সাজেদা হক
লেখক যখন কোনও দৃশ্যের বর্ণনা করেন, তখন পাঠক যেন সেটি দেখতে পায়। অর্থাৎ, দৃশ্যের বর্ণনা এমন হতে হবে, যেন কেউ দেখে দেখে পড়ছেন। পাঠককে শুধু গল্প পড়তে নয়, দেখতেও দিতে দিতে হবে। পড়তে পড়তেই প্রত্যেকটি দৃশ্যকে স্বচক্ষে দেখার অনুভূতিটা পাঠকের মনে তৈরি করে দিতে হবে। যদি তা করতে পারেন, তাহলেই লেখক হিসেবে আপনি সফল।
আরও সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, সিনেমায় যেমন প্রতিটি দৃশ্য আলাদা আলাদা, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও পাঠকের কাছে প্রত্যেকটা দৃশ্যকেই আলাদাভাবেই দৃশ্যমান করতে হবে-- হোক সে গল্পের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া, বচন কিংবা বহুবচন। মোট কথা-- প্রতিটি দৃশ্যকেই দৃশ্যমান হতে হবে এবং প্রতিটি দৃশ্যেরই একটা ইতি থাকবে। সংক্ষেপেই বোঝা যাবে লেখক আসলে কী বলতে চাইছেন।
এই কাজটা আসলে খুব কঠিন কিছু নয়। অনেকেই এটা খুব সহজেই পারেন। কেউ কেউ সাহায্য নিতে পারেন অন্য সাহিত্যিকদের। বিখ্যাতদের কাছ থেকে নেয়া কিছু টিপস আছে এখানে। যেমন:
• দৃশ্যের সংজ্ঞা
• দৃশ্যের উদ্দেশ্য
• দৃশ্যের গঠন
• দৃশ্যের ধরণ
পাঠকের মনে আপনার কল্পিত দৃশ্যটি চিত্রনে ওপরের এই কয়েকটি বিষয় আগে আপনার কাছে পরিস্কার থাকা দরকার।
দৃশ্যের সংজ্ঞা:
একটি ছোটগল্প বা উপন্যাসের একটি দৃশ্য আর একটি সিনেমার একটি দৃশ্যের মধ্যে কোনও তফাত নাই। সাহিত্যের সব দৃশ্যই জীবন থেকে নেয়া। জীবন থেকে নেয়া বলেই গল্প বা কথাসাহিত্যে এসব দৃশ্যই পাঠককে সম্পৃক্ত করে। তাই কখনও পাঠক নিজেই নায়ক হয়ে যান। গল্পের প্রতিটা দৃশ্যের সঙ্গেই নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেন। ভাবেন, এটি তার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। যে-দৃশ্য, জীবনের গল্প থেকে নেয়া, সেটি পাঠকের কাছে বাস্তব বলে মনে হয়।
একজন লেখক একটি দৃশ্য গঠন করেন, তিনি তখন গল্পটিতে কী ঘটছে তা পাঠককে দেখাতে চাইবেন। কী ঘটছে তা নাটকীয়তার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন। সেজন্য যে-বিষয়গুলি মনে রাখতে হবে :
• সেটিং বিবরণ। লেখক অবশ্যই দৃশ্যের সময় এবং অবস্থান অন্তর্ভুক্ত করবেন।
• এ্যাকশন থাকতে হবে। কিছু একটা ঘটতে হবে। হোক তা, দ্বন্দ্ব, বা সংঘাত বা যে-কোনও কিছু।
• বর্ণনা থাকতে হবে। লেখককে অবশ্যই প্রত্যেকটি দৃশ্যের সুনির্দিষ্ট বিবরণ দিতে হবে।
দৃশ্যকে সহজপাঠ্য করতে লেখক 'সংলাপ এবং প্রধান চরিত্রের চিন্তার ভারসাম্য-তারতম্য'ও যোগ করতে পারেন।
দৃশ্যের উদ্দেশ্য:
লেখক গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করাবার জন্য একটি দৃশ্য তৈরি করেন। পাঠককে এই দৃশ্যের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। লেখক এক বা একাধিক নাটকীয়তা তৈরি করতে পারেন অনায়াসেই। কিন্তু এই নাটকীয়তার উদ্দেশ্য পাঠকের কাছে পরিস্কার করাটাও লেখকের জন্য জরুরি একটি বিষয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে একটু খেয়াল রাখলেই, তা সহজেই করা যেতে পারে:
• ইভেন্টে নাটকীয়তা যোগ;
• চক্রান্তকে গতি দেয়া, এগিয়ে নেয়া;
• দ্বন্দ্ব বা সংঘাতকে প্রবল বা তীব্র করে তোলা;
• নতুন চরিত্র যোগ বা চরিত্রের বিকাশ;
• কথাসাহিত্যের মুড বা থিমকে প্রতিষ্ঠা করা;
• সমাধানের ইঙ্গিত দেয়া।
দৃশ্যগঠন:
একটি দৃশ্য, এক বা একাধিক ঘটনার নাটকীয় উপস্থাপন। এই উপস্থাপনেরও নির্দিষ্ট একটি কাঠামো আছে।
• শুরু (দৃশ্যের শুরু থাকতে হবে)।
• মধ্য (দৃশ্যের মধ্য থাকতে হবে)।
• শেষ (দৃশ্যের শেষ থাকতে হবে)।
দৃশ্যায়ন আরম্ভের কোনও নিয়ম নেই। লেখক বিভিন্ন উপায়ে একটি দৃশ্য পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন। লেখক কখনও কখনও চরিত্রের বর্ননা দিতে পারেন, ঘটনার বর্ণনা দিতে পারেন আবার কখনও কখরও গল্পে মধ্যভাগ থেকেও কিংবা কোনো ডায়ালগের মধ্যভাগ থেকেও দৃশ্য আরম্ভ করতে পারেন। আপনার উপন্যাসের ধরণের ওপর নির্ভর করছে আপনার দৃশ্যগঠন।
