মনোজিৎকুমার দাস
নাইজেরিয়ার কালজয়ী কথাসাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে (১৬ নভেম্বর ১৯৩০-২১ মার্চ ২০১৩) বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে উপনিবেশবিরোধী অবস্থানের জন্যে বিশেষভাবে সুখ্যাত। এই লেখকের কালজয়ী গ্রন্থগুলো হলো : 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট', 'অ্যারো অব গড', 'নো লংগার অ্যাট ইজ' , 'অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা', 'গালর্স অ্যাট বায়াফ্রা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ', 'দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ' ইত্যাদি।
নাইজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ওগিদি আনাবগ্রা স্টেট-এ ১৯৩০-এর ১৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আচেবে। পরিবারের লোকজন ইবো বা ইগবো ভাষায় কথা বলতেন কিন্তু আচেবে আট বছর বয়স থেকে স্কুলে ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। ফলে পরবর্তীকলে তিনি উপনিবেশিকদের পরিচালিত বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিল। তাদের মাতৃভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও তারা উপনিবেশকারীদের ভাষায় কথাবার্তা বলত। আচেবে লেখেন যে তিনি সেখানে প্রথমেই কলোনিয়ালিস্ট ক্ল্যাসিক উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলেন। 'আফ্রিকান লিটারেচার অ্যাজ রেস্টোরেশন অব সেলিব্রেশন' প্রবন্ধে তিনি লেখেন, 'শুরুতে আমি নিজেকে একজন আফ্রিকান হিসাবে দেখতে চাইতাম না। শ্বেতাঙ্গ মানুষ উত্তম, বিশ্বাসযোগ্য, বুদ্ধিমান এবং সাহসী। বর্বর অসভ্যরা তাদের বিরুদ্ধে ছিল। তারা ছিল অসৎ, বোকা, ধূর্ত। আমি তাদের নাড়িনক্ষত্রকে ঘৃণা করতাম।' তাঁর এ ধারণা ছিল ভ্রান্ত যা তিনি পরে বুঝতে পারেন।
লেখক হিসাবে চিনুয়া আচেবে আফ্রিকা ও পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির কাজ করেন। বেশকিছু লেখায় তাঁর দেশ নাইজেরিয়ার রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর গ্রন্থগুলোতে নাইজেরিয়ার ঔপনিবেশিক সময়ে ইবো সমাজের ঐতিহ্য, দেশটির সংস্কৃতিতে খ্রিস্টানদের আগ্রাসন ও আধিপত্য এবং আফ্রিকা ও পশ্চিমাদের মধ্যকার প্রথাগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আচেবের প্রথম জীবনীকার ইজেনওয়া-ওহাইতো লিখেছেন--তরুণ আচেবে বেড়ে উঠেন ক্রসরোডস কালচারের ভেতর দিয়ে। তাঁর পিতামাতা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও তাঁর আত্মীয়স্বজনরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ইবো ধর্মেই বিশ্বাসী থাকেন। ওই ধর্মে বিশ্বাসীরা পূজা করতেন বর্মধারী দেবতাদেরকে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত আত্মার নির্দেশনায় চলতেন। এ-আত্মাকে তারা বলতেন--চি। আচেবে তাঁর প্রতিবেশিদের অ- খ্রিস্টীয় বিশ্বাসেও আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
নাইজেরিয়ার ইবো জনগণের মধ্যে এই পুরাণকথা বা মিথটি প্রচলিত আছে--একদিন ইবো'রা সিদ্ধান্ত নেন তাদের প্রধান দেবতা চুকু-র কাছে একটা বার্তা পাঠাবেন। বার্তায় তারা জানতে চান, মৃত মানুষকে জীবন্ত মানুষ হিসাবে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে কি না। চুকু-র কাছে বার্তার বাহক হিসাবে তারা একটা কুকুরকে পছন্দ করে। কিন্তু কুকুরটা যেতে দেরি করে ফেলে। ফলে তারা কুকুরটির পরিবর্তে একটা কটকটে ব্যাঙকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হিসাবে ব্যাঙ প্রথম চুকু-র কাছে পৌঁছয়। মানুষ তাকে শাস্তি দিতে পারে এটা ভেবে ব্যাঙ তাদের অনুরোধ রাখতে সম্মত হয়েছিল। সে চুকুকে বলল যে মৃত্যুর পর মানুষেরা পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায়। দেবতা বললেন যে তিনি তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে চান। তারপর থেকে মানুষ আবার জন্ম গ্রহণ করতে লাগল তবে শুধুমাত্র অন্য এক আকৃতিতে। আচেবে এই মিথটাকে পুনরায় তাঁর লেখায় উপস্থাপন করতে থাকেন। তিনি লিখলেন, বার্তবাহক একটা বহুরূপী সরীসৃপ, একটা টিকটিকি কিংবা অন্য কোনও জন্তু। মাঝেমধ্যে বার্তাটিকেও আকস্মিকভাবে বদলে দিলেন। কিন্তু রূপরেখাটাকে একই রাখলেন। মানুষেরা অমরত্ব চাইলে দেবতা তা অনুমোদন করলেন। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ভুল করায় দেবতার অমরত্ব দান চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়। যে-সব পূর্বপুরুষেরা ভাষা তৈরি করেছিলেন তারা জানতেন --ভাষা নিজেদের রক্ষা করার জন্যে ব্যবহৃত হবে, তাই--ভাষার ব্যবহার সম্বন্ধে সাবধান হতে হবে। আচেবে লেখেন--যখন ভাষা মারাত্মকভাবে আহত হয়, অপব্যবহার করা হয়, তখন তা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, মানবজাতির ওপর পুনরায় দুর্ভোগ নেমে আসে।
আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, আপনার বার্তা সঠিক ভাবে প্রতিভাত হতে পারে, যদি তা-- আপনি আপনার মতো করে বলতে পারেন--এই মিথ আচেবেকে এই শিক্ষাও দিয়েছিল, যা তাঁর ক্যারিয়ারের জন্যে মৌলিক বিষয় ছিল, এজন্যেই তাঁকে আফ্রিকান উপন্যাসের গোষ্ঠীর প্রধান বলা হয়।
চিনুয়া আচেবের মাস্টার পিস, তাঁর প্রথম উপন্যাস-- 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট'। আফ্রিকার অনুষঙ্গে লেখা এই উপন্যাসে বর্তমান আফ্রিকার গ্রাম জীবনের কথা উঠে এসেছে। আচেবে উপনিবেশিক লেখকদের পূর্ব প্রজন্ম থেকে প্রাপ্ত তাঁর দেশের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে লিখে সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেন। পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত গ্রন্থের একটা নতুন সংস্করণ অ্যাঙ্কর থেকে প্রকাশিত হয়, যার মূল্য ছিল ১০.৯৫ ডলার। এ-গ্রন্থটা পঞ্চাশটা ভাষায় অনূদিত হয়ে দশ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।
