শিমুল মাহমুদ'এর গল্প ভাবনা : পক্ষান্তরে নিজেকেই লিখছি

শিমুল মাহমুদ কবি। গল্পকার। তিনি গল্প ও কবিতার মধ্যে এক ধরনের সেতু বন্ধন সৃষ্টি করেন। উপন্যাসের ক্ষেত্রে তিনি নির্মম। সেখানে অমিত শক্তিশালী গদ্য তাঁর আয়ূধ। আখ্যানকে ইতিহাসের সুতোয় গেঁথে দেন। এই ইতিহাস ভুলে যাওয়া ইতিহাস--ভুলিয়ে দেওয়া ইতিহাস। মুছে দেওয়া ইতিহাস। এবং তিনি এই ভুলে যাওয়া ইতিহাস খুঁড়ে দেখান বিশ্ব ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন থেকে।


শিমুল মাহমুদের উপন্যাস নালিতাবাড়ির পরিসর থেকে চলে যায় কলম্বাসের জাহাজে। ভুমি দখলের আখ্যান হয়ে অক্ষরগুলো চলে যায় একাল থেকে সেকালে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাছে মানুষ হয়ে ওঠে নয়া দাস। এভাবে রচিত হয়েছে শিমুল মাহমুদের বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া জনগোষ্ঠী শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী। এর আখ্যান, রচনারীতি ও ভাষাভঙ্গী বাংলা কথা সাহিত্যে নতুন।

এ সময়ের কথাসাহিত্যের দীর্ঘপথের যাত্রী আনোয়ার শাহাদাত, জাকির তালুকদার, শাহীন আখতার, শামিম আহমেদ এবং শিমুল মাহমুদ। তবে উপমহাদেশের মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ে জাকির তালুকদার ও শাহীন আখতার যেখানে সংশয়ের ঘোরপাকে ধরা পড়েন, সেখানে আনোয়ার শাহাদাত, শামিম আহমেদ ও শিমুল মাহমুদ সংশয়হীন পরিব্রাজক। আমাদের দুর্ভাগ্য শিমুল মাহমুদ প্রচারের পেছনে থাকেন। তবে সৎপাঠকের আবিষ্কারে প্রকাশিত হন প্রবলভাবে--এগিয়ে যান সামনে।  

শিমুল মাহমুদের নিজের গল্পের ভুবন নিয়ে নিজেই লিখেছেন দীর্ঘ রচনা। লেখক ও পাঠকের জন্য এই রচনাটি অবশ্যপাঠ্য।



মানবজীবন অর্থ, মানবিক বাস্তবতা। আমরা যা দেখি অথবা অনুভবে পেয়ে যাই, তা-ই মানবিক। হতে পারে হত্যাকর্ম। এই যে রক্তপাত, কষ্ট, দুঃখ অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত ক ঘটনা-স্রোত এই সব কিছুই তো আমাদের অভিজ্ঞতার অংশ। প্রকৃত বাস্তবতায় এই অভিজ্ঞতাও মানবিক। এ অর্থে অমানবিক বলে আদতে কিছু নেই; সবই জান্তব জীবন মাত্র। এই জান্তব জীবন অজস্র নীতিবোধ আদর্শ আর ধর্মবিশ্বাস অপেক্ষাও জটিল এবং ভয়ানক কুৎসিত।
এই জান্তব জীবনের ভেতর আমরা আমাদের ছেড়ে দিয়েছি। এই যে ছেড়ে দেওয়া এটা আসলে জীবনের দিকেই অংশ গ্রহণ। জন্ম মাত্রই এই অংশ গ্রহণ অনিবার্য। এই অনিবার্য অংশ গ্রহণের ভাষিক রূপান্তরই গল্প। হতে পারে একটা রাক্ষসের গল্প। ঐ রাক্ষসটা আসলে আমি অথবা আপনি অথবা জীব জগতের অপর কেউ; যা আমাদের জান্তব অভিজ্ঞতার অংশ।

আমরা আদতে কিছুই কল্পনা করতে পারি না। আমরা আমাদের সমগ্র জীবনের, গোটা একটা মানব জীবনের, হতে পারে তা প্রত্ন-অভিজ্ঞতা আশ্রিত জীবন; এমনতর একটা জীব-জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার রূপায়নের অভিধাই আমরা কল্পনা করতে পারি মাত্র; যা আসলে কল্পনা নয়, বাস্তব। এই বাস্তবতার বাইরে অন্য কিছু আমরা ভাবতে পারি না। এ অর্থে কল্পনা অর্থ বাস্তব-জীবন-আশ্রিত তথা বস্তু-আশ্রিত ভাষিক অথবা চিন্তক রূপ মাত্র। কল্পনা বলে আসলে কিছু নেই। যাকে আমরা কল্পনা বলি; আসলে তা বাস্তবতার রূপক উপস্থাপন। জটিল অভিজ্ঞতা প্রকাশের জন্য আমরা এমনতর ভাষিক রূপক প্রকাশ করতে বাধ্য। এই যে কুলদা রায় বললেন, নবারুণ দা চলে গেলেন তাকে নিয়ে লিখুন। এই দাবিটুকু আসলে জীবনের জৈব-রূপক; বহুমাত্রিক। এই চলে যাওয়া এক ধরনের রহস্য; আমরা রহস্য ভালোবাসি, যেন বা মাতামহীর চুলের সুতোয় ফুটে আছে সময়। শূন্যতায় ফেটে পড়ছে বীজ। পরিযায়ী পাখির পাখা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে শস্য-অঙ্কুর। মাখনের মত, রাত জেগে আছে মধ্য আকাশে। দুধবোন আকাশ, মৃত্যুর বিপরীত তাবিজ। এই সব রূপক-জীবনের ভেতর বিরামহীন জীবনকে সাথে নিয়ে নবারুণ ভট্টাচার্য মরে গেলেন। গল্প বলতে আমি এ রকম রূপক-আশ্রিত অথচ জান্তব বাস্তবতাকে বুঝি। জান্তব বাস্তবতার ভেতর দেখতে পাই, শঙ্খনদীর তীরে জোছনাদের পোষমানা ঘোড়া সবুজ ঘাসের প্রাণ থেকে খুটে খাচ্ছে আমাদের ফেলে আসা সময়। এই খুটে খাওয়া সময়ের ভেতর তাকিয়ে দেখি আমার প্রথম লেখা, নারী বিষয়ক একখানা প্রবন্ধ। অবশ্য এর আগে অথবা পরে লিখেছিলাম ছড়া জাতীয় একটা কিছু; যা আমি কোথাও ছাপতে দেইনি। শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘স্যান্ডেল’। ‘‘স্যান্ডেল কহে দুঃখ করে/ কতদিন আর রইব পরে/ তোমার চরণ তলে?’’--- এই রকম আরও বেশ কিছু চরণ ছিল; যা ছিল প্রধানত শোষিতের পক্ষে এক ধরনের রূপক-আশ্রিত হাহাকার ও প্রতিবাদের প্রকাশ। যাই হোক, এ সময় আমি শরৎচন্দ্রের ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধটি ৮ম শ্রেণিতে থাকালীন পাঠ করি। প্রবন্ধটি আমাকে বিশেষ ভাবে আলোড়িত করে। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলিতে এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান শুরু করি। তখন দৈনিক ইত্তেফাকের সাথে সাপ্তাহিক রোববার নিয়মিত সংগ্রহ করে পাঠ করতাম। সিরাজগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরিতে এক বিকেল না গেলে, বিমর্ষ হবার অভিজ্ঞতা পেতে শুরু করেছি। বিভিন্ন দেশের ও আমাদের দেশের নারী সমাজের বর্তমান অবস্থান বিষয়ে সপ্তাহ দুয়েকের প্রচেষ্টায় প্রবন্ধটি লেখা শেষ করি। প্রবন্ধের শিরোনাম কী দিয়েছিলাম এখন আর মনে নেই। রওশন ইবনে রহিম সম্পাদিত একখানি সাহিত্য পত্রিকা যেটি সিরাজগঞ্জ থেকে প্রকাশ পেত; সেখানে প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছিল। পত্রিকাটির নাম ছিল ‘সাহিত্য উন্মেষ’। গোষ্ঠীগত উদ্যোগে ছোটকাগজের মত বছরে তিন অথবা চারটি সংখ্যার পর পত্রিকাটি আর প্রকাশ পায়নি।

তখনও এরশাদ সাহেবের সময় আসেনি; মেজর জিয়া তখন দেশের নায়ক। আমাদেরকে ছাদখোলা ট্রাকে উঠিয়ে ভুরাঘাটে নিয়ে গিয়ে খাল-খনন কর্মসূচিতে ঠেলে দেয়া হলে আমরা ইউনেস্কোর বিস্কুট টিফিন হিসেবে পেয়ে কোদাল মাটি আর কাদার ভেতর নিজেদেরকে বেশ খানিকটা স্বাধীন হিসেবে আবিষ্কার করলে সহসা মনে পড়ে পাঁচ বছর পেছনের কথা, স্বাধীনতার পর তখন আমরা আলমডাঙাতে থাকি; আলমডাঙা একটি থানা। তখন উপজেলা বলে কিছু ছিল না। ছিল থানা, মহুকুমা, জেলা, বিভাগ। সেই তখন, আলমডাঙার বটতলার মোড় পার হয়ে আমাদের সরকারি প্রাইমারি স্কুল; টিনের চালার নীচে দাঁড়িয়ে থাকা সেই স্কুলটার মাঠ ছিল বিশাল। স্কুলের একটা টানা পুরোন দালান ঘরও ছিল। সেই স্কুলে, তখন টিফিনে বিলেতি দুধ বিলি শুরু হয়েছে। একদিন আমি কাগজের ঠোঙায়, যে ঠোঙা অংক খাতার পাতা ছিড়ে তৈরি করা হয়েছিল; সেই ঠোঙায় বিলেতি দুধ নিয়ে বাসায় ফিরছি। আমরা তখন আলমডাঙা থানা কাউন্সিলের দোতালা সরকারি বাসভবনে থাকতাম।

আমি বন্ধুদের সাথে হাতের ঠোঙায় বিলেতি দুধসহ ফিরছি বাসার দিকে। অথচ সেদিন বাসায় না ফিরে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মিশে গিয়েছিলাম পাখি শিকারিদের সাথে। আদিবাসী ওরা। ওদেরকে বলা হত কলু। আসলে শব্দটি ছিল কোল; যে যার মত করে বলত কলু, কুলু, কোল। মুণ্ডাদের থেকে পৃথক ছিল ওদের স্থিতিহীন জীবন। ওদের হাতে থাকত লম্বা লম্বা চিকন বাঁশ। প্রতিটি আলোকিত সেই বাঁশ লম্বায় পাঁচ ছ হাত। একটির মাথা আরেকটির ভেতর ঢুকিয়ে তিন চারটি বাঁশ জোড়া দিয়ে, এভাবে সকলের উঁচুতে যে বাঁশটি থাকত তার মাথায় এক ধরনের আঠা লাগান থাকত। খুব সন্তর্পণে জোড়া দেওয়া প্রায় পঁচিশ ত্রিশ হাত বাঁশ ঝাঁকড়া কোন বট, পাকুড় অথবা দেবদারু, গাব অথবা পুরোন কোন ছফেদা গাছ, আর আমি তখন সেই পুরোন গন্ধে কাঁপতে থাকা সব রকমের বৃক্ষরাজির নামও যে ঠিকঠাক জানতাম তেমনও নয়; যাই হোক সেই পুরোন আকাশ-প্রবণ বৃক্ষের ঝাঁক ঝাঁক শাখায় লুকিয়ে থাকা, নিরাপদে থাকা, বিশ্রামে থাকা, আনন্দে থাকা পাখির ঝাঁকের দিকে খুব ধীরে ধীরে ওরা ঠেলে দিত সেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর বাঁশ-শলাকা; সুদৃশ জাদুর লাঠি। দীর্ঘ বাঁশের মাথায় আঠার সাথে লেগে যেত সবুজ পাখি, কালো পাখি, লাল পাখি, ধূসর পাখি অথবা মেহগনি রঙের পাখি। আমি অবাক আনন্দে আর আশ্চর্য উত্তেজনায় তাকিয়ে থাকতাম সেই আঠায় আটকে যাওয়া পাখির দিকে; কী আশ্চর্য জান্তব জীবন; পাখা ঝাপটে উড়তে চাইছে শূন্যে! তারপর সেই পাখি কাচা বাঁশের খাঁচায় বন্দী হলে আমার উত্তেজনা, আমার আনন্দ বন্দী হয়ে যেত সেই খাঁচাবন্দী পাখির সাথে; আমি ক্রমাগত আটকে যেতে থাকতাম রহস্যের খাঁচায়। আমি ওদের সাথে সেই যারা বাঁশ চিরে চিরে কত রকম গৃহস্থালী তৈজস ধামা, কুলা অথবা মাছ ধরার সরঞ্জাম বানাতে বানাতে লাল কাঁচা রঙে ওগুলোকে রাঙিয়ে দিয়ে ওদের ভাষায় গান আওড়াতে আওড়াতে বিড়িতে আগুন ধরাত; আমি সেই তাদের সাথে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পিচ্ছিল তাজা দুপুরকে এলোমেলো ছড়িয়ে ফেলতাম। ওদেরকে কখনও হুকা খেতে দেখিনি আমি। ওরা বাস করত খালের ধারে। কখনও বা আমাদের স্কুলের পাশের খোলা জায়গায় অথবা ওদের আমি দেখতাম রাস্তার ধারে খালের পাশে উদোম রোদের নীচে শুয়ে আছে মহানির্বিকার। একদিন হাঁটের ভেতর সঙ্গন কাকাকে দেখে চিনে ফেলেছিলাম আমি। সঙ্গন কাকা আমাকে বাতাসা খাইয়েছিল। সঙ্গন কাকার ছেলের নাম ছিল পেঙ্গা। পেঙ্গার সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল বেশ আঠাল ভাবে। অথচ তখনও আমি জানতাম না এই আঠাল বন্ধনের জন্য আমাকে কাঁদতে হবে একদিন।


সুদীর্ঘ রোদের ভেতর, হাজার রঙের রাস্তার ভিড়ে আমরা দু’বন্ধু কাগজের ঠোঙার ভেতরে আমাদের নিরিবিলি স্পর্শকাতর আঙুল ঢুকিয়ে বিলেতি দুধ তুলে নিয়ে আমাদের জিহ্বা ঠোঁট সাদা করে নিতাম; দাঁতের সাথে দুধের মিহিগুড়া লেগে থাকতো; শুভ্র আঠাল; মিষ্টি তার অনুভব। এই অনুভবের ছোঁয়ায় পেঙ্গা হেসে উঠলে, বটতলার বিল্লু পাগলার সাথে ওর এক ধরনের মিল খুঁজে পেতাম আমি। ওকে কখনও কাপড় পড়তে দেখি নি। নুনুর সাথে বাঁধা ছিল এক জোড়া ঝুনঝুনি। সেই শব্দকাতর ঝুনঝুনি ছিল ওর লজ্জাছোঁয়া পোশাক। স্পর্শকাতর ঝুনঝুনি বেজে উঠত কালো চামড়ার স্পর্শে। সেই বেজে ওঠা ধ্বনির সাথে কেঁপে কেঁপে উঠত ওর কালো ত্বক। আমার বন্ধুর নির্বোধ কালো মাজার সাথে লেপটে থাকত মোটা-কালো সুতো। সেই অলৌকিক সুতোর সাথে বাঁধা ছিল তিনটি মাদুলি; একটি রূপোরঙা আয়তাকার চ্যাপ্টা; দ্বিতীয়টি কালচে, লোহার পাত কেটে তৈরি গোলাকার মার্বেলের মত; আর আরেকটি ছিল বন্দুকের গুলির মত সিসারঙ লম্বাটে গোল। গলায় প্যাঁচানো ছিল কাপড়ের পাড় দিয়ে হাতে কাটা ফিতা। ফিতায় বাঁধা জোড়বাঁধা জাদুর দোলক; একটি পিতলরঙ অপরটি রূপোর পানিতে ধোয়া রূপোরঙ জাদুর তাবিজ।

