মাহমুদ হাসান পারভেজ
গল্প উপন্যাসের নিপুন শিল্পী অমর মিত্রকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলতে দেখি। গল্পপাঠে এক আলাপে তিনি জানিয়েছেন ১৯৮০ সালে তিনি হস্তান্তর দলিলের আঙ্গিকে গল্প লেখেন। সে গল্পটির নাম ‘দানপত্র’। এরপর তিনি বাদী বিবাদীর সাক্ষ্য নিয়ে রায় যেভাবে লেখা হয় সেভাবেও গল্প লেখেন। ছিটমহলের নিরুপায় মানুষগুলোর পক্ষেও তিনি গল্প লেখেন। সে গল্পের শরীরও একখানা লিখিত আবেদন পত্র মাত্র। তার কাছে গল্পের এই অঙ্গিক নতুন কিছু নয়। তিনি নানারকম ভাবে গল্প বলতে ভালবাসেন।
যে ফেরেনি- শিরোনামের গল্পটি যারা ইতমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন গল্পের শরীরটি। হ্যাঁ, মনে হবে যেন প্রতিবেদন পড়তে পড়তে গল্পের ভেতর ঢুকে যাচ্ছেন। সে অনবদ্য এক উপস্থাপনা। আর গল্পটি বাংলা গল্পের ভান্ডারে একখানা অমূল্য সম্পদ হয়েই থাকবে।
প্রতিবেদনের আঙ্গিকে গল্প বলার ঢঙে গল্প কথক তাই নিশ্চিত প্রমাণাদি সহকারে যেমন বলেন ‘‘বিবরণে প্রকাশ…’’ আবার কোথাও অনিশ্চিত হয়ে জানান দেন ‘‘ …সঠিক না জানা গেলেও এটা জানা যায়…’’ আবার কখনও তিনি লোকের মুখে মুখে শোনা কথাও পাঠককে জানিয়ে দেন ‘‘বিবরণ যা কানাঘুষো ঘুরে বেড়ায় শীতের হাওয়ার মত, তাতে প্রকাশ…’’ কখনও বলেন ‘‘ বিবরণে অস্পষ্ট প্রকাশ….’’ অথবা একেবারে নিজের মত করে ঘটনার চুড়ান্ত রূপ দিয়ে দেন ‘‘বিবরণে অপ্রকাশিত…..’’ ইত্যাদি ইত্যাদি..। আর এভাবেই পাঠককে একটু একটু করে গল্পের অতলে নিয়ে যান তিনি। আর পাঠকও যেন সম্মোহিতের মত গল্পের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন। পাঠ শেষ হলে গল্পের চরিত্র, ঘটনা, ঘটনার আকস্মিকতা, বর্ণনার জাদু সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ সৃষ্টি হয় পাঠক মনে।
দেখুন, গল্পের শিরোনামটাই প্রথমেই প্রশ্ন খাড়া করে দিচ্ছে- কে ফেরেনি? আর সেটা আবিষ্কার করতে আমাদের যেতে হয় গল্পের স্থান চব্বিশ পরগণা জিলার দেগঙ্গা থানার বোয়ালঘাটা গ্রামে। ছয়মাস অন্তর সে গ্রামে একটার পর একটা খুন হচ্ছে। খুন হচ্ছে খুব সামান্য মানুষগুলো। এমনই মানুষগুলোর কেউ চাষী কেউ বা কামার।
চার পর্বে ভাগ করে গল্পটি সাজানো হয়েছে। প্রথম পর্বে আমরা দেখি জনৈক বিনয় মন্ডল নামের এক চাষীকে রাস্তার উপর খুন হতে। দ্বিতীয় পর্বে পাই, রাতে ক্ষেতের ধান পাহারা দিতে যাওয়া আরেক চাষী সুবল গয়েনের ছিন্ন মাথা। তৃতীয় পর্বে নিত্যপদ কামার রহস্যজনকভাবে তার কামারশালের ভিতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরে। আর চতুর্থ পর্বে এসে সকল খুনের রহস্য উন্মোচন হয়। শেষে আমরা জেনে যাই কে ফেরেনি।
তবে গল্পটি নিছক খুন আর খুনের রহস্য উন্মোচনের গল্প নয়। গল্পটি গ্রামের সামান্য চাষা কামার কুমোরদের স্বপ্ন আর স্বপ্ন ভাঙার ইতিবৃত্ত। গল্পটি সেসময় আর এসময় মিলিয়ে সাধারণ মানুষের শোষিত হবার গল্প। ক্ষমতা দখলের রাজনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নীরব প্রতিবাদের গল্প।
চলুন দেখে আসা যাক গল্পটি শুরু হচ্ছে কিভাবে:
‘‘ ঘটনার বিবরণে প্রকাশ জনৈক বিনয় মন্ডল সাকিন বোয়ালঘাটা, থানা দেগঙ্গা জিলা চব্বিশ পরগণা, বিকেলবেলায় তার ছোট্ট মেয়েটিকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে ঘরে ফেরার পথে প্রথমে আক্রান্ত হয় নির্জন পথের উপর। পথ সেই সময় নির্জন ছিল অথবা ঘটনার মুহূর্তে জনশুন্য হয়েছিল কিনা তা এখন বলা যাবে না। বলা কষ্টকর কেননা আক্রান্ত বিনয় মন্ডল এখন বেঁচে নেই এবং আক্রমনকারীর দল গাঁ ছাড়া। চারপাশের সকলে মুখ বুজে। কেউ কিছু বলছে না, বলতে চাইছে না।’’
এই বিনয় মন্ডল খুন হওয়ার দিন তিনেক আগে গ্রামে ফিরে এসেছিল। ছয়মাস গ্রাম ছাড়া বাড়ী ছাড়া হয়ে সে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। কেন? ফিরে এসেছিল বছর চারেকের কন্যা পদ্মাবতীর জন্য। জমির ফসলের জন্য। কথকের বর্ণনায়,
