বনি আমিন
গল্পের নাম ‘ আলোর অন্ধকার’। গল্পকার মনিরা কায়েস। মূল বক্তব্য বিষযের সাথে গল্পের নামকরণটি বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। সেহেতু নামকরণের দিকটিতে গল্পকার সুচারু শিল্প নৈপূণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। ‘আলো’ এই শব্দের সাথে ষষ্ঠি বিভক্তি ‘র’ প্রয়োগ করে একদিক থেকে আলোকিত মানুষদের উপস্থাপনাকে ব্যঞ্জনামন্ডিত করেছেন, অন্যদিকে তেমনি আলোর নিচে যে অনিবার্য অন্ধকার আছে সেই সত্যটি সচেতনভাবে বলে গেছেন।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজিম। তার অভিজ্ঞতার বিবরণের মধ্য দিয়ে এই আলো-অন্ধকারের পরিচয় উচ্চকিত হয়েছে। নাজিম পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। খ্যাতিমান লেখক শরাফত ভাইয়ের( গল্পে নামটি এভাবেই ব্যবহৃত) ছবি তোলার জন্য তার সফর সঙ্গী হয়েছেন ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে। এবং নাজিম চরিত্রের মাধ্যমে এ ধরণের খ্যাতিমান লেখকদের ব্যক্তিগত জীবনের কলঙ্কিত দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে। শরাফত ভাইয়ের সৃজিত সাহিত্য যদি হয় আলোর দিকটি, তবে তার জীবনের নারী দুর্বলতা তথা রিরংসা তাড়িত হয়ে কন্যাতুল্যা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবতীকে ট্যুরে যাওয়া বাংলোতে নিয়ে এসে ভোগ করার ঘটনা হয়েছে এই গল্পের অন্ধকারের দিকটি। এবং মনিরা কায়েস তাঁর এই গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সেই বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন বা পুনরায় প্রশ্নবিদ্ব করেছেন আমাদের সমাজের সেই সব খ্যাতিমানদের যাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কর্মে সুনিপুণ কিন্তু আজো নারীকে তার প্রকৃত মর্যদা না দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে করে রেখেছেন ভোগ্য পণ্য । লক্ষ্যণীয় মনিরা কায়েসের এই সাক্ষাৎকার বাণীটি: যেটি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে দিয়েছিলেন একটি ছোট কাগজের জন্য । তাঁর গল্প ‘ ১০০ বছরের নি:সঙ্গতা অথবা রানুর তৃতীয় ভাগ’ গল্প সম্পর্কে কথাটির অবতারণা।
“গল্প ‘১০০ বছরের নিঃসঙ্গতা অথবা রাণুর তৃতীয় ভাগ’ নামের গল্পে পুরুষতন্ত্রের জান্তবতা অতি নিপুণভাবে জাগ্রত করেছেন। নারীর উপর এই যে পীড়ন তার সামগ্রিক বিনাশ কখন সম্ভব ?
: পুরুষতন্ত্রের জান্তবতা, তার আগ্রাসন কমে আসবে তখনই ঐ যখন কি না ‘নারী’কে মানুষ বলে মনে করতে পারবো আমরা এবং নারীর সমস্যাগুলোকে কেবল নারী নয় পুরুষও একইসঙ্গে অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু আদতে তা কী হয় ? নারীকে তাই লড়াই চালিয়ে যেতে হয় একাকীই, কী পরিবারে কী সমাজে কী রাষ্ট্রে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশে নারীর যে অবস্থা তাতে গাভীতে আর নারীতে কোনও পার্থক্য নাই। খেয়াল করে দেখবেন, তাঁদের ঘিরে রেখেছে কিন্তু পুরুষই।........” এই সাক্ষাৎকারে সমাজে নারীর অবস্থান বিষয়ে আরো অনেক কথায় মনিরা কায়েসের ক্ষোভ প্রকাশিত হযেছে। সুতরাং এই ‘আলোর অন্ধকার’ গল্পেও সেই