সেই তখন, আমি ছিলাম উঠতি এক সাহেব-পুত্র। যে সাহেব দেশ স্বাধীন হবার আগেই গ্রাম্য টানাপোড়েন থেকে সাহেব হতে গিয়ে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না যে সে আসলে বাঙালি নাকি অন্য কিছু। আসলে সাহেব কাকে বলে তখন আমার বাবা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। তবে তাকে ইংরেজি আউড়াতে দেখতাম বিস্তর। আরও দেখতাম সাধারণ মানুষের সাথে তিনি মিশে গেলেও তার চারপাশে কেমন এক ধরনের ভয় জড়িয়ে থাকত। অথচ আমার বাবার কাজ ছিল কৃষকদের সাথে। তিনি ছিলেন বিএডিসি-র কৃষি কর্মকর্তা। অথচ কৃষকরা তাকে, তার পুত্রকে যেন বা রাজাজ্ঞানে পুঁজো দিত। তখনকার সময়টাই ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের অপার বিস্ময়ের সময়। তখন তাদের কাছে এক একজন শিক্ষিত আধা শিক্ষিত মানুষ মানে এক একজন রাষ্ট্রনায়ক; যাবতীয় সম্মানের একক অধিকারী। আর ওরা শিক্ষিত মানুষগুলোকে, সরকারের লোকগুলোকে ভক্তি করতে পারলে যেন বা বেহস্ত কিনে ফেলত, এমন একটা ভাব-পরিবেশ। এমন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে আমি চলতে চলতে কখন কীভাবে যে জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচির ভেতর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছি, তা বুঝতে না পারার মত কোন বিষয় নয়। বরং এর ভেতর জড়িয়ে আছে আমার অভিজ্ঞতার প্রতিটি স্তর; যে স্তরের সাথে মিশে গিয়েছে প্রতিটি দিনের প্রতিটি মানুষের প্রতিনিয়ত জান্তব হয়ে ওঠার গল্প। এই জান্তব জীবনের হাত ধরে একটু একটু করে আমি বুঝতে শিখেছি আমাদের ভেতর ভদ্রলোক হিসেবে দাবীকৃত অনেকেই, পাশ্চাত্য ধারায় সভ্য হয়ে উঠতে পারে নি এমন সাধারণ মানুষকে নীচু শ্রেণির মানুষ বলে খারিজ করে দিচ্ছে। অথচ পাঠক, আমি আপনাদের বিশ্বাস করাতে চাইছি পেঙ্গাকে আমি ভালোবাসতাম। তারপর আজকে এই বয়সে এসে আমি নিজেকে প্রশ্ন করছি, আসলে কি তাই? আমি তা বিশ্বাস করি না। আমরা লেখকেরা যখন নিজে যা বিশ্বাস করি না অথচ আপনাকে আমরা ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করিয়ে তা বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করি তখন আমার নিজের চেহারাটা কেমন দেখায় তা ভেবে আমি চমকে উঠি। লেখক জীবনের প্রকৃত যন্ত্রণা এখানেই; আমার ভালোবাসাকে, আমার বিশ্বাসকে আমি মিলিয়ে নিতে পারি না আমার রিয়েলিটির নিত্তিতে।

এই যে অপ্রিয় কথন, এর অনুসন্ধান আমি করতে শিখেছিলাম সেই আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক জীবন থেকেই। এখন আমি বুঝতে পারছি লেখকের অথবা একজন শিল্পীর নান্দনিক আবেগ রাজনীতিকদের কাছে যতটা অর্থহীন তার চেয়েও বেশি অর্থহীন আমার সেই প্রাথমিক জীবনের বন্ধু পেঙ্গাদের কাছে; যারা বেছে নিয়েছিল পাখি শিকারি জীবন; প্রাকৃত নিরাভরণ জীবন। এতটা জীবন পিছে ফেলে এসে আজ তাদের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারছি মানুষ হিসেবে আমি কতটা স্বার্থপর! যারা সুখের পেছনে ছোটে তারা স্বার্থপর। সেই পাখি শিকারির দল, তারা কি প্রতিনিয়ত সুখের পেছনে ছুটেছে? তারা কি স্বার্থপর? কেমন তাদের সুখ? তারা বসবাস করত অনিশ্চয়তার ভেতর, খাদ্যহীন, উলঙ্গ। অথচ আমি নান্দনিক আকাক্সক্ষায় আমার লেখায় নান্দনিক আবেগে বলতে চেষ্টা করি, এই যে অনিশ্চয়তার ভেতর বসবাস, এই যে স্বপ্ন, এই যে পরাজয় এগুলো ভয়ানক কষ্টের হলেও এর ভেতর এক ধরনের আনন্দ আছে; আছে স্বাধীনতা আর দিগন্তহীন উলঙ্গ জীবন। এইভাবে আমি জীবনকে সহনীয় আর রোমান্টিক চাদরে জড়িয়ে প্রকৃত বাস্তবতা থেকে আপনাকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আসি; তৈরি করে দেই এমন এক মিথ্যার জগত যেটা এক ধরনের নেশার জগত। মাতাল পাঠক অথবা প্রেমিক লেখক সকলেই কি নেশাগ্রস্থ, বাস্তববিমুখ? তাই যদি না হয়, আজ আমি কেনই বা জীবনের যাবতীয় নষ্টকাতর কষ্ট আর অপ্রিয় বাস্তবতাকে লেখার উপকরণ হিসেবে ছিড়ে ছিড়ে টেনে তুলতে শুরু করেছি বিস্মৃতির অতল গহীন থেকে?

এক একটি রাষ্ট্রীয় সময়ের মতো, একটি শাসন ব্যবস্থার সাথে আরেকটি শাসনকাল জোড়া দিয়ে যখন আমি বেড়ে উঠতে শুরু করেছি, তখন আমার মনে পড়তে থাকে সেই আলমডাঙার কোল যুবকদের বাঁশের সাথে বাঁশ জোড়া লাগিয়ে টিয়ে শিকারের কথা; যে সবুজ আর অস্থির টিয়ে আমি ইউনেস্কোর ভিক্ষে হিসেবে পাওয়া এক ঠোঙা সাদা বিলেতি গুড়ো দুধের বিনিময়ে পাওয়ার চেষ্টা করতাম; সেই রাষ্ট্রীয় সময়ের অন্ধকারে সারাদিন পর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হলে আমি পথ হারিয়ে ফেলি; একটি স্বাধীন দেশের ভেতর আমি ঠিক পথ চিনে নিতে পারি না। আমাদের ভেতর কেউ কেউ মেধাবীরা জামাতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবিরের দিকে, ছাত্রী শিবিরের দিকে, কেউ বা আমরা সরকারি দালানের গায়ে মোটা লাল দাগে লিখে রাখা জাসদের সাম্যবাদি শ্লোগানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জানতে পারলাম তখনও ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে; আর তখন এই যুদ্ধের বদৌলতে আমি ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দটির সাথে পরিচিত হয়ে উঠলাম। তখন ওরা আমার কাছ থেকে বিলেতি দুধের পরিবর্তে আমাকে একটি কাঁচা বাঁশের খাঁচায় বন্দী, একটি কাঁচা রঙের সবুজ টিয়ে দিলে আমি বাসায় ফিরে গিয়ে বাবার বকা খাবার ভয় ভুলে যাই; স্কুল থেকে সেদিন আমি বাসায় ফিরেছিলাম সন্ধ্যার অনেক পর।

সিরাজগঞ্জ বি.এল. স্কুলের টানা দালান-বারান্দার নীচে যখন আমি হাঁটছি তখন নারী বিষয়ক প্রবন্ধটি নিয়ে ভাবছি। আর তখন প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে পক্ষান্তরে আমার আলমডাঙায় ফেলে আসা প্রাইমারি স্কুলের জীবন, পেঙ্গাকে আশ্রয় করে আমার গোপন শ্বাস গ্রহণ আমার ভেতরে এক ধরনের কষ্ট তৈরি করতে শুরু করেছে। তখন আমার মামাতো বোনের লেখা গল্প পড়ে আমি বি.এল. স্কুলের মাঠে বসে কেঁদেছিলাম। গল্পের প্রধান চরিত্র স্কুল থেকে ফেরার পথে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। অথচ তখন আমার পেঙ্গার কথা মনে হল। মনে হল গল্পের ভেতরটা ঠিকঠাক মত উঠে আসেনি। আমি গল্প লেখার কথা ভাবলেও আমি প্রবন্ধের কাজ শেষ করার জন্য তাড়িত হলাম। এবং শেষ পর্যন্ত রওশন ভাইয়ের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটি আমাদের বি.এল. স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক পাঠ করলেন। দু’জন স্যার আমাকে তিরস্কার করলেন। কারণ নারীদের অবস্থান, যৌন জীবন ও বিবাহিত জীবনের গুটিকয়েক সত্যভাষ্য তুলে ধরার বিষয়টি তাঁরা ঠিক আমার মত এই বয়সে শোভন বলে মেনে নিতে পারেন নি। শিক্ষক দু’জনের একজন স্কুলে যাওয়ার সময় অথবা বাইরে কাজে যাবার সময় তাঁর স্ত্রীকে ঘরে তালা দিয়ে যেতেন। যাই হোক আমার হাই স্কুলের শিক্ষকদের তিরস্কার আমাকে লিখালিখির ক্ষেত্রে আরও অনুসন্ধানী করে তোলে। এ সময়ে ডি. সি. সাহেব সিরাজগঞ্জ শহরের হাড্ডিপাড়া অর্থাৎ যৌনকর্মীদের পাড়াটিকে উচ্ছেদ করে দেন। বারোয়ারি রমণীবৃন্দ যমুনা নদীর তীরে গিয়ে অস্থায়ী ব্যবসা ছাউনি গড়ে তোলেন। আমি আমার নারী বিষয়ক নিবন্ধটিকে কিছুটা প্রতিবেদনধর্মী করে তোলার জন্য রওশন ভাইসহ তিন চার দিন সেই ভাসমান নারীপল্লীতে যাই। সংগ্রহ করি খরিদ্দারদের বিচিত্র আচার আচরণ ও মনন জগতের রহস্যমুখর সংলাপ। সেইসাথে সংগ্রহ করি দেহজীবী রমণীদের জীবনকথা। সেই অভিজ্ঞতাকে আজও আমি গল্পে নিয়ে আসতে পারিনি। আনতে না পারার কারণ দেহ ব্যবসায়ীদের পল্লী নিয়ে এ যাবৎ অনেকেই লিখেছেন। আমি চাচ্ছি যা লিখা হয়ে ওঠেনি সেই অনুন্মোচিত বিষয়টিকে গল্পে ধারণ করতে। এখনও সেই জগৎটিকে উন্মোচন করতে সক্ষম হইনি আমি; অপেক্ষায় আছি।

লেখকের কলমে থাকে পরিশীলিত নান্দনিক জগত তৈরীর জাদুকরী তাবিজ; যা পাঠককে ইমোশনালি ব্ল্যাক মেইল করতে সক্ষম। রহস্যমুখর তৈরিকৃত দৃশ্যকল্প; যেখানে লেখক নিজেই মুখোশধারি ঈশ্বর; অথচ পক্ষান্তরে তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেন সাধু, যেন বা নিরপেক্ষ নিরাপদ বিবেক; তৈরি হয় স্টোরি নভেল ফিকশন; যা আমাদেরকে লেখকের সত্যিকার চেহারা থেকে দূরে সরিয়ে অনুভব ও প্রশান্তির ভেতর ঠেলে দেয়। পাঠককে শিল্পের বিভ্রমের ভেতর এই ঠেলে দেবার শক্তি আমি এখনও রপ্ত করতে পারি নাই; ফলে আমাকে দিয়ে স্টোরি নভেল অথবা ফিকশন লেখা সম্ভব নয়। আমি বাধ্য হয়েছি এর বিপরীতে সরাসরি নিজের চেহারাটিকে টেনে বাইরে এনে প্রকাশ করতে; যদিও বা সেই সাহস আমার কতটুকু আছে, সে বিষয়টিও প্রশ্ন সাপেক্ষ; যেমন ধরুন আপনাকে মনে মনে আমি চাবকাচ্ছি অথচ মুখে সৌম্য হাসি টেনে রেখে নিজেকে উপস্থাপন করছি সভ্য হিসেবে; হয়তো বা আপনাকে মা বলে ডাকছি অথচ ভেতরে জেগে উঠতে শুরু করেছে কাম। সমাজশাসিত রুচি নীতি ও শিক্ষা যে অনুভবগুলোকে আমরা সভ্য মানুষের সূচকচিহ্ন হিসেবে মানছি, সেই সমাজতাড়িত বোধ থেকে আমি যখন নভেল লিখছি তখন আমি নিজেকে গোপন করছি কৌশলে; আমার ভেতরের কামভাব আড়াল করে কাহিনীতে মায়ের সামাজিক আচরণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলছি। সুতরাং আড়াল; কেননা আমরা সভ্য হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নেমেছি; পক্ষান্তরে ক্রমাগত মিথ্যার মুখোশে বিভ্রম ফুটিয়ে তুলছি লেখায়। স্টোরি নভেল কবিতা অথবা নভেল এক ফ্যান্টাসির জগত, বিভ্রমের জগত, রূপ ও উপভোগের জগত, যেন বা স্বপ্নে কাঙ্ক্ষিত রমণীর সাথে রতিক্রিয়ার জগত। আমি দেখতে চাই, শিল্পের বিভ্রমকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি নিজের চেহারাটাকে তুলে ধরা সম্ভব কিনা। আমার ধারণা স্টোরি নভেল কবিতা অথবা ফিকশন এর কাঠামোতে এটি সম্ভব নয়। কেননা এগুলোর মূল চালিকা শক্তি, শিল্পের নান্দনিক বিভ্রম। আমি বিভ্রম থেকে বাইরে এসে বলতে চাইছি এন্টি ফিকশন, এমন একটা কাঠামোর ভেতর অভিজ্ঞতার অনুভব গেঁথে গেঁথে এমন একটা কিছু লিখতে যেখানে মানবজীবনের ধারাবাহিকতা থাকা সম্ভব নয়। আসলে অভিজ্ঞতা তো ধারাবাহিক কোন অর্জন নয়। আর জীবন তো আমার একার নয়, আপনার তার সকলের; আদিম বর্বর আর এই সময়ের; পূর্ব পশ্চিম উত্তর অথবা দক্ষিণের। ফলে ধারাবাহিকতা সেটাও এক ধরনের বিভ্রম; যা থাকে গল্পে অথবা উপন্যাসে। অথচ জান্তব জীবনে তা সম্ভব নয়। আর পক্ষান্তরে আমরা তো সবাই নিজেকেই লিখছি। আমি অর্থ প্রত্ন-অভিজ্ঞতা, জলজ-অভিজ্ঞতা, আদিম ও বর্বর জীবন থেকে ক্রমাগত সভ্য হয়ে ওঠার যাবতীয় সংকট। এই সংকটের প্রশ্নে নিজের ভেতরে কে কতখানি অপরকে বুঝে উঠতে পারছি; প্রশ্নটা সেখানে। পক্ষান্তরে আমি নিজেকে লিখতে গিয়ে শিল্পের অনিবার্যতায় ‘আমি’কে বিনির্মাণ করে মিথ্যা ‘আমি’কে উপস্থাপন করতে ইচ্ছুক নই। আমি চাই কাহিনীর নানামুখি ঐক্যনির্ভর বিভ্রমের প্রয়োজন দেখা দেবে না, লেখার ভেতর এমন একটি কাঠামো খুঁজে পেতে। কেননা ঐক্যসূত্রনির্ভর বয়ান যার জন্য প্রয়োজন হয় কমপ্লিট একটা কাহিনীকাঠামো; যার থাকবে শুরু বিকাশ এবং পরিণতি; আসলে জীবনের শুরু আর শেষ বলে তো কিছু নেই; জীবন অর্থ দৃশ্যমান প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ। এই দৃশ্যমান জগতের বাইরে যে অসংখ্য সৌরজগত, যা আমরা আপাতভাবে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিতে পারি না; সেই অদৃশ্য অভিজ্ঞতার জগতও কিন্তু জীবন; যার শুরু আর শেষ বলে ধারণা লালন করাও এক ধরনের বিভ্রম। আমি লেখার ক্ষেত্রে এই যাবতীয় বিভ্রম থেকে সতর্ক থাকতে ইচ্ছুক, যাতে লেখার ভেতর সত্যিকার ‘আমি’ বিনির্মিত হয়ে বিভ্রম ‘আমি’তে রূপান্তরিত হয়ে ওঠার সুযোগ পায়। আমি শিল্পের বিভ্রম তৈরিতে ঠিক সিদ্ধহস্তও নই; ফলে আমি রবিবাবু, শরৎবাবুর অথবা ইলিয়াসের মতো লেখার যোগ্যতা রাখি না। অবশ্য আমি কারো মত লিখতেও ইচ্ছুক নই। বরং লেখক হিসেবে আমি বিভ্রম সৃষ্টিকারী মুখোশ, সাধু ঈশ্বরের মুখোশ ঠেলে সরিয়ে সত্যিকার ‘আমি’কে লিখতে ইচ্ছুক; যদিও মানুষ প্রাণি জগতের আর সবার মত নোংরা জীব; এই নোংরা জীবকে সভ্যতার মোড়কে জড়িয়ে যাতে বিভ্রম সৃষ্টি না হয় সেই প্রচেষ্টায় আমাকে মুক্তগদ্যের আশ্রয় নিতে হচ্ছে; যদিও আমরা মানবীয় সূচকে প্রতিনিয়ত লড়াই করছি ঈশ্বর হবার বাসনায়। আমরা বাসনাজীবী জীব। এই বাসনার তাড়নায় আমরা নির্মাণ করি শিল্পের বিভ্রম। তারপরও বিভ্রমমুক্তির বাসনায় এন্টি ফিকশন।

