ও......।
৪০০১ টাকা পুরস্কার।
বাংলার মধ্যে যে-কোনো স্থানে বেহালা বাজনায়, স্বরগ্রামসহ গান ও লহরী যথা : ১। বেহাগ, ২। কারপা, ৩। আসাবরি, ৪। দরবারি, কালেংড়া, ৫। কারপা, ৬। পূরবি, ৭। জয়ন্তি, ৮। ভান কীর্তন, ৯। ভৈরবী ও ১০। ভৈরব।
১নং দাঁড়ায়ে বাজান
২নং বসে বাজান
৩নং শুয়ে বাজান
৪ নং চক্ষু ২টি বেঁধে বাজান
৫ নং লহরি ১০ মিনিট
৬নং
Vill & P.O Dadarat
Dt. 24 Pargs. W.B 2/4/67
যিনি এই কয়েকটি রাগিনী তানে ও মানে সমভাবে বাজাতে পারবেন তাহাকে ৪০০১ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। পরাজিত হলে আমাকে উক্ত টাকা দিতে হবে।
ঠিকানা-
শ্রী বিপিনবিহারী বিশ্বাস (রায়বাহাদুর)
M.A Honours in English
Calcutta University.
৪০০১ টাকা পুরস্কার।
বাংলার মধ্যে যে-কোনো স্থানে বেহালা বাজনায়, স্বরগ্রামসহ গান ও লহরী যথা : ১। বেহাগ, ২। কারপা, ৩। আসাবরি, ৪। দরবারি, কালেংড়া, ৫। কারপা, ৬। পূরবি, ৭। জয়ন্তি, ৮। ভান কীর্তন, ৯। ভৈরবী ও ১০। ভৈরব।
১নং দাঁড়ায়ে বাজান
২নং বসে বাজান
৩নং শুয়ে বাজান
৪ নং চক্ষু ২টি বেঁধে বাজান
৫ নং লহরি ১০ মিনিট
৬নং
Vill & P.O Dadarat
Dt. 24 Pargs. W.B 2/4/67
যিনি এই কয়েকটি রাগিনী তানে ও মানে সমভাবে বাজাতে পারবেন তাহাকে ৪০০১ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। পরাজিত হলে আমাকে উক্ত টাকা দিতে হবে।
ঠিকানা-
শ্রী বিপিনবিহারী বিশ্বাস (রায়বাহাদুর)
M.A Honours in English
Calcutta University.
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
ওই তারিখে বারুইপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছি। লক্ষীকান্তপুরের ট্রেন ধরব। খয়েরি পাঞ্জাবি গায়ে এক বুড়ো ঘরে ঢুকল। বগলে বেহালার বাক্স। গায়ে তাল্লিমারা পাম্প সু, পরণে খেটে ধুতি। গালে পাকা দাড়ি, সাদা ভ্রু। লোকটা বসেই বেহালার ছড় ঘষতে লাগল।
ফাঁকা দুপুরে বাইরের খোলা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে দু’জন চাষী অনাসৃষ্টি খরার কথাবার্তা বলছিল। বাজনা শুনে তারাও এগিয়ে এল। খুব সম্ভব কনসার্ট পার্টির কোনও খুব পরিচিত গৎ। শুনতে ভালোই লাগছিল।
বাজিয়ে, বাক্স বন্ধ করে লোকটি আমার কাছে একটি টাকা চাইল। দিলাম। তখন খুশি হয়ে পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে আমার হাতে দিল। খুলে দেখলাম তাতে ওসব লেখা রয়েছে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
কাগজখানার উল্টো দিকে লেখা রয়েছে- To the Hon’ble First Munseef of Baruipur. Sir, I wish to interview 2 minutes only. Kindly allow me, your valuable time west me. Excuse me for your trouble.
Your most obedient Servant truly, polite, believe sympathy, SreeBepin Behary Biswwas (Rai Bahadur), M.A Honours in English, Calcutta University, Vill & P.O Dadarat
Dt. 24 Pargs, West bangal.
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
পড়ে এই ক’টি জিনিস মনে হল-
লোকটি ইংরেজিতে অনার্সকে খুব সমীহ করে মনে মনে। উপরন্ত রায়বাহাদুর হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। তাছাড়া, সে চ্যালেঞ্জ ভালোবাসে। এদিককার এমন কোনও পাড়ায় থাকে--যেথানকার নাম বিপিনবাবুটির পূর্বপুরুষদের পরিচয়ে হয়ত পরিচিত। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি তার স্বপ্নে একছত্র।
কিন্তু লোকটি এখন নিশ্চয় রিটায়ার্ড ও সংসারে বাতিল।
লোকটিকে পরের রবিবার আমার বাড়িতে অন্নগ্রহণ করতে বললাম। আরো বললাম, আপনার বাজনার হাতটি খুব ভালো।
খুব খুশি।
আমি একটা খালের পাড়ে থাকি। উপস্থিত অনেকে কম সময়ে বেশি ধানের লোভে খালধারে আই-আর-এইট ধান চাষ করেছে। তাই খাল শুখো। দুপুরের রোদে রবিবার পুড়ে যাচ্ছিল। সেই খালধার ধরে বিপিনবাবু এলেন। সঙ্গে বেহালার বাক্স।
আমি প্রায়ই এরকম লোক ধরে ধরে আনি বলে আমার স্ত্রী বিপিনবাবুকে খেতে দিতে রাজি হচ্ছিল না প্রথমে। কিন্তু খেতে বসবার পর দেখলাম, বেশ এটা ওটা এগিয়ে দিল। খেয়ে উঠে বিপিন বিশ্বাস লম্বা একটা ঘুম দিল বসবার ঘরে। বিকেলে উঠে চায়ের কথা মনে করিয়ে দিল। তারপর বাক্স খুলে ছড় হাতে নিয়ে বেহালাটা জুত করে কাঁধে বসাল।
জানতাম না। সেদিন পূর্নিমা ছিল।
আর কিছু হাওয়া ছিল। খুব জোর। আমাদের বাড়িতে সন্ধে হতে না হতেই হ্যারিকেন ধরানো হয়। চাঁদও উঠল। কালো বাছুরটা পুকুরঘাটে দাঁড়ানো ওর মাকে খুব ঢুসোচ্ছে।
কাঁধে বেহালা সেট হয়ে গেছে। ছড় ঠেলে ঠেলে অনেক সুর ভেঙ্গে ওপরে উঠছে আবার নিচে নেমে পড়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য খাদে দাড়াচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা ফেলে এদিকেই কান খাড়া করে আছে।
এসব আমাদের বারান্দায় হচ্ছিল। বেহালার ঘ্যাঁ-ঘ্যোঁ কারও বুক তুবড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। বিপিনবাবুর মুখে ভাঙা পাটালির ধারা একচিলতে জোৎস্না পড়ে সাদা দাড়িতে ভ্রুতে ঝকঝ্ক করছে। কাটা বোঝাই বাবলা গাছগুলো এখন কেমন নির্দোষ বৃক্ষ হয়ে দাঁড়ানো। খালধারের শেকুলকাঁটার ঝোপে হলদে ফুলগুলো জোস্নায় হারিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ছড় থামিয়ে বিপিনবাবু বলল, ‘এই রাগিনী মাঘী পূর্নিমায় সারারাত দিঘির পাড়ে বসে বাজাতে পারলে পরী নামানো যায়। একবার মিত্তিরদের কাছারিবাড়ির পুকুরে নামিয়েছিলাম। ওরা একখানা কম্বল দেয় শেষে।‘
আমার ছেলেপিলের মা এতক্ষণ অবিশ্বাস করতে করতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল বাজনা শুনে। পরীর কথায় ঠোঁটে ওলটালো। নাও নাও এখন বিদেয় কর-এই ভাব নিয়ে উঠে গেল।
আমি বললাম, ‘কম্বল কেন?’
