সোহিনী সেন
‘ফেয়ারলনে মধুবালা’ শামিম আহমেদের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। প্রথম সংকলনের মতোই এটিও উনিশটি ভিন্ন স্বাদের গল্পে সাজানো এক পরিপাটি মোনতাজ। পুরাণ, বিজ্ঞান, আধুনিক মনোস্তত্ব, মন্দ্রমুখর কিম্বা দ্রুত ধাবমান যাপনের নানা স্তর – সব মিলেমিশে য্যানো এক বিরাট বাকোৎসুক লকালয়ের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। কোলকাতার ১৩/এ সদর স্ট্রিটের প্রাচীন ইঁটওয়ালা আধুনিকতার উত্তাপে জড়ানো ফেয়ারলন এখানে স্বপ্নে দ্যাখা লাস্যময়ী মধুবালাকে বাস্তবের কাদামাটিতে নামিয়েছে।
প্রাচীন-প্রাগাধুনিক-আধুনিক-স্বপ্ন-বাস্তব-অধিবাস্তবের এক সাদাকালো রঙিন কোলাজ ‘ফেয়ারলনে মধুবালা’ । বইয়ের ভূমিকা খসড়া অনুসরণ করে তাই বলতে হয় – “লেখকের নির্মম সত্যকথন হৃদয়কে পেরিয়ে যায়। চারপাশে ছায়ার মতো জেগে থাকে গল্পকথার বুনোট।”
দ্রুততা, ব্যস্ততা আর ভোগবাদী জগতের উন্মূল বাসনায় আচ্ছন্ন আমরা কখনো কখনো ভুলে যাই আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বটুকুকেও। আবরণ অ আভরণ জড়াই কাল্পনিক ছদ্মবেশের। সেই ছদ্মবেশখানাই কখন যে শরীরের সাথে এক হয়ে গিয়ে আমাদের চামড়ায়ে পরিণত হয় – তা ঘূণাক্ষরেও টের পেতে দ্যায় না চলমান সময়ের ষড়যন্ত্র। চোখের ডাক্তারখানায় ভিন্ন ধরণের কাঁচ লাগানোয় চোখ য্যামোন হরফের স্পষ্টতা বা অস্পষ্টতার তল খুঁজে পায় না, বিপন্ন স্বাতন্ত্র্যের মোড়কবন্দি আমরাও সেরকম হাতড়ে বেরাই ছেনা-অচেনা সম্পর্কগুলিকে। সম্পর্কদের খুঁজে পেলে নিজেকে, কখনো বা নিজেকে খুঁজে পেয়ে সম্পর্ককে হারাই। ভেতরে রয়ে যায় ‘Who am I?-’র মতো প্রচণ্ড বিভীষিকাময় এক প্রশ্নের আলোড়ন। মৃত্যু ও যৌনতা এবং মধুবালা গল্প দুটি খানিক সেই কথাই বলে। একমুঠো রোদ্দুর, সন্ন্যাসী, টলটলে দিঘি, সনেট, আজাদ চৌধুরী, রবার্ট অ্যাশবি, রশিদ সুহরাবর্দী, মাহমুদা বানু প্রমুখ চরিত্রেরা আসল ও নকল অস্তিত্বের আন্তর্জালে অস্তিত্বহীনভাবে পাক খেতে থাকে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় জ্যঁ বদ্রিলার কথা। ‘The Mirror of Production’, ‘The System of Object’, ‘The Consumer Society’, ‘Cool Memories’ প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টিগুলিতে তিনি বলতে চেয়েছেন যে আজকের বিশ্ব আসলে এক কুহক বিশ্ব। এই বিশ্বে আসল বলে কিছু নেই। সবটাই নকল। এক্তা সময় আসবে যখন আসল-নকলের মধ্যে পার্থক্য করার বোধটাও আর থাকবে না। নকলের মধ্যে থাকতে থাকতে অদ্ভুত ছায়াভ্রমে মনে হবে নকলই বুঝি আসল। বাস্তব বুঝি অবাস্তব। আর সেই বাস্তব-অবাস্তব-অধিবাস্তবের অদ্ভুত