মালেকা পারভীন এর গল্প একটা প্রেমের গল্পের অ্যাবসার্ড ভূমিকা!!!


                              ব্যাপারটা কখন জানলাম ? ঠিক তখন যখন আমার জানাটার ভেতর আর কোনরকম সন্দেহের খাদ ছিলনা। খাদ থাকলে ভালো হতো কিনা সেটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভ্যাজর-ভ্যাজর করা যেতে পারে, মোটামুটি মানের গ্রহণযোগ্যতায় একটা সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে,কিন্তু তাতে করে আলোচ্য বিষয়টার সন্তোষজনক কোন সুরাহা হবে বা হতো বলে মনে হয়না।
যাকগে, আমার মনে হওয়া-না-হওয়াতে কিচ্ছু যায় আসেনা, ফর শিওর। দুনিয়া চলছে, চলবে তার নিজস্ব ধরাবাঁধা নিয়মে। সেখানে আমার-আপনার মতো নস্যিদের কথা কে শুনবে,বলুন?আপনার সম্পর্কে কিছু না জেনেই আপনাকে নস্যি বলে ফেলাটা মনে হয় সমীচীন হলনা। আচ্ছা, ঠিক আছে, যদি, ওরকম অর্থাৎ আমার মতো নস্যি হয়ে থাকেন তো ল্যাঠা চুকেই গেলো। আর সৌভাগ্যক্রমে যদি না হয়ে থাকেন, তাহলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এই আশা বেচারার।

আপনার স্বভাবটা কবে বদলাবেন,ভাই? আসল কথা না বলে কিছু একটা বলবেন বলে সেই যে একটা লাল মুলা চোখের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছেন আর তা দেখিয়ে দেখিয়ে কোন দিক-বিদিক নিয়ে যাচ্ছেন তার তো কোন হদিসই ঠাহর করতে পারছিনা...বলেছিলেন, মানব মনের অদৃশ্য অলিগলিতে চিরন্তন কাল থেকে ঘুরপাক খেতে থাকা বিচিত্র রহস্যময় যে অনুভূতি, প্রেম যার সুমিষ্ট নাম, সে ব্যাপারে আপনার সাম্প্রতিক এক ইউরেকাময় অভিজ্ঞতা লাভের কথা শেয়ার করবেন আর এ সংক্রান্ত এতবিধ ইত্যাদি ইত্যাদি...আর এখন আপনি কি সব তলানি ঘাঁটতে শুরু করেছেন...যত্তসব...

হুম, আমি আপনাকে বলেছি যে এক ইউরেকাময় অভিজ্ঞতা লাভের কথা আপনার সাথে ভাগাভাগি করবো,তাইনা? আমিআপনাকে এমনটাই বলেছি বলে আপনার ধারণা? আপনার নিজের কানেই শুনেছেন যে আমি আপনাকে ওই প্রেম নিয়ে এক কাহিনী বলবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি ? আপনার মশায় মাথাটা নির্ঘাত গেছে। একেবারেই গেছে। তবে কোন নিউরোসার্জন বানিউরোমেডিসিননা, আপনার দরকার হবে একজন ভালো মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া, মোহিত কামাল বা এরকম নামকরা কারো কাছে যাওয়া যাদের এ ফিল্ডে ওই যেমনটা বললেন, অভিজ্ঞতা আছে---সাথে নামযশও এই ফাঁকে জুটে গেছে এরকম কারো কাছে। ‘পাগলের ডাক্তার’দের নাম ছড়াতে সময় লাগে। কারণ তো জানেন, রুগি সেরে উঠবার আগেই ভেগে যায় অথবা সেরে গেছে বলে সরে যায়...পাগল তো, ডাক্তারের তেমন কিছু করারও থাকেনা...ঠোঁট-কামড়ানো ছাড়া...

না,ভাই, আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারছি যে আপনার সিস্টেমে বড় রকমের কোন সমস্যা হয়েছে। নির্ঘাত হয়েছে। আর আমার মনে আরেকটা সন্দেহ প্রবলভাবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। প্রথমে সামান্য দ্বিধা- দ্বন্ধে ছিলাম। কিন্তু এখন আর নাই। এখন আমি পুরোটাই নিশ্চিত...