‘‘ফিরেছিল কেননা ভাল বর্ষা নামায় চাষের টানে টানে তাকে ফিরতে হয়েছিল। বিনয় মন্ডলের তিন বিঘের জমির ধান গত বছর খরায় সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল। এ বছর আকাশে মেঘের অপরূপ ঘনঘটা তাকে দূরে রাখতে পারেনি। এক বছর খরা, এক বছর বর্ষা, এ-তো লেগেই আছে। সুতরাং এবার চাষে নামতে না পারলে তাকে আরো দুবছর অপেক্ষা করতে হত জমির ফসলের জন্য। জমি এবং মেঘ তাকে টেনে এনেছিল গাঁয়ে, তার সঙ্গে পদ্মাবতী তো ছিলই’’।
বিনয় খুনের ছয় মাস পর বাড়ী ছাড়া সুবল গায়েনও গ্রামে ফিরে এসেছিল বাধ্য হয়ে। ফিরেছিল নিজের জমিতে গায়ে গতরে সোনা ফলানো ধানের ভারী ভারী শিষ দেখার অস্থিরতায়। গত বর্ষায় বৃষ্টি হওয়ায় সেবার ধানের উৎপাদন খুব ভাল হয়। ফসল তুলে ঋণমুক্ত হয়ে কিছু জমানোর স্বপ্নে সুবল ফিরে এসেছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি। রাতে নিজর ধানের জমি পাহারা দিতে গেলে কারা যেন সুবলের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে রেখেছিল।
সুবল খুনের পরদিন গ্রামের তিনজন উধাও হয়ে গেল। যেমন বিনয় খুনের পরও গ্রামের তিনজনকে উধাও হতে দেখি। বিনয় খুনের পর উধাও সেই তিন জনের একজন যে সুবল সেটা বুঝতে আমাদের আর বাকী রইল না। যদিও কথক তখনও খুব পরিষ্কার করে সেটি বলছেন না। তবে জাদুকরি বর্ণনায় সেই ইঙ্গিত জানাচ্ছেন। বর্ণনাটুকু এখানে সরাসরি তুলে দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
‘‘তার ফসলের ক্ষেত থেকে একশো গজ দূরে নয়ানজুলির ভিতরে সে পড়ে ছিল স্ফীত চক্ষু ছিন্নমুন্ড নিয়ে। পড়ে থাকার ভঙ্গিটি কেমন যেন অবহেলার। মানুষের দেহ নয়, মাটির পুতুল যেভাবে ভেঙে চুরে প’ড়ে থাকে হেথা হোথা তেমনি প’ড়ে আছে সুবল। যেন বা সুবলই ভেঙে রেখে গেছে তার নিজের মূর্তি। ভাঙা পুতুল ফেলে সুবল ধানক্ষেত থেকে উঠে মোরাম বিছানো রাস্তা ধরে হয় দত্তপুকুর নতুবা টাকিরোডের দিকে হেঁটে গেছে।’’
আর সে পথেই সুবল খুনের সাথে জড়িত তিন জনের সাথে উধাও হয়েছিল নিত্যপদ কামার। সে ও ছয়মাস বাদে ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে ঠাকুরদার আমলের ছোট্ট কুটিরে বসে হাতুড়ি নেহাইয়ে অবিশ্রান্ত কাজ করে যাচ্ছিল। কারণ উৎপাদন ভাল হওয়ায় মানুষের হাতে টাকা আছে। সামনের শিবের মেলায় বাড়তি সওদার লোভ সে সামলাতে পারে নি। তাই সে ও ফিরেছিল। কিন্তু তার নিয়তিও যেন গ্রামের বৃদ্ধ আর যুবকদের আগে থেকেই জানা। দুপুরে সে তার কুটিরে বসে কাজ করছিল। ছ’মাস বাদে নিস্তদ্ধ কামারশালায় জেগে ওঠা হাপরের গাঢ় নিশ্বাসের সাথে তাকেও আগুনে পুড়ে মরতে হল।
বাড়ীছাড়া সামান্য কামার গ্রামে ফিরে এসে চিরতরে ফিরে যাওয়ার অনস্তিত্বেই যেন তার অস্তিত্ব বেশী টের পাওয়া যাচ্ছে। কথক সে পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এভাবে-
‘‘কামারশালা গত ছ’মাস যেমন থেমেছিল তেমনিই থেমে থাকল। যেন বা নিত্যপদ কর্মকার যেমন ছ’মাস আগে ঘর ছাড়া হয়েছে তেমনই ঘর ছাড়া হয়ে আছে। মাঝখানের কয়েকটা দিন যেন উড়ে আসা! নিত্যপদ গাঁয়ে না থেকে দূরে অজ্ঞাতবাসে থাকলে রাতের অন্ধকার যেমন নীরব নিস্তব্ধ ছিল, গাঁয়ে ফিরে আগুনে কামারশালা সমেত ভস্ম হওয়ার পরও রাত তেমনি নিস্তব্ধ। শুধু কয়েকটা দিন রাতের অন্ধকার রাত কেমন পাথর চাপা নৈঃশব্দ্যে ডোবা, প্রাণহীন ধ্বংসস্তূপ যেমন ঠিক সেইরকম, রাত দুপুরে সকলে অনুভব করে মানুষের অস্তিত্ব কেমন শব্দময়, নৈঃশব্দ্য হরণকারী ছন্দময় এবং তা অনস্তিত্বেই প্রতীয়মান হয় সবচেয়ে বেশী।’’
নিত্যপদর আগুনে ভস্ম হওয়ার পরদিন থেকে আরো তিনজনের সাথে নলিনী পাল উধাও হয়ে যায়। গল্পের চুড়ান্ত ক্লাইমেক্স এ আমাদের জানা হয়ে যায় নলিনী পালের গল্প। যে ফেরেনি। আমরা জানতে পারি-
‘‘বছর দুয়েক আগে নলিনীর বিয়ে হয়েছে। বউয়ের পেটে মাস সাতেকের বাচ্চা।…এক মাস দু’মাস কেন ছ’মাস গিয়ে শীতও এল, তবু নলিনী ফেরে না। নলিনীর বউ-এর বাচ্চা হয়েছিল, সেই শিশুর টানেও নলিনী ফেরে না। তার কোন খবর নেই।’’
