শামিম, আপনাকে অভিনন্দন

শামিম আহমেদের উপন্যাস 'বিষাদবিন্দু' নিয়ে আলোচনা

স্বকৃত নোমান


পশ্চিমবঙ্গের লেখক শামিম আহমেদের নাম আগে কখনো শুনিনি। গত বছরের শেষের দিকে তার একটা উপন্যাসের নাম জানতে পারি, বিষাদবিন্দু। দামেস্কের মুয়াবিয়াপুত্র এজিদকে নায়ক করে তিনি উপন্যাসটি লিখেছেন। একেবারেই অভিনব বিষয়। এই বই তো পড়তেই হয়! ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট, কনকর্ড টাওয়ার, নীলক্ষেত বা অন্য বইয়ের দোকানগুলোতে হন্যে হয়ে খুঁজে না পেয়ে অগত্যা চট্টগ্রামের বিখ্যাত বই বিক্রয়কেন্দ্র ‘বাতিঘর থেকে এসএ পরিবহনে বইটি সংগ্রহ করলাম। আমার ধারণা ছিল এটি বুঝি মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু’র মতো ঢাউস আকৃতির একটা বই। কম করে হলেও চার শ পৃষ্ঠা তো হবেই। কিন্তু না, যখন হাতে পেলাম, দেখলাম, খুবই ছোট একটা বই, মাত্র ১২০ পৃষ্ঠার।


ছোট লঙ্কা দেখতে ছোট, কিন্তু ঝাল বেশি। বিষয়গত দিক থেকে উপন্যাসটির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। ‘বিষয়গত’ শব্দটি খেয়াল রাখা দরকার। বিষয়গত দিক থেকে একেবারে ভিন্নতর এই ছোট্ট উপন্যাসটি পড়তে খুব বেশি সময় লাগল না, সন্ধ্যায় শুরু করে রাত দুটো নাগাদ পড়া শেষ। ইসলামের ইতিহাস বা ইসলামধর্মতত্ত্ব যাদের অজানা বা যারা কম জানেন তারা উপন্যাসটিকে একটা বড় কাজ হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারেন। আবেগের আতিশয্যে শামিম আহমেদকে মহান, অতুলনীয় ঔপন্যাসিক ইত্যাদি বিশেষ্যণ দিয়ে বসতে পারেন। বাংলাদেশে এই প্রবণতাটা খুব বেশি। বাংলাদেশে এমন কয়েকজন ঔপন্যাসিকের নাম জানি, তারা যেসব উপন্যাস লেখেন, সেসব স্রেফ অখাদ্য। নীরিক্ষার নামে তারা এমন একটা জগাখিঁচুড়ি তৈরি করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেন, পাঠক ঐ তথাকথিত নীরিক্ষার দেয়াল ভেঙে উপন্যাসের গভীরে প্রবেশ করতে পারেন না। পাঠক ভাবেন, এই প্রবেশ করতে না পারাটা বুঝি তার ব্যক্তিগত দুর্বলতা। দুর্বলতা যে আসলে লেখকের, পাঠক সাহস করে সেটা বলতে পারেন না। বললে পাছে তার মূর্খতা ধরা পড়ে যায়! ফলে লেখককে তিনি ভালো লেখক, ‘মহান লেখক’ ইত্যাদি অভিধা দিতে থাকেন। অভিধাটি লোকমুখে চলতে চলতে এক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

কলকাতার লেখক আবুল বাশারের ‘ফুলবউ’ উপন্যাসটির কথাই ধরা যাক। তার ভালো কাজ ‘মরুস্বর্গ’ বা ‘রাজাবলি’ বা ‘অগ্নিবলাকা’ নিয়ে কথা বাংলাদেশ বা কলকাতার পাঠকদের মুখে খুব কম শোনা যায়। মাতামাতি শুধু তার ‘ফুলবউ’ নিয়েই। যারা মুসলমান সমাজের সঙ্গে পরিচিত তাদের কাছে উপন্যাসটি আহামরি কিছু নয়, বিশেষ কোনো গুরুত্বই বহন করে না। আঙ্গিক বা ভাষার ক্ষেত্রেও না। কিন্তু উপরে বর্ণিত তিনটি উপন্যাস সব দিক থেকেই তার শ্রেষ্ঠ কাজ। অথচ বলে কিনা শুধু ‘ফুলবউ’-এর মতো একটা দ্বিতীয় শ্রেণির উপন্যাসের কথা!

