তেলের শিশি ভাংলো বলে খুকুর পরে রাগ করো,
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙ্গে ভাগ করো
--- তার বেলা?
যদি বলি অন্নদাশংকরের এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে শামিম আহমেদ ‘সাত আসমান’লিখেছেন? আমরা ধাঁধায় আটকে যাই। সহজ ধাঁধা নয়। জটিল ধাঁধা। সম্ভবত এ রকম আরও একটি জটিল ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গিয়ে শাহাদুজ্জামান ‘ক্রাচের কর্নেল’উপন্যাসটি লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। সত্যিকারের একজন লেখক লিখতে বাধ্য হন এবং ধাঁধার উত্তর খুঁজে না পাওয়া অবধি তার মুক্তি নেই; তিনি লিখতে থাকেন। শাহাদুজ্জান কি মুক্তি পেয়েছেন? শামিম আহমেদ কি মুক্তি পেয়েছেন তার বিবেক এবং সময়ের দায়ভার থেকে? আসলে জীবন থেকে দায়মুক্তি সম্ভব নয়। আর সেই জীবন যদি হয় যৌথের জীবন।
ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লবের পর সমাজ-বাস্তবতার অনিবার্য প্রকাশকৌশল থেকে পশ্চিম-ইউরোপে উপন্যাসের সূচনা হলেও আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে উপন্যাসের বিকাশ সূচিত হয়েছে ঔপনিবেশিক শাসন শোষণ আর শ্রেণিচেতনার দায়ভার থেকে। সমাজ, ইতিহাস ও উপন্যাসের দায়ভার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে র্যালফ ফক্স দেখিয়েছেন, শিল্প বিশেষ করে উপন্যাস অবশ্যই জনগণের কাছে ঋণি। আমি এর সাথে যুক্ত করতে চাই, সেইসাথে উপন্যাস জনগণের কাছে দায়বদ্ধও বটে। তা না হলে শামিম আহমেদ ‘সাত আসমান’লিখতে পারতেন না। এই কারণেই তিনি তাঁর উপন্যাসে মানব জীবনের সামাজিক সত্য এবং ইতিহাসের সত্যকে নির্বাচন করতে পেরেছেন।
শাহাদুজ্জামান ‘ক্রাচের কর্নেল’এর পরিশিষ্টে লিখেছেন, ‘সাধারণভাবে দু’ধরনের ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস লক্ষ করি। এক ধরনের উপন্যাসে কালটি ঐতিহাসিক কিন্তু চরিত্রগুলো কাল্পনিক আর দ্বিতীয় ধরনে কাল এবং চরিত্র দুটোই বাস্তব। আমার উপন্যাসটি দ্বিতীয় ধারার।’আমিও দ্বিতীয় ধারার বলতে ইচ্ছুক। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন শাহাদুজ্জামানের পাশাপাশি আমি শামিম আহমেদের ‘সাত আসমান’পাঠ করলাম তখন। এটি কোন ধারার? না, শামিম আহমেদের জন্য শাহাদুজ্জামান কোন ধারা অবশিষ্ট রাখেন নি। আমি বাধ্য হয়েই ‘সাত আসমান’এর জন্য তৃতীয় আরেকটি ধারার চিন্তা করেছি। যে ধারায় শুধু ইতিহাস নয় বরং যা এখনও ঠিক ইতিহাস হয়ে ওঠেনি সেই প্রাত্যহিক ঘটনাসমূহ, যার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে বৃহত্তর জনজীবনের যাপিত-সংকট ও সত্য আশ্রিত প্রাত্যহিক দ্বন্দ্ব; যার আখ্যান তৈরি হয় কাল্পনিক নয় এমন সরাসরি চরিত্রের পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজ-চরিত্র উন্মোচনের স্বার্থে; ফলে চরিত্র হয়ে উঠতে পারে বাস্তব চরিত্রের পাশাপাশি কাল্পনিক; তবে আমাদের মনে রাখতে হবে শামিম আহমেদের ‘সময়’কিন্তু কাল্পনিক সময় নয়। বাস্তব সময়ের স্বরূপকে টেনে বাইরে এনে প্রকৃত চেহারাটিকে আমাদের সামনে মেলে ধরবার জন্য শামিমের জন্য অপরিহার্য হয়ে দেখা দিয়েছে জাদুশক্তি। অর্থাৎ সময়, চরিত্র আর ইতিহাসের সাথে ম্যাজিক যোগ করে যে ধারাটি অনুসরণ করলেন শামিম আহমেদ সেই ধারাটিকে আমি তৃতীয় ধারা বলছি। এই তৃতীয় ধারাটির নামকরণ করা যেতে পারে, ‘ম্যাজিক-হিস্ট্রি’। এই ম্যাজিকের কথা শাহাদুজ্জামানও যে বোঝেন না তা নয়; অবশ্যই বোঝেন; যার জন্য তিনি তার সারে তিন শ পাতার উপন্যাসটি শুরু করেছেন এভাবে, ‘এক কর্নেলের গল্প শোনা যাক। যুদ্ধাহত, ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটা এক কর্নেল। কিংবা এ গল্প হয়তো শুধু ঐ কর্নেলের নয়। জাদুর হাওয়া লাগা আরও অনেক মানুষের। নাগরদোলায় চেপে বসা এক জনপদের। ঘোর লাগা এক সময়ের।’
শাহাদুজ্জামানের এই ঘোর লাগা সময় দেশভাগ-উত্তর সময়। আর ‘সাত আসমান’এর ঘোর কিন্ত দেশভাগের আগের ঘোর। যে ঘোরলাগা সময়কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শামিম আহমেদ জিন পরি ভূত পেত্নী এমন কি প্রাত্যহিক স্বপ্ন-সংকট ও সিম্বল তৈরি করেছেন উপন্যাসের ভেতর। ‘সাত আসমান’শুরুই হচ্ছে এভাবে,
রুনার মা যখন জন্মায়, তার আগের রাতে নানা একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের বয়ান বিভিন্ন সময়ে নানা পরিবর্তন করে থাকেন। কখনও বলেন সে রাতে এক দরবেশ, সর্বাঙ্গ কালো আলখাল্লায় জড়ানো, তার মাঝে ধলো দুধ-দাড়ি নিয়ে নানাকে বলছেন, আজ তোর বংশের বাতি জ্বালানোর দিন। আবার নানা এমন কথাও বলেন যে, দরবেশ নন; তিনি স্ত্রী না পুরুষ, তার গলা শুনে বোঝা যায় না। পরনের পোশাকও ভারি অদ্ভুত, মনে হয় আরবের মরুভূমি থেকে তিনি এসে পৌঁছেছেন বাংলার এই অখ্যাত গ্রামে; তিনি নানাকে লিঙ্গহীন গলায় বলছেন, আজকে তোর ঘরে জন্মাবে সেই ছেলে যে শেখদের মাথা আরও উঁচুতে তুলে ধরবে।
পক্ষান্তরে আমরা বুঝতে পারি এই স্বপ্ন একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির স্বপ্ন নয়। এটি আসলে গোষ্ঠীস্বপ্ন। যে গোষ্ঠীস্বপ্নকে বাস্তবে রূপ না দিতে পারলে এই গোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু যিনি স্বপ্ন দেখাচ্ছেন তিনি তো লিঙ্গহীন। তখন প্রশ্ন জাগে, পৌরুষহীন স্বপ্ন কি আদৌ কোনদিন বাস্তবে রূপ নেবে? উপন্যাসের অবস্রোতে যে স্বপ্ন, যে পৃথক ভূমির স্বপ্ন তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হতে পারে নি। লেখক আগে ভাগেই সেই ইশারা দিচ্ছেন এমন এক কৌশলে যা আসলে ইতিহাসের অনিবার্য ইশারা। কেননা সময়ের ইতিহাস নির্মাতা তো শেষাবধি সমাজ নিয়ন্ত্রণকারী অর্থনৈতিক ও পেশীনৈতিক শক্তি। পক্ষান্তরে পেশীশক্তিকে ইতিহাসের আশ্রয়ে নৈতিকতায় জায়েজ করে নেওয়া--- এই ছিল দেশবিভাজন। তাহলে, ধর্ম কি পেশীশক্তির সমান্তরাল? সভ্যতার গতিবিধি তো আমাদের এমন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই টেনে নিয়ে এনেছে এতদূর।
লেখক যখন এভাবে ভাবছেন তখন কি ইতিহাস বিভ্রান্ত? নাকি লেখক পক্ষান্তরে ইতিহাসের পেছনের কূটকৌশল আর ষড়যন্ত্রকে ইতিহাসের সমান্তরালে অগ্রসর হবার সুযোগ করে দিচ্ছেন। সুযোগ করে দিয়েছেন, বিধায় ‘সাত আসমান’ ইতিহাস নয় উপন্যাস; তবে এটি নিছক গালগপ্পে ঠাসা আখ্যাননির্ভর উপন্যাস নয়; এটি সত্যিকারের প্রাত্যহিকতা নির্ভর ইতিহাস। যাকে অ্যাকাডেমিক ভাবে ইতিহাস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া সম্ভব নয়। তারপরও দেশভাগের পর ১৯৬১ সালের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জর্জ মেকলে ট্রেভেলিয়ন বক্তৃতামালায় অধ্যাপক ই এইচ কার তার বক্তৃতায় ইতিহাস বিষয়ে যে অনিবার্য প্রশ্নসমূহ উত্থাপন করেছিলেন তার কয়েকটি যদি বিবেচনায় রাখি, তা হলে ‘সাত আসমান’ কেন ইতিহাস অপেক্ষা অধিক গুরুত্বের দাবিদার তা বোঝা সহজ হবে। প্রফেসর ই এইচ কার প্রশ্ন তুলেছিলেন,
বাস্তবে যা যা ঘটে তার সবই কি ইতিহাসের তথ্য?