তার নিয়তি আমাদের জানা না থাকলেও আমরা জানি নলিনী ফেরেনি। কেউ চায় না নলিনী ফিরে আসুক। এমন কি সধবার শাঁখা হাতে সিঁদুর মাথায় নলিনীর বউও মনে মনে গোপনে চায় নলিনী ফিরে না আসুক।
বিনয় যাকে মেরেছিল তার বিধবা বউ সহ চার বিধবা সন্ধ্যায় পথের ওপর বসে থাকে। মেঘের নিচে খুব চুপচাপ হয়ে বসে। সেখানে মাথার সিঁদুর অক্ষয় রেখে নলিনীর বউও অপেক্ষা করে। যেভাবে অপেক্ষা করে চার বিধবা। আমরা দেখতে পারি-
‘‘চার বিধবা পথের উপর ব’সে থাকে সন্ধ্যায়। ব’সে পথের দিকে চেয়ে থাকে। চারজনে ভাল রকম জানে তাদের কেউ আর ওই পথে ফিরবে না। ফিরছিল বলেই ফিরবে না। না ফিরলে হয়ত ফিরত যে আশায় তাদের পিছনে এসে দাঁড়ায় নলিনী পালের বউ, কোলে বাচ্চা নিয়ে অন্ধকারে।’’
নানা ঘাত প্রতিঘাতে গল্প এভাবেই শেষ হয়। একের পর এক খুনের কারণ বিশ্লেষণে আমরা জানতে পারি- ভোট। ভোটের পর থেকে একটার পর একটা খুন হচ্ছে বোয়ালঘাটায়। গ্রামের দুই প্রান্তে দুই রাজনৈতিক দলের পতাকা সকাল দুপুর আকাশে ওড়ে, রাত্ হলেও যে পাতাকা কেউ নামায় না। বাঁশের ডগায় জীর্ণ পতাকা বাতাসে শুধুই ধাক্কা খায়। আর সে ধাক্কাতেই যেন বোয়ালঘাটার সামান্য চাষা, কামার কুমোরগুলো বাড়ী ছাড়া হয়, উধাও হয়ে যায়। নিজে নিজে উধাও হয়ে যায়। গ্রামে ফিরে এসে খুন হয়। আর সন্ধ্যায় শাঁখা সিঁদুর খুইয়ে বিধবা বউয়েরা তাদের স্বামীদের চিরতরে চলে যাওয়া বা ফিরে আসা না আসা পথের দিকে চেয়ে থাকে। যে পথ কেবল অন্ধকার।
*****
গল্পে অনেকগুলো চরিত্র চলে এসেছে। গল্পের প্রয়োজনেই সব চরিত্র। বিশ্বাসযোগ্য এসব দৃশ্যমান ও অদৃশ্য চরিত্র গুণে গুণে বললে প্রায় ডজন খানেকের ওপরে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র- বিনয়, সুবল, নিত্যপদ, নলিনী আর এদের বউয়েরা। গল্পে নলিনী বাদে বাকী সকলের বউ বিধবা। শুধু নলিনীর বউ সধবা- শাঁখা হাতে, সিঁদুর মাথায়। আরেক দিকে পুলিশ, এম.এল.এ, কেন্দ্রের মন্ত্রী ও আছেন।
তবে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বসেন এদের মধ্যে গল্পের প্রধান চরিত্র কোনটি?
আমি এখানে খুব সাধারণ পাঠক- তাই অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি। বিনয় সুবল নিত্যপদ নাকি নলিনী? নাকি এম. এল. এ. বা কেন্দ্রের মন্ত্রী? গল্পের প্রয়োজনে সকল চরিত্রকেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান চরিত্র বলে মনে হয়। আমার এই বিভ্রান্তির পাশে তবু কিছু যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করি। কথকের গল্প বর্ণনার ভঙ্গি থেকেই আসলে যুক্তিগুলো দাড়িয়ে যায়। আমার মনে হয়েছে গল্পের প্রধান চরিত্রটি আসলে নলিনী পাল। যুক্তিটা হলো- ভোটের পর থেকে গ্রামে যে একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়েছিল নলিনী পাল। কিভাবে? কারণ সে ফেরেনি। সবাই জানত নলিনী গ্রামে ফিরে এলে সেও অন্যদের মতই খুন হবে। আরও একটা খুন হলেই কেবল কর্মসূচীশুন্য পার্টির ইস্যু দীর্ঘস্থায়ী হবে। আবারো দেওয়ালে পোস্টার পড়বে- খুনের বদলা খুন চাই। প্রতিপক্ষ দুইটি পার্টির নতুন নেতৃত্ব চাঙা হবে। এম.এল.এ আর কেন্দ্রের মন্ত্রীর এলাকা দখলের মাঝখানে আরো সাধারণ চাষা মজুররা মরতে থাকবে। নলিনীর আর কোন দিন ফিরে না আসা আসলেই নতুন করে কাউকে বিধবা হতে দেয়নি। নিরীহদের বঞ্চনাকে নিরবে ঠেকিয়ে দিয়েছে।
আমারা দেখি- বিনয়, সুবল, নিত্যপদ বা নলিনীরা একে অপরের খুনি। যে মানুষগুলো সহজ সরল নিরীহ- সামান্য ফসলের লোভে বা বাড়তি সওদার আশায় যারা গ্রামে ফিরেছিল- তারা কি করে মানুষ খুন করতে পারে? নাকি তারা রাজনৈতিক বলির শিকার? চরিত্র বিশ্লেষণে এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। গল্পকারও সেটি পরিষ্কার করে দেখান নি। তবে অনুমান করা যায়, প্রতিটি খুনের পর গ্রাম থেকে তিনজন করে উধাও হয়েছিল। সে উধাও তিনজনের মধ্যে বিনয়, সুবল, নিত্যপদ বা নলিনী হয়ত আসল খুনির সাথে দলের সমর্থনে ছিল। এ কারণে নিজেরা ‘খূনের বদলা খুন’ হওয়া বা কখনই ফিরে না আসা নলিনীর প্রতি পাঠকের ঘৃণার বদলে সহমর্মিতাই জেগে ওঠে। চরিত্রের এই অসামান্য দ্বন্দ গল্পকে আরও অর্থবোধক করতে পেরেছে।