শামিম আহমেদের ‘বিষাদবিন্দু’ উপন্যাসটিও উপন্যাস হিসেবে আহামরি কিছু নয়। গতানুগতিক আঙ্গিক। ভাষাও গতানুগতিক। উপন্যাসের যে ক্ল্যাসিক শর্তগুলো রয়েছে সেগুলোর বাস্তবায়নও ঠিকভাবে তিনি ঘটাতে পারেননি। তাহলে উপন্যাসটির মাহাত্ম্য কোথায়? কেন আমি উপন্যাসটি পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিলাম? যারা পড়েননি তাদেরকেই-বা কেন উপন্যাসটি পড়তে হবে? এজন্য যে, বাংলার ঘরে ঘরে পঠিত মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ কাহিনিগ্রন্থে নবীদৌহিত্র হোসেনকে নায়ক এবং এজিদকে দেখানো হয়েছে প্রতিনায়ক। হোসেনের করুণ পরিণতির জন্য আমরা কাঁদি, এজিদের নিষ্ঠুরতার জন্য তাকে ঘৃণা করি। কল্পনার রঙচং মাখিয়ে মীর সাহেব অলৌকিক মানুষে রূপান্তরিত করেছেন হোসেনকে। একই ব্যাপার ঘটেছে বিখ্যাত ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথিতেও। চিন্তক আহমদ ছফা তার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে এটা নিয়ে লিখেছেন, সুতরাং আমার আর নতুন করে লেখার কিছু নেই। তার প্রবন্ধ থেকে আমার মতো করে উদ্ধৃতি দেই।

যেমন, তলোয়ারের অগ্রভাবে হোসেনের ছিন্ন মস্তক নিয়ে কারবালার প্রান্তর থেকে সিমার দামেস্কের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। যেতে যেতে পথে সন্ধ্যা নামল। রাতটা কাটানোর জন্য সিমারকে এক গেরস্তের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হলো। গৃহকর্তার নাম আজর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তার উপর আবার ব্রাহ্মণ। রাতে হোসেনের ছিন্ন মস্তক এক অলৌকিক কাজ করে ফেলল। গৃহকর্তা আজর, তার ব্রাহ্মণী, সাত পুত্র এবং সাত পুত্রবধু একসঙ্গে কাটা মস্তকের মুখে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল!

আহমদ ছফা লিখেছেন, এই অংশটি পড়ার সময় মনের ভেতর ঘোরতর অবিশ্বাস মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পুঁথি লেখক যদি সিমারের সঙ্গে ব্রাহ্মণ আজরের বদলে ইরানি, তুরানি, ইহুদি, খৃস্টান, তাতার, তুর্কি ইত্যাদি যে কোনো জাতির, যে কোনো ধর্মের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটিয়ে দিতেন, তাহলে পাঠকের মনে কোনো প্রশ্নই জাগত না। কিন্তু তিনি কারবালা থেকে দামেস্ক যাওয়ার পথে ধু-ধু মরুপ্রান্তরে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণকে আমদানি করলেন কোত্থেকে?

এমন শত শত কাল্পনিক কাহিনিতে ভরা ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথি। ইসলাম ধর্মকে মহান করে তোলার জন্য এসব অবাস্তব কাহিনি বয়ান করা হয়েছে। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদসিন্ধু’ও এমন অবাস্তব কাহিনিতে ভরা। হোসেনের চরিত্রকে নিষ্কলুষ রাখবার জন্য কল্পনার এমন রঙ তিনি লেপন করেছেন, বাংলার মুসলমানরা সেসব কল্পনাকে সত্যি বলেই জ্ঞান করল। হোসেন হয়ে উঠলেন তাদের কাছে মহানায়ক এবং এজিদ দুশ্চরিত্র খলনায়ক। এজিদ একটা গালিতে রূপান্তরিত হলো। সিমার তো গালি হিসেবে এখনো বহুল প্রচলিত।