আচেবে নাজেরিয়ান হিসাবে গর্বিত ছিলেন। তাঁর বহু লেখায় তাঁর পিতৃপুরুষদের ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। চিনুয়া আচেবে পাঁচটি উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতা সংকলন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেন। তাছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষণও প্রদান করেন।তিনি নিজস্ব রীতিতে তাঁর লেখায় আফ্রিকার জনগণের গল্প বলেছেন। ইউরোপীয় লেখকদের প্রতিনিধিত্বকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেননি। তবে তিনি ইউরোপীয় প্রভাব-বলয়কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারও করেননি। তিনি তাঁর দেশীয় ভাষা ইবোতে না লিখে ইংরেজি ভাষায় লিখতে পছন্দ করেন। তিনি বলেছিলেন-- 'ইতিহাস আমাদেরকে বাধ্য করেছে ইংরেজি ভাষা আমাদের গলার কাছে চলে আসতে।' একটা দেশে কয়েকটি প্রধান ভাষা আছে আর পাঁচ শতের অধিক ছোট ছোট ভাষাও আছে, যা বিভিন্ন এলাকার লোকজনদের কথ্যভাষা। আচেবে তাঁর রচনায় ভাষার কারুকার্য দেখিয়েছেন বিশেষ রীতি ও আদলে। তাঁর লেখায় সভ্যতার সংকটের চিত্র উঠে এসেছে বিশেষ অনুষঙ্গে।
ইবাদানের ইউনির্ভাসিটি কলেজে পড়াকালে অ্যাংলো-আইরিশ লেখক জয়েস ক্যারি'র লেখা 'মিস্টার জনসন' উপন্যাসটি পড়ে তার প্রতিপাদ্য বিষয়ে তিনি প্রতিবাদ করেন। জয়েস ক্যারি এক সময় নাইজেরিয়ান কলোনিয়াল অফিসার ছিলেন। অথচ এ উপন্যাসটি সম্বন্ধে টাইম-এ প্রশংসাসূচক কথা বলা হয় এভাবে, 'আফ্রিকার ওপর এ যাবত লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি সর্বোত্তম।' আচেবে কিন্তু বয়স্ক হয়ে কোনক্রমেই আর সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চাননি। তাঁর স্বদেশভুমি ও সেখানকার জনসাধারণ সম্বন্ধে ক্যারি'র মন্তব্যকে ন্যাক্করজনক মনে করেন। ক্যারি সাউথ আফ্রিকানদেরকে 'বর্বর, অসভ্য, রাজপ্রাসাদের ফ্লোরে ইঁদুরের মত বসবাসকারী' হিসাবে চিত্রায়িত করেন। 'নর্তকীদের নাচানাচির মধ্যে অসঙ্গতি, বোধহীন, অমানবীয়' ভাবের প্রকাশ ঘটে। কলোনিয়াল লেখকদের লেখা সাহিত্যে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে অমানবিক, বর্বর বলে অখ্যায়িত করা হয়। আচেবে উপলব্ধি করেন আসলেই এটা বিপদজনক ব্যাপার। পরবর্তীকালে আচেবে লেখেন, 'উপন্যাস কল্পনাপ্রসূত, যা সত্য কিংবা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করেও লিখিত হতে পারে, তাই বলে একটা নিউজ আইটেমের ধ্রুব কিংবা ছলনা থাকবে তাতো হতে পারে না। কিন্তু অনাগ্রহ, অভিপ্রায়, সাধুতা জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না।' উপন্যাসের নৈতিক ক্ষমতাতে এ বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আফ্রিকান সাহিত্যে।
'ওকোনকয়ো' নামের ছেলেটি নয়টা গ্রামসহ বাইরের এলাকাতেও বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। অচেবে'র প্রথম উপন্যাস 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট'-এর প্রথম লাইন--আমরা একটা অপরিচিত ভূখণ্ডে আছি। ওকোনকয়োকে কি প্রত্যেকেই চিনত? নয়টা গ্রাম কোথায় অবস্থিত? আচেবে তাঁর প্রথম উপন্যাস 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়ে লিখতে শুরু করেন যখন, তিনি লাওসে যান নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস যোগদান করতে। ১৯৫৮ সালে যখন তিনি পাবলিসার উইলিয়াম হেইনেম্যানের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দেন তখন কেউ জানতো না তা ছাপা হবে কিনা। অ্যালান হিল, ফার্মের ডিরেক্টর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, 'একজন আফ্রিকানের লেখা উপন্যাস কেনার জন্যে কাউকে কি পাওয়া যাবে? আগে এ ধরনের কোন নজির নেই।' তাঁর মন্তব্যটা মোটেই সঠিক ছিল না । নাইজেরিয়ান আমোস টুটুওলা এবং সিপ্রিয়ান একওয়েনসি প্রথম দশকের দিকে তাদের উপন্যাস প্রকাশ করেন। আফ্রিকান অনুষঙ্গের উপন্যাস তখনও ছিল খুবই প্রাথমিক স্তরে। কিন্তু আচেবের 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট'- সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে, যাতে পুরনো ও নতুন প্রজন্মের জীবন প্রবাহের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ইতিবৃত্ত উঠে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক কালপর্বের কিছু সময়ের ইবো গ্রামগুলোতে একটা ফিকশনাল গ্রুপ তৈরি হয়, যা ইউমুওফিয়া নামে পরিচিত।
'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাস শুরু হয়েছে একটা উপাখ্যানধর্মী দৃশ্যের মাধ্যমে, যা গ্রাম্যজীবনের ওকোনকয়ো'র পরিবারের প্রায় স্বাপ্নিক ইতিবৃত্ত হয়ে উঠে এসেছে। ইকেমেফুনা নামের একটা বালক ইউমুওফিয়া গ্রামের বাইরের গ্রাম থেকে তাদের সাথে বসবাস করার জন্যে আসে এবং ওকোনকয়ো'র ছেলে নরওয়েকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করে। ( ইকেমেফুনা'র বাবা ইউমুওফিয়া থেকে আসা একজন মহিলাকে হত্যা করে, গ্রামবাসীরা এর ক্ষতিপূরণ হিসাবে একজন কুমারী মেয়ে ও একজন তরুণকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়।)
পরবর্তী তিন বছরের বেশি সময় ধরে ফসল তোলার মৌসুমগুলিতে ওকোনকয়ো'র পরিবারে গল্পটি ধর্মীয় ও গার্হস্থ্য অনুষঙ্গে চালু ছিল। তাদের ভাষার রূপকল্প গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতা লব্ধ : ইকেমেফুনা বর্ষাকালে দ্রুত বেড়ে উঠা লতাপাতার মত বেড়ে উঠল এবং জীবন রসে পরিপূর্ণ হলো। ফসল ভাল না হলে গ্রাম জীবনে দুর্দশা চরম । যদি ফসল তোলার মৌসুমটা খারাপ হয় তবে গ্রামবাসীদেরকে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়। শিশুরা বেড়ে উঠার প্রত্যাশা করতে পারে না। ওখানকার কিছু প্রথা নিষ্ঠুর ধরনের। নবজাতক জমজ সন্তানের মধ্যে খারাপ আত্মার অবস্থান ভেবে তাদেরকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দেয়। ইবোদের আচরণ সব সময় ভাল থকে না, অনেক সময় তারা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। ওকোনকয়ো-সহ একদল লোক ইকেমেফুনাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। স্থানীয় দৈববাণী প্রদানকারী লোকটি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয় তাকে হত্যা করতে। বালকটি ভাবে যে, তার বাড়ি ফিরে যাওয়াই ঠিক। কিন্তু সে ভয় পায় এটা ভেবে যে তার মা বাড়িতে স্থান দেবে না। ছেলেটি শান্ত হয়ে শৈশবের খেলা খেলতে শুরু করে। সে নিজের মনে গান গেতে গেতে হাঁটতে থাকে এবং মনে মনে বাজি ধরে। যদি তার গান ডান পা ফেলতেই থেমে