‘মাঘী পূর্নিমার রাত। ঠাণ্ডা হবে না?’ ‘আমার অবিশ্যি তখন জোয়ান বয়স। শীতবোধ বিশেষ ছিল না। তবে কিনা-একে মেয়েছেলে, তায় পরী। শীত তো লাগবেই। ওঁদের তো বিশেষ জামাকাপড় পরতে নেই।‘
আমার জন্য তালশাঁস, ডাবের জল ঢাকা দেওয়া ছিল। ঘরের থেকে এনে নিজেই বিপিনবাবুকে দিলাম। ব্রেনওয়ার্ক হচ্ছে ওর।
‘উত্তর আকাশ থেকে নেমেছিল। রাত দু’টো নাগাদ। ঘাটলায় এসে পাখা গুটিয়ে বসে আমার বাজনা শুনছিল একমনে। সাক্ষাৎ দেবী প্রতিমা। মিত্তিরদের জেঠিমা যেমন হাসিখুশি তেমনি সাহসী ছিলেন। শরীরে দয়ামায়াও ছিল। তিনিই ঋষিকেশ থেকে আনানো পাহাড়ি ভেড়ার লোমের কম্বলটা শেষরাতে দোতলা থেকে ঘাটলায় ছুড়ে দিলেন।’
‘পরী উড়ে গেল না?’
‘বড় ভালো ছিল মেয়েটি। শীত লেগেছিল। দৈববানীর মতো আকাশ থেকে কম্বল পেয়েই গায়ে জড়িয়ে ফেলল। তারপর আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। আমার ভেতরটা সেই ক’সেকেন্ডের জন্য--কি বলব গাঙ্গুলীমশাই, ধক করে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় বলল--আরেকখানা বাজাও।‘
‘বাংলায়’।
বিপিনবাবু একটু থমকে গেল, তারপর বেহালাটা কাঁধে তুলে নিল, খানিকক্ষণ ছড় ঘষাঘষি করে একটা খুব ভারি রাগের মধ্যে ছড়সুদ্ধ হাত মাথা ডুবিয়ে দিল, ‘এই রাগটা বাজিয়েছিলাম’।
ছড়ের এক-এক টানে হাওয়াসুদ্ধ জল উঠে আসছিল এক-একবার। আবার ভাঁটাও হচ্ছিল। খালপাড়ের ওধারে দূর দিয়ে কলকাতার গাড়ি গেল আলো জ্বালিয়ে--লোকজন নিয়ে--আবার কয়েক গাড়ি লোক ফিরেও এল।
ছেলে-মেয়েরা খেতে বসেছে। ওদের মা ভাত মেখে দিচ্ছে। হ্যারিকেনটা হাওয়ার জ্বালায় দেওয়ালের পাশে সরিয়ে দিল।
এক সময় বললাম, ‘পরী নেমে আসবে না তো’?
