শামিম আহমেদের উপন্যাস বিষাদবিন্দু : কারাবালার অন্য প্রান্তরে

সোহিনী সেন

তামাম দুনিয়ার বুকফাটা ভালোবাসা উপছে পরেছে হোসেনের শরীরে। বছর পেরিয়েছে। পেরিয়েছে যুগ। কারাবালার শুষ্ক মরুপ্রান্তরে পড়ে থাকা ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত দেহখানা আজও য্যানো অশ্রুস্নাত। জল শুকিয়েছে রোদের তীব্র দাবদাহে, শোকের আদ্রতাকে শুকোতে পারেনি সর্বশক্তিমান সূর্যরশ্মিও। বিশ্বজোড়া সমব্যাথীর ব্যারিকেডের ওপারে ‘হায় হোসেন’, আর এপারে? ক্লান্ত পরিশ্রান্ত এক রুবাবে একটানা বেজে চলেছে বিষাদের রুকবানি।
বাদক স্বয়ং এজিদ – সারা পৃথিবী ও ইতিহাসের দৃষ্টিতে যে খলনায়ক। লেখক শামিম আহমেদের বিষাদবিন্দু উপহার দিলো এক আনকোরা নতুন এজিদকে। এই এজিদ হোসেন হন্তারক নয়, এই এজিদের তরবারির শাণে যতো না ঔজ্জ্বল্য, তার রুবাব(বেহালা), ওউদে(গিটারে) তোলা গুরবানির তীক্ষ্ণতা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি। অমুসলমান(নাসারা/খৃস্টান) মাতৃজঠরজাত এজিদ তার মায়ের মতোই নির্ভীক, স্বাধীনচেতা ও ধর্মের ফুঁৎকারে অবিশ্বাসী। মায়ের মতোই শিরাজীতে গলা ভিজিয়ে খামারিয়া লিখতে ও আওড়াতে বসে তার মগ্ন চৈতন্য। ভবিষ্যতের এই খলিফা তার আসন্ন আগামির কথা জানতে পেরেও সুরা পান করছে – ‘বিশ্বাসী’রা একে ‘অবজ্ঞা’ বলবেন সন্দেহ নেই, বলবেন ‘কাফের’ তাতেও সন্দীহান নই। কিন্তু একবার ভাবুন তো, ধর্মের তৈরি অন্ধ শিকলকে নিজে হাতে ভাঙতে পারে এমন সাহসী যোদ্ধা কি একালেও খুব একটা বেশি সহজলভ্য? উত্তরটা আমরা সবাই জানি। আর সেই উত্তরে ভর দিয়েই বলতে পারি – তিনি সত্যিই ‘এজিদ’ যিনি মহান হতে চলেছেন(আরবিক এজিদ শব্দের অর্থ)।