বিষয়টি উঠে এসেছে। আমরা মূল গল্পে ফিরে গিয়ে বিষয়টির উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। “শরাফত ভাইএর উৎকন্ঠা অন্যখানে। আজ রাতে তুমুল আড্ডা হবে রুমে। অসীম তার কাস্টমসের এক বন্ধুর কাছ থেকে ক’বোতল দামী পানীয় জোগাড় করেছে, তার ওপর সঙ্গে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শরাফত ভাইয়ের গুণমুগ্ধ দুই সুন্দরী তরুণী, যারা ভালো আবৃত্তি করে এবং ফ্ল্যাটারিতেও কম যায় না। তাদের একজন তো দিব্যি এই তুমুল বৃষ্টির ভেতর দুপর বেলায় শরাফত ভাইকে পদ্মার হাওয়া খাইয়ে নিয়ে এল।..” ( পৃ: ১) এই প্রসঙ্গে পূর্বে ময়মনসিংহে যাওয়ার এক ঘটনাও উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজিম : ‘…এর আগে একবার, সে তখন ময়মনসিংহে, শরাফত ভাই গিয়েছিলেন স্থানীয় এক কবিতা উৎসবে। নাজিমের সাংবাদিক বন্ধু আতিকের ভাগনীকে দেখা গেল ঘুর ঘুর করছে শরাফত ভাইয়ের পেছন পেছন। মেয়েটি কালো, তবে বেশ আকর্ষণীয়, বড় বড় চোখ। শরাফত ভাই কী করে যে তাকে মোহবিষ্ট করলেন, মেয়েটি নাকি সে রাতে তাঁর বাংলোয় যাবেই যাবে, শেষ-মেষ আতিককে রাখা হল ভাগনি পাহারায়। এদিকে সে গেছে ছবি তুলতে, তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারটা, শরাফাত ভাই তো রেগে পানপাত্র ছুঁড়ে ফেললেন বারন্দায়, ওকে বললেন, নাজিম, তুমি যাওনা একটু । গিয়ে নিয়ে এসো । কিছু না, জাস্ট একটু গল্প করব। জানোই তো মেয়েটি কীরকম ভক্ত আমার।..’ বা ‘......সত্যি সত্যিই ঝামেলা বেঁধেছিল। মেয়েটির প্রেমিক আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র, গান-টান গেয়ে নাম করেছে বেশ, সে তো বেশ কিছু ছেলে জোগাড় করে ভোরবেলা এসে হাজির শরাফাত ভাইকে রাম-ধোলাই দেবার জন্য। তখন সে, আতিক আর শামসুল মিলে যদি তাঁকে এসকর্ট করে ঢাকাগামী ট্রেনে না তুলে দিত, তাহলে অপমানিত শরীর নিয়ে ফিরতে হত তাঁকে।.....’ এ ছাড়াও আছে আরেক খ্যাতিমান গল্পকার ইফতেকার স্যারের গল্প। যিনি পতিতালয়ে গিয়ে তাঁর ফোকাল চশমা হারিয়ে রেখে আসেন আর সেটি পেয়ে যান তারই ছাত্র । এই সব হলো আলোদের কালো ভূবন যাকে লাইটিং করেছেন মনিরা কায়েস তাঁর এই গল্পে। অবশ্য এই স্যালিব্রেটিদের এ ধরণের কার্যাবলীকে একটি তাত্ত্বিক কথা দিয়ে সেরে ফেলার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। যেমন, নাজিম বোধ করছে... ‘আসলে কবি-লেখকেরা বোধহয় কোনও পথেই সুখ পান না। এই যেমন ইফতেখার স্যার, ...’ কিন্তু সেই নাজিমই শরাফত ভাইয়ের প্রতি ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে, তাঁর মুখে ঘুষি মারার তীব্র ইচ্ছা পোষণ করে।
এই গল্প ‘আলোর অন্ধকার’-এর দুটি অংশ একটি ওপরে বর্ণিত ওই শরাফত ভাই, ইফতেখার স্যারদের আলোর অন্ধকার এবং অন্যটি গল্পের পরবর্তি অংশ রাজশাহীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত নাজিমের বন্ধু জাকিরের পরিবার প্রসঙ্গ। দুটি অংশ একই বিষয়ের বিবরণকে তুলে ধরেছে এবং শেষের অংশের বিবরণই গল্পকারের গল্পের মূল বিষয়বস্তু। উপকাহিনী হিসেবে গল্পের প্রথম অংশটি সংযোজিত হয়েছে। মনিরা কায়েস গল্পের ভেতরে যে গল্প লেখেন, গল্পময় হয়ে