বাজনা না থামিয়েই বিপিনবাবু বললেন, ‘নামতেও পারে’।
আমার অবিশ্বাস এতই বেশি--প্রায় হো হো করে হেসে উঠছিলাম। পরী নামার অবস্থাই বটে। মডিফায়েড রেশনে আমাদের এই স্টেশনপাড়ায় চাল গম কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ক’ সপ্তাহ। ডিলার গরুর গাড়িতে মাল পাঠিয়েছিল। বাদার মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা ধরে তিন গাড়ি গম আসছিল। লুট হয়ে গেছে।
বিয়ের বরযাত্রী থেকে স্টেশনমাস্টার, পোস্টমাস্টার, হেড মাস্টার-সবাই চাল নিয়ে আলোচনা করে। স্মাগলারদের দাপটে ট্রেন রোজ লেট হচ্ছে। রাত হলে অন্ধকারে বসে বসে কত পরিবারের কর্তা হাওয়া খায়--বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আলাপ রীতিমত জমে উঠেছে। এমন সময় বড় ছেলেটা এটো হাতে উঠে এসে আমার সামনেই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। ইশারায় থামতে বলে এগিয়ে গেলাম।
ব্যাপার সামান্য। ও এবেলা-ওবেলা দু’টো বেশি করে পষ্টি ভাত খেয়ে থাকে। আরো খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ওর মা তুলে দিয়েছে মাঝখান থেকে। বলেছে, সবাই খাবে তো।
বিপিনবাবুর বেহালায় আলাপ জমে উঠেছিল।
চাষ উঠলে বছরকার ধান কেনা থাকে ফি’বার। এবারই হয়নি। ট্রেনে, বাজারে যত পুলিশ বাড়ছে, ফ্রন্ট সরকারের ফতোয়া যত লম্বা হচ্ছে--চালের দামও তত চড়ছে। ফি রাতে ডাকাতি হয়। থানা এখান থেকে পাঁচ মাইল। থবর দিয়েও কোনও লাভ হয় না।
বিপিনবাবু পরী নামানোর জন্য বেহালাটা খুব জোরে কাঁধে চেপে ধরেছে। আমাদের বাগানের বেলফুল গন্ধ ছড়াচ্ছিল বাতাসে। চাঁদ সারা পাড়া জুড়ে টর্চ ফেলেছে। এ বাড়ি সে-বাড়ির রেডিওগুলো জুড়িয়ে এল। শুধু স্টেশনের ধারে একটা দোকান--সারা বছরই ওদের হালখাতা থাকে। মাইক বাজিয়ে দানাদার খাওয়ায়। বেয়াড়া খদ্দেরদের বাকি টাকা তোলে। সেদিক থেকেই ভেসে আসছিল-‘আলেয়া! আলেয়া!! জীবনে নারী পেয়েছি অনেক’--।
পরী নামাতে না পেরে পরাজিত হলে বিপিন কি আমাকে ৪০০১ টাকা পুরস্কার দেবে? ছেলেটা বাইরের খাটে শুয়ে বাজনা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হয়তো খানিক বাদে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পরী নেমে এসে আমাদের ওই বাগানে বেলফুলের সারির মাঝে পাখনা গুটিয়ে দাঁড়াবে। তারপর বলবে-
Hon’ble Mr. Biswas Sir, I wish to interview 2 minutes only. Kindly allow me, your valuable time west me.
প্রথম আলাপের সেই চিরকুটখানা আমার টেবিলের ড্রয়ার খুললেই রোজ চোখে পড়ে।
কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না।
বিপিনবাবু বাজাতে বাজাতে শুয়ে পড়েছেন প্রায়। নারকেল পাতাগুলো জোৎস্না ছিঁড়ে ছিঁড়ে দুলছে। পৃথিবীতে এখন কোনও অশান্তি নেই। অথচ জানি এই আধা-শহর আধা-গায়ের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে নানা অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায্য-অন্যায্য দাবি লেখা পোস্টার মেরেছে ছেলেরা। সব বদলে যাচ্ছে। মাটি, গাছপালা, খাল, আকাশ--এরাই শুধু পাল্টায়নি! এর মাঝখানে আমরা পরী নামচ্ছিলাম। আমার বয়স চল্লিশ। বিপিনবাবুর তো সত্তর হবে। লোকটা চিট হতে পারে-- ক্র্যাক হতে পারে। জেনুইন কিনা কে জানে!
খড়ি-ওড়া শুকনো চামড়ার বিপিনবাবু দিবানিদ্রার পর খুব জম্পেশ করে বাজাচ্ছিল। এসব বাজনা কতকাল শুনিনি। তাল, লয়, রাগ-কিছুই জানি না। তবু বেশ লাগছিল। শুধু আমাকে শোনাতেই একজন বাজনাদার প্রাণপাত করে যাচ্ছে-অথচ আমি সভাসদ, পাত্রমিত্র, পাইক-বরকন্দাজ সাজিয়ে রাজা হয়ে বসে নেই। সামান্য শ্যামল গাঙ্গুলী।
বড় ছেলেটা বাইরের রোয়কেই ঘুমিয়ে গেল। নয় পেরিয়ে দশে পড়েছে। ভাতটা খেতে বড় ভালোবাসে। সবচেয়ে সস্তার জিনিস এমন আক্রা হয়ে যাবে একদিন কে জানত!
ছেলেমেয়েদের মা এখন সারাদিন পরে ফ্রি হয়েছে। মেয়েটাও এতক্ষণে ঘুমে হাল্লাট হয়ে গেল। অন্ধকার বারান্দায় আমি আর বিপিন বিশ্বাস। ভেতরের ঘরে আলোর সামনে গিন্নি দাঁড়ানো। তাই ওর মুখ-চোখ দেখা যাচ্ছে না। ঘোমটার শাড়ির চারধারে আলোর আউটলাইন।একবার মনে হল আমায় ডাকছে। উঠতে যাব। বিপিনবাবু ছড় ঘষতে ঘষতে আমাকে খুঁচিয়ে দিল। ওঁর দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে বিপিন বিশ্বাস চোখ দিয়ে ইশারায় আকাশে তাকাতে বলল। এনি মোমেন্টে পরী নেমে পড়তে পারে। সেই সময় কি আসন্ন? নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল আমার।
আলোর আউটলাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বউ যেন কি বলতে চাইল একবার। হাত নেড়েও যে থামিয়ে দেব সে সময় এখন নয়। এখন পরী নামে।
