গল্প নিয়ে আলাপ : ভণ্ডুল মামার বাড়ি



জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা 


যে কোন গল্পের প্রবেশমুখ ছাড়িয়ে একটু যেতেই গল্পটির প্রকৃতি বিশ্লেষণে সরব হয়ে ওঠে পাঠকের মন।  না ঠিক ‘মন’ নয়, মনের ভেতরে থাকা ‘আলাদা একটি মন’। মনের মূল অংশ তো জড়িয়ে পড়ে গল্পের সাথে। আর আলাদা সে মন ভাবতে শুরু করে  ‘আচ্ছা এটা কি কোন আশা-র গল্প? নাকি হতাশার?’ ‘কোন স্বপ্নের গল্প নাকি দুঃস্বপ্নের?’ ‘গল্পটি পারা’র নাকি ‘না পারা’র?’  সাধারণত লেখকের সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে,  চরিত্র-বিশ্লেষণে কিংবা ঘটনা পরম্পরায় পাঠক পরিশেষে একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছান।  আবার এমন গল্পও আছে যেখানে পাঠক এক সঙ্গে একাধিক  সিদ্ধান্তে কিংবা এর কোনটিতেই না  পৌঁছাতে পারেনপ্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়  এর ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’ তেমনই ‘এক আশ্চর্য অনুভূতি’র গল্প যেখানে লেখক শুধুই এক নিশ্চুপ শ্রোতা এবং বন্ধুতুল্যু হেডমাষ্টার অবিনাশবাবু অদ্ভুত সেই গল্পের জাদুময় এক কথক; যেখানে গল্পটি কিসের বা কি ধরণের তা নির্ধারণ করেন পাঠক -গল্পকে নিজের ভেতরে নিয়ে এবং নিজেকে গল্পে ডুবিয়ে দিয়ে



গল্পের শুরুতেই লেখক জানান তাঁকে মাঝে মাঝেই যেতে হয় স্কুল ভিজিটে। পাড়াগাঁয়ের মাইনর স্কুলের হেডমাস্টার অবিনাশ বাবুর সাথে পরিচয় সেই সুত্রে। বছর বিয়াল্লিশের একহারা চেহারার বেশ ভাবুক লোক এ অবিনাশবাবু।  কোন গোলমাল, ঝঞ্ঝাটের মাঝে থাকেন না।  খুব উচ্চাভিলাষী ও তিনি নন।  প্রধান শিক্ষক রূপেই কাটিয়ে দিয়েছেন পনেরটা বছর; আরও পনেরটা বছর এভাবেই কাটিয়ে দেবেন সেও নিশ্চিত করে বোঝা যায়ভদ্রলোককে লেখকের ভালই লাগে। স্কুল ভিজিটে গিয়ে উনার বাসাতে থাকেন।  বেশ একটু গল্প/আড্ডার সম্পর্কও আছে তাঁদের মাঝে। এই হেডমাস্টার অবিনাশবাবু গ্রামের আর দশ টা সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে যাপন করেন তাঁর গ্রামীণ জীবন;  যদিও শুধুমাত্র বস্তুগত জীবনের হিসেব নিকেশের পালায় ফেলে তাদের কাতারে নামিয়ে আনতে পারেন না নিজেকে।  তাই জ্ঞানের পরশে শোভিত ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বোধ সম্পন্ন এই  অবিনাশবাবুর কাছে  লেখক এক পরম আকাঙ্ক্ষিত  আড্ডার বন্ধু।