যান এ হলো তারই আরেকটি উদাহরণ। এই শেষের অংশে আলোর দিকটি ফুটে উঠেছে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক সহিংসতায় বাবার দীর্ঘশ্বাস থেকে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মৌলিক ইতিহাস এই একটি ছোট গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। জাতির প্রকৃত ত্যাগী বীর সন্তান যাঁরা, তাঁরা পায়নি তাঁদের প্রকৃত সম্মান। গল্পের মধ্যে জাকিরের ভাই আজাদ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধ। রাজশাহী অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন । অথচ রাজশাহীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে আজাদের নাম নেই। ঐ অঞ্চলে আজাদের বাবার যে সম্মান মর্যদাটুকু পাওয়ার কথা সেটি তিনি পান না। পরিবর্তে কিছু সুবিধাবাদী সব ফায়দা লুটে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুফলসমূহ ভোগ করে নিচ্ছে। স্বাধীনতার পরে গণতান্তিক লড়াইয়ে সেই বাবার আরেকটি সন্তান সেই সুবিধাবাদীদের হত্যার শিকার হয়। অথচ সেটারও কোন মূল্য মর্যদা আজাদের বাবা পান না, যিনি কিনা ছিলেন স্থানীয় স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। যাঁর আছে আজকে রাজশাহীতে কবি হিসাবে সম্বর্ধনা পাওয়া শরাফত ভাইয়ের মতো সরাসরি ছাত্র। নাজিম তার বন্ধু পরিবারের বাবা মার খবর নিতে অনেক খুঁজে-পেতে সেই সহকারী শিক্ষকের বাড়িতে যায়। অথচ একই সফরসঙ্গী হওয়া সত্বেও খ্যাতিমান সাহিত্যিক শরাফত ভাই তার সেই শিক্ষকের খোঁজ দূরে থাক, নাজিম সেখানে যাবেন সেটা জেনেও নাজিমকে বুঝতে দেন না যে যাঁর বাড়িতে সে যাচ্ছে তিনি তার সরাসরি শিক্ষক ; অথচ এই শরাফত ভাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীর জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। দেশের জন্য প্রাণ হারানো দুই পুত্র সন্তানের রির্টায়ার জনক আজ একমাত্র কন্যা সন্তান আর পরিবার নিয়ে রোগশয্যায়। তিনি রাষ্ট্রের কাছে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার আশা করতে পারেন না, চান শুধু যোগ্য মর্যদাটুকু। আর সেই একান্ত প্রাপ্তিটুকু যখন তার জোটেনা তখন তিনি অসুস্থ শরীরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ছেলের বন্ধুদের সহ্য করতে পারেন না। বাড়িতে শহীদ পরিবারের খবর নিতে কেউ ঢুকলে তাদেরকেও তিনি সহ্য করতে পারেন না। আলোর ইতিহাস গড়েছেন যাঁরা, তাঁদের পরিবার অসহায় অন্ধকারে। সুতরাং একেই বলা যায় আলোর অন্ধকার। মনিরা কায়েস কথার বুননে ছোটগল্পের আঙ্গিকে যা নির্মাণ করেছেন এবং দেশ-কাল-মানুষের জন্য কিছু বুঝাতে চেয়েছেন হয়তবা।
লেখক পরিচিত
মনিরা কায়েস
অধ্যাপক। গল্পকার। প্রবন্ধকার
গল্পগ্রন্থ : মাটি পুরাণ পালা।
বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা : মূল্যায়নের রূপান্তর
ঐ যে স্ট্রেচার আসছে , কথামনুষ্যপুরাণ, ধুলোমাটির জন্মসূত্রে, সত্যি ভূতের গল্প, জলডাঙার বায়োস্কোপ।
আলোচক পরিচিতি
বনি আমিন
জন্মস্থান: সাতক্ষীরা (সুন্দরবনের পাশ ঘেষে শেষ জনপদে) লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ওখানেই(মাধ্যমিক পর্যন্ত) এরপর খুলনা এবং রাজশাহী।