আমি লেখালেখির প্রথম জীবনের ভাবনাগুলোকে জীবিত রেখে আজকাল এইভাবে ভাবতে শুরু করেছি। আমার অভিজ্ঞতায় আমি বুঝতে পারছি শুধুমাত্র আইডিয়ার তথ্যচিত্র অথবা ঘটনার ডিটেইলস অথবা উপস্থাপনার ঐক্যরীতিই ছোটগল্পের অপরিহার্য কৃৎকৌশল নয়। এগুলি পৃথক প্রকৌশলে সব সময় গল্পে প্রযোজ্য হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ কথাসাহিত্যের জন্য শুধুমাত্র একটি কৌশলই ক্রিয়াশীল নয় বরং একখানা সফল গল্পের জন্য আইডিয়ার তথ্যচিত্র, ঘটনার ডিটেইলস ও উপস্থাপনার ঐক্যরীতি, এই তিনটি বিষয়ের যৌক্তিক ব্যবহার গল্পে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু সেই সাথে গল্পের জন্য প্রয়োজন প্রকাশযোগ্য ক্রাইসেসের একটি নান্দনিক উপস্থাপন। এক্ষেত্রে পয়েন্ট অব ভিউ থাকতে পারে আড়ালে; তারপরও এই জায়গাটা লেখকের কাছে পরিষ্কার থাকা জরুরি। অনেকেই এ জায়গাটি নিজের ভেতরে পরিষ্কার বা চিহ্নিত না করেই লিখতে শুরু করেন এবং ভাবেন যে লেখাই তাকে টেনে নিয়ে যাবে কোন একটা ক্রাইসেসের দিকে; হ্যাঁ এভাবে লেখা যেতে পারে তবে মনে রাখতে হবে, এভাবে লিখতে লিখতে লেখক কিন্তু গল্পের পয়েন্ট অব ভিউ চিহ্নিত করে ফেলেন। এভাবে পয়েন্ট অব ভিউ বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে পারে ডিটেইলসে; যদি প্রয়োজন হয় তবেই। তা না হলে শুধুমাত্র সিম্বল আর ইঙ্গিতের মাধ্যমেও গল্পের মোক্ষম মেসেজটিকে পাঠকের মগজে গেঁথে দেওয়া সম্ভব।

একই বিষয়ের অনুষঙ্গ ধরে বলা সম্ভব, একটি সফল ছোটগল্প নির্মাণের জন্য প্রধান শর্ত আসলে ঘটনা বা কাহিনীর যৌক্তিকতা বা শুধুমাত্র গল্পের ঘটনা প্রবাহের ওপরই এর সফলতা নির্ভর করে না। বরং ঘটনা বিন্যাসে যখনই সংযোজিত হয় ঘটনা প্রবাহ, ঘটনার ছবি অথবা নাটকীয়তার অতিরিক্ত একটি উপলব্ধিজাত জগত তখনই গল্প শুধুমাত্র ঘটনা প্রবাহের বর্ণনার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ না থেকে সার্থক ছোটগল্পের সীমানায় প্রবেশ করে। আর তা যদি গল্পে সম্ভব না হয় তা হলে আমরা দৈনিক কাগজের রিপোর্ট পাঠকেই যথেষ্ট মনে করতাম, ছোটগল্প পাঠের আর কোন প্রয়োজন হত না।

সুইজারল্যান্ডের গল্পকার পেটার বিকসেল-এর গল্পে দেখা যায় ছোট ছোট ঘটনা ও ছবি। আর কিছুই নেই। নেই লেখকের উপস্থিতি ও ব্যাখ্যা। ঘটনা বিশ্লেষণের কোন ঝোঁক নেই। কিন্তু ছোট ছোট ছবিগুলি পাঠককে পৌঁছে দেয় অমীমাংসিত সত্যভাষ্যের জগতে। পাঠক হাবুডুবু খায়। পাঠকের মস্তিষ্ক উস্কে ওঠে। অবশ্য গল্প পাঠের এ সীমানায় পৌঁছিতে হলে পাঠকের মগজেও ঘিলু থাকতে হবে।

যাই হোক, সার্থক ছোটগল্প সৃজনের কলাকৌশলের কথা বাদ দিলেও, আমাদের ছোটগল্পের কথা যদি বলি তাহলে দেখা যাবে সত্যিকার অর্থে বাংলা কবিতার মত তিরিশোত্তর জোয়ারের হাত ধরেই কিন্তু আমাদের কথাসাহিত্যের ভিত্তি তৈরি হতে শুরু হয়েছে। যদিও অনেকের মত আমিও এ কথাটি বলছি তারপরও আমি বলব এমনতর মতামতের সাথে আমি ঠিক এক মত হতে পারি না। বরং বলা সম্ভব ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে এ সময় বেশ কিছু লেখকের আগমন ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র বলয়ের গল্পকারদের প্রেসক্রিপশন ছিল, ছোটগল্পের মধ্যে একটা দুটো কাহিনী থাকবে, তিন চারটি বানানো ঘটনা থাকবে আর ছোটখাট একটা নাটকীয় ইমেজ, বাঙালি সেন্টিমেন্ট, লোকবিশ্বাস আর বিরহবোধ অথবা সংসার বৈরাগ্য অথবা ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলিয়া দেয়’ এমনতর বিবিধ অনুষঙ্গ। বাঙালি সাধারণ হাসান-হোসেনের ধার করা কারবালার কাহিনীর পাশাপাশি অপু-দূর্গা, দেবদাস-পারু সকলের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত করে রাখলেন। সেখানে মহেষের জন্য কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ঝরতে থাকে, সেই সাথে জোহরার মৃত এক জোড়া বাস্ত সাপের জন্য হা-হুতাশ বাড়তে থাকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এসে বাঙালি পাঠকদের রুচীতে খানিকটা ধাক্কা দিলেন। ফলে পাঠকদের পক্ষে সম্ভব হল ওয়ালীউল্লাহকে বুঝে ওঠার। এই সময়কালে অর্থাৎ বিভাগপূর্ব ও বিভাগ উত্তর কালে আমরা পাচ্ছি সরদার জয়েন উদ্দীন, আলাউদ্দীন আল আজাদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শাহেদ আলী, আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ। ইনারা সকলেই একাধারে মেধাবী এবং নৈরাশ্যবাদী। কেননা কার কাছেই বাংলাদেশ ও বাঙালি সমাজ দর্শনটি তখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। বরং সকলেই ছিলেন কলোনীর অধিবাসী। সুতরাং ওয়ালীউল্লাহ দীর্ঘদিন ইয়োরোপে বসবাস করে ‘দুইতীর’ (১৯৬৪) নামক যে গল্পগ্রন্থটি উপহার দিয়েছেন সেখানে বাঙালির পোশাকের অন্তরালে রয়ে গেছে সার্তের অসুস্থতা, সেই সাথে কাফকার নৈরাশ্য চেতনা। অবশ্য দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর আধা-নগরচেতনায় শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কাছ থেকে তখনকার প্রেক্ষাপটে প্রায়োগিক সমাজবীক্ষণ আশা করাটা যৌক্তিক নয়।

এ অবস্থার মধ্য দিয়েই ছোটগল্পের ধারাবাহিকতাকে বহন করেছেন আবুল ফজল, শওকত ওসমান, বুলবুল চৌধুরী, আবু রুশ্দ, শাহেদ আলী, মহীউদ্দিন চৌধুরী, মবিনউদ্দীন আহমদ, আকবর হোসেন, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আবু ইসহাক প্রমুখ ছোটগল্পকারগণ। যাঁরা কিনা বিভূতির নেশায় ডুবে থাকলেও তাঁদের মধ্য থেকে শওকত ওসমান এক ভিন্ন শিল্প কৌশলকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করতে পেরেছিলেন। হয়তো এই একই কারণে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এরই মাঝে লিখেছেন শওকত আলী, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, রাবেয়া খাতুন, জহির রায়হান, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, মিরজা আবদুল হাই, সুচরিত চৌধুরী প্রমুখ। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যৌক্তিক, শ্রেণি সচেতনতা, সমাজের নিচু তলার মানুষদের প্রতি পক্ষপাত ইত্যাদি বিষয়গুলো যা কিনা রবীন্দ্রনাথেরই সরলরেখাধর্মী ব্যক্তি ও পরিবার নির্ভর ছোটগল্প; যেখানে রয়েছে নিচু তলার মানুষের প্রতি করুণা ও পক্ষপাত; যে কাহিনী উঠে এসেছে একটা করুণ ও ক্লান্ত ট্রাডিশনাল ঘটনাকে অবলম্বন করে পাক খেতে খেতে একটা সরলরেখায় মিলিত হয়ে স্থান-কাল-পাত্রের ঐক্যসূত্রে এসে মিলনাত্মক অথবা বিয়োগাত্মক চেতনায় এসে শেষ হয়েছে। এই একই নন্দনতত্ত্বের অনুসারি হয়েছেন ৪০-৫০ দশকের ছোটগল্পগুলিও; যা কিনা অবক্ষয়পূর্ণ আধুনিকতারই ফলাফল, ঔপনিবেশিক আধুনিকতারই ফলাফল। আমার মনে হয় সভ্যতার এই সংকটের বিষফল থেকে ষাটের দশকের গল্পকারগণও মুক্তি অর্জন করতে পারেন নি। কেননা এ অবস্থায় কোন গ্রহণযোগ্য সমাজতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই গল্প লিখতে বসলেন ষাটের গল্পকারগণ। জ্যোতি প্রকাশ দত্ত এবং হাসান আজিজুল হক পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহ করে তাঁদের লেখায় সমসাময়িক আধা-গ্রাম আধা-শহরকে চিত্রিত করলেন। পাঠকবর্গ বাজারের বালশোভন গল্প লুফে নিলেও (যেমন আজও পাঠকের মেধা হুমায়ূন আহমেদের ছেলেমিপনার মধ্যে সীমাবদ্ধ) আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু বকর সিদ্দিক, রাহাত খান, মাহমুদুল হক, রশীদ হায়দার, আহমদ ছফা, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, মাহবুব তালুকদার, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, পূরবী বসু, সাদেকা শফি উল্লাহ, খালেদা এদিব চৌধুরী, জুবাইদা গুলশান আরা, সুব্রত বড়ুয়া, বশীর আল হেলাল, অরূপ তালুকদার, আশীষ কুমার লৌহ, আলমগীর রহমান, এহসান চৌধুরী, কায়েস আহমেদ, বুলবুল ওসমান, মুস্তফা আনোয়ার, জুলফিকার মতিন প্রমুখ ছোটগল্পকারদের অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ছোটগল্পের অন্তর্ভুবনে জেগে থাকলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং হাসান আজিজুল হক। সেই সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অল্প কিছু গল্পের কারণে ইনারা বিমর্ষও বোধ করলেন। অবশ্য এই বিমর্ষতা গল্প লেখার দায়বদ্ধতা থেকেই উৎসারিত। বুঝতে পারলেন বাংলা ছোটগল্পের জন্য নোতুন আঙ্গিক অপরিহার্য, কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব তা নির্ধারণে হোঁচট খেতে খেতে হতবাক হলেন; যখন দেখলেন বাংলা ছোটগল্প ইতিমধ্যে অর্থাৎ শতাব্দীর শেষ দশকে এসে স্পষ্টত একটা বাঁক নিতে শুরু করেছে। তারপরেও ইনারা যেহেতু ভারতবর্ষের ইতিহাসকে পুনর্বিবেচনায় আনার বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামাতে অভ্যস্থ নন সেহেতু এই বাঁক পরিবর্তনকে তাঁরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে মেনে নিতে কার্পণ্য বোধ করবেন এটাই স্বাভাবিক।

অবশ্য ইতিবাচক দৃষ্টি না থাকারও কারণ রয়েছে। যেমন বর্তমানে গল্পে দেখা যাচ্ছে সহজ বিষয় বস্তুকে বর্ণনায় দুর্বোধ্য, রহস্যময় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাব্যিকতাময় করার চেষ্টা চলছে। অথচ এক্ষেত্রে আমাদেরকে সতর্কতার সাথে ভাবা উচিত একজন শক্তিশালী গল্পকার সহজ বিষয়কে অযথা দুর্বোধ্য করে তোলেন না। আমরা হয়তো ব্যর্থ পাঠক হিসাবে বিষয়টির মধ্যে কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না; ফলে আমার আপনার কাছে বিষয়টিকে সহজ মনে হচ্ছে; মনে হচ্ছে লেখক অযথাই একটি সহজ বিষয়কে প্যাঁচিয়ে জটিল করে তুলছেন। কিন্তু মগজ খাটিয়ে দেখুন বিষয়টি ফালতু নয় বরং সেই অনুন্মোচিত গূঢ় বিষয়টিকে প্রকাশের জন্য এটিই ছিল একমাত্র উপযুক্ত ভাষাশৈলী। আর হ্যাঁ এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ গল্পকারগণ লেজেগোবরে গুলিয়ে ফেলে অযথা দুর্বোধ্যতার আশ্রয় নিয়ে পাণ্ডিত্য জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ রকমের অভিযোগ বা গল্প লেখার ক্ষেত্রে এ রকমের অরাজকতা মেধাহীন গল্পকারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

রহস্যময়তা এবং কাব্যিকতা গল্পের প্রয়োজনে বিষয়ের ওপর ভর করে একজন শক্তিশালী গল্পকারের হাত দিয়ে অবশ্যই উঠে আসতে পারে; পক্ষান্তরে তা গল্পকে নান্দনিক মাত্রায় উন্নীত করে। তবে অনুরোধ তা যেন মেধাহীন গল্পকারের হাতে না ঘটে। তা হলে পাঠকের বিভ্রান্ত হবার সম্ভবনাটি থেকেই যায়। এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে আমরা তা হলে গল্পহীনতার গল্প বলতে ঠিক কী বোঝাবো?

গল্প বলতে কি আমরা ঘটনা প্রবাহের বর্ণনাকৌশলকে বুঝবো? গল্প কি মূলত ঘটনানির্ভর? আসলে কাহিনী উপস্থাপনার জন্যই কি গল্প লেখা হয়? হ্যাঁ লেখা হয়, যা ছিল রবীন্দ্রবলয়ের প্রেসক্রিপশন। তারপর অনেক অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। হয়েছে অনেক গল্প লিখা। তো এখন আর মেধাবী পাঠক শুধুমাত্র ঘটনার বয়ান শুনতে রাজি নন। কাহিনীর যথাযথ বয়ান শোনার জন্য তো সংবাদ পত্রের শিরোনাম, বড়োজোর সংবাদটি আগাগোড়া পাঠই যথেষ্ট। এই যে ঘটনাটি তিনি পাঠ করলেন তারপরের বিষয়গুলি তিনি জানেন না অথবা এই ঘটনার অন্তরালে যে সত্যভাষ্যের জগত রয়েছে তা উন্মোচন করতে সংবাদপত্র ব্যর্থ। এক্ষেত্রে গল্পহীনতার গল্প সংবাদপত্রের ঘটনা উপস্থাপন রীতিকে অর্থাৎ রিপোর্টকে পরিত্যাগ করছে; কেননা পাঠক তা সংবাদপাঠে পেয়ে যাচ্ছেন; সেটি আর তাকে দ্বিতীয়বার পড়ার প্রয়োজন নেই। কেননা পাঠক প্রাত্যহিকতার প্রেসারে এই অসংখ্য ঘটনাবলী, নাটকীয়তা আর কাহিনীর মধ্যেই বসবাস করে আসছেন; সেক্ষেত্রে গল্পহীনতার গল্প এগুলির পরিবর্তে এর অতিরিক্ত সত্য ভাষ্যের অনুসন্ধান করে। সেক্ষেত্রে গল্পকারের কাছে কাহিনী অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব লাভ করে, কাহিনী-অতিরিক্ত যে জীবন জিজ্ঞাসা, যে ম্যাসেজ, যে ক্রাইসেসটি পাঠকের মগজে লেখক উস্কে দিতে চান, সেই বিষয়টি। ফলে ট্রাডিশনাল কাহিনীর কাঠামোকে যখন লেখক ইগনোর করতে বাধ্য হলেন তখন গতানুগতিক গল্প পাঠে অভ্যস্ত পাঠকের কাছে মনে হতে থাকল আসলে এর মধ্যে কোন গল্প নেই। সুতরাং সৃষ্টি হল গল্পহীনতার গল্প নামে একটি ধারণা। কিন্তু সবিনয় নিবেদন, পাঠক একটু মগজের চক্ষু বৃদ্ধি করুন, দেখবেন গল্পহীনতার গল্পের মধ্যে রয়েছে আরও অসম্ভব ইঙ্গিতধর্মী তাৎপর্যধর্মী অসংখ্য গল্পের অনুষঙ্গ ও ফলাফল। যখন আপনি সংবাদপত্রের রিপোর্টের মত গল্পগুলি পাঠ করে আর তৃপ্তি পাবেন না তখন আপনাকে ফিরে আসতে হবে গল্পহীনতার গল্পের কাছে। আর এতে গল্প আছে অবশ্যই তবে তাকে উচ্চ গ্রামে টিউন করে নিতে হয়। সঙ্গীতে কথা আছে আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কথাহীন অথচ...!