যেহেতু গল্পটি বর্ণনা প্রধান এবং কথক প্রতিবেদনের আদলে উপস্থাপনা করেছেন তাই এর চরিত্রগুলোকে আমরা আলাপ করতে দেখি না। দু এক জায়গায় যা দেখি তা খুবই সীমিত। যতটুকু বা সংলাপ এসেছে তা গল্পের ভেতরের গল্পটুকুকে পরিষ্কার করতেই এসেছে।
*****
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গল্পটির প্রথম প্রকাশ হয়েছিল গত শতাব্দীর আটের দশকের প্রারম্ভে। পশ্চিম বঙ্গের ‘অর্কিড’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনে। এরপর গল্পটি অমরমিত্রের গল্প সংকলন ‘প্রিয় পঞ্চাশটি গল্প’ তে স্থান পেয়েছে। এখন থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে প্রথম প্রকাশিত এই গল্পটি অনেকটা সময় পেরিয়ে এখনও সমকালীন। হয়ত এখন আর গ্রামের চাষীদের নিয়তি প্রকৃতির মেঘ জলের সাথে বাঁধা নয়। আগের মতই প্রকৃতির নিয়মে ‘এক বছর খরা- এক বছর বর্ষা’ চললেও কৃষকদের আর বৃষ্টি-জলের জন্য অতটা অপেক্ষা করতে হয় না। কারণ আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা চলে এসেছে। তবু গল্পটি সমকালীন বলছি এই জন্য যে, কৃষক কামার কুমোরদের বা আমাদের মত সাধারণ মানুষের নিয়তি এখনও যেন বাঁধা পড়ে আছে ক্ষমতাসীন সরকারি দল বা বিরোধী দলের দখলের লড়াইয়ে।
গল্পকার হয়ত তার সে সময়ের অভিজ্ঞতায় খুব কাছ থেকে দেখা ঘটনাগুলোকেই তুলে এনেছেন যা এখনও বর্তমান। গল্পটি পড়তে পড়তে আমি টের পাই- আমার অনূভতিগুলো জেগে উঠছে। খরা-বর্ষার নিয়তিতে বাঁধা গ্রামীণ অতীতের প্লটেও তাই আমি জেগে উঠতে পারি আজকের সময়ে। বর্তমানে।
একটু তাকালেই দেখছি, চব্বিশ পরগণা জিলার দেগঙ্গা থানার বোয়ালঘাটা গ্রাম যেন বা সর্বত্র। সে কী আমার গ্রাম! কী আমার নগর বা দেশ!
গল্পের পুরো প্লট জুড়ে লেখকের দেখা গ্রামটাই কিভাবে যেন আমার দেখা গ্রাম নগর বা দেশ হয়ে যায়! তফাৎ শুধু গল্পে ব্যবহৃত চরিত্র বা স্থানের। আমার গ্রামেও বিনয় সুবল নিত্যপদ নলিনীরা আছে। শুধু গ্রাম নয়, আমার নগরেও আছে। নগরে কৃষক না বাস করলেও অন্ন তো আছে। নিত্যপদ কামারের ঠাকুরদার আমলের কুটিরে হাপরের গাঢ় নিঃশ্বাসের বদলে এখানে যেন শুনতে পাই, বড় বড় কল-কারখানার চাকায় চাকায় ঘুরতে থাকা মজুরদের দীর্ঘশ্বাস! সে কারখানা ফ্যাকটরিতে এখনও শ্রমিকরা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়। সে আগুন দুর্ঘটনা নাকি হত্যা সে বড় প্রশ্ন! এখনও ছিন্ন মুন্ড পড়ে থাকে যত্র তত্র। নরম তলপেটে ড্যাগার ঢুকিয়ে দেয় কেউ কেউ। বস্তাবন্দী লাশ ভেসে ওঠে নদীর জলে। ঘরবাড়ি, উপসনালয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় নিরীহ মানুষদের। অন্যদিকে এসব কিছু ঘটে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত থাকা সরকারি দল বনাম বিরোধী দলের অপতৎপরতায়। গল্পের মতই এম.এল. বা এম.পি মন্ত্রীরা থানা জেলার পুলিশ পুষে রাখে- রাষ্ট্রকে পোষ মানাতে পারে।
আর আমরা নাগরিকেরাও গল্পের নিরীহ গ্রামবাসীদের মতই অস্পষ্ট আচরণ করতে থাকি। চোখের সামনে কেউ কাউকে তলপেটে ভোজালি দিয়ে এফোড় ওফোড় করে দিয়ে মাটিতে ফেলে দৌড়া্চ্ছে। আর আমি বা আমরা বলি- আমি কিছু দেখি নাই। কিছু শুনি নাই। আমি বা আমার পাশে কেউ কাউকে জবাই করে মাথা ছিন্ন করে ফেললে আমি অফশোস করতে করতে বলি- আমি তো বাড়িতে ছিলাম, ঘুমিয়ে। আহা, তখন যদি ধারে কাছে থাকতাম-। আমি বা আমার সামনে কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। আমি নিরাপদ দুরত্বে সরে যাই। জ্বলন্ত আগুনের চারপাশে গোল হয়ে দাড়াই। উর্দ্ধমুখী আগুনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। বোবার মত।
আমার খুব মনে হয়েছে, আমরা সকলেই সেই বোয়ালঘাটা গ্রামের বাসিন্দা! সে গ্রামের মানুষেরা বড্ড অস্পষ্ট! ফলে থেমে নেই বউদের শাঁখা ভাঙা, সিঁদুর তোলা।
