ছুটির লেখা : শব্দের মধ্যে উঁকি ঝুঁকি

আনন্দ রোজারিও

শব্দের কোনো অর্থমূল্য নেই। শব্দবিদ্গণ মনে করেন, শব্দের দু ধরনের অর্থ আছে। একটা হল বহির-বাড়ির অর্থ। আরেকটি হল--ভেতর বাড়ির অর্থ। বহিরবাড়িতে বহুমানুষ থাকতে পারে। সেখানে সাধারণত সাধারণের ব্যবহারযোগ্য একটি অর্থ থাকে। সেভাবেই মানুষ শব্দকে ব্যবহার করেন।


আবার যারা একটু সৃজনশীল মানুষ তারা শব্দের এই একটি অর্থে সন্তুষ্ট থাকেন না। তারা শব্দের অন্তরঙ্গ হয়ে ভেতরবাড়িতে যান। সেখান থেকে শব্দের বহু অর্থের সন্ধান পান। নানা কাজের ধরণ অনুসারে সে অর্থগুলো ব্যবহার করেন। নানা পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়। শব্দ তখন বিচিত্রগামী হয়ে ওঠে। অন্ধকারে যে শব্দ ব্যবহৃত হয়--সেটা আলোতে ব্যবহৃত হয় না। যেমন আমরা শীতে লেপ ব্যবহার করি। শান্তি পাই। কিন্তু গরমে লেপ ব্যবহার করা যায় না। ব্যবহার করলে 'আজাব' বোধ হয়।

কলিম খান এই ভেতরবাড়ির শব্দের অর্থকে বলেছেন ক্রিয়ার্থবিধি অর্থ। আর ডিএইচ লরেঞ্চ বলেছেন --individual meaning. আর বহিরবাটির শব্দের অর্থকে বলেছেন--mob meaning.

ধরা যাক 'বাঁশ' শব্দটি। এর মব-অর্থ হল--উদ্ভিদ। উদ্ভিদবিদগণ বলেন--বাঁশ হল ঘাস পরিবারের উদ্ভিদ। ফলে আমরা বাঁশ বাগান থেকে বাঁশ কেটে আনি। হাট থেকে বাঁশ কিনে আনি। ঘরের খুঁটি বানাই। মাছ ধরার চাঁই বানাই। মাঁচান বানিয়ে তার উপরে বসি।

আবার ধরুন যতীন্দ্রমোহন বাকচী কাজলা দিদি কবিতাটিতে লিখেছেন, বাঁশ বাগানের মাথার উপরে চাঁদ উঠেছে ওই। কী অপরূপ সৌন্দর্য সৃষ্টি করছে এই বাঁশ বাগান শব্দ করে। চাঁদ এমনিতেই সুন্দর। কিন্তু বাঁশ বাগানের উপরে যখন চাঁদ ওঠে তখন সে সৌন্দর্য হয়ে ওঠে অপার মধুর। এর পরের লাইনটি দেখুন--মাগো আমার কাজলা দিদি কই। পুরো কবিতাটির বেদনায় আমরা মূহ্য হয়ে উঠি।

আবার দেখুন নজরুলের গানটি - 'কে বিদেশি বন-উদাসী' বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে'। কেমন একটা প্রেমের সলজ্জ আভাস দিচ্ছে।

কিন্তু বাঁশের লাঠি দিয়ে লোকটির মাথায় বাড়ি দিল। ফট করিয়া শব্দ হইল। এখানে বাঁশ শব্দটি সন্ত্রাসের সৃষ্টি করেছে।
অথবা দেখুন, আমাগো মণ্ডলবাবুর কাছে যাইও না, তিনি ভালো কাজের পাছায় বাঁশ দিয়ে দেবেনে।

একবার থানার পাশে একটি বাড়িতে থাকতাম। সেখান থেকে বড়বাবু অধস্তন পুলিশকে বলছে--অরে বাইর কইরা একটা বাঁশ ডলা দাও। বোঝা যাচ্ছে কোনো অপরাধীকে শাস্তি স্বরূপ বাঁশডলার কথা বলা হচ্ছে।

কত ভাবে শব্দ নব নব রূপ পরিগ্রহ করে--অরূপ হয়ে ওঠে। এখানে শব্দের কোনো দোষ নেই। দোষ বা গুণ যদি থাকে সেটা হল শব্দকে কে কিভাবে ব্যবহার করছেন তার উপর।

এক এক পরিপ্রেক্ষিতে শব্দ আলাদা আলাদা অর্থ ধারণ করছে। পরিপ্রেক্ষিত পালটে গেলেই শব্দের অর্থও পালটে যাচ্ছে। ধরুন থানায় পুলিশ যে অর্থে বাঁশ ডলা দিচ্ছে--এখন যদি বলা হয়, ও ফল্লার মা, তোমারে ভাত দিতি কইছিলাম। দিলা না । এহন তোমারে তো একটা বাঁশ দেওন দরকার।

ঘটনা কি দাঁড়াচ্ছে? এটা একটা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স হয়ে যাচ্ছে। কদর্য অর্থ দাঁড়াচ্ছে। কাজলা দিদির বাঁশ বাগান আর থাকছে না।

আমাদের গ্রামে এখনো বলা হয়--কামাই রুজি নাই--মাগ-ছাওয়ালকে খাওয়াবো কি?
এখানে কোনো অশ্লীলতা আছে কি? নেই। কিন্তু এই মাগী শব্দটিকে যদি এভাবে বলা হয়--মাগীর বাড়ি যাইতেছো?
এটা কি বলা যায় সর্বত্র? বাবা-মায়ের সামনে। সন্তানের সামনে?

অর্থাৎ শব্দ শুধু বহু অর্থ ধারণ করে না। প্রয়োজনে আড়াল-আবডালও নেয়। নাহলে শব্দ নিজেই লজ্জিত হয়। অপমানিত হয়।

শব্দ নিজে কখনো কবিতা হয়ে ওঠে না। তার মধ্যে ভাব দিলেই কবিতায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। এটা একটা ম্যাজিক। যেমন আলোক বিচ্ছুরণ করে বলেই হীরে বহুমূল্যবান। আর যদি আলোক বিচ্ছুরণের ক্ষমতা না থাকে তবে হীরের দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। বাইবেলে একটা অসাধারণ বাক্য আছে--যে লবণে স্বাদ নেই, তা পাতে নেওয়া হয় না। ফেলে দিতে হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