আমরা অনেকেই গল্প লিখতে এসে পূর্বসুরী থেকে পাঠ গ্রহণ করি; যাকে অনেকে অনুকরণ বা অনুসরণ বলার চেষ্টা করি। প্রকৃত বাস্তবতায়, বলা চলে গল্প লেখার কৃৎকৌশলের ক্ষেত্রে তা অনুকরণ বা অনুসরণ নয়। অনুকরণ করে বেশিদিন লেখা সম্ভব নয়। তারা টিকে থাকবেন না। এখনও শরৎচন্দ্রের অনুসরণে অসংখ্য লোকজন গল্প-উপন্যাস দেদারসে ছাপছেন। এতে লাভ হচ্ছে প্রকাশনী ব্যবসার। এ শ্রেণিটাকে আলোচনায় না আনাই উত্তম। এই শ্রেণিটা কোনোদিন দু’পাতা পাঠ করার যোগ্যতা রাখে নি কোন কালেই। তবে লেখালেখির জগতে ইনারা ছিলেন এবং থাকবেন। কেননা সমাজবাস্তবতায় পাঠকের অবস্থান রুচি শিক্ষা পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা সমকাল থেকে এগিয়ে থাকার প্রবণতা সব কিছুই কিন্তু বিবেচ্য বিষয়; আর এই সূচকসমূহ বিবেচনায় রাখলে প্রকৃত বাস্তবতায় দেখা যায় একজন মেধাবী লেখকের পক্ষে কোন ক্রমেই সমকালে ব্যাপক অর্থে পঠিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ফলে আমাদের ভেতর অধিকাংশই ট্রাডিশনাল গল্পের ফর্মকে ভাঙার সাহস বা মেধা রাখেন না। কাজেই প্রশ্নটি ওঠাই স্বাভাবিক। তবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ থেকে শুরু করে আমরা যাঁদের কথা বলে থাকি অথবা বলার চেষ্টা করি তাঁদের ফর্মের কথা অথবা যা-ই বলি না কেন, সে জায়গাটিতে পৌঁছিতে তাঁদেরকেও ইতিপূর্বে বাংলা ভাষায় যে ছোটগল্পগুলি সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলির উপরই দাঁড়াতে হয়েছিল। শূন্য থেকে শুরু করেন নি কেউ। আমি বলব, শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এতে তাঁর অসুবিধের চেয়ে সুবিধেই বেশি ছিল। তিনি যা-ই লিখেছেন তা-ই ছিল গল্পের ভাষা। তা-ই ছিল তাঁর নিজেস্ব ভাষা। আর এখন যত প্রতিভাধরই হোন না কেন তিনি যা-ই লিখবেন সেক্ষেত্রেই বলা হবে নিজের মত নয় অথবা নিজের ভাষা নয়। এর কারণটা হল রবীন্দ্রনাথের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলা ছোটগল্পের ফর্ম নিয়ে, ভাষা নিয়ে এত বেশি নিরীক্ষা করা হয়েছে যে রবীন্দ্রনাথের পর আর কোন গল্পকারের ভাষাকেই একান্ত নিজেস্ব ফর্ম বা ভাষা হিসাবে মন্তব্য করা অনেকটা অযৌক্তিক। এমনকি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। আর এখন যারা লিখছেন তাদের নিজস্ব কণ্ঠস্বর তৈরীর বিষয়টা নির্ভর করছে তারা আর কতদূর পর্যন্ত লিখবেন তার ওপর।

তারপরও আমি মনে করি, সভ্যতা-বিজ্ঞান-বিশ্বরাজনীতি আর পৃথিবীর আবহাওয়া যদি পাল্টাতে থাকে তা হলে এই সময়ের শিল্পীগণ একটু ভিন্নভাবে আরও একটু সূক্ষ্মভাবে ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। আর সেই ভাবনা যদি ছোটগল্পে উঠে আসতে চায় তা হলে সে গল্পের কৃৎকৌশলতো একটু বদলাবেই। এই যে অনিবার্য পাল্টে যাবার সময় এসেছে এটা বাংলা ছোটগল্পের একটা সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে যারা সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিষয়গুলিকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হবেন তারা ছিটকে পড়বেন। জীবন উপলব্ধির সূক্ষ্মতার কারণেই এখনকার কারো কারো ছোটগল্প আর ফ্লাড কাহিনী নির্ভর নয় বরং তা মনন জগতের কার্যকলাপ নির্ভর, মস্তিষ্ক নির্ভর।

এ ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি, বিশ্বের সমকালীন ছোটগল্প আঙ্গিকগত গুণধর্মে যতটা সূক্ষ্মতা অর্জন করেছে সে ধরনের কনটেন্ট ও উপস্থাপনরীতি নিয়ে যে ইদানিং আমাদের ভাষায় কাজ হচ্ছে না তা নয়। তবে সমস্যা হচ্ছে পাঠক। পাঠক এখনও রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের গল্প বলার ঢঙে সীমাবদ্ধ। সেখানে তীব্র ইঙ্গিতধর্মী আবহ সংযোজন করলে তারা হাবুডুবু খান; বিরক্ত হন বরং হুমায়ূন আহমেদের গল্পে আপ্লুত বোধ করেন। বোরহেস-এর গল্পগুলি পাঠ করলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে ঘনসংবদ্ধ রচনাবৈশিষ্ট্য। এক মাত্রার বাক্যের মধ্যে ঠেসে দিয়েছেন বহুমাত্রিক অর্থমাত্রা ও ইঙ্গিত। যা পাঠককে আপাত জগত থেকে আরও দূরতম জগতে নিয়ে যায়। আর ক্রমাগত উন্মোচন করতে থাকে অধিকতর দূর্বোধ্য অথচ স্পর্শযোগ্য সত্যভাষ্যের জগত। ফলে যে জীবনবোধের সন্ধান তিনি দিয়ে থাকেন তা শুধুমাত্র একরৈখিক একটা নিরেট গল্পের মধ্যে সম্ভব নয়, তা যত চমৎকার কাহিনীই হোক না কেন। মানুষের অন্তর্জগতকে সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছভাবে দেখার কৌশল ফ্লাড গল্পে সম্ভব নয়। আর এ কারণেই সুবিমল মিশ্র ফ্লাড গল্প লিখতে ব্যর্থ হয়েছেন; কেননা ফ্ল্যাড গল্প শুধু কাহিনীই বর্ণনা করে অন্য কিছু নয়। এই অন্য কিছুর অনুসন্ধানে বিশ্বের সমকালীন ছোটগল্প ব্যস্ত। এই নিরীক্ষাটি নব্বই দশক থেকে আমাদের ভাষাতেও শুরু হয়েছে। এটা একটা ইতিবাচক দিক। তবে আবারও বলতে হয়, ইয়োরোপে শিল্প সাহিত্যের যে কৃৎকৌশল আবিষ্কৃত হয় তা আমাদের এখানে পঞ্চাশ থেকে একশ’ বছর পরে এসে জোয়ার তোলে; আর সেই জোয়ারের ছিটেফোটাও আধুনিক পাঠক কমিনিকেট করতে পারেন না। সে কারণে বিশ্বসাহিত্যের কলাকৌশলের সাথে আমাদের সাহিত্যের অবস্থান বিবেচনা করা অনেকটা শ্লেষাত্বকও বটে বরং নান্দনিকতার মানদণ্ড হওয়া উচিত প্রাচ্যের সাথে প্রাচ্য।

ল্যাটিন আমেরিকার ‘ক্রিস্টিনা পেরি রসি’র নাম স্মরণে আসছে। যিনি সমকালের গল্পের ভাষাকে মানস জগতের অলিখিত বোধের কাছাকাছিতে নিয়ে যাবার জন্য যে নিরীক্ষার পরিচয় দেন তা মানব ভাষাকে আরও সম্ভাবনাময় করে তোলার দরজা উন্মোচন করে; যদিও আমি লেখক হিসেবে কারো লেখার কৃৎকৌশলকেই উদাহরণযোগ্য মনে করি না কেননা শেষাবধি একজন সৃষ্টিশীল লেখকের উদাহরণ একমাত্র তিনি নিজে; কালোত্তীর্ণ লেখা কোন লেখকের চেয়ে কোন লেখকের কোন লেখাটি উন্নততর এটা কখনও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় অথবা শিল্পের ক্ষেত্রে এ ধরনের চিন্তা এক ধরনের হাস্যকর মানসিকতা মাত্র। গুয়াতেমালার ‘কার্লোস ওয়াইল্ড ওসপিনা’র কথা বলা সম্ভব। তাঁর ‘দি অনার অব হিজ হাউজ’ গল্পে মানব চরিত্রের অন্তর্গত পরিবর্তন কীভাবে পরিবেশ ও প্রাসঙ্গিক অনুষঙ্গের ওপর ভিত্তি করে অপরিহার্য হয়ে ওঠে তা চিত্রিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কাহিনী নির্মাণ ও নাটকীয়তা মুখ্য হয়ে ওঠেনি বরং মুখ্য হয়ে উঠেছে সাইকোলজিক্যাল ট্রিটম্যান্ট। ভারতের ‘প্রীতি ডেসা’র গল্পের প্রসঙ্গ আনা যেতে পারে। এই লেখিকা ইংরেজিতে লিখেন। তাঁর গল্পে নাটকীয়তা ও কাহিনী থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত কাহিনীর সীমাবদ্ধতাকে উত্তীর্ণ করে। তিনি জানেন কীভাবে প্রতিদিনের বিভৎসতাকে ক্লাসিক নন্দনে পাল্টে ফেলতে হয়। সুতরাং গল্পের কাহিনী তাঁর কাছে ভিন্ন মাত্রা লাভে সক্ষম। ‘মার্কোজ’ এর গল্পের প্রসঙ্গ টানলে বলতে হয় আমাদের এই সময়ের ছোটগল্পকে আরও খানিকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে তার ইঙ্গিত যে ইতিমধ্যে কিছু কিছু লেখায় পাওয়া যাচ্ছে না তা নয়। তবে এ কথা ঠিক রুশদি কথিত বিচ্ছিন্নতা ও অনিকেত বোধের এক অনিশ্চয়তার গভীর তলকে যেভাবে ‘ঝুম্পা লাহিড়ী’ তাঁর গল্পে উপস্থাপন করে থাকেন তার প্রতিভাস আমাদের এই সময়ের গল্পে উঠে আসতে শুরু করেছে। তবে ঝুম্পার প্রেক্ষাপট আর আমাদের প্রেক্ষাপট অবশ্যই ভিন্ন। উর্দু ভাষার লেখক ‘ইনতিজার হুসেইন’ ও ‘আহামদ সাদি’র লেখায় কিস্সা ও মিথ গল্পের উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যা এই সময়ে আমাদের গল্পেরও একটা নিরীক্ষাপ্রবণ ক্ষেত্র; যার ফলাফল অবশ্যই ইতিবাচক। একই ভাবে ইতালির গল্পকার ‘নাতালিয়া গিনস্বার্গ’ এর কথা বিবেচনায় আনা প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক। এই গল্পকারের ভাষা কবিতাময়। তবে কবিতাক্রান্ত নয়। এই কবিতা ঘেঁষা ভাষা ছোটগল্পের জন্য যে একটা শক্তিশালী বাহন হতে পারে তারও আভাস ইদানিংকালের কারো কারো লেখায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার ‘এলসা জুবার্ট’ অথবা ঐতিহ্য প্রবণতা, মিথ, দর্শন যা-ই বলি না কেন দক্ষিণ আফ্রিকার মত ল্যাটিন আমেরিকার গল্পেও সব মিলিয়ে যে দেশজবোধ নির্ভর একটা নোতুন ঘরানা তৈরি হয়েছে তা আমাদের জীবনবোধের প্রেক্ষাপটে বিচ্ছিন্নভাবে উঠে আসতে শুরু করেছে বলে ভাবা অযৌক্তিক কিছু নয়। যদিও এক সময় ইয়োরোপ জুড়ে অ্যাবসার্ড নাটক ও গল্পহীনতার গল্পের জোয়ার লক্ষ করা গিয়েছিল এবং যদিও সে জোয়ারে ভাটাও পড়েছে তথাপি এত বছর পর আমাদের গল্পকারগণ এ বিষয়গুলি নিয়ে নোতুন করে অনুসন্ধান করতে শুরু করেছেন। কেননা তাদের বিশাল জীবন জিজ্ঞাসাকে উপস্থাপনা করার জন্য বাংলা ভাষার ধারণ ক্ষমতা আরও ব্যাপক হবার প্রয়োজনীয়তা ইতিমধ্যেই দেখা দিয়েছে। সুতরাং শব্দের সমূহ সম্ভবনাকে বাজিয়ে দেখার জন্য শব্দের আঙ্গিক নিয়ে নোতুন নোতুন নিরীক্ষা লক্ষ করা যাচ্ছে ইদানিং। বিষয়গুলি সমসাময়িক বিশ্বের অর্থাৎ অতি আধুনিক বিশ্বের অস্থির জীবনবোধের প্রেক্ষিতে অন্যান্য ভাষাতেও ঘটতে দেখা বিচিত্র কিছু নয়। যেমন কানাডার ‘মার্গারেট অ্যাটউড’ অথবা ফিলিপাইনের ‘পলক্রা এম. নীটস’ যার কথাই উল্লেখ করি না কেন তাঁদের ভাষায় তাঁরা পুরোন সম্পদকে ব্যবহার করে নোতুন অর্থমাত্রা সৃষ্টির প্রতি মনোযোগী হয়েছেন। এভাবে অনেকের কথাই উল্লেখ করা সম্ভব। যাদের সমস্ত লেখা আমরা ঠিক সময় মত হাতের কাছে পাই না অথবা সংগ্রহ করতে পারি না অথবা এখনও আমরা গল্প লেখকেরা সমসাময়িক বিশ্বের দিকে নজর দেবার সময় পাই না; নিজেদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করি। অথচ ইন্টারনেটের বিশ্বে আমাদের আরও একটু অগ্রসর থাকাই হয়তো উচিত।

গল্প লেখার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ভাবে আমি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গল্পের প্লট নির্বাচনকে অপরিহার্য মনে করি না বা প্রাধান্য দেই না। অপরিহার্য মনে করি গল্পের কেন্দ্রীয় থিম বা মেসেজকে; আর এই থিম বা মেসেজকে আশ্রয় করে যে ক্রাইসেসের সৃষ্টি হয় সেটাই হচ্ছে আমার গল্পের নিউক্লিয়াস শক্তি। সুতরাং গল্পের প্লট কী হবে, কোন দিকে মোড় নেবে তা আর আমার ওপর নির্ভর করে না; নির্ভর করে এই নিউক্লিয়াস শক্তির ওপর। হতে পারে এই নিউক্লিয়াস শক্তিই লেখককে টেনে নিয়ে যায় আরও বিস্তীর্ণ সীমানায়। এর কারণ মানব জীবনকে অধিকতর বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে ও জীবনবোধ থেকে ব্যাখ্যা করার অপরিহার্য তাড়না থেকে জন্ম নেয় সমগ্র মানব গোষ্ঠীর জীবনের সমান গল্প লেখার এক অপরিহার্য জাদুকরি কৌশল; যে কৌশলকে বাস্তবায়ন করতে হলে গল্পকারকে উপন্যাসের কাছেই ফিরে আসতে হয়। অবশ্য আগামীতে হয়তো ঢাউস ঢাউস উপন্যাসের কাছে না ফিরে গিয়ে ছোটগল্প নিজেই এমন কোন কৌশল আবিষ্কার করে ফেলবে, যে কৌশলের দ্বারা ছোটগল্পের ভেতরই উপন্যাসের মত সুবিশাল জীবনের ক্যানভাসকে স্থান দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে। বলা সম্ভব এ রকম উদাহরণ কিন্তু আমরা পেতে শুরু করেছি।