মিশেলে তৈরি শামিমের একুশে আইন , ফেয়ারলনে বিশাখা গল্পগুলি। পৌরাণিক ঘটনা অ চরিত্রেরা এখানে ভিড় করে আছে। প্রকৃত অ অপ্রকৃত ফুটে উঠেছে রহস্যময় সন্মিলনে। আপাত অসঙ্গত বহু প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে তিনি এই গল্পগুলিতে এক এমন কথনবিশ্ব তৈরি করেছেন যা বাস্তব ও অবাস্তব, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সীমারেখা থেকে উঠে আসে। একবার যাকে অভিজ্ঞতা জগতে জায়গা দিতে ইচ্ছে করে, পরমুহুর্তেই কল্পনার জগতে।
রইসুদ্দির রাত্রিবাস-এর রইসুদ্দি বিবাহবিচ্ছিন্ন একা থাকা এক পুরুষ। আত্মবিশ্লেষণে বলা ভালো দাম্পত্য সম্পর্ক বিশ্লেষণে তার মনে হয় – সে খালেকাকে প্রাণ দিয়ে বা শরীর দিয়ে প্রচণ্ড ভালবেসেছিল। এমনও নয়। তাই খালেকার চলে যাওয়াতে রইসুদ্দির এমন কিছু এসে যায়নি। কিন্তু তার সচেতন, অচেতন ও অবচেতন জুড়ে বসবাস করে তার প্রাক্তন স্ত্রী’ই। ভালোবাসার মানুষটা চলে গেলেও আদ্র বিস্ময়ের জগৎ জুড়ে ভালোবাসাটুকু রয়ে যায়, এবং তা রয়ে যায় কিভাবে য্যানো রইসুদ্দির অজ্ঞাতেই! শামিমের তৈরি এই চরিত্রটিকে দেখে ক্যানো জানি মনে পড়ে যায় –
“I love you except because I love you;
I go from loving to not loving you,
From waiting to not waiting for you
My heart moves from cold to fire
I love you because it’s only the one I love…”
তবে কি একনিষ্ঠ হয়ে সত্যি এভাবে ভালোবাসা যায় হারিয়ে ফেলা মানুষটাকে? প্রশ্নচিন্হ
আবার এই গল্পটির বিপরীতে বিবাহবার্ষিকী এমন এক স্ত্রীর কথা যে নিজে বহু পুরুষে আচ্ছন্ন হয়েও পরকীয়ায় জড়িত ভেবে স্বামীকে সন্দেহ করতে ছাড়ে না। স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তির কল্পনা তাকে ভীত, সন্ত্রস্ত করে তোলে। আর এই ভয়, এই সন্ত্রাসই তাকে আলগোছ বৈবাহিক সম্পর্কখানাকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে। আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে সেই মানুষটাকে যার প্রতি আজ আর কোনো অনুভূতি আর তার নেই, কিন্তু একদিন ভালোবেসে যার কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিলো সে। তবে কি এই আঁকড়ে ধরা ভালোবাসাকে হারানোর সত্যি করে ভয়জনিত? নাকি স্রেফ একটা নিশ্চিত খুঁটিতে নিজেকে বেঁধে রেখে গয়ংগচ্ছ ব্যাভিচারের স্রোতে ভেসে যাওয়ার পথটুকু খোলা রাখা? প্রশ্ন তোলে কলম, প্রশ্ন তোলে মন, প্রশ্ন তোলে সমাজ। ঠিক য্যামোন প্রশ্ন তুলেছে হত্যাকারী গল্পের আনারুলের বোধি যে, রীরংসা, জিঘাংসায়ে ভরা এই নোংরা পৃথিবীতে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জায়গা সঠিক কোথায়?