যায় তবে তার মা বেঁচে আছে, আর যদি তার বাঁ-পা ফেলতেই থেমে যায় তবে তার মা মারা গেছে। না, মারা যেতে পারে না। ডান পা ফেলতেই গান থেমে গেছে। তাহলে তার মা ভালভাবে বেঁচেবর্তে আছে। সে আবার গান গাইতে গাইতে হাঁটতে থাকে, এবার তার গান শেষ হয় বাঁ-দিকে পা ফেলার কালে। সে দ্বিতীয়বারের হিসাব করে না। ঐতিহ্য জনগণকে সম্মিলিত করে। তার পিতা ইকেমেফুনাক হত্যা করেছিল জানতে পারার পর নয়োয়ি ভাবে, 'মনে হল কিছু তার ভেতরে প্রবেশ করেছে, যেমন শক্ত করে বাঁধা ধনুকের অংশ বিশেষ।' যখন প্রথম মিশনারিরা এসে গীর্জায় যোগদান করতে গিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন। স্থানীয় রীতিনীতি ও প্রথা সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকলেও মিশনারীরা সবাই খারাপ ছিলেন না : বিশেষভাবে তাদের একজন গ্রামবাসীদের সম্মান করতেন। কিন্তু অন্যান্যেরা গ্রামবাসীদের যাপিতজীবন সম্বন্ধে জানার জন্যে যৎসামান্য আগ্রহী ছিলেন। শ্বেতাঙ্গ মানুষটি আমাদের দেশের রীতিনীতি ও প্রথা সম্বন্ধে জানতেন। ওকোনকয়ো ধাঁধায় পড়ে একজন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে-- 'সে আমাদের মাতৃভাষা জানে না তাহলে সে কেমন করে আমাদের সাথে কথা বলবে?' অন্য একজন জবাব দেয়। বইয়ের শেষ অধ্যায়ে উপনিবেশকারীদের কন্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠে; তার কথা শোনার জন্যে চারধারে নীরবতা বিরাজ করে। পশ্চিমা সমালোচকরা আচেবেকে প্রশংসা করেন ইবো-জীবন সম্বন্ধে বিস্তারিত চিত্রাঙ্কন করার জন্যে, কিন্তু তারা তাঁর বইয়ের সাহিত্যিক গুণাবলী সম্বন্ধে কমই বলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস বারবার ওকোনকয়ো'র নাম ভুল বানানে লেখে এবং প্রিমিটিভ সোসাইটির নানা অনুষঙ্গকে অচেবে তাঁর লেখায় তুলে ধরে সমালোচনা করেন। অন্যান্য সমালোচকরা খোলাখুলিভাবে আচেবের লেখার প্রতি বৈরীভাব দেখান। 'ঔপন্যাসিক আচেবে কেমন করে লাওসে তাঁর অত্যাধুনিক ব্রডকাস্টিং কাজের পরিবর্তে ফিরে গেলেন তাঁর পিতামহের আমলের বিস্মৃত সময়ে?' ব্রিটিশ সাংবাদিক অনার ট্রাসি এটাই ছিল জিজ্ঞাস্য। আচেবে'র তৃতীয় উপন্যাস 'অ্যারো অব গড' (১৯৬৪) এর ত্রিমাত্রিক ভাবধারায় লেখা। একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় এ উপন্যাসটি থিংকস ফল অ্যাপার্ট-এর উত্তরসূরী। 'নো লঙ্গার অ্যাট ইজ' (১৯৬০)-এর ভাষা সম্বন্ধে সমালোচনা থাকলেও তাতে লোক ঐতিহ্যের ধারা বর্তমান। ১৯৬৫ সালে লেখা আচেবের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলন 'দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ' বের হয়।
আচেবে বলেন--একজন ন্যাটিভ স্পিকার হিসাবে ইংরেজি লেখার ইচ্ছে ছিল না। বরং, একজন আফ্রিকান লেখকের লক্ষ্য হওয়া উচিত তার বিশেষ অভিজ্ঞতাকে ইংরেজির মাধ্যমে প্রকাশ করা। তিনি এ প্রসঙ্গে 'অ্যারো অব গড' থেকে উদ্ধৃতি দেন : গ্রামের প্রধান ধর্মযাজক ইজেইউলু গ্রামের নতুন মিশনারীদের কাজকর্ম সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে উৎসুক ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি আমার এক ছেলেকে এসমস্ত লোকদের সঙ্গে যোগদান করে তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাতে চাইলাম। তাকে বললাম যদি তাদের মধ্যে কোন কিছু না দেখ তবে ফিরে আসবে। আর যদি তাদের মধ্যে কোন কিছু ভাল দেখ তবে আমার অংশটা বাড়িতে নিয়ে আসবে। পৃথিবীটা হচ্ছে একটা মুখোশের মত, যা নৃত্য করছে। যদি তুমি এর মধ্যে ভাল কিছু দেখতে চাও তবে তুমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার আত্মা আমাকে বলেছে যে আজকের দিনে যারা শ্বেতাঙ্গ মানুষের বন্ধুভাবাপন্ন নয় তাদের দিয়ে বলানো হবে আমরা আগামীকাল জানব। তারপর পুনরায় আচেবে অনুচ্ছেদটি রঙে রঙে চিত্রায়িত করেন। অপরিচিত পন্থায় ইংরেজি শব্দগুচ্ছের ভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করে ওই ভাষার মাধ্যমে আচেবে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো তুলে ধরেছেন। ইরেজির পর আচেবের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয় না। ১৯৬২ সালে উগান্ডাতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান সাহিত্যের ওপর অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে আফ্রিকান সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে নাইজেরিয়ার কবি ও প্লে-রাইটার ওলে সোয়িনকি এবং ক্যানিয়ার ঔপন্যাসিক জেমস নগুগি প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। লেখকেরা সচেষ্ট হয়েও আফ্রিকান সাহিত্যেকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ হন। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না আফ্রিকান সাহিত্যের লেখকদের জাতীয়বাদী চরিত্রকে এবং বিষয়বস্তুকে। পরবর্তীকালপর্বে সাহিত্য সমালোচক ওবি ওয়ালি এক লেখায় দাবি করেন যে আফ্রিকান সাহিত্য কানাগলিতে গিয়ে আবদ্ধ হয়েছে। এ কানাগলি থেকে বের হয়ে আসতে গেলে এ সমস্ত লেখকরা ও তাদের পশ্চিমা ধাত্রীরা সত্যিটাকে স্বীকৃতি দিলে আফ্রিকান সাহিত্য অবশ্যই আফ্রিকান ভাষায় লিখিত হত। তারা তাঁর কথায় সম্মত হন। জেমস নগুগি চারটি উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন, কিন্তু সাতানব্বই সালে তিনি তাঁর দেশীয় ভাষা গিকুয়ু এ 'ওয়া থিওংও' নামে বইটি লেখেন, যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় 'আত্মার বশীভুত'।
