শহীদুল জহিরের দিকে দেখি

শাহাদুজ্জামান

যাদুকর লেখক শহীদুল জহির। তিনি তার যাদুবিদ্যায় পাঠকের মন বশ করেন। তার পাঠক যেন ডুমুর খেকো মানুষ। তিনি আমাদের বিচিত্র সব বিষয়ের সন্ধান দেন। তার গল্পে আব্দুল করিমের ছেঁড়া স্যান্ডেল, মহল্লার মৌসুমী তরমুজ বিক্রেতা, মিয়া আব্দুল করিমের ডালপুড়ি আখ্যান আমাদের এক যৌথ সমাজের ইংগিত দ্যায়। অথবা যৌথতাও নয়, সুইসাইডের দিকে ঠেলে দেবার মত চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতা উদযাপনের কথা-ও বলেন। আমরা তখন সুহাসিনী গ্রামের মানুষের মতো হতবিহ্ব্ল হয়ে পড়ি। আর শহীদুলকে অনুধাবন করতে চাই দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ি, বাবুবাজার, মিরপুর ১০ নং গোলচক্কর, মাতুয়াইল অথবা শনিরআখড়া অথবা ফার্মগেটে অথবা পল্টন মোড়ের ভয়ঙ্কর ৩ ঘণ্টার জ্যামে আটকা পড়ে অথবা না পড়ে, নিজ কি বন্ধু কি সুহাসিময় রমণীদের বাসা বা অফিসের দিকে যেতে যেতে, আমাদের ব্যক্তিগত বোধে।

অনন্য কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান তার নিজস্ব ভাবনায় ও বয়ানে সেই যাদুকর লেখককে তুলে ধরেছিলেন তার বক্তৃতায়। যেখানে শহীদুল জহিরকে তিনি নানাবিধ নিক্তিতে মাপার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা তো আর সহজ কাজ নয়। সেই অ-সহজ কাজটির জন্য লেখক শাহাদুজ্জামানকে সেলাম জানাই আর আমরা শহীদুল জহিরের পাঠকেরা নিতান্তই অকম্মার মতন মহল্লার ফার্মেসি কিংবা ডাইল্পুরীর দোকানে ঘুরপাক খাই, ডলুনদীর দেশে অথবা ময়মনসিংহের ফুল্বাড়িয়ায় ক্যামনে যাওয়া যায় তা নিয়া ভাবি অথবা ভাবিনা। আর এইভাবে যে বিভ্রম ও কুহেলীকা আমাদের জড়ায়ে ধরে, তার কুয়াশায় বসে থাকি। তখন শহীদুল জহিরের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কিছুই করার থাকেনা।

জয়তু শহীদুল জহির।
ভূমিকাঃ শিবু কুমার শীল

…………………………………………………………………………………………

ধন্যবাদ জানাই ‘বাঙলার পাঠশালা‘কে আমাকে এখানে আমন্ত্রন জানাবার জন্য। গত বছরেও আমি বাঙলার পাঠশালার একটা আয়োজনে কথা বলেছিলাম। কথা বলেছিলাম ‘বিশ্বায়নের কালে লেখালেখি’ এই বিষয়ে। এবার এই সংগঠনের প্রধান সংগঠক আহমেদ জাভেদ চৌধুরী রনি আমাকে অনুরোধ করেছেন শহীদুল জহির সম্পর্কে বলবার জন্যে। আমি খুব আগ্রহের সঙ্গেই আমার সম্মতি জানিয়েছি কারণ শহীদুল জহিরকে আমি আমার পছন্দের লেখকদের মধ্যে অন্যতম একজন বলে মনে করি।

আমার লেখালেখির সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তারা হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে আমি নানা বিষয়ে লিখেছি। সাহিত্যের নানা শাখায় কাজ করার চেষ্টা করেছি। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ, পত্রিকার কলাম ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে আমি কাজ করছি। আসলে যেটা হয় যে, বিভিন্ন সময় নানারকম প্রশ্ন, নানারকম ভাবনা দিয়ে তাড়িত হই। তারপর সেই ভাবনা আর প্রশ্নগুলো বহন করে বেড়াই অনেকটা মালবাহী ট্রাকের মত। ভার বোধ করি। একটা সময় সেই ভারটাকে লাঘব করবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এইসব প্রশ্ন আর ভাবনার বোঝাটাকে নামানোর ইচ্ছা হয়। একমাত্র লিখেই এই বোঝাটাকে নামাতে পারি। কিন্তু সব বোঝা তো সব জায়গায় নামানো যায় না। কোনো বোঝা নামাই গল্পে, কোনটা উপন্যাসে, কোনটা প্রবন্ধে, কোনটা পত্রিকার কলামে। লেখালেখি করা তাই আমার কাছে একটা ভারমুক্ত হবার ব্যাপার। লিখেই মনে ভার হয়ে থাকা প্রশ্নগুলোকে, ভাবনাগুলোকে মোকাবেলা করতে পারি। আমি যখন অন্যের লেখার পাঠক হই তখনও আমার সেই একই তাড়না কাজ করে। আমি এমন লেখাই পাঠ করতে চাই যা আমাকে ভারমুক্ত করবে, যে লেখা আমার ভেতর যে প্রশ্নগুলো আছে, আমার ভেতর যে ভাবনাগুলো আছে সেগুলোকে মোকাবেলার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। শহীদুল জহির যখন আমি পাঠ করি, তখন আমার ঠিক সেরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়। শহীদুল জহির পাঠ করতে গিয়ে আমি চিন্তার একটা নতুন দিগন্তে গিয়ে পৌঁছাই, আমার অনেক ভাবনার জট খুলে যায়, আমি সত্যি ভারমুক্ত বোধ করি। এবং পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটে একটা গভীর আনন্দের ভেতর দিয়ে। পাঠক হিসেবে শহীদুল জহির তাই আমার পছন্দের তালিকার অন্যতম একজন।

