শামিম আহমেদ : তারুণ্যের প্রজ্ঞা

জয়া মিত্র

গত ছ’মাসে পরমাশ্চর্য ভাবে অন্তত পাঁচজন তরুণ লেখককে খুঁজে পাবার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এই খুঁজে পাওয়াটা অবশ্য ‘আমেরিকা আবিষ্কারে’র মত- এঁরা ছিলেন, লিখছিলেন, কেবল আমি জানতাম না।খুঁজে পাবার পর সমকালীন সাহিত্যপাঠের ক্ষেত্রে যেন মনে নতুন একটা আগ্রহের জোয়ার এল।আশা হচ্ছে, প্রতিদিন যে সব ক্লান্তিকর গল্প-উপন্যাসের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তার বাইরে আরো লেখা-ভুবন ছড়িয়ে আছে। জেনে ফেলার বাইরে, এখনও।
সাহিত্যসরস্বতীর মুখ এখনও সম্পূর্ণ দেখা ফুরোয় নি। যে ক’জন লেখকের কথা বলছি,আয়ুর দিক থেকে এঁরা আমাদের প্রায় পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু লেখনকুশলতায় সমীহ করার মত।মহানগরের বদ্ধ, ভেপসে ওঠা, ছকবন্দী জীবনের পাশাপাশি আরও অন্য অঙ্গন-প্রাঙ্গণে বিস্তৃত জীবনের অভিজ্ঞতা,সেই অভিজ্ঞতা-সঞ্জাত জ্ঞান এবং তা প্রকাশের বিচিত্র প্রকরণ এই লেখকদের প্রত্যেককে ভিন্ন ভিন্ন গভীরতা ও বৈশিষ্ট্য দিয়েছে।

শামিম আহমেদ এই লেখকদের একজন। মাত্র এবছর জানুয়ারি মাসে তাঁর সাথে পরিচয় হল।সুলেখক নীহারুল ইসলামের আমন্ত্রণে লালগোলার এক সাহিত্য সম্মেলনে কিছু উজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্যে ছিলেন শামিম।শামিম শব্দের অর্থ ইংরিজিতে ‘গর্জাস’।বাংলায়, ঝকমকে? শামিম কিন্তু যেন ঈষৎ ছদ্মবেশী স্বভাব। অন্তত নবাগতের কাছে।কিছুটা চুপচাপ, একটু পিছিয়ে কোণ নিয়ে বসা- এরকমই। যদিও বাংলাদেশের অগ্রগণ্য লেখক জাকির তালুকদার ও অন্যান্য লেখকসঙ্গীদের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছিল তাঁর গুরুত্ব আর ঔজ্জ্বল্য।তারপর পড়লাম তাঁর বই- ‘সাত আসমান’। এর আগে শুনে নিয়েছি এসব চিত্তচমৎকারী বৃত্তান্ত যে বেলুড় কলেজের শতবর্ষব্যাপী ইতিহাসে প্রথম মুসলিম অধ্যাপক এই চুপচাপ তরুণটি এবং পড়ান, বিজ্ঞান নয়, দর্শন।এবং মহাভারত নিয়ে দুটি মৌলিক অনুসন্ধানের বই আছে এঁর।‘সাত আসমান’ এঁর প্রথম উপন্যাস। পড়লাম। খুব ধীরে ধীরে, প্রায় ‘বিদেশি ভাষায় কথা বলার’র মত করে। কতোদিন পর যে এরকম করে পড়লাম কোনো উপন্যাস!প্রায় ঢোঁড়াই চরিতমানস কিম্বা গোপীনাথ মহান্তির অমৃতের পুত্র পাঠের অভিজ্ঞতা।অথচ মাত্র একশ পৃষ্ঠার উপন্যাস।(তখনও জানিনা যে ঠিক তার পরপরই আবার একবার হবে ওই একই রকম অথৈ অভিজ্ঞতা যখন পড়তে পাবো জাকির তালুকদারের ‘মুসলমানমঙ্গল’)

সাতচল্লিশে দেশভাগের ঠিক আগে বীরভূমের গ্রাম থেকে মুর্শিদাবাদের সালারে উঠে আসেন এক গৃহস্থ, জার্মান মিঞা।আরো অনেকের মত তাঁরও আশা যে মুর্শিদাবাদ পাকিস্তানে যাবে সুতরাং তাঁরা হয়ে যাবেন আল্লার সেই প্রিয় দেশ পাকিস্তানের নাগরিক।কাহিনীর বহিরঙ্গের বিষয় হিসেবে আমরা জানি যে দুদিন পর মুর্শিদাবাদ ফিরে এসেছিল ভারতে।শামিম নিজেই স্পষ্ট ইঙ্গিত রেখেছেন যে এ কাহিনী তাঁর পারিবারিক ইতিহাস। আজও সালারেই বাস করেন তাঁর পরিবার। কিন্তু একদিকে এই জার্মান মিঞা আর নানান স্বপ্নে, কল্পনায়, ভয়ে আর সরলতায় ভরা তার ভুবন, সাধারণ পাশাপাশি স্থানীয় এবং দেশীয় রাজনীতির খেলা, সাধারণ মানুষদের আশা আকাংক্ষা, এমনকি ছেচল্লিশের সেই দাঙ্গা- এই সবকিছু চলেছে একসঙ্গে। গায়ে গায়ে যেমন চলে পাখির ঝাঁক। ইতিহাসের অতি জটিল প্রেক্ষাপটে গ্রামবাংলার লৌকিক জীবনের এই ছবি আমার মত পাঠক খুব বেশি পায় না।অথচ কোনমতেই ডকুমেন্টেশনের দায় ঘাড়ে নেয় নি এ উপন্যাস। বিশাল বিষয়কে সরলতম ভাবে বিবৃত করার যে পূর্বদেশীয় ধরণ, সেই বাস্তব ও পরাবাস্তবে সাবলীল চলাফেরা করছে অবারিত। অবিরল। হতে পারে আরবী ও সংস্কৃত সাহিত্যে অধিকার লেখককে এই কুশলতা দিয়েছে।এই সচেতন নির্মাণ।