গল্প উপন্যাসের নিপুন শিল্পী অমর মিত্রকে আমরা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে গল্প বলতে দেখি। গল্পপাঠে এক আলাপে তিনি জানিয়েছেন ১৯৮০ সালে তিনি হস্তান্তর দলিলের আঙ্গিকে গল্প লেখেন। সে গল্পটির নাম ‘দানপত্র’। এরপর তিনি বাদী বিবাদীর সাক্ষ্য নিয়ে রায় যেভাবে লেখা হয় সেভাবেও গল্প লেখেন। ছিটমহলের নিরুপায় মানুষগুলোর পক্ষেও তিনি গল্প লেখেন। সে গল্পের শরীরও একখানা লিখিত আবেদন পত্র মাত্র। তার কাছে গল্পের এই অঙ্গিক নতুন কিছু নয়। তিনি নানারকম ভাবে গল্প বলতে ভালবাসেন।
যে ফেরেনি- শিরোনামের গল্পটি যারা ইতমধ্যেই পড়ে ফেলেছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন গল্পের শরীরটি। হ্যাঁ, মনে হবে যেন প্রতিবেদন পড়তে পড়তে গল্পের ভেতর ঢুকে যাচ্ছেন। সে অনবদ্য এক উপস্থাপনা। আর গল্পটি বাংলা গল্পের ভান্ডারে একখানা অমূল্য সম্পদ হয়েই থাকবে।
প্রতিবেদনের আঙ্গিকে গল্প বলার ঢঙে গল্প কথক তাই নিশ্চিত প্রমাণাদি সহকারে যেমন বলেন ‘‘বিবরণে প্রকাশ…’’ আবার কোথাও অনিশ্চিত হয়ে জানান দেন ‘‘ …সঠিক না জানা গেলেও এটা জানা যায়…’’ আবার কখনও তিনি লোকের মুখে মুখে শোনা কথাও পাঠককে জানিয়ে দেন ‘‘বিবরণ যা কানাঘুষো ঘুরে বেড়ায় শীতের হাওয়ার মত, তাতে প্রকাশ…’’ কখনও বলেন ‘‘ বিবরণে অস্পষ্ট প্রকাশ….’’ অথবা একেবারে নিজের মত করে ঘটনার চুড়ান্ত রূপ দিয়ে দেন ‘‘বিবরণে অপ্রকাশিত…..’’ ইত্যাদি ইত্যাদি..। আর এভাবেই পাঠককে একটু একটু করে গল্পের অতলে নিয়ে যান তিনি। আর পাঠকও যেন সম্মোহিতের মত গল্পের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকেন। পাঠ শেষ হলে গল্পের চরিত্র, ঘটনা, ঘটনার আকস্মিকতা, বর্ণনার জাদু সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ সৃষ্টি হয় পাঠক মনে।
দেখুন, গল্পের শিরোনামটাই প্রথমেই প্রশ্ন খাড়া করে দিচ্ছে- কে ফেরেনি? আর সেটা আবিষ্কার করতে আমাদের যেতে হয় গল্পের স্থান চব্বিশ পরগণা জিলার দেগঙ্গা থানার বোয়ালঘাটা গ্রামে। ছয়মাস অন্তর সে গ্রামে একটার পর একটা খুন হচ্ছে। খুন হচ্ছে খুব সামান্য মানুষগুলো। এমনই মানুষগুলোর কেউ চাষী কেউ বা কামার।
চার পর্বে ভাগ করে গল্পটি সাজানো হয়েছে। প্রথম পর্বে আমরা দেখি জনৈক বিনয় মন্ডল নামের এক চাষীকে রাস্তার উপর খুন হতে। দ্বিতীয় পর্বে পাই, রাতে ক্ষেতের ধান পাহারা দিতে যাওয়া আরেক চাষী সুবল গয়েনের ছিন্ন মাথা। তৃতীয় পর্বে নিত্যপদ কামার রহস্যজনকভাবে তার কামারশালের ভিতর অগ্নিদগ্ধ হয়ে মরে। আর চতুর্থ পর্বে এসে সকল খুনের রহস্য উন্মোচন হয়। শেষে আমরা জেনে যাই কে ফেরেনি।
তবে গল্পটি নিছক খুন আর খুনের রহস্য উন্মোচনের গল্প নয়। গল্পটি গ্রামের সামান্য চাষা কামার কুমোরদের স্বপ্ন আর স্বপ্ন ভাঙার ইতিবৃত্ত। গল্পটি সেসময় আর এসময় মিলিয়ে সাধারণ মানুষের শোষিত হবার গল্প। ক্ষমতা দখলের রাজনীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নীরব প্রতিবাদের গল্প।
চলুন দেখে আসা যাক গল্পটি শুরু হচ্ছে কিভাবে:
‘‘ ঘটনার বিবরণে প্রকাশ জনৈক বিনয় মন্ডল সাকিন বোয়ালঘাটা, থানা দেগঙ্গা জিলা চব্বিশ পরগণা, বিকেলবেলায় তার ছোট্ট মেয়েটিকে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে ঘরে ফেরার পথে প্রথমে আক্রান্ত হয় নির্জন পথের উপর। পথ সেই সময় নির্জন ছিল অথবা ঘটনার মুহূর্তে জনশুন্য হয়েছিল কিনা তা এখন বলা যাবে না। বলা কষ্টকর কেননা আক্রান্ত বিনয় মন্ডল এখন বেঁচে নেই এবং আক্রমনকারীর দল গাঁ ছাড়া। চারপাশের সকলে মুখ বুজে। কেউ কিছু বলছে না, বলতে চাইছে না।’’
এই বিনয় মন্ডল খুন হওয়ার দিন তিনেক আগে গ্রামে ফিরে এসেছিল। ছয়মাস গ্রাম ছাড়া বাড়ী ছাড়া হয়ে সে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। কেন? ফিরে এসেছিল বছর চারেকের কন্যা পদ্মাবতীর জন্য। জমির ফসলের জন্য। কথকের বর্ণনায়,
‘‘ফিরেছিল কেননা ভাল বর্ষা নামায় চাষের টানে টানে তাকে ফিরতে হয়েছিল। বিনয় মন্ডলের তিন বিঘের জমির ধান গত বছর খরায় সম্পূর্ণ পুড়ে গিয়েছিল। এ বছর আকাশে মেঘের অপরূপ ঘনঘটা তাকে দূরে রাখতে পারেনি। এক বছর খরা, এক বছর বর্ষা, এ-তো লেগেই আছে। সুতরাং এবার চাষে নামতে না পারলে তাকে আরো দুবছর অপেক্ষা করতে হত জমির ফসলের জন্য। জমি এবং মেঘ তাকে টেনে এনেছিল গাঁয়ে, তার সঙ্গে পদ্মাবতী তো ছিলই’’।
