মাসুদ পারভেজ এর গল্প- ভেল্কিবাজ


চনচনা রোদের মধ্যে টানাটান হই খাড়াই থাকা পঞ্চাশ পার করা মানুষটা তার বাও হাতটা কপালত ঢালের মতন ধরি রেলের লাইন বরাবর দেখি থাকে। আর তখন ভর দুুপুরের ঠাঠা রোদে তার তেল চপচপ ঝাকড়া চুলের জঙ্গল থেকে চুয়ে চুয়ে পড়া ঘাম পিরানের কলার ভেজায়।
রোদের মধ্যে খাড়ানো মানুষটা ইতিউতি করতে করতে প্লাটফর্মের দিকে হাঁটা দেয়। তার গেরুয়া পিরান, ঘাড় পর্যন্ত ছাটা জঙ্গলের মতন ক্যাকড়া ক্যাকড়া চুল, নাকের নিচে দুর্বাঘাসের মতোন মোচ আর ২ হাত মিলাই মোট ৬টা আঙুলত ৩ রঙা পাথরের আংটি দেখি ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে জংধরা লোহার বেঞ্চত বসি থাকা শাহেদ বিরক্ত হয়। আরও বিরক্ত হয় তখন, যখন শাহেদ মানুষটার সাথে থাকা বিভিন্ন সাইজের কাঠের বাক্সগুলার দিকে নজর নাড়ে। কারণ মানুষটা তখন শাহেদের পায়ের কাছত আসি বসে এবং সাপের হরেক মাপের কাঠের বাক্সগুলার একটা পর একটার ঢাকনা সরাই নিস্তেজ আধমরা সাপগুলাক নাড়িচাড়ি দেখে। সাপের এত কাছত শাহেদ কখনো ঘেঁষে নাই। শাহেদের চোখমুখত ভয় কি বিরক্তির কি ঘেন্নার চিহ্ন দেখি সাপুড়িয়া মানুষটা বলে, ভয় ক্যানে পাছেন বাহে, গরমত এলা নিজের জান নিয়া এরা টানাটানিত আছে। মাইনষেক কিস্যু করার ক্ষমতা থাকিলে সিন! মানুষটার সামনে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টায় শাহেদ বলেÑ আচ্ছা ট্রেন কেন আসছে না কিছু জানেন নাকি?


মানুষটা তখন বলে, ক্যাংকা করি আসবে বাবা রেলের লাইন তো আটকা। মাইনষে রেলের লাইন আটকাই থুইছে।


মানুষ কেন রেল লাইন আটকাল এই শব্দ শাহেদের জিভ ঠোঁটে শব্দ করার আগেই মানুষটা বলতে শুরু করে, না আটকাই বা কি কনে, মাইনষের জমিজমা দাবি যাছে, বাড়িঘর ফাটি যাছে, হাল-চাষের পানি নাই।


জিভ, ঠোঁটের সাহায্যে শাহেদ এবার আওয়াজ করে বলে, ট্রেন আটকানোর সাথে এসবের সম্পর্ক কী?


মানুষটা তখন বলে, বাবারে যার হয় ঘাও তায় বুঝে বেদনা, অন্য মাইনষে বুঝে না। তোমরা তো বাপ বুঝবেন না। হামার বাড়ির সিথানত কয়লার খনি, হামার জমির বগলত কয়লার খনি, হামরা বুঝি ক্যাংকা করি জমিন দাবে, বাড়ি ফাটে।


এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটি থাকি মাস্টার্স পাশ দেওয়া এবং ব্রাকের এগ্রো ডিপার্টমেন্টের মার্কেটিংয়ের চাকরি করা শাহেদ চড়া রোইদের দুপুরত ঘামতে ঘামতে চিন্তা করে, আজ তার তিনটা হাট থেকে টাকা কালেকশন করার ডেট। গেলো হাটবার বাজারের কী অবস্থা গেছে সেটাও জানা জরুরি।