শুরুতেই বলি কি করে শহীদুল জহিরের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটলো। শহীদুল জহিরের লেখার সঙ্গে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের অন্যতম আরেকজন কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। সম্ভবত নব্বই/একানব্বই সালের দিকে। আমি তখন আড্ডা দেবার জন্য নিয়মিত ইলিয়াস ভাইয়ের টিকাটুলির বাড়িতে যেতাম। তেমনি একটা আড্ডার দিন তিনি আমাকে একটা বই দিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা পড়ে দেখো, সিগনিফিকেন্ট একটা কাজ‘। আমার মনে আছে, বইটার প্রচ্ছদে ছিলো সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে খুব আনাড়ি একটা স্কেচ, বইটার প্রডাকশন ছিলো নিম্নমানের। চটি আকারের একটা বই, নাম ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটা কোনো প্রবন্ধের বই হবে। তাছাড়া প্রবন্ধের বই হিসেবেও নামটা আমার খুব ক্লিশে আর অনাকর্ষনীয় মনে হয়েছিলো। ইলিয়াস ভাই বললেন, এটা একটা উপন্যাস। তো আমি বাড়িতে গিয়ে বইটা পড়তে শুরু করি। বইটার প্রথম লাইন- ‘উনিশশ পঁচাশি সনে একদিন লক্ষ্মীবাজার শ্যামপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সংগে সঙ্গতিবিধানে ব্যার্থ হয়ে ফট করে ছিড়ে যায়’। বলা যায় যে, বইটার এই প্রথম লাইনই আমাকে রীতিমত বঁড়শির মত গেঁথে ফেলে। আপনাদের যাদের স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যে, এই স্পঞ্জের স্যান্ডেল এভাবেই খুব বেমক্কা, বেকায়দা জায়গায় এরকম ফট করে ছিড়ে যায়। এরপর তিনি আবদুল মজিদের স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা নিয়ে এমনভাবে আলাপ শুরু করেন যেন সেই স্যান্ডেলটার প্রাণ আছে, ব্যক্তিত্ব আছে। এরপর তিনি ক্রমশ যে পরিস্থিতির সাথে সংগতিবিধানে ব্যার্থ হয়ে এই স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতাটা ছিঁড়ে গেলো সে পরিস্থিতির দিকে আমাদের নিয়ে যান। আমি দেখতে পাই ঘটনাবলি ঘটছে পুরনো ঢাকার প্রেক্ষাপটে এবং আমার সামনে উন্মোচিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সময়কাল। একটা স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতা থেকে তিনি ধীরে ধীরে পাঠককে নিয়ে যান একটা বৃহৎ প্রেক্ষাপটে। মাইক্রো থেকে ম্যাক্রোতে। সম্ভবত দ্বিতীয় পৃষ্ঠাতেই একটা দৃশ্য দেখতে পাই যেখানে একজন মওলানা, যিনি বস্তুত একজন রাজাকার, মানুষের মাংস টুকরা টুকরা করে কাককে খাওয়াচ্ছেন। আরো দেখি সেই মাংসের একটা টুকরা মওলানার প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী সেই মাংসের টুকরাটা হাতে তুলে নিয়ে আবিষ্কার করছে যে সেটা আসলে একজন মেয়ের আংটি পরা একটা কাটা আঙুল। আমি ক্রমশ টের পাই সাহিত্যের একটা নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর ঢুকেছি আমি, একটা নতুন পৃথিবীতে ঢুকেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে এভাবে আমি পাঠ করিনি কখনো। আমি এক টানে রুদ্ধশ্বাসে বইটা শেষ করি এবং বইটা শেষ করবার পর আমার কোনো সন্দেহ থাকে না যে মুক্তিযুদ্ধের উপর শ্রেষ্ঠ বইটাই আমি পড়ে উঠলাম। এরপর থেকে আমি শহীদুল জহিরের লেখার জন্য বরাবর অপেক্ষা করেছি। তার পরবর্তী সবগুলো বই আমি মনোযোগের সাথে পড়েছি এবং আমি তাকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবেই বিবেচনা করে নিয়েছি। আমি আমার ‘গল্প, অগল্প না গল্প‘ সংকলনটাকে শাহিদুল জহিরকেই উৎসর্গ করেছি।