বিনয় খুনের ছয় মাস পর বাড়ী ছাড়া সুবল গায়েনও গ্রামে ফিরে এসেছিল বাধ্য হয়ে। ফিরেছিল নিজের জমিতে গায়ে গতরে সোনা ফলানো ধানের ভারী ভারী শিষ দেখার অস্থিরতায়। গত বর্ষায় বৃষ্টি হওয়ায় সেবার ধানের উৎপাদন খুব ভাল হয়। ফসল তুলে ঋণমুক্ত হয়ে কিছু জমানোর স্বপ্নে সুবল ফিরে এসেছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি। রাতে নিজর ধানের জমি পাহারা দিতে গেলে কারা যেন সুবলের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে রেখেছিল।
সুবল খুনের পরদিন গ্রামের তিনজন উধাও হয়ে গেল। যেমন বিনয় খুনের পরও গ্রামের তিনজনকে উধাও হতে দেখি। বিনয় খুনের পর উধাও সেই তিন জনের একজন যে সুবল সেটা বুঝতে আমাদের আর বাকী রইল না। যদিও কথক তখনও খুব পরিষ্কার করে সেটি বলছেন না। তবে জাদুকরি বর্ণনায় সেই ইঙ্গিত জানাচ্ছেন। বর্ণনাটুকু এখানে সরাসরি তুলে দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না।
‘‘তার ফসলের ক্ষেত থেকে একশো গজ দূরে নয়ানজুলির ভিতরে সে পড়ে ছিল স্ফীত চক্ষু ছিন্নমুন্ড নিয়ে। পড়ে থাকার ভঙ্গিটি কেমন যেন অবহেলার। মানুষের দেহ নয়, মাটির পুতুল যেভাবে ভেঙে চুরে প’ড়ে থাকে হেথা হোথা তেমনি প’ড়ে আছে সুবল। যেন বা সুবলই ভেঙে রেখে গেছে তার নিজের মূর্তি। ভাঙা পুতুল ফেলে সুবল ধানক্ষেত থেকে উঠে মোরাম বিছানো রাস্তা ধরে হয় দত্তপুকুর নতুবা টাকিরোডের দিকে হেঁটে গেছে।’’
আর সে পথেই সুবল খুনের সাথে জড়িত তিন জনের সাথে উধাও হয়েছিল নিত্যপদ কামার। সে ও ছয়মাস বাদে ফিরে এসেছিল। ফিরে এসে ঠাকুরদার আমলের ছোট্ট কুটিরে বসে হাতুড়ি নেহাইয়ে অবিশ্রান্ত কাজ করে যাচ্ছিল। কারণ উৎপাদন ভাল হওয়ায় মানুষের হাতে টাকা আছে। সামনের শিবের মেলায় বাড়তি সওদার লোভ সে সামলাতে পারে নি। তাই সে ও ফিরেছিল। কিন্তু তার নিয়তিও যেন গ্রামের বৃদ্ধ আর যুবকদের আগে থেকেই জানা। দুপুরে সে তার কুটিরে বসে কাজ করছিল। ছ’মাস বাদে নিস্তদ্ধ কামারশালায় জেগে ওঠা হাপরের গাঢ় নিশ্বাসের সাথে তাকেও আগুনে পুড়ে মরতে হল।
বাড়ীছাড়া সামান্য কামার গ্রামে ফিরে এসে চিরতরে ফিরে যাওয়ার অনস্তিত্বেই যেন তার অস্তিত্ব বেশী টের পাওয়া যাচ্ছে। কথক সে পরিস্থিতি বর্ণনা করেন এভাবে-
‘‘কামারশালা গত ছ’মাস যেমন থেমেছিল তেমনিই থেমে থাকল। যেন বা নিত্যপদ কর্মকার যেমন ছ’মাস আগে ঘর ছাড়া হয়েছে তেমনই ঘর ছাড়া হয়ে আছে। মাঝখানের কয়েকটা দিন যেন উড়ে আসা! নিত্যপদ গাঁয়ে না থেকে দূরে অজ্ঞাতবাসে থাকলে রাতের অন্ধকার যেমন নীরব নিস্তব্ধ ছিল, গাঁয়ে ফিরে আগুনে কামারশালা সমেত ভস্ম হওয়ার পরও রাত তেমনি নিস্তব্ধ। শুধু কয়েকটা দিন রাতের অন্ধকার রাত কেমন পাথর চাপা নৈঃশব্দ্যে ডোবা, প্রাণহীন ধ্বংসস্তূপ যেমন ঠিক সেইরকম, রাত দুপুরে সকলে অনুভব করে মানুষের অস্তিত্ব কেমন শব্দময়, নৈঃশব্দ্য হরণকারী ছন্দময় এবং তা অনস্তিত্বেই প্রতীয়মান হয় সবচেয়ে বেশী।’’
নিত্যপদর আগুনে ভস্ম হওয়ার পরদিন থেকে আরো তিনজনের সাথে নলিনী পাল উধাও হয়ে যায়। গল্পের চুড়ান্ত ক্লাইমেক্স এ আমাদের জানা হয়ে যায় নলিনী পালের গল্প। যে ফেরেনি। আমরা জানতে পারি-
‘‘বছর দুয়েক আগে নলিনীর বিয়ে হয়েছে। বউয়ের পেটে মাস সাতেকের বাচ্চা।…এক মাস দু’মাস কেন ছ’মাস গিয়ে শীতও এল, তবু নলিনী ফেরে না। নলিনীর বউ-এর বাচ্চা হয়েছিল, সেই শিশুর টানেও নলিনী ফেরে না। তার কোন খবর নেই।’’
তার নিয়তি আমাদের জানা না থাকলেও আমরা জানি নলিনী ফেরেনি। কেউ চায় না নলিনী ফিরে আসুক। এমন কি সধবার শাঁখা হাতে সিঁদুর মাথায় নলিনীর বউও মনে মনে গোপনে চায় নলিনী ফিরে না আসুক।
বিনয় যাকে মেরেছিল তার বিধবা বউ সহ চার বিধবা সন্ধ্যায় পথের ওপর বসে থাকে। মেঘের নিচে খুব চুপচাপ হয়ে বসে। সেখানে মাথার সিঁদুর অক্ষয় রেখে নলিনীর বউও অপেক্ষা করে। যেভাবে অপেক্ষা করে চার বিধবা। আমরা দেখতে পারি-
