বর্ষাকাল। রাস্তাঘাটে জলকাদা, উঠানেও আসর বসানো মুশকিল। নীলকান্ত এই ক’টা মাস তাই যাত্রার দল ছেড়ে কবিরাজি করে। জায়গাটা খুব ভাল। ম্যালেরিয়া তো আছেই, তা ছাড়া আজকাল নুতন নুতন রোগ-পীড়া দেখা দিচ্ছে, সে-সব নাম নীলকান্ত বাপের জন্মে শোনে নি। অতএব কাজ-কারবার খাসা চলেছে, এক-এক দিন নিশ্বাস ফেলবার সময় থাকে না।
কিন্তু তা সত্ত্বেও সন্ধ্যার পর আয়ুর্বেদীয় ওষধালয়ে একটুখানি আড্ডার বন্দোবস্ত চাই-ই। নয় তো তার রাতে ঘুয হয় না। জম-জমাটের সময় কোন রোগী দৈবাৎ যদি এসে পড়ে, সে বেচারা গালি খেয়ে মরে।
আজও দুই-একজন করে সকলে জমায়েত হচ্ছে। হরিশ বেহালা-দার এসে গেছে। করালী ভীম সাজে, সে তো সেই দুপুর থেকে তক্তাপোষে গদিয়ান হয়ে হুঁকো টানছে। সামনের রাস্তা দিয়ে গুড়-বোঝাই খান পাঁচ-ছয় গরুর গাড়ি যাচ্ছিল—তারই একখানা থেকে ছোকরাগোছের একটা লোক খোঁড়াতে খোঁড়াতে এসে ঢুকল। লোকটা বিদেশি; পায়ে পাম্প-সু, গলায় কম্ফর্টার, গায়ে ময়লা আধ- ছেঁড়া জিনের কোট, ডান হাঁটুর নিচে বেশ বড় আকারের বাণ্ডেজ বাঁধা। সেই জায়গাটা দেখিয়ে সে বলে, পুঁজ পড়ছে, থুঃ থুঃ—একদম ঘা হয়ে গেছে মশায়। তার উপর আবার জ্বরে ধরেছে।
নীলকান্ত ঘাড় নেড়ে গম্ভীর ভাবে বলে, ঘায়ের তাড়সে জ্বর। হুঁ, তাই—
ঘা থকুক, জ্বরটার চিকিচ্ছে করে দাও দিকি। গাড়ি চেপে বেড়াচ্ছি, পা একটু জখম থাকলে কি আর এমন ক্ষতি হবে ?
ডান হাতখানা এগিয়ে দিয়ে লোকটা কবিরাজের পাশে বসে পড়ল। বলে, আগে আসছিল এক দিন অন্তর; আজ দু-দিন সকাল- বিকাল দু-বেলা ধরেছে। খাওয়ার তোয়াজ দেখছে, তাই আরও কষে ধরছে।
নীলকান্ত নাড়ি দেখতে দেখতে বলল, এত বড় জ্বর—তার উপর খাওয়া ?
খাওয়া বলে খাওয়া! দুপুর গাড়ি রেখেছিল মণ্ডলগাঁয়ের বাজারে। রান্নার সুবিধে হ’ল না—তা মশায়, পাকি পাঁচ-পোয়া চিঁড়ে পাঁচ পোয়া কাঁচাগোল্লা আর ঘন-আটা দুধ—তাও সের খানেকের বেশি হৃবে তো কম নয়। আমার আবার এক বদ স্বভাব—শরীর বেজুত হলে ক্ষিদে ভয়ানক বেড়ে যায়।
করালী প্রশ্ন করে, কোথায় যাবে তুমি?
পিরথিমের তদারকে। বলে সে সুর করে ছড়া কাটে—
জীবনপুরের পথে যাই,
কোন দেশে সাকিন নাই।
বসন্ত আমার নাম। আংটি চাটুজ্জের নাম শুনেছ—তস্য ভ্রাতা। তিনি থাকেন বাড়ি-ঘরদোর আগলে, বাকি জগৎ-সংসারের খোঁজ খবর আমাকে নিতে হয়।
রকম সকম দেখে মনে হয় লোকটা পাগল। নীলকান্ত বলে, জামাটা তোল দিকি। পিলে আছে বলে ঠেকছে।
বসন্ত হা-হা করে হসে উঠল। তা আছে। আরও নানা রকমের চিজ আছে। কোমর টিপে দেখছ কি, সে চিজ আমি গাঁটে রাখি নে। এই দেখ।
বলে পা থেকে জুতো খুলে শুকতলার নিচে থেকে একখানা দশ টাকার নোট বের করে দেখাল।
এই দেখ দাদা, জাল নয়—আসল রাজ-মূর্তি। আরও অছে, গরজের সময় ফুসমন্ত্রে বেরিয়ে যাবে। হেঁ-হেঁ আর দেখাচ্ছি নে। আংটি চাটুজ্জের ভাই আমি, তাঁর দশ আঙুলে দশটা হিরের আংটি। তোমার ভিজিট মারব না কবিরাজ মশায়।
নীলকান্ত আরও খানিকক্ষণ প্রণিধান করে দেখে আলমারি,থেকে একটা গুঁড়ো ওষুধ বের করল। পিছন দরজার দিকে চেয়ে বলে, এক গ্লাস জল দিতে হবে যে মা! প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই—মানুষটি দেখা গেল না—চুড়ি-পরা একখানা হাত দরজা একটু ফাঁক করে জলের গ্লাস রেখে দিল।
বসন্ত বলে, ঠিক করে বল কবিরাজ, সুরকির গুঁড়ো দিচ্ছ না তো? বড্ড কাবু করে ফেলেছে। মাইরি বলছি। হাঁটা মুশকিল হয়েছে, নইলে শর্মারাম গরুর গাড়ি চাপে? রাত্তিরের মধ্যে জ্বরটা নির্দোষ করে সেরে দাও বুঝব ক্ষমতা। তা হলে ঘোর ঘোর থাকতে মা-গঙ্গা পাড়ি দিয়ে চাকদা-মুখো বেরিয়ে পড়ি।
নোট দেখিয়ে মন্ত্রের কাজ হয়েছে। নীলকান্ত মোলায়েম সুরে জিজ্ঞাসা করে, রাত্তিরবেলা ওঠা হচ্ছে কোথায়?