মেরুদণ্ড শোনায় পণ্যে পরিণত হওয়া সমাজের মেরুদণ্ডহীনতার কথা। রুমির মোবাইল ফোন, ইন্তেকালের রাজনীতি, সিদরাতুল মুনতাহা অথবা ধানগাছের গল্প প্রভৃতি গল্পগুলিতে ধরা পড়ে মানুষের মন ও সমাজের লোভী, পৈশাচিক, অর্থলিপ্সু দিকগুলি। কোথাও পণপ্রথার সামাজিক সংক্রমণ, কোথাও পরিস্থিতির চাপে ভোগবাদী চাহিদাপূরণের কাছে বিবেকবর্জিত আত্মসমর্পণ আবার কোথাও বা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যথেচ্ছ শোষণ। সমাজের বোধি য্যানো এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় সিদরাতুল মুনতাহার(ইসলামিক পুরাণ অনুযায়ী এটি একটি উল্লেখযোগ্য সিদরা/আনার/বেদানা গাছ) মতো দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে এই অবনমন।
ধর্মীয় অনুশাসন যে বেশিরভাগ সময় সুস্থ স্বাভাবিক যাপনের পথে বাঁধা হয় দাঁড়ায় তার প্রমাণ পাই দর্শন-এ। গল্পের ডাক্তার চরিত্র জামাল হোসেনের মুখ দিয়ে শামিম বার করিয়েছেন জীবনোপলব্ধির এক অমোঘ সত্য – “পর্দা দিয়ে সবকিছু ঢেকে রাখতে নেই। পর্দার অন্য প্রান্তকে জানার ইচ্ছে সকলের থাকে।” জীবনের এই স্বচ্ছন্দ গতিকে ব্যাহত করার অধিকার যে ধর্মের নেই সেই বার্তাটুকুই পৌঁছে দ্যায় গল্পটি।
মেঘমল্লার দৈন্যতাপুষ্ট সেই সমাজের কাহিনি যেখানে পিতারা কেবল পুত্রসন্তানলাভের আশাতেই সহবাস করে। সমাজ লিঙ্গের পার্থক্যবিচারে ব্যপ্ত থাকে, কিন্তু প্রকৃতি তার দু’হাত ভরে আপন করে নেয় নিজের সৃষ্টিকে। প্রকৃতির উদারতা য্যানো চ্যালেঞ্জ জানায় সমাজের সংকীর্ণতাকে।
আরো গল্প আছে বইটিতে। বিশ্লেষণের ক্ষুদ্র পরিসরে সবটুকু তুলে ধরা সম্ভব না। তবে বলতে পারি, গল্পসংকলন হিসেবে সংখ্যায় দ্বিতীয় এই সৃষ্টিটি শামিমের প্রথম সংকলন(বিলকিস বেগমের পতনজনিত আখ্যান ও অন্যান্য গল্প) তুলনায় পরিণত ও পোক্ত প্রয়াস। উপস্থাপনারীতি ও নান্দনিকতার বৈচিত্র্যে প্রতিটি গল্পই সোচ্চারে নতুনত্বের দাবিদার। এবং প্রায় প্রতিটিই প্রতীত সময়ের অনন্ত কক্ষপথে ঘুরতে থাকা আমাদের মন ও মানসিকতার নানা স্তরকে কোনো না কোনোরকমভাবে প্রস্ন করতে উদ্যোত। ১৩/এ সদর স্ট্রিটের ফেয়ারলন এবং মাগরিবের আজানে মিশে যাওয়া আমাদের সান্ধ্য একাকীত্বও কি ঠিক এইভাবে প্রশ্ন করতো না আমাদের?
