শিহাব শাহরিয়ার
সন্ধ্যা তখন। ফাল্গুনের ভর সন্ধ্যা। কিন্তু নিয়নের আলোয় এই সন্ধ্যার খেদ বোঝা যায় না। তারপর আবার বইমেলার প্রাঙ্গণ। তারপর আবার লেখক আড্ডায় মশগুল। পুরনো কড়ই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আমরা কয়েক জন লিখিয়ে বন্ধু-- কবি কুমার চক্রবর্তী, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি সোহেল হাসান গালিব ও আমি আড্ডা দিচ্ছিলাম। সম্ভবত আমরা তখন প্রতিক্রিয়াশীল কয়েকজন তরুণ লেখক-প্রকাকশকে নিয়ে কথা বলছিলাম। এসময় কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর এলেন। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে, হাতের ব্যাগ থেকে তাঁর সম্পাদিত ‘কথা’র সর্বশেস ‘কমলকুমার মজুমদার’ সংখ্যা আমাদের প্রত্যেকের হাতে বিনিময় মূল্য ছাড়াই তুলে দিলেন। তারপর চলে গেলেন ওদিকটায়। কথা তেমন বললেন না।
তাঁর মৃত্যুর খবরটা পেলাম ফেসবুকে কথাশিল্পী স্বকৃত নোমানের আবেগি একটি স্টেটাসে। বুকটা ভারী হয়ে গেল। মনে পড়ল সেদিনের সন্ধ্যার কথা, সেটিই তাহলে তার সঙ্গে শেষ দেখা হলো? আর কোনোদিন দেখা হবে না? স্টেটাসটা পড়ে দেখলাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন, পথেই হার্টঅ্যাটাক করেছেন, তারপর মৃত্যুবরণ করেছেন। পেশায় ডাক্তার তিনি। অনেকের প্রশ্ন ডাক্তার হয়েও কি চেকআপে ছিলেন না। আমি বলি কি মৃত্যুটা কোনো পেশাকেই মানে না, কোনো বয়সকেই মানে না। তা না হলে ৫০ উর্ধ্ব একজন নিভৃতচারী মানুষ কিভাবে চলে গেলে অনন্তের পথে!
তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা ছিল না। তিনি কথাশিল্পী ও ছোটকাগজ ‘কথা’র সম্পাদক এই পরিচয়টিই আমার কাছে অনেক বড় ছিল। তাঁর গল্পও পড়েছি, কাগজটিও দেখেছি। কিন্তু জমিয়ে কথা বলা কখনো হয়ে উঠেনি। তাই তাঁর সর্বশেষ দেয়া এবং সর্বশেষ কথার সংখ্যাটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলেই তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করতে চাই।
‘কথা’র এটি ডিসেম্বর ২০১৪, অঘ্রাণ ১৪২১ কমলকুমার মজুমদার সংখ্যা। আপনারা জানেন, কথা কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ। এই সংখ্যাটিও তাই বাংলা সাহিত্যেও এমন একজন বিরলপ্রজ কথাশিল্পীকে নিয়ে করেছেন, যা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। কলেবের ছোট হলেও, কমলকুমারকে নিয়ে আমি বলবো, একটি চমৎকার সংখ্যা এটি। কমলকুমারের চিত্র অবলম্বেনে এটির প্রচ্ছদ করেছেন হিরন মিত্র। সূচিতে রয়েছে-- কমলকুমার বিষয়ে সাক্ষাৎকার, কমলকথা, পুনর্পাঠ, সেমিনার : কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ ও কমলকুমারের জীবনকথা ও গ্রন্থপঞ্জী।
সাক্ষাৎকার পর্বে কমলকুমার সম্পর্কে বলেছেন : হাসান আজিজুল হক, রফিক কায়সার, মনিরা কায়েস, সাজ্জাদ শরিফ, ওয়াসি আহমেদ, চঞ্চল অশরাফ, আহমেদ মুনীর, ভাগ্যধন বড়–য়া, রিপন মিনহাজ ও নির্ঝও নৈঃশব্দ। ‘কমলকথা’ পর্বে কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে লিখেছেন মামুন হুসাইন, ইমতিয়ার শামীম, শৈবাল চৌধুরী, হামীম কামরুল হক ও আহমেদ জসিম। ‘পুনর্পাঠ’ পর্বে রয়েছে-- সাক্ষাৎকার : কমলকুমার মজুমদার, অগ্রন্থিত গল্প : স্বাতি নক্ষত্রে জল, কমলকুমার মজুমদার : বাংলা বই প্রসঙ্গক্রমে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : আমার লেখা ও কমলকুমার এবং শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় : খালাসিটোলা ও কমলকুমার, ‘সেমিনার’ পর্বে এখনও কোথাও মায়া রহিয়া গেল। আর সবশেষে কমলকুমারের জীবন গ্রন্থের পরিচিতি রয়ে।