আসলে সাহিত্যের মাঠে নানারকম চেষ্টা তো অবিরাম চলছে। অনেক পরিশ্রম, অনেক চেষ্টা। কিন্তু সব চেষ্টা, সব পরিশ্রম কোথাও গিয়ে পৌছায় না। যেমন কিনা আমের মৌসুমে হাজার হাজার মুকুল হয়, কিন্তু গুটিকয়েক মুকুলই কেবল আমে পরিনত হয়। সাহিত্যের অঙ্গনে এরকম বহু মুকুল ফোটে কিন্তু আম হয়ে ওঠে গুটিকয় মাত্র। শহীদুল জহিরের লেখা পড়বার পরে আমার মনে হয়েছে যে, শহীদুল জহির সেরকম একজন সফল আম। যিনি সত্যিকার অর্থে মুকুল থেকে ফুটে বেরিয়েছেন। গল্প উপন্যাসের সফলতার প্রশ্নে গার্সিয়া মার্কেজ একবার বলেছিলেন, ‘আইদার ইট ওয়ার্ক অর ইট ডাজ নট‘। শহীদুল জহিরের লেখা পড়ার পর আমার মনে হয়েছে সাহিত্যে এ এক নতুন কন্ঠস্বর এবং ইট ডেফিনিটলি ওয়ার্কস। নিজে একজন প্র্যাকটিসিং লেখক হিসেবে, এই অভিনব ধারার লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে কৌতুহলী হয়ে উঠি। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে পরিচয়ও ঘটে আমার। কিন্তু তিনি ভেতরগোটানো স্বভাবের মানুষ। তার সঙ্গে আড্ডায় মশগুল হওয়া সহজ না। তবে অভিজ্ঞতায় দেখেছি একবার তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে গেলে অনেক আলাপই জমে ওঠে। আমার সুযোগ হয়েছিলো তার সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিস্তর আড্ডা দেবার। তিনি আমার লেখারও মনোযোগী পাঠক ছিলেন। সেসব আড্ডায় আমি যেমন তার লেখা সম্পর্কে আমার মতামত জানাবার সুযোগ পেয়েছি, আমার সৌভাগ্য হয়েছে, আমার লেখা সম্পর্কেও তার মতামত জানবার। আমার একটা বাড়তি আনন্দের ব্যাপার এই যে তিনি আমার বই ‘বিসর্গতে দুঃখ’র একটা রিভিউ করেছিলেন। মেধাবী একটা রিভিউ। এবং সেটা তার জীবনের একমাত্র বুক রিভিউ।

শহীদুল জহিরের উপন্যাস ‘মুখের দিকে দেখি‘র আদলে আজকের এই বক্তৃতার শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘শহীদুল জহিরের দিকে দেখি।‘ তো শহীদুল জহিরের লেখা পাঠ এবং তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ইত্যাদি মিলিয়ে আমি কিভাবে শহীদুল জহিরের দিকে দেখি তা নিয়ে কিছু কথা বলবার চেষ্টা করবো আজকে। বলাবাহুল্য আমার শহীদুল জহিরের দিকে দেখার সঙ্গে অন্যের দেখার মিল থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে। বক্তৃতার শেষে প্রশ্ন উত্তর পর্বে এ নিয়ে আমরা কথা বলারর সুযোগ পাবো। বলে নেয়া ভালো যে শহীদুল জহিরের যাবতীয় কাজ নিয়ে, তার প্রতিটি উপন্যাস, গল্প নিয়ে একটা পুর্নাঙ্গ সাহিত্যিক আলোচনার সুযোগ এই বক্তৃতার পরিসরে নাই। শহীদুল জহিরের লেখা এবং জীবনের উপর আমার কিছু পর্যবেক্ষনের কথা সংক্ষেপে বলবার চেষ্টা করবো শুধু।

যেটা শুরুতে বলছিলাম যে, শহীদুল জহির তার লেখার ভিতর দিয়ে একটা এ্যাটমোস্ফিয়ার তৈরি করেন, একটা আবহ তৈরি করেন, যে আবহের স্বতন্ত্র একটা চরিত্র আছে, বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে যা নতুন। আমার পাঠের অভিজ্ঞতাকে যা একটা নতুন দিগন্তে পৌঁছে দেয়। শহীদুল জহিরের এই সাহিত্যিক আবহের ভেতর আমি কতগুলো প্রবণতা লক্ষ্য করি। ধরা যাক তার ভাষা। গদ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাষার ব্যাবহার তো নানারকম আছে। মোটাদাগে বললে একদল গদ্য লেখক আাছেন, আমি মুলত গল্প, উপন্যাস লেখকের কথা বলছি যাদের কাছে ভাষা হচ্ছে তার কাহিনীটাকে, তার বিষয়টাকে টেনে নিয়ে যাবার বাহন। আবার আরেক ধরণের লেখক আছেন যাদের কাছে ভাষাটাই একটা বিষয়। ভাষা তাদের কাছে গল্পটা বলবার মাধ্যম না কেবল, তারা ভাষার ভেতর দিয়ে একটা রহস্য তৈরী করেন, ভাষাটাকেই তারা একটা বিষয় হিসেবে উপস্থিত করেন, ভাষাটাকেই তার কনটেণ্ট হিসেবে দাঁড় করান। শহীদুল জহির এই দ্বিতীয় ধারার লেখক। ভাষার নিজস্ব চরিত্র দাঁড় করাবার চেষ্টা অনেকেই করেন। কিন্তু ঐ যে বলছিলাম, ‘আইদার ইট ওয়ার্কস অর ইট ডাজ নট।‘ সবার চেষ্টার মধ্যে সেই মেধা থাকে না। শহীদুল জহির যে মেধা আর প্রজ্ঞা সমেত ভাষা ব্যবহার করেছেন তা সফলভাবেই সাহিত্যে এক নতুন এ্যাটমোস্ফিয়ারের জন্ম দিয়েছে। বাংলা কথাসাহিত্য দীর্ঘদিন ধরে, পশ্চিমবঙ্গের এবং বাংলাদেশের লেখকদের হাত ধরে যে ধারায় পুষ্টি পেয়েছে, সে ধারা থেকে শহীদুল জহির বেশ বড় একটা বাঁক নিয়েছেন। তার সঙ্গে তার পুর্বসুরিদের মিল খুব সামান্য। খানিকটা মিল পাওয়া যায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র সঙ্গে। পশ্চিমবঙ্গের লেখক কমলকুমার মজুমদার যিনি সচেতনভাবে নিজস্ব একটা সান্ধ্য ভাষা তৈরি করেছিলেন, তার সঙ্গেও ঠিক মেলে না শহীদুল জহিরের। বলা যায় শহীদুল জহির স্বরুপে স্বতন্ত্র হয়ে হাজির হয়েছেন আমাদের সাহিত্যে।