অপরপক্ষে শামিম আহমেদের ‘বিষাদবিন্দু’র নায়ক হচ্ছেন এজিদ। ‘শহীদে কারবালা’ বা ‘বিষাদসিন্ধু’র মাধ্যমে যে এজিদকে আমরা খুনি, লম্পট, মদ্যপ হিসেবে জানি, শামিম তার উপন্যাসে এজিদকে উপস্থাপন করেছেন অন্য মানুষ হিসেবে। তার ভিন্ন চরিত্রগুলো উদঘাটন করেছেন। যেমন, হোসেন খুন হোক তা চাননি এজিদ। কারবালায় তিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন হোসেনকে বন্দি করে আনতে, খুন করতে নয়। ‘বিষাদবিন্দু’তে এজিদকে দেখানো হয়েছে একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে। তিনি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন নিপুণ হাতে। প্রেমিক এজিদ, পিতা এজিদ, যোদ্ধা এজিদ বেহালায় ছড় টেনে কাঁদেন। হোসেন খুন হওয়ার সংবাদ শুনে কাঁদতে কাঁদতে এজিদের ছিনা ভেসে যায়। হোসেনের খুনি সিমারকে হত্যার জন্য তিনি পরওয়ানা জারি করেন।

তার মানে ‘শহীদে কারবালা’ পুঁথি ও ‘বিষাদসিন্ধু’র প্রতি বিশাল একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন দাঁড় করিয়ে দিলেন শামিম তার ‘বিষাদবিন্দু’র মধ্য দিয়ে। আগের দুটি বইয়ের মাধ্যমে লেখকের কিছু কল্পনা যেখানে বাস্তব এমনিক ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়ে পড়েছিল, শামিম বলছেন, না, এই ইতিহাস ভুল। এখানেই শামিমের সার্থকতা। ইতিহাসকে তিনি উল্টো করে দেখিয়েছেন। ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনা করেছেন। শুধু এই কারণেই উপন্যাসটি কিছুটা আলোচনার দাবি রাখে, অন্য কোনো কারণে নয়।

উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে পাঠক হিসেবে আমার মনে হয়েছে, শুধু বিষয়ের কারণে শামিম উতরে গেছেন। নইলে তিনি পাঠকের কাছে দারুণভাবে ধরা খেতেন। কেন? আঙ্গিককে আমরা যতই ভাঙচুর করি না কেন, উপন্যাসের একটা চিরায়ত আঙ্গিক অবশ্যই আছে। এই চিরায়ত আঙ্গিক থেকে উপন্যাসকার সরে যেতে পারেন না। গেলে সেটা আর উপন্যাস থাকে না। ‘বিষাদবিন্দু’ পড়তে গিয়ে বারবার হোঁচট খেতে হয়েছে। মনে হয়েছে, আমি কি উপন্যাস পড়ছি, না ইতিহাস? মনে হয় লেখক ¯্রফে ইতিহাসের বর্ণনা দিচ্ছেন। পাতার পর পাতা। ইতিহাসের তথ্যগুলোকে ইতিহাসকারের মতো উপস্থাপন করছেন, উপন্যাসকারের মতো নয়।

ঐতিহাসিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে এ কথাটি খুবই সত্য যে, শুধু ঐতিহাসিক তথ্য ও ঘটনাপঞ্জী সাজিয়ে দিলেই ঐতিহাসিক উপন্যাস হয়ে যায় না। ঐতিহাসিকের মূখ্য কাজ ঐতিহাসিক তথ্যকে উপস্থাপিত করা, ব্যাখ্যা করা। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনার প্রধান কর্তব্য ঐতিহাসিক কল্পনাবোধের দ্বারা বিশেষ যুগের সর্বস্তরের নর-নারী, তাদের বিপুল সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের বেগ, দৃশ্য ও ঘটনাকে জীবন্তু করে তোলা। নিজেকে বর্তমানের পটভূমি থেকে সরিয়ে নিয়ে সেই অতীত যুগের সংবেদনশীল দর্শকে রূপান্তরিত হওয়া। এ ক্ষেত্রে শামিম দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ। তার উপন্যাসটিতে বিশেষ কালের সর্বস্তরের নর-নারী, তাদের বিপুল সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের বেগ, দৃশ্য ও ঘটনাকে তিনি জীবন্ত করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটা উপন্যাসটির বড় দুর্বলতা। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে লেখককে সংশয়ী মনে হয়েছে। একটা বিষয়ের বর্ণনা যখন তিনি দিচ্ছেন, খুব পরিস্কারভাবে দিচ্ছেন না। একটা সংশয়ের জায়গা থেকে তিনি বর্ণনা দিচ্ছেন। কাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে লেখকের এই সংশয় উপন্যাসের শিল্পমানকে ক্ষুণ্ন করে, উপন্যাসকে দুর্বল করে তোলে।