এই ধরনের ভাবনা চিন্তার পাশাপাশি আমাদেরকে ভাবতে হচ্ছে বাজারের কথা। অবশ্য এ কথাও ঠিক যে লেখালেখির ক্ষেত্রে বাজার একটা বড় বিষয় যা একজন লেখককে খ্যাতি এবং পাশাপাশি রুচিহীন পাঠক তৈরিতেও বাজার সমান ভূমিকা রাখে। তবে বাজারী উপন্যাস বা ছোটগল্প অতীতেও ছিল এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এমনকি সব ভাষাতেই এমন একটা গড়পরতা ধারা চলে আসছে। এতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের সাহিত্য বাধাগ্রস্থ হয়নি। তবে এ কথা ঠিক এই বাজারী হয়ে ওঠার ধারাটি প্রতিভাধর ও চিন্তাশীল পাঠক সৃষ্টির অন্তরায়। ইলিয়াস পাঠ করার মত পাঠক আমাদের সমাজ তৈরী করতে পারেনি। অথচ এই সময়ের বাংলা ছায়াছবি নির্ভর পরগাছাদের লেখা পাঠ করার মত শিক্ষিত মানুষ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক থেকে শুরু করে ঘরের গৃহিনী তথা অলস সময় কাটানোর অজুহাত হিসাবে ডিশের পাশাপাশি ম্যাগাজিন ও এ জাতীয় বাজারী বইয়ের পাতা উল্টিয়ে থাকেন তারা এবং এই শ্রেণিটি দৈনিক সংবাদ পত্রটি পর্যন্ত গুরুত্ব সহকারে নিয়মিত পাঠের ধৈর্য রাখেন না। এই শ্রেণিটির মধ্যে ন্যূনতম বোধশক্তির জন্ম দেবার জন্য আমাদের বটতলার লেখকদের লেখাকে যদি অন্তত কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া যেত তা হলে জাতি কিছুটা হয়তো সুস্থ্য হয়ে উঠতে পারার সুযোগ পেত বলে আমার বিশ্বাস।

যাই হোক প্রসঙ্গক্রমে লেখা প্রকাশের কথা বলা যেতে পারে। অনলাইন পত্রিকা, লিটল-ম্যাগ, সাহিত্য পত্রিকা অথবা দৈনিক সংবাদপত্র নির্ভর সাহিত্য যাই বলি না কেন, সত্যি বলতে কি এখনও কোনটিই সাহিত্যের জন্য ঠিক উপযুক্ত প্লাটফর্ম হিসাবে আমাদের বাংলা ভাষায় চরিত্র অর্জন করতে পারে নি। তবে পারবে হয়তো; সেদিকেই আমরা হাঁটতে শুরু করেছি। এক্ষেত্রে লেখক অপেক্ষা পাঠক অধিক গুরুত্ববহ। পাঠককে হয়ে উঠতে হবে অনুসন্ধানী ও দায়িত্বশীল। যৌনপত্রিকা পাঠের চাহিদা থাকবে তাই বলে তো তা সাহিত্যের মূলধারা হতে পারে না। সে অর্থে সাহিত্যের উপযুক্ত ক্ষেত্র নির্মাণ করা মূলত সামাজিক বৈশিষ্ট্য নির্ভর একটি বিষয়; যে নির্ভরতার নিয়ন্ত্রক বস্তুত লেখক ও পাঠক উভয়ই। আসলে সঠিক উপযুক্ত ক্ষেত্রের ধারণাটা একটা অলীক স্বপ্ন মাত্র। সমাজ বিজ্ঞান তা বলে না। সাহিত্য সমাজ নির্ভর। প্রকৃত বাস্তবতায় সমাজ, স্বর্গের প্রতিচিত্র নয় যে আমার আপনার দর্শন ও নীতি মাফিক আমরা একটা ক্ষেত্র পেয়ে যাব। আর আমার আপনার দর্শন ও নীতি আরেক জন অথবা সমাজ মানবেই বা কেন? আমার দর্শন মোতাবেক কাজ করতে হলে বিচ্ছিন্ন ভাবে আমাকে একটা গোষ্ঠী তৈরী করে পৃথক ভাবে কাজ করতে হবে। এতে সমাজ-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আর সমাজ-বিচ্ছিন্ন ভাবে শিল্পের কাজ কীভাবে সম্ভব তা আমার বোধগম্য নয়। যদিও আমরা অনেকেই গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই গোষ্ঠীবদ্ধতা এক অর্থে সমাজের একটা অংশরূপ মাত্র। এই গোষ্ঠীবদ্ধতা শুধু বাংলা সাহিত্য নয় বিশ্বসাহিত্যের ক্ষেত্রেও সব সময় ছিল এবং থাকবে। এটা সামাজিক কারণেই ঘটবে। এর ভাল দিকও আছে খারাপ দিকও আছে। তবে ভাল দিকই বেশি। জোয়ারে গা না ভাসিয়ে ভাল কিছু করতে হলে মেধাবী সমমনাদের একত্রিত হবার যৌক্তিকতা অবশ্যই আছে। যদিও মেধাবী শিল্পীরা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জল।

দৈনিকও গোষ্ঠীবদ্ধ চরিত্র নিয়েই কাজ করে থাকে। কিন্তু একটি বিষয় বুঝতে হবে লিটল-ম্যাগ গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে কাজ করলে তা অবশ্যই অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিবাচক আর দৈনিক গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে কাজ করলে প্রায় ক্ষেত্রেই আমরা তার নেতিবাচক প্রভাব দেখতে পাই। এতে নোতুন মেধাবী লেখক তৈরী হবার সুযোগ ব্যহত হয়; আর অলেখকেরা হিরো হবার সুযোগ লাভ করে। কেননা মিডিয়া একটা বিরাট ভেল্কিবাজির জগত। তারপরও বলতে হবে মোটা দাগে দেখলে এখন ছোটকাগজ আর দৈনিকের মধ্যে চরিত্রগত খুব একটা হেরফের নেই। এখন তো ছোটকাগজের লোকজনই দৈনিকগুলির চালিকাশক্তি। তা হলে বিষয়টি কী দাঁড়াচ্ছে? মোদ্দা কথা যতই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলা হোক না কেন, এক পর্যায়ে মিডিয়ার কাছে মানুষ যাবেই। আমাদের নির্মিত বাস্তবতার এটাই অনিবার্য চরিত্র। আমরা মিডিয়া কাতর সভ্যতার প্রোডাক্ট। আর শিল্প নিজেই তো একটা কালজয়ি মিডিয়া। যার জন্য ওভিদ এর মেটামরফসিস ডিশ এর চ্যানেলে দেখান না হলেও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ তা আজও পাঠ করেন। সুতরাং তারপরও মনে রাখতে হবে, বর্তমান পত্র পত্রিকা আর ডিশ চ্যানেল অপেক্ষা শক্তিশালী মিডিয়া হচ্ছে একটা উত্তীর্ণ শিল্পকর্ম, একটা শিল্পোত্তীর্ণ লেখা। তা শতাব্দী পরেও পঠিত হবে। কিন্তু জবরজং মিডিয়ার বর্তমান বিষয়টি উপস্থাপনের পর দিনই অচল। বলা চলে অনেকটা পুরাতন সংবাদ পত্রের মত। সুতরাং যাদের নিজেদের শিল্প বিষয়ে আস্থা পরিষ্কার তারা আমার মনে হয় মিডিয়ার বাচবিচার নিয়ে খুব একটা ব্যাস্ত হয়ে ওঠেন না। কেননা কাল উত্তীর্ণ মিডিয়াটি তো তারই হাতে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। তার লেখাই তার উৎকৃষ্ট মিডিয়া। দৈনিক অথবা লিটিল-ম্যাগ একজন মেধাবী লেখকের জন্য সাময়িক অবলম্বন মাত্র। এই অবলম্বন তার রুচি মাফিক তিনি নির্ধারণ করবেন। তিনি দৈনিক অথবা লিটিল-ম্যাগ যা-ই বেছে নেন না কেন এতে দোষের কিছু নেই। তবে সমাজ দর্শনের সাথে পত্রিকাটির চরিত্রের সমন্বয় থাকা জরুরি। লেখকের রাজনৈতিক ও সমাজ দর্শনের ভিত্তিটি পরিষ্কার হওয়া জরুরি এবং তারই ভিত্তিতে পত্রিকা নির্বাচন জরুরি। এক্ষেত্রে বর্ণচোরা চরিত্র পালন ন্যাক্কার জনক। এ প্রসঙ্গে সমালোচকদের কথাও চলে আসে। অধিকাংশ আলোচক দেখা যায় উদ্দেশ্য প্রবণ অথবা অযথা পা-িত্য প্রদর্শনে আগ্রহী। আসলে লেখকরা যখন সমালোচকদের মেধা থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে থাকেন তখন সমালোচকদের আঠা লাগানো আর উস্কানি মূলক আলোচনা করা ছাড়া আর কোন পথ থাকে না। সমালোচকদের অগভীর জীবনবোধ ও শিল্পবোধ সেই সাথে অস্থিরতা এবং ক্রমাগত মিডিয়াগুলির সাহিত্যের ক্ষেত্র দখল করার প্রবণতা সমালোচকদের মেধাকে বিভ্রান্ত করছে এবং ব্যবহার করছে। এটা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। বর্তমান সময়ের রাজনীতির ধারাটি যেমন অস্থির মূর্খতা এবং অসততার বাণিজ্যে মেতে আছে তেমনি সাহিত্যের বাজারও তো কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন সমালোচকদের মত ব্যক্তিবর্গ। সেক্ষেত্রে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এতে আমাদের সমাজে ভাল পাঠক তৈরী থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ ভাল মানের পাঠক তৈরীর বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি। একাডেমিক ক্ষেত্রে অবশ্য লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে এম.ফিল. পিএইচ-ডি. ডিগ্রী দেওয়া হয়। অথচ সুস্থ্য সমালোচনার ধারা তৈরী হচ্ছে না। এর কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ সমসাময়িক শিল্প সাহিত্য নিয়ে খুব একটা উৎসাহী নন অথবা তাঁরা তা বুঝতে পারেন না। অথচ সমালোচনা সাহিত্যও একটি সৃষ্টিশীল ধারা হতে পারে যা কোন ক্রমেই রেফারেন্স বই অথবা গবেষণা সন্দর্ভ নয়। এই পার্থক্যটুকু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রবীণ শিক্ষকও বুঝতে চান না, বা বুঝতে পারেন না।

মেধাহীনদের খেলা সর্বত্র। কাজেই খারিজ করার প্রবণতা থাকবেই। কেননা এটাও একটা রাজনীতি। এই রাজনীতিতে যিনি নমিনেশন পান তিনি রাতারাতি স্টার বনে যান। তাকে বাইরের দেশেও উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। বাইরের দেশগুলিতে উপস্থাপিত হয়ে থাকে দরিদ্র দেশের মত দ্ররিদ্রতর সাহিত্য। এ গুলি সম্ভব হচ্ছে আমরা অসৎ জাতি সে জন্যই। মৌলিক অধিকারের জন্য এখনও আমরা লড়াই করছি, কাজেই সততা নামক সুকুমার বৃত্তিটি এখনও অনেক অনেক দূর। গণতন্ত্রও একটা মৌলিক অধিকার, এটাও অনেক দূর। কত দূর তাও জানা নেই। কাজেই আমরা যারা কথা বলছি সৎ সমালোচনা নিয়ে তারা কি বলতে পারবো সৎ সমালোচনার মানদ-টি ঠিক কেমন। এখনও সবকিছুই ধারণা মাত্র। কেননা আমরা এখনও ব্যক্তিপূঁজায় বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রে নয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও পাঠ নয় বরং কার নাম কতটা বাজার পেল সেই খেলাটাই চলছে; কাজেই সমালোচনাটাও তো সেই পথেই চলবে।

সমালোচনার প্রয়োজন আছে। তবে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে সমালোচনা করলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৎ হয় না, বা পারফেক্ট হয় না। কেননা এর সাথে জড়িয়ে থাকে সমকালীন সমাজের উত্তাপ ও মিডিয়ার রঙবাজি। আর সময়কে অতিক্রম করে যে সাহিত্য টিকে থাকে তা নিয়ে আলোচনা করলে তা অপেক্ষাকৃত পারফেক্ট হবার সুযোগ পায়। কেননা তখনকার সমালোচক অনেকটা প্রভাব মুক্ত থাকার সুযোগ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ তেমন কিছু সৃষ্টি হলে এক সময়ে সে নিজেই তার সমালোচনার বিষয়টিকে সামালোচকদের নলেজে আনবে এর জন্য মিডিয়াবাজির দরকার নেই। আর উৎকৃষ্ট সাহিত্য সমকালে অপেক্ষাকৃত কম পঠিত হয়, অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হয় আর তা অধিকাংশের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। এর জন্য দুঃখ করার কিছু নেই। মিডিয়া যারা দখল করে থাকেন তাদের ভাল কিছু খুঁজে বের করে অতঃপর পাঠ করে এর স্বাদ আস্বাদন করার মত এত সময় কোথায়? কাজেই তা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেঁচে থাকা অবস্থায় তার রচনা যতটা না পাঠ হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পাঠ হচ্ছে এখন। অবশ্য আমাদের দেশের শিক্ষিত শ্রেণির একটা মোটা অংশ তাঁর নাম এখনও জানেন না অথবা জানলেও তাঁকে পাঠ করেন নি অথবা দু একজন পাঠ করলেও তা পড়ে শেষ করতে পারেন নি অথবা শেষ করার ধৈর্য রাখেন না অথবা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের প্রফেসারকে জানি তিনি দীর্ঘদিন পড়া উচিত বিবেচনা করে ২/৪ মাসেও ‘খোয়াবনামা’র একশ পৃষ্ঠার অধিক শেষ করতে না পেরে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছেন। ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ এর কথা মনে এলে আমার ভেতর প্রশ্ন জাগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা আমাদের কথাসাহিত্যে কতটা কাজ করতে পেরেছি? মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্ণায়ক ঘটনা। এ আলোকে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কথাসাহিত্যের পরিমাণ কি আমাদের দেশে যথেষ্ট? অভিযোগ রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর প্রেক্ষাপট যেভাবে কথাসাহিত্যে উঠে আসতে পারত তা ঠিক সে অর্থে আমাদের ছোটগল্পে উঠে আসছে না কেন? অথবা এ অভিযোগই বা কতটুকু যৌক্তিক?

মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কথাসাহিত্যের পরিমাণ ও মান দুই-ই কম। অবশ্য ভাল কিছুর জন্ম কমই হয়ে থাকে তবে প্রশ্ন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সাহিত্য কেন রচিত হচ্ছে না সেখানে নয় প্রশ্নটি হল জাতি হিসেবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে কী বুঝি? সে বিষয়ে আমরা কি এখনও পরিষ্কার? যখন আমাদের প্রাত্যহিকতার ভেতর দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সনাক্ত করার কথা তখন পঁচাত্তরের পটভূমিতে আমরা আমাদের পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে চেতনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি ফলে সঙ্গত কারণেই চেতনা ভিত্তিক প্রেক্ষাপট অস্পষ্ট অর্থাৎ প্রকৃত চিত্র যেভাবে উপস্থাপিত হবার কথা ছিল তা হয়নি অর্থাৎ আমরা ইতিহাস বিকৃত করার মত আত্মঘাতী জাতি; আর শিল্প সাহিত্যে বিকৃত-ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বড় মাপের কোন কিছু সৃষ্টি হবে না এটাই স্বাভাবিক; কেননা প্রকৃত বাস্তবতাই সাহিত্যের নিয়ামক শক্তি; বিকৃত বাস্তবতা দিয়ে সৃষ্টি হতে পারে ফ্যান্টাসি; সিরিয়াস ধারার কিছু নয়। ফলে আমরা দেখতে পাই শহীদুল জহির যখন পুরাণ ঢাকার প্রেক্ষাপটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার খোঁজ করতে যাচ্ছেন তাঁর গল্পে তখন তিনি কতটা অসহায়; তার এই অসহায় অবস্থা ধামাচাপা দিতে গিয়ে ঘুরে ফিরে তিনি গল্পের ভেতর এমন এক ঘোর তৈরি করছেন যা এক ধরনের পলায়নপরতা ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য এই অসহায় পলায়নপরতার মধ্য দিয়েই তিনি বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন এবং অনুসরণযোগ্য নয় এমন একটি কাঠামো নির্মাণ করে ফেললেন; যা শুধুমাত্র তাঁর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য; আর কেউ শহীদুল জহিরের ধারায় গল্প লিখবেন বলে আমার মনে হয় না। যেমন আর কাউকে সুবিমল মিশ্রের ধারায় লিখতে দেখছি না। যাই হোক আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন এখন লোকমুখে হঠাৎ হঠাৎ শোনা বিচ্ছিন্ন কোন রূপকথার মত মনে হয় মাত্র। তাহলে আমরা কীভাবে লিখব? আর সত্যি কথা বলতে আমরা জাতি হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কতটুকু কীভাবে কতদিন সাফার করেছি? এই সাফারিংটা নেই বলেই আমরা তেতাল্লিশ বছর ধরে বিভ্রান্ত; যুদ্ধ করছি এখনও সুশাসনের জন্য বিকৃত সংবিধানের সাথে; ধর্মনিরপেক্ষতা বদলে দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করার লড়াইয়ে প্রতিদিন প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছি। এবং অবশ্যই প্রশ্ন করা প্রাসঙ্গিক, বর্তমান শাসকদল কতটুকু বঙ্গবন্ধু নির্দেশিত মুক্তি যুদ্ধের চেতনা ধারণ করে চলেছে? এ প্রসঙ্গে আরও একটি বিষয় আমি মনে করিয়ে দিতে চাই পৃথিবীর সব দেশেই কিছু ভাড়াটে লেখক-গবেষক থাকে, যারা প্রগতি বিরোধী কাজের জন্য নিবেদিত প্রাণ; যেমনটি ঘটেছে আমাদের ক্ষেত্রেও। আমরাও পৃথিবীর যাবতীয় আদিম যুক্তিহীন দুর্বোধ্য ধর্মের মত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশপ্রেম ও সাহিত্যকে করে তুলেছি অত্যাধিক আবেগ আক্রান্ত। এর কারণ আছে, পক্ষান্তরে আমরা শাসকশ্রেণির এজেন্ডার পক্ষে কাজ করছি; কেননা আমরা গণতন্ত্রে আস্থা রেখেছি আর ‘গণতন্ত্র’ হল ধনিকশ্রেণির চালাকি; তারা আসলে ক্ষমতা দখল করতে চায় কিন্তু ভান করে যে সবার স্বার্থ রক্ষার জন্যই এটা করছে। যাই হোক একজন সৃষ্টিশীল কথাসাহিত্যিককে এসব নিয়ে বিস্তর বোঝাপড়া করতে হয়; কেননা লেখকই চূড়ান্ত অর্থে নিজের সমালোচক।

এ প্রসঙ্গে বলা সম্ভব কারো কারো ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল লেখকই উত্তম সমালোচক। তবে সকলের ক্ষেত্রে নয়। অর্থাৎ একজন শিল্পীর অন্তর্জগতে যে বোধ কাজ করে তা প্রকাশের ভাষা তার সৃষ্টি। এবং এটাই তার জন্য প্রকাশযোগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সমালোচনা তার জন্য সেকেন্ডারি মাধ্যম। এক্ষেত্রে সবাই যে বিশ্লেষণী ক্ষমতায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করবেন এটা আমি মনে করি না। আমি অনেক উঁচু মানের লেখককে দেখেছি, তিনি তাঁর লেখায় যে স্টেজকে ধারণ করে থাকেন বলার সময় বা লিখে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার সময় তার শত ভাগের এক ভাগকেও তিনি প্রকাশ করতে পারেন না। তবে এ কথা ঠিক যে একাডেমিক সমালোচকের চেয়ে একজন সৃষ্টিশীল মানুষ অতিরিক্ত প্রাসঙ্গিক মাত্রা সহকারে শিল্পটিকে বুঝবেন, এটা তো অবশ্যই। এবং যার সমালোচনা করার চর্চা ও যোগ্যতা আছে তিনি যদি সৃষ্টিশীল হন, তার কাছে অবশ্যই ভাল কিছু আশা করা সম্ভব। কিন্তু সৃষ্টিশীল হলেই যে তার সমালোচনা করার চর্চা ও যোগ্যতা থাকবে এমনটি আশা করার কোন যৌক্তিকতা দেখি না। বরং সৃষ্টিশীল মানুষ সমালোচনা বিষয়টিতে বাস্তবে খুব একটা সময় দিতে চান না। যদি প্রশ্ন ওঠে লেখক হিসেবে যদি আমি সমালোচকের দায়িত্ব পালন করি তাহলে আমি আমার কোন গল্পটিকে প্রাধান্য দেব? এক্ষেত্রে বলা উচিত আমার কোন গল্পই আমার দৃষ্টিতে চূড়ান্ত নয়। আমি আজ অবধি যা লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তা আয়ত্বে আনতে পারি নাই। আর শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত প্রকাশের অর্থ হল আসলে নিজেকে প্রকাশ; যা আমি এখনও শুরু করি নাই। বরং এ পর্যন্ত যা লিখেছি তা পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা তাড়িত হয়েই লিখেছি। আর পারিপার্শ্বিকতাকে কখনও চূড়ান্ত তাৎপর্যে লেখায় আটকে ফেলা সম্ভব নয়; ফলে এক ধরনের অতৃপ্তিবোধ সব সময় কাজ করে। এই অতৃপ্তিবোধ থেকে আমি লিখেছিলাম ‘বুদ্ধ বলিলেন আমি এক জীবনে বহু জীবন ভোগ করিতে চাই’। এখানে আমি সার্বিক অর্থে প্রকাশযোগ্য বিষয়কে ঠিকঠাক মত উপস্থাপন করতে পারি নাই। আর ঠিকঠাক বলতে যদি বলা হয়, একশত ভাগ তবে সেই একশ ভাগকে প্রকাশ করে ফেললে গল্পের নিজস্ব সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে ব্যহত করা হয়। অর্থাৎ গল্প লেখার পর সেই গল্পটি সৃষ্টিশীলতায় হয়ে ওঠে স্বয়ম্ভূ; সেই গল্পটির থাকে একটি সৃষ্টিশীল সত্তা। সুতরাং সার্থক ছোটগল্পে সবকিছু বলে ফেলা হয় না; কিছুটা রেখে দেয়া হয়, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে গল্পটি তা নিজে সৃজন করবে এই উদ্দেশ্যে। উৎকৃষ্ট ছোটগল্পের ভেতর এই সৃজনশীল ক্ষমতা থাকে। আর এই ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটে গল্পপাঠের সময় পাঠকের মানস জগতে; অর্থাৎ পাঠকেরও গল্পে অংশ গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়; পাঠকও সৃজনশীলতায় অনুপ্রবেশ করে। এ অর্থে আমি আমার গল্পের অভিষ্ট লক্ষ্যের কাছাকাছিতে অবস্থান করি অথবা পয়েন্ট অব ভিউকে আড়ালে রাখি। গল্পটি গভীর অভিনিবেশে পাঠ করলে বেরিয়ে আসবে গল্পে আপাত যা নেই সেই না বলা অর্থাৎ অনুন্মোচিত জগতের বোধিচিত্র। অবশ্য গল্পটি বুঝবার জন্য পাঠকের মেধার একটা লেবেল থাকা দরকার। অনেকে বলে থাকেন অমুক লেখক খুব ভাল লেখেন অথবা অমুক লেখাটি বেশ উল্লেখযোগ্য। কিন্ত আমি বাস্তবে দেখেছি এই শোনা কথার সাথে আমার ব্যক্তিগত পাঠের খুব একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কারো কাছে কিছু শুনে আস্থা রাখতে প্রস্তুত নই। কেননা পাঠকের গ্রহণ ক্ষমতা আর রুচি নিয়ে আমি বিভ্রান্ত। কুলদা রায়কে লিখেছিলাম আপনার জীবনই আপনাকে দিয়ে লিখিয়ে নিতে পারে অনেকগুলো শক্তিশালি গল্প। বিনিময়ে তিনি আমাকে তার বেশ কিছু গল্প পাঠিয়ে ছিলেন। আমি পাঠের পর তার সাথে আলোচনায় জেনেছিলাম, প্রকৃত প্রস্তাবে তার জীবনকেই তিনি প্রতিনিয়ত লিখে যাচ্ছেন। আসলে গল্পের মূল চাবিটা নিজের জীবনের ভেতরেই লুকিয়ে থাকে। যার সমৃদ্ধ শৈশব নেই অর্থাৎ বিস্তীর্ণ জীবন নেই, সে ভাল কিছু ভাবতে পারে না; উৎকৃষ্ট কিছু লিখতেও পারে না। আমাদেরকে বুঝতে হবে একজন লেখকের ব্যক্তিগত জীবন আসলে শুধুমাত্র নিজের জীবন নয়; তিনি নিজের ভেতর আটকে থাকেন না। বিস্তীর্ণ জীবনকে দেখার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ‘আমি’ তখন হয়ে ওঠে ‘সামষ্টিক-আমি’। একজন গল্পকার তখন আর সবার জীবনকে নিজের জীবনের ভেতর দিয়ে খুড়ে খুড়ে প্রকাশ করেন; এই প্রকাশ যন্ত্রণা থেকেই উঠে আসে গল্প।

আমরা সবাই তো কোনো না কোনো ভাবে নিজেকেই লিখছি। সামষ্টিক অহমকে না লিখলে, নিজেকে না লিখলে তা প্রকৃত লেখা হয়ে ওঠে না। আমার সর্বশেষ গল্পের বই ‘ইস্টিশনের গহনজনা’। আমার এ বইয়ের লেখাগুলোর বৈশিষ্ট্য কবিতা-আশ্রয়ি; তারপরও একটা কিছু তো আছে সেখানে? এর আগের তিনটি গল্পের বই এর সাথে মিলবে না এটি। আমি দু’ভাবে এখানে গল্প বলার চেষ্টা করেছি। প্রথমত কবিতার মত করে আমি আখ্যানভাগকে মুক্ত করে দিয়েছি। দ্বিতীয়ত সেই মুক্ত অবস্থা থেকে বিষয়-সংকটকে আমি কথক ভঙ্গিতে আবার ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি আখ্যানের কাছে। কমলকুমারও তার মত করে এমনটি করার চেষ্টা করতেন। তারপরও বলবো অনেক শক্তিশালী গল্পকার এভাবে গল্প লিখতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন; অনেকেই আর ফিরে আসতে পারেন নি আখ্যানের কাছে; ফলে গল্প মার খেয়েছে। আমার গল্প নিয়ে এ ধরনের মতামত কুলদা রায় দিয়েছিলেন বটে তারপরও আমি এক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত। আমি নিজেকে এখনও ব্যতিক্রম ভাবতে পারছি না। কেননা আমার অনুসন্ধান ঠিক এখানেও নয়; এটি একটি পথের উন্মোচন প্রক্রিয়া মাত্র। কেননা আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি ‘এন্টি ফিকশন’ লেখার জন্য; যা আমি প্রথমেই বলার চেষ্টা করেছি। আমি আমার লেখার বিষয়ে নির্মোহ থাকতে চাই। লেখালেখির জগতে সত্যিকার অর্থে কেউ সত্যিকারের বন্ধু থাকে না; হয় পিঠ চাপড়িয়ে অযথা বাহবা দেয়; অথবা না বুঝে ভদ্রতা করে। আর যারা বোঝেন, তারা সহজে মুখ খোলেন না। কেননা অপ্রিয় সত্য কথা হজম করার ক্ষমতা কারোই নেই; যেমন আমিও কারো লেখার দুর্বল দিকগুলো নিয়ে সরাসরি কথা বলতে সংকোচ বোধ করি; এতে অযথা বিব্রত হতে হয়।

গল্প লেখা এমন এক তাড়না; এগুলি নিয়ে না ভাবতে পারলে আমি ঠিক সুস্থ্য থাকতে পারি না। অথচ গল্পের সাথে জীবন যাপন করতে গেলেও আমি অসুস্থ্য হয়ে উঠি। এটি এমন এক প্রেম, তাকে ভালোবাসতে বাধ্য কিন্তু তার সাথে সফল সংসার করা অসম্ভব। অনেকটা গর্ভাবস্থার মত; নয় মাস যন্ত্রণা বহনের পর আকার পাবে অথচ তিন মাস থেকেই বমি বমি ভাব শুরু হয়। এই হলো লেখালেখির জীবন; যে জীবনের ভেতর বসবাস করে আমি আজও উপলব্ধি করতে পারি নাই, গল্প কী এবং কতটা গভীর বাস্তবতাবোধ অথবা উদ্দীপনা থেকে তা উৎসারিত হয়? এ বিষয়ে আমার তেমন যৌক্তিক কোন জ্ঞান পরামর্শ বা ব্যাখ্যা নেই। এক্ষেত্রে আমি আমার বুদ্ধি মত্তাকে ভয় পাই না; ভয় পাই লিখতে বসে আমার অবাধ স্বাধীনতা আর আমার মানস জগতের অনিবার্য স্বেচ্ছাচারিতাকে। তখন আমার সন্দেহ হয় আমি কি আমার ভেতর প্রতিটি চরিত্রের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছি? তখন আমি সংশয়বাদি হয়ে উঠি পারিপার্শ্বিকতা, চরিত্রের কণ্ঠস্বর, উপস্থাপন কাঠামো, কাব্যময় বহুমাত্রিক সংকট নাকি সত্যবাদি কথক কোন বিষয়ের ওপর আমি অধিক নজর রাখবো? যেমন কখনই আমি নির্ধারণ করতে পারি না আমার কর্মক্ষেত্রে প্রগতিচেতনা, ধর্মনিরপেক্ষতা আর গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক ঠিক কোনটি অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। এবং এই দ্বিধা-সংকট থেকেই আমি বুঝতে শিখেছি খ্যাতিমান ব্যক্তি মাত্রই কখনও শ্রদ্ধেয় হতে পারেন না; যেমন আমার পরিমিতি বোধের অভাবে আমি আমার গল্পে ভদ্রজন অথবা ব্রাত্যজন ঠিক কোনো বৈশিষ্ট্যই অর্জন করতে পারছি না। ইদানিং প্রাজ্ঞজনগণ ভাবতে শুরু করেছেন কবিরাই সেরা গদ্য লিখতে পারেন; সাথে দরকার মিউজিকের এক্সপেরিয়েন্স; মিউজিক থেকে পাওয়া যায় অনির্বচনীয়তার টেস্ট; তবে যেভাবেই হোক না কেন গল্প শেষ পর্যন্ত গল্পই। একজন ম্যাজিশিয়ানের গল্প বলার কৌশল খুব দরকার। পাঠকের সঙ্গে একটা রহস্যঘন ইন্দুর বিড়াল দৌড় সম্পর্ক ক্রিয়েট করা দরকার। এই কৌশলটা কুলদা রায়ের ভেতর দেখতে পেয়েছি আমি। তার ‘পরী সিরিজ’ এ জন্যই উৎরে গেছে। বর্ণনার পরিবর্তে শুধু তথ্যের ওপর ভর দিয়ে কীভাবে শেষাবধি জাদুকরের হাতে বহুরৈখিক গল্প বহুমাত্রিক চেতনার দিকে, বহুমাত্রিক সংকটের দিকে অগ্রসর হয় তা তিনি নীরক্ষা করেছেন এই সিরিজে। এক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট গল্প রূপকথার ক্ষমতাকেও কাজে লাগিয়ে থাকে; যেমনটা কবিতার ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রকাশিত জাহানারা পারভীনের ‘স্কুল বলতে তোমাকেই বুঝি’ দীর্ঘকবিতার বইতে এই ক্ষমতার শক্তিশালী ব্যবহার দেখা যায়। আমার গল্প যেমন জটিল হয়ে উঠেছে; আমি যেমন সেই জটিলতাকে পাশ কাটাতে গিয়ে হাবুডুবু খেয়েছি; আমি দেখেছি অবলীলায় অনেকেই সেই জটিলতাকে পাশ কাটিয়েছে, মাহবুব লীলেন, রায়হান রাইন, মাসুদুল হক, জফির সেতু, মুজিব ইরমের গল্পে রূপকথার ঘোর থাকলেও তারা জটিলতাকে পাশ কাটাতে পেরেছে। পাশাপাশি ইদানিং কুলদা রায়ের গল্পে রূপকথার আবহের ভেতর দিয়ে মানব চেতনার সিরিয়াস অনুভবগুলো উন্মোচিত হয়েছে। কলুদা রায় দুবছর ধরে পরী সিরিজের পনেরোটি গল্প লিখেছেন। তার আলমগীর চরিত্র সৃজনের কৌশল আমাকে গল্প উপস্থাপন কৌশলের আরও অনেকগুলো মাত্রা বলা চলে গল্পের কৌণিকতল পর্যবেক্ষণ করতে শিখিয়েছে।