কর্মস্থল: গোপালগঞ্জ--দিগনগর গ্রামে।
গল্পের নাম ‘ আলোর অন্ধকার’। গল্পকার মনিরা কায়েস। মূল বক্তব্য বিষযের সাথে গল্পের নামকরণটি বেশ সঙ্গতিপূর্ণ। সেহেতু নামকরণের দিকটিতে গল্পকার সুচারু শিল্প নৈপূণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। ‘আলো’ এই শব্দের সাথে ষষ্ঠি বিভক্তি ‘র’ প্রয়োগ করে একদিক থেকে আলোকিত মানুষদের উপস্থাপনাকে ব্যঞ্জনামন্ডিত করেছেন, অন্যদিকে তেমনি আলোর নিচে যে অনিবার্য অন্ধকার আছে সেই সত্যটি সচেতনভাবে বলে গেছেন।
গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজিম। তার অভিজ্ঞতার বিবরণের মধ্য দিয়ে এই আলো-অন্ধকারের পরিচয় উচ্চকিত হয়েছে। নাজিম পেশায় একজন ফটোগ্রাফার। খ্যাতিমান লেখক শরাফত ভাইয়ের( গল্পে নামটি এভাবেই ব্যবহৃত) ছবি তোলার জন্য তার সফর সঙ্গী হয়েছেন ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে। এবং নাজিম চরিত্রের মাধ্যমে এ ধরণের খ্যাতিমান লেখকদের ব্যক্তিগত জীবনের কলঙ্কিত দিকগুলো উন্মোচিত হয়েছে। শরাফত ভাইয়ের সৃজিত সাহিত্য যদি হয় আলোর দিকটি, তবে তার জীবনের নারী দুর্বলতা তথা রিরংসা তাড়িত হয়ে কন্যাতুল্যা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবতীকে ট্যুরে যাওয়া বাংলোতে নিয়ে এসে ভোগ করার ঘটনা হয়েছে এই গল্পের অন্ধকারের দিকটি। এবং মনিরা কায়েস তাঁর এই গল্পের মাধ্যমে পাঠকের কাছে সেই বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন বা পুনরায় প্রশ্নবিদ্ব করেছেন আমাদের সমাজের সেই সব খ্যাতিমানদের যাঁরা তাঁদের স্ব স্ব কর্মে সুনিপুণ কিন্তু আজো নারীকে তার প্রকৃত মর্যদা না দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে করে রেখেছেন ভোগ্য পণ্য । লক্ষ্যণীয় মনিরা কায়েসের এই সাক্ষাৎকার বাণীটি: যেটি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরকে দিয়েছিলেন একটি ছোট কাগজের জন্য । তাঁর গল্প ‘ ১০০ বছরের নি:সঙ্গতা অথবা রানুর তৃতীয় ভাগ’ গল্প সম্পর্কে কথাটির অবতারণা।
“গল্প ‘১০০ বছরের নিঃসঙ্গতা অথবা রাণুর তৃতীয় ভাগ’ নামের গল্পে পুরুষতন্ত্রের জান্তবতা অতি নিপুণভাবে জাগ্রত করেছেন। নারীর উপর এই যে পীড়ন তার সামগ্রিক বিনাশ কখন সম্ভব ?
: পুরুষতন্ত্রের জান্তবতা, তার আগ্রাসন কমে আসবে তখনই ঐ যখন কি না ‘নারী’কে মানুষ বলে মনে করতে পারবো আমরা এবং নারীর সমস্যাগুলোকে কেবল নারী নয় পুরুষও একইসঙ্গে অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু আদতে তা কী হয় ? নারীকে তাই লড়াই চালিয়ে যেতে হয় একাকীই, কী পরিবারে কী সমাজে কী রাষ্ট্রে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের এই দরিদ্র দেশে নারীর যে অবস্থা তাতে গাভীতে আর নারীতে কোনও পার্থক্য নাই। খেয়াল করে দেখবেন, তাঁদের ঘিরে রেখেছে কিন্তু পুরুষই।........” এই সাক্ষাৎকারে সমাজে নারীর অবস্থান বিষয়ে আরো অনেক কথায় মনিরা কায়েসের ক্ষোভ প্রকাশিত হযেছে। সুতরাং এই ‘আলোর অন্ধকার’ গল্পেও সেই বিষয়টি উঠে এসেছে। আমরা মূল গল্পে ফিরে গিয়ে বিষয়টির উদাহরণ তুলে ধরতে চাই। “শরাফত ভাইএর