ইতিহাসের ঘটনাবলির ভেতর কি কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক থাকে?
ঐতিহাসিক কি শুধুই অতীতমুখী?
ব্যক্তি ও সমাজ কি আলাদা দুটো সত্তা?
ইতিহাসকে কি বিজ্ঞান বলা যায়?
নৈতিকতার সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক কোথায়?
‘সাত আসমান’ পাঠে এমন ভাবনা-সংকট অনিবার্য হয়ে দেখা দেয়, যখন আমরা দেখতে পাই ‘সাত আসমান’পক্ষান্তরে দেশভাগের যৌক্তিকতা আর আম জনতার সেন্টিম্যান্ট কে বায়োস্কপের ধাতব চোঙের মধ্য দিয়ে যাচাই বাছাই করে দেখাতে শুরু করেছে। যাচাই বাছাই তো বটেই, কেননা শামিম আহমেদ দেশভাগের প্রেক্ষাপটে নির্বাচিত চরিত্র ও ঘটনা পরম্পরা গ্রন্থিত করতে গিয়ে এক ধরনের শ্বাসহীনতার ভেতর হাপিত্তেশ করেছেন। উপন্যাস ফাদতে যে পরিমাণ মালমশলা প্রয়োজন, তা যথেষ্ট থাকলেও তিনি প্রাত্যহিকতার ভেতর গ্রহণযোগ্য উপাদান নির্বাচনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে গিয়ে উপন্যাসকে পক্ষান্তরে সংকটের মুখে এগিয়ে দিয়েছেন। ফলে তাকে মাত্র এক শ পাতা লিখতে হয়েছে। অথচ প্রেক্ষাপট, বিষয়-সংকট ও বিতর্কের বিস্তার শতাব্দিব্যাপি। যদি বলি এটাই লেখকের অভিষ্ট। হতে পারে। তবে আমি বলবো তিনি শুধুমাত্র মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বেছে নেয়ার ফলে বাধ্য হয়েছেন ঘটনা-নির্বাচনের সীমানাকে এক ধরনের চোঙের ভেতরে পুরে রাখতে। যার জন্য উপন্যাসটি নিজেই নিজের ভেতর থেকে শ্বাস নিতে গিয়ে চমকে উঠেছে। বলা সম্ভব, তিনি এমনটিই চেয়েছিলেন? এক শ পাতার ভেতর, একটি মাত্র পরিবার থেকে একটি মাত্র চরিত্রকে বেছে নিয়ে, যে চরিত্রটির নাম জর্মান মিঞা, এবং এই নামটিই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ইউরোপ প্রীতি; যদিও মুসলমানরা তখন পরজাতি প্রীতি থেকে পিছিয়ে ছিল প্রায় এক শতাব্দি; এই একটি মাত্র চরিত্র, যে চরিত্রটি কিনা মানসিকভাবে বিভ্রম-আতঙ্কে আক্রান্ত; যে বিভ্রম জর্মান মিঞা নিজেই নিজের উপলব্ধিতে উপভোগে অভ্যস্ত। অর্থাৎ সময়টিই ছিল বিভ্রমের এবং একই সাথে উপভোগের। কেমন সেই উপভোগ? স্বপ্ন! ধর্মভিত্তিক নিজের একখানি স্বাধীন ভূমি! কেমন সেই বিভ্রম? ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের ভোগযোগ্য অভিধার অপর নাম, উপভোগ? অথবা যে ফরাসি বিপ্লব সামন্তবাদের বিকাশে সাম্রাজ্যবাদের পুঁজিকে ত্বরান্বিত করছে, সেই পুঁজির পথকে সুগম করে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে আবারও ধর্মকে ব্যবহার করে একটি পাকভূমির জন্ম দেয়া? বিভ্রমের নাম তাহলে এই পাকভূমির জন্ম-রহস্য?
এমনতর নানাবিধ সন্দেহের জবাব অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা দেখতে পেলাম, গুজরাটি ঝীনা ভাইয়ের পুত্র মহম্মদ আলী ঝীনা যিনি দ্রুতই স্যুট কোট পরিহিত ব্যারিস্টার জিন্নাহ হয়ে উঠেছেন। তিনি শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে ইসলামাবাদে লাঞ্চে মিলিত হয়েছেন। কেন এই লাঞ্চ? মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান অর্থাৎ পবিত্র ভূমির জন্ম হয়েছে। সুতরাং রোজার দিন হলেও জিন্নাহ সাহেবকে দুপুরের জৌলসে খানাপিনা আর সুরার দরিয়াতে উৎফুল্ল হতে হয়েছে। কেননা পৃথিবীতে মুসলমানদের জন্য একটি দেশের আবির্ভাব হয়েছে। আর সবচেয়ে মজার বিষয়, এ অবস্থায় সূচিত হল এমন এক সভ্যতার যেখানে এই ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ এর ঠিক সাতষট্টি বছর পর হুমায়ূন আজাদ অথবা বিশ্বজিৎ রায়ের মতো মুক্তচিন্তার অধিকারীদের জন্য বসবাসের মতো পূর্বপাকিস্তানে, যখন সেই পূর্ব পাকিস্তান বাধ্য হয়েছে ৩০ লক্ষ বাঙালির রক্তের বিনিময়ে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’হয়ে উঠতে, সেই স্বাধীন ভূমিতে বসবাসের জন্য তাদের মতো মানুষের কোন অধিকার থাকবে না; ভূমি থাকবে না। প্রকাশ্যে তাদের হত্যা করা হবে এবং পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র যন্ত্রটি হয়ে উঠবে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদের এমন এক চারণভূমি যেখানে একুশ শতকে এসেও মালালার মতো কিশোরীদের বিদ্যালয়ে যাবার অপরাধে গুলি করা হবে অথবা মুনতারান মাইয়ের মতো মহিলাকে জনতার সামনে রেপ করা হবে; আর সবকিছুই চলতে থাকবে জনতার খেয়ালখুশি মতো মৌখিক আদেশে। যে আদেশসমূহ জন্ম নেবে ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রথা মোতাবেক। মুসলমানদের জন্য রাস্ট্র যন্ত্রটি ততদিনে ধর্মীয় খসবু ও আতর উত্তেজনায় আইএস অর্থাৎ ইসলামি স্টেট প্রতিষ্ঠার জেহাদে ক্রমশ বর্বর হয়ে উঠতে থাকলে সারা বিশ্বে শান্তির ধর্মটিকে গুটিকয়েক মুসলমান ভীতিপ্রদ ধর্ম হিসেবে নোতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবে। আর এই সুযোগে সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র আরও খানিকটা গুছিয়ে তুলবে নিজেদের? আর তখন শামিম আহমেদ এর উপন্যাস পাঠে আমরা নিজেদেরকে প্রশ্ন করবো আমরা আদৌ কি সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ থেকে নিজেদেরকে সেই ১৪ আগস্টে মুক্ত করতে পেরেছিলাম? নাকি আমরা এখনও জর্মান মিঞার সাথে স্বপ্ন দেখছি একটি নির্দিষ্ট ধর্ম নিয়ন্ত্রণকারী রাস্ট্রীয় ব্যবস্থার? নাকি আমরা এখনও জিনের নিয়েন্ত্রণে ভূতগ্রস্থ,
--- আমি জুল। জিনকা বাদশা। হুজুরে আলা, আপনার কাছে আমার একটা আর্জি আছে।আমরাও শামিমের সাথে, রিয়েলিটির সাথে ক্রমাগত ভূতগ্রস্থ হতে থাকি। উপন্যাসের ভেতর নিবিষ্ট হই। আর এই ফাঁকে লেখক আমাদের মুখ ঘুড়িয়ে দেন ইতিহাসের দিকে। ইতিহাসের সাথে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা আর যাপিত জীবনের প্রাত্যহিকতা সংযুক্ত করেন। উপস্থাপন করেন, শাহ রুস্তমের মাজার, মুসলমান ধর্মের ভেতরের নানা তরিকা ও বিভাজন বিদ্বেষ। ধর্মীয় আচার বিধি নিষেধের সাথে সাথে শামিম কৌশলে মোল্লা বদরেদ্দোজাকে দিয়ে আমাদের শোনাতে থাকেন ইসলামের ঐতিহ্যনির্ভর কিংবদন্তি, ইতিহাস-ঐতিহ্য; যার একটিও এই উপমহাদেশের নয়, কোনটি বা বাবেলের, কোনটি বা আফগানিস্তান অথবা তুর্কি, তুরস্ক, ইস্তাম্বুল অথবা আরবের।
--- আর...জি?