উঠেছি এই তামার এখানে। তুমি জায়গা না দাও, বটতলা রয়েছে। সে জায়গা তো কেউ কিনে রাখে নি।
নীলকান্ত প্রস্তাব করে, একটা রাতের ব্যাপার যখন, তা বেশ তো—এখানেই থাক। অসুবিধা হবে না।
উপরে নীচে চারিদিকে বার কয়েক তাকাল বসন্ত। বলে, শুতে হবে কোন ঘরে?
এইখানে তক্তপোষের উপর মাদুর পেতে দেব। তবে একটুখানি রাত হবে। এই এরা সব আসছে—এরা চলে যাবে, তার পরে—
বসন্ত দৃঢ় ভাবে ঘাড় নেড়ে বলে, না মশায়, তা হলে চলবে না। এরই মধ্যে চোখ বুজে আসছে। সকাল সকাল না শুলে ভোরবেলা রওনা হব কি করে?
কেন জানিনা করালীর বড্ড ভাল লেগে গেল বসন্তকে। বলে, এক কাজ কর—খেয়ে দেয়ে বরং আমার ওখানে গিয়ে শুয়ে থেক। এখানকার হাঙ্গামা চুকতে এক-একদিন রাত কাবার হয়ে যায়। ঐ টিনের দোতালায় থাকি আমি। একা থাকি। খুব হাওয়া।
বসন্ত আবার প্রশ্ন করে, শোওয়া তো হল, খাওয়াবে কি শুনি কবিরাজ? তুমি বাবা জ্বরো-রোগীর জন্য শঠির পালো এনে হাজির করবে না তো? আগেভাগে বলে দাও, না পোষায় সরে পড়ব।
নীলকান্ত বলল, অর পুরানো হয়ে গেছে। দুটো পুরানো চালের ভাত খেলে দোষ হবে না। তাই খেয়ো।
আর গাঁদালের ঝোল?
উহুঁ, তোফা ভাজা মুগের ডাল লাগিয়ে দেব ঐ সঙ্গে।
তবে বন্দোবস্ত করে ফেল। দেরি কোরো না, পেট জ্বলে উঠেছে। এক্ষুণি চাপাও গে। বলে তৎক্ষণাৎ বসন্ত উঠে দাঁড়াল। করালীর হাত ধরে টেনে বলে, চল তোমার দোতলা অট্টালিকা দেখে আসি। বলি খাট-টাট আছে তো? হেঁ-হেঁ মশায়, রুই-কাতলা খাওয়াবে তো ঘিয়ে ভেজে খাওয়াও। দোতলায় গিয়ে মেজেয় পড়ে থাকতে পারব না তা বলে দিচ্ছি।
আবার সে ঘুরে দাঁড়িরে ডাকতে লাগে ও কবিরাজ মশায়, ইদিকে শোন একবার। যোগাড়-যন্তোর করেছ, রাঁধাবাড়া করবে কে?
নীলকান্ত বলে, আমার মেয়ে হরিমতী। আর কেউ নেই বাড়িতে, ঘর-সংসার সে-ই দেখে।
তা বেশ করে। কিন্তু নৈকষ্য কুলীন আমরা। আংটি চাটুজ্জের ভাই। যার তার হাতে খাই নে।
মুখ কালো করে নীলকান্ত বলে, তুমিই তবে রান্না কর। অন্দরের দিকে এগিয়ে উচ্চ কণ্ঠে ডাক দিল, ও খুকি, বোগনোয় করে তুই শুধু ভাতটা চড়িয়ে দে। ছোঁয়াছুঁয়ি করিস নে—খবরদার!
একগাল হেসে বসন্ত বলল হ্যাঁ—সেই ভাল। ভাল বামুনের জাত মেরে শেষকালে মহাপাতকের ভাগী হবে, তাই সামাল করে দিলাম।
করালীর সঙ্গে তার ঘরে ঢুকে বসন্ত সর্বাগ্রে দুয়োর ভেজিয়ে দিল। জুতোর ভিতর থেকে নোট বের করে বলল, নাও দাদা, ধর। তোমাদের মনস্কামনা পুর্ণ হোক।
ব্যাপার কি?
শনির দৃষ্টি পড়ে গেছে, কাছে রাখলে রক্ষে আছে? বুঝি দাদা, বুঝি। নিজের বিছানায় এনে শোয়াচ্ছ, ওদিকে ভাজা-মুগের বন্দোবস্ত! এত সব খাতির আমাকে নয়, পদতলে এই যিনি আছেন তাঁর। ছোট ভাইকে ছলনা কর কেন, নেবেই তো সহজে না দিলে পেটে ছুরি বসিয়ে নেবে। তার কাজ নেই। কিন্তু মা-কালীর কিরে, একা খেয়ো না—কবিরাজের পাওনা-গণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে বাদ বাকি সমস্ত তোমার।
ধর্মভীরু মানুষ করালী। রাগ করে সে নোট ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বসন্ত খানিক অবাক হয়ে থাকে। তার পর ঢিপ করে সে তার পায়ের গোড়ায় প্রণাম করে। বলে, টাকা ছুড়ে দেয়—সে-মানুষ পরমহংস। না নাও, না-ই নিলে। রাতের মতন রেখে দাও তোমার কাছে। ওখানকার ঐ একঘর মানুব দেখে ফেলেছে। তোমাদের দেশ-ভূঁই, তোমায় কিছু বলবে না—বুঝলে না? বড্ড পাজি জিনিস এই টাকা- পয়সা। ঠকে ঠকে বুঝছি।
তবে সঙ্গে নিয়ে এসেছ কেন?