হাইব্রিড বীজ ধান এই অঞ্চলত আগোত মার্কেট পায় নাই কিন্তুক এখন অবস্থা পাল্টাইছে। আর মার্কেটিং শাহেদ আসার পর সাপ্লাই হিড় হিড় করি বাড়িছে। সাপ্লাই বাড়া মানে হাইব্রিড ধানের কাটতি বাড়া, কাটতি বাড়া মানে মাইনষে বিছন করার জন্যে হাইব্রিড ধান লাগায়। এইরকম একটা বাম্পার সময়ত যদি হাটের রিপোর্ট না পাওয়া যায় তাইলে মাথাটা কার ঠিক থাকে! বাজারে তো আরো অন্য কোম্পানীর মার্কেটিংরা গোল্লাছুটের চক্কর চালাচ্ছে। যদি তার ডিলারদের বীজ ধান খতম হয়া যায় আর তার অনুপস্থিতিতে অন্য কোম্পানী অর্ডার পায় তাহলে... চনচনা রোদের মতোন শাহেদের রাগও টনটন করে।


আরে শাহেদ সাহেব এইটাইতো বয়স; এই বয়সে যত পরিশ্রম করবেন তত উন্নতি, তত প্রমোশন, এখন একটু কষ্ট করলে পরে লাইফ আছে। বসের এই ডায়লগ শাহেদের মনে পড়লে, মুতের চাপ থাকলে তলপেটত যেমন চিনচিনা বেদনা হয় তেমন বেদনা শাহেদের মনের গহীন পেটে কাবডি খেলায় আর তখন সে সেই বেদনায় দুধের ছাওয়ালের মতোন কান্দুড়ে গলায় আওয়াজ তোলে, শালার ট্রেন আটকার আর দিন পায় নাই। আটকে থাকা ট্রেনের মতো তার বেটার লাইফ, প্রমোশন সব আটকা পড়ে গেল।


শাহেদ যখন কান্দুড়ে গলায় রাগে ফতফত করছে তখন সাপুড়িয়া মানুষটা হাতের আংটি দিয়া বাড়ি মারি মারি সাপের খবরা খবর নিচ্ছে। আজকের বারের হাট থাকি তার ভালোই ইনকাম আসে। মাসে একবার এই হাটত সাপখেলা, তাবিজ বেচা, শিকড় বেচা চলে। সেই হাটটা যদি মিস হয়া যায় তাইলে এনা বেকায়দায় হবি, ভাবে সে।


খাঁ খাঁ করা লোকাল স্টেশনটাতে শাহেদ আর সাপুড়িয়া ছাড়া ঔষুধ করার মতোন কোনো মানুুষ নাই। শাহেদ কিছুটা স্বাভাবিক গলায় সাপুড়িয়াকে বলে, লোকজন মনে হয় আগেই জানত ট্রেনের খবর তাই সটকিছে।


নারে বাবা নিরাশ হচেন ক্যানে, আইসবারো তো পারে, বলে মানুষটা তার কানের পিঠত গুঁজি থোয়া আধেক ছেঁড়া বিড়িটা ধরাই কষি কষি দু-টা টান মারে। মানুষটার বিড়ি টানা দেখি শাহেদের রাগ জমি যায়, তখন মনে মনে বলে, শালা ফকিরনির ভাব দ্যাখো। তখন সে আরও খুটি খুটি মানুষটাকে দেখে এবং হুট করি রাগ জমা গলাত প্রশ্ন করি ফেলায়, আচ্ছা সাপ কি সত্যি দুধ খায়? প্রশ্নটা শোনার সাথে সাথে বিড়ির ধোঁয়াটা পাক মারি সাপুড়িয়ার চোখে লাগে তাতে মানুষটার চোখ লাল হয়া যায়। তখন সে বিড়ি টানা বন্ধ করি বার দুয়েক কাশি মারি ধোঁয়ালাগা চোখের গভীর দৃষ্টি ফেলাই শাহেদ কে কড়া নজরত আনে। ভর দুপুরের জনমানবহীন খাঁ খাঁ স্টেশনে সাপুড়িয়ার মরিচা রঙের ধোঁয়ালাগা চোখের দৃষ্টির গভীরতায় শাহেদ ডুবি যাবা ধরে এবং ডুবি যাওয়া থাকি রক্ষা পাওয়ার জন্যে সমস্ত শক্তি দিয়া মানিব্যাগটা চাপি ধরি মনে মনে বলে, প্রশ্নটা করি গাধা সাজা গেলো।