কনফারেন্সে আচেবে নগুগি'র প্রথম উপন্যাস 'উইপ নট, চাইল্ড'-এর পাণ্ডুলিপি পাঠ করেছিলেন এবং তা ছাপানোর জন্যে হেইনেম্যান পাবলিসারকে সুপারিশ করেন। পাবলিসার তাড়াতাড়িই তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন লেখককে দশ বছর কোন প্রকার সম্মানি না দেওয়ার শর্তে। তাঁর সময়ে যাদের উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল তারা ছিলেন ফ্লোরা এনওয়াপা, জন মুনোনয়ে এবং এয়ি কেওএই আর্মাহ। আফ্রিকার উদীয়মান সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। হেইনেম্যানের অ্যালান হিল পরবর্তীতে বলেন--আচেবে'র বইয়ের অকল্পনীয় বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি ভাষার আবেদন পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছিল না। একটা বড় মাপের উপন্যাস সম্বন্ধে আচেবে পারবর্তীতে যুক্তি দেখান এই বলে যে পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ইবো, গিকুয়ু কিংবা ফান্তে ভাষার আন্তর্জাতিক আবেদন নেই; অথচ ইংরেজি সেটা আছে। নাইজেরিয়াতে রাজনৈতিক আধিপত্যের দায়বদ্ধতা তেমনটা নেই। দীর্ঘদিনের লড়াই সংগ্রামের পর নাইজেরিয়া ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৭ সালে দু-দুটো ক্যু ঘটে। যার ফলে ইবোদের বিরুদ্ধে গণহত্যাও ঘটে। ইবোল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করে রিপাবলিক অব বায়াফ্রা নামে। আচেবে নিজেও সন্ত্রাসকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন, আচেবে এ-অবস্থার প্রেক্ষাপটে 'এ ম্যান অব দি পিপল' ( ১৯৬৬) নামে একটা রাজনৈতিক ব্যঙ্গকাব্য রচনা করেন, যাতে তিনি ভবিষ্যতবাণী করেন যে ক্যু ঘটে যেতে পারে। সত্যি সত্যি ক্যু ঘটে যাওয়ায় কেউ কেউ বিশ্বাস করলেন যে আচেবে এ ক্যুয়ের পরিকল্পনাকারী। তিনি বায়াফ্রানদের জন্যে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেন। এক সময় তিনি উপন্যাস লেখা বন্ধ রেখে কবিতা ও গল্প লিতে শুরু করেন। আচেবে লন্ডন সফর করেন যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে। ১৯৬৯ সালে তিনি 'প্রিন্সিপাল অফ দি বায়াফ্রান রেভ্যুলেশন' সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণা লিখতে সাহায্য করেন। যুদ্ধ-বিগ্রহরত জাতিটি অনাহার ক্লিষ্ট অবস্থায় ছিল, ব্রিটিশ সমর্থিত নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনী রাস্তাঘাট ও বন্দরগুলি ব্লক করে রেখেছিল। ১৯৭০ সালে বায়ফ্রানদেরকে চুড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় নিহত ইবোদের সংখ্যা ছিল এক মিলিয়ন থেকে তিন মিলিয়নের মধ্যে। দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে 'দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এ কোনোর ক্রুস ও বিরেন-এর পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার লোক নিহত হয়, তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। এ লড়াইয়ে যারা ভোগান্তির শিকার হয় তাদের প্রোটিন ঘাটতির ফলে কওয়াশিওরকোর, পেট মোটা, ফ্যাকাশে ত্বক, চুল লালচে হয়ে যায়। আচেবের কবিতা 'রিফ্যুজি ক্যাম্পে একজন মা' কবিতায় সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন মহিলায় প্রচেষ্টার আকুতি এভাবে ধরা পড়ে :
মহিলাটি তাদের পোটলা থেকে একটা ভাঙা চিরুণী বের করে তার মাথার ধুলোবালিতে ভরা চুলগুলো আঁচড়ে তার চোখ দুটো সচেতনভাবে তা সরিয়ে নেয়।
তাদের সাবেককালে সম্ভবত তাদের জীবনে দৈনন্দিন কাজ ছিল ছেলেটির ব্রেকফাস্ট ও স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত করা আর এখন সে যা করছে তা ছোট্ট একটা কবরে ফুল দেবার মতো।
বায়াফ্রা'র পতন নাইজেরিয়ান সোসাইটির ভিতকে নাড়িয়ে দেয় এবং এক দশকের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থাকেও নাড়া দিয়ে যায়। আচেবে সুযোগবুঝে অস্থায়ীভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেন, সাতানব্বইয়ের প্রথম দিকের একটা অংশে শিক্ষাদান কাজের জন্যে তিনি আমেরিকায় থাকতে থাকেন। এসময় তিনি তাঁর প্রবন্ধ, লেকচারে উপনিবেশিক শাসনের শোষণ শাসনের চিত্র উপস্থাপন করেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে 'আর্ট ফর আর্ট সেক' জাতীয় ইউরোপিয়ান মর্ডানিজমের পক্ষে ছিলেন না আচেবে । তিনি সব সময়ই এমন এক সাহিত্যের কথা বলেছেন যা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রেরণাদায়ক। তিনি বলেন, উপনিবেশিকতার ভূত তাড়ানোর জন্যে কাজ করা উচিত। আচেবে ১৯৮০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেন, 'আমাদের জন্যে সাহিত্য বিলাসিতা নয়। এটা জীবন মৃত্যুর বিষয়, কারণ আমরা এক একজন রুচিশীল মানুষ।' তাঁর লেখা শেষ দিকের উপন্যাস 'অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা' (১৯৮৭)-এ তিনি পরিষ্কারভাবে এ কথাটাই বলেন। একদল বন্ধু যারা পশ্চিম আফ্রিকার নাইজেরিয়ার পাশের দেশ কঙ্গান-এর সরকারি অফিসে কর্মরত ছিলেন, তারা সামের ক্যু'র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশের হাল ধরেন এবং দ্রুতই একনায়ক হওয়ার পথে ধাবিত হন। তথ্যমন্ত্রী ক্রিস সামের পক্ষ নিয়ে ইলকেমের বিরোধিতার করার কথা প্রত্যাখান করলে সরকার নিয়ন্ত্রিত খবরের কাগজগুলোর সম্পাদকরা ওই দু'জনের কারোই পক্ষে না গিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের পক্ষ নেন। বইটিতে আফ্রিকার রাজনীতিতে ঘুষ ও স্বজনপোষণের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন।
আচেবে তাঁর লেখা উপন্যাসে অবশ্যই দেশীয় আবহের অবতারণা করতে সচেষ্ট হন। তাঁর এই প্রবণতা অন্যান্য লেখকদের দ্বারা সমালোচিত হলেও তিনি তাদের অনেকের লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিশেষ করে আউই কেওয়া আরমাহ'র প্রতি তাঁর উপন্যাস 'দ্য বিউটিফুল ওয়ানস আর নট ইয়েট বর্ণ' (১৯৬৮)-এর জন্যে, যাতে আরমাহ ঘানার উপনিবেশোত্তর ঘানার একটা ভিশনের কথা তুলে ধরেন। ১৯৯০ সালে আচেবে মারাত্মক কার দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা চিকিৎসার জন্যে তাঁকে আমেরিকা যাবার পরামর্শ দেন। মূলত সে সময় থেকে তিনি আমেরিকায় বসবাস করে আসছিলেন । তিনি অধিকাংশ সময়ই সেখানকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সে সময় তিনি প্রবন্ধ সংকলন 'হোম এন্ড এক্সাইল' প্রকাশ করেন। তিনি নতুন প্রজন্মের লেখকদেরকে আফ্রিকান সাহিত্যে নতুন নতুন মাত্র যোগ করতে আহ্বান জানান। অনেকেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আফ্রিকার উপনিবেশিক আমলের শোষণ শাসনের চিত্র তুলে ধরতে এগিয়ে আসেন। প্রসঙ্গক্রমে চিমামানডা এগোজি অডিচি'র লেখা 'হাফ অব এ ইয়েলো সান' উপন্যাসের কথা বলতে হয়। অডিচি'র এ-উপন্যাসে বায়াফ্রান যুদ্ধের বাস্তব চিত্র অংকন করে তিনি বায়াফ্রান'স অরেঞ্জ প্রাইজ লাভ করেন।
আচেবে 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাসটি লেখার পঞ্চাশ বছর পরও পৃথিবীর পরিস্থিতি বদলায়নি।
লেখক পরিচিতি