--- বাদ মে বলেগা। পহেলে আপনি সুনেন, আমার নাম জুল জেনাহেন। রাজা সোলেমান হামার বেটা বালজেবুলকো মার ডালা। ও লড়কা বহুত পেয়ারা থা, আউর বহুত বদমাশ ভি। উসকো এক লড়কি আছে, নাম লুসিফা। বাবেলের রাজার সাথে শাদি হুয়া থা, মগর তালাক ভি হো গয়া। বাপ-মরা অফরত, বহুত খুবসুরত। উসকো আপ শাদি করলে, এহি মেরা খোয়াইশ হ্যায়।
সেইদিন চৌদ্দ আগস্টের পরদিন এক দিনের ব্যবধানে ১৫ আগস্টে জন্ম নিচ্ছে হিন্দুদের জন্য আরেকটি দেশ হিন্দুস্থান; ভারত। নেতা, ব্যারিস্টার করমচাঁদ গান্ধী স্যুট-টাই ফেলে গায়ে তুলেছেন ধুতি, পায়ে চপ্পল। বিষণ্ন, ধুমধামের বাইরে রাতের তারার নীচে বসে তখনও ভাবছেন তিনি জনতার কাছে যে অঙ্গিকার করেছিলেন সেই স্বপ্নের কথা; অথচ যা আজ অর্থহীন, ‘ভারতকে ভাগ করবার আগে তোমরা আমাকে দু ভাগ করো।‘ অথচ ড্রাফটম্যান র্যাডক্লিফ যিনি কিনা কখনও ভারত দেখেন নি, তাকে লন্ডন থেকে নিয়ে আনা হলো। তিনি টেবিলের ওপর বিছানো ভারতের মানচিত্রের ওপর পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে, যেখানে মুসলমানের বাস বেশি সে জায়গাগুলো চিহ্নিত করলেন; আর বাহ কি চমৎকার, আমরা স্বাধীন হলাম! আর আমরা পাঠকেরা তখন ধন্ধে পড়ে যাই, বুঝতে পারি না আসলে ব্রিটিশ হটাও বা অসহযোগ অথবা স্বরাজ আন্দোলন বলে আসলেই কখনও কিছু ছিল কিনা; নাকি সব কিছুই ইতিহাসের সাজানো নাটক? ঔপন্যাসিক শামিম আহমেদ এর উপন্যাস পাঠে আমরা তখন ইতিহাস থেকে পাঠ গ্রহণের পরিবর্তে আরও খানিকটা সতর্ক হই; ইতিহাসকে ভয় পাই আর রাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাস আরও খানিকটা দানা বেঁধে ওঠে। সুতরাং জর্মান হোসেন নিজের এলাকা বীরভূম ছেড়ে মুর্শিদাবাদ গিয়ে বসবাস করবেন এটাই স্বাভাবিক; তৈরি হয় বসতবাড়ি, জোত জমি; দানা বাঁধে স্বপ্ন; নিকটেই পূর্বপাকিস্তান।
এ অবস্থায় মানুষ সম্পর্কে মানুষের ভেতরে জন্ম নিলো ঘৃণা ও ভয়। মানুষ আর শুধুমাত্র নিষ্ঠুর, উচ্ছ্বল, কামুক অথবা সংগ্রামী অথবা শুধুমাত্র রক্তমাংসের মানুষ রইলো না। বরং সে হয়ে উঠলো পাপী; আর তখন তারা সেই পাপ স্খলনের উত্তেজনায় আরও একবার অন্ধত্বকে বরণ করে নিলো। এই হলো সাত আসমানের চরিত্রের ভেতর-রহস্য; যে রহস্য থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার মতো কোনো ক্ষমতা চরিত্রসমূহ ধারণ করে না; কেননা দেশভাগের আগে অথবা পরে ভারতীয় উপমহাদেশের বাঙালি সমাজ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের দায়ভার বহন করার মতো যোগ্যতা অথবা চেতনা বিষয়ক কোনো অভিধা তখনও অর্জন করতে পারেনি; যদিও তখনও বৃটিশ হটাও প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেই প্রস্তুতি কতটা স্পষ্ট ও দ্বিধাহীন। বরং আমরা দেখতে পাই তা দ্বিধান্বিত ও গোপনীয়। সুতরাং, ‘নানির সই হাসেন। বলেন, শোনো, তুমি মাজেরা খাতুনের নাম জানো তো! উনি একটা বাহিনী গড়েছেন, আমি সেই দলে যোগ দিয়েছি। আমাকে এখন এই পোশাকে দেখছো বলে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। অন্য সময় আমার পরনে থাকে মোটা পায়জামা, পায়ে শক্ত জুতো, জামার উপর মোটা কোট আর মাথায় চুল ঢাকবার জন্য পাগড়ি। দেখে কেউই বুঝবে না আমরা ছেলে না মেয়ে। আমাদের বাহিনীর আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। যদি তোমার ভাসুর কিছু টাকা পয়সা আমাদের যোগার করে দিতে পারেন, খুব ভাল হয়।’
এভাবে দ্বিধান্বিত ও গোপনীয় মুভম্যান্টের সাথে বাঙালি মুসলমান নারীরাও যুক্ত হয়েছিল কিনা; এ প্রশ্নটিও আমাদের কাছে এখন জরুরি। তাই যদি হয় তাহলে আমাদের নিকট লেখক আরও একটি ইশারা দিচ্ছেন, তা হল, জর্মান মিঞার পারিবারিক কালচারই তৎকালিন বাঙালি মুসলমান সমাজের একমাত্র চিত্র নয়। এমনতর ইশারা যখন জেগে উঠতে থাকে, তখন পাঠকের কাছে চারপাশটা কেমন অপরিচিত হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু তারপরও এই অপরিচিত প্রতিবেশকে বুঝতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হয় টাকার ক্রমবর্ধিষ্ণু শক্তির কথা; যে শক্তি মানুষের সাথে মানুষের ভেতরের সম্পর্ককে বিষিয়ে তোলে; নারীর কাছ থেকে পুরুষকে দূরে সরিয়ে দেয়; সমাজে সৃষ্টি করে বিত্তশালী ও বিত্তহীন কালচার। উপন্যাসের সংকটের ভেতর এমনতর বিষয়াদির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে র্যালফ ফক্স খুব স্পষ্ট করেই বললেন, ‘জানতে হবে কৃষক সম্প্রদায়ের করুণ দখলচ্যুতি এবং আরও জানতে হবে পল্লীগ্রাম বা বাজার কেন্দ্রগুলোকে সরিয়ে যে শহর গড়ে উঠছিল সেই শহরের জীবনযাত্রার ক্লেদ ও অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার কথা।’উপন্যাসের প্রেক্ষাপটে এই দুর্দশার চিত্র উন্মোচনের যৌক্তিকতা শামিম আহমেদকে খুঁজে বের করতে হয়েছে। ফলে তাকে বুঝতে হয়েছে, শুধুমাত্র মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতে শিখলেই যথেষ্ট নয়, উপন্যাস লিখতে হলে সেই সাথে দরকার এমন এক যোগ্যতার, যে যোগ্যতা দিয়ে সেই মানুষকে ইতিহাসের সত্যমিথ্যার মাপকাঠিতে যাচাই করে দেখা সম্ভব। সুতরাং,
এ দিকে চালের দাম ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। গত তিন চার মাসে মোটা চাল মণপিছু পাঁচ টাকা থেকে বেড়ে এখন প্রায় পনেরো টাকায় গিয়ে পৌঁছেছে। লোকজন এক সের চালের জন্য কোলের বাচ্চাও বিক্রি করে দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। এরই মধ্যে একদিন অদ্ভুত খবর এল। কাটোয়া-আহমদপুর ছোট লাইনের একটি ট্রেনে ব্যবসায়ীরা চাল-ডাল নিয়ে যাচ্ছিল। পথে কূর্মডাঙা স্টেশনে এক দল লোক তা লুঠ করতে যায়। লুঠ করার আগে নাকি তারা ব্যবসায়ীদের হাতেপায়ে ধরে ভিক্ষা চেয়েছিল। ব্যবসায়ীরা তখন পুলিশ ডাকে। যে তিন-চার জন অস্ত্রধারী পুলিশ ট্রেনে যাচ্ছিল তারাই হাজার খানেক লোককে ডান্ডা পেটা করে তাড়ায়। কারও মাথা ফাটে, কারও বা হাত পা, ওই অবস্থাতেও লোকগুলো চাল-ডাল হাতছাড়া করেনি। নিষ্ঠুর ভাবে মেরেও নাকি তাদের হাত থেকে লুঠের মাল কাড়া যায়নি। এমন কথাও শোনা যাচ্ছে যে কয়েক জন লোক পুলিশের মার খেয়ে মারাও গেছে। মৃতদের হাত লোহার সাঁড়াসির মতো লেগে ছিল বস্তায়।