স্কুল ভিজিটকালীন এক শীতের সন্ধ্যায় খুব সাধারণভাবে শুরু হয় অবিনাশবাবুর  অসাধারণ একস্মৃতি-গল্প।  আর সে গল্পের নিপাট শ্রোতা বনে যান লেখক বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।  শীতের সন্ধ্যা এমনিতেও একটু অন্যরকম।  রহস্যময়তায় মোড়া, ধোঁয়াশা বিষন্নতায় ভরা এ শীত-সন্ধ্যা সমমনা বন্ধু পেলে যে কাউকেই দিয়েই  স্মৃতি-সিন্দুক ভাঙ্গিয়ে  পুরনো  কোন শীত-সন্ধ্যার  অন্যরকম এক  গল্পে আছড়ে ফেলতে পারে।  ফেলতেই পারে!  লেখক সে সন্ধ্যার  শীতের আমেজ আরেকটু উপভোগ করতে চেয়ে দুটি গরম ভাজা মুড়ি খাবার ইচ্ছে ব্যাক্ত করেন তখনই অবিনাশবাবু তাঁর বাড়িতে থেকে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া ছেলেটিকে হাঁক দিয়ে অবিলম্বেতা আনতে পাঠান।এরপরপর হালকা কিছু গল্পগুজব; তারপর সামান্য অন্যমনস্কতায় ফেলে আসা দিনে আছড়ে পড়া অবিনাশবাবু শুরু করলেন, ‘হুগলী জেলার কোন এক গ্রামে ছিল আমার মামা বাড়ি’  লেখক তাঁকে থামিয়ে বলেন, “ ‘ছিল কেন’? এখন নেই? ” ‘কেন যে নেই, তার সঙ্গে গল্পের একটা সম্বন্ধ আছে, গল্পটা শুনলেই বুঝবেন’ – এই বলে অবিনাশবাবু সেই যে হুগলী জেলার মামাবাড়িতে পাঁচ বছর বয়সী অবিনাশবাবুর সামনে পাঠককে ছেড়ে দিলেন, তো দিলেনই। খুব অদ্ভুত হলেও সত্যি লেখক বা গল্প-কথক কারো কথাই তারপর আর তেমন করে মনে থাকে না।  অবিনাশবাবুর সাথে সাথে পাঠক নিজেই সব দেখে যেতে থাকেন, অবিনাশবাবু’র বয়সানুক্রমে দেখার সামান্য ভিন্নতাও  যেন পাঠক এড়াতে পারেন না।  পাঠকেরও যেন একই ভাবে একটু একটু করে বয়স বাড়ে; আর স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতরহয় সে দেখে যাওয়া!  মামাবাড়ির দেশে পাড়াগাঁয়ের শীত-সন্ধ্যায় জঙ্গলের মাঝে আচমকা দেখা আধেক গড়া এক নির্মিতব্য কোঠা, গল্পকথক অবিনাশবাবুর শিশুমন কে যেমন একরাশ ভাবনায় আন্দোলিত করেছিল, পাঠকও সম্ভবত তাঁর চেয়ে একতিলও কম আলোড়িত হন না। সেই কবেকার ফেলে আসা বেশ সাধারণ কিন্তু চমকিত হয়ে উপস্থাপিত হওয়া কোন কোন ঘটনা সব পাঠকের মনেও যে গচ্ছিত থাকে পরম আদরে, ভেলভেটের লাল কোটরে। পাঠক কি মিলিয়ে নিতে থাকেন অবিনাশবাবুর সাথেনিজস্ব অনুভূতি গুলো?  নিতেও পারেন!   তাই শ্যাওলা পড়া, আগাছায় ভরা অসমাপ্ত ঐ বাড়ির গল্প কোথায় মোড় নেবে সে চিন্তার চেয়েও জরুরি হয়ে যায় সে মুহূর্তেটি।  কি ঘটছে, কি ভাবনা তৈরি হচ্ছে অবিনাশবাবুর  তথা পাঠকের মনে সেই প্রখর অনুভূতিটাই যেন মূল উপজীব্য পুরো গল্পজুড়ে।