আমি? বয়ে গোছ আমার সঙ্গে আনতে। ষড়যন্ত্র করে পকেটে ঢুকিয়ে দিয়েছে। ঘাগী ময়ে আমার বউ-ঠাকরুন। ক্ষারে কাপড়কাচা দখে সন্দেহ করেছে। এক প্রহর রাত থাকতে রওনা হয়েছি, কিচ্ছু জানি নে। চানের সময় জামা খুলতে গিয়ে দেথি, খসখস করছে। আংটি চাটুজ্জের বউ কি না, নজর এড়ান কঠিন। এক হিসাবে মন্দ হয়নি অবিশ্যি। শুধু দেখিয়ে দেখিয়েই কাজ হাসিল করা যাচ্ছে। আজ পাঁচ-ছ’টা দিন তো কেবল চেহারা দেখিয়ে চলে যাচ্ছে, একটা পয়সা খরচ হয় নি।
এমন সময়ে কবিরাজের বাড়ি থেকে ডাক এল, গিয়েভাত নামাতে হবে।
ডাল ফুটে উঠেছে। হরিমতী চুপটি করে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর মিটিমিটি হাসছে। অতি ছেলেবয়সে মা-হারা, তখন থেকেই গিন্নী। বাবাকে দেখে দেখে সে ধরে নিয়েছে, গোটা পুরুষ জাতটাই আনাড়ি। তাদের সম্পর্কে কৌতুক ও করুণার অন্ত নেই। হঠাৎ হাঁ-হাঁ করে ওঠে, ও কি হচ্ছে? অত নুন দেয় নাকি? এই রকম রান্না শিখেছেন আপনি?
বসন্ত বিষম চটে যায়। ডেঁপো মেয়ে, রান্না শেখাতে এসেছ? তোমার জন্মের আগে থেকে এই কর্ম করছি। এ আর কতটুকু—দৈনিক আড়াই পোয়া নুন লেগে থাকে আমার।
বলে হাতের নুনটুকু নয়, আর একবার তার ডবল পরিমাণ নিয়ে ডালের মধ্যে দিল।
হরিমতী রাগ করে বলে, তা হলে আবার মশলা লাগবে, আবার জল ঢালতে হবে। ও যে পুড়ে জবক্ষার হয়ে গেছে। মানুষে কেন, গরুতেও মুখ দিতে পারবে না।
ঘটির জল হুড়-হুড় করে সে কড়াইয়ে ঢেলে দিল।
বসন্ত উঠে দাঁড়িয়ে দু-হাত কোমরে দিয়ে রণমূর্তিতে বলল, জল ঢেলে দিলে যে বড়! কি জাত তুমি?
বামুন।
ওঃ, হলেই হল! বামুন অমন সবাই কপচে থাকে। কি রকম বামুন দেখি, গায়ত্রী মুখস্থ বলতে পার?
হরিমতী বিদ্রূপ করে বলে, সর্বস্ব ফেলে এসে জাতটাই শুধু সঙ্গে নিয়ে বেড়াচ্ছেন? পৈতে তো ছেড়েছেন, তবু জাত ছাড়ে না—ও বুঝি কাঁঠালের আঠা?
একটুখানি চুপ করে থেকে বসন্ত এইবার হেসে ফেলল। বলে, রাঁধো মাণিক, তুমিই রাঁধো তবে। জ্বরের উপর আজ জুত হবে না। কিন্তু রাঁধতে আমি জানি, খুব ভাল জানি। আর এক দিন রেঁধে দেখাব, তখন বুঝবে।
খাওয়া-দাওয়ার পর উদ্গার তুলতে তুলতে বসন্ত এদের আড্ডায় এল। করালীকে ডেকে বলে, ঘরের চাবিটা দাও—শুয়ে পড়ি গে। ...একটা কুকর্ম করে ফেললাম দাদা। গঙ্গার পারের উপর রয়েছি, গঙ্গাজলে রান্না—তেমন কিছু দোষ হবে না, কি বল?
সকালবেলা বসস্ত ঘুমন্ত করালীকে নাড়া দিচ্ছে। চারটে পয়সা দাও দিকি।
করালী চোখ রগড়ে জিজ্ঞাসা করে, কি হবে?
পারানির পয়সা। গঙ্গা তো সাঁতারে পার হওয়া যাবে না। যাই বল দাদা, মানুষের চেয়ে বানরের বুদ্ধি বেশি।
বসন্ত হঠাৎ ভাবুকের পর্যায়ে উঠে গেছে। মাথা দোলাতে দোলাতে বলে, বিবেচনা করে দেখ, তাই কিনা। হনুমান গন্ধমাদন পর্বত এনেছিল, কাজকর্ম চুকে গেলে যেখানকার জিনিস সেইখানে রেখে এল। আর ভগীরথের কি রকম আক্কেল—মা গঙ্গাকে এনে গুষ্ঠিসুদ্ধ বাঁচালি, তারপর শিবের মাথার জিণিস আবার সেখানে গুঁজে দিয়ে আয়—তা নয়, গরজ ফুরোলে কিচ্ছু আর মনে থাকল না। গাঙ-খাল যদি না থাকত দাদা, মনের সাধে একবার পায়ে হেঁটে বুঝতাম।
তোমার যে পায়ে ঘা। হাঁটবে কি করে?
ঠিক কথা। থুঃ থুঃ—ওদিকে নজর দিও না।
করালী নোটখানাই ফিরিয়ে দিল। বসন্ত বলে, শুধ চারটে পয়সার দরকার। নোট বন্ধক রেখেই না হয় দাও। পয়লা খেয়া—ওদের এখন ভাঁড়ে মা-ভবানী। কোথায় ভাঙাতে যাই, কি করি! আবার যখন আসব, বন্ধকি জিনিস ছাড়িয়ে নিয়ে যাব, কথা দিচ্ছি।
খুচরো পয়সা নেই। নোট ভাঙিয়ে নিয়ে যা ইচ্ছে করো গে যাও। ব’লে করালী আবার শুয়ে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজল।
দুপুর গড়িয়ে গেছে। করালী বেরুবে বেরুবে করছিল, কাঠের সিঁড়ি হঠাৎ মচমচ ক’রে উঠল।
দাদা, ও দাদা, ঘরে আছ?
তুমি চলে যাওনি বসন্ত?
যেতে পারলাম আর কই। ভাঙানি খুঁজতে গিয়ে গোলমালে পড়ে গেলাম।
কাঁধে বেহালা, বসন্ত ঘরে ঢুকলো। হাত-মুখ নেড়ে বলতে লাগল, ঘুরতে ঘুরতে কালকের ঐ হরিশ-বেহালাদারের ওখানে গিয়ে পড়লাম। একখানা গৎ শোনাল-বলব কি দাদা, মন কেড়ে নিল যেন! দরদস্তুর করে বেহালাটাই কিনে নিয়ে এলাম।
বাজাতে জান?
কিছু না, কিছু না। কোনদিন এসব ঝঞ্ঝাট ছিল না। নতুন ক’রে এই প্যাঁচে পড়ে গেলাম। কর্মনাশা জিনিস। ...সাত টাকায় কিনেছি, দাঁও মারা গেছে, কি বল?