আমাদের বুঝতে হবে এই উপন্যাসটি ট্রেনে অথবা বাসে বসে সময় কাটানোর জন্য লেখা কোনো আখ্যান-গদ্য নয়। এটি অগ্রসরমান পাঠকের জন্য অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্দেশক জাতিবাচক সমাজকথন। যদিও এটি জর্মান হোসেন নামের একজন ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিগত ধ্যানধারণা আচার ও বিশ্বাসকে আশ্রয় করে উপস্থাপিত হয়েছে। অথচ ব্যক্তির মধ্য দিয়ে যখন আমরা একটি গোষ্ঠীস্বপ্নকে অবলোকন করতে পারি তখন এই উপন্যাসটির গঠনশৈলী এবং প্রায়োগিক ফলাফল নিয়ে আমাদের ভাবতেই হয়। এই উপন্যাসটি একদিকে যেমন কিছুটা সিরিয়াস তেমনি কিছুটা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে হলে আমাদেরকে সাংস্কৃতিক-সামাজিক ইতিহাস-জ্ঞান নিয়েই অগ্রসর হতে হয়। তা না হলে এটি নিছক মুসলিম কালচার আশ্রিত খণ্ডিত জীবনের ধারাভাষ্য হিসেবে মূল্যায়িত হতে বাধ্য। কেননা একজন জর্মান হোসেনের জীবন কিন্তু সার্বিক অর্থে বাঙালি জীবনকে উপস্থাপন করে না। আমরা বুঝতে পারছি লেখকের তেমন ইচ্ছেও ছিল না; তিনি মূলত মুসলিম কালচারকেই উপস্থাপন করতে ইচ্ছুক। কিন্তু প্রেক্ষাপট যেহেতু দেশভাগ সেহেতু আমরা ব্যক্তি জর্মান হোসেনকে এখানে অতিক্রম করে দেখতে চাই দেশভাগের অন্তরালের রহস্য। প্রকৃত প্রস্তাবে সেই দিনগুলোতে ঠিক কী কী ঘটেছিল আর কী কারণে কীভাবে স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছিল; প্রকৃত স্বপ্নই বা আসলে কী ছিলো। এ অবস্থায় কার, কোথায়, কীভাবে, কতটুকু স্বার্থ লুকিয়ে ছিল; উপন্যাস পাঠে আমাদেরকে এ ধরনের বিষয়াদির উত্তর জেনে বুঝে অগ্রসর হতে হয়।
বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক পর্যায়ের বিবেচনায় বঙ্কিমচন্দ্র সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছেও শেষ পর্যন্ত চরিত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেননা তিনি তখন পর্যন্ত ঠিক সমাজের চরিত্র আঁকবার মতো যুতসই কোনো ভাষা তৈরি করে নিতে পারেন নাই। আর আমাদের শামিম আহমদ চরিত্রের নিকট আত্মসমর্পণের পরিবর্তে চরিত্রসমূহ উপেক্ষা করে সমাজ-বর্ণনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এটা তার চরিত্র অঙ্কনের ব্যর্থতা নয়; বরং ‘সাত আসমান’এর বৈশিষ্ট্যই এমন। কেননা শামিম আহমদ জানেন দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তার সৃজিত চরিত্রসমূহ নিজেদের সমস্যাবলী সমাধানের বাইরে অবস্থান করতে বাধ্য। ফলে লেখক তার চরিত্রসমূহের সামনে যে ভঙ্গিতে দাঁড়ান তা আত্মসমর্পণের ভঙ্গি ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং জর্মান মিঞার মতো আশেপাশের আর সবাই নপুংশক তো বটেই সেই সাথে নপুংশক স্বপ্নে বিভোর। এই স্বপ্নচালিত চরিত্রসূহের মাঝে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে সতর্কতার সাথে ভাবতে হচ্ছে, লেখক কি দেশভাগের প্রাক্কালে মানুষের যথার্থ অবস্থানে মানুষকে দেখতে সক্ষম?
লেখকের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ জাগা যৌক্তিক। কেননা আমরা দেখি লেখক এক ধরনের অক্ষমতা নিয়েই উপনিবেশ শাসিত সমাজের মানুষকে নিছক জীব হিসেবে দেখতে বাধ্য হয়েছিলেন। এটা লেখকের অযোগ্যতা নয়; বরং দেশভাগের প্রেক্ষাপটে প্রকৃত বাস্তবতায় এটাই স্বাভাবিক বাস্তবতা। তিনি একাধিক বার পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন, ‘অতএব গাড়িতে এখন ছ’জন প্রাণী--- আনোয়ার মিঞা, জর্মান মিঞা, তেতুঁলি, ফেরেশতা ও দুটি কালো মোষ।’অর্থাৎ অশরীরী জীব এমনকি গরু জাতীয় জীবের সমান্তরালে মানব চরিত্রকে উপস্থাপন করতে বাধ্য হয়েছেন লেখক। এর ফলে ব্যক্তিমানুষের চরিত্র গণমানুষের চরিত্রে উন্নীত হবার সুযোগ পায় নি। ঘটনা ও চরিত্র আটকে থেকেছে নির্দিষ্টতায়। তবে দেশভাগের প্রাক্কালে এমন একটি খণ্ডিত অবস্থা মেনে নেয়া ছাড়া আর কিই বা করার আছে? এমন একটা হতাশা নিয়ে লেখক যখন তার উপন্যাসকে এগিয়ে নিতে যত্নবান হন তখন আমরা সতর্কতার সাথে আবিষ্কার করি ‘সাত আসমান’নিজে এ রকম সীমাবদ্ধতা থেকে নিজেকে টেনে তোলার মতো খুব একটা ভূমিকা রাখে না; উপন্যাসটি নির্মোহ। যদিও উপন্যাস উপস্থাপনায় লেখকের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় লক্ষ্যণীয়। লেখক অধিকাংশ জায়গায় নিজেই মন্তব্য করতে আগ্রহী; যেমন,
গত বছর ধানের ফলন তেমন হয়নি। বর্মার অবস্থা খুব খারাপ। সারা দুনিয়ায় যুদ্ধ, সেখানেও ঝামেলা লেগেই আছে। তাই বর্মা থেকেও চাল আসছে না। গ্রামের কয়েকটা লোকের বাড়িতে মণ-মণ চাল মজুদ করা আছে। রাতের দিকে মোষের গাড়িতে করে সে সব চাল চালান যায় শহরে। দু’গুণ বা তিনগুণ দামে সেই সব চাল বিক্রি করছে মালিকরা। এই মাল নাকি যাবে মাদ্রাজ, সিংহল, ত্রিবাঙ্কুর! ইংরেজ সরকার এখন এ সব ব্যাপারে গা করছে না। কংগ্রেস, মুসলিম লিগের নেতারাও সব চুপচাপ। তাঁরা দেশের আজাদি আনতে ব্যস্ত। চালের চেয়ে সে সব ঢের জরুরি কাজ। আনোয়ার মিঞা, জর্মান মিঞার মেজ ভাই এই সব সাত-পাঁচ ভাবছেন আর নিজেকে এই বলে আশ্বস্ত করছেন যে আজাদি মিললে চালের দাম কেন, রোজকার দিনের সব জিনিসপত্রের মূল্য একেবারে কমে যাবে। বিনা পয়সাও মিলতে পারে। সেই সরকার চালাবে দেশের মানুষ।
এভাবে উপন্যাসের ভেতর লেখকের নিজের উপস্থিতি ও বর্ণনা কৌশল উপন্যাসটিকে শ্লথ বা স্থবির করে দেয়নি। বরং এর ফলে পাঠকের অবচেতনে এক ধরনের তোরজোড় শুরু হয়ে যায়। পাঠকের ভেতর প্রস্তুত হতে থাকে উপন্যাস পাঠের প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিক আয়োজন। অনেক লেখকই বেশ শক্তি নিয়ে এভাবে উপন্যাসকে এগিয়ে নিয়েছেন। দেবেশ রায় তো রীতিমতো নিজে উপন্যাসের ভেতরে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসহ নিজে উপস্থিত থেকেছেন; যেন বা প্রবন্ধ লিখছেন। এতে কিন্তু আমরা আখ্যান নির্ভরতা থেকে কিছুটা মুক্তি পাই। আর এর ফলাফলে যা ঘটে তা হলো, ‘সবই বানানো গপ্প’এমন একটা অনুভবের ভেতর পাঠক আর আটকে না থেকে অবচেতনে সিরিয়াস হয়ে উঠতে শুরু করেন। এবং এতে উপন্যাসের ওপর পাঠকের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পাঠক বিশ্বাস করতে শুরু করেন, লেখক খেয়ালখুশি মতো গালগপ্প ফাদছেন না বরং লেখক জেনে বুঝে সঠিক তথ্যসহ ব্যখ্যা বিশ্লেষণ সংগ্রহ করে রীতিমত সত্য বিষয়াদির ওপর ভিত্তি করে সত্য কথা বলছেন। তখন অবশ্যই পাঠকের ভেতরে পাঠ গ্রহণ-উত্তর এমন এক উপলব্ধির জন্ম হয়, যে উপলব্ধির উন্মোচন ঘটানোই ছিল লেখকের উদ্দেশ্য। প্রশ্ন হলো, শামিম আহমেদ কি নিজে ক্লিয়ার? তিনি পাঠককে ঠিক কোন কোন বিষয়াদি নিয়ে ভাবাতে বাধ্য করাবেন?