‘লীলায় দ্রোহে প্রেরণায় আমরা একজন কমলকুমার মজুমদারকে স্মরণ করছি’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর লিখেছেন বা বলেছেন, ‘ আমরা পালন করছি তার জন্মশত বার্ষিকী-- এ যেমন অতিশয় আনন্দের বিষয়, তেমনি তা প্রশ্নহীনও তো নয়। আমরা তাকে ভালবাসার চেয়েও ভালবাসি, তাকে বাসনা করি, তবে তা প্রশ্নাতীত নয়। তাকে আমরা জানতে চাই, তার বিষয়ে আমাদেও মগ্নতা আছে, কিন্তু মুগ্ধতা নাই। মুগ্ধতা এক দয়াহীন, প্রশ্নহীন সমর্পণের নাম। ... আমরা চেয়েছি তার প্রতি একধরনের ভালবাসার প্রকাশ ঘটাতে, একটা স্বতন্ত্র ঘরানার সাহিত্যবোধ আর কলোনিয়াল প্রভাবের বাইরের একটা সাহিত্যসত্তার সাথে সাহিত্যপ্রেমীদেও পরিচয় করিয়ে দিতে। আমরা চাই, কমলবিষয়ে আরও পাঠ হোক। তার বিষয়ে কথার ইশারা কেবল নয়, সামগ্রিক একটা তন্ময়তা যেন আমাদের ঘিরে রাখে। আমরা তার সম্পর্কে টোটাল একটা বোধের ভিতর থাকতে চাই।তাতে ধর্মমুখর একটা হতচকিতাকে নিজেদের ভিতর খণ্ডিত ভাবে ক্ষণকালের জন্য হলেও হয়ত নিয়ে আসতে হবে। একটা সাহিত্যেও ধরাকে তো আত্মস্থ করতে পারলাম আমরা।’
খুব ছোট্ট পরিসরে কমলকুমার মজুমদারকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সম্পাদক কোনো কার্পণ্য করেননি। একজন কথাশিল্পী হয়ে পূর্বসূরি কথাশিল্পীকে নিয়ে তার এই প্রয়াসকে স্বাগত জানাতেই হবে। কিন্তু সম্পাদককে সরাসরি স্বাগত জানাতে পারছি নাতো! কারণ এই সফল প্রয়াসের প্রশংসা পাওয়ার আগেই তিনি অনন্তের পথে হেঁটে গেলেন। তার সঙ্গে কতা বলার সুযোগ আছে কি? নেই। শুধু এইটুকু বলেই শেষ করি-- বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ দড়ির তিনিও একজন সুতা, তাকে আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি আসুন।
সন্ধ্যা তখন। ফাল্গুনের ভর সন্ধ্যা। কিন্তু নিয়নের আলোয় এই সন্ধ্যার খেদ বোঝা যায় না। তারপর আবার বইমেলার প্রাঙ্গণ। তারপর আবার লেখক আড্ডায় মশগুল। পুরনো কড়ই গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আমরা কয়েক জন লিখিয়ে বন্ধু-- কবি কুমার চক্রবর্তী, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি সোহেল হাসান গালিব ও আমি আড্ডা দিচ্ছিলাম। সম্ভবত আমরা তখন প্রতিক্রিয়াশীল কয়েকজন তরুণ লেখক-প্রকাকশকে নিয়ে কথা বলছিলাম। এসময় কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর এলেন। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে, হাতের ব্যাগ থেকে তাঁর সম্পাদিত ‘কথা’র সর্বশেস ‘কমলকুমার মজুমদার’ সংখ্যা আমাদের প্রত্যেকের হাতে বিনিময় মূল্য ছাড়াই তুলে দিলেন। তারপর চলে গেলেন ওদিকটায়। কথা তেমন বললেন না।
তাঁর মৃত্যুর খবরটা পেলাম ফেসবুকে কথাশিল্পী স্বকৃত নোমানের আবেগি একটি স্টেটাসে। বুকটা ভারী হয়ে গেল। মনে পড়ল সেদিনের সন্ধ্যার কথা, সেটিই তাহলে তার সঙ্গে শেষ দেখা হলো? আর কোনোদিন দেখা হবে না? স্টেটাসটা পড়ে দেখলাম ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন, পথেই হার্টঅ্যাটাক করেছেন, তারপর মৃত্যুবরণ করেছেন। পেশায় ডাক্তার তিনি। অনেকের প্রশ্ন ডাক্তার হয়েও কি চেকআপে ছিলেন না। আমি বলি কি মৃত্যুটা কোনো পেশাকেই মানে না, কোনো বয়সকেই মানে না। তা না হলে ৫০ উর্ধ্ব একজন নিভৃতচারী মানুষ কিভাবে চলে গেলে অনন্তের পথে!