খট করে বিপিনের বাজনা থেমে গেল। আমি আর আকাশে তাকাতে পারছি না। যদি নামেই--আমি নির্ঘাত সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাব। বিপিন বাগানের দিকে নেমে যেতে যেতে বলল, ‘জল সেরে আসছি। কখন থেকে একঠায় বসে বাজাচ্ছি’। তাই বল! এমনভাবে আচমকা বাগানে নেমে গেল--যেন পরী নেমেছে। হাত ধরে বারান্দায় তুলে আনবে এক্ষুণি।
ছেলে-মেয়েদের মা ঝড়ের বেগে ঢুকেই ঘুমন্ত ছেলেটাকে এক হ্যাঁচকায় কোলে তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে, ‘কোনও কাণ্ডজ্ঞান যদি থাকে। ক’পালি চাল আছে ঘরে শুনি? রোজ রোজ লোক ধরে আনা চাই’-
ছেলে কোলে শোয়াতে চলে গেল। যাবার সময় ওর পায়ের ধাক্কায় বেহালার বাক্সটা হাঁটকে খুলে গেল।
বিপিন বিশ্বাস ফিরে আসার আগে জায়গার জিনিস জায়গায় রাখা দরকার। বন্ধ করতে পারি না। কিসে আটকে গেছে। আলোতে নিয়ে দেখি, বাক্সটা নানান জিনিসে বোঝাই। তিনখানা নিমের দাঁতন! তেলচিটে গামছাও আছে একখানা। একেবোরে বিপিনের সংসার। রংচটা নীল লুঙিটাও কাগজে মুড়ে গুঁজে রেখেছে। তাড়াতাড়ি জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে দিলাম।
বারান্দায় উঠেই এক সেকেন্ডে বিপিন বাজনার ছেড়ে আসা জায়গায় ফিরে গেল, ‘ঠিক এমনি চাদের আলো ছিলো সে রাতে’--
আর কথা নয়। আমার পরিচিত বউ এখনো প্রায় তরুণী। অল্পদিন হলো ভ্রু কুঁচকে কথা বলার সময় ওর নাকের পাশ দিয়ে দু-ধারে ভাঁজ পড়ে। যা দিনকাল। এসব দেখার সময় পাই--দেখে ভাবারও সময় পাই--কেননা ব্যাঙ্কে আমার পাকা চাকরি। এখনো অনেক কাল বেঁচে থাকলেই মাইনে পাব। শুধু অফিসে গিয়ে খানিকক্ষণ কলম নাড়তে হবে রোজ। খুব খারাপ লাগে। কোনো মহৎ কাজ করি না। লোক টাকা রাখে, তোলে, ধার নেয়, ফেরত দেয়--সুদ কষে সেসব তুলে রাখি লেজারে। এজন্যে আজকাল পরীক্ষা করে বাজিয়ে টাটকা ছেলে ভর্তি করা হয়।
খুব জমাটি বাজনায় বিপিন নিজেই চোখ বুজে ফেলেছে। কাছাকাছি কোনও বাড়িতে সুন্দর করে মুসুরির ডাল রান্না হচ্ছে। সেই গন্ধে আমার বাজনা শোনার গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। জীবনের অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে গেল। আর বড় জোর বিশ-পচিশ বছর বাঁচব।
বাগানের শুকনো পাতা মাড়িয়ে কে আসছিল। এই বারান্দার দিকেই। বিপিন এখন নিজের বাজনায় মতোয়ারা হয়ে আছে।
আমার বউ। খুব সাবধানে এগিয়ে আসছে। কলমের পেয়ারার ডাল ধরে দাঁড়িয়ে গেল। সেই জায়গাতেই কিছু চাঁদের আলো ডাল-পাতার আড়াল খুড়ে ভেতরে নেমে পড়তে পেরেছে।
চোখাচোখি হল। সেখানেই দাঁড়িয়েই ও হাতের ইশারায় বলতে চাইল, আর কেন? এবার বিপিন বিশ্বাসকে উঠতে বল।
হাত নেড়ে বিপিনকে তুলে দেওয়ার কথা বলল তিনবার। আড়াইসের চাল ন’টাকা চোদ্দ আনা। কোলকাতায় আরো বেশি। দশ বছর আগে বসানো শিরিশ চারা ধা ধা করে বেড়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় নানা লোকের সেন্টার। সেখান থেকে হরেকরকম কথাবার্তা ভেসে আসছে। আলাদা করে বোঝা যায় না।
আমিও সিগন্যাল দিলাম। খুব সাবধানে। বিপিন চোখ খুললেই ডেনজার। শেষে হাতজোড় করে অন্ধকারে নিজের মুখখানা যতটা কাচুমাচু করা যায়--তাই করে, যতটা মাথা নেড়ে বোঝানো যায়-- তাতে বললাম, এবার তুমি দয়া করে গোয়ালের দিক থেকে ফিরে এসো।
মন বলছিল, সাপখোপ থাকতে পারে। উঠে এসো।
এত সুন্দর দেখাচ্ছিল। পারলে বরণ করে বারো-চোদ্দ বছরের পুরনো বউকে বারান্দায় তুলে নিতাম। কতকাল আলতা পরে না।
বউ তবু নড়ে না। আমাকে বিপদে ফেলে ওর কি আনন্দ।
ও শুধু মাথা নাড়ল। মানে ওখান থেকে যাবে না।
বিপিন এমন কিছু বেশি খায় না। ভাতটা যা কিছু লাগে।
কতকাল আগে কিনে দেওয়া জরিপাড় কালো শাড়িখানা পরেছে আজ। অনেকটা আগের দিনের নীলাম্বরী প্যাটার্ন। কাউকে বিপদে ফেলতে এমন সেজে কেউ বাগানে নামে! গালে জোস্না পড়লেও বোঝা যাচ্ছে না--পাউডার মেখেছে কি না।
উঠে দাঁড়িয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, হেট হেট। যেন গরু তাড়াচ্ছি। যেন কারো কালো গাইটা হঠাৎ বাগানে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ওঠা গেল না।
বিপিন উঠতে দিল না। বুকের ভেতর কতরকমের পাহাড়-পর্বত থাকতে পারে জানা ছিল না। ছড়ের এক এক টানে সেসব ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুধু সুদূর সাইকেল রিকশার প্যাক প্যাক আওয়াজ। তাতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। ঘস করে খোকার মা সরে গেল।
‘ওই যে! নড়বেন না। এসেছে’- ছড় থামেনি বিপিনের।
বললাম, ‘কোথায়’?
‘বাগানে’-
বুড়ো মানুষ। কোনো বেলাই পেট ভরে খাওয়া জোটে না বোধহয়। বাজিয়ে নানারকম ভুজুংভাজুং দিয়ে তবে অন্ন হয়। নিজের বানানো পরীর গল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একেবারে জলজ্যান্ত পরী এসে বাগানে দাঁড়াবে এ ওর স্বপ্নেও ছিল না।
তাই বোধহয় হাত ফসকে টানের মাথায় ছড়খানা স্লিপ খেয়ে একেবারে বাগানে গিয়েই পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে বারান্দা বোঝাই সুর থেমে গেল।
‘দেখলেন’?