এজিদ ছোটোবেলা থেকেই ড্রাম বাজায়(যা ইসলামবিরোধী)। নসব্, সনদ্ তার নখদর্পণে। “বাদ্যযন্ত্র না বাজিয়েও সে যখন ‘হুদা’ সংগীত ধরে, মনে হয় বসরা যেন উঠে এসে দামাস্কাসের ঘরে বাসা নিয়েছে। মরুভূমির আত্মা আর জিনরা এই সংগীত শুনলে বিবশ হয়ে যায়।” এছাড়া ঘিনা, আজাজ প্রভৃতি সংগীতেও এজিদ রীতিমত দক্ষ। অদ্ভুত লাগে যখন দেখি অমুসলমান রাজকুমারী বিন জাবালার প্রেমে পরে একটি গোটা রাত এজিদ বিনিদ্র কাটায়। তাঁবুর ভেতরে তখন কেবলমাত্র সে ও রাজকুমারী। চাইলেই যেকোনোরকম অঘটন ঘটাতে পারতো মাইসুন-মাবিয়ার এই বীরপুত্রটি, …দামাস্কার রাজমুকুট যার মাথায়, দেখতেও যে রাজপুরুষের মতো, যাকে সিরিয়ার লোকজন ‘এজিদুর ফুহুদ’ বলে ডাকে, যে ফাতা আল আরব। …যুবকদের বীর। আর যাই হোক দুপাত্র সুরা পান করার পর কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে সেরকম কিছু করলে তাতে আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু থাকতো না। কিন্তু এজিদ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়নি। তার রুবাবে বেজেছে পারসিদের প্রচলিত ভৈরবী রাগ। একলারাতে পুরুষোচিত পাশবিকতা প্রয়োগের বদলে রাজকুমারীকে এজিদ ‘কোমল রে’ আর ‘কোমল নি’-র তফাৎ বোঝাতে থাকে। তার সেই উদার সুরে কোথায় য্যানো মিশে যায় প্লেটোনিক ভালোবাসার গভীর নিষ্কাম আর্তি। রাজনৈতিক কারণে বাবেলের রাজকুমারী ঘাসানা সম্প্রদায়ভুক্ত উম্মে রামালাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় এজিদ। বিন জাবালাকে অভূতপূর্ব পোশাক ও অলংকারে সাজিয়ে আনাতলিয়ায় পাঠিয়ে দ্যায় সে। প্রেমিক এজিদের মুখে শুনতে পাই – “তোমাকে আমি ভালোবাসি রাজকুমারী। আমার কবি বন্ধু আল আখতাল বলে, যাকে ভালোবাসবে তাকে বিয়ে করো না। রাজকুমারী তুমি আমার হৃদয়ে অবস্থান করো।” এজিদের পক্ষে হয় তো এর বেশি কিছু করা সম্ভবও ছিলো না কারণ পারিবারিক সম্মানরক্ষার কাছে সে দায়বদ্ধ। তবে আর পাঁচজনের মতো নয় বলেই তার চরিত্রের তীক্ষ্ণতার কাছে বোধ হয় প্রত্যাশা খানিক বেশিই ছিলো। ক্যানো প্রতিবার প্রেমকে পরাজিত থেকেই বিজিত হোতে হবে? ক্যানো কেবলমাত্র না পাওয়ার দুঃখবিলাসের মধ্যেই থাকবে সুতীব্র ভালোবাসার গোপন অর্ঘ্য – সমাজকে এই নির্মম কঠোর প্রশ্নগুলো ছুঁড়ে দ্রোহ দ্যাখাতেই পারতো সে, তাতে অন্তত আমাদের আশ্চর্য্য হওয়ার কিছু থাকতো না, বরং তার ইস্পাত কঠিন দার্ঢ্যের সঙ্গে খানিক মিলেই যেতো এই প্রশ্নবাণ। কিন্তু এজিদ সে প্রশ্ন তোলেনি। না তুলে সে বুঝিয়ে দিলো মানুষের চেনা মনস্তত্বের গহিনে লুকিয়ে থাকে অন্য এক মানুষ যে অন্যের কাছে তো বটেই হয় তো খোদ তার নিজের কাছেও অচেনা। “A wonderful fact to reflect upon, that every human creature is constituted to be that profound secret and mystery to every other and to self also.” – তবে কি এরমই কোনো ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন শামিম? জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি, প্রেমিক এজিদের ভালোবাসার সপ্তরাগ সেদিন ছুঁয়েছিল কোনো এক সীমাহীন সীমা যেখান থেকে দুরত্ব পরিমাপ করা যায় না, করা গেলে বলতাম ভৌগলিক মানচিত্রে দুরত্ব কমে গ্যাছে আনাতোলিয়া আর কুস্তান্তিনিয়ার। এক হয়ে গ্যাছে দুই দেশ কোমল রে আর কোমল নি’র রাগে।