তখন সাপুড়িয়া বলে, বাবা, এই জীব বড়ো আজব জীব। জলত থাকে গাছত থাকে, ডাঙাত থাকে। সব্বায় দুনিয়াত হাঁটে পাও দিয়া আর এই জীব হাঁটে বুক দিয়া। আর এর খানাপিনা আরো আজব কিছিমের।


শোনেন বাবা বহুত দিন আগের ঘটনা :


তখন আমি জোয়ান বয়সের। হাট বাাজরে সাপ খেলা দ্যাখাই, তাবিজ বেচি, মাইনষের বাড়িত সাপ ধরার বায়না আসিলে সাপ ধরবার যাই। তো এ্যাগদিন বায়না আইসে দিনাজপুরের বিরল থানার ফরকাবাদ ইউনিয়নের চাকমধু গাঁয়ের চেযারম্যানের বাড়িত সাপ ধরার। আমি আর সাগরেদ মিলি খুব ভোরে ওই বাড়িত রওয়ানা দেই। আগিলা জমানার চেয়ারম্যান, দোতলার মাটির বাড়ি। চেয়ারম্যানের মাইজো ব্যাটার বউয়ের তিন দিন আগে ছইল হইছে। ছইল হওয়ার পর থাকি প্রতি রাইতোত নাকি চেয়ারম্যান সাপ দ্যাখা পায়। দিনত সাপ দ্যাখে নাই। দ্যাখে খালি রাত বিরাইতে। আমি বাড়ির আশপাশোত সাপের গাহাড় খুঁজি, গোয়াইলঘরত সাপের গাহাড় উটকাই, বাড়ির আশপাশোত বড়ো বড়ো গাছগাছালিত চড়ি তাও কুনো আলামত পাইনা। আমি ওই বাড়িত রাইত থাকার বন্দোবস্ত করি। বাড়ি তখন নিশুতি। অমাবস্যার রাইত মাঝামাঝি। আন্ধারে চান্দের হুদিশ নাই। আমার চোখ লাল হয়া আসিছে ঠিক তখন সাগরেদ আমাক আঙুল দিয়া দ্যাখায়। সে এক আজব ব্যাপার। এমন জিনিস জিন্দেগিতে দেখা হয় নাই, সাক্ষাৎ মহারাজ। মহারাজের পিছন পিছন চলা শুরু করি। আঁতুড়ঘরের সামনত আসি মহারাজ থামে আর তখন আমি বুঝি ফেলাই আসল কাহিনি। কিন্তুক আমার কাহিনি বুঝার চোইখের পলকে মহারাজ হাওয়া। মানে আঁতুড় ঘরের দুয়ারের চৌকাঠের এককোণত যে ছোট্ট গাহাড় দিনের বেলা কারো সাধ্য নাই সেই গাহাড় দেখে, সেই গাহাড় দিয়া ঘরের ভেতর ঢুকি পড়ে। আমি তখন সাগরেদক পাঠাই চেয়ারম্যানক খবর দে। চেয়ারম্যানক ঘটনা খুলি বলার পর চেয়ারম্যান সিস্টেম করি ঘরের দুয়ার খুলি ফেলায়। ঘরের দুয়ার খুলি ফেলার পর হারিকেনের টিমটিম আলোত যা দেখি তা দেখার ভাগ্য জিন্দেগিতে কয়জনের হয়। দেখি ৪ দিনের বাচ্চা, পোয়াতি আর ১ বুড়ি বেঘোরে নিন্দায়। আর মহারাজ পোয়াতির ডাইন স্তন চুষি চুষি দুধ খায়। শাল দুধের গন্ধরে বাবা, বাবা শাল দুধ। মহারাজ স্তন চুষি খাছে আর মহারাজের লেজ পোয়াতির বাও নাকের ফুটার মইধ্যে ঢুকাই দেওয়ার পজিশনে। যাতে পোয়াতি ভয়ে নড়াচড়া না করে। নড়াচড়া করিলে বিপদ, লেজ দিয়া চটকা মারি নাক ফাটাই দিবি। আমি অবাক হয়া যাই এমন সাপ আগত দেখি নাই, দেখি সাপের মুখভর্তি দাড়ি। সেই টাইমে চেয়ারম্যান তো মহারাজাক মারার জন্যে রেডি কিন্তুক আমি সাবধান করি এই সাপ মারিলে বংশ নির্বংশ হয়া যাবি। বংশত বাত্তি জ্বালার মানুষ থাকিবেনে। এই সুযোগে আমি সারা বাড়ি বান মারি যাতে বাড়ি থাকি সাপ বের হবার না পারে। আর যায় কই, বাধ্য হয়া আমার হাতত ধরা খায়। মুখভরতি দাড়িরে বাবা, মুখভরতি দাড়ি। মানুষটার মুখে মুখভরতি দাড়ি শোনার পর শাহেদ মানুষটাকে চিনতে পারে। এই গল্পটি সে মানুষটার মুখে বহুবার শুনিছে কিন্তু সাটপাকে দেখা হয় নাই। শাহেদ যখন ক্লাস সিক্স কি সেভেনত পড়ে তখন ওর স্কুলের পাশত যে দিনাজপুর কোর্ট কাচারি সেই কোর্ট কাচারিত বসি এই মানুষটা সাপ খেলার ক্যানভাস যখন মারা শুরু করে তখন শাহেদ স্কুল থাকি বাড়ির যাবার পথত থামে তারপর ক্যানভাস শুনা আরম্ভ করে। শাহেদ দাড়িঅলা সাপ দেখার আশায় মেলাদিন দেরি করি বাড়ি গেছে কিন্তু সাপটা দেখা হয় নাই।