একেবারেই স্বতন্ত্র একটি বৈশিষ্ট্য আছে সাহিত্যিক বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর।  তাঁর পাঠক মাত্রই তা জানেন।  প্রকৃতির বর্ণনায়, শুধুমাত্র প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর ‘এফোঁড়-ওফোঁড়’ বর্ণনায় তিনি তাঁর গল্প/উপন্যাসকে জীবন্ত করে তোলেন পাঠকের সামনে।  সত্যি, আশ্চর্যময় অনন্য এক ক্ষমতা তাঁর; আশপাশের গাছপালা-পাহাড়-নদী-জঙ্গলকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো কে-কিভাবে  দেখছে শুধু তাই দিয়েই কাহিনীতে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য/অবস্থান তিনি ফুটিয়ে তোলেন।  কিন্তু ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’ গল্পে তাঁর সেই চিরাচরিত পুংখানুপুংখ প্রাকৃতিক বিবরণটি সেভাবে দেখা যায় না। এখানে মানব-মনের জটিল মনস্তািত্বক গতি-প্রকৃতির দিকেই আলোকপাত করেছেন বেশি, অবিনাশাবাবুর বলে যাওয়া স্মৃতি-গল্পের মধ্য দিয়ে। এটিই বোধ হয় একজন ক্ল্যাসিক্যাল সাহিত্যিকের নিজস্বতার স্বাক্ষর!  অন্যরকম বর্ণনায় বুঝিয়ে দেন গল্পটি তাঁর নয়; অবিনাশবাবুর।   তিনি শুধুই শ্রোতা;  এবং পাঠক তা বিশ্বাস করেন দ্বিধাহীন চিত্তে।  মজার বিষয় হচ্ছে – গল্পের লেখনী এমন যে পাঠকের কখনো মনে হয় তিনিও এক নিরপেক্ষ শ্রোতা লেখকের মত; আবার কখনো বা মনে হয় নিজেই এ গল্পের কথক, এ গল্প নিজেরই যেন!  যে কারণে, শুরু থেকেই পাঠক ভণ্ডুলমামার জন্য যৌক্তিক এবং অযৌক্তিক সব সহানুভূতির সুবিশাল এক পুকুর খোঁড়েন বুকের ভেতর। 

যাকে কেন্দ্র করে, অনুভূতির এই উথাল-পাথাল ঝড়, এবার আসি সেই ভণ্ডুলমামার আখ্যানে ।  পাঁচবছর বয়সে শীতের এক ‘আলো-আঁধারি  সন্ধ্যা’য় অবিনাশবাবু প্রথম যেদিন অর্ধনির্মিত সে দালানটি দ্যাখেন, খুব অবাক হন – কে বা কারা বাড়ি বানাতে গিয়ে এমন থেমে গেল! চটজলদি  দিদিমা’র কাছে গিয়ে জানতে পারেন, এ বাড়ি করছেন ভণ্ডুলমামা;  এ পাড়াতেই নাকি তাঁর বেড়ে ওঠা, এখন লালমনিরহাট না কোথায় যেন চাকরি করেন।  একসাথে হাজারটা প্রশ্ন অবিনাশবাবুর মাথায়, উত্তর গুলোও পেয়ে যান তিনি;  কিছু শুনে শুনে (তখন-তখনি), আর  কিছু বুঝে নিয়ে (ধীরে ধীরে বয়সের পথ-পরিক্রমায়)।  ভণ্ডুলমামা যখনই পারেন কিছু টাকা জমিয়ে পাঠিয়ে দেন, আর তাঁর মামাবাড়ির লোকেরা মিস্ত্রি লাগিয়ে গাঁথুনি শুরু করেন।  টাকা শেষ, তো থেমে যায় বাড়ি তৈরির কাজ।  শহরে ভণ্ডুলমামার নিজের সংসার খরচও তো কম নয়।  এর মাঝেও একটু একটু করে শুরু করেছেন একটি ‘বাড়ি’, একটি ‘ঠিকানা’  নাকি একটি ‘স্বপ্ন’?  একান্ত নিজস্ব স্বপ্ন!  নিজের বাড়িঘর ছিল না, মামাবাড়িতে মানুষ।   খুব অনাদর না থাকলেও এরকম মা-বাবা ছাড়া বেড়ে ওঠা যে শেকড়হীন এক ‘ভুঁইফোঁড় উদ্ভিদ-জীবন’ কেও হার মানায় তা কে না জানে?  শৈশব থেকেই  নিজের একটা ঘর, একদম নিজের করে পাবার আকাংখা  তাই হয়তো সব সময়ই ছিল।   নিজের সেই শৈশব, ছেলেবেলার সেই জায়গা এবং মামাদের প্রতি ভালবাসা-কৃতজ্ঞতাও  নিশ্চয়ই অনেক বেশি করেই ছিল; নইলে চাকরিস্থল সেই শহরে বা কাছাকাছি তেমন কোন জায়গায় বাড়ি না করে এই গণ্ডগ্রামে কেন ফের ফিরে আসার সত্যি কিন্তু অবাস্তব এক কঠিন পথে হাঁটতে চাইলেন?  পাঠক ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যান।  নিজের কোন এক আশৈশব লালিত স্বপ্নের কথা মনে করেই কি?  সে যাইহোক,ভণ্ডুলমামা প্রায়ই সুযোগ করে গাঁয়ে এসে দেখে যান, ‘হতে হতে থেমে যাওয়া’  কিংবা  ‘থামতে থামতে গেঁথে যাওয়া’ পুরনো আবার নতুন এ বাড়িটিকে। অবিনাশবাবুর সাথে দেখাও হয়েছে ভণ্ডুলমামার; নিজ স্বপ্নে অটুট তিনি বিভোর হয়ে বাড়ির গল্পও  করেছেন অবিনাশবাবুর সাথে।  অবিনাশবাবুর সাথে পাঠকও  অধীর অপেক্ষায় থাকেন, কি হবে শেষপর্যন্ত?  পারবেন ভণ্ডুলমামা ফিরতে, তাঁর ইচ্ছে’র কাছে? পারবেন ফিরতে জীবনভর বয়ে চলা তাঁর প্রান-প্রিয় এই আশা’র কাছে?  মামাবাড়ি বেড়াতে এলেই তাই ভণ্ডুলমামার বাড়িটা একবার  দেখে যেতেন অবিনাশাবু;  অপার সম্ভাবনায় দেখতেন বেশ খানিকটা  নতুন করে গাঁথা হয়েছে কোথাও,  আবার বিষাদময় চোখে দেখতেন পুরনো ছাদটায়  ফাটল ধরেছে, শ্যাওলা ধরা মেঝেতে ভাঁট শ্যাওড়া’র গাছ গজিয়েছে।  

