শামীম আহমেদের লখিন্দর গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া

হুমায়ূন কবির


শামীম আহমেদের অনেকেগুলো গল্প আমি পাঠ করেছি। এবং তা গল্পপাঠ-এ। এর মধ্যে তার মধ্যে ‘লখিন্দর’ গল্পটি আমাকে বেশি আকর্ষণ করেছে। এই গল্পটি পড়লেই মনে এক অন্য অনুভুতির সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে গল্পে লখাই চরিত্র, গ্রামীণ মানুষের জীবন চিত্রায়ন, তার ভেতরে মানুষের মনোস্ততত্ত্ব ইত্যাদি ভাল পাঠকে আকর্ষণ করে।


গল্পের প্রথম দিকে লখাই এর জীবনের করুন পরিণতির উল্লেখ আছে। মাঝের দিকে পরিণতির কারণ এবং সর্বশেষে তার জীবন ফিরে পাওয়ার আকুতি লক্ষ্য করা যায়। প্রথমে লখাই এর প্রচন্ড ক্ষুধাতুর দৃষ্টি মীরদের বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু গরিবরা তো সব জায়গায় অবহেলিত। তাদের দিকে কারো দৃষ্টি পড়ে আবার পড়ে না। তাদের সাথে কুকুর, বিড়াল এমনকি ইদুরের সাথেও অনেকে তুলনা দেয়। গল্পে এক সময় দেখা যায় কুকুরেরা অনেক বিরক্ত করছিল বিয়ে বাড়িতে। এই কুকুরগুলোকে আবার লখাই নিজে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। একবেলা সুস্বাদু খাবারের আশায়।

কিন্তু এক সময় ছিল যখন তাদের নিজের জমিজমা ছিল। তার বাবা অনেক ধনী না থাকলেও খাবারের আশায় কারো বাড়ি এই ভাবে পড়ে থাকতো হত না। তার বাবা এই সব পছন্দও করত না। তাই তো মাড়া যাবার আগে তার বাবা তাকে হাত ধরে বলেছিল ‘বাপ রে, বুদ্দি-হুঁশ করে চলোস; পরের কতায় নাচোস না।’ তার বাবার এই কথাগুলো স্মরণ থাকলে হয়তো তাকে এইভাবে কারো বাড়ি কুত্তার মত পড়ে থাকতে হত না। লেখক হয়তো এখানে লখাই এর চরম পরিণতিকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন। এবং সেটা তিনি অতান্ত্য সুনিপুণ ভাবে প্রকাশ করতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয়েছে।

গল্পের মাঝে লখাই এর বিয়ের কথা বলা আছে। যেখানে মেম্বর তাকে ফাদে ফেলে নিজের গর্ভবতী ভাগ্নীকে গোপনে বিয়ে দেয় লখাইয়ের সাথে। এমনকি লখাইয়ের জীবন বিয়ের পর থেকেই যে দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পরে তারও উল্লেখ রয়েছে গল্পে। তার সব সম্পত্তি ও লিখে নেয় মেম্বর তার ভাগ্নী নামে। যখন বুঝতে পারে তখন আর সময় থাকে না লখাইয়ের। তাকে সব কিছু হারিয়ে পথে বসতে হয়।

মাঝে এক সময় ছোট মিয়ার আবির্ভাব ঘটে। সে কুকুরদের কে এক ধরনের পাউডার মিশ্রিত ভাতের মাড় খাওয়াতে দেয়। লখাই এর খাবারের সাথেও ঐ পাউডার মিশিয়ে দেয় ।এতে করে তার প্রচন্ড ঘুম এসে যায়। সে ঘুমের মধ্যে অনেক স্বপ্ন দেখে। সেগুলো তার কাছে স্বাদহীন মনে হয়। তবুও লেখক তাকে এই স্বপ্নগুলো দেখায়।

লখাইয়ের ভিতর যৌনানুভুতি তা প্রবল আকারে ধরা পরে গল্পে শেষের দিকে। যখন মাইকে হিন্দি গানের পাশাপাশি বলা হয় যে ‘যৌন দুর্বলতায় ক্ষেত্রে তারা যথা চেষ্টা করবে’ তখন লখাই দৌড়ে ছুটে তার দিকে। কিন্তু পরক্ষণে মনে পড়ে তানু তো তাকে ঘরেই ঢুকতে দেয় না। তার কি আর মিলনের সৌভাগ্য আছে। তবুও সে আশা ছাড়ে নি। সে ছুটে যায়। যদি কোন উপায় বলে দেয় ছেলেটা। ছেলেটা একটা উপায়ও বলে দেয় কিন্তু সেখানে অনেক টাকার ব্যাপার থাকে। তাই সে হতাশ হয় ।সে টাকার জন্য মেম্বরের পিছন পিছন ঘুরে কিন্তু লাভ হয় নি।

এই গল্পটি শেকড়ছেঁড়া মানুষের, যারা লখাইয়ের মত, তাদের জন্য। লেখক এইখানে গরীব-দুঃখী, অধিকার বঞ্চিত মানুষের কথা বলেছেন। যারা দু’বেলা খাওয়ার জন্য পৃথিবীর জঘণ্যতম কাজ করতেও দ্বিধা করে না। তারা অন্যের দাসী হতেও দ্বিধা করবে না।

মানুষেরা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে বা নিজের স্বার্থের জন্য অন্যের ক্ষতি করতে একটুও পিছপা হয় না। এটা আদিম যুগ থেকেই চলে আসছে। বর্তমানেও একই অবস্থা। ভবিষ্যৎ এ ও একই থাকবে।

এই গল্পে মেম্বর তার ভাগনীর কলংক ঢাকতেই লখাই এর মত সহজ সরল মানুষকে বেছে নেয়। কারণ বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে এই সরল মানুষগুলোই সারাজীবন মার খেয়ে যায় বা যাবে। তাদের প্রতিবাদের ভাষাও হারিয়ে ফেলে, সর্বোচ্চ হারিয়ে। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলোয় মরিচীকা ধরে যায়। সেই মরিচীকা আর ঘষেও পরিস্কার করা যায় না।

আর ছোট মিয়ার মত মানুষেরা সর্বদা নিম্ন শ্রেণির লোকদের জানোয়ারের সাথে তুলনা করে থাকে। তারা মনে করে যাদের টাকা-পয়সা নেই তারা মানুষ না। আসলে কারা মানুষ এই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যায়।

দুইটা হাত-দুইটা পা-চোখ-নাক-কান-কথা বলার জন্য একটি জিহ্বা আর দুইটি ঠোট বা সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেই সে মানুষ হয়ে উঠে না। বিবেক বলে একটি কথা থেকেই যায়। যেখানে সকল প্রশ্নের উত্তর জমা রয়েছে ।০


লেখক পরিচিতি
হুমায়ূন কবির

সাহিত্যে উৎসাহী তরুণ হুমায়ূন কবির। কবিতা ও গল্প লিখার চেষ্টার করছে। গোয়েন্দা ধারায় মিশেলে গ্রামীন আবহের গল্প লেখার চেষ্টা। জন্ম ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার কঠুরী গ্রামে। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