এইবার শাহেদের স্মৃতির দড়ির গেরো খুলা শুরু হয়া যায় :


এই যে এখানে যিনি আছেন তিনি যেনোতেনো কেউ নয়, এ হচ্ছে মহারাজ। এই মহারাজ সেই মহারাজ যে হচ্ছে দুধ খায়। আপনেরা প্রশ্ন করিবার পারেন কিসের দুধ খায়Ñ গরুর দুধ, ভেড়ার দুধ, বকরির দুধ। আপনেরা আরও প্রশ্ন করিবার পারেনÑ ক্যামন করি খায়, ফিডারত করি খায়, বাটিত করি খায় নাকি চুষি খায়। আপনেদের সকল প্রশ্নের জবাব আমি দিব। তার আগে একটু সাবধান করি দেই। এই মহারাজ হচ্ছেন সর্পমহারাজ। ইনি বকরি, ভেড়া, গরুর দুধ খায় না। তাইলে কার দুধ খায়; ইনি খায় মানুষের দুধ। আমর যেমন শিশু কালে খাইছি তেমনি এও খাইছে কিন্তুক মহারাজ বেচারার দুর্ভাগ্য আর আপনাদের সৌভাগ্য যে, বিরল থানার ফরকাবাদ ইউনিয়নের চাকমধু গাঁওয়ের এক ভরবুক পোয়াতির দুধ খাইতে খাইতে আমার হাতে ধরা খাইছে। আপনেদের সৌভাগ্য আপনারা এমন এক জিনিস দেখি যাবেন যা আগত দেখা হয় নাই, তা হলো এই মহারাজের মুখত দাড়ি গজাইছে, এর মুখভরা দাড়ি। এমন সাপ দ্যাখা তো দূরের ব্যাপার কান দিয়া পর্যন্ত শোনেন নাই। আপনেদের সেই সাপ দ্যাখাব। তার আগে একটা কথা, আপনেদের কাছে অনুরোধ অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ এই সাপ দ্যাখার চেষ্টা করিবেন না। যার দাড়ি গোঁফ গজায় নাই তারা কেউ এই সাপ দ্যাখার চেষ্টা ভুলে মনে আনিবেন না। তাইলে আপনেদের ক্ষতি আমারও ক্ষতি। যে ক্ষতির কোনো মাশুল নাই।