কিরকম? আপনি আমার ব্যাপারে কিরকম কোন বিষয়ে একেবারে নিশ্চিত হলেন আমাকে একটু খুলে বলেন তো, দেখি। তাজ্জব কাণ্ড !

তাজ্জব বটে ! তাজ্জব না ? সেই শুরু থেকে আপনি কেমন অদ্ভুতভাবে একটা বিশেষ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করছেন, অথচ ভাব করছেন যে এ ব্যাপারে আপনার কোন ধারণাই নাই...অথচ আপনি নিজেই সেই সমস্যায় আক্রান্ত...আপনার ক্ষেত্রে আসলে যেটা হয়েছে সেটা হল...

থাক,আপনাকে আর বলতে হবে না।আমি বুঝতে পেরেছি আপনি কি বলতে চাচ্ছেন। এখন বরং শুনুন আমি আপনাকে যা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সমস্যা কি জানেন, পুরো ব্যাপারটাই অনুমাননির্ভর। তবে এটা ঠিক যে অনেক তথ্যপ্রমাণ আছে । অনায়াসে একটার সাথে আরেকটা মিলিয়ে কাহিনীর যোগসূত্র বের করে ফেলা যায়। তারপরও কথা থাকে। কি লাভ অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে অযথা ঘাঁটাঘাঁটি করে। সাময়িক বিনোদন ছাড়া তো আর কিছু পাওয়া যায়না।

এতক্ষণে আমার মনের মতো একটা কথা বললেন। সাময়িক বিনোদন কথাটা দারুণ বলেছেন। আমার খুব মনে ধরেছে। সত্যি কথা বলতে কি, আমি আজ আপনার কাছে এসেছিলাম ওই সাময়িক বিনোদন লাভের আশায়... জীবনটা মাঝে মাঝে কেমন যে বোরড হয়ে যায় কিছুই ভালো লাগেনা...তখন এমন কিছু দেখতে বা শুনতে ইচ্ছা করে যা থেকে কিছুটা হলেও আনন্দ পাওয়া যেতে পারে...সাময়িক প্রশান্তির পরশ...আবার সাময়িক বিষয়টা চলে এলো দেখছি।

না, এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছিনা যে আপনাকে আমি এমন কিছু মনরোচক ঘটনা বলতে পারবো যাতে অল্প সময়ের জন্য হলেও আপনার কিছুটা ভালো লাগে। আর এটা শুনে ভালো লাগার মতো তেমন কিছু নয়, বরং উল্টোটাও হতে পারে। অর্থাৎ ভালো লাগার পরিবর্তে আপনার ভেতরে এমন একঅদ্ভুত আবেগের স্ফুরণ ঘটলো যে রাগে অথবা বিরক্তিতে আপনি আপনার বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করবেন। আবেগ ব্যাপারটা তো এরকমভাবেও ঘটতে পারে, তাইনা?

সেরকম আশঙ্কা আছে নাকি? তাহলে তো বেশ ইন্টারেস্টিংই মনে হচ্ছে। আর দেরি না করে এখন ঝটপট শুরু করে দিন তো, দেখি। আমার আর তর সইছেনা। আপনার গল্পের হুকটা দারুণ হয়েছে। মানে ঠিকমতো শ্রোতার মনোযোগের আসল জায়গাটা কায়দা করে বড়শিতে গেঁথে ফেলেছেন।

বড়শিতে গেঁথে ফেলার কথা বললেন না? একেবারে পারফেক্ট বলেছেন। সুলতানা রাজিয়া এ কাজে ইতোমধ্যে তার পারঙ্গমতা দেখিয়ে ফেলেছে। আর আমি যখনই তার কথা মনে করি, এটা অবশ্য প্রায়ই হয়, অবাক বিস্ময়ে ভাবি মানুষের ক্ষমতা আসলেই আনফ্যাদমএবল। যদিও বছরখানেক হল তাকে আমি এড়িয়ে চলছি। মানুষের ভণ্ডামি, বুঝলেন, একবারেই সহ্য করতে পারিনা।

আমি আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। বোঝার চেষ্টাও করছিনা। দয়া করে যদি ব্যাখ্যা সমেত বলেন, ভালো। না বললে কিছুই করার নাই যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার নিজের ইচ্ছা না হচ্ছে বলতে।কিন্তু একটা প্রশ্ন না করেই পারছিনা। এতক্ষণ আমাদের আলাপ-আলোচনা একটা বিমূর্ত ধারণাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আচমকা দেখি, এই সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়ার সশব্দ আগমন। তা তিনি কি এই গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র?