বললাম, ‘একদম স্পষ্ট’।
দুজনে চুপচাপ বসে রইলাম খানিক। এখন বাগান থেকে কে ছড় তুলে আনে।
ব্যাপারটা অশরীরী। বুড়ো বিপিন আগে থেকেই ভয় পেয়ে বসেছিল। আমার পাওয়া উচিত। তাই বেশ কিছুটা ভয় পেয়ে গেছি এইভাবে বললাম, ‘থাকগে, কাল সকালে তুলে আনা যাবে। কি বলেন’?
‘তাই ভালো’
যেমন ছিলাম তেমন আছি।
ছেলেপিলের মা জল দিয়ে, থালা সাজিয়ে আমাদের ডাকতে এসেছে। পৃথিবী যেমন ছিল তেমন আছে। জোৎস্নায় মেঘ কিংবা গাছপালার ছায়া লেগে কোথাও কোনও ময়লা পড়েনি।
ওই তারিখে বারুইপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছি। লক্ষীকান্তপুরের ট্রেন ধরব। খয়েরি পাঞ্জাবি গায়ে এক বুড়ো ঘরে ঢুকল। বগলে বেহালার বাক্স। গায়ে তাল্লিমারা পাম্প সু, পরণে খেটে ধুতি। গালে পাকা দাড়ি, সাদা ভ্রু। লোকটা বসেই বেহালার ছড় ঘষতে লাগল।
ফাঁকা দুপুরে বাইরের খোলা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে দু’জন চাষী অনাসৃষ্টি খরার কথাবার্তা বলছিল। বাজনা শুনে তারাও এগিয়ে এল। খুব সম্ভব কনসার্ট পার্টির কোনও খুব পরিচিত গৎ। শুনতে ভালোই লাগছিল।
বাজিয়ে, বাক্স বন্ধ করে লোকটি আমার কাছে একটি টাকা চাইল। দিলাম। তখন খুশি হয়ে পকেট থেকে একখানা কাগজ বের করে আমার হাতে দিল। খুলে দেখলাম তাতে ওসব লেখা রয়েছে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
কাগজখানার উল্টো দিকে লেখা রয়েছে- To the Hon’ble First Munseef of Baruipur. Sir, I wish to interview 2 minutes only. Kindly allow me, your valuable time west me. Excuse me for your trouble.
Your most obedient Servant truly, polite, believe sympathy, SreeBepin Behary Biswwas (Rai Bahadur), M.A Honours in English, Calcutta University, Vill & P.O Dadarat
Dt. 24 Pargs, West bangal.
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
পড়ে এই ক’টি জিনিস মনে হল-
লোকটি ইংরেজিতে অনার্সকে খুব সমীহ করে মনে মনে। উপরন্ত রায়বাহাদুর হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। তাছাড়া, সে চ্যালেঞ্জ ভালোবাসে। এদিককার এমন কোনও পাড়ায় থাকে--যেথানকার নাম বিপিনবাবুটির পূর্বপুরুষদের পরিচয়ে হয়ত পরিচিত। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি তার স্বপ্নে একছত্র।
কিন্তু লোকটি এখন নিশ্চয় রিটায়ার্ড ও সংসারে বাতিল।
লোকটিকে পরের রবিবার আমার বাড়িতে অন্নগ্রহণ করতে বললাম। আরো বললাম, আপনার বাজনার হাতটি খুব ভালো।
খুব খুশি।
আমি একটা খালের পাড়ে থাকি। উপস্থিত অনেকে কম সময়ে বেশি ধানের লোভে খালধারে আই-আর-এইট ধান চাষ করেছে। তাই খাল শুখো। দুপুরের রোদে রবিবার পুড়ে যাচ্ছিল। সেই খালধার ধরে বিপিনবাবু এলেন। সঙ্গে বেহালার বাক্স।
আমি প্রায়ই এরকম লোক ধরে ধরে আনি বলে আমার স্ত্রী বিপিনবাবুকে খেতে দিতে রাজি হচ্ছিল না প্রথমে। কিন্তু খেতে বসবার পর দেখলাম, বেশ এটা ওটা এগিয়ে দিল। খেয়ে উঠে বিপিন বিশ্বাস লম্বা একটা ঘুম দিল বসবার ঘরে। বিকেলে উঠে চায়ের কথা মনে করিয়ে দিল। তারপর বাক্স খুলে ছড় হাতে নিয়ে বেহালাটা জুত করে কাঁধে বসাল।
জানতাম না। সেদিন পূর্নিমা ছিল।
আর কিছু হাওয়া ছিল। খুব জোর। আমাদের বাড়িতে সন্ধে হতে না হতেই হ্যারিকেন ধরানো হয়। চাঁদও উঠল। কালো বাছুরটা পুকুরঘাটে দাঁড়ানো ওর মাকে খুব ঢুসোচ্ছে।
কাঁধে বেহালা সেট হয়ে গেছে। ছড় ঠেলে ঠেলে অনেক সুর ভেঙ্গে ওপরে উঠছে আবার নিচে নেমে পড়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য খাদে দাড়াচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা পড়াশুনা ফেলে এদিকেই কান খাড়া করে আছে।
এসব আমাদের বারান্দায় হচ্ছিল। বেহালার ঘ্যাঁ-ঘ্যোঁ কারও বুক তুবড়ে দিয়ে বেরিয়ে আসছিল। বিপিনবাবুর মুখে ভাঙা পাটালির ধারা একচিলতে জোৎস্না পড়ে সাদা দাড়িতে ভ্রুতে ঝকঝ্ক করছে। কাটা বোঝাই বাবলা গাছগুলো এখন কেমন নির্দোষ বৃক্ষ হয়ে দাঁড়ানো। খালধারের শেকুলকাঁটার ঝোপে হলদে ফুলগুলো জোস্নায় হারিয়ে যাচ্ছিল।
হঠাৎ ছড় থামিয়ে বিপিনবাবু বলল, ‘এই রাগিনী মাঘী পূর্নিমায় সারারাত দিঘির পাড়ে বসে বাজাতে পারলে পরী নামানো যায়। একবার মিত্তিরদের কাছারিবাড়ির পুকুরে নামিয়েছিলাম। ওরা একখানা কম্বল দেয় শেষে।‘
আমার ছেলেপিলের মা এতক্ষণ অবিশ্বাস করতে করতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল বাজনা শুনে। পরীর কথায় ঠোঁটে ওলটালো। নাও নাও এখন বিদেয় কর-এই ভাব নিয়ে উঠে গেল।
আমি বললাম, ‘কম্বল কেন?’