লেখা তো আসলে অটোবায়োগ্রাফি। যা আমি দেখেছি দেবেশ রায়ের ক্ষেত্রে। তিনি আমাকে শিখিয়েছেন কীভাবে ডকুমেন্টকে ফিকশনে রূপ দিতে হয়। আমিও ভাবছি দীর্ঘ মেয়াদি সাধনায় এবার মনোযোগ দিতে হবে। আমি সমকালকে পাঠ করে প্রতিদিন শিখছি জীবন থেকে নেয়া ঘটনা প্রবাহ কীভাবে পৃথক মাত্রা পেতে পারে গল্পে। যেমন হতে পারে অদিতি ফাল্গুনী, আকিমুন রহমান, আবু হেনা মোস্তফা এনাম, পারভেজ হোসেন, মনিরা কায়েস, মামুন হুসাইন, মাহবুব মোর্শেদ অথবা হুমায়ূন মালিকের গল্পের চরিত্রসমূহের ভেতর যেখানে হয়তো জীবন থেকে নেওয়া বাস্তবের অনুভব আদৌ ছিল না অথচ প্রাত্যহিকতার চোখ সেই অনুপস্থিত অনুভবের ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন প্রাত্যহিক সংকট আর বুহুমাত্রিক সামাজিক প্রতিযোগ ফলে চরিত্রগুলো বেঁচে থেকে আমাদের পারপাশে যে আচরণ করে, তার চেয়েও অধিক তাৎপর্যবহ ম্যাসেজ বহন করতে সক্ষম হচ্ছে গল্পের ভেতরে তাদের আচরণে। আর আমি মনে করি এখানেই লেখকের উপস্থিতি। ইদানিং ছোটগল্পে লেখকের এমন উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে কবীর রানা, পিন্টু রহমান, মেহেদী উল্লাহ, হাসান অরিন্দম প্রমুখের গল্পে। ইনারা জানেন তিনি কী লিখবেন, কীভাবে লিখবেন, কোন পর্যায়ে এসে লেখাটি শিল্প হয়ে উঠবে। একজন প্রকৃত গল্পকারের জন্য এই জানাটা খুব জরুরি।

গল্প লিখব ভাবিনি কখনও। কবিতাতেই জীবন যাপন করেছি দীর্ঘদিন। প্রথম যখন গল্প লিখতে আসি ততদিনে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে এসেছে। অধ্যাপনা শুরু করেছি। বিয়ে করেছি সাত বছর প্রেম করে। কন্যা ধ্রুব-র জন্ম হয়েছে। জন্ম নিয়েছে কবিতার বই ‘মস্তিষ্কে দিনরাত্রি’ (১৯৯০)। বিশ্বাস ছিল না গল্প লিখতে পারব। ১৯৮৬ সালের দিকে মাথার ভেতর কবিতার এক ধরনের ঘোরলাগা খসড়া তৈরি হয়েছিল। যে অবস্থাটিকে কোন দিনই আর কবিতা হিসেবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। কেননা ঘোরের ভেতর ছিল গল্পের অনুষঙ্গ। গল্পের যে বীজ প্রোথিত ছিল তা শেষ পর্যন্ত দশ বছর পরে এসে ১৯৯৭ তে নোতুন করে লিখতে বসে গল্পের দিকে মোড় নেয়। জন্ম হয় ‘ইলিশ খাড়ি’ নামক গল্পটির। গল্পটি প্রথম ছাপা হয় ‘প্রণোদনা’ পত্রিকার ১৯৯৮ এর ডিসেম্বর সংখ্যায়। ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ এই দু’বছরে মাত্র ৬টি গল্প লিখতে সক্ষম হই। ১৯৯৯-তে নিত্য উপহার ঢাকা থেকে বাহার রহমান প্রকাশ করেন আমার প্রথম গল্পের বই ‘ইলিশখাড়ি ও অন্যান্য গল্প’। অবশ্য এর আগে ১৯৯৮ এর ফেব্রুয়ারিতে বাহার রহমান তার ‘নিত্যউপহার’ থেকে প্রকাশ করেছেন আমার দ্বিতীয় কবিতার বই ‘সাদাঘোড়ার ¯্রােত’।

গল্প লেখার শুরুটাই আমার বোধের জগতের জন্য ছিল জটিল এক ধরনের অনুভব। যদিও কবিতার ভাষা আমার অনুভবকে প্রকাশ করার মত বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তারপরও আমি বরাবরই অনুভব করেছি আমার ভেতর প্রকাশযোগ্য আরও কিছু রয়ে গেছে যা কবিতাতে ঠিক সেভাবে পাঠক যেভাবে আমার সাথে যোগাযোগ তৈরি করতে পারেন ঠিক সেভাবে উঠে আসছে না বরং পাঠকের জন্য আরও কিছুটা সুযোগ থাকা দরকার; আমাকে গদ্যের বিস্তারে আসতে হবে; তবে সেই গদ্য দৈনন্দিন কেজো গদ্য নয়; সেই গদ্যও ধারণ করবে কবিতার মত বহুমাত্রিক অর্থ। ফলে আমি শুধুমাত্র দৈনিকতা নির্ভর চোখের দেখার ওপর স্থির থাকতে প্রস্তুত নই বরং আমি যা দেখি, আমার অভিজ্ঞতায় যা জীবিত আছে শুধুমাত্র সেই পরিচিত সাদা চোখে দেখা জগতটিকে উন্মোচনের জন্য আমি গল্প লিখছি না। বস্তুত আমি কাহিনী লিখি না। আমি লিখবার চেষ্টা করি আমি যা দেখিনি অথবা দেখবার সৌভাগ্য হবে না কোনদিন; অথচ দেখবার জন্য সেই সৌভাগ্যটি আমার চাই। সুতরাং সৌভাগ্য নির্মাণের জন্য না দেখা জীবনকে, না দেখা জীবনবোধকে আমি বাংলা ভাষার বাক্যবন্ধনে ক্রমাগত তৈরী করতে থাকি। মিলিয়ে নেই পরিচিত জীবন বোধের সাথে ‘ইলিশ খাড়ি’র ইলিশ চরিত্র বৃদ্ধা ‘গাগূঢ়ী’কে। এই ইলিশজীবনকে আমার জীবনের সাথে মিলিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা পাইনি কখনও; প্রকৃত বাস্তবতায় তা কখনও সম্ভবও নয়। এই না দেখা জগতকে আমি আমার গল্পে নির্মাণ করার চেষ্টা করলাম। অতঃপর শিহরিত হলাম। শিহরিত হলাম তখনই, যখন দেখলাম অরবিন্দ বা মাধবের সমান্তরালে মানব জীবনের দৈনন্দিন ঘটনা প্রবাহ বেঁচে থাকবার জন্য লড়াই আর ইলিশের জীবনের সাথে মানুষের জীবনের বিবর্তন সব মিলিয়ে যে জগতের ছবি উপস্থাপন করা হল তা শুধুমাত্র ভাষা নয় অথবা ছবি নয়, তা ইতিপূর্বে অনুভূতির জগত দিয়ে স্পর্শ করা হয়নি, সেই অদৃশ্য অনুভবের দরজা উন্মোচন করল ‘ইলিশ খাড়ি’।

আমার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন স্মৃতি আমার মনে নেই। যেহেতু এই অভিজ্ঞতা আমার নিকট মৃত সেহেতু এ অভিজ্ঞতাকে জীবন দানের জন্য আমাকে লিখতে হয়েছিল ‘আমার মেয়ের নাম ছিল প্রজ্ঞা’। একই ভাবে ‘চিত্রশিল্পী বিয়াত্রিস’এর সংকট ছিল এমন একজন নারী যে একই সাথে তার অনুভূব অভিজ্ঞতায় নারী এবং পুরুষ উভয় প্রজ্ঞানির্ভর মেধাই ধারণ করতে চায়। ধারণ করতে চায় এমন এক ভালোবাসাকে যে প্রেমের মধ্যে পুরুষের সাথে পুরুষের বন্ধুত্বের যে স্বাধীনতা সেই স্বাধীনতাকে; বিয়াত্রিচ ধারণ করতে চায় সেই উদার বন্ধুত্বের বন্ধনকে; আবার একই সাথে বিয়াত্রিচ ভোগ করতে চায় নারী-পুরুষের প্রেমের ভেতর যে আসক্তি সেই প্রগাঢ় গুপ্ত প্রেমকে। কেননা সে ধারণ করছে নারী দেহকে। কাজেই দৌহিক সৌন্দর্য তার কাছে ভেনাসের নিরাভরণ দেহের মতই মাদকতা জাগায়। অথচ নারী দেহ ধারণের মধ্যে যে প্রেম সে প্রেম সমাজে পুরুষের কাছে শুধুই ভোগের কিনা অথবা তা কতটা মনন নির্ভর, সেই প্রশ্নের মীমাংসা খুঁজে ফিরেছে বিয়াত্রিচ। সুতরাং প্রয়োজন প্রেমের জন্য আরও একটা অতিরিক্ত অর্থপ্রবণ আনুভূমিক মাত্রা। যে মাত্রাটি একাধারে নারী সত্তা আর পুরুষ সত্তার স্বাধীনতা দান করতে সক্ষম। সুতরাং মনন জগতের অতল রহস্যে বিয়াত্রিচ হাবুডুবু খেতে বাধ্য।

আমি মনে করি, যেহেতু প্রতœ-অভিজ্ঞতা ও প্রজাতি-অভিজ্ঞতাকে ধারণ করছি আমি আমার নিউরোনে সেহেতু না দেখা জীবনের ছবি আঁকা আমার জন্য অসম্ভব কিছু নয়। ‘প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী’ গল্পে আমি আঁকতে চেয়েছি সাঁচচুয়ানাকে। যে কিনা গণিতের শিক্ষক। যার প্রকৃত নাম সচিন দেব। সচিন দেব যে স্বপ্ন দেখেছে গতরাতে, সেই স্বপ্নের ছবি আমাদের জীবনকে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে? এই বাখ্যা কীভাবে আমাদের জীবন জিজ্ঞাসাকে উস্কে দিচ্ছে? সুতরাং আমি ভালোবাসি আমার পাঠকদেরকে নিজের মুখোমুখিতে অসংখ্য অনিবার্য প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে। এই প্রশ্ন শুধুমাত্র ফ্লাড জীবনের উপরিতলঘেঁষা জীবন বাস্তবতা থেকে উঠে আসে না। বরং উঠে আসে অদেখা জীবনের অতিসত্যের সত্যভাষ্যকে আশ্রয় করে। সুতরাং ‘আখবাটি’ গল্পের হাবিল-কাবিল জমজ দুই ভাই অবশ্যই তার চিরপরিচিত প্রেক্ষাপটকে ত্যাগ করতে বাধ্য। একটা লাল মালগাড়িতে করে তারা চলে যেতে চায় এমন একটা জগতে যে জগত এই চিরপরিচিত জগতের মত কুৎসিত নয়। যে জগতে কুৎসিত মা অথবা ঘৃণিত বাবা নেই। যে জগত ওরা তৈরি করতে চায় ওদের মত করে ওরা নিজেরা।

আমার গল্পের ভাষা ও আঙ্গিক, বিষয় ও শৈলী এভাবেই হাবিল-কাবিলের মত ঘৃণিত চেনা পরিবেশ ত্যাগ করে নির্মাণ করে নিতে চায় নিজের জন্য জুতসই একটা জগত। যে জগতে আমার গল্পগুলি আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে। হয়ে উঠবে পাঠকের কাঙ্ক্ষিত বিচরণ ভূমি।

সমস্ত জীবন ধরে আমি আসলে একটি গল্পই লিখছি। হতে পারে বিগত তিন বছর ধরে আমি তিনটি মোড়কে আসলে একটি গল্পই লিখছি। হয়তো প্রতিদিন গল্পগুলো নিয়ে বসতে পারি না অথচ গল্পের ভেতরেই আছি প্রতিনিয়ত আমার ভেতরে একটি গল্পই এডিট হচ্ছে। এভাবে চব্বিশ ঘণ্টা অনুভবে, এই যে লেখা নিয়ে সাধনা, এই সাধনা আসলে প্রতিটি মানুষকে বুঝে ওঠার সাধনা, যে মানুষ আজ তার সভ্যতাকে আদিম জীবন থেকে বর্বর জীবন থেকে সভ্যতা নামক আলোক ধাঁধায় নিয়ে এসেছে। এ এক ভয়ানক রহস্যের খেলা। শুধুমাত্র রহস্য দেখার জন্য দরকার এক হাজার বছরের জীবন; আর মানব সভ্যতার রহস্য বুঝতে হলে প্রয়োজন লক্ষ জীবন। এই লক্ষ জীবন প্রাপ্তীর সাধনা হল, জীবনকে প্রতিনিয়ত লিখে রাখার ভেতর দিয়ে বিনির্মাণ করে যাওয়া। মাস্টারপিসগুলো আসলে এরকমই এক চিরন্তন সাধনা; যা উঠে আসে জীবনের ধারাক্রমে শিল্পের বিনির্মাণের পথ বেয়ে।

এই যে জীবন এটি আসলে একটি মুভি। কাজেই আমরা যা লিখছি তাকে মুভি ফর্মে বাজিয়ে দেখার অবকাশ রয়েছে। এই মাত্র যে গল্পটি আমাদের ভেতরে কেউ লিখে শেষ করলেন, আসলে জীবনকে লিখে শেষ করা যায় না; এর পর ভাবা যেতে পারে এই গল্পটি যদি মুভি বানানো হয় তাহলে কীভাবে এটিকে এই ঘটনাটিকে এই চরিত্রকে শুট করা হতো সেভাবে একজন ডিরেক্টর হিসেবে আবার গল্পটিকে ভাঙাচোরা করা সম্ভব। একটা মুভি তো একটু একটু করে অনেকদিন ধরে তৈরি করা হয়; একটি গল্পও এভাবে একটু একটু করে অনেকদিন ধরে তৈরি হতে পারে।

এভাবে ছোটগল্পের টেকনিক নিয়ে ভাবা সম্ভব। আমরা আজকাল শুধু ভাবছি না, বরং লিখছিও। আমার জানা মতে এবং আমার পঠনের আওতায় এমন অনেকেই আছেন। এখনকার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এগুলোও হয়ে উঠতে শুরু করেছে লাগসই কৃৎকৌশল। ছোটগল্পের ভেতর লুকিয়ে থাকে দীর্ঘমেয়াদি কম্পোজিশন; যা পাঠকরা বুঝতে পারে না; এখানেই লেখকের ক্ষমতা; এই ক্ষমতার হাত ধরে আমি যে কোন ভাবেই হোক না কেন প্রকাশযোগ্য সত্যটাকে নির্মাণ করতে চাই গল্পে। আবার নির্মিত সত্যকে মিররের মত ভেঙেও ফেলতে ইচ্ছুক। ফলে গল্পের ভেতর এক শ্যাডো ট্রুথ নির্মাণ হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। গল্পের একটা বড় কাজতো এখানেই। এ জায়গায় পৌঁছাতে গিয়ে অধিকাংশ লেখকের সারা জীবন অপচয় করে ফেলতে হচ্ছে। অনেকে গল্পে এলিগরি নির্মাণ করতে ইচ্ছুক নন। আমি এক্ষেত্রে প্রশ্ন তুলি এলিগরি এড়াতে পারলে গল্পের রেজাল্ট শেষ পর্যন্ত কী আসতে পারে? যদিও গল্পে এলিগরি এসেনশিয়াল নয়; রিয়েলিটিই মূল কথা বলে আমার মনে হয়। এটাই কবিতা এবং স্টরি-র পার্থক্য। কিন্তু এটিও চূড়ান্ত নয়; আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছি, এটা নির্ভর করে গল্পের ট্রিটম্যান্ট ঠিক কোন পর্যায়ের তার ওপর। এলিগরি অনেক ক্ষেত্রে গল্পের অনুভব মূল্যায়নে মৌল ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আর আমরা যদি গল্পে ম্যাজিক তৈরি করতে চাই তাহলে এলিগরিকে এড়ানো অনেক ক্ষেত্রেই অনুচিত হয়ে দেখা দেয়। আমরা দেখতে পাই কুলদা রায় আলমগীরের গল্পে বারবার ম্যাজিক তৈরি করেছেন; আবার লজিক দিয়ে সেই ম্যাজিক থেকে বাইরেও চলে এসেছেন; এ লট অব টুইস্ট।