গদ্য রচনার প্রকরণের দিক থেকে যদি বলি তাহলে আমি লক্ষ্য করি, বাক্য গঠনে তিনি ব্যাপকভাবে ‘প্যারেন্থিসিস‘ ব্যাবহার করেন, যা ইংরেজি সাহিত্যে বিস্তর ব্যাবহার হয়। আপনারা জানেন যে প্যারেনন্থিসিসের ক্ষেত্রে অনেকগুলো ছোটো ছোটো বাক্যাংশ মিলিয়ে একটা দীর্ঘ বাক্য তৈরি করা হয়। একটা দীর্ঘ বাক্যের ভেতর স্বয়ংসম্পুর্ন অনেকগুলো বাক্যাংশ থাকে এবং সেই বাক্যংশকে যদি ঐ পুর্নাঙ্গ বাক্য থেকে সরিয়ে ফেলা হয়, তুলে নেয়া হয়, তাহলে সেই পুরো বাক্যটার কোন ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। ইংরেজি গদ্যে এই প্যারেন্থিসিসের অনেক ব্যবহার রয়েছে কিন্তু বাংলা গদ্যে তেমন দেখা যায় না। শহীদুল জহির তার কথাসাহিত্যে প্যারেন্থিসিসের বহুল ব্যাবহার করেছেন। এতে করে তার গদ্যের একটা বিশেষ আবহ তৈরী হয়েছে। এর চূড়ান্ত উদাহরণ সম্ভবত তার ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটা। সেই গল্পের কিছুটা অংশ আমি পড়ছি, ‘আমাদের মহল্লা, দক্ষিণ মৈশুন্দির শিল্পায়নের ইতিহাস আমাদের মনে পরে, মহল্লায় গরম পরতে শুরু করলে চৈত্র বৈশাখ মাসের তরমুজওয়ালারা তরমুজ নিয়ে আসে, আমরা তরমুজ খেতে শুরু করি, আমরা তখন তরমুজ সম্পর্কে সচেতন হই, আমরা লক্ষ্য করি যে এই তরমুজওয়ালারা মহল্লার গলির সংকীর্ন একটি জায়গার মাটিতে দেয়ালের পাশ ঘেঁষে, গোল গোল তরমুজের ছোটো ছোটো ঢিপি বানিয়ে বসে, . . .’ এভাবে তিনি কমা দিয়ে দিয়ে দীর্ঘ একটা পরিচ্ছদে গল্পটা লেখেন। পুরো গল্পটা তিনি লেখেন একটা পরিচ্ছদে। কমা দিয়ে দিয়ে তিনি অনেকগুলো বাক্যাংশকে মিলিয়ে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকেন। আমার জানা মতে বাংলা সাহিত্যে এরকম আরেকটা উদাহরণ হলো, কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাস, ‘সুহাসিনী পমেটম’, যে পুরো উপন্যাসটা একটা মাত্র বাক্যে লেখা। ছোট ছোট বাক্যংশের ভেতর দিয়ে দক্ষিন মৈশুন্দির অগনিত ডিটেইলস তিনি উপস্থিত করেন। পড়তে পড়তে ঐ মহল্লার আটোঁসাটো পুরনাবৃত্তিমুলক জীবনটা আমাদের কাছে যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। তিনি ঐ গল্পটা শেষও করেছেন একটা কমা দিয়ে। এই কমা নিয়ে তার কাছে থেকেই ইন্টারেস্টিং একটা গল্প শুনেছি। ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ গল্পটা আছে তার ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ বইটাতে। তিনি বলছিলেন প্রতিবার প্রেস থেকে প্রুফ আসলে তিনি দেখতেন কম্পোজার গল্পটা শেষ করেছেন দাঁড়ি দিয়ে। তিনি আবার দাঁড়ি কেটে কমা করে দিতেন কিন্তু পরের প্রুফে আবার দেখতেন সেটা দাঁড়ি হয়ে গেছে। তিনি আবার প্রুফ কারেকশন করে সেটাকে কমা করতেন। একপর্যায়ে প্রুফরিডারের সঙ্গে এই নিয়ে তার বেশ একটা বিতন্ডা হয়। প্রুফরিডার তাকে বলেন, ‘আপনে সাহিত্য করতে আসছেন, বাংলা ব্যাকরণও মানবেন না? ব্যাকরণ জানেন না আপনে? কমা দিয়া কখনো কোন লেখা শেষ হতে দেখছেন?