দৃশ্যের মাঝখানে লেখক সাধারণ দ্বন্দ্বকে তীব্র করে, চরিত্রকে বিস্তৃত করে এবং ঘটনাকে এগিয়ে নেন। দৃশ্যের শেষে, লেখক সাসপেন্স, টানটান উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব তৈরি করে অমীমাংসিত দৃশ্যের দিকে চলে যান। পাঠক তখন পরবর্তী দৃশ্যের জন্য পাতা উল্টায়। এভাবেই একটির পর একটি পাতা উল্টাতে উল্টাতে পাঠক লেখকের প্রেমেই পড়ে যায়।
দৃশ্যের ধরন:
দৃশ্যের অনেক ধরন আছে। যেমন:
- দৃশ্য হবে এমন যা গল্পের ভবিষ্যৎ পটভূমির বিবরণ দেবে।
- এমন দৃশ্য যা দ্বদ্বের জন্ম দেবে।
- দৃশ্য এমন যা কখনও কখনও নতুন চরিত্রের জন্ম দেবে।
- এ্যাকশনকে প্রতিফলিত করবে।
- সাসপেন্স তৈরি করবে।
- অতীতের ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।
- সম্ভাব্য সমাধানের ইংগিত দেবে।
লেখক সাসপেন্স তৈরি, দ্বন্দ্ব প্রদর্শন, দ্বন্দ্ব বিকাশ, চরিত্রের প্রকাশ, কর্ম বর্ণনা করতে একটি দৃশ্যের গাঁথুনি করেন। ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য একটি দৃশ্যের মধ্যে একটি দৃশ্য। লেখক যেখানে এমন কিছু লিখেছেন যা অতীতে ঘটেছে, পাঠককে তা স্মরণ করিয়ে দিতেও দৃশ্যের প্রয়োজন হতে পারে।
গল্পের 'মধ্যভাগে আবেগ' যোগের ২৫ উপায়:
লেখার সবচেয়ে জটিল অংশ হলো মধ্যভাগ। গল্পের শুরু করা যায়, শেষও করা যায় কিন্তু মধ্যভাগে এমন কি যোগ করা উচিত উচিত তা নিয়েই অনেক লেখক চিন্তিত থাকেন। কখনও দ্বন্দ্ব যোগ করার কথা ভাবেন, তো কখনও সংঘাতের কথা ভাবেন। কেউ কেউ ভাবেন আবেগ যোগের কথা। যারা সাহিত্যের মধ্যভাগে আবেগ যোগের কথা ভাবের তাদের জন্য ২৫টি টিপস।
১. দৃশ্যের দ্বিতীয় অংশে যেতে:
দৃশ্যের প্রথম ভাগটাও ছোট, শেষ ভাগটাও ছোট কিন্তু মধ্যভাগটা হবে দুটোকে যুক্ত করার অংশ। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন ক্ষেত্রে আপনি চতুর্থ পরিকল্পনা হাতে নিতে পারেন। প্রত্যেকটির সঙ্গে প্রত্যেকটিকে যুক্ত করুন। কোনওটাকে বাদ দিয়ে যেন কোনওটা না হয়। চলচ্চিত্র বা নাটকের দৃশ্যগুলোতে যেমন গাঁথুনি থাকে। হ্যারি পটারকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
২. নাটকীয়তার জাল বুনুন:
দৃশ্যের পরতে পরতে নাটকীয়তার জাল বুনুন। পাঠক যেন কোনওভাবেই একটু পরেই লেখক কী করতে পারেন তা অনুমান করতে না পারে। জাল বুনুন ষড়যন্ত্রের, জটিলতা তৈরি করুন চরিত্র থেকে চরিত্রে। আবার সেসব জটও খুলে দিন। আবার জট লাগান। এভাবেই চলতে থাকুক পাতার পর পাতা।
৩. 'পরী, দস্যু, বিধাতা' ধরনের চরিত্র যোগ করুন:
ক্লাইম্যাক্স তৈরি করতে পারছেন না? চিন্তা নেই আপনার গল্পের ধরণ অনুযায়ী সাহিত্যে যোগ করুন কোন অপ্সরা, পরী, দৈত্য কিংবা বিবেক বা বিধাতা চরিত্র। যোগ করতে পারেন অশরীরী কোন কিছুও। দেখবেন গল্পটি কীভাবে গতি পাচ্ছে।
৪. ধর্মীয় কোন উৎসবকে যোগ করুন:
গল্পে তো অনেক সময় কাল থাকে, ইস্যু থাকে, থাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-ক্লেশ-ক্লাইম্যাক্স। সবই ঠিক আছে, তবে কোনও এক জায়গায় ধর্মীয় উৎসব যোগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে 'লালসালু'কে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
৫. নতুন চরিত্র যোগ করুন:
গল্পের ঠিক মাঝখানে নতুন একটি চরিত্র যোগ করুন, যে-চরিত্রটি আপনার গল্পকে শুধু গতিই দেবে না, মোড়ও ঘুরিয়ে দেবে। পাঠকও অবাক হবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত এ-চরিত্রটি হতে পারে সাময়িক কিংবা দীর্ঘ। এটা নির্ভর করবে আপনার গল্পের ধরনের ওপর। চরিত্রটি-- নারীও হতে পারে, পুরুষও হতে পারে। ভালও হতে পারে, মন্দও হতে পারে। ভেবে দেখুন কি দিলে হয়। যোগ-বিয়োগে মেলে কি না?