মনোজিৎকুমার দাস
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গল্পকার ও কবি
লাঙ্গলবাঁধ , শ্রীপুর , মাগুরা।
নাইজেরিয়ার কালজয়ী কথাসাহিত্যিক চিনুয়া আচেবে (১৬ নভেম্বর ১৯৩০-২১ মার্চ ২০১৩) বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে উপনিবেশবিরোধী অবস্থানের জন্যে বিশেষভাবে সুখ্যাত। এই লেখকের কালজয়ী গ্রন্থগুলো হলো : 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট', 'অ্যারো অব গড', 'নো লংগার অ্যাট ইজ' , 'অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা', 'গালর্স অ্যাট বায়াফ্রা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ', 'দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ' ইত্যাদি।
নাইজেরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের ওগিদি আনাবগ্রা স্টেট-এ ১৯৩০-এর ১৬ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন আচেবে। পরিবারের লোকজন ইবো বা ইগবো ভাষায় কথা বলতেন কিন্তু আচেবে আট বছর বয়স থেকে স্কুলে ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন। ফলে পরবর্তীকলে তিনি উপনিবেশিকদের পরিচালিত বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। ওই স্কুলের শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসেছিল। তাদের মাতৃভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও তারা উপনিবেশকারীদের ভাষায় কথাবার্তা বলত। আচেবে লেখেন যে তিনি সেখানে প্রথমেই কলোনিয়ালিস্ট ক্ল্যাসিক উপন্যাসগুলো পড়ে ফেলেন। 'আফ্রিকান লিটারেচার অ্যাজ রেস্টোরেশন অব সেলিব্রেশন' প্রবন্ধে তিনি লেখেন, 'শুরুতে আমি নিজেকে একজন আফ্রিকান হিসাবে দেখতে চাইতাম না। শ্বেতাঙ্গ মানুষ উত্তম, বিশ্বাসযোগ্য, বুদ্ধিমান এবং সাহসী। বর্বর অসভ্যরা তাদের বিরুদ্ধে ছিল। তারা ছিল অসৎ, বোকা, ধূর্ত। আমি তাদের নাড়িনক্ষত্রকে ঘৃণা করতাম।' তাঁর এ ধারণা ছিল ভ্রান্ত যা তিনি পরে বুঝতে পারেন।
লেখক হিসাবে চিনুয়া আচেবে আফ্রিকা ও পশ্চিমের দেশগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরির কাজ করেন। বেশকিছু লেখায় তাঁর দেশ নাইজেরিয়ার রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁর গ্রন্থগুলোতে নাইজেরিয়ার ঔপনিবেশিক সময়ে ইবো সমাজের ঐতিহ্য, দেশটির সংস্কৃতিতে খ্রিস্টানদের আগ্রাসন ও আধিপত্য এবং আফ্রিকা ও পশ্চিমাদের মধ্যকার প্রথাগত দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
আচেবের প্রথম জীবনীকার ইজেনওয়া-ওহাইতো লিখেছেন--তরুণ আচেবে বেড়ে উঠেন ক্রসরোডস কালচারের ভেতর দিয়ে। তাঁর পিতামাতা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হলেও তাঁর আত্মীয়স্বজনরা তাদের ঐতিহ্যবাহী ইবো ধর্মেই বিশ্বাসী থাকেন। ওই ধর্মে বিশ্বাসীরা পূজা করতেন বর্মধারী দেবতাদেরকে। তারা নিজেদের ব্যক্তিগত আত্মার নির্দেশনায় চলতেন। এ-আত্মাকে তারা বলতেন--চি। আচেবে তাঁর প্রতিবেশিদের অ- খ্রিস্টীয় বিশ্বাসেও আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
নাইজেরিয়ার ইবো জনগণের মধ্যে এই পুরাণকথা বা মিথটি প্রচলিত আছে--একদিন ইবো'রা সিদ্ধান্ত নেন তাদের প্রধান দেবতা চুকু-র কাছে একটা বার্তা পাঠাবেন। বার্তায় তারা জানতে চান, মৃত মানুষকে জীবন্ত মানুষ হিসাবে ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে কি না। চুকু-র কাছে বার্তার বাহক হিসাবে তারা একটা কুকুরকে পছন্দ করে। কিন্তু কুকুরটা যেতে দেরি করে ফেলে। ফলে তারা কুকুরটির পরিবর্তে একটা কটকটে ব্যাঙকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত হিসাবে ব্যাঙ প্রথম চুকু-র কাছে পৌঁছয়। মানুষ তাকে শাস্তি দিতে পারে এটা ভেবে ব্যাঙ তাদের অনুরোধ রাখতে সম্মত হয়েছিল। সে চুকুকে বলল যে মৃত্যুর পর মানুষেরা পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায়। দেবতা বললেন যে তিনি তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতে চান। তারপর থেকে মানুষ আবার জন্ম গ্রহণ করতে লাগল তবে শুধুমাত্র অন্য এক আকৃতিতে। আচেবে এই মিথটাকে পুনরায় তাঁর লেখায় উপস্থাপন করতে থাকেন। তিনি লিখলেন, বার্তবাহক একটা বহুরূপী সরীসৃপ, একটা টিকটিকি কিংবা অন্য কোনও জন্তু। মাঝেমধ্যে বার্তাটিকেও আকস্মিকভাবে বদলে দিলেন। কিন্তু রূপরেখাটাকে একই রাখলেন। মানুষেরা অমরত্ব চাইলে দেবতা তা অনুমোদন করলেন। কিন্তু তারা মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ভুল করায় দেবতার অমরত্ব দান চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়। যে-সব পূর্বপুরুষেরা ভাষা তৈরি করেছিলেন তারা জানতেন --ভাষা নিজেদের রক্ষা করার জন্যে ব্যবহৃত হবে, তাই--ভাষার ব্যবহার সম্বন্ধে সাবধান হতে হবে। আচেবে লেখেন--যখন ভাষা মারাত্মকভাবে আহত হয়, অপব্যবহার করা হয়, তখন তা সত্য থেকে বিচ্যুত হয়, মানবজাতির ওপর পুনরায় দুর্ভোগ নেমে আসে।
আপনি বিশ্বাস করতে পারেন যে, আপনার বার্তা সঠিক ভাবে প্রতিভাত হতে পারে, যদি তা-- আপনি আপনার মতো করে বলতে পারেন--এই মিথ আচেবেকে এই শিক্ষাও দিয়েছিল, যা তাঁর ক্যারিয়ারের জন্যে মৌলিক বিষয় ছিল, এজন্যেই তাঁকে আফ্রিকান উপন্যাসের গোষ্ঠীর প্রধান বলা হয়।
চিনুয়া আচেবের মাস্টার পিস, তাঁর প্রথম উপন্যাস-- 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট'। আফ্রিকার অনুষঙ্গে লেখা এই উপন্যাসে বর্তমান আফ্রিকার গ্রাম জীবনের কথা উঠে এসেছে। আচেবে উপনিবেশিক লেখকদের পূর্ব প্রজন্ম থেকে প্রাপ্ত তাঁর দেশের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে লিখে সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেন। পঞ্চাশ বছর আগে প্রকাশিত গ্রন্থের একটা নতুন সংস্করণ অ্যাঙ্কর থেকে প্রকাশিত হয়, যার মূল্য ছিল ১০.৯৫ ডলার। এ-গ্রন্থটা পঞ্চাশটা ভাষায় অনূদিত হয়ে দশ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।
