মোজাফফর হোসেনের একটি জরুরী বই



কবিতা নিয়ে অনেক কথা-বার্তা বলেন অনেকেই। কবিতা নিয়ে অনেক বই-পত্রও লেখা হয়েছে--হচ্ছে। কিন্তু গল্প নিয়ে লেখাপত্র খুব বেশি নেই। যা আছে তার মধ্যে থেকে গল্পের কলকব্জা উদ্ধার করা অসম্ভব। সবে ভরসা সৈয়দ শামসুল হকের মার্জিনে মন্তব্য বইটি।

অনেকেই মনে করেন ইচ্ছে করলেই কবিতা লেখা যায়। গল্প আরো সহজ। একটা নায়িকা আর নায়ক খাড়া করলেই হল। একটু প্রেম। একটু বিরহ। মাঝখানে সেক্স।আর কিছু ডায়লগ--যার সঙ্গে মূল আখ্যানের মিলঝিল নেই।

এর ফাঁকে প্রথমালো অনুগত লেখক-গল্পকার মেকিং প্রকল্প তৈরি করে গল্পকারদের সম্ভাবনাকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। যাদের সম্ভাবনা আছে বা থাকতে পারে--তাদের গল্পটল্প ছাপিয়ে--প্রথমালো বর্ষ সেরা পুরুষ্কার-টুরুশকার দিয়ে তাদেরকে চাঙ্গে তুলে দিচ্ছে প্রথমালো। সেখান থেকে নামার উপায় নেই। নামবে কি--সেই চাঙ্গ তো আর চাঙ্গ নয়, ওটা বোকার স্বর্গ। তারা নিজের গল্পও বোঝেন না। অন্যের গল্পও বোঝেন না।কারো গল্পই বোঝেন না। গল্প যে একটি আয়াস সাধ্য ব্যাপার, উত্তরাধীকারের ব্যাপার--পঠন-পাঠনের ব্যাপার--নির্মাণের ব্যাপার--এই ব্যাপারগুলো তাদের অজানা। তারা জানেন 'সাজ্জাদ ভাই' কইলেই হৈল। মজার ব্যাপার হলো 'সাজ্জাদ ভাই' নিজেই জানেন না গল্প জিনিসটা কি!

একটা সহজ কথা কই। গলায় স্বর থাকলেই গান হয় না। গানের জন্য গানের চর্চার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই চর্চা ছাড়া যারা গান করতে চান তারা খুব বেশি হলে বাথরুম সিঙ্গার হতে পারেন। জন-সমক্ষে গাইলে তাড়া খাওয়ার আশঙ্কা আছে।

আরেক দল ভাই-বেরাদার আছেন--তারা লেখেন বটে, তবে লেখেন কমলকুমার মজুমদার আর শহীদুল জহির। নিজের লেখাটি লেখেন না--লিখতে পারেন না। ফলে সেটা যা হয়--তা কমলকুমারও হয় না। শহীদুল জহিরও হয় না। সেটা হয় আবর্জনা। অথচ আমাদের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আছেন, হাসান আজিজুল হক আছেন, হূমায়ূন আহমেদ আছেন। আমরা কেউ খুঁজেও এদেরকে শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করি না। তাদের লেখাকে পাঠ্য-পুস্তক হিসেবে দেখি না। গল্পের মধ্যে থেকে গল্পের কলকব্জাগুলো খুলে খুলে দেখি না। গল্প-নির্মাণের পথে যাই না। অথচ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ভরেই রয়েছে অসামান্য সব মহত্তম গল্প। লেখার কায়দাটা জানতে পারলেই লেখা সম্ভব সেই মহৎ কাহিনীগুলো।