আমরা সতর্কতার সাথে উপন্যাস পাঠে বুঝতে পারি, শামিম আহমেদের কাছে স্পষ্ট, তিনি পাঠককে ঠিক কোন বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করাতে ইচ্ছুক। এবং সেই ভাবনা-জগতের ইশারা পাঠক ‘সাত আসমান’পাঠে পেয়ে থাকেন বলে আমার বিশ্বাস নয় বরং উপন্যাসের কৃৎকৌশল তা নিশ্চিত করতে কিছুটা হলেও পেরেছে। অবশ্য এটা নির্ভর করে পাঠকের প্রস্তুতির ওপরও অনেকটা।
অনুষঙ্গ নয় বরং উপন্যাসের অপরিহার্য বিষায়াদি হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে পির-ফকির, মাজার বিশ্বাস ও মুসলমানদের বিবিধ তরিকা যা পক্ষান্তরে চলমান সমাজ ভাবনার সাথে প্রাসঙ্গিক। ঔপনিবেশিক আইন ও শাসন প্রক্রিয়া, স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন, ধর্মভিত্তিক সম্পদ ও নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা উপন্যাসে মূখ্য হয়ে ওঠে। ধর্মভিত্তিক সম্পদ ও নিরাপত্তা এই জন্য যে, জনগণের রয়েছে দাঙ্গার অভিজ্ঞতা। সুতরাং মোঘলদের দেয়া কালচার আর সনাতন কালচার মিলেমিশে এক হয়ে গেলেও যে অংশটি মোটা দাগে ক্রমশ পৃথক হতে থাকে তারা মুসলমান। কেননা তারা শিক্ষা ও অর্থনীতিতে পিছিয়ে; কিন্তু এগিয়ে আছে কুবিশ্বাস তকদির আর ঐতিহ্য-অহমিকার ক্ষেত্রে। অবশ্য তাদের ঐতিহ্য-অহমিকা কিন্তু তাদের নিজেদের ঐতিহ্য নয়; বরং তা চাপিয়ে দেয়া যবন তুর্কি আর মোঘলদের ঐতিহ্য। এবং বাঙালি মুসলমান এমন এক ঐতিহ্য বহন করে চলেছে, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানদের থেকে পৃথক। ‘সাত আসমান’এ উপস্থাপিত বাঙালি মুসলমান সমাজে ও পরিবারে আমরা পাচ্ছি পিরপ্রথা ধর্মীয় বিশ্বাস আর ব্যক্তি জীবনের কিছু আশা ও প্রাত্যহিক জৈবিকতা। লেখক যদিও জৈবিকতার ক্ষেত্রে যৌনতা নির্ভর বিষয়াদি সুকৌশলে এড়িয়ে চলেন; এটাও লেখকের সৃজনশীল ক্ষমতার প্রকাশ।
উপন্যাসের প্রকাশযোগ্য ঘরানা নির্মাণের লক্ষ্যে লেখক প্রাত্যহিক রাজনীতি ও দেশকালের সাথে যুক্ত করতে থাকেন ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে বিস্তারিত লোককথা ও লোকবিশ্বাস; যা পক্ষান্তরে মুসলমান সমাজের সেন্টিম্যান্ট প্রকাশের ভূমিকা পালন করে। যেমন সোহরাব-রুস্তম, সত্যপীরের গান, মালেকুল মউত আজরাইল, যার ডানায় রয়েছে ৬০০ পালক; হারুত-মারুতের মিথ, বনি-ইসরাইল সম্প্রদায়ের কাহিনী; এক্ষেত্রে তিনি প্রয়োজনে প্রাসঙ্গিক হাদিসের আশ্রয় নিয়েছেন। তবে আমাদের বুঝতে হবে এগুলোর একটি বিষয়ও কিন্তু উপন্যাসে অপ্রাসঙ্গিক নয়; বরং উপন্যাসের ম্যাসেজ যাতে পাঠক যথাযথ ভাবে গ্রহণ করতে পারেন তার জন্য এমনতর বয়নকৌশল। যেমন, ‘বনি-ইসরাইলরা তখন বাবেলে দাস ও বন্দীর জীবন যাপন করছিল। সেই সময় আল্লাহতালা তাদের পরীক্ষার জন্য দুই ফেরেস্তাকে পাঠিয়েছিলেন। লুত আলাইহেসাল্লাম, যিনি হজরত ইব্রাহিমের ভাতিজা, তাঁর জাতির কাছে যে রকম ফেরেশতারা খুবসুরত বালেগের রূপ ধরে গিয়েছিলেন, তেমনি ইসরাইলিদের কাছেও খোদার ফেরেশতারা পির ও ফকিরের বেশ ধরে গেলেন। সেখানে তেনারা জাদুর বাজারে নিজেদের আসর বসালেন, আর জাদু দেখাতে লাগলেন।’
এভাবে শামিম মুসলিম মিথ থেকে ইচ্ছেমত বেছে নিলেন উপন্যাসের মশলা। খুলে দিলেন উপন্যাস উপস্থাপনের আরও এক দিগন্ত; অথচ তার উপন্যাসের বিষয় কিন্তু ইতিহাস। কী সেই মহার্ঘ্য পাঠ, যা ইতিহাসের কাছ থেকে আমাদের উপলব্ধিতে আহরণ করা অনিবার্য? এই যে মহার্ঘ্য পাঠসূত্র; এই পাঠ-তরজমা শামিম আহমেদ যে পদ্ধতিতে বয়ান করেছেন; এই বয়ানকৌশল নিয়ে আমাদেরকে, একালের উপন্যাস রচয়িতাদেরকে ভাবতে হচ্ছে; এবং এতে অল্পবিস্তর শেখারও সুযোগ রয়ে যায়। শামিম বয়ান করলেন এক এক করে সাতটি আসমানের মোজেজা; শামিম তার প্রতিটি অধ্যায়ের শিরোনাম নির্বাচন করলেন আখ্যান তাৎপর্যের সাথে মিল রেখে; চলমান জীবনচেতনার তাৎপর্য প্রকাশজ্ঞাপক এমন কিছু ইসলাম ধর্মভিত্তিক শব্দ বন্ধনী যেগুলো নিয়ে আমরা আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নোতুন করে ভাবতে বাধ্য। যেমন,
১ম অধ্যায়ের শিরোনাম, আল মোকাম আল আমিন; যার অর্থ নিরাপদ স্থান। অর্থাৎ একটি জনগোষ্ঠী বা জাতি দীর্ঘ সময় ধরে নিরাপদ ভূগোলের আশায় অনুসন্ধানরত ও যুদ্ধরত। এই নিরাপত্তা পক্ষান্তরে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য রক্ষার নিরাপত্তা; সম্পদ রক্ষার নিরাপত্তা; অর্থাৎ সামন্ত প্রথার স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে এমন একটি আবাসভূমি।
২য় অধ্যায়ের শিরোনাম, দার উল মকাম; যার অর্থ গৃহ। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এই গৃহনির্মাণ হলো প্রথম পদক্ষেপ। জর্মান মিঞার বিশ্বাস মুর্শিদাবাদ পবিত্র ভূমির মধ্যে অবশ্যই থাকবে অর্থাৎ পাকিস্তানের ভেতর থাকবে; সুতরাং সালার গিয়ে তিনি গৃহ নির্মাণ করলেন। এর পেছনে রয়েছে ১ম অধ্যায়ের স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রায়োগিক পদক্ষেপসমূহ।