বিপুল আত্মপ্রসাদে সে যেন ফেটে পড়ছিল। বলতে লাগল, আর নোটের দরুন বাকি তিনটে টাকাও দিল না। তার বাবদ তিনখানা গৎ শিখিয়ে দেবে বলেছে। সে-ও সস্তা—কি বল? তারের ভিতর থেকে সুর বেরকরা, সোজা কথা?
তা হলে আর তোমার চাকদায় যাওয়া হয় কই? এখানেই থেকে যেতে হবে।
বসন্ত শুষ্ক মুখে বলে, তা ক’টা দিন থাকতে হবে বই কি। কপালই এই রকম দাদা। ভাবি এক, হয়ে যায় অন্য। ছোট একটা ঘর-টর দেখে দাও, স্বপাক শুরু ক’রে দিই সেখানে।
করালীর নজরে পড়ল, বসন্তের গা খালি। ভিজে কাপড়-জামা পুঁটলি ক’রে বগলে নিয়েছে।
বৃষ্টি হরনি, ও-সব ভিজল কি ক’রে?
ভিজিয়ে দিল কবিরাজের বাঁদর মেয়েটা। আগাগোড়াই ভিজেছিল। গা মুছে ফেলে কবিরাজর একখানা শুকনো কাপড় পরে এলাম।
করালী উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে, কেন, কি হয়েছিল বল তো—
ওদের বারান্দার বসে একটু গৎ প্রাকটিশ করছিলাম। ছড়াৎ ক’রে জল ঢেলে দিল। মেরে বসতাম—তা বলল, দেখতে পাইনি।
তাই হবে।
তোমরা বুড়োমানুষ, যা বলে তাই বিশ্বাস কর। মুখ টিপে হাসছিল। মনে মনে ওর দুষ্টুমি, যতই সাফাই দাও। আবার বলে, ভাল হয়েছে—মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার দরকার ছিল। এত বড় অপমান! বেহালা আমি শিখবই। তোমার এহ নিচের ঘরটা ভাড়া দেয় না দাদা ? দাও না ঠিকঠাক ক’রে—একসঙ্গে থাকা যাবে।
করালী বলে, টাকা গুলো ছাইভস্ম ক’রে উড়িয়ে দিয়ে এলে। খাবে কি?
আছে দাদা, আরও আছে। সাগরের জল ফুরোবে না। অঙ্গ চিরে বের ক’রে দেবো। আংটি চাটুজ্জের বউ, নজর তার কত মোটা। নোট দিয়েছে কি একখানা?
দরজায় খিল এঁটে অতি সন্তর্পণে সে পায়ের ব্যাণ্ডেজ খুলে ফেলল। ঘা নখ পায়ে—কিচ্ছু হয়নি, সব ফাঁকি। ব্যাণ্ডেজের ভাঁজের মধ্যে নোটের গোছা। বলে, বিশ্বাস হ’ল তো? এবার থাকার বন্দোবস্ত ক’রে দাও। কাউকে কিছু বলো না কিন্তু। খবরদার। ঋষিতুল্য লোক তুমি—টাকা ছুড়ে ফেলে দাও, তাই তোমায় শুধু দেখিয়ে দিলাম।
নিচের ঘরটাই সাব্যস্ত হ’ল। দেড় টাকা ভাড়া। সেইখান থেকে সে বেহালা শেখে। ডালকলাই-বোঝাই দক্ষিণের বড় বড় নৌকা নদীর ঘাটে পনর দিন কুড়ি দিন এসে নোঙ্গর ক’রে থাকে, ধীরে সুস্থে কলাই বিক্রি হয়। তারই এক মাঝির সঙ্গে বসন্তর ভাব জমে গেল। লোকটা ভাল দাবা খেলে। বেহালা বাজানো দাবা খেলা আর কোন গতিকে দু’টি চাল সিদ্ধ করে নেওয়া—এই তার কাজ।
একদিন এক কাণ্ড হরে গেল। শরীরটা আবার খারাপ, হয়েছে, বেহালা চর্চা বেশিক্ষণ ভাল লাগল না। খেয়ে দেয়ে সকাল সকাল শুয়ে পড়বে, এহ মতলবে রান্নার যোগাড়ে লেগে গেল। উনানে হাঁড়ি চাপিয়ে দেখে, চাল নেই। দোকানপাট ইতিমধ্যে সব বন্ধ হয়ে গেছে। তখন দরজায় শিকলটা তুলে দিয়ে তাড়াতাড়ি নদীর ঘাটে তার বন্ধু সেই মাঝির কাছে এল রাত্রের মতো চারটি চাল ধার করবার আশায়। বন্ধুর তখন সঙিন অবস্থা, দাবাখেলা খুব জমে গেছে, এক সুপারিওয়ালা তাকে মাত করবার জো করেছে। এমন দুঃসময়ে কি করে ফেলে যায়—জুৎ দিতে দিতে কখন এক সময় বসস্ত নিজেই বসে পড়েছে তার হুঁশ নেই।
খেলা ভাঙল। তখন গভীর রাত, দশমীর জ্যোৎস্না ডুবে গেছে ? ভয় হ’ল দরজায় তালা দিয়ে আসেনি—ইতিমধ্যে চোর ঢুকে যদি যথাসর্বস্ব নিয়ে গিয়ে থাকে। যথাসর্বস্ব অবশ্য অতিরিক্ত মূল্যবান কিছু নয়—টাকাকড়ি বসন্ত কাছছাড়া করে না, গামছার পুঁটুলিতে বাঁধা একখানা ধুতি ও একটা উড়ানি, মাঢির হাঁড়িকুড়ি দু-তিনটা আর ছড়িসহ বেহালাটি। ছূটোছুটি ক’রে এসে দেখে, যা ভেবেছে তাই—চোর সত্যিই ঘরে ঢুকে পড়েছে, তবে জিনিসপত্র নিয়ে পালাবার গরজ দেখা যাচ্ছে না, খিল এঁটে এমন দখল ক’রে বসেছে যে বিস্তর চেঁচামেচি ও দরজা ঝাঁকাঝাঁকি ক’রেও সাড়া মেলে না।
চেঁচামেচিতে দূরবর্তী দোকানের লোকগুলা পর্যন্ত ঘুমচোখে সাড়া দিতে আরম্ভ ক’রল। অবশেষে দরজা খুলল। নত নেত্রে দাঁড়িয়ে আছে হরিমতী। নিজের ভাড়া-নেওয়া ঘর এতক্ষণ বেদখল হয়েছিল, তার উপর ক্ষিধেয় নাড়ি জ্বলছে, বসন্ত আগুন হয়ে ঊঠল।
আমার ঘরে ঢুকেছ কি জন্যে? কৈফিয়ৎ দাও বলছি।
হরিমতী কি বলতে গেল। শব্দ বরোর না, ঠৌঢ দু’ঢি শুধু থর-থর ক’রে কেঁপে ওঠে। বসন্ত বলে, চালাকির জায়গা পাও না? একদিন থাপ্পড় মেরে মুন্ডু ঘুরিয়ে দেব। টের পাবে সেই সময়।
কাজটা আজও যে অসম্ভব ছিল, তা নয়। কিন্তু হরিমতী হঠাৎ ঝর-ঝর ক’রে কেঁদে ফেলল। রাত দুপুর, কোন দিকে কেউ নেই, ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে বয়স্থা মেয়ে কাঁদছে, কি জানি কি রকমটা হয়ে গেল বসন্তর মন। বিব্রতভাবে সে বলতে লাগল, কেঁদ না—আর জ্বালাতন কোরো না লক্ষ্মী। থাপ্পড়ের কথা শুনে এদ্দূর, আর ঘা-গুঁতো একটা-কিছু খেলে কি করতে? এই বীরত্ব নিয়ে মাথায় জল ঢেলেছিলে সেদিন? মারব না, কিচ্ছু করব না—বাপের ঘরের মাণিক, এবার গুটি-গুটি চলে যাও দিকি!