মহারাজক দর্শন করার আগে একটু কথা :

ভাই দুনিয়াত মানুষ যেমন আছে হরেক কিসিমের, তেমন এই মানুষের সমস্যাও হরেক কিসিমের। আর আরও বড়ো সমস্যা হইলো এই সমস্যা কাউরে বলতে না পারা। মানে এমন কিসিমের সমস্যা যা বলা সম্ভব হয় না মানে বলা যায় না। ঘরত সুন্দরী বউ কিন্তুক সেই বউয়ের পাশত শোয়ার কালে আপনের বুক ধড়ফড় করে, জালত আটকা মাছের মতোন আপনের ভেতর ছোটাছুটি শুরু হয়া যায়। অনেকেই মনে করবার পারেন এর কারণ প্রেশার হবার পারে কিন্তুক তা নয়, কেস অন্যখানে, সেই কেসটা কী? আপনের আছে গোপণ প্রবলেম, যেটা লজ্জায় কাউরে বলা হয় নাই।

সুন্দরী বউ আছড়ে পড়ে
বুকত পড়ি ঘাই মারে
বউয়ের তখন চরম বিকার
মাগার বেচারা আপনি নাচার।

যারা বউয়ের কাছত রাইত-বিরাইতে এইরকম নাচার হন এইবার থাকি খেল দ্যাখাবেন। ক্যামনে খেল দ্যাখাবেন তার মেডিসিন আমি দিব।

খাইছেন ম্যালা হোমিও-এলোপ্যাথি
সমস্যার হয় নাই কুনো গতি
দিনে দিনে বাড়িছে দুর্গতি
থামাইতে পারেন নাই বউয়ের রতি
হইতে পারেন নাই জাঁদরেল পতি।

আপনাকে জাঁদরেল পতি বানাবার দায়িত্ব আমি নিলাম। এই যে শিকড় মুখত নিয়া দুই গালের মাড়ির নিচত থুয়া গুনি গুনি দুই দু-গুণে চারবার কড়া চিবান দিয়া গিলি ফেলাবেন। তারপর দুই ঘন্টা টোটাল রেস্ট। তারপর, তারপর...


আপনের লিঙ্গ করিবে গর্জন
সুন্দরবনের বাঘের মতোন
আপনে তখন বাঘ
কাইত করবেন মাগ।

তাইতো বলি ভাই, কুনো টেনশন নাই, এক পুরিয়া শেকড় করেন সেবন, ফেরত আনেন তাগড়া যৌবন। বিফলে মূল্য ফেরত। মনে রাখিবেন, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ এইটা আমার না, জ্ঞানী গুণীজনের কথা।

আরও বলি ভাই সমস্যার শেষ নাই। এই সকল সমস্যা নিয়া গান শোলোক হয়া গেছে।

হাঁটু পানিত নামি দ্যাখ
চিনচিন করে তলপেট
উরু পানিত নামি দ্যাখ
চিনচিন করে চ্যাট।

এইরকম যাদের পানিতে নামিলে লিঙ্গ চিনচিন করে তরল পড়ে তারা কতো না লজ্জা অপমান সহ্য করিছেন। কিন্তুকÑ