৭. সত্যিকারের একটি জটিল চরিত্র যোগ করুন:
পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করুন। এমন চরিত্র যোগ করুন যেটি সত্যিকার অর্থেই নেগেটিভ চরিত্র হবে। ওই প্রবাদটা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের,
'দুষ্টু লোকের মিষ্ট কথা
ভিড়িয়া বসে কাছে
কথা দিয়ে কথা নেই
প্রাণ বধে শেষে'।
কি পেয়ে গেলেন তো চরিত্রটি আসলে কেমন হবে? কীভাবেই বা কাজ করবে সেটি! ব্যাস, আর কী, এবার শুরু করে দিন।
৮. পার্থক্যগুলো তুলে ধরুন:
হুমম, এবার জটগুলোকে আস্তে আস্তে খুলুন। চরিত্রগুলোর পার্থক্যগুলো আলাদা আলাদা করুন। পাঠক যেন এই পর্যায়ে বুঝতে পারে, কোন চরিত্র কী করছে। চরিত্রগুলোর কাছে জট না খুললেও চলবে, কিন্তু পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। অর্থাৎ চরিত্রের জটিলতা চরিত্রগুলো টের না পেলেও, পাঠকের কাছে স্পষ্ট করুন।
৯. এবার অ্যাকশনে যান:
এবার গল্পের লাগাম টেনে ধরুন। বদ চরিত্রের বাদরামির কিছু কিছু অংশ আপনার সাহিত্যের প্রধান চরিত্রকে বুঝতে দিন। দ্বন্দ্বের কারণ সম্পর্কে চরিত্রগুলোকে ইঙ্গিত দিন। প্রয়োজনে এ্যাকশনে যান। অর্থাৎ হাতে-নাতে চক্রান্তকারীকে ধরিয়ে দিন।
১০. গল্পের ম্যাপ আঁকুন:
এই পর্যায়ে আপনি আসলেই গল্পের মধ্যখানে এসে পড়েছেন। এবার মনে মনে একটি ছক এঁকে নিন। গল্পের শুরু কোথায় করেছেন, শেষ কোথায় করবেন, এখন আছেন কোথায়। স্থির হয়ে নিন। ঠাণ্ডা মাথায়, আবার পড়ুন, ভাবুন এবং ছকটাকে মাথার মধ্যে গেঁথে ফেলুন। সেইভাবেই এগোতে থাকুন।
১১. দৃশ্যের বিন্যাস করুন:
এবার দৃশ্যগুলোর শৈল্পিক বিন্যাস করুন। মনোযোগ দিন। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিন। আরও নিখুঁত আরও প্রাণবন্ত আরও আকর্ষণীয় করুন দৃশ্যগুলোকে। এই বিন্যাসটা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই যত্নের সঙ্গে করবেন।
১২. ধাপে ধাপে দৃশ্য বাড়ান:
ধাপে ধাপে দৃশ্যগুলোকে এগিয়ে নিন। এমনকি পোশাক, মুখভঙ্গি সব খেয়াল করুন। চিন্তা-ভাবনাকেও বাদ দেবেন না। দৃশ্যের প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন করুন। সেটা যুক্তিযুক্ত হবে। শারীরিক দ্বন্দ্ব কিংবা মানসিক দ্বন্দ্বকে পৃথক করুন। সেই পার্থক্যগুলোকেই ধাপে ধাপে তুলে ধরুন।
১৩. স্থির থাকুন:
গল্পের মাঝখানে এসে মুলত পাঠক নয়, বিপদে পড়েন লেখকই। তাই অস্থির হবেন না। একটু শান্তভাবে বসুন। সবকিছুকে ফিরে ফিরে করুন। একের পর এক দৃশ্যগুলোকে নিজের মনেই গেঁথে যান। দেখবেন, কোথাও থামছেন না আপনি। ভয় পাবেন না কিছুতেই, খেইও হারাবেন না, -কারণ আপনিই পারবেন।
১৪. চাইলে কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন:
এখানে চাইলে একটু পরিবর্তন আনতে পারেন। মানসিক চাপ বাড়াতে পারেন। আবার মজার মজার সেন্স অব হিউমারও যোগ করতে পারেন। হাস্যরসাত্মক চরিত্র যোগ করতে পারেন। চমকও যোগ করতে পারেন এখানে। আপনার ইচ্ছা।
১৫. সন্দেহ তৈরি করুন:
এবার চরিত্রের প্রতি চরিত্রের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করুন। ভাল এবং খারাপ মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরুন।চরিত্রের প্রতি চরিত্রে বিশ্বাস হারাতে দিন। অবিশ্বাসী করে তুলুন। এটা আপনার গল্পকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। গল্পে যোগ হবে নান্দনিকতা।
১৬. এখান থেকে মূলে ফিরে যান:
এই পর্যায়ে এসে একদম কাহিনীর শুরুতে ফিরে যান। কী নিয়ে শুরু করেছেন গল্প আর কোথায় শেষ চাচ্ছেন। ঠিক সেখানে পৌঁছতে আপনাকে আর কী যোগ করতে হবে ভেবে দেখুন।