‘‘চার বিধবা পথের উপর ব’সে থাকে সন্ধ্যায়। ব’সে পথের দিকে চেয়ে থাকে। চারজনে ভাল রকম জানে তাদের কেউ আর ওই পথে ফিরবে না। ফিরছিল বলেই ফিরবে না। না ফিরলে হয়ত ফিরত যে আশায় তাদের পিছনে এসে দাঁড়ায় নলিনী পালের বউ, কোলে বাচ্চা নিয়ে অন্ধকারে।’’
নানা ঘাত প্রতিঘাতে গল্প এভাবেই শেষ হয়। একের পর এক খুনের কারণ বিশ্লেষণে আমরা জানতে পারি- ভোট। ভোটের পর থেকে একটার পর একটা খুন হচ্ছে বোয়ালঘাটায়। গ্রামের দুই প্রান্তে দুই রাজনৈতিক দলের পতাকা সকাল দুপুর আকাশে ওড়ে, রাত্ হলেও যে পাতাকা কেউ নামায় না। বাঁশের ডগায় জীর্ণ পতাকা বাতাসে শুধুই ধাক্কা খায়। আর সে ধাক্কাতেই যেন বোয়ালঘাটার সামান্য চাষা, কামার কুমোরগুলো বাড়ী ছাড়া হয়, উধাও হয়ে যায়। নিজে নিজে উধাও হয়ে যায়। গ্রামে ফিরে এসে খুন হয়। আর সন্ধ্যায় শাঁখা সিঁদুর খুইয়ে বিধবা বউয়েরা তাদের স্বামীদের চিরতরে চলে যাওয়া বা ফিরে আসা না আসা পথের দিকে চেয়ে থাকে। যে পথ কেবল অন্ধকার।
*****
গল্পে অনেকগুলো চরিত্র চলে এসেছে। গল্পের প্রয়োজনেই সব চরিত্র। বিশ্বাসযোগ্য এসব দৃশ্যমান ও অদৃশ্য চরিত্র গুণে গুণে বললে প্রায় ডজন খানেকের ওপরে হবে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র- বিনয়, সুবল, নিত্যপদ, নলিনী আর এদের বউয়েরা। গল্পে নলিনী বাদে বাকী সকলের বউ বিধবা। শুধু নলিনীর বউ সধবা- শাঁখা হাতে, সিঁদুর মাথায়। আরেক দিকে পুলিশ, এম.এল.এ, কেন্দ্রের মন্ত্রী ও আছেন।
তবে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে বসেন এদের মধ্যে গল্পের প্রধান চরিত্র কোনটি?
আমি এখানে খুব সাধারণ পাঠক- তাই অন্ধকারে হাতড়াতে থাকি। বিনয় সুবল নিত্যপদ নাকি নলিনী? নাকি এম. এল. এ. বা কেন্দ্রের মন্ত্রী? গল্পের প্রয়োজনে সকল চরিত্রকেই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান চরিত্র বলে মনে হয়। আমার এই বিভ্রান্তির পাশে তবু কিছু যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করি। কথকের গল্প বর্ণনার ভঙ্গি থেকেই আসলে যুক্তিগুলো দাড়িয়ে যায়। আমার মনে হয়েছে গল্পের প্রধান চরিত্রটি আসলে নলিনী পাল। যুক্তিটা হলো- ভোটের পর থেকে গ্রামে যে একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়েছিল নলিনী পাল। কিভাবে? কারণ সে ফেরেনি। সবাই জানত নলিনী গ্রামে ফিরে এলে সেও অন্যদের মতই খুন হবে। আরও একটা খুন হলেই কেবল কর্মসূচীশুন্য পার্টির ইস্যু দীর্ঘস্থায়ী হবে। আবারো দেওয়ালে পোস্টার পড়বে- খুনের বদলা খুন চাই। প্রতিপক্ষ দুইটি পার্টির নতুন নেতৃত্ব চাঙা হবে। এম.এল.এ আর কেন্দ্রের মন্ত্রীর এলাকা দখলের মাঝখানে আরো সাধারণ চাষা মজুররা মরতে থাকবে। নলিনীর আর কোন দিন ফিরে না আসা আসলেই নতুন করে কাউকে বিধবা হতে দেয়নি। নিরীহদের বঞ্চনাকে নিরবে ঠেকিয়ে দিয়েছে।
আমারা দেখি- বিনয়, সুবল, নিত্যপদ বা নলিনীরা একে অপরের খুনি। যে মানুষগুলো সহজ সরল নিরীহ- সামান্য ফসলের লোভে বা বাড়তি সওদার আশায় যারা গ্রামে ফিরেছিল- তারা কি করে মানুষ খুন করতে পারে? নাকি তারা রাজনৈতিক বলির শিকার? চরিত্র বিশ্লেষণে এ প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। গল্পকারও সেটি পরিষ্কার করে দেখান নি। তবে অনুমান করা যায়, প্রতিটি খুনের পর গ্রাম থেকে তিনজন করে উধাও হয়েছিল। সে উধাও তিনজনের মধ্যে বিনয়, সুবল, নিত্যপদ বা নলিনী হয়ত আসল খুনির সাথে দলের সমর্থনে ছিল। এ কারণে নিজেরা ‘খূনের বদলা খুন’ হওয়া বা কখনই ফিরে না আসা নলিনীর প্রতি পাঠকের ঘৃণার বদলে সহমর্মিতাই জেগে ওঠে। চরিত্রের এই অসামান্য দ্বন্দ গল্পকে আরও অর্থবোধক করতে পেরেছে।
যেহেতু গল্পটি বর্ণনা প্রধান এবং কথক প্রতিবেদনের আদলে উপস্থাপনা করেছেন তাই এর চরিত্রগুলোকে আমরা আলাপ করতে দেখি না। দু এক জায়গায় যা দেখি তা খুবই সীমিত। যতটুকু বা সংলাপ এসেছে তা গল্পের ভেতরের গল্পটুকুকে পরিষ্কার করতেই এসেছে।
