর্ব্যক্তিক এই কাহিনিটি নিরপেক্ষ, মন ছুঁয়ে যায়। দাগ কাটে গভীরে। কোনও এক যামিনীতে নিদ্রা ভঙ্গে এই গল্পটি পুনরায় পাঠ করার জন্য আকুলিবিকুলি করতে পারেন আপনিও। আপনার কানে বেজে উঠতে পারে সেই বৃদ্ধার কন্ঠস্বরঃ

“যামিনীকে নিয়ে তুই সুখী হবি বাবা। আমার পেটে হয়েছে বলে বলছি না, এমন মেয়ে হয় না। শোকে-তাপে বুড়ো হয়ে মাথার ঠিক নেই, রাতদিন খিটখিট করে মেয়েটাকে যে কত যন্ত্রণা দিই—তা কি আমি জানি না! তবু ওর মুখে রা নেই। এই শ্মশানের দেশ—দশটা বাড়ি খুঁজলে একটা পুরুষ মেলে না। আমার মতো ঘাটের মড়ারা শুধু ভাঙা ইট আঁকড়ে এখানে-সেখানে ধুঁকছে, এরই মধ্যে একাধারে মেয়ে পুরুষ হয়ে ও কী না করছে!...

যামিনীকে তুই নিবি তো বাবা! তোর শেষ কথা না পেলে আমি মরেও শান্তি পাব না।’’

... যামিনী শুধু বলবে, “আপনার ছিপটিপ যে পড়ে রইল!”

আপনি হেসে বলবেন, “থাক না! এবারে পারিনি বলে তেলেনাপোতার মাছ কি বারবার ফাঁকি দিতে পারবে!”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