তাঁর সঙ্গে আমার ঘনিষ্টতা ছিল না। তিনি কথাশিল্পী ও ছোটকাগজ ‘কথা’র সম্পাদক এই পরিচয়টিই আমার কাছে অনেক বড় ছিল। তাঁর গল্পও পড়েছি, কাগজটিও দেখেছি। কিন্তু জমিয়ে কথা বলা কখনো হয়ে উঠেনি। তাই তাঁর সর্বশেষ দেয়া এবং সর্বশেষ কথার সংখ্যাটি নিয়ে কয়েকটি কথা বলেই তাঁকে গভীরভাবে স্মরণ করতে চাই।
‘কথা’র এটি ডিসেম্বর ২০১৪, অঘ্রাণ ১৪২১ কমলকুমার মজুমদার সংখ্যা। আপনারা জানেন, কথা কথাসাহিত্যের ছোটকাগজ। এই সংখ্যাটিও তাই বাংলা সাহিত্যেও এমন একজন বিরলপ্রজ কথাশিল্পীকে নিয়ে করেছেন, যা সত্যি প্রশংসার যোগ্য। কলেবের ছোট হলেও, কমলকুমারকে নিয়ে আমি বলবো, একটি চমৎকার সংখ্যা এটি। কমলকুমারের চিত্র অবলম্বেনে এটির প্রচ্ছদ করেছেন হিরন মিত্র। সূচিতে রয়েছে-- কমলকুমার বিষয়ে সাক্ষাৎকার, কমলকথা, পুনর্পাঠ, সেমিনার : কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ ও কমলকুমারের জীবনকথা ও গ্রন্থপঞ্জী।
সাক্ষাৎকার পর্বে কমলকুমার সম্পর্কে বলেছেন : হাসান আজিজুল হক, রফিক কায়সার, মনিরা কায়েস, সাজ্জাদ শরিফ, ওয়াসি আহমেদ, চঞ্চল অশরাফ, আহমেদ মুনীর, ভাগ্যধন বড়–য়া, রিপন মিনহাজ ও নির্ঝও নৈঃশব্দ। ‘কমলকথা’ পর্বে কমলকুমার মজুমদার সম্পর্কে লিখেছেন মামুন হুসাইন, ইমতিয়ার শামীম, শৈবাল চৌধুরী, হামীম কামরুল হক ও আহমেদ জসিম। ‘পুনর্পাঠ’ পর্বে রয়েছে-- সাক্ষাৎকার : কমলকুমার মজুমদার, অগ্রন্থিত গল্প : স্বাতি নক্ষত্রে জল, কমলকুমার মজুমদার : বাংলা বই প্রসঙ্গক্রমে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস : আমার লেখা ও কমলকুমার এবং শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় : খালাসিটোলা ও কমলকুমার, ‘সেমিনার’ পর্বে এখনও কোথাও মায়া রহিয়া গেল। আর সবশেষে কমলকুমারের জীবন গ্রন্থের পরিচিতি রয়ে।
‘লীলায় দ্রোহে প্রেরণায় আমরা একজন কমলকুমার মজুমদারকে স্মরণ করছি’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর লিখেছেন বা বলেছেন, ‘ আমরা পালন করছি তার জন্মশত বার্ষিকী-- এ যেমন অতিশয় আনন্দের বিষয়, তেমনি তা প্রশ্নহীনও তো নয়। আমরা তাকে ভালবাসার চেয়েও ভালবাসি, তাকে বাসনা করি, তবে তা প্রশ্নাতীত নয়। তাকে আমরা জানতে চাই, তার বিষয়ে আমাদেও মগ্নতা আছে, কিন্তু মুগ্ধতা নাই। মুগ্ধতা এক দয়াহীন, প্রশ্নহীন সমর্পণের নাম। ... আমরা চেয়েছি তার প্রতি একধরনের ভালবাসার প্রকাশ ঘটাতে, একটা স্বতন্ত্র ঘরানার সাহিত্যবোধ আর কলোনিয়াল প্রভাবের বাইরের একটা সাহিত্যসত্তার সাথে সাহিত্যপ্রেমীদেও পরিচয় করিয়ে দিতে। আমরা চাই, কমলবিষয়ে আরও পাঠ হোক। তার বিষয়ে কথার ইশারা কেবল নয়, সামগ্রিক একটা তন্ময়তা যেন আমাদের ঘিরে রাখে। আমরা তার সম্পর্কে টোটাল একটা বোধের ভিতর থাকতে চাই।তাতে ধর্মমুখর একটা হতচকিতাকে নিজেদের ভিতর খণ্ডিত ভাবে ক্ষণকালের জন্য হলেও হয়ত নিয়ে আসতে হবে। একটা সাহিত্যেও ধরাকে তো আত্মস্থ করতে পারলাম আমরা।’
খুব ছোট্ট পরিসরে কমলকুমার মজুমদারকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সম্পাদক কোনো কার্পণ্য করেননি। একজন কথাশিল্পী হয়ে পূর্বসূরি কথাশিল্পীকে নিয়ে তার এই প্রয়াসকে স্বাগত জানাতেই হবে। কিন্তু সম্পাদককে সরাসরি স্বাগত জানাতে পারছি নাতো! কারণ এই সফল প্রয়াসের প্রশংসা পাওয়ার আগেই তিনি অনন্তের পথে হেঁটে গেলেন। তার সঙ্গে কতা বলার সুযোগ আছে কি? নেই। শুধু এইটুকু বলেই শেষ করি-- বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ দড়ির তিনিও একজন সুতা, তাকে আমরা মনে রাখার চেষ্টা করি আসুন।
0 মন্তব্যসমূহ