ঠিক ধরেছেন। আমার দেখা রহস্যময়ী রমণীদের একজন। অবশ্য রহস্য বললে তাকে ঘিরে যে একটা আলোআঁধারির ঘুলঘুলি তৈরি হয়, সেরকম কিছু নয় একেবারে। বরং সময়-বিশেষে চরম বিরক্তিকর একজন সঙ্গী। আর তাছাড়া আসলে ওইসব রহস্য-ফহস্য কিছু না। সাদা ভাতের মত একেবারে প্লেইন এন্ড সিম্পল। কিন্তু সমস্যা বলুন বা বিরক্তি, অথবা ধরুন গিয়ে সঙ্কট যা তিনি প্রায়ই সৃষ্টি করে থাকেন এবং অনিবার্যভাবে একটা টেলিফোন কল অথবা মেইলের মাধ্যমে আমার কাছে সাহায্যের জন্য ধর্না দেন, কি যেন বলছিলাম, ও আচ্ছা, এসবের প্রকৃত কারণ হল গিয়ে তার বেমালুমঅস্বীকার-প্রবণতা।

অস্বীকার-প্রবণতা ? এটা আবার কোন চিজ? কি অস্বীকার করেন তিনি? যা বলেছেন, যা করেছেন সব?

না,না,সব না। অর্ধেকটা। মানে আপনাকে একটা ঘটনার মাঝখান পর্যন্ত তিনি নিয়ে যাবেন। খুবই আন্তরিকভাবে। অত্যন্ত অমায়িক ভঙ্গিতে। দারুণ বিশ্বস্ততার সাথে। কিন্তু ঘটনার মাঝখানে,ধরুন, আলোচনার প্রয়োজনে, আপনি তাকে একটা প্রশ্ন করলেন। আর তার উত্তর তিনি এমনভাবে দিলেন যে আপনি একবারেই বুঝতে পারলেন যে তিনি সত্য কথা বলছেন না। একটা অলরেডি ঘটে যাওয়া ঘটনার আশেপাশে তিনি মূর্তিমান, অথচ কেমন নির্বিকার মুখ করে বলবেন, ‘আমি কিছুই জানিনা। আমার জানবার কোন কারণও নেই। লোকজন যে কেন এভাবে আমার পেছনে লেগে থাকে? সত্যি, খুব খারাপ লাগে মানুষের এইসব হৃদয়হীন আচরণ দেখে। একজন অসহায় একাকী নারীর জন্য আসলে কোথাও কোন জায়গা নেই।’

দারুন ইন্টারেস্টিং ক্যারাকটার তো ! তবে সত্যি কথা বলতে কি, একেবারে আহামরি তেমন কিছু নয়। এ ধরনের ব্যক্তি-মানুষেই এখন চারপাশটা গিজগিজ করছে। আমরা এদের মধ্যেই অথবা এরা আমাদের মধ্যেই বাস করছে। যখন আমার-আপনার সাথে এরকম সরাসরি যোগাযোগের কারণ ঘটে,তখন আমরা কেমন একরকম বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ি আর অকারণ নিজেদেরকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে থাকি। অথচ অবাক হবার মতো তেমন কিছুই না। বরং এই যে আমরা এভাবে বিস্ময়াভিভূত হয়ে যৌক্তিক- অযৌক্তিক নানা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশের চূড়ান্ত করছি এতেই অন্যরা বুঝতে পারছেনা যে, আমাদের এই ইগ্নরেন্স কি জেনুইন নাকি ফেইনড?