তারপরও উপন্যাসটির বিষয় এত শক্তিশালী এবং এত অভিনব যে, দুর্বলতাগুলো পাঠকের নজর এড়িয়ে যায়। সত্যি, বাংলা উপন্যাসে বিষয়ের আকাল চলছে। শামিম নতুন বিষয়ের মধ্য দিয়ে একটা চমক দিতে পেরেছেন। ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার একটা প্রচেষ্ট তিনি চালিয়েছেন। এটি এখন সময়ের দাবি। কাজটি শুরু হয়ে গেছে। তরুণরা ইতিহাসের প্রচলিত মতকে প্রশ্নবিদ্ধ করবেন। গতানুগতিক ইতিহাস শুধু সামনে থেকে আলো ফেলেছে। তরুণ লেখকরা শুধু সামনে থেকে নয়, আলো ফেলবেন পেছন থেকে, উপর থেকে, নিচ থেকে, ডান থেকে, বাঁ থেকে। ইতিহাস যে বাজে বিষয়গুলোকে মহৎ করে তুলে ধরেছে, যে বিষয়গুলোকে গোপন করেছে বা এড়িয়ে গেছে, তরুণরা খুঁড়িয়ে সেগুলো বের করে আনবেন। শামিম তার ‘বিষাদবিন্দু’র মধ্য দিয়ে সে চেষ্টাটি করেছেন; যদিও বিষয়টা নিয়ে আরো ব্যাপকভাবে, বিস্তৃত পরিসরে, নতুন আঙ্গিকে কাজ করার সুযোগ ছিল। তবুও শামিম, আপনাকে অভিনন্দন।




আলোচক পরিচিতি
স্বকৃত নোমান

কথাসাহিত্যিক। সাংবাদিক।

উপন্যাস। কাল কেউটের সুখ। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. 'বিষাদবিন্দু' র নাম জানি ফেইসবুকে স্বকৃত নোমানের একটা পোস্টিং থেকে। বইটি পড়ি বইয়ের হাট এর সৌজন্যে এবং উপরের আলোচনার সাথে অনেকটা সহমত পোষণ করছি।'বিষাদসিন্ধু" বইটি কলেবরে বড়, আর ‘বিষাদবিন্দু’ ভাবনায়। ভালো লেগেছে প্রথা বিরোধী কিছু ঘটানার অবতারণা।যেমন,মাইসুন বিবি মাবিয়ার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী হলেও পুত্রের জন্য তাকে আবার প্রাসাদে নিতে হয় বা উনি কিছুদিনের জন্য প্রাসাদে যান।
    মাইসন বিবি আর এজিদের কবিতাগুলো আরও একটু সৃজনশীল হতে পারত। আমার কাছে এজিদের শাসক চরিত্র, কবিত্ব ও তার সঙ্গীত সাধনার চেয়েও রাজকুমারী বিন-জাবালার সাথে তার আচরণ ও কিশোরী কন্যা রাফালার জন্য এজিদের আকুলতাকে লেখক আরও গুরুত্বের সাথে আপ্লুত করে লিখলে পারতেন।
    এজিদের মা মাইসুন বিবি একটি অস্ফুট পদ্ম। তাকে নিয়ে একটি উপন্যাস হতে পারে। তিনি কবি, বেদায়ি নামক স্থানে বেনি কেলব উপজাতিদের স্বাধীকার আন্দোলনের নেত্রী মাইসন।
    সব মিলিয়ে উপন্যাসের বিষয় নির্বাচনে ব্যতিক্রমী এ পথে রও তরুনরা হাঁটুক--- এ প্রত্যাশা করছি।

    উত্তরমুছুন