‘ তারপরও শহীদুল প্রুফরিডারকে বলেছিলেন নিয়ম যাই হোক লেখাটা কমা দিয়েই শেষ হবে। কিন্তু প্রুফ রিডার সে কথা মানেননি। বইটা যখন বের হলো তিনি দেখলেন গল্পটা দাড়ি দিয়ে শেষ করেই ছাপা হয়েছে। শহীদুল জহির খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং তিনি শুধু এই কমার দুঃখে সেই গল্পটা আবার তার পরবর্তী বইয়ে ছাপিয়েছিলেন যেখানে তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে গল্পটা যেন কমা দিয়েই শেষ হয়। একটা গল্পের শুধুমাত্র একটা শুদ্ধপাঠ তৈরি করবার জন্যে সেটাকে দ্বিতীয়বার ছাপিয়েছিলেন শহীদুল। কারণ ঐ কমাটা তার কাছে খুব গুরুত্বপুর্ণ ছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন মহল্লার জীবনের ভিসাস সাইকেলটাকে বোঝাতে তিনি ঐ কমাটাকে রেখেই গল্পটা শেষ করেছিলেন, ঐ জীবনের পৌনপুনিকতার উপর জোর দিতে চেয়েছিলেন। দাঁড়ির মধ্য দিয়ে কাহিনীর যে পুর্নচ্ছেদ ঘটে তা গল্পটার মুল সুরটাকে ব্যাহত করে। ফলে তিনি একটা কমার মধ্য দিয়ে গল্পটাকে উন্মুক্ত রেখে দিতে চেয়েছিলেন। যাহোক শহীদুল জহির ছিলেন সেই লেখক যিনি একটা কমার দুঃখে দ্বিতীয়বার একটা গল্প ছাপান। বলছিলাম তার বাক্যগঠনে প্যারেন্থিসিসের ব্যবহারের কথা। ‘কুটির শিল্পের ইতিহাস‘ ছাড়াও তার প্রায় গল্পেই এর ব্যবহার রয়েছে যা তার গল্পে একটা ভিন্নতর মেজাজ এনে দিয়েছে। তিনি তার শেষ দিকের লেখায় আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারও শুরু করেছিলেন, বিশেষ করে ক্রিয়াপদের ক্ষেত্রে। তিনি যেমন ‘হয়ে‘ না লিখে ‘হয়া’ লিখতেন। দাড়িয়ে না লিখে ‘খাড়ায়া’ লিখতেন। যেমন, ’… ভুতের গলির লোকেরা যখন এইসব বলে, তখন কেরোসিনের বাত্তির সুপিয়া আকতার এবং চম্পা ফুল গাছের ভাঙ্গা একটা ডালের কথা প্যাঁচ খায়া জড়ায়া যায়..”। আমাদের এখানে মান ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বেশ নানারকম বিতর্ক আছে। পশ্চিমবঙ্গের গদ্য থেকে বাংলাদেশের গদ্যকে আলাদা করবার চেষ্টা আছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক জীবন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সামাজিক জীবন থেকে নানাভাবেই ভিন্ন। ফলে ভাষার একটা আঞ্চলিক চেহারা থাকবেই। কিন্তু পুর্ববঙ্গের আঞ্চলিক কিছু শব্দ ব্যবহার করলেই তো তা পূর্ববঙ্গের সাহিত্য হয়ে ওঠে না। আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার ইন ইটসেলফ সাহিত্য প্রতিভার কোন নমুনা হতে পারে না। দেখবার বিষয় কতটা সৃজনশীল ভাবে, মেধার সাথে তার ব্যবহার হয়েছে। মান ভাষা, আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে নানা রকম তর্ক আছে বলেছি কিন্তু কিছু ব্যাতিক্রমী উদাহরন ছাড়া সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার মেধাবী ব্যবহার তেমন চোখে পড়ে না। এক্ষেত্রে শহীদুল সীমিত আকারে আঞ্চলিক ক্রিয়াপদের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যে মেধাবী বাক্যগুলো রচনা করতে শুরু করেছিলেন তাতে আমি নিশ্চিত বেঁচে থাকলে তার হাত দিয়ে গদ্য সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের আরো চমৎকার উদাহরন আমরা দেখতে পেতাম।