আচেবে নাজেরিয়ান হিসাবে গর্বিত ছিলেন। তাঁর বহু লেখায় তাঁর পিতৃপুরুষদের ত্যাগ ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। চিনুয়া আচেবে পাঁচটি উপন্যাস, ছোটগল্প ও কবিতা সংকলন এবং অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেন। তাছাড়া তিনি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভাষণও প্রদান করেন।তিনি নিজস্ব রীতিতে তাঁর লেখায় আফ্রিকার জনগণের গল্প বলেছেন। ইউরোপীয় লেখকদের প্রতিনিধিত্বকে আক্রমণ করতে দ্বিধা করেননি। তবে তিনি ইউরোপীয় প্রভাব-বলয়কে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকারও করেননি। তিনি তাঁর দেশীয় ভাষা ইবোতে না লিখে ইংরেজি ভাষায় লিখতে পছন্দ করেন। তিনি বলেছিলেন-- 'ইতিহাস আমাদেরকে বাধ্য করেছে ইংরেজি ভাষা আমাদের গলার কাছে চলে আসতে।' একটা দেশে কয়েকটি প্রধান ভাষা আছে আর পাঁচ শতের অধিক ছোট ছোট ভাষাও আছে, যা বিভিন্ন এলাকার লোকজনদের কথ্যভাষা। আচেবে তাঁর রচনায় ভাষার কারুকার্য দেখিয়েছেন বিশেষ রীতি ও আদলে। তাঁর লেখায় সভ্যতার সংকটের চিত্র উঠে এসেছে বিশেষ অনুষঙ্গে।
ইবাদানের ইউনির্ভাসিটি কলেজে পড়াকালে অ্যাংলো-আইরিশ লেখক জয়েস ক্যারি'র লেখা 'মিস্টার জনসন' উপন্যাসটি পড়ে তার প্রতিপাদ্য বিষয়ে তিনি প্রতিবাদ করেন। জয়েস ক্যারি এক সময় নাইজেরিয়ান কলোনিয়াল অফিসার ছিলেন। অথচ এ উপন্যাসটি সম্বন্ধে টাইম-এ প্রশংসাসূচক কথা বলা হয় এভাবে, 'আফ্রিকার ওপর এ যাবত লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি সর্বোত্তম।' আচেবে কিন্তু বয়স্ক হয়ে কোনক্রমেই আর সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে চাননি। তাঁর স্বদেশভুমি ও সেখানকার জনসাধারণ সম্বন্ধে ক্যারি'র মন্তব্যকে ন্যাক্করজনক মনে করেন। ক্যারি সাউথ আফ্রিকানদেরকে 'বর্বর, অসভ্য, রাজপ্রাসাদের ফ্লোরে ইঁদুরের মত বসবাসকারী' হিসাবে চিত্রায়িত করেন। 'নর্তকীদের নাচানাচির মধ্যে অসঙ্গতি, বোধহীন, অমানবীয়' ভাবের প্রকাশ ঘটে। কলোনিয়াল লেখকদের লেখা সাহিত্যে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে অমানবিক, বর্বর বলে অখ্যায়িত করা হয়। আচেবে উপলব্ধি করেন আসলেই এটা বিপদজনক ব্যাপার। পরবর্তীকালে আচেবে লেখেন, 'উপন্যাস কল্পনাপ্রসূত, যা সত্য কিংবা মিথ্যার ওপর ভিত্তি করেও লিখিত হতে পারে, তাই বলে একটা নিউজ আইটেমের ধ্রুব কিংবা ছলনা থাকবে তাতো হতে পারে না। কিন্তু অনাগ্রহ, অভিপ্রায়, সাধুতা জলাঞ্জলি দেওয়া যায় না।' উপন্যাসের নৈতিক ক্ষমতাতে এ বিশ্বাসের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই আফ্রিকান সাহিত্যে।
'ওকোনকয়ো' নামের ছেলেটি নয়টা গ্রামসহ বাইরের এলাকাতেও বিশেষভাবে পরিচিত ছিল। অচেবে'র প্রথম উপন্যাস 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট'-এর প্রথম লাইন--আমরা একটা অপরিচিত ভূখণ্ডে আছি। ওকোনকয়োকে কি প্রত্যেকেই চিনত? নয়টা গ্রাম কোথায় অবস্থিত? আচেবে তাঁর প্রথম উপন্যাস 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়ে লিখতে শুরু করেন যখন, তিনি লাওসে যান নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস যোগদান করতে। ১৯৫৮ সালে যখন তিনি পাবলিসার উইলিয়াম হেইনেম্যানের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দেন তখন কেউ জানতো না তা ছাপা হবে কিনা। অ্যালান হিল, ফার্মের ডিরেক্টর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, 'একজন আফ্রিকানের লেখা উপন্যাস কেনার জন্যে কাউকে কি পাওয়া যাবে? আগে এ ধরনের কোন নজির নেই।' তাঁর মন্তব্যটা মোটেই সঠিক ছিল না । নাইজেরিয়ান আমোস টুটুওলা এবং সিপ্রিয়ান একওয়েনসি প্রথম দশকের দিকে তাদের উপন্যাস প্রকাশ করেন। আফ্রিকান অনুষঙ্গের উপন্যাস তখনও ছিল খুবই প্রাথমিক স্তরে। কিন্তু আচেবের 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট'- সম্পূর্ণ নতুন এক আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে, যাতে পুরনো ও নতুন প্রজন্মের জীবন প্রবাহের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের ইতিবৃত্ত উঠে এসেছে। বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভিক কালপর্বের কিছু সময়ের ইবো গ্রামগুলোতে একটা ফিকশনাল গ্রুপ তৈরি হয়, যা ইউমুওফিয়া নামে পরিচিত।
'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাস শুরু হয়েছে একটা উপাখ্যানধর্মী দৃশ্যের মাধ্যমে, যা গ্রাম্যজীবনের ওকোনকয়ো'র পরিবারের প্রায় স্বাপ্নিক ইতিবৃত্ত হয়ে উঠে এসেছে। ইকেমেফুনা নামের একটা বালক ইউমুওফিয়া গ্রামের বাইরের গ্রাম থেকে তাদের সাথে বসবাস করার জন্যে আসে এবং ওকোনকয়ো'র ছেলে নরওয়েকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করে। ( ইকেমেফুনা'র বাবা ইউমুওফিয়া থেকে আসা একজন মহিলাকে হত্যা করে, গ্রামবাসীরা এর ক্ষতিপূরণ হিসাবে একজন কুমারী মেয়ে ও একজন তরুণকে গ্রহণ করতে সম্মত হয়।)
পরবর্তী তিন বছরের বেশি সময় ধরে ফসল তোলার মৌসুমগুলিতে ওকোনকয়ো'র পরিবারে গল্পটি ধর্মীয় ও গার্হস্থ্য অনুষঙ্গে চালু ছিল। তাদের ভাষার রূপকল্প গ্রামবাসীদের অভিজ্ঞতা লব্ধ : ইকেমেফুনা বর্ষাকালে দ্রুত বেড়ে উঠা লতাপাতার মত বেড়ে উঠল এবং জীবন রসে পরিপূর্ণ হলো। ফসল ভাল না হলে গ্রাম জীবনে দুর্দশা চরম । যদি ফসল তোলার মৌসুমটা খারাপ হয় তবে গ্রামবাসীদেরকে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়। শিশুরা বেড়ে উঠার প্রত্যাশা করতে পারে না। ওখানকার কিছু প্রথা নিষ্ঠুর ধরনের। নবজাতক জমজ সন্তানের মধ্যে খারাপ আত্মার অবস্থান ভেবে তাদেরকে জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দেয়। ইবোদের আচরণ সব সময় ভাল থকে না, অনেক সময় তারা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। ওকোনকয়ো-সহ একদল লোক ইকেমেফুনাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। স্থানীয় দৈববাণী প্রদানকারী লোকটি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয় তাকে হত্যা করতে। বালকটি ভাবে যে, তার বাড়ি ফিরে যাওয়াই ঠিক। কিন্তু সে ভয় পায় এটা ভেবে যে তার মা বাড়িতে স্থান দেবে না। ছেলেটি শান্ত হয়ে শৈশবের খেলা খেলতে শুরু করে। সে নিজের মনে গান গেতে গেতে হাঁটতে থাকে এবং মনে মনে বাজি ধরে। যদি তার গান ডান পা ফেলতেই থেমে যায় তবে তার মা বেঁচে আছে, আর যদি তার বাঁ-পা ফেলতেই থেমে যায় তবে তার মা মারা গেছে। না, মারা যেতে পারে না। ডান পা ফেলতেই গান থেমে গেছে। তাহলে তার মা ভালভাবে