এইগল্পে’র ভণ্ডুলমামার মত একটি বাড়ি তৈরির স্বপ্ন  বাস্তবে অনেকেই পূরণ করেন; বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাচ্ছন্দ কে মাথায় রেখেই তা করেন।  শৈশবের ফেলে আসা বিন্দুতে  ‘ফিরে যাবার ইচ্ছে’টিকে চাপা দিয়ে গতিময়তায় মিশে গিয়েই সাধারণত এমনটা করেন।  কিন্তু চলমান জীবনবোধে উদাসীন এই ভণ্ডুলমামা পুরো চাকরি-জীবন শহরে থেকেও, শহুরে জীবনকে পাশ কাটিয়ে এঁদো-ডোবা  জংলা’র পাশে কেনা তাঁর ছোট্ট জমিটায় একটু একটু করে স্বপ্ন বুনে চলেন।  তাঁর ফেরা’র সে স্বপ্ন ছেলে-বৌ-প্রতিবেশী সবার কাছেই হাস্যাস্পদ করে তাঁকে, জটিল এবং দূরের মানুষ করে দেয় তাঁকে, তবু তিনি এগিয়ে যান।  নিজস্ব  সফলতা কিংবা ব্যর্থতার কারণেই পাঠকও অবিনাশবাবুর মতই অদ্ভুত এক ব্যাকুলতায় বারেবারে ভাবতে থাকেন,  ভণ্ডুলমামা কি ফিরে আসবেন ম্যালেরিয়া অধ্যুষিত এই ক্ষয়িষ্ণু অজ-পাড়াগাঁয়ে ?  ভাবনা গিয়ে মেশে স্বপ্নের সাথে; তাই চাকরিশেষে ছেলে-বৌ নিয়ে ভণ্ডুলমামার জমজমাট এক ফিরে আসার অপেক্ষা জ্বলজ্বল জ্বলতে থাকে অবিনাশবাবু এবং পাঠকের বুকে। গতানুগতিকতার বাইরে থাকা এই ভণ্ডুলমামা ধীরে ধীরে শুধু অবিনাশবাবুর বুকে নয়, পাঠকের বুকের ভেতরও সংরক্ষিত হয়ে যান রূপকথার এক অবিশ্যাস্য রাজপুত্রের রূপে।  দিন, মাস, বছর যায়; বড় হবার পালায় অবিনাশবাবুও কি একটু বদলে যান? তেমন করে আর যখন তখন  দিদিমার বাড়ি যাওয়া হয়ে ওঠে না।  ছেলেবেলার রূপকথার সে রাজকুমার বা রাজকুমারের সে বাড়িটার কথা সেভাবে আর চোখের পর্দায় ভাসে না!  কিন্তু তারপরও অনেকদিন বাদে হঠাৎ যখন কোলকাতাতেই দেখা হয়ে যায় ভণ্ডুলমামার সাথে পরম আবেগে আপ্লুত হয়ে বাড়ির অগ্রগতি জানতে চান অবিনাশবাবু।   ভণ্ডুলমামা নিকটজনের মতই আন্তরিকতায়  তাঁকে তাঁর শহরের বাড়িতে নেমন্তন্ন করেন। সেখানে গিয়ে অবিনাশবাবু ভণ্ডুলমামার স্বপ্নের কথা শোনেন, শোনেন স্বপ্নভঙ্গের কথাও। তৈরি হতে থাকা সে কোঠা বাড়ির ছাদ ফুটো হয়ে এখন নাকি জল পড়ে। এখনো বাড়িতে পাতকুয়ো বসানো হয়নি, পাঁচিল নেই, দরজা-জানালার জায়গাও নাকি এখনও রয়েছে হাট-খোলা।  কিন্তু তাতে কি, ভণ্ডুলমামা আপনমনে আবার বলে চলেন – সব হবে!   ছা-পোষা চাকরিজীবী মানুষ সংসার সামলিয়ে সব একবারে পারছেন না, এই যা!  স্বপ্নাবিষ্টের মত আরও বলে চলেন, ‘মানুষ বাস না করলেই বাড়িতে বট-অশ্বথের গাছ হয়, ... ... পাতকুয়োর আর কত খরচ? চৈত্র মাসের দিকে না হয় করে দেওয়া যাবে। ... ... পাঁচিল আষাঢ় মাসেই করে দেওয়া যাবে’।