১৭. বহু ধরণের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রন ঘটান:
সীমাবদ্ধ হয়ে যাবেন না। বহু চরিত্র, বহু ঘটনা একসাথে চিত্রিত করুন। একইসাথে দ্বন্দ্বগুলোক আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিতে পারেন। একইসাথে বুদ্ধিজীবী, সামাজিক, মানসিক, শারীরিক চরিত্র যোগ করুন এবং সেগুলোকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ক্লাইম্যাক্স দিয়ে ঘিরে রাখুন।
১৮. আবারও শুরু থেকে শুরু করুন:
আবারও শুরুতে যান। কেন এই চরিত্রগুলো তৈরি হচ্ছে, তার একটা যোগসুত্র তৈরি করুন। আবার এগিয়ে যান। আবার ফিরে দেখুন, আবার লেখুন। বার বার গোড়ায় ফিরে যাবেন, তাতে করে আপনার গল্পের মেজাজ, বৈশিষ্ট্য আলাদা মাত্রা পাবে।
১৯. গেট সাজানো:
এবার ওয়েলকাম গেট সাজান। মানে, গল্পটিকে এমনভাবে সাজান যেন মনে হয়, চরিত্রগুলোই পাঠককে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। পাঠক অতিথি আর চরিত্রগুলো হলো হোস্ট। অঙ্কিত চরিত্র আর পাঠকের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করুন।
এখানে একটি সমাপ্তির ভীত নির্মাণ করা প্রয়োজন। গল্পের উপসংহারে এগিয়ে যান। চরিত্রকে মূল চক্রান্ত বা চক্রান্তকারীর কাছে নিয়ে যান। তাকে বুঝতে সাহায্য করুন চক্রান্তকারীর মোটিভ কী ছিল। কী করতে চেয়েছিল, কেন করতে চেয়েছিল--তা বুঝতে দিন।
২০. শাসন করুন:
প্রধান চরিত্রগুলোকে দিয়ে খল চরিত্রগুলোকে শাসন করুন, ধমক দিন, ভয় দেখান। তাকে বোঝান যে, সে অন্যায় করেছে। তার কৃতকর্মের ফলে কী কী ক্ষতি হল, তা তুলে ধরুন। ক্ষতির প্রভাব কী হল তাও বলুন। এজন্য তার কী শাস্তি বা সাজা দেয়া উচিত তাও জানতে দেন।
২১. যুক্তিতে নতুনত্ব আনুন:
প্রতিটি যুক্তিতে নতুনত্ব যোগ করুন। হোক সে পক্ষের যুক্তি কিংবা বিপক্ষের যুক্তি। এমন কিছু প্রয়োজন বা শর্ত দিন যা কিছুটা অভিনব। কেন দিলেন সেই যুক্তিটাও যোগ করুন নতুন আঙ্গিকে। ভাবনা-চিন্তা-চেতনা-মানসিকতাতেও নতুনত্ব যুক্ত করতে পারেন।
২২. ধ্বংস করুন:
সকল অপকর্ম, অন্যায়, অবিচারের নাশ করুন। গল্প শেষ পর্যায়ে। সুতরাং এবার সময় এসেছে দৃশ্যকল্পে যোগ হওয়া সকল দ্বন্দ্বের অবসান হওয়ার। এজন্য নেতিবাচক চরিত্র, ঘটনা বা অশুভ সব কিছুকেই ধ্বংস করুন।
২৩. ইতি টানুন:
এবার সাহিত্যের ভীষন সুন্দর একটা সমাধান টানুন। সমাপ্তিতেও যেন আপনার উপন্যাসের পূর্ণ স্বাদ পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায়। এমনভাবে আগ্রহী করে তুলুন যেন পাঠক বার বার আপনার উপন্যাসের জন্য মুখিয়ে থাকে।
২৪. একই কথা বার বার বলবেন না:
শর্ট অ্যান্ড স্লিম' আকারে গল্পটির ইতি টানুন। বেশি চর্বিত চর্বণের প্রয়োজন নেই। পুরো দৃশ্যগুলোকে একই সুতোয় গেঁথে পাঠকের জন্য চমৎকার একটি অনন্য সাহিত্য উপহার দিন।
২৫. বিরক্তিকর অংশকে চিহ্নিত করুন:
এবার নিজেই একবার আপনার গল্পটি পড়ুন। খুঁজে বের করুন, গল্পের বিরক্তিকর অংশটি। সেখানে প্রয়োজনীয় কাট-ছাট করুন। বাড়তি মেদ না রেখে উপন্যাসটিকে একটু স্লিম করুন। এবার আবারও পড়ুন। যতক্ষণ না নিজে পড়ে তৃপ্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ সংযোজন-বিয়োজন এবং সংশোধন করুন। মনে রাখবেন, যতবার পড়বেন, ততবারই উপন্যাসটিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। এতে করে আপনার লাভ বৈ ক্ষতি নেই। সুতরাং আর দেরি কেন, ঝটপট বসে পড়ুন, আর লিখে ফেলুন অনন্য এক কথাসাহিত্য।
লেখক পরিচিতি
সাজেদা হক
সাংবাদিক। অনুবাদক। প্রবন্ধকার।