বাহ,বাহ, আপনি তো মশায় কম যান না দেখি। অল্প কথায় একেবারে সমাজের ব্যক্তি-মানুষের মনস্তত্তের প্রকৃত স্বরুপ উদ্ঘাটন করে ফেললেন যাকে বলে একেবারে স্বমূলে উৎপাটন। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি আপনি কিছু বোঝাতে পেরেছেন অথবা আপনার কাছে কি আদৌ কোন ব্যাখ্যা আছে এ বিষয়ে? ব্যাপারটা আমার কাছে সেরকমভাবে পরিষ্কার নয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির বিশেষ একটি চারিত্রিক মাত্রা নিয়ে; সেটা ভালো কি মন্দ, দোষ নাকি গুণ, সেটা নিয়েই কথা বলতে চেয়েছিলাম আর বুঝতে চেয়েছিলাম ব্যক্তিবিশেষে এর ব্যাখ্যা কতটা আলাদা হতে পারে। যা হোক, আপনি তো পুরো ব্যাপারটা টেনে অন্যদিকে নিয়ে গেছেন। দেখুন আমি যখন বললাম, তিনি অর্থাৎ সুলতানা রাজিয়া কিভাবে তার অসত্য ভাষণকে জাসটিফাই করার জন্য তার মানসিক, অথবা শারীরিকও হতে পারে, অসহায়ত্বকে কাজে লাগাতে চাইছেন, তখন আমি আসলে জানতে চাইছিলাম যে আপনি বুঝতে পেরেছেন কিনা তিনি আমার আবেগের ঠিক কোন দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছেন?

না, বুঝতে পারিনি। কারণ, আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। আপনি একজন রহস্যময়ী নারীর গল্প শুরু করেছেন এমন রহস্যের বার্তাবরণে যে আমি রীতিমত কনফিউজড। শুধু তার নামটা ছাড়া আর কিছুই আমার মর্মগোচর হয়নি। তাও হতো না যদি না নামটা ওরকমরাজকীয় না হতো। শাহিদা সুলতানা বা সুলতানা পারভীন হলে এ গল্প আমি শুনতেই চাইতাম না।

ধুত্তরি,ছাই, আপনি আমার গল্প বলার মুডটাই নষ্ট করে দিলেন। আচ্ছা, ঠিকাছে, শুনুন। রহস্য-টহস্যবাদ দিয়ে একেবারে প্লেইন এন্ড সিম্পল ল্যাঙ্গুয়েজে একটা ইন্সিপিয়েণ্ট লাভ-স্টোরির গল্প শোনাই। ইন্সিপিয়েণ্ট এজন্য যে এটা এখনও ঠিক পাপড়ি মেলে ধরেনি, ফুটবো কি ফুটবো না করছে। শোনেন, মজা পাবেন। চিন্তার খোরাকও জুটে যাবে। মানব-চরিত্রের আরেক বিচিত্র দিকের সাথে পরিচিত হবার আনন্দে হঠাৎ শিষও বাজিয়ে উঠতে পারেন। কথা দিচ্ছি, সেভাবেই সেই প্রেম-ওই প্রেমের গল্প বলার চেষ্টা করছি এখন। শোনেন তাহলে বলতেই হঠাৎ একটা হেঁচকি মতো উঠে গেলো। হেঁচকি তো হঠাৎই উঠে। তো উঠলো আর সে কারণে লাভ-স্টোরির বক্তাকে পানির গ্লাস খুঁজতে হল।

ওদিকে হেঁচকি-বাধায় অধৈর্য হয়েশ্রোতার বিরক্তি চরমে পৌঁছে গেলো যখন তিনি পরিষ্কার ভাষায় বললেন,লাভ-স্টোরির গল্প? এটা একটা কথা হল? হয় বলেন লাভ-স্টোরি না হয় ভালবাসা বা প্রেমের গল্প। তা না লাভ-স্টোরির গল্প। শুনেই তো মনে হচ্ছে একটা গাঁজাখোরি কিছু শোনাতে চাচ্ছেন। আপনার আবার ওসব সিদ্ধি-টিদ্ধি খাওয়ার বদ অভ্যাস নেই তো ? আমার তো আপনার কথা শুনে শুরু থেকেই ওরকম সন্দেহ হচ্ছে। এখন আবার যেরকম হেঁচকি তুললেন...

গল্প শুনতে চাননা ভালো কথা, তাই বলে হেঁচকি নিয়েও খোঁটা দিতে হবে? হেঁচকি কি আর বলে-কয়ে আসে রে ভাই ? এক নিশ্বাসে কথা বলে যাচ্ছি। গলার মধ্যে বায়ু–চলাচল আটকে গিয়ে এই চোখ- উলটানো অবস্থা। আর আপনি এটা নিয়েও মশকরা করতে ছাড়লেননা। আবার হেঁচকি !