‘মাঘী পূর্নিমার রাত। ঠাণ্ডা হবে না?’ ‘আমার অবিশ্যি তখন জোয়ান বয়স। শীতবোধ বিশেষ ছিল না। তবে কিনা-একে মেয়েছেলে, তায় পরী। শীত তো লাগবেই। ওঁদের তো বিশেষ জামাকাপড় পরতে নেই।‘
আমার জন্য তালশাঁস, ডাবের জল ঢাকা দেওয়া ছিল। ঘরের থেকে এনে নিজেই বিপিনবাবুকে দিলাম। ব্রেনওয়ার্ক হচ্ছে ওর।
‘উত্তর আকাশ থেকে নেমেছিল। রাত দু’টো নাগাদ। ঘাটলায় এসে পাখা গুটিয়ে বসে আমার বাজনা শুনছিল একমনে। সাক্ষাৎ দেবী প্রতিমা। মিত্তিরদের জেঠিমা যেমন হাসিখুশি তেমনি সাহসী ছিলেন। শরীরে দয়ামায়াও ছিল। তিনিই ঋষিকেশ থেকে আনানো পাহাড়ি ভেড়ার লোমের কম্বলটা শেষরাতে দোতলা থেকে ঘাটলায় ছুড়ে দিলেন।’
‘পরী উড়ে গেল না?’
‘বড় ভালো ছিল মেয়েটি। শীত লেগেছিল। দৈববানীর মতো আকাশ থেকে কম্বল পেয়েই গায়ে জড়িয়ে ফেলল। তারপর আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। আমার ভেতরটা সেই ক’সেকেন্ডের জন্য--কি বলব গাঙ্গুলীমশাই, ধক করে উঠল। পরিষ্কার বাংলায় বলল--আরেকখানা বাজাও।‘
‘বাংলায়’।
বিপিনবাবু একটু থমকে গেল, তারপর বেহালাটা কাঁধে তুলে নিল, খানিকক্ষণ ছড় ঘষাঘষি করে একটা খুব ভারি রাগের মধ্যে ছড়সুদ্ধ হাত মাথা ডুবিয়ে দিল, ‘এই রাগটা বাজিয়েছিলাম’।
ছড়ের এক-এক টানে হাওয়াসুদ্ধ জল উঠে আসছিল এক-একবার। আবার ভাঁটাও হচ্ছিল। খালপাড়ের ওধারে দূর দিয়ে কলকাতার গাড়ি গেল আলো জ্বালিয়ে--লোকজন নিয়ে--আবার কয়েক গাড়ি লোক ফিরেও এল।
ছেলে-মেয়েরা খেতে বসেছে। ওদের মা ভাত মেখে দিচ্ছে। হ্যারিকেনটা হাওয়ার জ্বালায় দেওয়ালের পাশে সরিয়ে দিল।
এক সময় বললাম, ‘পরী নেমে আসবে না তো’?
বাজনা না থামিয়েই বিপিনবাবু বললেন, ‘নামতেও পারে’।
আমার অবিশ্বাস এতই বেশি--প্রায় হো হো করে হেসে উঠছিলাম। পরী নামার অবস্থাই বটে। মডিফায়েড রেশনে আমাদের এই স্টেশনপাড়ায় চাল গম কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না ক’ সপ্তাহ। ডিলার গরুর গাড়িতে মাল পাঠিয়েছিল। বাদার মধ্যে দিয়ে পিচ রাস্তা ধরে তিন গাড়ি গম আসছিল। লুট হয়ে গেছে।
বিয়ের বরযাত্রী থেকে স্টেশনমাস্টার, পোস্টমাস্টার, হেড মাস্টার-সবাই চাল নিয়ে আলোচনা করে। স্মাগলারদের দাপটে ট্রেন রোজ লেট হচ্ছে। রাত হলে অন্ধকারে বসে বসে কত পরিবারের কর্তা হাওয়া খায়--বড় বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আলাপ রীতিমত জমে উঠেছে। এমন সময় বড় ছেলেটা এটো হাতে উঠে এসে আমার সামনেই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগল। ইশারায় থামতে বলে এগিয়ে গেলাম।
ব্যাপার সামান্য। ও এবেলা-ওবেলা দু’টো বেশি করে পষ্টি ভাত খেয়ে থাকে। আরো খাওয়ার ইচ্ছে ছিল। ওর মা তুলে দিয়েছে মাঝখান থেকে। বলেছে, সবাই খাবে তো।
বিপিনবাবুর বেহালায় আলাপ জমে উঠেছিল।
চাষ উঠলে বছরকার ধান কেনা থাকে ফি’বার। এবারই হয়নি। ট্রেনে, বাজারে যত পুলিশ বাড়ছে, ফ্রন্ট সরকারের ফতোয়া যত লম্বা হচ্ছে--চালের দামও তত চড়ছে। ফি রাতে ডাকাতি হয়। থানা এখান থেকে পাঁচ মাইল। থবর দিয়েও কোনও লাভ হয় না।
বিপিনবাবু পরী নামানোর জন্য বেহালাটা খুব জোরে কাঁধে চেপে ধরেছে। আমাদের বাগানের বেলফুল গন্ধ ছড়াচ্ছিল বাতাসে। চাঁদ সারা পাড়া জুড়ে টর্চ ফেলেছে। এ বাড়ি সে-বাড়ির রেডিওগুলো জুড়িয়ে এল। শুধু স্টেশনের ধারে একটা দোকান--সারা বছরই ওদের হালখাতা থাকে। মাইক বাজিয়ে দানাদার খাওয়ায়। বেয়াড়া খদ্দেরদের বাকি টাকা তোলে। সেদিক থেকেই ভেসে আসছিল-‘আলেয়া! আলেয়া!! জীবনে নারী পেয়েছি অনেক’--।
পরী নামাতে না পেরে পরাজিত হলে বিপিন কি আমাকে ৪০০১ টাকা পুরস্কার দেবে? ছেলেটা বাইরের খাটে শুয়ে বাজনা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
হয়তো খানিক বাদে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে পরী নেমে এসে আমাদের ওই বাগানে বেলফুলের সারির মাঝে পাখনা গুটিয়ে দাঁড়াবে। তারপর বলবে-
Hon’ble Mr. Biswas Sir, I wish to interview 2 minutes only. Kindly allow me, your valuable time west me.