আর হবেন না অপমান
হাতের কাছেই সমাধান
একবার করিলে সেবন
অমর থাকিবে যৌবন।

ভাই সকল, যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। এইটা আমার কথা না এইটা জ্ঞানী গুণীজনের কথা। মানে আপনার শরীলে যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ আশাও আছে। তাই বলি ভাই, হতাশার কুনো কারণ নাই।

অনেকের কান দিয়া পনি পড়ে, পুঁজ পড়ে, কানে কম শুনেন, কানত হাত দিলে কান বিবিসির রেডিওর মতোন ফড়ফড় করা আরম্ভ করে।

তাদের বলি সবায় শুনেন
এক শিশি তেল কিনেন।

তারপর ভাই শিকড় ওই তেলত ভিজাই শিকড় চুয়া তেল বেলা উঠার আগত আর বেলা ডুবার আগত নিয়মিত একসপ্তা ২ ফোঁটা করি মারেন। তারপর রেজাল্ট দ্যাখেনÑ

কান শুকাই হবে চাউল ভাজা
কান দিয়া শুনি পাবেন মজা
কান আর বিবিসির রেডিও নাই
কানত বাজে বিয়ার সানাই
আর আপনি তখন মারেন ড্যান্স
নারে বিনা চটনি ক্যায়সে বানি
কান দিয়া পড়ে না আর পুঁজ পানি।

সময় যখন আছে ভাই, আরেকটু সেবা দিয়া যাই। ভাই বাতের ব্যথা বড়ো ব্যথা যার হয় তায় বুঝে।

গিঠায় গিঠায় ব্যথা করে
অমাবস্যা পূর্ণিমায় বাড়ে
ব্যথার ঠেলায় শরীল কাইত
নির্ঘুম কাটে রাইত।
গিঠায় গিঠায় করে বেদনা
হাঁটতে চলতে জিন্দেগি ফানা।
ভাই আপনেদের বলি শুনেন :
আর হবেন না বাতে হতাশ
বাতের বেদনা করেন নাশ
মালিশ করেন এই তেল
বাতের ব্যথাক দেন জেল।

অতএব, ভাইসব পকেট সাবধান, লজ্জা হইতে সাবধান, ব্যথা হইতে সাবধান, মহারাজ হইতে সাবধান। অল্প বয়সে নিজের ক্ষতি করি মহারাজ দর্শন করবেন না। নিজের ক্ষতি হবার ভয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক শাহেদ খাড়া হয়া লিঙ্গ শক্ত করা ঔষুধ, যৌবন বাড়া ঔষুধ, বাতের মালিশ, কান পচা ঠিক করা তেল বেচার ক্যানভাস শুনেছে কিন্তু দাড়িঅলা সাপ দেখা হয় নাই। খাঁ খাঁ এই দুপুরত শাহেদের ভিতর জমা হওয়া সমস্ত রাগ ঝাড়ার জন্যে শাহেদ সাপুড়িয়া মানুষটাকে দোষী বানায় এবং বলে, এই এক গল্প বিক্রি করি আর কতোদিন খাবেন। ছোটবেলা থাকি তো আপনার দুধ খাওয়া মহারাজ সাপের গল্প শুনি। মহারাজ কি খালি দুধ খায়, দুধ খাইতে খাইতে আর অন্য কাম করে না। এখন একটা মোচওয়ালা সাপের গল্প বানান। এক গল্প দিয়া মানুষ আর কতোদিন ভেল্কি খায়।