শোনেন, লোকজন একটা কথা বলে না ? লোকজন যেন কি বলে? ভুলে গেলাম তো। আপনার হেঁচকির দমকে কি বলবো সেটাও ভুলে গেলাম। যাই হোক, দম নিন, পানি খান। তারপর ধীরে-সুস্থে সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়ার সাথে কোন রাজা-বাদশা না সিপাহশালার কার প্রেম-ট্রেম হল সেটা একটু ঝেড়ে– কেশে বলুন। ধৈর্যের শেষ মাথায় নিয়ে গেছেন। আর অপেক্ষা করতে পারছিনা। গল্প শোনার আগ্রহও মোটামুটি বাতাসে মোম নেভার মতো বেশ খানিকটা উবে গেছে।

আচ্ছা শুনুন, আমি যখন অফিসের কাজের চাপে দিশাহারা হয়ে কিছুক্ষণ মাথাটা খালি করার জন্য, এই অল্প-আধটু গল্প-সল্প করার জন্য আরকি, সুলতানা রাজিয়ার রুমে যাই, তার টেবিলের সামনের চেয়ারটায় আরাম করে বসি, তার দিকে হাসিমুখে তাকাই, তিনি তখন ওই মুহূর্তে কি করেন, অনুমান করে বলেন তো?

এটা বলতে আবার অনুমান করতে হবে কেন? এতো জানা কথাই যে, আপনার দিকে তাকিয়ে আপনার হাসির জবাবে মিষ্টি একটা হাসি উড়িয়ে দিয়ে চা খাবেন কিনা জানতে চান। এর থেকে অন্যথা আর কি হতে পারে বলে আমাকে অনুমান করতে বলছেন?

তাহলেই হয়েছে! মিষ্টি হাসি আর চায়ের অফার! সুলতানা রাজিয়ার আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই তিনি অফিস-রুমে বসে বসে আমার জন্য ওসব ঘরকন্নার ঝকমারি দেখাবেন। আরে ভাই, তিনি তো তখন মেসেঞ্জারে বসে চ্যাট করেন। দুনিয়ার যতরকম আহ্লাদিপনা আর ফ্লারটিং ম্যানারস আছে সব কাজে লাগিয়ে। চ্যাট বুঝেন,চ্যাটিং! তার আই-লাইনার টানা পটল–চেরা চোখজোড়া তখন সেঁটে আছে কম্পিউটারের মনিটরে। আমি দরজায় নক করে ঘরে ঢুকবার পরও তার অপলক দৃষ্টি ওই স্ক্রিনেই নিবদ্ধ। আমার দিকে এক ঝলক তাকানোর যেন ফুরসত নেই তার। আশ্চর্য ! বলুন, এটা কোন ভদ্র মানুষের আচরণ?

মানছি, এটা কোন ভদ্র মানুষের আচরণ নয়। কিন্তু আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে, তিনি বসে বসে চ্যাট করছেন ? তিনি তো গুরুত্বপূর্ণ কোন ফাইলের কাজেও ব্যস্ত থাকতে পারেন। হয়তো ওই মুহূর্তেই তিনি একটা দরকারি পয়েন্ট নোট করছিলেন। আই মিন, কম্পোজ করছিলেন। আপনার দিকে তাকালে তার মনোযোগ ক্ষুণ্ণ হতে পারত। আর এতে করে তিনি যা এতক্ষণ ধরে ভেবে ভেবে ঠিক করেছিলেন তার খেই হারিয়ে যেতে পারত। আপনি তো ভাই সামান্য ধৈর্য ধরলেও পারতেন।

ধৈর্য? ঘড়ির কাটা ধরে পুরা সাত মিনিট আমি তার দিকে বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছি। এক ঠায় বসে আছি। আর বেগম সুলতানা রাজিয়া কম্পিউটারের মনিটর থেকে তার চাঁদবদন তুলবার অবসর করতে পারলেননা। আরে ভাই, আপনার কি মনে হয় আমি ঘাস-পাতা খাই যে কিছুই বুঝিনা, কিছুই বুঝবোনা? আর তাই যা বুঝাবেন তাই বুঝতে হবে।