[ইংরেজি কবিতার পঙক্তি সৌজন্যে Pablo Neruda’র
I Do Not Love You Except Because I Love You]
‘ফেয়ারলনে মধুবালা’ শামিম আহমেদের দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। প্রথম সংকলনের মতোই এটিও উনিশটি ভিন্ন স্বাদের গল্পে সাজানো এক পরিপাটি মোনতাজ। পুরাণ, বিজ্ঞান, আধুনিক মনোস্তত্ব, মন্দ্রমুখর কিম্বা দ্রুত ধাবমান যাপনের নানা স্তর – সব মিলেমিশে য্যানো এক বিরাট বাকোৎসুক লকালয়ের সৃষ্টি হয়েছে এখানে। কোলকাতার ১৩/এ সদর স্ট্রিটের প্রাচীন ইঁটওয়ালা আধুনিকতার উত্তাপে জড়ানো ফেয়ারলন এখানে স্বপ্নে দ্যাখা লাস্যময়ী মধুবালাকে বাস্তবের কাদামাটিতে নামিয়েছে।
প্রাচীন-প্রাগাধুনিক-আধুনিক-স্বপ্ন-বাস্তব-অধিবাস্তবের এক সাদাকালো রঙিন কোলাজ ‘ফেয়ারলনে মধুবালা’ । বইয়ের ভূমিকা খসড়া অনুসরণ করে তাই বলতে হয় – “লেখকের নির্মম সত্যকথন হৃদয়কে পেরিয়ে যায়। চারপাশে ছায়ার মতো জেগে থাকে গল্পকথার বুনোট।”
দ্রুততা, ব্যস্ততা আর ভোগবাদী জগতের উন্মূল বাসনায় আচ্ছন্ন আমরা কখনো কখনো ভুলে যাই আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্বটুকুকেও। আবরণ অ আভরণ জড়াই কাল্পনিক ছদ্মবেশের। সেই ছদ্মবেশখানাই কখন যে শরীরের সাথে এক হয়ে গিয়ে আমাদের চামড়ায়ে পরিণত হয় – তা ঘূণাক্ষরেও টের পেতে দ্যায় না চলমান সময়ের ষড়যন্ত্র। চোখের ডাক্তারখানায় ভিন্ন ধরণের কাঁচ লাগানোয় চোখ য্যামোন হরফের স্পষ্টতা বা অস্পষ্টতার তল খুঁজে পায় না, বিপন্ন স্বাতন্ত্র্যের মোড়কবন্দি আমরাও সেরকম হাতড়ে বেরাই ছেনা-অচেনা সম্পর্কগুলিকে। সম্পর্কদের খুঁজে পেলে নিজেকে, কখনো বা নিজেকে খুঁজে পেয়ে সম্পর্ককে হারাই। ভেতরে রয়ে যায় ‘Who am I?-’র মতো প্রচণ্ড বিভীষিকাময় এক প্রশ্নের আলোড়ন। মৃত্যু ও যৌনতা এবং মধুবালা গল্প দুটি খানিক সেই কথাই বলে। একমুঠো রোদ্দুর, সন্ন্যাসী, টলটলে দিঘি, সনেট, আজাদ চৌধুরী, রবার্ট অ্যাশবি, রশিদ সুহরাবর্দী, মাহমুদা বানু প্রমুখ চরিত্রেরা আসল ও নকল অস্তিত্বের আন্তর্জালে অস্তিত্বহীনভাবে পাক খেতে থাকে। প্রসঙ্গত মনে পড়ে যায় জ্যঁ বদ্রিলার কথা। ‘The Mirror of Production’, ‘The System of Object’, ‘The Consumer Society’, ‘Cool Memories’ প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টিগুলিতে তিনি বলতে চেয়েছেন যে আজকের বিশ্ব আসলে এক কুহক বিশ্ব। এই বিশ্বে আসল বলে কিছু নেই। সবটাই নকল। এক্তা সময় আসবে যখন আসল-নকলের মধ্যে পার্থক্য করার বোধটাও আর থাকবে না। নকলের মধ্যে থাকতে থাকতে অদ্ভুত ছায়াভ্রমে মনে হবে নকলই বুঝি আসল। বাস্তব বুঝি অবাস্তব। আর সেই বাস্তব-অবাস্তব-অধিবাস্তবের