এরপর আরও অনেক বছর কেটেছে।  অবিনাশবাবু  ক্রমে বি-এ পাশ করে চাকরিতেও ঢুকেছেন।  মামাবাড়ি আর যাওয়া হয়নি। যাবার উপায়ও নেই।  পরিচিত কেউ তেমন আর বাস করেন না সে গ্রামে। মামাবাড়ির কেউ ত নয়ই।  মামারা সবাই এখন শহরে।  ছোটমামার ছেলের অন্নপ্রাশনে আবার অনেকদিন পর যখন ভণ্ডুলমামার সাথে দেখা হল, চমকে উঠলেন অবিনাশবাবু।   ভেঙ্গে পড়েছে চেহারা এবং কি ভয়ানক দীনহীন হয়েছে বেশভূষা!  মামারা ব্যস্ত শহুরে কেতাদুরস্ত বন্ধুদের অভ্যর্থনায়।   অবিনাশবাবু এগিয়ে গেলেন ভণ্ডুলমামার দিকে।  তিনি এবং পাঠক জানলেন সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের উত্তর।  পাঁচ বছর হল অবসর নিয়ে তিনি ফিরেছেন।  হ্যা ফিরেছেন  তাঁর প্রাণের ঠিকানায়।  পাঠক এটুকু জেনে নিয়ে জয়ের অনুভূতি পেয়ে ভাবতে পারেন- আর কেউ পারুক বা না পারুক ভণ্ডুলমামা পেরেছেন!  আবার পাঠক এও ভাবতে পারেন, ভণ্ডুলমামা পারেননি তাঁর কল্পনার মত করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে জমাটি এক মেলা বসাতে।  পাঠকের জন্য রাশি রাশি ভাবনা, একান্তই নিজস্ব এসব চিন্তা-রাস্তায় মূল স্টিয়ারিংটি  পাঠকের হাতে;  ভাবতে ভাবতে পাঠক সেখানেই  যাবেন যেখানে তাঁর ইচ্ছে।  ভণ্ডুলমামার সন্তানাদি এখন প্রতিষ্ঠিত;  এই কোলকাতাতেই সন্তান, স্ত্রীসহ তিনি স্বাচ্ছন্দেই কাটাতে পারতেন জীবনের বাকিটা সময়।  কিন্তু স্বপ্নের কাছে কখনো  কখনো স্বাচ্ছন্দ হেরে যায়।  অনেক আগে ভণ্ডুলমামা একদিন বলেছিলেন, “ – কি করি বাবা, ওই বাড়িখানার ওপর বড় দম আমার যে। দেখ চিরকাল পরের বাসায়, পরের বাড়িতে মানুষ হয়ে ঘরের কষ্ট বড় পেয়েছিলুম – তাই ঠিক করি বাড়ি একখানা করবই।  ছেলেবেলা থেকে ওই গাঁয়েই কাটিয়েছি, ওখানটা ছাড়া আর কোথাও মন বসে না”।  পাঠকের জন্য এখানেও আছে অবাক করা কিছু ভাবনা-  পিতৃতান্ত্রিক এ সমাজ ব্যবস্থায় মামাবাড়ির গ্রাম সাধারণত কারোর এমন শেকড় হয়ে ওঠে না।  সমাজ তা হতে দেয় নাশুধুমাত্র শৈশব,  শৈশবের চারিপাশকে তীব্র আবেগে ধারণ করলেই তথাকথিত সমাজের এমন বিরুদ্ধাচরণ  হতে পারে! ছেলেবেলাকে এলোমেলো আবেগে অনেকেই জড়িয়ে ধরে, কিন্তু ভণ্ডুলমামার মত ক’জন পারে জীবনভর সে আবেগ  লালন করতে?   সেই আদিকাল থেকে হতে থাকা ‘তীব্র ইচ্ছে আর স্বপ্ন’ দিয়ে গাঁথা সে বাড়ির এ প্রান্তটি যখন গড়ে উঠেছে, ও প্রান্তটি তখন ক্ষয়ে গিয়েছে।  আর যুগ যুগ ধরে এভাবে বাড়ি বানিয়ে চাকরিশেষে ভণ্ডুলমামা সেখানে গিয়ে উঠতে পারলেও হয়েছেন সর্বস্বান্ত। গ্রামে ফিরে একটি মুদি দোকান দিয়ে সেখান থেকেও ফিরতে হয় কপর্দকশুন্য হয়ে।  বাকী দিতে দিতে সে দোকান যায় উঠে।  তারপর, এর ওর দয়া-দাক্ষিন্যে চলতে থাকা সে জীবনে আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, পারা-না পারা সবই কি হয়নি মিলেমিশে একাকার?  এর পরের ঘটনা কিন্তু অতি সংক্ষিপ্ত। দারিদ্রে, একাকীত্বে, রোগে-শোকে এবং বড্ড হেলাফেলায় এ বাড়িতেই ঘটে ‘এক অন্যরকম স্বপ্নমানব ভণ্ডুলমামা’র জীবনাবসান।