শহীদুল জহিরের লেখার যে স্বতন্ত্র এ্যাটমোষ্ফিয়ারের কথা বলছিলাম তা যে তিনি শুধু ভাষা দিয়ে তৈরী করেন তা না। বিষয় উপস্থাপনের ব্যাপারেও তার রয়েছে একেবারে ইউনিক একটা ধরন। যেমন দেখতে পাই তিনি তার গল্পে প্রায়ই একেবারে বিপরীতমুখী দু‘টা পরিস্থিতিকে জাক্সটাপোজ করেন, যাতে করে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়। যেমন ধরা যাক, তার ‘আগারগাঁও কলোনীতে নয়নতারা ফুল নেই কেনো’ গল্পটা। সেখানে দেখা যাচ্ছে একজন নিম্নপদস্থ চাকরিজীবি আগারগাঁও কলোনিতে থাকেন। তিনি স্বল্পবাক, নিভৃতচারী একজন মানুষ যিনি প্রতিদিন অফিস থেকে এসে কলোনির বাড়িটার বারান্দায় গিয়ে বসেন। ঐ বারান্দাটাই তার নিভৃত শান্তির জগত, সেখানেই তিনি জীবনের স্বস্থি খুঁজে পান। অফিস থেকে ফিরে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওখানে বসে থাকেন। একপর্যায়ে বারান্দায় রাখা নয়নতারা ফুলের আকর্ষণেঅসংখ্য প্রজাপতি আসতে শুরু করে। প্রজাপতিতে বারান্দা ভরে যায়। তারপর ঐ প্রজাপতি দেখবার জন্য আগারগাঁওয়ের লোকজন কলোনীর সামনের মাঠে ভীড় করতে থাকে। তারা প্রজাপতি লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে থাকে। প্রজাপতি আসাতে বিশেষ সমস্যা না হলেও লোকজনের এই ভীড়, ঢিল ছোঁড়াছুড়িতে এই ভদ্রলোকের পক্ষে আর বারান্দায় এসে বসা দুরুহ হয়ে পড়ে। বারান্দাটা যে আর তার নিভৃত, শান্তির জায়গা থাকছে না সেটা ভেবে খুব মর্মাহত হন সেই ভদ্রলোক। আর ঠিক তখনই একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার ঘটে। শহীদুল জানাচ্ছেন যে, ঠিক সেরকম একটা মুহুর্তে দেশে মার্শাল ল জারি হয়। এবং এই মার্শাল ল জারি হবার কারণে তার এই প্রজাপতি বিষয়ক সমস্যার সমধান হয়ে যায়। কিভাবে? কারণ সামরিক সরকার এসে হঠাৎ করে পার্শবর্তী চিড়িয়াখানা উন্নয়নে খুবই ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তারা চিড়িয়াখানায় নতুন শিম্পাঞ্জি নিয়ে আসে বিদেশ থেকে। তখন আগারগাঁওয়ের লোকেরা প্রজাপতি ছেড়ে শিম্পাঞ্জি দেখার জন্য সব দলে দলে চিড়িয়াখানার দিকে ছুটতে থাকে। এভাবে ঐ ভদ্রলোক তার বারান্দার নিভৃত কোনটা আবার ফিরে পান। তারপর গল্প অন্যদিকে যায়, কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে, প্রজাপতি এবং মার্শাল ল এই দুটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গকে জাক্সটাপোজ করে একটা অদ্ভুত কৌতুককর পরিস্থিতি তৈরি করলেন তিনি। এবং এর ভিতর দিয়ে তিনি সামরিক শাসন বিষয়ে খুব মজাদার ভঙ্গীতে একটা ক্রিটিক করলেন। শহীদুল জহিরের লেখায় এমন অনেক বিপরীতধর্মী বিষয়ের একটা এ্যাবসার্ড জাকসটাপজিশন আছে যা তার লেখার সেই স্বতন্ত্র চরিত্রটা তৈরীতে সহায়তা করেছে।