বেঁচেবর্তে আছে। সে আবার গান গাইতে গাইতে হাঁটতে থাকে, এবার তার গান শেষ হয় বাঁ-দিকে পা ফেলার কালে। সে দ্বিতীয়বারের হিসাব করে না। ঐতিহ্য জনগণকে সম্মিলিত করে। তার পিতা ইকেমেফুনাক হত্যা করেছিল জানতে পারার পর নয়োয়ি ভাবে, 'মনে হল কিছু তার ভেতরে প্রবেশ করেছে, যেমন শক্ত করে বাঁধা ধনুকের অংশ বিশেষ।' যখন প্রথম মিশনারিরা এসে গীর্জায় যোগদান করতে গিয়ে গ্রামীণ ঐতিহ্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েন। স্থানীয় রীতিনীতি ও প্রথা সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকলেও মিশনারীরা সবাই খারাপ ছিলেন না : বিশেষভাবে তাদের একজন গ্রামবাসীদের সম্মান করতেন। কিন্তু অন্যান্যেরা গ্রামবাসীদের যাপিতজীবন সম্বন্ধে জানার জন্যে যৎসামান্য আগ্রহী ছিলেন। শ্বেতাঙ্গ মানুষটি আমাদের দেশের রীতিনীতি ও প্রথা সম্বন্ধে জানতেন। ওকোনকয়ো ধাঁধায় পড়ে একজন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে-- 'সে আমাদের মাতৃভাষা জানে না তাহলে সে কেমন করে আমাদের সাথে কথা বলবে?' অন্য একজন জবাব দেয়। বইয়ের শেষ অধ্যায়ে উপনিবেশকারীদের কন্ঠস্বর উচ্চগ্রামে উঠে; তার কথা শোনার জন্যে চারধারে নীরবতা বিরাজ করে। পশ্চিমা সমালোচকরা আচেবেকে প্রশংসা করেন ইবো-জীবন সম্বন্ধে বিস্তারিত চিত্রাঙ্কন করার জন্যে, কিন্তু তারা তাঁর বইয়ের সাহিত্যিক গুণাবলী সম্বন্ধে কমই বলেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস বারবার ওকোনকয়ো'র নাম ভুল বানানে লেখে এবং প্রিমিটিভ সোসাইটির নানা অনুষঙ্গকে অচেবে তাঁর লেখায় তুলে ধরে সমালোচনা করেন। অন্যান্য সমালোচকরা খোলাখুলিভাবে আচেবের লেখার প্রতি বৈরীভাব দেখান। 'ঔপন্যাসিক আচেবে কেমন করে লাওসে তাঁর অত্যাধুনিক ব্রডকাস্টিং কাজের পরিবর্তে ফিরে গেলেন তাঁর পিতামহের আমলের বিস্মৃত সময়ে?' ব্রিটিশ সাংবাদিক অনার ট্রাসি এটাই ছিল জিজ্ঞাস্য। আচেবে'র তৃতীয় উপন্যাস 'অ্যারো অব গড' (১৯৬৪) এর ত্রিমাত্রিক ভাবধারায় লেখা। একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় এ উপন্যাসটি থিংকস ফল অ্যাপার্ট-এর উত্তরসূরী। 'নো লঙ্গার অ্যাট ইজ' (১৯৬০)-এর ভাষা সম্বন্ধে সমালোচনা থাকলেও তাতে লোক ঐতিহ্যের ধারা বর্তমান। ১৯৬৫ সালে লেখা আচেবের উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলন 'দ্য আফ্রিকান রাইটার অ্যান্ড দি ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ' বের হয়।
আচেবে বলেন--একজন ন্যাটিভ স্পিকার হিসাবে ইংরেজি লেখার ইচ্ছে ছিল না। বরং, একজন আফ্রিকান লেখকের লক্ষ্য হওয়া উচিত তার বিশেষ অভিজ্ঞতাকে ইংরেজির মাধ্যমে প্রকাশ করা। তিনি এ প্রসঙ্গে 'অ্যারো অব গড' থেকে উদ্ধৃতি দেন : গ্রামের প্রধান ধর্মযাজক ইজেইউলু গ্রামের নতুন মিশনারীদের কাজকর্ম সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে উৎসুক ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি আমার এক ছেলেকে এসমস্ত লোকদের সঙ্গে যোগদান করে তাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখাতে চাইলাম। তাকে বললাম যদি তাদের মধ্যে কোন কিছু না দেখ তবে ফিরে আসবে। আর যদি তাদের মধ্যে কোন কিছু ভাল দেখ তবে আমার অংশটা বাড়িতে নিয়ে আসবে। পৃথিবীটা হচ্ছে একটা মুখোশের মত, যা নৃত্য করছে। যদি তুমি এর মধ্যে ভাল কিছু দেখতে চাও তবে তুমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে না। আমার আত্মা আমাকে বলেছে যে আজকের দিনে যারা শ্বেতাঙ্গ মানুষের বন্ধুভাবাপন্ন নয় তাদের দিয়ে বলানো হবে আমরা আগামীকাল জানব। তারপর পুনরায় আচেবে অনুচ্ছেদটি রঙে রঙে চিত্রায়িত করেন। অপরিচিত পন্থায় ইংরেজি শব্দগুচ্ছের ভাণ্ডারকে ঋদ্ধ করে ওই ভাষার মাধ্যমে আচেবে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো তুলে ধরেছেন। ইরেজির পর আচেবের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে স্বীকৃত হয় না। ১৯৬২ সালে উগান্ডাতে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান সাহিত্যের ওপর অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে আফ্রিকান সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে নাইজেরিয়ার কবি ও প্লে-রাইটার ওলে সোয়িনকি এবং ক্যানিয়ার ঔপন্যাসিক জেমস নগুগি প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। লেখকেরা সচেষ্ট হয়েও আফ্রিকান সাহিত্যেকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যর্থ হন। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন না আফ্রিকান সাহিত্যের লেখকদের জাতীয়বাদী চরিত্রকে এবং বিষয়বস্তুকে। পরবর্তীকালপর্বে সাহিত্য সমালোচক ওবি ওয়ালি এক লেখায় দাবি করেন যে আফ্রিকান সাহিত্য কানাগলিতে গিয়ে আবদ্ধ হয়েছে। এ কানাগলি থেকে বের হয়ে আসতে গেলে এ সমস্ত লেখকরা ও তাদের পশ্চিমা ধাত্রীরা সত্যিটাকে স্বীকৃতি দিলে আফ্রিকান সাহিত্য অবশ্যই আফ্রিকান ভাষায় লিখিত হত। তারা তাঁর কথায় সম্মত হন। জেমস নগুগি চারটি উপন্যাস ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন, কিন্তু সাতানব্বই সালে তিনি তাঁর দেশীয় ভাষা গিকুয়ু এ 'ওয়া থিওংও' নামে বইটি লেখেন, যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় 'আত্মার বশীভুত'।
কনফারেন্সে আচেবে নগুগি'র প্রথম উপন্যাস 'উইপ নট, চাইল্ড'-এর পাণ্ডুলিপি পাঠ করেছিলেন এবং তা ছাপানোর জন্যে হেইনেম্যান পাবলিসারকে সুপারিশ করেন। পাবলিসার তাড়াতাড়িই তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন লেখককে দশ বছর কোন প্রকার সম্মানি না দেওয়ার শর্তে। তাঁর সময়ে যাদের উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল তারা ছিলেন ফ্লোরা এনওয়াপা, জন মুনোনয়ে এবং এয়ি কেওএই আর্মাহ। আফ্রিকার উদীয়মান সাহিত্যের ক্ষেত্রে এরা ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। হেইনেম্যানের অ্যালান হিল পরবর্তীতে বলেন--আচেবে'র বইয়ের অকল্পনীয় বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি ভাষার আবেদন পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছিল না। একটা বড় মাপের উপন্যাস সম্বন্ধে আচেবে পারবর্তীতে যুক্তি দেখান এই বলে যে পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ইবো, গিকুয়ু কিংবা ফান্তে ভাষার আন্তর্জাতিক আবেদন নেই; অথচ ইংরেজি সেটা আছে। নাইজেরিয়াতে রাজনৈতিক আধিপত্যের দায়বদ্ধতা তেমনটা নেই। দীর্ঘদিনের লড়াই সংগ্রামের পর নাইজেরিয়া ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৭ সালে দু-দুটো ক্যু ঘটে। যার ফলে ইবোদের বিরুদ্ধে গণহত্যাও ঘটে। ইবোল্যান্ড স্বাধীনতা ঘোষণা করে রিপাবলিক অব বায়াফ্রা নামে। আচেবে নিজেও সন্ত্রাসকারীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন, আচেবে এ-অবস্থার প্রেক্ষাপটে 'এ ম্যান অব দি পিপল' ( ১৯৬৬) নামে একটা রাজনৈতিক ব্যঙ্গকাব্য রচনা করেন, যাতে তিনি ভবিষ্যতবাণী করেন যে ক্যু ঘটে যেতে পারে। সত্যি সত্যি ক্যু ঘটে যাওয়ায় কেউ কেউ বিশ্বাস করলেন যে আচেবে এ ক্যুয়ের পরিকল্পনাকারী। তিনি বায়াফ্রানদের জন্যে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেন। এক সময় তিনি উপন্যাস লেখা বন্ধ রেখে কবিতা ও গল্প লিতে শুরু করেন। আচেবে লন্ডন সফর করেন যুদ্ধ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যে। ১৯৬৯ সালে তিনি 'প্রিন্সিপাল অফ দি বায়াফ্রান রেভ্যুলেশন' সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণা লিখতে সাহায্য করেন। যুদ্ধ-বিগ্রহরত জাতিটি অনাহার ক্লিষ্ট অবস্থায় ছিল, ব্রিটিশ সমর্থিত নাইজেরিয়ান সেনাবাহিনী রাস্তাঘাট ও বন্দরগুলি ব্লক করে রেখেছিল। ১৯৭০ সালে বায়ফ্রানদেরকে চুড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণে জোরপূর্বক বাধ্য করা হয়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায় নিহত ইবোদের সংখ্যা ছিল এক মিলিয়ন থেকে তিন মিলিয়নের মধ্যে। দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে 'দ্য নিউ ইয়র্ক রিভিউ অব বুকস-এ কোনোর ক্রুস ও বিরেন-এর পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার লোক নিহত হয়, তাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই ছিল বেশি। এ লড়াইয়ে যারা ভোগান্তির শিকার হয় তাদের প্রোটিন ঘাটতির ফলে কওয়াশিওরকোর, পেট মোটা, ফ্যাকাশে ত্বক, চুল লালচে হয়ে যায়। আচেবের কবিতা 'রিফ্যুজি ক্যাম্পে একজন মা' কবিতায় সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একজন মহিলায় প্রচেষ্টার আকুতি এভাবে ধরা পড়ে :
মহিলাটি তাদের পোটলা থেকে একটা ভাঙা চিরুণী বের করে তার মাথার ধুলোবালিতে ভরা চুলগুলো আঁচড়ে তার চোখ দুটো সচেতনভাবে তা সরিয়ে নেয়।
তাদের সাবেককালে সম্ভবত তাদের জীবনে দৈনন্দিন কাজ ছিল ছেলেটির ব্রেকফাস্ট ও স্কুলে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত করা আর এখন সে যা করছে তা ছোট্ট একটা কবরে ফুল দেবার মতো।
বায়াফ্রা'র পতন নাইজেরিয়ান সোসাইটির ভিতকে নাড়িয়ে দেয় এবং এক দশকের রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থাকেও নাড়া দিয়ে যায়। আচেবে সুযোগবুঝে অস্থায়ীভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেন, সাতানব্বইয়ের প্রথম দিকের একটা অংশে শিক্ষাদান কাজের জন্যে তিনি আমেরিকায় থাকতে থাকেন। এসময় তিনি তাঁর প্রবন্ধ, লেকচারে উপনিবেশিক শাসনের শোষণ শাসনের চিত্র উপস্থাপন করেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে 'আর্ট ফর আর্ট সেক' জাতীয় ইউরোপিয়ান মর্ডানিজমের পক্ষে ছিলেন না আচেবে । তিনি সব সময়ই এমন এক সাহিত্যের কথা বলেছেন যা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রেরণাদায়ক। তিনি বলেন, উপনিবেশিকতার ভূত তাড়ানোর জন্যে কাজ করা উচিত। আচেবে ১৯৮০ সালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেন, 'আমাদের জন্যে সাহিত্য বিলাসিতা নয়। এটা জীবন মৃত্যুর বিষয়, কারণ আমরা এক একজন রুচিশীল মানুষ।' তাঁর লেখা শেষ দিকের উপন্যাস 'অ্যান্টহিলস অফ দি সাভানা' (১৯৮৭)-এ তিনি পরিষ্কারভাবে এ কথাটাই বলেন। একদল বন্ধু যারা পশ্চিম আফ্রিকার নাইজেরিয়ার পাশের দেশ কঙ্গান-এর সরকারি অফিসে কর্মরত ছিলেন, তারা সামের ক্যু'র মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশের হাল ধরেন এবং দ্রুতই একনায়ক হওয়ার পথে ধাবিত হন। তথ্যমন্ত্রী ক্রিস সামের পক্ষ নিয়ে ইলকেমের বিরোধিতার করার কথা প্রত্যাখান করলে সরকার নিয়ন্ত্রিত খবরের কাগজগুলোর সম্পাদকরা ওই দু'জনের কারোই পক্ষে না গিয়ে সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের পক্ষ নেন। বইটিতে আফ্রিকার রাজনীতিতে ঘুষ ও স্বজনপোষণের বিষয়টি তিনি তুলে ধরেন।
আচেবে তাঁর লেখা উপন্যাসে অবশ্যই দেশীয় আবহের অবতারণা করতে সচেষ্ট হন। তাঁর এই প্রবণতা অন্যান্য লেখকদের দ্বারা সমালোচিত হলেও তিনি তাদের অনেকের লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিশেষ করে আউই কেওয়া আরমাহ'র প্রতি তাঁর উপন্যাস 'দ্য বিউটিফুল ওয়ানস আর নট ইয়েট বর্ণ' (১৯৬৮)-এর জন্যে, যাতে আরমাহ ঘানার উপনিবেশোত্তর ঘানার একটা ভিশনের কথা তুলে ধরেন। ১৯৯০ সালে আচেবে মারাত্মক কার দুর্ঘটনায় আহত হয়ে প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা চিকিৎসার জন্যে তাঁকে আমেরিকা যাবার পরামর্শ দেন। মূলত সে সময় থেকে তিনি আমেরিকায় বসবাস করে আসছিলেন । তিনি অধিকাংশ সময়ই সেখানকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। সে সময় তিনি প্রবন্ধ সংকলন 'হোম এন্ড এক্সাইল' প্রকাশ করেন। তিনি নতুন প্রজন্মের লেখকদেরকে আফ্রিকান সাহিত্যে নতুন নতুন মাত্র যোগ করতে আহ্বান জানান। অনেকেই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে আফ্রিকার উপনিবেশিক আমলের শোষণ শাসনের চিত্র তুলে ধরতে এগিয়ে আসেন। প্রসঙ্গক্রমে চিমামানডা এগোজি অডিচি'র লেখা 'হাফ অব এ ইয়েলো সান' উপন্যাসের কথা বলতে হয়। অডিচি'র এ-উপন্যাসে বায়াফ্রান যুদ্ধের বাস্তব চিত্র অংকন করে তিনি বায়াফ্রান'স অরেঞ্জ প্রাইজ লাভ করেন।
আচেবে 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাসটি লেখার পঞ্চাশ বছর পরও পৃথিবীর পরিস্থিতি বদলায়নি।
লেখক পরিচিতি
মনোজিৎকুমার দাস
প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, গল্পকার ও কবি
লাঙ্গলবাঁধ , শ্রীপুর , মাগুরা।
0 মন্তব্যসমূহ