সেই রাগের মাঙ্গলিক ধোঁয়া ছুঁয়ে যায় পিতা এজিদের হৃদয়খানাও। এজিদ জন্মগতভাবে নাসারা এবং মুসলমান। কিন্তু সে ইসলাম অনুসরণ করে না। তার মদ্যপানের প্রতি চূড়ান্ত আসক্তিই সেই কথা বুঝিয়ে দ্যায়। অথচ পুত্র খালিদকে কি অপূর্ব নৈপুণ্যে সে শেখায় আরবি সপ্তস্বর ও তার সাথে ইসলামের সংযোগ – যা কোনো একদিন মাইসুনবিবি তাকে শিখিয়েছিলো। দা-রে-মি-ফা-সা-লা-তি’র যাবতীয় ধোঁয়াশা পরিষ্কার হয়ে যায় খালিদের কাছে। এজিদ ইসলাম মানে না, কিন্তু প্রবল নৈরাশ্যে সে আবৃত্তি করে কোরানের সুরা রুম্। বাঁ হাতে তরবারি, ডান হাতে রুবা্‌ব, এজিদের কণ্ঠে ধ্বনিত হোতে থাকে – “শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু... আলিফ লাম মিম… অতএব, আপনি ধৈর্য্য ধরুন। আল্লাহর শপথ সত্য। যারা বিশ্বাসী নয়, তারা যেন আপনাকে বিচলিত না করতে পারে।” এজিদকে মৌলবিরা কোরান পড়াতে পারেনি। তাই জোব্বা আলখাল্লাদের কাছে সে অশিক্ষিত। কিন্তু অমুসলিম মাইসুনবিবি সেই ছোট্টবেলাতেই ছেলেকে দিয়েছিলো কোরানের পাঠ। তাই দরবেশের সাথে তর্কযুদ্ধেও কোরানের প্রতিটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় সম্পর্কে এজিদের জ্ঞান চোখে পড়ে। তার জানার স্পৃহা পরিলক্ষিত হয়। আসলে এজিদের কাছে ধর্ম কোনো ফটকে আবিষ্ট অনুশাসন নয়। ধর্ম তার কাছে জ্ঞানের দ্যোতক, শিল্পের মুক্তি আর আত্মার প্রসারতা। তাই আপাদমস্তক ইসলামিক ধর্মীয় কঠোরতার বাতাবরণেও যখন মাইসুন-মাবিয়ার এই পুত্রটি উচ্চারণ করে ওঠে-

“…ধর্ম ভাঙে সুখে, টুকরো দুঃখে
সময় ভাঙে আমার দু-মণিবন্ধে
ধর্মে অমর হতে চায় লোভী দল
ফেলো না চোখের জল। ধর্মের কল
নিঃশ্বাসের মতো ঝেড়ে ফেলো। ধর্ম –
দাঘ! টেনে নাও জ্ঞান – সুকর্ম।”

তখন মনে হয় একবিংশ মনোস্তত্বের কোনো আদি সূর্যকণা য্যানো প্রতীতী হয়ে ছুঁয়ে গিয়েছিলো মানুষটাকে। তার সিকাহ, মুস্তার, আজম, জিকারকাহ, জমজমা’র সুরে লেগে আধুনিক স্বাধীন চিন্তক একবিংশ – যা প্রশ্ন ও বিশ্লেষণ করতে উদ্বুব্দ্ধ করে, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার ইন্ধন যোগায়। খোদ কঠোর ইসলামের প্রাণকেন্দ্রের আবেষ্টনীতে এ য্যানো এক বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ! ধর্মের দিকে সুনিপুণ ভঙ্গীতে আঙ্গুল তোলা তো কেবল বিপ্লবী বৈশ্বানরের পক্ষেই সম্ভব – নয় কি?