লেখক যখন কোনও দৃশ্যের বর্ণনা করেন, তখন পাঠক যেন সেটি দেখতে পায়। অর্থাৎ, দৃশ্যের বর্ণনা এমন হতে হবে, যেন কেউ দেখে দেখে পড়ছেন। পাঠককে শুধু গল্প পড়তে নয়, দেখতেও দিতে দিতে হবে। পড়তে পড়তেই প্রত্যেকটি দৃশ্যকে স্বচক্ষে দেখার অনুভূতিটা পাঠকের মনে তৈরি করে দিতে হবে। যদি তা করতে পারেন, তাহলেই লেখক হিসেবে আপনি সফল।
আরও সহজ করে বলতে গেলে বলতে হয়, সিনেমায় যেমন প্রতিটি দৃশ্য আলাদা আলাদা, সাহিত্যের ক্ষেত্রেও পাঠকের কাছে প্রত্যেকটা দৃশ্যকেই আলাদাভাবেই দৃশ্যমান করতে হবে-- হোক সে গল্পের ক্রিয়া, প্রতিক্রিয়া, বচন কিংবা বহুবচন। মোট কথা-- প্রতিটি দৃশ্যকেই দৃশ্যমান হতে হবে এবং প্রতিটি দৃশ্যেরই একটা ইতি থাকবে। সংক্ষেপেই বোঝা যাবে লেখক আসলে কী বলতে চাইছেন।
এই কাজটা আসলে খুব কঠিন কিছু নয়। অনেকেই এটা খুব সহজেই পারেন। কেউ কেউ সাহায্য নিতে পারেন অন্য সাহিত্যিকদের। বিখ্যাতদের কাছ থেকে নেয়া কিছু টিপস আছে এখানে। যেমন:
• দৃশ্যের সংজ্ঞা
• দৃশ্যের উদ্দেশ্য
• দৃশ্যের গঠন
• দৃশ্যের ধরণ
পাঠকের মনে আপনার কল্পিত দৃশ্যটি চিত্রনে ওপরের এই কয়েকটি বিষয় আগে আপনার কাছে পরিস্কার থাকা দরকার।
দৃশ্যের সংজ্ঞা:
একটি ছোটগল্প বা উপন্যাসের একটি দৃশ্য আর একটি সিনেমার একটি দৃশ্যের মধ্যে কোনও তফাত নাই। সাহিত্যের সব দৃশ্যই জীবন থেকে নেয়া। জীবন থেকে নেয়া বলেই গল্প বা কথাসাহিত্যে এসব দৃশ্যই পাঠককে সম্পৃক্ত করে। তাই কখনও পাঠক নিজেই নায়ক হয়ে যান। গল্পের প্রতিটা দৃশ্যের সঙ্গেই নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলেন। ভাবেন, এটি তার জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। যে-দৃশ্য, জীবনের গল্প থেকে নেয়া, সেটি পাঠকের কাছে বাস্তব বলে মনে হয়।
একজন লেখক একটি দৃশ্য গঠন করেন, তিনি তখন গল্পটিতে কী ঘটছে তা পাঠককে দেখাতে চাইবেন। কী ঘটছে তা নাটকীয়তার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলবেন। সেজন্য যে-বিষয়গুলি মনে রাখতে হবে :
• সেটিং বিবরণ। লেখক অবশ্যই দৃশ্যের সময় এবং অবস্থান অন্তর্ভুক্ত করবেন।
• এ্যাকশন থাকতে হবে। কিছু একটা ঘটতে হবে। হোক তা, দ্বন্দ্ব, বা সংঘাত বা যে-কোনও কিছু।
• বর্ণনা থাকতে হবে। লেখককে অবশ্যই প্রত্যেকটি দৃশ্যের সুনির্দিষ্ট বিবরণ দিতে হবে।
দৃশ্যকে সহজপাঠ্য করতে লেখক 'সংলাপ এবং প্রধান চরিত্রের চিন্তার ভারসাম্য-তারতম্য'ও যোগ করতে পারেন।
দৃশ্যের উদ্দেশ্য:
লেখক গল্পকে বিশ্বাসযোগ্য করাবার জন্য একটি দৃশ্য তৈরি করেন। পাঠককে এই দৃশ্যের উদ্দেশ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। লেখক এক বা একাধিক নাটকীয়তা তৈরি করতে পারেন অনায়াসেই। কিন্তু এই নাটকীয়তার উদ্দেশ্য পাঠকের কাছে পরিস্কার করাটাও লেখকের জন্য জরুরি একটি বিষয়। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের দিকে একটু খেয়াল রাখলেই, তা সহজেই করা যেতে পারে:
• ইভেন্টে নাটকীয়তা যোগ;
• চক্রান্তকে গতি দেয়া, এগিয়ে নেয়া;
• দ্বন্দ্ব বা সংঘাতকে প্রবল বা তীব্র করে তোলা;
• নতুন চরিত্র যোগ বা চরিত্রের বিকাশ;
• কথাসাহিত্যের মুড বা থিমকে প্রতিষ্ঠা করা;
• সমাধানের ইঙ্গিত দেয়া।
দৃশ্যগঠন:
একটি দৃশ্য, এক বা একাধিক ঘটনার নাটকীয় উপস্থাপন। এই উপস্থাপনেরও নির্দিষ্ট একটি কাঠামো আছে।
• শুরু (দৃশ্যের শুরু থাকতে হবে)।
• মধ্য (দৃশ্যের মধ্য থাকতে হবে)।
• শেষ (দৃশ্যের শেষ থাকতে হবে)।
দৃশ্যায়ন আরম্ভের কোনও নিয়ম নেই। লেখক বিভিন্ন উপায়ে একটি দৃশ্য পাঠকের কাছে তুলে ধরতে পারেন। লেখক কখনও কখনও চরিত্রের বর্ননা দিতে পারেন, ঘটনার বর্ণনা দিতে পারেন আবার কখনও কখরও গল্পে মধ্যভাগ থেকেও কিংবা কোনো ডায়ালগের মধ্যভাগ থেকেও দৃশ্য আরম্ভ করতে পারেন। আপনার উপন্যাসের ধরণের ওপর নির্ভর করছে আপনার দৃশ্যগঠন।