হরিমতী নড়ে না। বসন্ত মারুক খুন ক’রে ফেলুক, সে কিছুতে যাবে না। বাড়ির নামে এখনও শিউরে উঠেছে। অন্য দিনের মতোই রান্নাঘরে সে ঘুমিয়ে ছিল আড্ডা ভাঙার অপেক্ষায়। চোরের মত চুপিচূপি গিয়ে একজনে তার হাত চেপে ধরে। জেগে উঠে চেঁচামেচি করতে করতে সে বেরিয়ে পড়ল। লোকঢিও পিছু ছুটল। অবশেষে বসন্তের এই ঘর খোলা পেয়ে সে তাড়াতাড়ি দরজা দিয়েছে।
বসন্ত রুখে ওঠে। এত সব কাগু ঘটল, কবিরাজ ছিল কোন্ চুলোয়?
যেখানেই থাকুক, চোখ-কান বর্তমান থেকেও আজকের রাতে নীলকান্তর দেখাশোনা করবার অবস্থা নেই। কি একটা উপলক্ষে আড্ডায় আজ বিশেষ একটু আয়োজন ছিল। গান-বাজনা ও গাঁজা সমানে চলেছে। যে লোকটা রান্নাঘরে ঢুকেছিল, সে নীলকান্তরই যাত্রার দলের লোক, হরিমতী চিনতে পেরেছে তাকে।
উনানের ধারে চেলা-বাঁশ ছিল। তারই একখানা তুলে নিয়ে বলে, যাও—যাও এবার। রাত দুপুরে বদনামের ভাগী করতে চাও আমাকে?
ভয়ে ভয়ে হরিমতী রাস্তায় নেমে পড়ে, এক-পা দু’-পা ক’রে এগোয়। বসন্ত বলে, রোসো আমিও যাচ্ছি। বাপের ধন বাপের কাছে বুঝে দিয়ে আসি।
ঔষধালয়-ঘরে তখনও পাঁচ-ছ’ জন রয়েছে, বাঁয়াতবলায় একজনে মাঝে মাঝে চাঁটি দিচ্ছে, অপরগুলি যেন ধ্যানস্থ। একপাশে নীলকান্ত বোধকরি ঘুমিয়েই পড়েছে, প্রবল নিঃশ্বাস-ধ্বনি উঠছে। তবলচি লোকটা বসন্তকে চিনল। বলে, বেহালা এনেছ কই? নিয়ে এস, নিয়ে এস। আর জমবে কখন?
তাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে নীলকান্তর পিঠে ঘা-কতক চেলা-বাঁশ বসিয়ে বসন্ত বিনাবাক্যে ফিরে চলল। তখন সে এক মহাকাণ্ড। জেগে উঠে নীলকান্ত পিঠের জ্বালায় লাফালাফি করছে, বন্ধুমণ্ডলী সমস্বরে অভয় দিচ্ছে। হরিমতী ইতিমধ্যে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েছে।
অতরাত্রে রাঁধাবাড়া আর ঘটল না, মেয়েটাকে গালি পাড়তে পাড়তে বসন্ত শুয়ে পড়ল। ঘুমও এসেছিল একটু। হঠাৎ জেগে উঠে শুনতে লাগল, ঔষধালয় থেকে মুষলধারে গালিবর্ষণ হচ্ছে, নৈশ নিস্তব্ধতায় প্রত্যেকাট কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে, সব চেয়ে উঁচু হয়েছে নীলকান্তর গলা। সকাল হোক্, দেখা যাবে কত বড় চাটুজ্জের ভাই। দেহটা দুই খণ্ড ক’রে যদি গঙ্গার জলে ভাসিয়ে না দেয়, তবে যেন তাদের নামে কুকুর পোষা হয়। ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এইসব হাঙ্গামে বসন্তর ঘুমাতে দেরি হয়ে গেল, বেলা পর্যন্ত পড়ে থেকে পুষিয়ে নেবে এই ছিল মতলব। কিন্তু ভোর না হতেই দরজা ঝাঁকাঝাঁকি। নীলকান্ত ডাকছে। অতএব নেশার ঘোরে যা বলেছিল, নেশা ছুটলেও সে তা মনে রেখেছে। বিরক্ত হয়ে বসন্ত উঠল, গত রাতের চেলা-বাঁশখানা নিয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে খিল খুলে দিল। ঢুকে পড়লেই মাথা ফাটিয়ে দেবে, তা তারা যতজনে আসুক। কিন্ত নীলকান্ত ঘরে ঢোকে না, বাইরে থেকে মিনতি করতে লাগল, কৃপা ক’রে এস না একটু। একটা কথা নিবেদন করি।
মুখ বাড়িয়ে দেখে নীলকান্ত একাই, সঙ্গে কেউ নেই। বসন্তকে দেখেই সে নিজের গাল দু’-হাতে চড়াতে লাগল।
কি, ও কি?