আমাদের সৌভাগ্য মোজাফফর হোসেন আছেন। তিনি নিজে গল্পকার। অনুবাদক। স্বচ্ছ চিন্তার অধিকারী। লেখাপড়া করেছেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। সাহিত্যপত্রিকা প্রকাশ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। ঢাকায় একটি সাপ্তাহিক সাময়িকীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রের মগ্ন দর্শক। মোজাফফর হোসেনের আরেকটি বড় গুণহল--তিনি কোনো গ্রুপ তৈরি করেন না। কোনো গ্রুপেও থাকেন না। এইসব গ্রুফবাজিকে হাবিজাবি জ্ঞান করেন। নিজের মত করে তিনি লিখে চলেছেন গল্প, অনুবাদ করছেন বিশ্বসাহিত্বের সেরা গল্পগুলো, শুধু অনুবাদ নয়—সে-গল্পগুলো সেরা গল্প কী করে হয়ে উঠেছে সেটাও ভেঙ্গে চুরে দেখে নিচ্ছেন, সেই দেখার মধ্যে থেকেই লিখে চলেছেন গল্প লেখার শৈলী নিয়ে নানা লেখা। এর উদ্দেশ্য হল--তিনি নিজে শ্রেষ্ঠ গল্প লিখতে চান। শ্রেষ্ঠ গল্পলেখার ক্রাফট বা কৌশলগুলো নতুন গল্পকারদের জানাতে চান। নির্মাণ করে নিতে চান শিক্ষিত গল্পকার ও শিক্ষিত পাঠক। তিনি জানেন অসীম মূর্খতা নিয়ে শিল্পী হওয়া যায় না। কাদা হাতে থাকলেই ভাস্কর্য গড়া যায় না। এই কাঁদা দিয়ে তিনি কী গড়তে চান--কীভাবে গড়তে হয় সেটা জানা থাকা চাই। শুধু জানা থাকলেই হবে হবে না-- এই জানাকে আয়ত্তের মধ্যে আনা চাই। চর্চার মধ্যে নেওয়া চাই। দক্ষতার মধ্যে টানা চাই। তিনি জানেন আগে মর্ম থেকে মূর্তিটির একটা কঙ্কাল বানাতে হবে। তার গায়ে পরাতে হবে মাংস। মজ্জা। অন্ত্র। তন্ত্র। রক্ত। প্রাণ। শক্তি। লাবণ্য। অনন্য। এভাবেই একটি বাঁশ কারো হাতে মাথায় বাড়ি দেওয়ার মত লাঠি হয়ে ওঠে। কারো বা হাতে হয়ে ওঠে আড় বাঁশি। সে বাঁশিতে আরেকজন শিল্পী সুর তোলেন। সে সুরে ঘরে থাকা দায়।

এই অভিজ্ঞান থেকেই মোজাফফর হোসেন লিখেছেন 'বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ' নামে একটি বই।

এই বইটির মুখবন্ধে তিনি বলেছেন-- শিল্প বা সাহিত্যের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত জিজ্ঞাসার বিষয়টিও। নতুন কিছু সৃষ্টি হওয়া মাত্রই সৃষ্টি হয় তার প্রাসঙ্গিকতা বা উপযোগিতার প্রশ্নও। তৈরি হয় দেখবার নতুন নতুন দৃষ্টি। একটি শিল্পকর্ম (ArtWork) বা সাহিত্যকর্মকে (Literary Text) এমন বেশ কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি (Point of View) থেকে পাঠ করা যায়। কোনো সাহিত্যকর্মকে বিশ্লেষণ ও ব্যবচ্ছেদ করার জন্য এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরী। দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে তাত্ত্বিক বা সাহিত্যসমালোচকরা বলছেন-- সাহিত্যতত্ত্ব (Literary Theory)| সাহিত্যতত্ত্ব হল একটি সাহিত্যকর্মকে মূল্যায়নের একটি প্রামাণ্য ছক।

এই সাহিত্যতত্ত্বগুলো নিয়ে তিনি প্রাঞ্জলভাবে আলোচনা করেছেন। মূল গল্পগুলোর মধ্য থেকে এই সাহিত্যতত্ত্বগুলোকে চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন। একটি সাহিত্যকর্মে কী ধরনের ভাষা (Language) ব্যবহার করা হয়েছে, আখ্যানভাগে কোন কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে, লেখকের বলার স্বরটা (Tone) কেমন, ভাষার অলঙ্করণগুলো (Rhetoric & Prosody)কোন ধরনের, এসব বিষয়াদিও প্রতিটি গল্পের মধ্যে থেকে বের করে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ এই বইটি হল গল্পবিদ্যার এনাটমী এবং আলকেমী। এই বইটি পাঠের মধ্যে দিয়ে গল্পের জগৎকে আবিষ্কার করা যায়।