শাহেদের কথা শুনার পর সাপুড়িয়া মানুষটা ফ্যাকাশে হয়া যায়। তারপর তার ফ্যাকাশে চেহারার মধ্যে কিছুটা রক্ত চলাচল শুরু করলে মানুষটা শাহেদকে কিছু বলা আরম্ভ করে কিন্তু শাহেদের কড়া ধমক মানুষটাকে আবার ফ্যাকাশে বানায়। এবার মানুষটা তার সাপগুলার মতোন আবার নিস্তেজ হয়া যায়। তারপর তার নিস্তেজ শরীল আহত সাপের লেজত থাকা প্রাণের মতোন ঝাপটাঝাপটি করতে করতে একসময় চাঙ্গা হয়া ওঠে। তখন মানুষটার শরীলত দীর্ঘদিন ধরি বাসা বাঁধি থাকা লজ্জা-অপমান-ঘেন্না-ক্রোধ-ক্ষুধা-ক্ষোভ-দারিদ্র্য মিলেমিশে একাকার হয়া যায়। তখন সে বাক্সের ঢাকনা খুলি খুলি সাপগুলাক দেখা শুরু করার পর একটা বাক্সত কুন্ডলী পাকাই মরি থাকা একটা সাপ পায়। মরা সাপটাক বাক্স থাকি বের করি দুই হাতের তালুত লম্বা করি ধরিলে শাহেদ কিছুটা ভয় পায়। তখন সাপুড়িয়া মানুষটা বলা শুরু করে, ভেল্কি কে-না দ্যাখায়? প্রতিবচ্ছর মাঘ আসিলে এই পেশা ছাড়ি দিবার মন চায়। কিন্তুক বাপ-দাদা চোদ্দ পুরুষের পেশা চাইলে কি ছাড়া যায়! তখন বুঝি সাপের ভেল্কিত আমি বান্ধা। বাপ-দাদার যে ২/৪ ছটাক বাড়ি ভিটা আছিল সউগে এখন কয়লা খনির প্যাটত সেন্দাইছে। জমিন দিবি, ভিটা দিবি, টাকা দিবি কয়া কয়া যেই সরকার আইসে সেই সরকার ভেল্কি দ্যাখায়। দুনিয়াত কুন মানুষ আছে ভেল্কি দ্যাখায় না?

সাপুড়িয়া মানুষটার মুখ থাকি বের হওয়া কথা শুনার পর শাহেদ ভাবে, সে কীভাবে ভেল্কি দ্যাখায়? তখন সে মনে মনে বলে, চোরের মায়ের ডাঙ্গর গলা। তখন হাতঘড়িতে নজর গেলে শাহেদ চমকে ওঠে তারপর ইস ইস করতে করতে জিহ্বাত চো চো আওয়াজ করি হাট থাকি টাকা কালেকশন করার কথা, বাজার রিপোর্ট জানার কথা, কৃষকরা হাইব্রিড ধান কেমন কিনছে সেটার রিপোর্ট নেওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে মাথার ভেতর নাইলনের প্যাঁচ লাগাই ফেলায়। আর মাথার ভেতর লাগা প্যাঁচের গিরায় গিরায় থাকা ভাবনা : কৃষক যত কিনবে কোম্পানি তত বেশি মার্কেট ক্যাপচার করবে, সে কমিশন তত বেশি পাবে, প্রমোশন তত তাড়াতাড়ি হবে, প্রমোশন মানে বাড়ি, গাড়ি, টাকা, সুন্দরী বউ এমন করি তার মাথার মগজত শক্ত প্যাঁচ মারে সেই প্যাঁচের ঠেলায় এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির বিপ্লবী বাম ছাত্রনেতা শাহেদ আওয়াজ করি বক্তৃতা ধরে : সংগ্রামী দেশবাসী, কিনুন, আপনার উচ্চফলনশীল জাতের হাইব্রীড বীজধান কিনুন। বিদেশ থেকে আমদানিকৃত ধান, ফলন বেশি, বন্যার পানিতে ডুববে না, মরবে না, পচবে না। বিদেশি ধান, দেশে বসে খান। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান, বেশি করে খান। এই ধান কিনলে কীটনাশক ফ্রি, মানে বিষ ফ্রি, একদম ফ্রি। খান খান খান বিদেশি ধান।