আর এই যে কৌতুকের কথা বললাম এটিও তার লেখার একটা বড় বৈশিষ্ট্য বলে লক্ষ করি। তার লেখায় প্রায়সই একটা চাপা কৌতুক থাকে। খুব উইটি। তার কৌতুককে কখনো কখনো আমার চার্লি চ্যাপলিনের মহৎ কৌতুকের মত মনে হয়। চার্লি চ্যাপলিন খুব গম্ভীরভাবে জীবনের দুর্বিসহ, ভয়াবহ বিষয়গুলোকে নিয়ে কৌতুক করতেন। তিনি মানুষের মৌলিক দুটো তাড়না অশ্রু এবং হাসির অসাধারন সমন্বয় করেছিলেন। চ্যাপলিনকে আইজেনস্টাইন তুলনা করেছিলেন শেক্সপিয়ারের সঙ্গে। শহীদুল জহিরও প্রায়ই সমাজের সবচেয়ে কঠিন, বীভৎস ব্যাপারগুলোকে নিয়ে গম্ভীর ভঙ্গীতে কৌতুক করেন। যেমন ধরা যাক তার ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ গল্পটা। সেখানে খুব গম্ভীরভাবে তিনি খেলাটার বর্ননা দিচ্ছেন। খেলাটার নিয়ম কানুন পাঠকদের জানাবর জন্য শুরুতে তিনি বিভিন্ন জিনিসের সংজ্ঞা দিচ্ছেন। যেমন তিনি বলছেন, ‘ইন্দুর কাহাকে বলে?‘ উত্তরে বলছেন, ‘ইন্দুর হচ্ছে ইন্দুর জাতীয় প্রাণী‘, যথা, ‘ইন্দুর ভায়া পেয়েছে ভয়।‘ তারপর আবার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘বিলাই কাহাকে বলে?‘ উত্তর দিচ্ছেন, ‘বিলাই হচ্ছে বিলাই জাতীয় প্রাণী।‘, যথা, ‘বিলাই ঘুরে জগতময়।‘ বেশ একটা কৌতুককর ব্যাপার তৈরী করছেন খুব গম্ভীর একটা ভঙ্গীতে। কিন্তু তারপরই ক্রমশ এই ইন্দুর-বিলাই খেলার বর্ননা করতে করতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একটা বীভৎস বাস্তবতার দিকে নিয়ে যান পাঠকদের। মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার, শক্তিমান, দুর্বল, এদের পারস্পরিক লড়াইয়ের নির্মম কতগুলো বাস্তবতার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলেন পাঠককে। এরকম ভঙ্গী তার আরো অনেক গল্পেই আছে। ‘ইন্দুর বিলাই খেলা‘ গল্পটা যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে সেই গল্পে তিনি ভিজুয়্যাল ইমেজও ব্যাবহার করেছেন। গল্পের ভেতর ছবি এঁকেছেন। তিনি খেলাটা বুঝাতে যেয়ে ইদুর, বিড়াল ইত্যাদির ছবি এঁকেছেন । খেলার ছক এঁকেছেন। তার ‘ডলু নদীর হাওয়া’ গল্পের এক চরিত্র যে ফাঁদ তৈরি করে সেই ফাঁদের ছবিও তিনি এঁকে দেখিয়েছেন। অনেকটা বাচ্চাদের বইয়ের অলংকরনের মত। এতে যেমন একটা কৌতুকের উপাদান আছে তেমনি টেক্সট এবং ভিজুয়্যাল দুটা ভিন্ন মাধ্যমে লেখা উপস্থাপন করে পাঠককে একটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতাও দিয়েছেন তিনি। তো ব্যাপার হচ্ছে, বাক্য গঠনে প্যারেন্থিসিসের মধ্য দিয়ে, ভিন্ন দু’টো বাস্তবতার জাক্সটাপজিশনের ভিতর দিয়ে কিম্বা এই কৌতুককর আবহ তৈরীর মধ্য দিয়ে পাঠককে তিনি একটা বেশ ঘোরের ভেতর ফেলে দেন। একটা জালের ভিতর আটকে ফেলেন। জালে আটকে তারপর পাঠককে তিনি মুখোমুখি করেন নির্দিষ্ট কয়েকটা জনপদের। ভুতের গলি, দক্ষিণ মৈশুন্দি, পদ্মনিধি লেন কিম্বা কখনো কখনো সুহাসিনীর। এই দু’তিনটা গলি, মহল্লার ভিতর দিয়েই তিনি হাত রাখেন পুরো বাংলাদেশের প্রানের ভেতর। যেমন মার্কেজের মাকানডো গ্রাম ঘুরে ফিরে এসেছে তার উপন্যাসে। শহীদুল তার গল্পের মধ্য দিয়ে মহল্লার একেবারে প্রান্তিক মানুষগুলোর মুখোমুখি করেন আমাদের। মহল্লার খুচরা মানুষ, আইসক্রিম বিক্রেতা, তরকারিওয়ালা, লেদ-মেশিনের অপারেটর, ডালপুরী বিক্রেতা প্রমুখদের জীবনের জঙ্গমতা, প্রেম, সংগ্রামকে হাজির করেন তিনি আমাদের সামনে।

