বিকাশ গণ চৌধুরী'র গল্প : তরী বেয়ে যাই

সকালটা যেভাবে শুরু হয় সেভাবেই শুরু হয়েছিল দিনটা, অরিত্রর, তবে অন্যদিনের থেকে একটু দেরী করে, বেশ একটু দেরী; ছুটির দিনে ঘুম যখন ভাঙল ঘরময় তখন সাদা বাতাস, দোতালার ঘরের জানালার পাশের জামগাছটার সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে অনেক রোদ, চিক্‌চিকে, উজ্জ্বল, চোখে লাগছিল রোদটা। তারপর বিছানা ছেড়ে উঠে, ক্রিয়া-কর্ম সেরে যখন চটিতে পা গলিয়েছে, ঘড়িতে তখন দশটা; সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তার মনে হলো শেষহীন একটার পর একটা যাত্রাপথ – বাড়ি থেকে কৃষ্ণেন্দুর মেস, সকালের খাওয়া, রঞ্জনদার বাড়ি, চা, অর্কদের বাড়ি, অর্কর বৌয়ের সঙ্গে উচ্চগ্রামে রসিকতা, অর্কর ছেলেটাকে নিয়ে একটু নাকু-নাকু খেলা, ক্লিক ক্লিক, চা, ক্লিক ক্লিক, রিল শেষ, বাড়ি ফেরা, স্নান, খাওয়া, দুপুরে এলোমেলো পড়তে পড়তে কারও কথা হয়তো মনে পড়বে, কারও মুখ, তার সঙ্গলিপ্সা নিয়ে ঘুমতে যাবে – ঘরের ভিতর তখন চড়ুই, বাইরে অনেক রোদ আর টালমাটাল বইয়ের পাশে ভাতঘুম।


প্রায়শই যা হয় – কল্পনার বা পরিকল্পনার ছবিগুলোর রাস্তা ধরে পথ হাঁটতে পারে না অরিত্র। আর তাই কৃষ্ণেন্দুর মেসে পৌঁছে সকালের খাওয়াটা খাওয়ার পর আর কোথাও যায়নি অরিত্র, যেতে পারেনি। কৃষ্ণেন্দু, পার্থ আর ও – এই তিনজনেই তো ধূম আড্ডা সেই বিকেল পর্যন্ত, যখন আকাশ ছুঁই-ছুঁই করছে শেষবেলাকার আলো আর ফিরে আসছে সন্ধের হালকা বাতাস।

কী নিয়ে শুরু হয়েছিল, অরিত্রর তা আর মনে নেই, কারণ গোটা আড্ডা জুড়ে এতোগুলো শুরু ছিল যে আড্ডাটাকে বলা যেতে পারে – নানান শুরুর এক প্রবাহমালা, যার কোন শেষ নেই, কারণ সময়প্রবাহের মধ্যবর্তী কোন এক সময় থেকেই তো আমাদের সময়ের গণনা শুরু – যার কোন আদি নেই, অন্ত নেই, আছে শুধু এগিয়ে চলা; হিল্লোলবিমনস্কতায়; আমাদের সময়ের যা হিসেব তাতো কখনই সঠিক হিসেব নয়, সময়ের নিহিত অর্থে, তার ভাবে, ব্যঞ্জনায়, কোন এক হিসেবে, প্রচলিত হিসেবে হয়তো, অনড়, বদ্ধ, কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে – মুক্ত, সেখানে কোন বাধা নেই, উচ্ছল ঊর্মিমালার মতো তা গড়িয়ে চলে প্রকৃতি-নিয়মে। ছোটবেলার কানফুসফুসি খেলার কথা মনে পড়ে অরিত্রর। এসব আড্ডার কথাগুলো, কানে কানে ঘোরা কথার মতো বদলাতে বদলাতে কোথায় যে যায়! অরিত্রর মনে পড়ে একবার কানফুসফুসি খেলার শুরুর শব্দ ‘গোলাপ ফুল’ খেলা শেষে হয়েছিল ‘ইঁদুরের দুধ’। গোলাপ ফুল ছিল না, ছিল না ইঁদুরের দুধও, রাজনীতি ছিল – যেমনটা থাকে বাঙালির আড্ডায়, ফুটবল, ক্রিকেট, স্টেফি গ্রাফ, মিরোস্লাভ মিসির থেকে টাইসন, কুংফু-কারাটে, জ্যাকি চ্যান্‌, ব্রুসলি ঘুরে সিনেমা, নুভো রোমা, সমাজ-দর্শন, অর্থনীতি ... এমনটাই চলতে চলতে দুপুরের খাওয়া শেষে যখন একটু ঘুম-ঘুম, তখনই এক উৎসাহ-অভ্যাসে আবার ভেসে যাওয়া, বেখেয়ালে অনেক দূর।