এভাবে প্রতিটি অধ্যায়কে পরিকল্পিতভাবে শামিম আহমেদ রচনা করেছেন। তিনি মূলত কাহিনী নির্ভরতা থেকে মুক্তি চেয়েছেন; বরং যৎসামান্য কাহিনীর ওপর ভর করে দু একটি চরিত্রকে নিয়ে কৌশলে মুসলিম মিথের আশ্রয়ে পক্ষান্তরে দেশভাগপূর্ব বাঙালি মুসলমান জাতির আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ চিহ্নিত করায় যত্নশীল থেকেছেন। সুতরাং তিনি হাজির করেছেন রাণী বিলকিস আর রাজা সোলেমানের কথপোকথন; ধাঁধা। পাশাপাশি শামিম প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছেন হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় জনজীবনের ভেতর, যাতে আমরা সংশয় প্রকাশ না করি; এবং যাতে দ্বিধান্বিত না হই যে, লেখক আসলে কোন জনগোষ্ঠীর ছবি আঁকছেন? ভারতীয় বাঙালি মুসলমানের জীবন, নাকি ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট লেখকের মনগড়া কোনো জনজীবনের ছবি? এমনতর বিভ্রান্তের ভেতর যাতে পাঠক তার চিন্তার সূত্রগুলোকে গুলিয়ে না ফেলেন, এ জন্য তিনি জর্মান মিঞাকে কেন্দ্র করে ঘোড়া ব্যবহারকারী, জোতজমির অধিকারী, গ্রামীণ অভিজাত বাঙালি মুসলিম কালচারের গ্রহণযোগ্যতার প্রতি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। এর ভেতর থেকেই তিনি উন্মোচন করতে ইচ্ছুক এই ধর্মভিত্তিক জাতিটির অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যত-আশ্রিত অনিশ্চিত যাপিত-স্বপ্নকে। প্রকৃত প্রস্তাবে, শামিম আহমেদ আমাদের চিরায়ত বিশ্বাসকে এক অর্থে ব্ল্যাকমেইল করে, ভারতীয় বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে একটি খণ্ডিত জনজীবনের অস্থির বাসনা-আশ্রিত চেতনা-প্রবাহ উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন ‘সাত আসমান’উপন্যাসে।
আমরা সতর্কতার সাথে লক্ষ করি, লেখক শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে এগিয়ে যান। এভাবে অগ্রসর হবার যৌক্তিকতা কোথায়? লেখকের সীমাবদ্ধতা? সীমাবদ্ধতার বিষয়টি যদি আলোচনায় না এনে পজেটিভ দিক খুঁজে প্রকাশ করতে চাই তাহলে বলতে হবে, তিনি তার পাঠকদের সরাসরি কিছু তথ্যের মুখোমুখি করাতে চান; যাতে পাঠকের ভেতর প্রয়োজনীয় ভাবনার প্রেক্ষাপট তৈরি হবার সুযোগ সৃষ্টি হয়। নিজের দেশের অতীত আর বর্তমানের প্রতি একজন সফল ঔপন্যাসিকের থাকে এক বিশেষ দায়বদ্ধতা; হতে পারে তা নান্দনিক অথবা বস্তুজৈবনিক। সেইসাথে লেখকের থাকে সামাজ পর্যবেক্ষণের সততা এবং দায়িত্বশীল জ্ঞান। এই দায়িত্বশীল আচরণের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে তিনি সমাজ থেকে সরাসরি চরিত্র বেছে নেন; আর যদি সমাজে কাঙ্ক্ষিত চরিত্র না থাকে তবে লেখক নিজেই চরিত্র নির্মাণ করতে বাধ্য হন। কিন্তু আমরা যখন দেখি, সৃজিত চরিত্রটির আচরণের সাথে প্রকাশযোগ্য ভাবনাগুলো ঠিক প্রাসঙ্গিক বা উপযুক্ত নয় তখন উপন্যাসটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি যে শামিম আহমেদ হননি তা নয়; কিন্তু তিনি যখনই এ ধরনের সমস্যা বোধ করেছেন তখনই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন ঝুঁকি না নিয়ে সরাসরি সিম্বলের আশ্রয় নিয়েছেন। এ জন্য তিনি ভূত প্রেত জিন পরির চরিত্র হাজির করেছেন। সাত আসমানে তো ‘জিনের বাদশাহ’চরিত্র সৃজনের মধ্য দিয়ে পক্ষান্তরে লেখক গোষ্ঠীচেতনা ও গোষ্ঠী-ষড়যন্ত্র তথা গোষ্ঠী-নপুংশকতাকে উপস্থাপন করেছে। এমন কি উপন্যাসের শেষে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি, ঔপন্যাসিক দ্বিধান্বিত, তিনি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে রাজি নন; কেননা তিনি ঠিক জানেন না এই জনগোষ্ঠীর বা এই ভূগোলের ভবিষ্যৎটা ঠিক কেমন। সুতরাং লেখক জর্মান মিঞার পরিবারকে উঠিয়ে দিচ্ছেন এমন এক গরুর গাড়িতে, যে গাড়িটি অন্ধকারেও এগিয়ে চলেছে; অর্থাৎ আমরা দেশবিভাজনের মধ্য দিয়ে পক্ষান্তরে অন্ধকারের দিকেই এগিয়ে চলেছি। এমন একটি প্রশ্নের অবতারণা উপন্যাসের সীমানাকে প্রসারিত করে বহুগুণ। এরপর, পথ সহসা শেষ হয় না। জর্মান মিঞার মনে পড়ে, দুর্ভিক্ষে মৃত মহিলার লাশের কথা, যে লাশ সৎকার করা হয়নি। এই যে ধর্মীয় আচরণ ভিত্তিক অপরাধবোধ, ফলে জাতীয় জীবনে জন্ম নেয় অপরাধবোধ। এই অপরাধ সম্পদ কুক্ষিগত করার অপরাধ শুধু নয়, বরং দায়িত্বশীল আচরণ পালনের জন্য দরকার যে যোগ্যতার, সেই যোগ্যতার অভাবজনিত অপরাধবোধ। সুতরাং ধীর গতির ভেতর যেন বা থেমে আছে দেশ-কাল-পাত্র; যার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। অর্থাৎ ধীর ও অন্ধকারে আচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ। আর চূড়ান্ত বাস্তবতায় আমরা উপন্যাসের শেষে গিয়ে দেখতে পাই, গরুর গাড়িটির বাস্তবে কোনো চালক ছিল না; কখনও ছিল না লাগাম ধরার মতো কেউ। অর্থাৎ প্রকৃত নেতৃত্বের অভাব। একজন জিনকে চলকের আসনে বসিয়ে অর্থাৎ আমরা অলৌকিক তকদিরের ওপর ছেড়ে দিয়েছি আমাদের জীবন। এটি শেষ অধ্যায়; শিরোনাম ‘জান্নাত-উল-ফিরদাউস’--- অর্থাৎ এই অবস্থাটি আমাদের জন্য ‘জান্নাত-উল-ফিরদাউস’। সর্বোচ্চ স্থান। আয়রনি? নাকি পক্ষান্তরে স্বপ্নক্লান্ত জর্মান মিঞা শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন নিজের জন্মভূমি বীরভূমে; এই জন্মভূমিই তার জন্য ‘জান্নাত-উল-ফিরদাউস’? পাঠক একবার ভাবুন, স্বপ্নভঙ্গুর এই জনগোষ্ঠীর শেষ পর্যন্ত কী হতে পারে। কী হতে পারে, তারও ইশারা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে উপন্যাসের শেষে। চালক শেষ পর্যন্ত পারিবারিক গোরস্থানের রাস্তার ওপর গাড়িটি থামিয়ে দেয়, ‘সুমাই গাড়োয়ানের বলা নাম আর শেষ হতে চায় না। অগুনতি সব কবর। শেষ নামটি শুনে জর্মান মিঞা প্রচণ্ড ঘাবড়ে যান। অন্য সময় হলে তিনি অজ্ঞান হয়ে যেতেন। কিন্তু এই গাড়িতে তার বউ-বাচ্চারা আছে। তাদের বাড়িতে পৌঁছে দেবে কে? সুমাই গাড়োয়ান নিজের কবরটা দেখানোর পর কোথায় যেনো মিলিয়ে যায়।’