দৃশ্যের মাঝখানে লেখক সাধারণ দ্বন্দ্বকে তীব্র করে, চরিত্রকে বিস্তৃত করে এবং ঘটনাকে এগিয়ে নেন। দৃশ্যের শেষে, লেখক সাসপেন্স, টানটান উত্তেজনা, দ্বন্দ্ব তৈরি করে অমীমাংসিত দৃশ্যের দিকে চলে যান। পাঠক তখন পরবর্তী দৃশ্যের জন্য পাতা উল্টায়। এভাবেই একটির পর একটি পাতা উল্টাতে উল্টাতে পাঠক লেখকের প্রেমেই পড়ে যায়।
দৃশ্যের ধরন:
দৃশ্যের অনেক ধরন আছে। যেমন:
- দৃশ্য হবে এমন যা গল্পের ভবিষ্যৎ পটভূমির বিবরণ দেবে।
- এমন দৃশ্য যা দ্বদ্বের জন্ম দেবে।
- দৃশ্য এমন যা কখনও কখনও নতুন চরিত্রের জন্ম দেবে।
- এ্যাকশনকে প্রতিফলিত করবে।
- সাসপেন্স তৈরি করবে।
- অতীতের ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পারে।
- সম্ভাব্য সমাধানের ইংগিত দেবে।
লেখক সাসপেন্স তৈরি, দ্বন্দ্ব প্রদর্শন, দ্বন্দ্ব বিকাশ, চরিত্রের প্রকাশ, কর্ম বর্ণনা করতে একটি দৃশ্যের গাঁথুনি করেন। ফ্ল্যাশব্যাক দৃশ্য একটি দৃশ্যের মধ্যে একটি দৃশ্য। লেখক যেখানে এমন কিছু লিখেছেন যা অতীতে ঘটেছে, পাঠককে তা স্মরণ করিয়ে দিতেও দৃশ্যের প্রয়োজন হতে পারে।
গল্পের 'মধ্যভাগে আবেগ' যোগের ২৫ উপায়:
লেখার সবচেয়ে জটিল অংশ হলো মধ্যভাগ। গল্পের শুরু করা যায়, শেষও করা যায় কিন্তু মধ্যভাগে এমন কি যোগ করা উচিত উচিত তা নিয়েই অনেক লেখক চিন্তিত থাকেন। কখনও দ্বন্দ্ব যোগ করার কথা ভাবেন, তো কখনও সংঘাতের কথা ভাবেন। কেউ কেউ ভাবেন আবেগ যোগের কথা। যারা সাহিত্যের মধ্যভাগে আবেগ যোগের কথা ভাবের তাদের জন্য ২৫টি টিপস।
১. দৃশ্যের দ্বিতীয় অংশে যেতে:
দৃশ্যের প্রথম ভাগটাও ছোট, শেষ ভাগটাও ছোট কিন্তু মধ্যভাগটা হবে দুটোকে যুক্ত করার অংশ। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন ক্ষেত্রে আপনি চতুর্থ পরিকল্পনা হাতে নিতে পারেন। প্রত্যেকটির সঙ্গে প্রত্যেকটিকে যুক্ত করুন। কোনওটাকে বাদ দিয়ে যেন কোনওটা না হয়। চলচ্চিত্র বা নাটকের দৃশ্যগুলোতে যেমন গাঁথুনি থাকে। হ্যারি পটারকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
২. নাটকীয়তার জাল বুনুন:
দৃশ্যের পরতে পরতে নাটকীয়তার জাল বুনুন। পাঠক যেন কোনওভাবেই একটু পরেই লেখক কী করতে পারেন তা অনুমান করতে না পারে। জাল বুনুন ষড়যন্ত্রের, জটিলতা তৈরি করুন চরিত্র থেকে চরিত্রে। আবার সেসব জটও খুলে দিন। আবার জট লাগান। এভাবেই চলতে থাকুক পাতার পর পাতা।
৩. 'পরী, দস্যু, বিধাতা' ধরনের চরিত্র যোগ করুন:
ক্লাইম্যাক্স তৈরি করতে পারছেন না? চিন্তা নেই আপনার গল্পের ধরণ অনুযায়ী সাহিত্যে যোগ করুন কোন অপ্সরা, পরী, দৈত্য কিংবা বিবেক বা বিধাতা চরিত্র। যোগ করতে পারেন অশরীরী কোন কিছুও। দেখবেন গল্পটি কীভাবে গতি পাচ্ছে।
৪. ধর্মীয় কোন উৎসবকে যোগ করুন:
গল্পে তো অনেক সময় কাল থাকে, ইস্যু থাকে, থাকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-ক্লেশ-ক্লাইম্যাক্স। সবই ঠিক আছে, তবে কোনও এক জায়গায় ধর্মীয় উৎসব যোগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে 'লালসালু'কে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
৫. নতুন চরিত্র যোগ করুন:
গল্পের ঠিক মাঝখানে নতুন একটি চরিত্র যোগ করুন, যে-চরিত্রটি আপনার গল্পকে শুধু গতিই দেবে না, মোড়ও ঘুরিয়ে দেবে। পাঠকও অবাক হবেন। অনাকাঙ্ক্ষিত এ-চরিত্রটি হতে পারে সাময়িক কিংবা দীর্ঘ। এটা নির্ভর করবে আপনার গল্পের ধরনের ওপর। চরিত্রটি-- নারীও হতে পারে, পুরুষও হতে পারে। ভালও হতে পারে, মন্দও হতে পারে। ভেবে দেখুন কি দিলে হয়। যোগ-বিয়োগে মেলে কি না?