না, না, আমি ওরকম কিছু মিন করে বলতে চাইনি। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না, প্লিজ।

ভুল আমি আপনাকে বুঝি নাই। আপনি বরং আমার কথা বুঝতে না পেরে ভুল করে ফেলছেন। তাহলে এবার আসল কাহিনী শুনুন। সুলতানা রাজিয়া আমার দিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ না করাতে আমার খুবই খারাপ লাগলো যেটা স্বাভাবিক। একটা নুন্যতম সৌজন্যতাবোধের ব্যাপার তো আছে নাকি? সে যখন আমার দিকে তাকানোর সময়ই করতে পারলনা,আমি তাকে কিছু না বলে তার রুম থেকে আস্তে করে বের হয়ে নিজের রুমে ফিরে এলাম। নিজেকে খুব অপমানিত মনে হচ্ছিল। আপনাকে ঠিক ভাষায় বুঝিয়ে বলা সম্ভব না আমার ভেতরে তখন কিরকম অস্থিরতা ! কেন এরকম লাফ দিয়ে দিয়ে তার রুমে যাই নিজেকে প্রশ্ন করে তেমন কোন সন্তোষজনক জবাব পেলাম না। তাই চুপচাপ নিজের ডেস্কে বসে পড়লাম আর ভ্রু কুঁচকে ভাবতে থাকলাম, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। তার যে উপকার একদিন করেছিলাম তার বিনিময়ে এইরকম ছোটলোকি ব্যবহার ইত্যাদি সমাচার। মেজাজটা এমন খিঁচরে গেলো! মানুষের সামান্য ভদ্রতাবোধ যদি না থাকে...

কি হল, থেমে গেলেন কেন,বলুন?মানুষের সামান্য ভদ্রতাবোধ না থাকলে সে কতদূর কি করতে পারে, ভুক্তভোগীর কি হয় সেটা আমাকে খুলে বলুন।

জানিনা কি হয়। জুতসই কিছু মনে আসছেনা। কিন্তু যেটা মনে আছে, আমি সুলতানা রাজিয়াকে সে মুহূর্তে কড়া ভাষায় একটা মেইল করেছিলাম যার সারাংশ হচ্ছে সে যদি তার বিদঘুটে স্বভাব পরিবর্তন না করে তাহলে আমি আর কখনই তার রুমে যাবনা। অথচ কি আশ্চর্য দেখেন, তার রুমে যাওয়ার ঠিক আগেই তাকে আমি ইউবি-ফরটি এর বিখ্যাত সেই গানটার,‘ডোন্ট ব্রেক মাই হার্ট’ এর ইউটিউবের লিঙ্ক পাঠিয়েছিলাম। লিরিকসহ। আর এমন আইরনি অফ সিচুয়েশন-হার্ট ব্রেক তো ব্রেক, একেবারে গুরাগুরা করে দিল ফাজিল মহিলা !

সে কি তার স্বভাব বদলাতে পেরেছিল?

না, পারেনি। সে যেমন ছিল, দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ চর্চায় সেটাকে একটা শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছে। তার সেই মিষ্টি মিষ্টি কথায় ধোঁকা দেবার অহর্নিশ প্রবণতা, চারপাশে সাক্ষী রেখে নানা অঘটন ঘটিয়ে তারপর বেমালুম তা অস্বীকার করে যাওয়া—সুলতানা রাজিয়ার মতো এমন মুন্সিয়ানার অভিনয় আমি আর কাউকেই করতে দেখি নাই আমার চল্লিশ বছরের জীবনে। জানি, জীবনের রঙ্গমঞ্চে নানা কারণে আমাদের প্রত্যেককেই কখনও কখনও অভিনয় করতে হয়। শেক্সপিয়ার আঙ্কেল তো কবেই ঝেরে দিয়ে গেছেন তার সেই অমূল্য বাণীঃ “ অল দ্য ওয়ার্ল্ড’স আ স্টেজ, এন্ড অল দ্য মেন এন্ড উইমেন মেয়ারলি প্লেয়ারস...”। কিন্তু সুলতানা রাজিয়ার অভিনয়, ভাই, না দেখলে বা না বুঝলে আপনি তার প্রকৃতি সমঝে উঠতে পারবেননা।

তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু, দেখুন, এই যে এতক্ষণ ধরে একজন মানুষ সম্পর্কে একটানা এতগুলো কথা আপনি বলে গেলেন, অথচ একটা কংক্রিট উদাহরণ দিয়ে আপনি আপনার বক্তব্যটাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলেননা। আমার খুবই ইচ্ছা ছিল, একটা মধুর ভালোবাসার গল্প শুনব, আপনার ভাষায়, লাভ-স্টোরির গল্প । কিন্তু দুঃখজনকভাবে এতটা সময় গচ্ছা দিয়ে আমাকে শুনতে হল কেবল আপনার ভ্যাজর-ভ্যাজর যার না আছে কোন শুরু, না কোন শেষ, না এমনকি কোন অর্থ।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, এত তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়েননা, ব্রাদার। গল্পের ক্লাইমেক্সে পৌঁছাতে হলে একটু ধৈর্য ধরতে হয়। হুটহাট করে নামতা পড়ার মতো গল্প বলে দিলাম, আপনার ফিলিংসের ডেইনুমা হয়ে গেল। ব্যস, সব শেষ। এভাবে কি গল্প হয় নাকি? তাও আবার এক রহস্যপূর্ণ মাত্র গজিয়ে ওঠা প্রেমের গল্প যেটার নায়িকার কথাই এখনো শেষ করতে পারিনি। নায়কের গল্পে প্রবেশ তো দূরের কথা।

ঠিক,একদম ঠিক। এত সময় ধরে আপনার এই কিসব কথার কচকচানি হজম করে যাচ্ছি, আবার ভাবছি এটা একটা প্রেমের গল্প, অথচ সেই প্রেমের গল্পের অপরিহার্য অনুষঙ্গ যে নায়ক তার কথাই এতক্ষণ মাথায় আসেনি। আপনি, মশায়, পারেনও আপনার কথার মারপ্যাঁচে একেবারে ভুলিয়ে রাখতে। তা, সত্যিই তো, নায়ক, নায়ক কে আপনার সুলতানা রাজিয়ার? কোথায় তিনি, কি করেন? কখন এই অর্থহীন গল্পের চৌহদ্দিতে তার প্রবেশ ঘটবে?

এতক্ষণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে... ধীরে,বৎস্য, ধীরে...তিনি আসবেন সময়মত। এখন তিনি সুলতানা রাজিয়ার সাথে ফেসবুকেচ্যাটিং করা নিয়ে মগ্ন আছেন। শুধু এতটুকু বলি, তিনি সুলতানাকে আদর করে মাই ডার্লিং বলে ডাকেন। এটা নিশ্চিতভাবেই জানি। কারণ একদিন আমি আচমকা সুলতানার মোবাইল সেটটা হাতে নিয়ে ফেলেছিলাম। বুঝি তো নাই যে সে তার ফেবু ওপেন করে রাখছে আর সমানে প্রেমালাপ চালিয়ে যাচ্ছে। কিভাবে তার ফোন আমার আমার হাতে আসলো এটা কিন্তু আবার জানতে চাইবেন না।

এহ, গল্প তো এখন জমে উঠছে। বেশ একটা রসের সাড়া পাচ্ছি।বলেন, বলেন...

আর না, আজকের মতো এটুকুই থাক। আমার ভারি তেষ্টা পেয়েছে। এই সেই কখন থেকে আপনার সাথে কথা বলছি,গলা শুকিয়ে কাঠ। চলেন, গলাটা একটু ভিজিয়ে আসি...



লেখক পরিচিতি
মালেকা পারভীন

বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা। বর্তমানে ব্রাসেলস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সেলর হিসেবে কর্মরত।
মূলত ছোট গল্প লিখে থাকেন। কবিতাও তার আরেক ভালোবাসা। বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য সাময়িকী ও পত্রিকা এবং অনলাইন ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখে থাকেন।

গল্পগ্রন্থঃ সিদ্ধান্ত ( ২০১২),

অনুধাবনের মতো কিছ(২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি বইমেলায় জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত)























একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