বাঙ্গালি, হিন্দু বাঙ্গালি, পাঠক হিসাবে অনেক কথা আমাকে ভাবালো এই দুটি বই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাপনে সাধারণভাবে আমরা বড় একদেশদর্শী। কিম্বা হয়ত দুশো বছরের পরাধীনতা আমাদের সংস্কৃতিকে এভাবেই সংকীর্ণ করে দিয়েছে যে আমরা নিজেদের সহজ প্রতিবেশী জনগোষ্ঠী সম্পর্কে অদ্ভুত উদাসীনতায় থাকি। একথা যে শুধু মুসলিম সমাজ সম্পর্কে প্রযোজ্য তা নয়, আদিবাসীরা, গ্রামের মানুষরা- অন্যসকলের ক্ষেত্রেই সত্যি। তাই আমাদের পাঠ্য বইগুলোতে ধারণা গত ভাবে প্রাধান্য পায় কেবল নাগরিক জীবন, আমাদের মুখের বা সাহিত্যের ভাষা হয়ে ওঠে কেবল নাগরিক ভাষা। অতি সহজে, প্রায় বিনা প্রতিরোধে, আমাদের খাওয়াপরা, উৎসব-অনুষ্ঠান নিজেদের শিকড়বিছিন্ন বাজারতন্ত্রের মৃগয়াভূমি হয়ে উঠতে পারে। স্বাভাবিক স্বজন থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি বলে ক্ষমতার যখন যেমন ইচ্ছা আমাদের দড়ি টানতে পারে। কখনো ‘রামরথ’, কখনো সন্ত্রাসবা্দ,‌ কখনো বা উন্নয়ন-অনুন্নয়ন।

অন্য বিষয়টি একেবারেই ব্যক্তিগত ভাবনা। বৃটিশপূর্ব বাংলাভাষায় আরবি-ফার্সির যে ব্যাপক মিস্রণ ছিল, কোম্পানির প্রথম যুগে লেখা চিঠিপত্রেও যার একটা চেহারা বেশ দেখা যায়, তার একটি নিজস্ব মাধুর্য আছে। বিশেষত বাংলার এক বড় অংশের গ্রামাঞ্চলে এ ভাষা এখনও বেশ চর্চিত। তথাকথিত রেণেসাঁর মোহে ‘ভদ্রলোকের ভাষা’ হয়ে ওঠে ইংরেজি।সুপরিকল্পিত ভাবে, হাতে কাটা সুতো কিম্বা তাঁতে বোনা কাপড়ের মত, এই আয়ত্তে থাকা ভাষাটি চিহ্নিত হল ‘পিছিয়ে পড়া’ বলে।যে বঙ্কিমচন্দ্রের একশ পঞ্চাশ জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে আধুনিক বাংলাভাষার জনক হিসাবে স্তুতি করা হবে, তাঁর সাহিত্যে সংস্কৃতবহুলতার পাশাপাশি নানা দেশি ও আরবি ঘেঁষা বাংলার যে সমৃদ্ধি দেখা যায়, আমরা তাকে সাহিয়ে ব্যবহার করিনা কেন?যদি মর্নিংওয়াক করা যায়, গোসল করা যায় না কেন? একসময়ে আয়ত্তে ছিল তাকে ফিরিয়ে আনতে সমস্যা কোথায়? ধন বেশি রাখাই তো ধনী হবার শ্রেষ্ঠ উপায়।


লেখক পরিচিতি
জয়া মিত্র
২১ সেপ্টেম্বর,ধানবাদ | ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী,রূপনারায়ণপুরে শিক্ষকতা করতেন | লেখক জীবনের প্রথমে শুধু কবিতা লিখেছেন,গত পাঁচ বছর গদ্যও লিখেছেন | বেশ কিছুকাল কারারুদ্ধ ছিলেন | সেই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা বই 'হন্যমান'-এর জন্য ১৯৯১ সালে আনন্দবাজারে 'সুরেশচন্দ্র স্মৃতি পুরুস্কারে'র প্রাপক | বর্তমানে মানবাধিকার রক্ষা ও পরমানু শক্তি বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছেন |
প্রকাশিত বই :  হন্যমানে, স্বর্ণকমলের চিহ্ন, যুদ্ধপর্ব, মাটি ও শিকড়বাকড়, কালোসাদা বাতাস,কালপরশুর ধারাবাহিক, একটি উপকথার জন্ম। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