গল্পের শেষ পর্যায়ে, ভণ্ডুলমামার এ মৃত্যু পাঠককে ভীষণ নাড়িয়ে দেয়, কষ্টের শিরা-উপশিরাগুলোও সব চিনিয়ে দেয়!  যদিও এমন মৃত্যু তেমন অস্বাভাবিক ছিল না।  গল্পের প্রতিটি ঘটনাই অতি সহজে এবং সাবলীলতায় এসেছে; তবু কেন যেন পাঠক-মনকে এলোমেলো করে দিতে হৃদয়ের অলি-গলি-তস্য গলি সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে গিয়েছে!  কেন? ভণ্ডুলমামার আশা-আকাংখা-লক্ষ্যে পৌঁছাবার  দৃঢ়তা সবই কেন পাঠকের নিজের হয়ে গেল?  ভয়ঙ্কর গতিতে চলতে থাকা এ জীবনে পেছনে ফেলে আসা কোন বিন্দুতে ফেরার অবকাশ  আমাদের থাকে না কিন্তু ইচ্ছেটা ভেতরে ভেতরে হয়তো  ঠিকই থেকে যায়।  অবদমিত সে ইচ্ছে’র কথা স্মরণ করেই কি তাহলে পাঠক ভণ্ডুলমামাকে মিলিয়ে ফেলেন নিজের ভিন্ন কোন স্বত্তা’র সাথে?  পাঠকের আত্মা হয়েই যেনঅবিনাশবাবু বলে চলেন, “এরপর আমি আর কখনও মামার বাড়ির গ্রামে যাইনি, হয়তো আর কোনদিন যাবও না, বাড়িটাও আর দেখিনি, কিন্তু জ্ঞান হয়ে পর্যন্ত যে বাড়িটা গাঁথা হতে দেখেছি সেটা আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত স্থান অধিকার করে আছে। ...... আমার জীবনের সাথে ভণ্ডুলমামার এমন যোগ কি করে ঘটল সেটা আজ ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই – আমার গল্পের আসল কথাই তাই অমন একটা সাধারণ জিনিস কেন আমার মন জুড়ে বসে রইল, অথচ কত বড় বড় ঘটনা তো বেমালুম মন থেকে মুছেই গিয়েছে”!


