অবন্তী,
আজ সকালে আলবেয়ার কামুর নোটবুক পড়তে গিয়ে বিষন্নতা বোধ করতে থাকি। কামু নিজে ছিলেন খুব সম্ভব ‘দি আউটসাইডার'-এর মার্সেল, যে উপন্যাস পড়তে গিয়ে আমরাও মার্সেলের মত জীবনের নিরর্থকতা বোধে আক্রান্ত হই। সেই নিরর্থকতা বোধ তার নোটেও গভীরভাবে সঞ্চার করে গেছেন; যদিও সেইসব দার্শনিক কথা-বার্তার সবটা যে ধরতে পেরেছি, তা নয়— যতটুকু ধরতে সক্ষম হয়েছি, বলা ভাল, যতটুকু আমাকে আক্রান্ত করেছে, ততোটুকুর বিষন্নতা আমার চোখে কুয়াশা হয়ে নেমে এসেছে। জীবনের সমস্ত আয়োজন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার তাগিদ অনুভব করছি। আহ! যদি সত্যি তা করা যেত!
কারোর মুখে শুনেছি, মার্সেলের সেই এবসার্ডিজম আসলে একটা মানসিক রোগ, আর এই এমন এক রোগ, যা তোমাকে জীবনের উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা, উত্তেজনা ইত্যাদি উপভোগ করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। হতে পারে। কিন্তু, আমরা যারা মার্সেলের ভেতরে জীবনের নগ্ন রূপের এমন নগ্ন উপস্থাপন দেখে লেখকের কৃতিত্বে মুগ্ধ হবার বদলে বরং তাতে আক্রান্ত হই, তাদের এই আক্রান্ত হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, বিশ্বাস কর? বলতে পারো, শুধু আমাদের বেলায় কেন এমন হল? আসলে, আমাদের এই নিরর্থকতা বোধ সেই ছোটবেলা থেকেই ভেতরে গেঁথে ছিল, অথবা কারোর কারোর ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল— আমরা যখন মার্সেলের সাথে সাক্ষাৎ করি, তখন আসলে নিজেদের ভেতরের নগ্ন রূপটারই প্রতিফলন খুঁজে পাই তার ভেতরে। এবং, আক্রান্ত হয়ে পড়ি। আর যাদের ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল এতোদিন এই বোধ, জীবনের সমস্ত আয়োজন উৎসবে অংশগ্রহণ করা শেষে, একদিন যখন মার্সেলের মুখোমুখি হয়, আর ভেতরে এতোদিন যাবৎ ঘুমিয়ে থাকা এবসার্ডিজম ধড়ফড় করে জেগে ওঠে— তাদের অনেকেই এই নিরর্থকতা বোধের আকস্মিক আক্রমণের তীব্রতা সইতে পারে না; তারা কোন এক পঞ্চমির জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ ডুবে গেলে অদ্ভুত আঁধারে এক গাছি দড়ি হাতে অশত্থের ডালে মুক্তি খোঁজে। তারা হয়ত কৃতিত্বের সাথে স্কুল শিক্ষা-জীবন পার করে, বন্ধু-বান্ধব, চেনা-অচেনার সাথে সামাজিক পারিবারিক জীবন-যাপন করে, রূপসী মেয়ে বিয়ে করে, সন্তান-সন্ততির জন্ম দেয়, সব রকমের ‘সুখে' কাটানোর মত অর্থ-বিত্তের মালিক হয়, খ্যাতি আসে— তারপর কোন এক রাতে রূপসী বউয়ের সাথে সঙ্গম শেষে আনমনে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে; তখন মনের গভীরে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে থাকা সেই জীবনানন্দীয় ভূত আলগোছে সেই কড়িকাঠে ঝুলতে থাকে।
আর, তখনই তার মনে পড়ে যায়, সে যে সেই ছোটবেলা থেকে সফলতার পেছনের ছুটেছে, তার স্বরূপ কি আসলে এ-ই? সে লেখাপড়ায় ভাল করতে চেয়েছিল, বেশ কৃতিত্বের সাথেই করেছে; উঁচু বেতনের চাকরি পেতে চেয়েছিল, সে শুধু ভাল চাকরিই পায় নি, সাথে সামাজিক মর্যাদাও লাভ করেছে; খুব রূপসী একটা প্রেয়সীর দিবাস্বপ্নে সে কত দুপুর কাটিয়ে দিয়েছে, তার বউটা বলার মত সত্যি তেমন রূপসী বটে; আর তাদের পাশে এখনো শুয়ে আছে তার তারুণ্যের সেই স্বপ্নের মানিকজোড়! অথচ, আজ সব কিছু পাবার পরে মনে হচ্ছে, সে মোটেও এসব চায় নি; সে যা চেয়েছিল তা 'অন্য কোথাও, অন্য কোন জীবনে।'
২.