খুব স্বাভাবিকভাবে অনেকের মতই আমি বলতে চাই, গল্পের এমন ক্ষমতা থাকা মন্দ নয় যে গল্পটি এক নিঃশ্বাসে পড়া যায়। পাঠক ধরে রাখার ক্ষমতাও লেখকের করায়ত্বে; ক্যারেকটার স্পষ্টভাবে এক্ট করে; এ ধরনের গল্পকে আমরা অভিনন্দন জানাতে ইচ্ছুক। কিন্তু পাশাপাশি এও ভাবা যেতে পারে গল্পের এগুলি ব্যাসিক দাবি; কিন্তু এই দাবি মেটানোর পরও এর সাথে সংযুক্ত হতে শুরু করেছে সাইকো ইফেক্ট সহ পেয়েটিক ইমেজ; যা গল্পের প্রয়োজনেই শক্তিশালী গল্পকারের হাতে উঠে আসতে পারে। ফলে গল্পে কবিতার প্রয়োজনীয় প্রভাব প্রবলভাবে উপস্থিত থাকা অসম্ভব কিছু নয়; একজন গল্পকার হিসেবে কবিতাকে বাতিল করার পক্ষে নই আমি। তবে কবিতা গল্পকে শাসন করুক এটাও আমার আকাক্সক্ষা নয়। গল্প লেখার ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার বিষযটি কোনো নমুনা বা আইকন অনুসরণ করুক এটি আমার কাম্য নয়। গল্পকে গল্পের মতই হতে হবে এটি আমি বিশ্বাস করি না; অথবা করতে চাই না। গল্পেরও বিবর্তন হচ্ছে এবং হবে যেমন কবিতার ক্ষেত্রে ঘটেছে। গল্পের উপস্থাপন কৌশল, চিন্তার জগত ও বিষয় অনেক আগে থেকেই লেখকের ভেতরজগত প্রকাশের স্বার্থে সে সাথে বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা পরিবর্তনের স্বার্থে নোতুন আঙ্গিক দাবি করতেই পারে। বিস্তর সফল গল্পের ভেতর আমি এমনটি দেখেছি; গল্পগুলো আমাকে বেশ টেনেছে; গল্প পাঠে মনে হয়েছে গল্পটিকে ভাস্কর্যের মতো চেছে ছিলে ধাপে ধাপে তৈরি করে নিতে হয়েছে। বড় মাপের কাজের জন্য এটি একটি প্রায়োগিক কৌশল। তবে স্বতঃপ্রণোদিত অবচেতন চেতনা সেক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে হারিয়ে যাবার ভয় থাকে। আমার গল্প নিজে থেকেই অগ্রসর হবার মতো সচল থাকার এক ধরনের তাড়না অনুভব করে। কবিতা গল্পকে শাসন করবে না একথা ঠিক বরং গল্প কবিতাকে অধিগ্রহণ করবে নিজের প্রয়োজনে। যে অনুভূতি গদ্যে প্রকাশযোগ্য নয় তা অনায়াসে কবিতার ইশারায় একাধিক মাত্রায় প্রকাশ পায়। যদি প্রকাশযোগ্য বিষয়ের ভেতর একাধিক অনুভূতি প্রকাশের তাড়না ফিল করি তাহলে কবিতার ভাষা অনিবার্য হয়ে দেখা দেয় গল্পের জন্য। আর এটাও সত্য যে মানুষ একরৈখিক চিন্তা বা এক মাত্রার চিন্তা করতে অভ্যস্ত নন; তার একটি প্রকাশযোগ্য বাক্যের পেছনে অজ¯্র অনুন্মোচিত বিষয়াদি সংযুক্ত থাকে। সেক্ষেত্রে গল্পের ভাষা আর কবিতার ভাষা পরিপুরক হয়ে দেখা দেয়। একজন গল্পকারকে অবশ্যই কবিতা বুঝতে হয় গদ্যের প্রয়োজনে।

একজন গল্পকার শুধুমাত্র আবেগ-নির্ভরতাকে আশ্রয় করে লেখক হয়ে উঠতে পারেন না। বরং তিনি ক্রমাগত লেখার কলাকৌশল অর্জন করতে গিয়ে লেখক সত্তা থেকে আবিষ্কার করেন শিল্পসত্তা। এসব বিষয় একজন লেখক যেভাবে বুঝতে পারবেন পাঠক সেভাবে পারবেন না; বিধায় এগুলি লেখক বন্ধুদের জন্য আমার সংকোচহীন প্রকাশ। আমি সাধারণত এক সিটিঙে কখনও বা ২/৩ বসায় লেখা শেষ করে থাকি। আমার প্রায় সোয়া শ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী’ শেষ করেছিলাম পাঁচ সিটিঙে। যদিও এটি আসলে বহুকৌণিক পর্যবেক্ষণ; উপস্থাপন কৌশল অপ্রচল অথচ রূপকথা, কিংবদন্তি আর কাব্যময়তার আবহে প্রাত্যহিক আন্তর্জাতিক সংকটগুলো রূপক হিসেবে উঠে আসলেও মূলত এটি সংখ্যালঘু সংকটের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে শাসিয়েছে। আমার বিশ্বাস আমার উপন্যাস অধিকাংশকেই সন্তুষ্ট করতে পারবে না; হতে পারেন তিনি একজন লেখক অথবা বিজ্ঞ পাঠক। কেননা এখানে আমি উপন্যাসের প্রথা ভেঙেছি; বিস্তারিত বর্ণনা এড়িয়ে সারকথাকে তীর্যক ও ইশারাভিত্তিক করে তোলার চেষ্টা করেছি; এখানে দেখা সম্ভব কবিতার ভাষা কীভাবে গদ্যভাষাকে শাসন করতে গিয়ে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে নোতুন মাত্রা লাভ করে। কেজো ভাষা, ডায়লগ নির্ভর ভাষা দৈনন্দিন মতামত প্রকাশের ভাষা এগুলো বস্তুত গল্প উপন্যাসের জন্য সংকুচিত ও প্রাথমিক স্তর মাত্র; এ জায়গায় অধিকাংশ লেখক আটকে থেকে হাবুডুবু খায়; অবশেষে অজ¯্র জঞ্জাল তৈরি করে। এদের সংখ্যা এতো বেশি যে, পাঠক সাহিত্য বলতে এগুলিকেই বুঝতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। মিডিয়া অথবা একাডেমিক ভাবে এগুলো চর্চা হতে হতে মূর্খ প-িতদের গোলক ধাঁধায় সৃষ্ট হয় নৈরাজ্য।

দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্য বলতে যেটা দেখে আসছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটি খুবই হাস্যকর। ভেতর থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে আসছে না কিছু। কেউ কেউ উত্তরাধুনিক বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ ফুকো দেরিদা বলে ফতওয়া দিয়ে বিশেষ গুরুত্ব নিতে চেষ্টা করছেন। কিছু একটু চেখে দেখলেই বোঝা যায় এর মধ্যে আসল জিনিসটি নেই। এগুলি করাপশন। সম্পাদকদের কথা নাই বা বললাম। এক্ষেত্রে লেখকের কি দায়বদ্ধতা নেই? তিনি লেখা প্রকাশের জন্য এত কাঙাল কেন? সত্যি বলতে কি আমি আপনি কেউ লেখক নই। লেখক বলতে কিছু নেই বরং লেখক বিষয়টি হয়ে ওঠার বিষয়। কেউ সারা জীবন হয়ে উঠতে পারেন না। কেউ বা ক্রমাগত হয়ে উঠতে থাকেন। তবে চূড়ান্ত জায়গায় আমরা শেষাবধি কেউ পৌঁছিতে পারি না। এখানেই মানব ভাষার প্রকাশ-রহস্য; এ জন্যই সৃজনশীলতা অনিবার্য; প্রকাশের অনিবার্যতা থেকেই তো এইসব; প্রকাশ হয়ে গেলে তো আর সৃজনশীলতার দরকার নেই। প্রশ্ন তুলেছিলাম লেখকের দায়বদ্ধতা নিয়ে। তিনি কীভাবে লিখবেন; নাকি তিনি কীভাবে লেখক হয়ে উঠবেন; কোন জায়গাটিকে তিনি গুরুত্ব দেবেন? কীভাবে লেখক হয়ে উঠবেন, শ্লেষ অর্থে এটা মিডিয়াবাজির বিষয়। সত্যিকারের লেখকের অহঙ্কার থাকে; কীভাবে লেখক হয়ে উঠবে এ বিষয়টি তার মর্যাদার সাথে তার অহঙ্কারের সাথে যায় না। কাজেই লেখকের দায় লেখকের মর্যাদার সাথে সম্পর্কযুক্ত তিনি কীভাবে লিখবেন, কী লিখবেন কেন লিখবেন তার দায় এখানে। যদিও লেখকের কাজ মানুষ নিয়ে, সমাজ নিয়ে, সংকট আর অসঙ্গতি নিয়ে তারপরও একজন লেখক কিন্তু তার দায়বদ্ধতার কাছে প্রচ- রকম অহঙ্কারী এবং একা। লেখক যেটা বোঝেন সেটাই তার কাছে, তার সৃষ্টির কাছে চূড়ান্ত। তার লেখাকে সম্পাদনা করতে হলে আমি মনে করি সেখানে লেখকের অংশ গ্রহণ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। আমার ক্ষেত্রে সম্পাদনার বিষয়টি এবার প্রথম বারের মতো ঘটেছে। কবি আমিনা শেলী তার প্রকাশনা থেকে এবারে আমার একটি কবিতার বই এবং একটি গল্পের বই প্রকাশ করেছেন। দুটো বই-ই আমার শতভাগ অংশ গ্রহণ সাপেক্ষে, আলোচনা, নিমগ্ন-পাঠ ও সার্বিক নন্দনভিত্তিক বিষয় ও প্রকাশ-উপযুক্ততার বিষয়সমূহ প্রাধান্য দিয়ে সম্পাদনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে খুব সামান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। আমি বলব, এটি পরিবর্তন নয় বরং আরেক জন শিল্পীর চোখ দিয়ে নিজের সৃজনশীলতাকে জাসটিফাই করে নেয়া। বাস্তবে এর ফরাফল ভাল; কেননা নিজের লেখার ওপর এক ধরনের পক্ষপাত ও আবেগ থাকার সম্ভবনা থাকে। এ অবস্থায় পাঠকের গ্রহণ ক্ষমতার প্রতি লেখকের মনোযোগ নাও থাকতে পারে। অথবা বলা যেতে পারে লেখক ভেতরে ভেতরে নিজে সব কিছুই বুঝতে পারেন অর্থাৎ তার লেখার নন্দন-তাৎপর্য তিনি নিজে যেভাবে নিজের ভেতরে তৈরি করে নেওয়ার ফলে তিনি নিজে তা উপলব্ধি করতে পারেন ঠিক সেভাবে পাঠক যে বুঝতে পারবেন এমন কোনো কথা নেই; যথক্ষণ পর্যন্ত তা পাঠকের গ্রহণ-ক্ষমতার নাগালে না আসবে ততক্ষণ পাঠক তা যথাযথ ভাবে রিসিভ না করতে পারাই স্বাভাবিক। অথচ লেখক নিজে যেভাবে বোঝেন তিনি যদি মনে করে বসে থাকেন যে পাঠও সেভাবে বুঝতে পারবেন তাহলে এখানে একটা গ্যাপ তৈরি হয়; লেখক নিজের লেখার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হলে এ অবস্থাকে তিনি ওভারকাম করতে পারেন না; এ অবস্থায় সম্পাদক তাকে সাহায্য করতে পারেন। সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রেও সম্পাদকের ভূমিকা ভালো ফলাফল নিয়ে আসতে পারে। যেমনটি ঘটেছিল এলিয়টের ক্ষেত্রে, তার ওয়েস্ট ল্যান্ড লেখার পর; আমরা যে ওয়েস্ট ল্যান্ড পাঠ করি তা এজরা পাউন্ড এর সম্পাদিত ‘ওয়েস্টল্যান্ড’; এক্ষেত্রে এজরা পাউন্ডের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমন উদারহণ অনেক রয়েছে। দায়বদ্ধতার বিষয়ে এভাবেও ভাবা যেতে পারে। আমি দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি তুলেছি সম্পাদকের কা-জ্ঞানের প্রেক্ষিতে। সম্পাদক অথবা সমালোচক অথবা একাডেমিশিয়ানরা লেখককে শাসন করবে এটা তো আর কাম্য নয়; এ জায়গায় লেখকের দায়বদ্ধতা সবার আগে। অথচ লেখকের ভেতর কাঙালেপনা থাকলে দায়বদ্ধতার জায়গাটিকে তিনি পদদলিত করেন এবং এক্ষেত্রে তিনি পারসোনালিটি তৈরির যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। আর লেখকের এই পারসোনালিটির বিষয়টি খুব জরুরি। এটি না থাকলে তিনি তার লেখার বৈশিষ্ট্যকে পৃথক মাত্রায় নিজের প্রবণতায় লেখায় প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হবেন। আর এ কারণেই গড়পড়তা লেখকদের লেখাকে পৃথক করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই দায়বদ্ধতা থেকেই তার অহঙ্কার তৈরি হয়; যে অহঙ্কারটি তাকে ক্রমাগত লেখক হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আর এই দায়বদ্ধতার কারণে তিনি বহুজনের মত হয়ে উঠতে পারেন না। বরং ক্রমাগত সবার থেকে পৃথক হয়ে অসামাজিক হয়ে ওঠেন। এর ফলে এমন হওয়াও সম্ভব যে তাকে তার সমকাল ঠিক মেনে নেন না বা পছন্দ করেন না। তারপরও তিনি তার নিজের শিল্পের বিষয়ে পরিষ্কার; তিনি বোঝেন তিনি কী করতে চান বা কী করতে যাচ্ছেন। ফলে তিনি তো এক্ষেত্রে এক ধরনের অহমিকা তৈরি করে নেবেনই; আর তিনি এক্ষেত্রে মিডিয়া বা সম্পাদক বা প-িতদের ঠিক মেনে নিতে পারবেন না; এটাই স্বাভাবিক। আর আমরা এও জানি যে, মিডিয়া সব সময় এগিয়ে থাকা শিল্প বুঝে ওঠার যোগ্যতা রাখে না; বা বিবিধ রাজনৈতিক কারণে সে দায়ভার তারা নিতে প্রস্তুত নয়; যদিও বড় বড় প্রকাশকদের এডিটোরিয়াল বোর্ড সারা বিশ্বেই কাজ করে যাচ্ছে। তারপরও বলব মিডিয়া সব সময় প্রতিষ্ঠিত ও স্বীকৃত ফরমেডের বাইরে যেতে প্রস্তুত নয়। তা হলে প্রশ্ন উঠতে পারে আপনি যদি নোতুন ফর্মে কাজ করেন সেটি প্রকাশের দায়িত্ব কে নেবে? আমি মনে করি এক্ষেত্রেও রয়েছে লেখকের দায়বদ্ধতা। লেখক বুঝতে চেষ্টা করবেন ঠিক কোন ফর্মে তিনি তার পাঠকের সাথে যোগাযোগ তৈরি করবেন। হতে পারে ধীরে; হতে পারে পাঠক হোচট খাবেন; কিন্তু লেখকই সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি ঠিক কীভাবে অগ্রসর হবেন। বিষয়টির সুরাহা লেখকের কলমে; তারপরে প্রশ্ন উঠবে পাঠক কীভাবে পাঠ গ্রহণ করবেন।

আমি বিশ্বাস করি, শেষ পর্যন্ত একজন সত্যিকারের লেখক অভিধান-আশ্রিত পা-িত্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অনিবার্য পাঠ গ্রহণে নিমগ্ন থাকতে বাধ্য হন। এই পাঠ যতটা না পুস্তকনির্ভর তার চেয়েও হাজার গুণ অধিক পারিপার্শ্বিকতা নির্ভর। ভার্জিনিয়া উলফের মতো লেখক আত্মস্থ করেন, লেখালেখি মূলত বুনোহাঁসের পাশ্চাদধাবন। এই বুনোহাঁসের পিছে ছুটতে ছুটতে এক সময় তিনি আবিষ্কার করেন, জীবনকেই তিনি রূপান্তরিত করেছেন শিল্পে। সুতরাং তাকে দাঁড়াতে হয় বৌদ্ধিক অবক্ষয়ের মুখোমুখি এবং সত্যিকার অর্থে তিনি যখন পক্ষান্তরে নিজেকেই লিখতে থাকেন তখন তার শরীরের প্রতিটি রোমকূপে সঞ্চিত হয় সুখ, কাঁপতে থাকে অস্তিত্ব। এই অস্তিত্ব, পক্ষান্তরে জান্তব বর্ণমালায় জীবনকে জাগিয়ে তোলার যন্ত্রণা। মুক্তগদ্যের ইশারায় আমি সেই অস্তিত্বমুখর জান্তব-জীবনের সন্ধ্যান করে চলেছি পরিণতিহীন; সমাপ্তিবিহীন।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