এ এক মৃতের লোকালয়। এই দ্বিধাবিভক্ত দেশ এখন মৃতদের জন্য। এখানে মৃতকে কবর দেবার মতো কোনো স্থান নেই; চারিধার শুধুই অন্ধকার আর জীবিত অথবা মৃত সকলেই কবরবাসী। আমরা সবাই যেন জর্মান মিঞার পরিবারের মতো বসে আছি স্থির; ধীর গতির এক গরুর গাড়ির অন্ধকার চাতালের নীচে। এ অবস্থায় শামিম আহমেদ মধ্যবিত্তের দুর্বলতা ভালোভাবেই বুঝতে সক্ষম হলেও মধ্যবিত্তের অসাড়তাকে আক্রমণ না করে বরং দ্বিধান্বিত থেকেছেন। ফলে লেখক দেখতে অনিচ্ছুক রাষ্ট্র ও সমাজের নৈতিক অধঃপতনের সুদূরবিস্তারি প্রতিক্রিয়াকে। লেখক এড়িয়ে গিয়েছেন ধনতান্ত্রিক সমাজের দীনতাকে। এর কারণও আছে। যে সমাজকে লেখক সমর্থন করতে পারছেন না, তার ভেতরে প্রবেশ করে তাকে শিল্পসম্মত অভিব্যক্তিতে উপস্থাপন করা আদৌ সম্ভব কিনা এটিও বিবেচনা করবার মতো একটি প্রশ্ন। এমনতর অনুসন্ধান থেকে উদ্ঘাটন করা সম্ভব শামিম আহমেদের উপন্যাস লেখার কৃৎকৌশল। যাই হোক, এই হলো শামিমের উপন্যাসে উপস্থাপিত মুসলমান জাতির জন্য নির্ধারিত ধর্ম ও রাষ্ট্র। এ রকম এক ধর্মের গহ্বরে বসে বিভ্রান্ত মস্তিষ্কের জর্মান মিঞা তার লড়াই থামায় না, ‘জর্মান মিঞা মোষ হাঁকানোর লাঠিটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে গাড়ি হাঁকাতে থাকেন। নিজস্ব মকামে পৌঁছানোর জন্য এই শেষ পথটুকু তাঁকে যে করেই হোক অতিক্রম করতে হবে।’উপন্যাসের শেষ বাক্যে আমরা আরও এক ভয়ানক উপলব্ধিতে উপনীত হই; আমরা দেখতে পাই তখনও মুসলমান নারী এই লড়াইয়ের কিছুই বুঝতে পারে না। উপন্যাসের শেষ বাক্য, ‘অথচ ভিতরে বসে থাকা পর্দানশিন কামরুন্নেছা কিছুই টের পান না।’জানিয়ে রাখা প্রাসঙ্গিক, এই কামরুন্নেছা হলেন লেখকের নানি; যাকে লেখক তাঁর উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন। আসলেই কি তাই? নাকি পাজেল? উপন্যাস উপস্থাপনের কৌশল? ম্যাজিক? এভাবে সন্দেহ সমেত ভাবতে থাকলে উপন্যাসটি আরও খানিকটা বাস্তব অনুসারি অর্থ-তাৎপর্য পেয়ে যায়। সামন্ত শ্রেণির মুসলমান নারী তখনও ঘুমিয়ে; আর উপন্যাসের প্রথম ‘অধ্যায় আল মকাম আল আমিন’যার অর্থ নিরাপদ স্থান; অথচ এই নিরাপদ স্থানের জন্য কামরুন্নেছারা ঘুমিয়ে থাকলেও মাজেরা খাতুনের মতো নিম্নবিত্ত শ্রেণির মুসলমান নারীরা বাহিনী গঠন করতে বাধ্য হচ্ছেন। যদিও লেখকের অভিজ্ঞার প্রশ্রয়ে মাজেরা খাতুনদের এই ‘বাহিনী-চরিত্র’উপন্যাসে মোটেও দানা বেঁধে ওঠার সুযোগ পায়নি। শুধুমাত্র তথ্য উপস্থাপনের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকে।
শামিম আহমেদের চরিত্র অথবা ঘটনাসমূহ ঠিক দানা বাঁধে না। বরং প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন শেষে দ্রুত বিদায় নেয়। শুধুমাত্র কাহিনী বুঝে ওঠার জন্য দরকারি বিষয়াদি সরবরাহ করার স্বার্থেই যেন ঘটনা ও চরিত্র উপস্থাপন করা হয়েছে। সুতরাং চরিত্রগুলো সংলাপ ঠিক নয় ক্রমাগত বর্ণনামূলক কথাবার্তা উপস্থাপন করতে অভ্যস্থ; যার অধিকাংশই সরাসরি ডায়লেক্ট বা মুখের কথা নয়। আমরা যেমন নাটকে পাত্র পাত্রীর কথাবার্তা শুনে আখ্যানভাগ মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করি; এখানেও অনেকটা তাই। ফলে কাহিনীর সাথে অজস্র প্রাসঙ্গিক উপকাহিনী যোগ হবার প্রয়োজন হয়নি; বরং এমন কিছু প্রথা ও বিশ্বাস এবং কিংবদন্তি যোগ হতে থাকে যেগুলো আখ্যানের গ্রহণযোগ্যতাকে সহনীয় করতে সাহায্য করে। এটাও অবশ্য উপন্যাস বয়ানের কৌশল।
‘সাত আসমান’পাঠে আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের কি নোতুন করে আবেগ তাড়িত হবার সুযোগ আছে? যদি থাকে, প্রশ্ন হলো কেনো? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের দেশভাগের কাছে ফিরে যেতে হয়। ‘সাত আসমান’এর সাথে এই পিছে ফিরে যাওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কেননা লেখক চিন্তার সুযোগ সৃষ্টি করেছেন মাত্র; তিনি শেষ করেন নাই। এটাও উপন্যাস উপস্থাপনের জন্য একটি পজেটিভ কৌশল। যতটা না দেশভাগের সংকট দেখিয়েছেন তার চেয়েও বেশি সময়-সংকটের প্রেক্ষাপট উপস্থাপনে তিনি সিদ্ধান্তহীনতার সংকটে আটকে থেকেছেন। ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি যে তিনি কোন বিষয়ে কতটুকু গুরুত্ব প্রয়োগ করতে চান; বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ, নাকি ব্যক্তির স্বার্থ? বাঙালির স্বার্থ, নাকি স্বাধীন ভারতের স্বার্থ? ঔপনিবেশিক স্বার্থ, নাকি জনগণের স্বার্থ? আর সত্যিকার অর্থে স্বার্থ বলতে আমরা কী বুঝবো? এমনতর বোধ ও প্রশ্ন ‘সাত আসমান’এর অন্তরালের সহায়ক অনুঘটক। শামিম পারতেন আরও কিছুটা মগজের অনুভব ছড়িয়ে দিয়ে; সে অবকাশ তিনি তার আখ্যানকৌশলে রেখেছেন। যেমন তিনি শান্তির কবুতর ওড়াতে গিয়ে কবুতর প্রজাতির নানা আধুনিক বিন্যাস উপস্থাপন করেছেন। যদিও এভাবে বিষয়ান্তরে অনুপ্রবেশ উপন্যাস রচনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ; কিন্ত সে ঝুঁকি অতিক্রম করার জন্য শামিম সতর্কও বটে।
প্রকৃত প্রস্তাবে প্রাত্যহিক জীবনের আংশিক অনুভব ও সংকট যাই বলি না কেন শেষ পর্যন্ত শামিম আহমেদের উপন্যাস ‘সাত আসমান’আখ্যানহীনতার নির্বাচিত বয়ান। এই উপন্যাসটি তৈরির কলাকৌশলে রয়েছে এক ধরনের সীমাবদ্ধতা যা অতিক্রম করতে গিয়ে পক্ষান্তরে লেখক নিজের মতো করে যুতসই আরেকটি ঘরানা নির্মাণ করেছেন। যেখানে চরিত্র অথবা কাহিনী-বয়ান মোটেও মূখ্য বিষয় নয়; অথবা ইতিহাসকে মূখ্য বিষয় করে তুলতে গিয়ে তিনি ইসলামি জীবনভিত্তিক একটি কালচারের আংশিক ও খণ্ডিত বিশ্বাসকে মূখ্য করে, চিরায়ত করে তুলতে চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত বৈশ্বিক সভ্যতার সমান্তরালে লেখক যাত্রা করেছেন। এখানেই এই উপন্যাসের স্পেশালিটি। এ অর্থে তিনি উপন্যাস বয়ানের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে ঠাণ্ডা মেজাজে চমক সৃষ্টি করেছেন। লেখকের লেখক হিসেবে অনুভবসংকটের ভেতর রয়েছে আরও কিছু স্পেশালিটি। যেমন তিনি ইতিহাস ও জনগণের মাঝে দাঁড়িয়ে কতটুকু নিরপেক্ষ থাকতে পেরেছেন? কেনো তার ম্যাজিক তৈরির প্রবণতা এতটা সক্রিয়? তিনি কেনোই বা পারিবারিক কাহিনীর পথ ধরে অগ্রসর হলেও পক্ষান্তরে পরিবারকে এড়িয়ে চলতে চেয়েছেন? কোনো তাঁর আখ্যানসংকট; এটা কি ইচ্ছাকৃত? নাকি এটাকে এ উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত? তিনি চরিত্র নির্মাণসংকটের ভেতর আটকে থাকা সত্ত্বেও চরিত্রসমূহ স্বাধীন করে দিলেন না কেনো? ভাষাগত সমস্যার কারণে, নাকি ইতিহাসকে অনুসরণ করতে গিয়ে খণ্ডিত মতামত উপস্থাপনের স্বার্থে? আমরা দেখতে পাই এ হেন নানাবিধ দ্বিধা ও জিজ্ঞাসাকে সাথে নিয়ে তিনি মুসলিম ধর্ম, লোকাচার ও ইমানি-বিশ্বাস এবং মুসলিম মিথকে উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন; যার ভেতর রয়েছে লিবিডো ভাবনাকে এড়িয়ে চলার এক ধরনের গোপন প্রবণতা; যদিও জর্মান মিঞা সঙ্গীত ও পুকুরপাড়ে কাপড় কাচতে থাকা নারীর জন্য নেশাগ্রস্থ; কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত নপুংশকতায় পর্যবসিত হয়; এই সবকিছুই কিন্তু সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সামাজিক অবস্থান নির্দেশজ্ঞাপক ইঙ্গিত।