৭. সত্যিকারের একটি জটিল চরিত্র যোগ করুন:
পরিস্থিতিকে জটিল থেকে জটিলতর করুন। এমন চরিত্র যোগ করুন যেটি সত্যিকার অর্থেই নেগেটিভ চরিত্র হবে। ওই প্রবাদটা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের,
'দুষ্টু লোকের মিষ্ট কথা
ভিড়িয়া বসে কাছে
কথা দিয়ে কথা নেই
প্রাণ বধে শেষে'।
কি পেয়ে গেলেন তো চরিত্রটি আসলে কেমন হবে? কীভাবেই বা কাজ করবে সেটি! ব্যাস, আর কী, এবার শুরু করে দিন।
৮. পার্থক্যগুলো তুলে ধরুন:
হুমম, এবার জটগুলোকে আস্তে আস্তে খুলুন। চরিত্রগুলোর পার্থক্যগুলো আলাদা আলাদা করুন। পাঠক যেন এই পর্যায়ে বুঝতে পারে, কোন চরিত্র কী করছে। চরিত্রগুলোর কাছে জট না খুললেও চলবে, কিন্তু পাঠকের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন। অর্থাৎ চরিত্রের জটিলতা চরিত্রগুলো টের না পেলেও, পাঠকের কাছে স্পষ্ট করুন।
৯. এবার অ্যাকশনে যান:
এবার গল্পের লাগাম টেনে ধরুন। বদ চরিত্রের বাদরামির কিছু কিছু অংশ আপনার সাহিত্যের প্রধান চরিত্রকে বুঝতে দিন। দ্বন্দ্বের কারণ সম্পর্কে চরিত্রগুলোকে ইঙ্গিত দিন। প্রয়োজনে এ্যাকশনে যান। অর্থাৎ হাতে-নাতে চক্রান্তকারীকে ধরিয়ে দিন।
১০. গল্পের ম্যাপ আঁকুন:
এই পর্যায়ে আপনি আসলেই গল্পের মধ্যখানে এসে পড়েছেন। এবার মনে মনে একটি ছক এঁকে নিন। গল্পের শুরু কোথায় করেছেন, শেষ কোথায় করবেন, এখন আছেন কোথায়। স্থির হয়ে নিন। ঠাণ্ডা মাথায়, আবার পড়ুন, ভাবুন এবং ছকটাকে মাথার মধ্যে গেঁথে ফেলুন। সেইভাবেই এগোতে থাকুন।
১১. দৃশ্যের বিন্যাস করুন:
এবার দৃশ্যগুলোর শৈল্পিক বিন্যাস করুন। মনোযোগ দিন। ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিন। আরও নিখুঁত আরও প্রাণবন্ত আরও আকর্ষণীয় করুন দৃশ্যগুলোকে। এই বিন্যাসটা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই যত্নের সঙ্গে করবেন।
১২. ধাপে ধাপে দৃশ্য বাড়ান:
ধাপে ধাপে দৃশ্যগুলোকে এগিয়ে নিন। এমনকি পোশাক, মুখভঙ্গি সব খেয়াল করুন। চিন্তা-ভাবনাকেও বাদ দেবেন না। দৃশ্যের প্রয়োজনে স্থান পরিবর্তন করুন। সেটা যুক্তিযুক্ত হবে। শারীরিক দ্বন্দ্ব কিংবা মানসিক দ্বন্দ্বকে পৃথক করুন। সেই পার্থক্যগুলোকেই ধাপে ধাপে তুলে ধরুন।
১৩. স্থির থাকুন:
গল্পের মাঝখানে এসে মুলত পাঠক নয়, বিপদে পড়েন লেখকই। তাই অস্থির হবেন না। একটু শান্তভাবে বসুন। সবকিছুকে ফিরে ফিরে করুন। একের পর এক দৃশ্যগুলোকে নিজের মনেই গেঁথে যান। দেখবেন, কোথাও থামছেন না আপনি। ভয় পাবেন না কিছুতেই, খেইও হারাবেন না, -কারণ আপনিই পারবেন।
১৪. চাইলে কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন:
এখানে চাইলে একটু পরিবর্তন আনতে পারেন। মানসিক চাপ বাড়াতে পারেন। আবার মজার মজার সেন্স অব হিউমারও যোগ করতে পারেন। হাস্যরসাত্মক চরিত্র যোগ করতে পারেন। চমকও যোগ করতে পারেন এখানে। আপনার ইচ্ছা।
১৫. সন্দেহ তৈরি করুন:
এবার চরিত্রের প্রতি চরিত্রের মধ্যে সন্দেহ তৈরি করুন। ভাল এবং খারাপ মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরুন।চরিত্রের প্রতি চরিত্রে বিশ্বাস হারাতে দিন। অবিশ্বাসী করে তুলুন। এটা আপনার গল্পকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। গল্পে যোগ হবে নান্দনিকতা।
১৬. এখান থেকে মূলে ফিরে যান:
এই পর্যায়ে এসে একদম কাহিনীর শুরুতে ফিরে যান। কী নিয়ে শুরু করেছেন গল্প আর কোথায় শেষ চাচ্ছেন। ঠিক সেখানে পৌঁছতে আপনাকে আর কী যোগ করতে হবে ভেবে দেখুন।