মোজাফফর হোসেন 'বিশ্বগল্পের বহুমাত্রিক পাঠ' নামের এই বইটিতে ১১ জন বিদেশী গল্পকারের সেরা গল্পের অনুবাদ ও সেই গল্পের কলকব্জা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এঁরা হলেন-- এডগার অ্যালান পো (আমেরিকা, ১৮০৯-১৮৪৯, কেটচপিন (আমেরিকা, ১৮৫০-১৯০৪),ম্যারি ও’বেইলি (জার্মান, ১৮৭৩-১৯৩৯), জেমস জয়েস (আয়ারল্যান্ড, ১৮৮২-১৯৪১), কাফকা (জার্মান,১৮৮৩-১৯২৪), জেমস থার্বার (আমেরিকা, ১৮৯৪-১৯৬১), আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (আমেরিকা, ১৮৯৯-১৯৬১),মারজরি কিনান রোলিং (যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৯৬-১৯৫৩), রোয়ল্ড ডাল (ইংল্যান্ড ১৯১৬-১৯৯০),ভি এস নাইপল (ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ লেখক, ১৯৩২) ও হারুকি মুরাকামি (জাপান, ১৯৪৯।এদের সঙ্গে বাংলা ভাষার গল্পকার হিসেবে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সেলিনা হোসেনের গল্প।

গল্পের এই কলকব্জাকে বোঝার জন্য মোজাফফর হোসেন বইটিতে যুক্ত করেছেন একটি সাহিত্য কোষ। সেগুলো হল--বিন্যাস (Plot), কাঠামো (Setting), বর্ণনাকৌশল (Narrative), চিত্রকল্প (Image), রূপক (Allegory), সিমিলি-মেটাফর(Simile& Metaphor), শ্লেষ বা আয়রনি (Irony), পূর্বসূত্র বা অ্যালুশন (Allusion),, কথারূপক (Parable), উপরূপক (চধৎধনষব), অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি বা চমক (Twist), উন্মীলন বা এপিফ্যানি (Epiphany), চেতনাপ্রবাহ (Stream of Consciousness), ড্রামাটিক মনোলগ(DramticMonologue), পরাবাস্তববাদ (Surrerialism), জাদুবাস্তববাদ (Magic Realism), অনুগল্প (Flash Fiction), তুলনামূলক সাহিত্য (Comparative Litarature),গল্পহীন বা ভাবাশ্রীত গল্প।

একটি অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন সাহিত্যের নানা তত্ত্ব। সেগুলো হল--অবয়ববাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Structural Literary Theory), রূপতান্ত্রিক সাহিত্যতত্ত্ব(FormalistLiterary Theory), বিনির্মাণ সাহিত্যতত্ত্ব (DeconstructionistLiterary Theory), লেখক-জীবনীভিত্তিক সাহিত্যতত্ত্ব (Biographycal LiteraryTheory) , ঐতিহাসিক সাহিত্যতত্ত্ব (Historical LiteraryTheory), মার্ক্সীয় সাহিত্যতত্ত্ব (MarxistLiterary Theory), লিঙ্গভিত্তিক বা নারীবাদসাহিত্যতত্ত্ব (এবহফবৎ(Genderor Feminist Litarary Theory), মনস্তাত্ত্বিক সাহিত্যতত্ত্ব (Psyco-AnalyticalLiterary), অস্তিত্ববাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Existential LiteraryTheory), উত্তর-উপনিবেশবাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Post-Colonial Litarary Theory), সামাজিক সাহিত্য-তত্ত্ব(SocialLitarary Theory), পাঠক-প্রতিক্রিয়া সাহিত্যতত্ত্ব(ReaderResponse Literary Theory), পরিবেশবাদ সাহিত্যতত্ত্ব (Eco-criticism), বাস্তববাদ সাহিত্যতত্ত্ব RealismLiterary Theory)।

মোজাফফর হোসেনের ভাষা সহজ, সরল, প্রাঞ্জল ও আকর্ষণীয়। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় এ ধরনের বই এই প্রথম। বইটি এবারের বইমেলায় আসবে। এখন পাওয়া যাচ্ছে -বি-৬৪, কনকর্ড এম্পরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স, ২৫৩-২৫৪ ড. কুদরত-এ-খুদা সড়ক ( এ্যালিফেন্ট রোড) কাঁটাবন, ঢাকায়। । প্রকাশক অনুপ্রাণন। দাম সহনীয়। প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু। এই বইটি মোজাফফর হোসেন উৎসর্গ করেছেন 'গল্প'কে। কে এই 'গল্প'? 'গল্প' অক্ষরের গল্প নয়--রক্ত-মাংশের, প্রাণ ও উত্তরাধীকারের। গল্প হল মোজাফফর হোসনের আত্মজ--একমাত্র পুত্র। অক্ষরে ও জীবনে গল্পই মোজাফফর হোসেনের সবকিছু।

গল্পকার ও গল্পপাঠকের জন্য এই বইটি অবশ্য পাঠ্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