সীমিত পরিসরে অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, দুর্ভিক্ষের বিরামহীনতা, ভূমি বদলের কূটকৌশল, সম্পদ আহরণের ইমানি লড়াই ও পরকাল-সংকট, মৃত্যু ও দাঙ্গার অনিবার্যতা, বিভ্রান্তকর অতীত মর্যাদা ও বংশীয় অহমিকার হাস্যকর দাম্ভিকতা, ঘৃণা ও শোষণ, আভিজাত্য অথচ ভূমি হারাবার ভয় ও লোভ--- এভাবে উপন্যাসের বিষয়সমূহের আরও আরও দীর্ঘ ফিরিস্তি দেয়া সম্ভব; কিন্ত মজার বিষয়টি হলো এগুলো সবই কিন্তু উপন্যাসের দেহ নির্মাণের মালমশলা মাত্র নয় পক্ষান্তরে এই প্রতিটি বিষয়ই পৃথক পৃথক তাৎপর্য এবং ইশারা-ইঙ্গিত উপস্থাপনে সক্ষম; যা সফল উপন্যাসের আচরণ প্রকাশের জন্য সহায়ক। আর আমাদের এও বুঝতে হবে, সফল উপন্যাস শুধুমাত্র তার সময় ও প্রেক্ষাপটের ভেতর আটকে থাকে না; বরং তা সমকালের সাথেও অর্থবহ যোগসূত্র সৃষ্টির যোগ্যতা রাখে। এই যোগসূত্রের দায়বদ্ধতা থেকে বলছি, আমি হতবাক হই না মোটেও যখন এই ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমার কবি বন্ধু মতামত প্রকাশ করলো, যেহেতেু আমাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক, সুতরাং আমি দুই রাষ্ট্র নায়কদের কাছে অনুরোধ করছি প্লিজ দুই বাংলাকে এক করে দিন। মজার বিষয় পশ্চিমবাংলা থেকে মূখ্য মন্ত্রীর সাথে আগত বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক দেব ঠিক এ কথাটিই প্রকাশ করেছিলেন তার বক্তব্যে। প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অনুভব প্রকাশ, আহ এ জীবনে কি এমন কিছু দেখে যেতে পারব? এ বিষয়ে পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেভাবে পূর্বজার্মানিরা বার্লিন দেয়াল ভেঙে মিলিত হয়েছিল পশ্চিম জর্মানির সাথে, সেভাবেই তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে কাঁটাতার কেটে। কলিকাতায় আমার সফরে দেখেছি সেখানে হিন্দির দাপটে আস্তে আস্তে বাঙালি সংস্কৃতি বিলীন হতে যাচ্ছে। ভাষার ক্ষেত্রে হিন্দি, ইংরেজি, কিংবা খোট্টা ভাষার দাপট বাড়ছে। ব্যবসা বাণিজ্যে সেখানকার বাঙালিরা পিছিয়ে। এই প্রেক্ষিতে ওখানকার বাঙালিরা বাংলাদেশের সাথে মিলিত হতে চাইলে আমরা বাংলাদেশের বাঙালিরা স্বাগত জানাবো। কিন্তু দিল্লিকেন্দ্রিক আধিপত্যবাদী শক্তি তা কি হতে দেবে? আগে স্বাধীন হতে হবে পশ্চিমবাংলাকে।
আজকের এই অনুভব, এই প্রতিক্রিয়ার সাথে শামিম আহমেদের ‘সাত আসমান’এর সম্পর্ক নিবির। তার উপন্যাসের পাত্র পাত্রীগণ এ জাতীয় সংকটের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হলেও শামিম তা প্রকাশ করেন নি উপন্যাসের স্বার্থে। তিনি চিন্তার জগতে একটি বিশাল শূন্যস্থান রেখে দিয়েছেন ভবিষ্যতের মানুষের জন্য, এক জাতি এবং এক ভাষা অধিক অর্থবহ? নাকি এর চেয়ে ধর্ম অধিক শক্তিশালী? আর আশ্চর্য, ধর্মই শেষাবধি আধুনিক বিশ্বে যখন মাথাচারা দিয়ে দাঁড়াতে চায় তখন সত্যিকার অর্থেই একজন জর্মান মিঞাকে শেষাবধি একজন মুসলমানের ভেতর আটকে থাকতে দেখা যায়; তার ভেতর বাঙালিপনার কোন উষ্ণতার ছোঁয়া আমরা অনুভব করি না। এটাও শামিমের সফলতা; তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই এমনটি করেছেন। তিনি সরাসরি এক ঘর বনেদি মুসলমান পরিবার, তাদের ভাষা, ধর্মবিশ্বাস আর তাবিজ-কবজ, জিন-ভূতসহ স্বপ্নচারি আয়েসি ব্যক্তিস্বার্থবাদি মুসলমান সামন্তশ্রেণিকে উপস্থাপন করে পক্ষান্তরে আমাদের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা শুধু নয় পাশাপাশি মানসিক সীমাবদ্ধতার সীমানাকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন। এই যে চিহ্নিতকরণ ক্ষমতা, এটি শুধু এক্ষেত্রেই নয় বরং সতর্কতার সাথে ‘সাত আসমান’পাঠ করলে দেখা যাবে উপন্যাসের বেশ কিছু বয়ানকৌশলে এমনতর বিবেচনা লক্ষ্যণীয়। এই যে বিবেচনাবোধ, প্রধানত এ কারণেই বলা সম্ভব, ‘সাত আসমান’এর যতটুকুই সীমাবদ্ধতা থাকুক না কেন সেই সীমাবদ্ধতা শেষ পর্যন্ত ইশারাগুণে এবং বিষয়গুণে সিরিয়াস উপন্যাসের পক্ষেই কাজ করেছে।
লেখক পরিচিতি
শিমুল মাহমুদ
কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার।
জন্ম ৩ মে ১৯৬৭। নাড়িমাটি যমুনাপারে, সিরাজগঞ্জের কাজিপুর। বাংলাদেশ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পৌরাণিক বিষয়াদি নিয়ে উচ্চতর গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করেছেন পিএইচ-ডি. ডিগ্রি। কবি হিসেবে আবির্ভাব গত শতকের আশির দশকে। স্বৈরশাসনের দুঃসহকালে কবিতার সাথে তাঁর সখ্য; সমান্তরালে কথাসাহিত্যে রেখেছেন নির্মোহ ছাপ; অধ্যাপনা পেশার সাথে মিলিয়ে নেন সমসাময়িক পাঠ; ফলে সমালোচনাতেও সিদ্ধহস্ত। এখন থিতু রংপুরে; বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের কাগজ ‘কারুজ’। স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা পুরস্কার ২০০০’। সেইসাথে সাহিত্যকর্মের জন্য ২০১২ তে ‘বগুড়া লেখকচক্র’ এবং ২০১৫ তে পশ্চিমবঙ্গের ‘অচেনা যাত্রী ও দ্বৈপায়ন’ কর্তৃক সন্মাননা প্রাপ্ত হন।
0 মন্তব্যসমূহ