প্রথম আলাপের সেই চিরকুটখানা আমার টেবিলের ড্রয়ার খুললেই রোজ চোখে পড়ে।
কিন্তু সেসব কিছুই ঘটল না।
বিপিনবাবু বাজাতে বাজাতে শুয়ে পড়েছেন প্রায়। নারকেল পাতাগুলো জোৎস্না ছিঁড়ে ছিঁড়ে দুলছে। পৃথিবীতে এখন কোনও অশান্তি নেই। অথচ জানি এই আধা-শহর আধা-গায়ের প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে নানা অবিচারের বিরুদ্ধে ন্যায্য-অন্যায্য দাবি লেখা পোস্টার মেরেছে ছেলেরা। সব বদলে যাচ্ছে। মাটি, গাছপালা, খাল, আকাশ--এরাই শুধু পাল্টায়নি! এর মাঝখানে আমরা পরী নামচ্ছিলাম। আমার বয়স চল্লিশ। বিপিনবাবুর তো সত্তর হবে। লোকটা চিট হতে পারে-- ক্র্যাক হতে পারে। জেনুইন কিনা কে জানে!
খড়ি-ওড়া শুকনো চামড়ার বিপিনবাবু দিবানিদ্রার পর খুব জম্পেশ করে বাজাচ্ছিল। এসব বাজনা কতকাল শুনিনি। তাল, লয়, রাগ-কিছুই জানি না। তবু বেশ লাগছিল। শুধু আমাকে শোনাতেই একজন বাজনাদার প্রাণপাত করে যাচ্ছে-অথচ আমি সভাসদ, পাত্রমিত্র, পাইক-বরকন্দাজ সাজিয়ে রাজা হয়ে বসে নেই। সামান্য শ্যামল গাঙ্গুলী।
বড় ছেলেটা বাইরের রোয়কেই ঘুমিয়ে গেল। নয় পেরিয়ে দশে পড়েছে। ভাতটা খেতে বড় ভালোবাসে। সবচেয়ে সস্তার জিনিস এমন আক্রা হয়ে যাবে একদিন কে জানত!
ছেলেমেয়েদের মা এখন সারাদিন পরে ফ্রি হয়েছে। মেয়েটাও এতক্ষণে ঘুমে হাল্লাট হয়ে গেল। অন্ধকার বারান্দায় আমি আর বিপিন বিশ্বাস। ভেতরের ঘরে আলোর সামনে গিন্নি দাঁড়ানো। তাই ওর মুখ-চোখ দেখা যাচ্ছে না। ঘোমটার শাড়ির চারধারে আলোর আউটলাইন।একবার মনে হল আমায় ডাকছে। উঠতে যাব। বিপিনবাবু ছড় ঘষতে ঘষতে আমাকে খুঁচিয়ে দিল। ওঁর দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে বিপিন বিশ্বাস চোখ দিয়ে ইশারায় আকাশে তাকাতে বলল। এনি মোমেন্টে পরী নেমে পড়তে পারে। সেই সময় কি আসন্ন? নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল আমার।
আলোর আউটলাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বউ যেন কি বলতে চাইল একবার। হাত নেড়েও যে থামিয়ে দেব সে সময় এখন নয়। এখন পরী নামে।
খট করে বিপিনের বাজনা থেমে গেল। আমি আর আকাশে তাকাতে পারছি না। যদি নামেই--আমি নির্ঘাত সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাব। বিপিন বাগানের দিকে নেমে যেতে যেতে বলল, ‘জল সেরে আসছি। কখন থেকে একঠায় বসে বাজাচ্ছি’। তাই বল! এমনভাবে আচমকা বাগানে নেমে গেল--যেন পরী নেমেছে। হাত ধরে বারান্দায় তুলে আনবে এক্ষুণি।
ছেলে-মেয়েদের মা ঝড়ের বেগে ঢুকেই ঘুমন্ত ছেলেটাকে এক হ্যাঁচকায় কোলে তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে, ‘কোনও কাণ্ডজ্ঞান যদি থাকে। ক’পালি চাল আছে ঘরে শুনি? রোজ রোজ লোক ধরে আনা চাই’-
ছেলে কোলে শোয়াতে চলে গেল। যাবার সময় ওর পায়ের ধাক্কায় বেহালার বাক্সটা হাঁটকে খুলে গেল।
বিপিন বিশ্বাস ফিরে আসার আগে জায়গার জিনিস জায়গায় রাখা দরকার। বন্ধ করতে পারি না। কিসে আটকে গেছে। আলোতে নিয়ে দেখি, বাক্সটা নানান জিনিসে বোঝাই। তিনখানা নিমের দাঁতন! তেলচিটে গামছাও আছে একখানা। একেবোরে বিপিনের সংসার। রংচটা নীল লুঙিটাও কাগজে মুড়ে গুঁজে রেখেছে। তাড়াতাড়ি জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে দিলাম।
বারান্দায় উঠেই এক সেকেন্ডে বিপিন বাজনার ছেড়ে আসা জায়গায় ফিরে গেল, ‘ঠিক এমনি চাদের আলো ছিলো সে রাতে’--
আর কথা নয়। আমার পরিচিত বউ এখনো প্রায় তরুণী। অল্পদিন হলো ভ্রু কুঁচকে কথা বলার সময় ওর নাকের পাশ দিয়ে দু-ধারে ভাঁজ পড়ে। যা দিনকাল। এসব দেখার সময় পাই--দেখে ভাবারও সময় পাই--কেননা ব্যাঙ্কে আমার পাকা চাকরি। এখনো অনেক কাল বেঁচে থাকলেই মাইনে পাব। শুধু অফিসে গিয়ে খানিকক্ষণ কলম নাড়তে হবে রোজ। খুব খারাপ লাগে। কোনো মহৎ কাজ করি না। লোক টাকা রাখে, তোলে, ধার নেয়, ফেরত দেয়--সুদ কষে সেসব তুলে রাখি লেজারে। এজন্যে আজকাল পরীক্ষা করে বাজিয়ে টাটকা ছেলে ভর্তি করা হয়।