১৭. বহু ধরণের অভিজ্ঞতার সংমিশ্রন ঘটান:
সীমাবদ্ধ হয়ে যাবেন না। বহু চরিত্র, বহু ঘটনা একসাথে চিত্রিত করুন। একইসাথে দ্বন্দ্বগুলোক আস্তে আস্তে গুছিয়ে নিতে পারেন। একইসাথে বুদ্ধিজীবী, সামাজিক, মানসিক, শারীরিক চরিত্র যোগ করুন এবং সেগুলোকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ক্লাইম্যাক্স দিয়ে ঘিরে রাখুন।
১৮. আবারও শুরু থেকে শুরু করুন:
আবারও শুরুতে যান। কেন এই চরিত্রগুলো তৈরি হচ্ছে, তার একটা যোগসুত্র তৈরি করুন। আবার এগিয়ে যান। আবার ফিরে দেখুন, আবার লেখুন। বার বার গোড়ায় ফিরে যাবেন, তাতে করে আপনার গল্পের মেজাজ, বৈশিষ্ট্য আলাদা মাত্রা পাবে।
১৯. গেট সাজানো:
এবার ওয়েলকাম গেট সাজান। মানে, গল্পটিকে এমনভাবে সাজান যেন মনে হয়, চরিত্রগুলোই পাঠককে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। পাঠক অতিথি আর চরিত্রগুলো হলো হোস্ট। অঙ্কিত চরিত্র আর পাঠকের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করুন।
এখানে একটি সমাপ্তির ভীত নির্মাণ করা প্রয়োজন। গল্পের উপসংহারে এগিয়ে যান। চরিত্রকে মূল চক্রান্ত বা চক্রান্তকারীর কাছে নিয়ে যান। তাকে বুঝতে সাহায্য করুন চক্রান্তকারীর মোটিভ কী ছিল। কী করতে চেয়েছিল, কেন করতে চেয়েছিল--তা বুঝতে দিন।
২০. শাসন করুন:
প্রধান চরিত্রগুলোকে দিয়ে খল চরিত্রগুলোকে শাসন করুন, ধমক দিন, ভয় দেখান। তাকে বোঝান যে, সে অন্যায় করেছে। তার কৃতকর্মের ফলে কী কী ক্ষতি হল, তা তুলে ধরুন। ক্ষতির প্রভাব কী হল তাও বলুন। এজন্য তার কী শাস্তি বা সাজা দেয়া উচিত তাও জানতে দেন।
২১. যুক্তিতে নতুনত্ব আনুন:
প্রতিটি যুক্তিতে নতুনত্ব যোগ করুন। হোক সে পক্ষের যুক্তি কিংবা বিপক্ষের যুক্তি। এমন কিছু প্রয়োজন বা শর্ত দিন যা কিছুটা অভিনব। কেন দিলেন সেই যুক্তিটাও যোগ করুন নতুন আঙ্গিকে। ভাবনা-চিন্তা-চেতনা-মানসিকতাতেও নতুনত্ব যুক্ত করতে পারেন।
২২. ধ্বংস করুন:
সকল অপকর্ম, অন্যায়, অবিচারের নাশ করুন। গল্প শেষ পর্যায়ে। সুতরাং এবার সময় এসেছে দৃশ্যকল্পে যোগ হওয়া সকল দ্বন্দ্বের অবসান হওয়ার। এজন্য নেতিবাচক চরিত্র, ঘটনা বা অশুভ সব কিছুকেই ধ্বংস করুন।
২৩. ইতি টানুন:
এবার সাহিত্যের ভীষন সুন্দর একটা সমাধান টানুন। সমাপ্তিতেও যেন আপনার উপন্যাসের পূর্ণ স্বাদ পাঠকের অন্তর ছুঁয়ে যায়। এমনভাবে আগ্রহী করে তুলুন যেন পাঠক বার বার আপনার উপন্যাসের জন্য মুখিয়ে থাকে।
২৪. একই কথা বার বার বলবেন না:
শর্ট অ্যান্ড স্লিম' আকারে গল্পটির ইতি টানুন। বেশি চর্বিত চর্বণের প্রয়োজন নেই। পুরো দৃশ্যগুলোকে একই সুতোয় গেঁথে পাঠকের জন্য চমৎকার একটি অনন্য সাহিত্য উপহার দিন।
২৫. বিরক্তিকর অংশকে চিহ্নিত করুন:
এবার নিজেই একবার আপনার গল্পটি পড়ুন। খুঁজে বের করুন, গল্পের বিরক্তিকর অংশটি। সেখানে প্রয়োজনীয় কাট-ছাট করুন। বাড়তি মেদ না রেখে উপন্যাসটিকে একটু স্লিম করুন। এবার আবারও পড়ুন। যতক্ষণ না নিজে পড়ে তৃপ্ত হচ্ছেন, ততক্ষণ সংযোজন-বিয়োজন এবং সংশোধন করুন। মনে রাখবেন, যতবার পড়বেন, ততবারই উপন্যাসটিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। এতে করে আপনার লাভ বৈ ক্ষতি নেই। সুতরাং আর দেরি কেন, ঝটপট বসে পড়ুন, আর লিখে ফেলুন অনন্য এক কথাসাহিত্য।
লেখক পরিচিতি
সাজেদা হক
সাংবাদিক। অনুবাদক। প্রবন্ধকার।
0 মন্তব্যসমূহ