নীলকান্ত বলে, মহাপাতক করেছি মশায়। ওসব আমি একেবারে ছেড়ে দিয়েছি। কালকেই শুধু দলে পড়ে—
এখন বসন্ত ভেবে পায় না, কি এমন অপরাধ নীলকান্তর যার জন্য কাল সে অমন মারমুখি হয়ে গিয়েছিল। বেটা ছেলে—একটু-আধটু নেশাভাঙ করবে, সেটা এমন মারাত্মক কিছু নয়। বলল, নেশা ছাড় না ছাড়, দলটা ছেড়ে দাও। নিতান্ত যদি ইচ্ছা করে, একা-একা খেয়ো।
এ সব যে দলেরই ব্যাপার। একা খেয়ে জুৎ হয় কখনো?
এ কথার সত্যতা বসন্ত খুব জানে। তখন সে অন্য দিক দিয়ে গেল। বলে, তোমার দলের লোকগুলো বড্ড খারাপ কবিরাজ। ওদের মধ্যে থেকেই তো কাণ্ডটা করল।
নীলকান্ত বলে, কিন্তু তা-ও বোঝ, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরেরা কি আসবে আড্ডা দিতে?
এর উপরে কথা চলে না। বসন্ত একটু ভেবে বলল, মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দাও। শ্বশুরবাড়ি চলে যাক্, তারপরে যা-ইচ্ছে তাই কোরো।
নীলকান্ত এবার খপ্ ক’রে তার হাত জড়িয়ে ধরল। বলে, সেই জন্যেই এসেছি। তুমি একটা ঠিকঠাক ক’রে দাও। দেখ, কি রকম চেলাকাঠ মেরেছিলে। কালসিটে পড়ে আছে। তা সত্ত্বেও এসেছি।
এখন দিনের বেলা ঠাণ্ডা মাথায় শাস্তির বহর দেখে বসন্তর করুণা হয়। সে ভরসা দিল—চেলাকাঠ মারার দরুন যেন সত্যি সত্যি একটা দায়িত্ব এসে পড়েছে তার—বলে, আচ্ছা দেখব।
ইতিমধ্যে নীলকান্ত আর একদিন খাতির ক’রে তাকে নিমন্ত্রণ খাওয়াল। তাগিদ রোজই চলেছে। বিরক্ত হয়ে শেষে বসন্ত বলে, বেহালায় ইস্তফা দিয়ে আমি কি পাত্র খুঁজতে বেরুব? বেশ, আমার সঙ্গেই না হয় দিয়ে দাও।
তোমার সঙ্গে?
দশ বচ্ছর তপস্যা করলেও এমন পাত্র পেতে না। আংটি চাটুজ্জের ভাই, চকমিলানো দালান-কোঠা। মেয়েটার কপাল ভাল। নেহাৎ কথা দিয়ে ফেলেছি তাই—
ইতিপূর্বেও অবশ্য আরও অনেক জনকে অনেক ক্ষেত্রে কথাল দিয়েছে, ভাঙতে তার তিলার্ধ আটকায়নি। কিন্তু আংটি চাটুজ্জের ভাইয়ের মাথায় জল ঢেলে ঠাণ্ডা করবার আস্পর্ধা যার, তাকে বিয়ে ক’রে সকাল-বিকাল দুইবেলা কানের কাছে অবিরত বেহালা শোনাতে হবে এই তার সঙ্কল্প।
নীলকান্ত যথাসম্ভব পাত্রের খোঁজখবর নিল। বিয়ে হয়ে গেল। বসন্ত করালীর ঘরে এসে বলে, কাজটা গর্হিত হ’ল, কি বল দাদা? কেবলই জড়িয়ে পড়ছি। এরা আবার নিচু ঘর।
করালী বলে, আজকাল ও-সমস্ত দেখে না।
তা ঠিক। তা ছাড়া প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। আছি তো গঙ্গার উপর। দোষ-টোষ শুধরে গেছে। কিন্তু আমার ভাই টের পেলে খুন ক’রে ফেলবে। জাত আর ধনসম্পত্তি আগলে বাড়ি বসে থাকে। তবে টের পাবে না, বেরোয় না তো!
দু’টো মাস যেন উড়ে চলে গেল। বিয়ের খবর শেষ পর্যন্ত গোপন থাকেনি, চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে। শোনা গেল, আংটি চাটুজ্জেরও কানে গিয়েছে। নিজে একদিন এসে ভাইয়ের কান ধরে টানতে টানতে প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করবে, এই রকম সে শাসিয়ে বেড়াচ্ছে।
আবার এক রাত্রে অভ্যাস অনুযায়ী বসন্ত পিঠটান দিল। আংটির ভয়ে নয়, নূতন নেশা ইতিমধ্যে ফিকে হয়ে এসেছে। আরও কিছুদিন এদিক-সেদিক ঘুরে হাতের শেষ পয়সাটি অবধি খরচ ক’রে অবশেষে সে বাড়ি গিয়ে উঠল। আংটির সামনে যায় না। বাগদি-পাড়ায় ভাব-গানের দল করেছে, তাতে বসন্তর বড় উৎসাহ। নিরক্ষরেরা গানের পদ ভুলে যায়, বসন্ত খাতা খুলে পদগুলো ধরিয়ে দেয়। নিজে যে কয়টা গৎ শিখে এসেছে, তাও খুব কাজে লেগে গেল। দিনরাত সে এই সব নিয়ে মেতে আছে। দুপুরবেলা আংটি ঘুমিয়ে পড়লে টিপিটিপি বাড়ি ঢুকে সোজা রান্নাঘরে এসে বসে। স্নান ইত্যাদি মাঠের পুকুর থেকে সেরে আসে। আংটির স্ত্রী পটেশ্বরী রান্নাঘরে তৈরি হয়ে থাকে, স্বামীর অজ্ঞাতে দেওরকে খাইয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় করতে পারলে সে বেঁচে যায়। রাতে বসন্তর ফুরসৎ নেই। আজ এখানে, কাল সেখানে—বায়না লেগেই আছে। নেহাৎ বায়না যেদিন না থাকে,সেদিনও মহলা দিতে রাত কাবার হয়ে যায়া রাতে তাই বাগদিদের ওখানে ফলাহারের বন্দোবস্ত—চিড়ে, গুড়, নারকেল-কোরা। তোফা দিন কেটে যাচ্ছে।
কিন্তু অদৃষ্ট খারাপ, একদিন একেবারে মুখোমুখি পড়ে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে আংটি বলল, এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছ এটা জগন্নাথ চাটুজ্জের বাড়ি। তাঁর অতুল ঐশ্বর্য রাখা যায়নি, কিন্তু নামটা আছে। সে নাম তুমি ডুবিয়ে দিচ্ছ।
বসন্ত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। কথা শেষ হলে দাদার পায়ের গোড়ায় ঠক করে প্রণাম করল।
আংটি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি করবে?