খুব জমাটি বাজনায় বিপিন নিজেই চোখ বুজে ফেলেছে। কাছাকাছি কোনও বাড়িতে সুন্দর করে মুসুরির ডাল রান্না হচ্ছে। সেই গন্ধে আমার বাজনা শোনার গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল। জীবনের অর্ধেকের বেশি খরচ হয়ে গেল। আর বড় জোর বিশ-পচিশ বছর বাঁচব।
বাগানের শুকনো পাতা মাড়িয়ে কে আসছিল। এই বারান্দার দিকেই। বিপিন এখন নিজের বাজনায় মতোয়ারা হয়ে আছে।
আমার বউ। খুব সাবধানে এগিয়ে আসছে। কলমের পেয়ারার ডাল ধরে দাঁড়িয়ে গেল। সেই জায়গাতেই কিছু চাঁদের আলো ডাল-পাতার আড়াল খুড়ে ভেতরে নেমে পড়তে পেরেছে।
চোখাচোখি হল। সেখানেই দাঁড়িয়েই ও হাতের ইশারায় বলতে চাইল, আর কেন? এবার বিপিন বিশ্বাসকে উঠতে বল।
হাত নেড়ে বিপিনকে তুলে দেওয়ার কথা বলল তিনবার। আড়াইসের চাল ন’টাকা চোদ্দ আনা। কোলকাতায় আরো বেশি। দশ বছর আগে বসানো শিরিশ চারা ধা ধা করে বেড়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় নানা লোকের সেন্টার। সেখান থেকে হরেকরকম কথাবার্তা ভেসে আসছে। আলাদা করে বোঝা যায় না।
আমিও সিগন্যাল দিলাম। খুব সাবধানে। বিপিন চোখ খুললেই ডেনজার। শেষে হাতজোড় করে অন্ধকারে নিজের মুখখানা যতটা কাচুমাচু করা যায়--তাই করে, যতটা মাথা নেড়ে বোঝানো যায়-- তাতে বললাম, এবার তুমি দয়া করে গোয়ালের দিক থেকে ফিরে এসো।
মন বলছিল, সাপখোপ থাকতে পারে। উঠে এসো।
এত সুন্দর দেখাচ্ছিল। পারলে বরণ করে বারো-চোদ্দ বছরের পুরনো বউকে বারান্দায় তুলে নিতাম। কতকাল আলতা পরে না।
বউ তবু নড়ে না। আমাকে বিপদে ফেলে ওর কি আনন্দ।
ও শুধু মাথা নাড়ল। মানে ওখান থেকে যাবে না।
বিপিন এমন কিছু বেশি খায় না। ভাতটা যা কিছু লাগে।
কতকাল আগে কিনে দেওয়া জরিপাড় কালো শাড়িখানা পরেছে আজ। অনেকটা আগের দিনের নীলাম্বরী প্যাটার্ন। কাউকে বিপদে ফেলতে এমন সেজে কেউ বাগানে নামে! গালে জোস্না পড়লেও বোঝা যাচ্ছে না--পাউডার মেখেছে কি না।
উঠে দাঁড়িয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, হেট হেট। যেন গরু তাড়াচ্ছি। যেন কারো কালো গাইটা হঠাৎ বাগানে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ওঠা গেল না।
বিপিন উঠতে দিল না। বুকের ভেতর কতরকমের পাহাড়-পর্বত থাকতে পারে জানা ছিল না। ছড়ের এক এক টানে সেসব ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে শুধু সুদূর সাইকেল রিকশার প্যাক প্যাক আওয়াজ। তাতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। ঘস করে খোকার মা সরে গেল।
‘ওই যে! নড়বেন না। এসেছে’- ছড় থামেনি বিপিনের।
বললাম, ‘কোথায়’?
‘বাগানে’-
বুড়ো মানুষ। কোনো বেলাই পেট ভরে খাওয়া জোটে না বোধহয়। বাজিয়ে নানারকম ভুজুংভাজুং দিয়ে তবে অন্ন হয়। নিজের বানানো পরীর গল্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একেবারে জলজ্যান্ত পরী এসে বাগানে দাঁড়াবে এ ওর স্বপ্নেও ছিল না।
তাই বোধহয় হাত ফসকে টানের মাথায় ছড়খানা স্লিপ খেয়ে একেবারে বাগানে গিয়েই পড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে বারান্দা বোঝাই সুর থেমে গেল।
‘দেখলেন’?
বললাম, ‘একদম স্পষ্ট’।
দুজনে চুপচাপ বসে রইলাম খানিক। এখন বাগান থেকে কে ছড় তুলে আনে।
ব্যাপারটা অশরীরী। বুড়ো বিপিন আগে থেকেই ভয় পেয়ে বসেছিল। আমার পাওয়া উচিত। তাই বেশ কিছুটা ভয় পেয়ে গেছি এইভাবে বললাম, ‘থাকগে, কাল সকালে তুলে আনা যাবে। কি বলেন’?
‘তাই ভালো’
যেমন ছিলাম তেমন আছি।
ছেলেপিলের মা জল দিয়ে, থালা সাজিয়ে আমাদের ডাকতে এসেছে। পৃথিবী যেমন ছিল তেমন আছে। জোৎস্নায় মেঘ কিংবা গাছপালার ছায়া লেগে কোথাও কোনও ময়লা পড়েনি।
5 মন্তব্যসমূহ
asadharon laglo..
উত্তরমুছুনDarun
উত্তরমুছুনKhub bhalo laglo...
উত্তরমুছুনKhub bhalo laglo...
উত্তরমুছুনঅসম্ভব ভালো। অব্যাখ্যাত সুন্দর।
উত্তরমুছুন