হেডমাস্টার অবিনাশবাবু থামার পরও, আপাদমস্তক সাহিত্যমনস্ক সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় কোন সাহিত্য করলেন না;  এমন কি প্রকাশ করলেন না গল্প সম্পর্কিত নিজস্ব কোন ভাবনা।  শুধু একটি বাক্যে শেষ করলেন, “অবিনাশাবুর ছাত্রটা মুড়ি নিয়ে এল”।  আর পাঠক দেখলেন, গল্পের ভেতরের গল্পটা শেষ হয়ে গেল!  বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর ‘ভণ্ডুলমামার বাড়ি’ গল্পটি আসলেই সহজ-সরল  কিন্তু ভিন্নমাত্রার এক অতি অদ্ভুত গল্প যেখানে পাঠকের জন্য লেখকের সরাসরি কোন বক্তব্য নেই, নেই কোন দিক নির্দেশনা;  যেকোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন পাঠক।  এমন কি কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছালেও চলে পাঠকের।  আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, স্বপ্ন-কল্পনা  সবকিছু মিলিয়ে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন জটিল অনুভূতির সহজ প্রকাশ ঘটিয়ে লেখক অবিনাশবাবুর ভণ্ডুলমামাকে পাঠকের নিজের করে দিয়েছেন।  আর তাই মুগ্ধ, অভিভূত পাঠক পাঠ শেষে ভাবতেই পারেন, ‘গল্পটি আমার! ফিরে যাওয়ার এই স্বপ্নটি আমার; ভণ্ডুলমামার একার নয়’!  অনুভূতির অনবদ্য প্রকাশভঙ্গি তে যে কোনগল্পে লেখকের সৃষ্ট চরিত্র বোঝা এবং চেনা যায়, চরিত্রটিকে ভালবাসা বা ঘৃণাও করা যায়।  আর  বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর মত গুণী শিল্পীর হাতযশে পাঠক শুধু চরিত্রটিকে নয়;  চরিত্রের সাথে সাথে ‘অদ্ভুত অচেনা এক নিজেকে’ও  চিনে নেন!  


নিচের লিঙ্কে ক্লিক করে পড়ুন
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প : ভণ্ডুলমামার বাড়ি

লেখক পরিচিতি
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা 


জন্মস্থান: যশোর, বাংলাদেশ 
হোম ডিস্ট্রিক্ট: সাতক্ষীরা, বাংলাদেশ 
বর্তমান আবাসস্থল: মেলবোর্ণ, অস্ট্রেলিয়া 
পেশা: অধ্যয়নরত| ব্যাচেলর অফ এন্ভায়রন্মেন্টস (মেজর- আরবান ডিজাইনিং এন্ড প্ল্যানিং), 
ইউনিভার্সিটি অফ মেলবোর্ণ|
খন্ডকালীন কাজ: রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট, আর.এম.এই.টি. ইউনিভার্সিটি|

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. আবারও একটি সুন্দর বিশ্লেষণ পড়ে মুগ্ধ হলাম / অদেখা সেই 'ভন্ডুল মামার বাড়ি'কে দেখার একটি আকুলতা তৈরি করে দেয় বৈকি এই আলোচনায়/ ধন্যবাদ 'জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা' কে /

    উত্তরমুছুন
  2. খুবই ভালো লাগলো আলোচনাটা পড়ে। গল্পের এত ভিতর কি করে চলে যাওয়া যায়, তা মাঝেমাঝে জেন ভেবে পাই না। আবেগ এ যেন ভরে আছে প্রতিটা অক্ষর। মূল গল্প টা পড়ে একবার এই অনুভূতিটাকেও মিলিয়ে নিতে ইচ্ছে হয়। আনেক ধন্যবাদ সুন্দর এই লেখাটার জন্য।

    উত্তরমুছুন
  3. সমলোচনা এত শক্তিশালী যে পঠিত গল্প আবার পড়লাম, জানিনা আপনি নিজে লেখেন কিনা ? না লিখলে
    মনে হয় শুরু করা উচিত, ধন্যবাদ - শুভেচ্ছা জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা

    উত্তরমুছুন
  4. প্রতিভাময়। আরো আরো লেখো। ডুবে থাকো সাহিত্যে চিরকাল। শুভেচ্ছা। -মৌসুমী কাদের

    উত্তরমুছুন