চলে যাব।
কোথায়?
চাকরি-বাকরি করব, আয়ের চেষ্টা করব, এমনধারা ঘুরে বেড়াব না আর।
আংটি জ্বলে উঠল। অসুবিধেয় পড়ে আমি কিছু দিন কালেক্টরির গোলামি করেছি। তা ব’লে গুষ্ঠিসুদ্ধ উঞ্ছবৃত্তি করবে? ভাই আমার একটা, তার ভাত আমি স্বচ্ছন্দে জোটাতে পারব।
বসন্ত জবাব দেয় না, তেমনিই দাঁড়িয়ে আছে।
এক মুহূর্ত স্তব্ধ থেকে আংটি পুনরায় প্রশ্ন করে, কি ঠিক করলে? যাবেই?
আজ্ঞে হ্যাঁ—
শোন। ব’লে আংটি বসন্তর হাত ধরল। নি চলল অন্দরের শেষদিককার গোল-কুঠুরিতে, যেটায় সে আমলে জগন্নাথ চাটুজ্জে মশায় থাকতেন ব’লে সকলে জানে। ঘরের মাঝখানে গিয়ে বলল, দাঁড়াও। বাইরে এসে আংটি ঝনাৎ ক’রে শিকল এঁটে দিল।
বসন্ত ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ঘরে আটকাচ্ছেন কেন? পোষাচ্ছে না বলেই তা চলে যাচ্ছি।
আংটি প্রবল হাসি হেসে উঠল। বলে, তা বই কি ! বেহালা কাঁধে দেশ-বিদেশে জগন্নাথের মুখ পুড়িয়ে বেড়াবে। তাই আমি হতে দিলাম আর কি।
বসন্ত দরজায় প্রচণ্ড লাথি মেরে বলে, আমি থাকব না যাব, যাব—
আংটি পটেশ্বরীর দিকে চেয়ে বলে, বউমাকে আনতে লোক পাঠিয়েছি। চাবি দিয়ে দেব বউমার কাছে, তোমাকেও বিশ্বাস করিনে ভাইয়ের ব্যাপারে।
হরিমতী এসে পৌঁছল। আংটি উচ্চকণ্ঠে বলে, উড়ো-পাখি পোষ মানাতে হবে মা-লক্ষ্মী। এই নাও খাঁচার চাবি, সামাল ক’রে আঁচলে বেঁধে রাখ। তুমিই পারবে মা। সাত পাকের বাঁধনে পড়েছে যখন, আস্তে আস্তে সমস্ত সয়ে যাবে।
বন্দী বসন্তর উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল, বউ তো আদর ক’রে ঘরে তুলছেন। কোন্ জাত, কি বৃত্তান্ত, খোঁজখবর নিয়েছেন?
আংটি বলে, আমার মা-লক্ষ্মী কি আমার চেয়ে আলাদা কিছু হবেন? হুঁ...ভয় পেয়ে গেছে, কথা শুনে বুঝতে পারছি, আমার মন ভাঙিয়ে দিতে চায়। ...মোটে এলাকাড়ি দেবে না, বুঝলে তো মা?
হরিমাতীর অপরূপ বেশ। এ চেহারার সঙ্গে বসন্ত একেবারে অপরিচিত। সমস্ত সন্ধ্যা পটেশ্বরী বসে বসে তাকে সাজিয়েছে, বসন্তর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে সকল খবর দিয়ে তাকে পাখি-পড়ানোর মতো ক’রে পড়িয়েছে। দুরন্ত দেওরকে বাঁধবার এই একমাত্র ফাঁদ, এ ফাঁদের কোন অংশে ত্রুটি থাকলে চলবে না।
বসন্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দৃষ্টির সামনে হরিমতী সঙ্কুচিত হয়ে গড়ে। নিটৌল কপালে দুই বিন্দু ঘাম দেখা দেয়। বসন্ত বলে, বাঃ বাঃ—বেড়ে দেখাচ্ছে। এই বস্তায় এমন বালাম চাল, টের পাইনি তো!
একটু আনাড়ি ধরনে হেসে হরিমতী বলে, এই ইয়ে... বেহালা বাজাও না একটু—
তুমি শুনবে বেহালা?
হরিমতী বলে, হ্যাঁ, শুনব বইকি। তুমি গুণীলোক হয়েছ, গাঁয়ে গাঁয়ে তোমায় ধরে বায়না গাওয়ায়। আমি শুনব না?
জল এনেছ বুঝি বাটি ভরে—সেই সেবারের মতো গায়ে ঢালবে? দেখি, হাত বের কর দিকি। ও কি...চাঁপাফুল?
হরিমতী বলে, সত্যি—খুব নামডাক হয়েছে। সকলে বলে, বড় মিষ্টি হাত। তখন একেবারে নতুন ছিলে কি না।
বেহালার প্রশংসায় বসন্ত গলে গেল। বলে, আজকের বকশিশ তা হলে কনকচাঁপা? তারপর চিন্তাকুল হয়ে বলে কিন্তু এখানে তো হবে না। বউকে বাজনা শোনাচ্ছি, দাদা-বউঠাকরুন কি ভাববেন! না, সে হয় না।
আস্তে, আস্তে—
ভাব এলে জোর বেড়ে যাবে যে! তখন কি কাণ্ডজ্ঞান থাকে? বড্ড যাচ্ছে-তাই জিনিস।
হঠাৎ এক মতলব মাথায় অসে। বলে, তুমি তো নৌকোয় এসেছ। সে নৌকো চলে গেছে নাকি?