অদ্ভুত মিশেলে তৈরি শামিমের একুশে আইন , ফেয়ারলনে বিশাখা গল্পগুলি। পৌরাণিক ঘটনা অ চরিত্রেরা এখানে ভিড় করে আছে। প্রকৃত অ অপ্রকৃত ফুটে উঠেছে রহস্যময় সন্মিলনে। আপাত অসঙ্গত বহু প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে তিনি এই গল্পগুলিতে এক এমন কথনবিশ্ব তৈরি করেছেন যা বাস্তব ও অবাস্তব, অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সীমারেখা থেকে উঠে আসে। একবার যাকে অভিজ্ঞতা জগতে জায়গা দিতে ইচ্ছে করে, পরমুহুর্তেই কল্পনার জগতে।
রইসুদ্দির রাত্রিবাস-এর রইসুদ্দি বিবাহবিচ্ছিন্ন একা থাকা এক পুরুষ। আত্মবিশ্লেষণে বলা ভালো দাম্পত্য সম্পর্ক বিশ্লেষণে তার মনে হয় – সে খালেকাকে প্রাণ দিয়ে বা শরীর দিয়ে প্রচণ্ড ভালবেসেছিল। এমনও নয়। তাই খালেকার চলে যাওয়াতে রইসুদ্দির এমন কিছু এসে যায়নি। কিন্তু তার সচেতন, অচেতন ও অবচেতন জুড়ে বসবাস করে তার প্রাক্তন স্ত্রী’ই। ভালোবাসার মানুষটা চলে গেলেও আদ্র বিস্ময়ের জগৎ জুড়ে ভালোবাসাটুকু রয়ে যায়, এবং তা রয়ে যায় কিভাবে য্যানো রইসুদ্দির অজ্ঞাতেই! শামিমের তৈরি এই চরিত্রটিকে দেখে ক্যানো জানি মনে পড়ে যায় –
“I love you except because I love you;
I go from loving to not loving you,
From waiting to not waiting for you
My heart moves from cold to fire
I love you because it’s only the one I love…”
তবে কি একনিষ্ঠ হয়ে সত্যি এভাবে ভালোবাসা যায় হারিয়ে ফেলা মানুষটাকে? প্রশ্নচিন্হ
আবার এই গল্পটির বিপরীতে বিবাহবার্ষিকী এমন এক স্ত্রীর কথা যে নিজে বহু পুরুষে আচ্ছন্ন হয়েও পরকীয়ায় জড়িত ভেবে স্বামীকে সন্দেহ করতে ছাড়ে না। স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তির কল্পনা তাকে ভীত, সন্ত্রস্ত করে তোলে। আর এই ভয়, এই সন্ত্রাসই তাকে আলগোছ বৈবাহিক সম্পর্কখানাকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে। আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করে সেই মানুষটাকে যার প্রতি আজ আর কোনো অনুভূতি আর তার নেই, কিন্তু একদিন ভালোবেসে যার কাছে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছিলো সে। তবে কি এই আঁকড়ে ধরা ভালোবাসাকে হারানোর সত্যি করে ভয়জনিত? নাকি স্রেফ একটা নিশ্চিত খুঁটিতে নিজেকে বেঁধে রেখে গয়ংগচ্ছ ব্যাভিচারের স্রোতে ভেসে যাওয়ার পথটুকু খোলা রাখা? প্রশ্ন তোলে কলম, প্রশ্ন তোলে মন, প্রশ্ন তোলে সমাজ। ঠিক য্যামোন প্রশ্ন তুলেছে হত্যাকারী গল্পের আনারুলের বোধি যে, রীরংসা, জিঘাংসায়ে ভরা এই নোংরা পৃথিবীতে মানুষ ও মনুষ্যত্বের জায়গা সঠিক কোথায়?