মানুষের জীবন-যাপনের একটা চিরন্তন প্যাটার্ন থাকে। সেই আদিম গুহায় মানুষ ভোরের আলোয় জেগে ওঠত, লক্ষ বছর পরেও মানুষ তাই করে। সব কালে সব মানুষের জীবন যে প্রণালীতে যাপিত হয়। ধরা যাক, ষাট বছরের জীবনে একটা মানুষ যে জীবনটা যাপন করে, সেই জীবনে প্রতিটা দিন যা যা করেছে, যেসমস্ত ঘটনা এবং পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে— সেগুলোর ভেতর যা ছিল প্রথম, তা-ই হল অভিজ্ঞতা। একজন মানুষের ষাট বছরের সমস্ত জীবনে সে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি কমই হয়। বাকিটা সময় সে একটা অভ্যস্ত জীবন যাপন করে কাটায়। যেন, জাস্ট বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা অথবা নতুন আরও অভিজ্ঞতা লাভের আশায় প্রতীক্ষা। অথবা, কেউ কেউ নিজের ভেতরে তাকায় না। ফলে সে যে কী এক শূন্য জীবন-যাপন করছে, তা আর দেখেও না। তারা আপাতত চোখে সুখি। একটা অভ্যস্ত জীবন নিয়েও সুখি। কিন্তু কেউ কেউ একটা অভ্যস্ত জীবন নিয়ে সুখি হতে পারে না, আমার মত যারা। তারা নিরন্তর নিঃসঙ্গ। তাদের সঙ্গ দেয় দিবাস্বপ্ন স্মৃতি আর চারপাশ। চারপাশের কর্মযজ্ঞে এরা অংশগ্রহণ করে না, শুধু দেখে যায়। এগুলোই তার বেঁচে থাকার অবলম্বন।
আমারও একটা অবলম্বন আছে, সেটা সাহিত্য। এযাবৎ এটাই ভেবে আসছি, কিন্তু ভেতরে কখনো তাকাই নি বলেই ফাঁকটুকু ধরতে পারিনি। ইদানীং শাহাদুজ্জামানের 'কাগজের এরোপ্লেন' সেই রফিকের মত আমারও মনে হয়,— “সাহিত্য আমার কাছে ধন উপার্জন কিংবা খ্যাতির পরিপূরক কোন মাধ্যম নয়। এ আমার বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় খাদ্য মাত্র। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকার একটাই তাৎপর্য, লিখব। লেখালেখি ছাড়া পৃথিবীর বাকি যাবতীয় কাজ আমার কাছে হাস্যকর। কিন্তু ক্রমশ টের পাচ্ছি লেখালেখি আমাকে দিয়ে হবে না। সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার। সেই প্রজ্ঞার উৎসভূমি আমার কাছে নেই। আছে প্রবঞ্চনা। এ ছাড়া লিখতে পারি অন্যের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। কিন্তু তাতে কী লাভ? যার ভালো লাগার আমি না লিখলেও পড়বে। বাকি রইলো সাহিত্যপাঠ। এ যাবতকাল বেশ কিছু পরিমাণ সাহিত্য পড়ে মনে হয়েছে, না পড়লেও বিশেষ ক্ষতিবৃদ্ধি ছিল না। অতএব বুঝতে পারছি আমার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল, হয় এবং হবে।"
তারপরও আমি এখন আর নৈরাশ্যবাদ পছন্দ করতে চাই না। জাস্ট ভুলে থাকতে চাই। নাহয় একটা একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির মিথ্যা বিশ্বাসের মত একটা মিথ্যে জীবনই কাটালাম, এত সত্য জেনে কী হয়? নৈরাশ্যবাদের ভেতরে বাস করতে করতে জীবনের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। আমি জীবনকে ভাল বাসতে চাই। আবার, বাবা বা চারপাশের মানুষগুলো যে একটা অভ্যস্ত জীবন-যাপন করে যাচ্ছে, সে জীবন যাপন করাও অসম্ভব; তাতে আমি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। তাই ভালবাসি, যারা Explorer, তাদের; জীবনের ক্ষেত্রে। যারা এই অভ্যস্ত আর রুটিন মাফিক সামাজিক জীবনের ভেতর থেকে বের হয়ে জীবনের প্রতিটা মোড়ে মোড়ে নতুন নতুন লাইটপোস্ট আবিষ্কার করে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ অভ্যস্ত আর শান্ত জীবনের ‘কমফোর্ট জোন' থেকে বের হতে সাহস পায় না, তারা সেই সাহস করে বলেই জীবন যে একটা অন্যের যাপিত জীবনের খোসা নয়, বরং পরিপক্ক ফল, তার স্বাদ পায়।
অবন্তী, ভাবছি, এখন ভেতরে না তাকিয়ে, দৃষ্টি সর্বদা পথের দিকে আর চারপাশে নিবদ্ধ রাখব। জীবনের মোড়ে মোড়ে খুঁজে বেড়াব শুধুই উজ্জ্বল লাইটপোস্ট। সফল হতে পারব কিনা, জানি না— কিন্তু, এতে যদি অন্তত মার্সেলকে ভুলে থাকতে পারি।
শূন্য
মিরপুর DOHS, ঢাকা
২৪ ফেব্রুয়ারি, '১৫
লেখক পরিচিতি
কিঙ্কর আহসান
গল্পকার।
ব্লগার।
বাংলাদেশের জামালপুরে থাকেন।
0 মন্তব্যসমূহ