উঁহু, ঘাটে রয়েছে। ভাঁটা না হলে গাঙে পড়বে কি করে?
তবে এক কাজ কর...চল টিপিটিপি ঘাটে যাই।, ঐ নৌকয় বসে বাজনা শোনাব। খুব মজাদার হবে।
হাসতে হাসতে দু’টিতে হাত ধরাধরি ক’রে খালের ঘাটে গেল। ফুটফুটে জ্যোৎস্না। জলধারা রূপার রেখার মতো মাঠের ভিতর দিয়ে দূরে—কত দূরে চলে গেছে। দূরে, কত দূরে! মাঠের শেষ নেই—খালেরও যেন শেষ নেই। চেয়ে চেয়ে বসন্তর মন কি রকম ক’রে উঠল। হরিমতী লীলা-ভঙ্গিতে তার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। বসন্ত বলে, ইঃ—কাদার মধ্যে নিয়ে রেখেছে। দাঁড়াও এখানে—নৌকো ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
নৌকোয় উঠে বসন্ত বৈঠা ধরল। হরিমতী দাঁড়িয়ে আছে।
কই, এসো—
আসছি, আসছি—
ওপারে চললে যে!
উঁহু, টানের মুখটা কাটান দিয়ে ঘুর আসছি।
হরিমতী কাতর কণ্ঠে বলে, বড্ড ভয় করছে। নৌকোয় কাজ নেই, ঘাটে বসে বেহালা শুনব। তুমি এসো।
বসন্ত বলে, ছড়ের গুণ ছিঁড়ে গেছে। বড্ড ঠকিয়েছে হরিশ বেহালাদার। তার কাছ থেকে নতুন ছড় এনে তোমায় শুনিয়ে যাব। তুমি দাঁড়িয়ে থাক, ফিরে এসে দেখতে পাই যেন।
হা-হা-হা—মাঠের বাতাসে তার ব্যঙ্গহাসি দূর-দূরান্তরে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
ও দাদা, দাদা গো—
করালী দুয়োর খুলে বেরিয় এসে দেখে বসন্ত।
কি রকম ঝঞ্ঝাটে যে ফেলেছিল দাদা! কবিরাজের মেয়ে হেসে হেসে কাছে আসে, আবার ওদিকে আংটি চাটুজ্জে দরজায় শিকল আটকে রাখলেন। খুব বেঁচে এসেছি এ যাত্রা। খাল পার হয়ে একরকম ছুটতে ছুটতে এসেছি। পারাণির চারটি পয়সা দাও দিকি এক্ষুণি। দিতেই হবে। নোট ভাঙাতে গিয়েই তো সেদিন থেকে এইসব গোলমাল।
পয়সা নিয় সেই মুহূর্তে বসন্ত সরে পড়ল।
বিকালে এসে পড়ল দশ আঙুলে দশ আংটি-পরা স্বয়ং আংটি চাটুজ্জে। কালেক্টরির চাকরি ছাড়বার পর জগন্নাথের অট্টালিকা ছেড়ে এই সে প্রথম বেরিয়েছে। নীলকান্তকে সঙ্গে নিয়ে করালীর কাছে এল।
বউমার কাছে শুনলাম বসন্তর বড্ড ভাব তোমার সঙ্গে। এসেছিল সে?
করালী বলে, এসেই চলে গেছে।
কোথায়? কোন্ দিকে?
উই যে চাকদার রাস্তা—
গঙ্গার ওপারের দিকে দেখিয়ে দিল। সীমাহীন ধান-ক্ষেত, মাঝখান দিয়ে চাকদার রাস্তা চাল গিয়েছে। দু’-পাশে সারবন্দি পত্রবহুল শিরিষগাছ। চেয়ে চেয়ে আংটি গর্জন ক’রে উঠল।
তোমার মেয়ের হয়ে নালিশ করাতে হবে কবিরাজ, খোরপোষের দাবি দিয়ে। আর তুমি করালী হবে সাক্ষি। ডিগ্রি ক’রে দেওয়ানি জেলে আটকে রাখব। দেখি, সেখান থেকে কোন্ ছুতোয় পালায়। জগন্নাথ চাটুজ্জের নাম নিযে দিব্যি করছি, এ আমি করবই—
তা কোরো। ততদিন তো বসন্ত ঘুরে বেড়াক। নিয়ম-মাফিক খাওয়া-দাওয়া আর বেহালা বাজানো—অসহ্য হয়েছিল তার। পরিচিত পথ-ঘাট গাছপালা ঘর-বাড়ি দেখে দেখে চোখ যেন ভোঁতা হয়ে যাচ্ছিল। আর, এ কি জীবন! সকালবেলা জানা নেই, রাতে কোথায় পড়ে থাকতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে বালু উত্তীর্ণ হয়ে আসবে জাঙাল, জাঙাল ছাড়িয়ে অড়হড়-ক্ষেত...কাদের কাছারিবাড়ি...একটা পচা দীঘি, কত পদ্ম ফুটে আছে...আমবন, তারই ছায়ায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখবে—দিগন্তবিস্তৃত বিল তোমার চোখের সামনে। সন্ধ্যায় দাওয়ায় বসে গোপীযন্ত্র বাজিয়ে কে গান গাচ্ছে, একটি মেয়ে গরুর নাম ধরে ডেকে ডেকে বেড়াচ্ছে, বাঁশঝাড়ে ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ। যে বাড়িতে খুশি উঠানে গিয়ে দাঁড়াও, নূতন মানুষের সঙ্গে পরিচয় কর, ভালবাসাবাসি হোক, …এক রাত্রি বেশ কাটল,আবার ভোরবেলা বোঁচকা বগলে বেহালা কাঁধে বেরিয়ে পড়ো...
কৈলেসকাঠি কোন্ দিকে ভাই? হ্যাঁ গো- হ্যাঁ—বারান্দি-কৈলেস-কাঠি?
লঙ্কা-ক্ষেতে মাটি তুলতে তুলতে চাষীরা প্রশ্ন করে, মশায়ের সাকিন?
জীবণপুরের পথিক রে ভাই
কোন দেশে সাকিণ নাই......
1 মন্তব্যসমূহ
অপুর। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
উত্তরমুছুন