*****
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গল্পটির প্রথম প্রকাশ হয়েছিল গত শতাব্দীর আটের দশকের প্রারম্ভে। পশ্চিম বঙ্গের ‘অর্কিড’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিনে। এরপর গল্পটি অমরমিত্রের গল্প সংকলন ‘প্রিয় পঞ্চাশটি গল্প’ তে স্থান পেয়েছে। এখন থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে প্রথম প্রকাশিত এই গল্পটি অনেকটা সময় পেরিয়ে এখনও সমকালীন। হয়ত এখন আর গ্রামের চাষীদের নিয়তি প্রকৃতির মেঘ জলের সাথে বাঁধা নয়। আগের মতই প্রকৃতির নিয়মে ‘এক বছর খরা- এক বছর বর্ষা’ চললেও কৃষকদের আর বৃষ্টি-জলের জন্য অতটা অপেক্ষা করতে হয় না। কারণ আধুনিক কৃষি প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়া কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থা চলে এসেছে। তবু গল্পটি সমকালীন বলছি এই জন্য যে, কৃষক কামার কুমোরদের বা আমাদের মত সাধারণ মানুষের নিয়তি এখনও যেন বাঁধা পড়ে আছে ক্ষমতাসীন সরকারি দল বা বিরোধী দলের দখলের লড়াইয়ে।
গল্পকার হয়ত তার সে সময়ের অভিজ্ঞতায় খুব কাছ থেকে দেখা ঘটনাগুলোকেই তুলে এনেছেন যা এখনও বর্তমান। গল্পটি পড়তে পড়তে আমি টের পাই- আমার অনূভতিগুলো জেগে উঠছে। খরা-বর্ষার নিয়তিতে বাঁধা গ্রামীণ অতীতের প্লটেও তাই আমি জেগে উঠতে পারি আজকের সময়ে। বর্তমানে।
একটু তাকালেই দেখছি, চব্বিশ পরগণা জিলার দেগঙ্গা থানার বোয়ালঘাটা গ্রাম যেন বা সর্বত্র। সে কী আমার গ্রাম! কী আমার নগর বা দেশ!
গল্পের পুরো প্লট জুড়ে লেখকের দেখা গ্রামটাই কিভাবে যেন আমার দেখা গ্রাম নগর বা দেশ হয়ে যায়! তফাৎ শুধু গল্পে ব্যবহৃত চরিত্র বা স্থানের। আমার গ্রামেও বিনয় সুবল নিত্যপদ নলিনীরা আছে। শুধু গ্রাম নয়, আমার নগরেও আছে। নগরে কৃষক না বাস করলেও অন্ন তো আছে। নিত্যপদ কামারের ঠাকুরদার আমলের কুটিরে হাপরের গাঢ় নিঃশ্বাসের বদলে এখানে যেন শুনতে পাই, বড় বড় কল-কারখানার চাকায় চাকায় ঘুরতে থাকা মজুরদের দীর্ঘশ্বাস! সে কারখানা ফ্যাকটরিতে এখনও শ্রমিকরা আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়। সে আগুন দুর্ঘটনা নাকি হত্যা সে বড় প্রশ্ন! এখনও ছিন্ন মুন্ড পড়ে থাকে যত্র তত্র। নরম তলপেটে ড্যাগার ঢুকিয়ে দেয় কেউ কেউ। বস্তাবন্দী লাশ ভেসে ওঠে নদীর জলে। ঘরবাড়ি, উপসনালয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয় নিরীহ মানুষদের। অন্যদিকে এসব কিছু ঘটে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত থাকা সরকারি দল বনাম বিরোধী দলের অপতৎপরতায়। গল্পের মতই এম.এল. বা এম.পি মন্ত্রীরা থানা জেলার পুলিশ পুষে রাখে- রাষ্ট্রকে পোষ মানাতে পারে।
আর আমরা নাগরিকেরাও গল্পের নিরীহ গ্রামবাসীদের মতই অস্পষ্ট আচরণ করতে থাকি। চোখের সামনে কেউ কাউকে তলপেটে ভোজালি দিয়ে এফোড় ওফোড় করে দিয়ে মাটিতে ফেলে দৌড়া্চ্ছে। আর আমি বা আমরা বলি- আমি কিছু দেখি নাই। কিছু শুনি নাই। আমি বা আমার পাশে কেউ কাউকে জবাই করে মাথা ছিন্ন করে ফেললে আমি অফশোস করতে করতে বলি- আমি তো বাড়িতে ছিলাম, ঘুমিয়ে। আহা, তখন যদি ধারে কাছে থাকতাম-। আমি বা আমার সামনে কাউকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে। আমি নিরাপদ দুরত্বে সরে যাই। জ্বলন্ত আগুনের চারপাশে গোল হয়ে দাড়াই। উর্দ্ধমুখী আগুনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। বোবার মত।
আমার খুব মনে হয়েছে, আমরা সকলেই সেই বোয়ালঘাটা গ্রামের বাসিন্দা! সে গ্রামের মানুষেরা বড্ড অস্পষ্ট! ফলে থেমে নেই বউদের শাঁখা ভাঙা, সিঁদুর তোলা।
2 মন্তব্যসমূহ
গল্পটা যত সহজে অনুভব করতে পারলাম দৃশ্যপট। আলোচনায় এসে ঠিক তার উল্টো জটে পরে গেলাম।
উত্তরমুছুনগ্রামের চিরন্তনী দৃশ্য নিয়ে এই গল্পটি । যেখানে খুন খারাবী নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার । গল্পকারে হাতের বুনন দক্ষতা খুবই চিত্তাকার্ষক । খুব ভাল লাগলো।
উত্তরমুছুন