তখন পর্যন্ত খাঁ খাঁ স্টেশনটাতে সাপুড়িয়ার এক বিকট চিৎকার শাহেদের মাথার ভেতর খেলতে থাকা বক্তৃতাবজি বন্ধ করি দেয়। তারপর শাহেদের নজর পড়ে সাপুড়িয়া মানুষটা একটা লাল গামছার ওপর সটান করি মরা সাপটা বিছাই থুইছে আর সমানে মন্ত্র চালাচ্ছে। বাঁক নেওয়া সূর্যটার চনচনা রোদ তেরছা মতোন শাহেদ আর সাপুড়িয়ার চোখমুখত পড়লে শাহেদ শুনতে পায় :

জোয়ান মরদ হউক মাগী
সারা জিন্দেগি থাকুক দাগী

মন্ত্রপড়া সাপুড়িয়ার বিস্ফোরিত চোখের দিকে তাকানোর পরপরই শাহেদের নুনুর বিচিত ঝি ঝি লাগা শুরু হয়া যায় তখন সে তার একটি হাত পকেটে চালান করি দিয়া নুনুর বিচি চিমটি মারি ধরি থাকে। তাতে তার নুনুর বিচির ঝি ঝি বাড়ে কি কমে কিছ্ইু সে টের পায় না। কিন্তু তার অন্য হাতটা থরথর করি কাঁপা শুরু হয়া যায়। কিন্তু ঝি ঝি লাগা নুনুর বিচিক ছাড়ি দিয়া সে থরথর করি কাঁপা হাত ধরার সাহস পায় না।

আর এই সুযোগ পায়া থরথর করি কাঁপা হাতটা পিছন পকেট থাকি মানিব্যাগটা নিয়া মরা সাপঅলা লাল গামছাটার ওপর ঢিল মারে। সাপুড়িয়ার মন্ত্র পাঠ মিহি হয়া বাতাসের সাথে মিশি যায়। তখন আর কোনো আওয়াজ মুখ থাকি বের হয় না। শাহেদের নজর তখন ফ্যালফ্যাল করি মানিব্যাগের ওপর পড়ে। ওই মানিব্যাগত তার বীজধান সাপ্লাইয়ের রশিদ আছে, কতো সরকারি বেসরকারি চাকরির সার্কুলার আছে কিন্তু সাধ্য কি তার সেই মানিব্যাগ তুলি নিয়া আবার পকেটত ঢুকায় এক ফ্যালফ্যাল করি নজর দেওয়া ছাড়া!

সাপুড়িয়া মানুষটা তখন কপালের ঘাম মুছে তারপর শাহেদের দিকে নজর দেয় দুইবার ভুরু নাচায় এবং বলে, কি বাবা ভেল্কি নাগিছে নাকি? সারা দুনিয়া চলে ভেল্কির ওপর দিয়ারে বাবা, সেই দুনিয়ায় আপনে-তুমি-আমি অছিলা মাত্র।

শাহেদের চোখের নজর কখন যে মানিব্যাগ থাকি মরা সাপটার ওপর পড়ে তা সে টের পায় না। যখন টের পাওয়া শুরু করে তখন দেখে গামছার ওপর সাপ নয় সে সটান হয়া শোওয়া আর মন্ত্র পড়ছে কোর্ট-টাই-স্যুট-পরা একজন কিন্তু সাধ্য কি তার সেই গামছা ঝাড়া দিয়া উঠি খাড়ায়।


লেখক পরিচিতি
মাসুদ পারভেজ
জন্ম : ২১ জানুয়ারি ১৯৮৫, দিনাজপুর

শিক্ষক, বাংলা বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : ঘটন অঘটনের গল্প (২০১১), বিচ্ছেদের মৌসুম (২০১৫)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