উৎকন্ঠা অন্যখানে। আজ রাতে তুমুল আড্ডা হবে রুমে। অসীম তার কাস্টমসের এক বন্ধুর কাছ থেকে ক’বোতল দামী পানীয় জোগাড় করেছে, তার ওপর সঙ্গে থাকবে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শরাফত ভাইয়ের গুণমুগ্ধ দুই সুন্দরী তরুণী, যারা ভালো আবৃত্তি করে এবং ফ্ল্যাটারিতেও কম যায় না। তাদের একজন তো দিব্যি এই তুমুল বৃষ্টির ভেতর দুপর বেলায় শরাফত ভাইকে পদ্মার হাওয়া খাইয়ে নিয়ে এল।..” ( পৃ: ১) এই প্রসঙ্গে পূর্বে ময়মনসিংহে যাওয়ার এক ঘটনাও উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছে গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজিম : ‘…এর আগে একবার, সে তখন ময়মনসিংহে, শরাফত ভাই গিয়েছিলেন স্থানীয় এক কবিতা উৎসবে। নাজিমের সাংবাদিক বন্ধু আতিকের ভাগনীকে দেখা গেল ঘুর ঘুর করছে শরাফত ভাইয়ের পেছন পেছন। মেয়েটি কালো, তবে বেশ আকর্ষণীয়, বড় বড় চোখ। শরাফত ভাই কী করে যে তাকে মোহবিষ্ট করলেন, মেয়েটি নাকি সে রাতে তাঁর বাংলোয় যাবেই যাবে, শেষ-মেষ আতিককে রাখা হল ভাগনি পাহারায়। এদিকে সে গেছে ছবি তুলতে, তখন প্রায় রাত সাড়ে এগারটা, শরাফাত ভাই তো রেগে পানপাত্র ছুঁড়ে ফেললেন বারন্দায়, ওকে বললেন, নাজিম, তুমি যাওনা একটু । গিয়ে নিয়ে এসো । কিছু না, জাস্ট একটু গল্প করব। জানোই তো মেয়েটি কীরকম ভক্ত আমার।..’ বা ‘......সত্যি সত্যিই ঝামেলা বেঁধেছিল। মেয়েটির প্রেমিক আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র, গান-টান গেয়ে নাম করেছে বেশ, সে তো বেশ কিছু ছেলে জোগাড় করে ভোরবেলা এসে হাজির শরাফাত ভাইকে রাম-ধোলাই দেবার জন্য। তখন সে, আতিক আর শামসুল মিলে যদি তাঁকে এসকর্ট করে ঢাকাগামী ট্রেনে না তুলে দিত, তাহলে অপমানিত শরীর নিয়ে ফিরতে হত তাঁকে।.....’ এ ছাড়াও আছে আরেক খ্যাতিমান গল্পকার ইফতেকার স্যারের গল্প। যিনি পতিতালয়ে গিয়ে তাঁর ফোকাল চশমা হারিয়ে রেখে আসেন আর সেটি পেয়ে যান তারই ছাত্র । এই সব হলো আলোদের কালো ভূবন যাকে লাইটিং করেছেন মনিরা কায়েস তাঁর এই গল্পে। অবশ্য এই স্যালিব্রেটিদের এ ধরণের কার্যাবলীকে একটি তাত্ত্বিক কথা দিয়ে সেরে ফেলার চেষ্টা যে হয়নি তা নয়। যেমন, নাজিম বোধ করছে... ‘আসলে কবি-লেখকেরা বোধহয় কোনও পথেই সুখ পান না। এই যেমন ইফতেখার স্যার, ...’ কিন্তু সেই নাজিমই শরাফত ভাইয়ের প্রতি ভেতরে ভেতরে রাগে ফেটে পড়ে, তাঁর মুখে ঘুষি মারার তীব্র ইচ্ছা পোষণ করে।
এই গল্প ‘আলোর অন্ধকার’-এর দুটি অংশ একটি ওপরে বর্ণিত ওই শরাফত ভাই, ইফতেখার স্যারদের আলোর অন্ধকার এবং অন্যটি গল্পের পরবর্তি অংশ রাজশাহীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদ এবং পরবর্তীকালে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত নাজিমের বন্ধু জাকিরের পরিবার প্রসঙ্গ। দুটি অংশ একই বিষয়ের বিবরণকে তুলে ধরেছে এবং শেষের অংশের বিবরণই গল্পকারের গল্পের মূল বিষয়বস্তু। উপকাহিনী হিসেবে গল্পের প্রথম অংশটি সংযোজিত হয়েছে। মনিরা কায়েস গল্পের ভেতরে যে গল্প লেখেন, গল্পময় হয়ে যান এ হলো তারই আরেকটি উদাহরণ। এই শেষের অংশে আলোর দিকটি ফুটে