এই বিপ্লব সত্যি সত্যিই এজিদের মজ্জায় মজ্জায়। যৌনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী এই মানুষটি নিজের উভকামিতার কথা প্রছারে কুণ্ঠিত হন না। তার স্বতঃস্ফূর্ত কলম লিখে ফেলে –

“সেই বালকের সঙ্গে প্রেম করো
যার এখনও গোঁফ গজায়নি
তৃপ্তি দেবে তোমাকে সে আরও
যার এখনও দাঁড়ি বেরোয়নি।
বালিকার প্রেম, সে তো বিবাহ-প্রস্তাব
প্রতিদিন দেখি আমি তাকে জয়নাব
তবু বালকরা কেন পিছু ছাড়ে না
সেই বালকের সঙ্গে প্রেম করো।”

যৌবনে এজিদ অল্পবয়সি কিশরদের ঘরে ডেকে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের সাথে সময় কাটায়। পাশাপাশি সে উম্মে হিশাম নামে এক কিশরীরও প্রেমে পড়ে। সমলিঙ্গ প্রেম তো ইসলামে হারাম। খোদাতালা এই পাপকে দেখতে পারেন না। আল্লাহতালা সুরা আরফে বলছেন – তোমরা স্ত্রীলোকদের বাদ দিয়ে পুরুষদের দ্বারা নিজেদের যৌন ইচ্ছা পূরণ করে নিচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী লোক। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।” লিওয়াতের শাস্তি যে ভয়াবহ! এবং স্বয়ং নবিসাহেবও এই পাপীদের মৃত্যুদণ্ডের কথা বলে গেছেন। – এইসব কঠিন রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই এজিদ বাঁচিয়ে রাখে তার ব্যক্তিসত্তার দাবিটি। গা শিউরে ওঠে তার এই অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় পেয়ে!

শুধু এখানেই শেষ নয়। চমকের বুঝি আর কিছু বাকি ছিলো! বাবেলের রানী উম্মে রামালার গর্ভে যখন এজিদের একটি কন্যাসন্তান হয়, তখন এক অভূতপূর্ব এজিদকে আবিষ্কার করি আমরা। ইসলামে কন্যাসন্তানের জন্মে আনন্দ উৎসব হয় না বিশেষ, আর হোলেও তা বীরপুরুষ পুত্রসন্তানটির চেয়ে কম। এজিদ প্রথমবার কন্যাসন্তানের পিতা হওয়ার পর তার নামকরণ করে গরু জবাই করে। আকিকার গোস্ত নিয়ে নিজে হাতে সুস্বাদু কাবাব বানায় পিতা এজিদ। মামাবাড়ির পক্ষ থেকে কন্যাটির নাম রাখা হয় রাফালা – বেহেস্তের হুরি। এ নামের সঙ্গে সৌন্দর্য্যের সংস্রব আছে, শৌর্য্যের না – বোধ হয় এমন মনোভাবাপন্ন হয়েই এজিদ কন্যার নাম বদলান। রাখেন বিলকিস, যার অর্থ সূর্যের চারপাশে ঘোরে এমন তারা। বিলকিস য্যানো পরবর্তীকালে এই পুরুষশাসিত সমাজেও শৌর্য্যের প্রতিবিম্বন হয়ে ওঠে – এই ছিলো পিতৃহৃদয়ের কামনা। মনু-খলিফাদের এই পুংবিশ্বে লিঙ্গবৈষম্যকে খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলো এক ভবিষ্যৎ খলিফা। খিলাফতের এই অনন্য নজির বাকরূদ্ধ করে দ্যায় বৈকি!

অবশ্য বাকরূদ্ধ আমরা তখনও হই যখন দেখি হোসেনের মৃত্যুতে বিজয়ীসুলভ আস্ফালনের এজিদের ছখ ভেসে যায় নোনতা জলে।

ইতিহাসের এক পূরণকারক সত্য আবিষ্কারের মাধ্যমে বিন্দু বিন্দু নোনতা বিষাদ য্যানো শামিম জমিয়ে দ্যান বুকের মধ্যে। এজিদ হয়ে ওঠে কারাবালার অন্য প্রান্তর।


English Quotation Courtesy – Charles Dickens (A Tale Of Two Cities)





লেখক পরিচিতি
সোহিনী সেন 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেছেন। মূলত কবিতা লেখেন। তাঁর আগ্রহের
বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সেমিটিক পুরাণ ও সুফি দর্শন। থাকেন কলকাতায়। গদ্য
সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ও সমালোচক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