মেরুদণ্ড শোনায় পণ্যে পরিণত হওয়া সমাজের মেরুদণ্ডহীনতার কথা। রুমির মোবাইল ফোন, ইন্তেকালের রাজনীতি, সিদরাতুল মুনতাহা অথবা ধানগাছের গল্প প্রভৃতি গল্পগুলিতে ধরা পড়ে মানুষের মন ও সমাজের লোভী, পৈশাচিক, অর্থলিপ্সু দিকগুলি। কোথাও পণপ্রথার সামাজিক সংক্রমণ, কোথাও পরিস্থিতির চাপে ভোগবাদী চাহিদাপূরণের কাছে বিবেকবর্জিত আত্মসমর্পণ আবার কোথাও বা পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যথেচ্ছ শোষণ। সমাজের বোধি য্যানো এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় সিদরাতুল মুনতাহার(ইসলামিক পুরাণ অনুযায়ী এটি একটি উল্লেখযোগ্য সিদরা/আনার/বেদানা গাছ) মতো দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে এই অবনমন।
ধর্মীয় অনুশাসন যে বেশিরভাগ সময় সুস্থ স্বাভাবিক যাপনের পথে বাঁধা হয় দাঁড়ায় তার প্রমাণ পাই দর্শন-এ। গল্পের ডাক্তার চরিত্র জামাল হোসেনের মুখ দিয়ে শামিম বার করিয়েছেন জীবনোপলব্ধির এক অমোঘ সত্য – “পর্দা দিয়ে সবকিছু ঢেকে রাখতে নেই। পর্দার অন্য প্রান্তকে জানার ইচ্ছে সকলের থাকে।” জীবনের এই স্বচ্ছন্দ গতিকে ব্যাহত করার অধিকার যে ধর্মের নেই সেই বার্তাটুকুই পৌঁছে দ্যায় গল্পটি।
মেঘমল্লার দৈন্যতাপুষ্ট সেই সমাজের কাহিনি যেখানে পিতারা কেবল পুত্রসন্তানলাভের আশাতেই সহবাস করে। সমাজ লিঙ্গের পার্থক্যবিচারে ব্যপ্ত থাকে, কিন্তু প্রকৃতি তার দু’হাত ভরে আপন করে নেয় নিজের সৃষ্টিকে। প্রকৃতির উদারতা য্যানো চ্যালেঞ্জ জানায় সমাজের সংকীর্ণতাকে।
আরো গল্প আছে বইটিতে। বিশ্লেষণের ক্ষুদ্র পরিসরে সবটুকু তুলে ধরা সম্ভব না। তবে বলতে পারি, গল্পসংকলন হিসেবে সংখ্যায় দ্বিতীয় এই সৃষ্টিটি শামিমের প্রথম সংকলন(বিলকিস বেগমের পতনজনিত আখ্যান ও অন্যান্য গল্প) তুলনায় পরিণত ও পোক্ত প্রয়াস। উপস্থাপনারীতি ও নান্দনিকতার বৈচিত্র্যে প্রতিটি গল্পই সোচ্চারে নতুনত্বের দাবিদার। এবং প্রায় প্রতিটিই প্রতীত সময়ের অনন্ত কক্ষপথে ঘুরতে থাকা আমাদের মন ও মানসিকতার নানা স্তরকে কোনো না কোনোরকমভাবে প্রস্ন করতে উদ্যোত। ১৩/এ সদর স্ট্রিটের ফেয়ারলন এবং মাগরিবের আজানে মিশে যাওয়া আমাদের সান্ধ্য একাকীত্বও কি ঠিক এইভাবে প্রশ্ন করতো না আমাদের?
[ইংরেজি কবিতার পঙক্তি সৌজন্যে Pablo Neruda’র
I Do Not Love You Except Because I Love You]
লেখক পরিচিতি
সোহিনী সেন
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী। সম্প্রতি প্রেসিডেন্সি
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেছেন। মূলত কবিতা লেখেন। তাঁর আগ্রহের
বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সেমিটিক পুরাণ ও সুফি দর্শন। থাকেন কলকাতায়। গদ্য
সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ও সমালোচক।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করেছেন। মূলত কবিতা লেখেন। তাঁর আগ্রহের
বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সেমিটিক পুরাণ ও সুফি দর্শন। থাকেন কলকাতায়। গদ্য
সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক ও সমালোচক।
0 মন্তব্যসমূহ