বক্‌বক্‌ অরিত্র অনেকই করে, এটা-ওটা-সেটা নিয়ে অনেকইক্ষণ, তবু বহুদিনের সযত্ন প্রয়াসে অনেক গোপনে, নিজস্ব সংগোপনতায় লুকিয়ে রাখে সুড়িঙ্গলালিত সব স্বপ্নদের, নিবিড় এক আকাঙ্ক্ষায়। তবু দিনশেষে, ঘর যখন বিকেলের রাঙা রোদে মাখামাখি, দুপুরের অনেকক্ষণ একটানা বকে যাবার পর, কোন মমতায় কিংবা কে জানে, কোন চিত্তবিচ্ছেদে, অরিত্র একের পর এক খুলে দিয়েছিল দরজা, একেকটা ঘরের ভিতর অন্য একটা ঘর, তার ভিতর আরও আরও অনেক; অরিত্রর স্বপ্নরা জন্ম দিচ্ছিল নৃত্যরত নক্ষত্রদের, যার বিভায় প্রজ্জ্বল হচ্ছিল তার মুখ। ছবির গল্প করে যাচ্ছিল অরিত্র, একের পর এক ছবি, ছড়িয়ে পরছিল তাদের হিরণ্যদ্যুতি। গল্পের বৃত্তে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই বেজে ওঠে পাগলাঘন্টি, সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে যায় সব দরজা, ঝপাঝপ সব। অরিত্র উঠে দাঁড়ায়; সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেঙ্গে আবার রাস্তায়। বাড়ির সামনেটা বড় বেশি নির্জন – সামনে মাঠ, দূরে কারখানার আলো, আরো দূরে শহরের প্রায় স্থির দীপমালা স্পন্দমান। ঠান্ডা বাতাসের আমেজভরা নির্জনতা স্মৃতিবিহারী করে তোলে মানুষকে – অরিত্রর মনে পড়ে মা’র উৎকন্ঠিত মুখ, মা বলে চলেছে – শান্তশিষ্ট হয়ে থাকবি, কন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বি না, বাইরে একা থাকিস, সবসময় অতো প্রতিবাদ-ট্রতিবাদ না করলেও চলবে। বাড়ির চিঠি এসেছে গতকাল, ছোট্ট চিঠি, চিঠির শেষে সেই পরিচিত কথা – ভালোমতো খাওয়া-দাওয়া করিও, শরীরের প্রতি নজর দিও, স্নেহাশিষ নিও। ইতি আশীর্বাদক বাবা। অরিত্রর মনে পড়ে ধীর লয়ে বলে যাওয়া বাবার সেই কথা – না, না, সবসময় চুপচাপ থাকবে না, প্রতিবাদ করবে, লড়বে, তবে পরিস্থতিটা ভালো করে বুঝে নিও। অরিত্র আবছা আবছা জানে একবার ভুল হলে শুদ্ধ হতে কতদিন লাগে! ঠিক এই এখন, কলকাতায়, বন্ধুরা যখন সব তুমুল আড্ডায়, তখন রাস্তার মোড়ের পিপুল গাছটার ঝাকড়া মাথার দিকে তাকায় অরিত্র – সোডিয়াম ভেপারের বাতির আলোয় পিপুলপাতার রং কেমন ম্রিয়মাণ, যেন ক্লোরোফিলের অল্পতায় ভুগছে। সবুজ যেন কোথাও দূরে, অতিদূর। উত্তাপিত নির্জন অন্তরে রাত্রির নিরবচ্ছিন্ন স্পর্শ। আজ অনেকদিন তার অদিতির একখানা চিঠিও আসেনি।


লেখক পরিচিতি

বিকাশ গণ চৌধুরী

আদি নিবাস কুমিল্লা জেলার বুড়িচং গ্রাম হলেও, পাহাড় ঘেরা একটা ছোট্ট শহর দেরাদুনে ১৯৬১ সালে জন্ম, ছোটবেলার অনেকটা সেখানে কাটিয়ে বড় হওয়া কলকাতায়, চাকরিসূত্রে অনেকটা সময় কেটেছে এলাহাবাদ আর মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। বর্তমানে কলকাতার বাসিন্দা... লেখেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ; ফরাসি, হিস্পানি, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন মন্‌পসন্দ নানান লেখা, সম্প্রতি শেষ করেছেন পাবলো নেরুদার শেষ কবিতার বই ‘El libro de las preguntas’ –এর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ‘প্রশ্ন-পুঁথি’। দীর্ঘদিন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছেন সবুজপত্র ‘বিষয়মুখ’।


------







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