উঠেছে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা উত্তর রাজনৈতিক সহিংসতায় বাবার দীর্ঘশ্বাস থেকে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের মৌলিক ইতিহাস এই একটি ছোট গল্পে ফুটিয়ে তুলেছেন। জাতির প্রকৃত ত্যাগী বীর সন্তান যাঁরা, তাঁরা পায়নি তাঁদের প্রকৃত সম্মান। গল্পের মধ্যে জাকিরের ভাই আজাদ শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধ। রাজশাহী অঞ্চলে যুদ্ধ করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন । অথচ রাজশাহীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধার যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে আজাদের নাম নেই। ঐ অঞ্চলে আজাদের বাবার যে সম্মান মর্যদাটুকু পাওয়ার কথা সেটি তিনি পান না। পরিবর্তে কিছু সুবিধাবাদী সব ফায়দা লুটে নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুফলসমূহ ভোগ করে নিচ্ছে। স্বাধীনতার পরে গণতান্তিক লড়াইয়ে সেই বাবার আরেকটি সন্তান সেই সুবিধাবাদীদের হত্যার শিকার হয়। অথচ সেটারও কোন মূল্য মর্যদা আজাদের বাবা পান না, যিনি কিনা ছিলেন স্থানীয় স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক। যাঁর আছে আজকে রাজশাহীতে কবি হিসাবে সম্বর্ধনা পাওয়া শরাফত ভাইয়ের মতো সরাসরি ছাত্র। নাজিম তার বন্ধু পরিবারের বাবা মার খবর নিতে অনেক খুঁজে-পেতে সেই সহকারী শিক্ষকের বাড়িতে যায়। অথচ একই সফরসঙ্গী হওয়া সত্বেও খ্যাতিমান সাহিত্যিক শরাফত ভাই তার সেই শিক্ষকের খোঁজ দূরে থাক, নাজিম সেখানে যাবেন সেটা জেনেও নাজিমকে বুঝতে দেন না যে যাঁর বাড়িতে সে যাচ্ছে তিনি তার সরাসরি শিক্ষক ; অথচ এই শরাফত ভাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণীর জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। দেশের জন্য প্রাণ হারানো দুই পুত্র সন্তানের রির্টায়ার জনক আজ একমাত্র কন্যা সন্তান আর পরিবার নিয়ে রোগশয্যায়। তিনি রাষ্ট্রের কাছে আর্থিক সুবিধা পাওয়ার আশা করতে পারেন না, চান শুধু যোগ্য মর্যদাটুকু। আর সেই একান্ত প্রাপ্তিটুকু যখন তার জোটেনা তখন তিনি অসুস্থ শরীরে ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ছেলের বন্ধুদের সহ্য করতে পারেন না। বাড়িতে শহীদ পরিবারের খবর নিতে কেউ ঢুকলে তাদেরকেও তিনি সহ্য করতে পারেন না। আলোর ইতিহাস গড়েছেন যাঁরা, তাঁদের পরিবার অসহায় অন্ধকারে। সুতরাং একেই বলা যায় আলোর অন্ধকার। মনিরা কায়েস কথার বুননে ছোটগল্পের আঙ্গিকে যা নির্মাণ করেছেন এবং দেশ-কাল-মানুষের জন্য কিছু বুঝাতে চেয়েছেন হয়তবা।
লেখক পরিচিত
মনিরা কায়েস
অধ্যাপক। গল্পকার। প্রবন্ধকার
গল্পগ্রন্থ : মাটি পুরাণ পালা।
বাংলাদেশের রবীন্দ্রচর্চা : মূল্যায়নের রূপান্তর
ঐ যে স্ট্রেচার আসছে , কথামনুষ্যপুরাণ, ধুলোমাটির জন্মসূত্রে, সত্যি ভূতের গল্প, জলডাঙার বায়োস্কোপ।
আলোচক পরিচিতি
বনি আমিন
জন্মস্থান: সাতক্ষীরা (সুন্দরবনের পাশ ঘেষে শেষ জনপদে) লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ওখানেই(মাধ্যমিক পর্যন্ত) এরপর খুলনা এবং রাজশাহী।
কর্মস্থল: গোপালগঞ্জ--দিগনগর গ্রামে।
0 মন্তব্যসমূহ