শহীদুল যে জনপদের জীবনকে উপস্থিত করেন তার লেখায় তার দু’টা বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করবো এখানে। লক্ষ করলে দেখা যাবে শহীদুলের মহল্লা মানুষদের একটা যৌথ চরিত্র আছে। কোন মানুষ যেন একা কোন মানুষ না, সবাই মিলে একটা মানুষ। তারা যৌথভাবে চিন্তা করে, যৌথভাবে কাজ করে। যেমন ধরা যাক, ‘কোথায় পাবো তারে’ গল্পটাতে তিনি লিখছেন, ‘আমরা মহল্লার লোকেরা সেদিন রাতে আমাদের দিবসের কর্ম শেষে ক্লান্ত অবসরে আবদুল করিমের ময়মনসিংহ যাওয়ার সর্বশেষ খবর শুনি এবং বলি যে পোলাটা হালার ভোদাই।’ কিংবা ‘আমাদের মনে হবে যে আবদুল করিমের খোঁজ করা যায় এবং আমরা ভুতের গলিতে আবদুল করিমের খোঁজ করব’। আবার আরেকটা গল্পে, ‘ভুতের গলির মানুষেরা বানর নিয়া ব্যাস্ত থাকে, তারা দেয়ালের উপর অথবা দূরে ছাদের কার্নিশে লেজ ঝুলিয়ে বসে থাকা এই খয়েরী রঙের জানোয়ারের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে, ঐ যে বান্দর।‘ ব্যাপারটা হচ্ছে মহল্লার মানুষ যখন কিছু একটা ভাবে তখন যেন সবাই মিলে একসাথে ভাবে, যখন কিছু একটা করে তখন তা একসাথে করে। আমরা দেখছি আবদুল করিম কেন ময়মনসিংহ যাবে এটা নিয়ে পুরো মহল্লা একসাথে মিলে ভাবছে। কিম্বা আমাদের কুটির শিল্প গল্পটায় জানাচ্ছেন, দক্ষিণ মৈশুন্দিতে যখন তরমুজয়ালারা আসে তখন মহল্লার সবাই কি কি করে, তরমুজ নিয়ে মহল্লার সবাই কি কি ভাবে ইত্যাদি। এই যে কালেকটিভ থিংকিং, জনপদের এই যে যৌথ চরিত্র এব্যাপারটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপুর্ন মনে হয়। এর একটা সমাজতাত্ত্বিক মাত্রাও আছে। পাশ্চাত্য দীর্ঘদিন ধরে, সেই রেঁনেসা বা এনলাইটমেন্টের সময় থেকে চেষ্টা করেছে ব্যক্তিকে যৌথতার ভিতর থেকে বের করে ব্যক্তি হিসেবে হাজির করার। ব্যক্তি তৈরির সংগ্রামই হচ্ছে পুরো পাশ্চাত্য সভ্যতার সংগ্রাম। এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নাগরিক হচ্ছে আধুনিক বুর্জুয়া রাষ্ট্রের কাম্য অধিবাসী। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন কথিত উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকেরা সেই অর্থে বুর্জুয়া একক ব্যক্তিতে পরিনত হতে পারেনি। এখানকার ব্যক্তিরা নানাভাবে সামষ্টিক জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা। পরিবার, মহল্লা, গ্রামবাসীর যৌথতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বতন্ত্র ব্যক্তি তারা হয়ে ওঠেনি। এটা কি আমাদের দুর্বলতা না শক্তি? একটা ছোট্ট উদাহারণ দেই। আমি ডাক্তারী পড়েছি। এখন শিক্ষকতা, গবেষণা ইত্যাদির কাজ করলেও প্রথম দিকে গ্রামীন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছি। মনে আছে গ্রামে একদিন একজন রোগী এসেছে। ২০/২২ বছরের একটা ছেলে। নারিকেল গাছ থেকে পড়ে তার পা ভেঙ্গে গেছে। তো তার মা-বাবা, বড় ভাই, তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। আমি জিজ্ঞাস করলাম, কিভাবে কি হলো? তো বড়ভাই বর্ণনা করতে লাগলো কিভাবে নারিকেল গাছে উঠেছিলো ছেলেটা তারপর যে দড়ি জাতীয় জিনিসটা দিয়ে গাছে ওঠে সেটা ছিঁড়ে গেলে গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙ্গে যায় ছেলেটার। পা ভাঙ্গা বাইরে থেকে বোঝা যাচ্ছিল না তো আমি জিজ্ঞাসা করলাম ঠিক কোথায় তার ব্যাথা করছে। তখন ছেলেটার মা আমাকে আঙ্গুল দিয়ে দেখালেন ঠিক কোথায় ব্যাথা করছে। ব্যাথা কোনদিকে থেকে কোনদিকে যাচ্ছে ইত্যাদি। ছেলেটার বাবাও কিছু তথ্য এর সঙ্গে যোগ করলেন। ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার হচ্ছে, যে ছেলেটার পা ভেঙ্গেছে সে কিন্তু চুপ আছে, সে কিছুই বলছে না। তার অসুখের পুরো বর্ণনা দিচ্ছে তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। লক্ষ করবার ব্যাপার হচ্ছে অসুখটার যে সাফারিংস তা বর্ণিত হচ্ছে যৌথভাবে, পারিবারিকভাবে। অন্যভাবে যদি দেখি তাহলে বলতে হবে যে, ছেলেটার শারীরিক এই বিপর্যয়ের জন্য যে সাফারিং সেটা নেহাত একটা ব্যক্তির সাফারিং না, কালেকটিভ সাফারিং ফলে এর ন্যারেটিভটাও কালেকটিভ। ছেলেটার অসুখে শুধু ছেলেটা না পুরো পরিবারটাই সাফার করছে। আমি এখন বৃটেনে থাকি সেখানে এভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক একজনের পক্ষে বাবা মা ভাইবোন মিলে ডাক্তারের সামনে হাজির হওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। রোগীর সঙ্গে যদি কখনো আত্মীয় স্বজন কেউ যায়ও তার ভুমিকা খুবই নগণ্য। রোগীকে একক একজন ব্যক্তি হিসেবে ডাক্তারের মুখোমুখি হতে হবে। তার রোগের বয়ান তাকেই করতে হবে। ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে চিকিৎসা বিষয়ক সিদ্ধান্ত তাকেই নিতে হতে। তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার এক্তিয়ার অন্য কাউকে দিতে গেলে নানারকম আইনী প্রক্রিয়া অনুসরন করতে হবে। অথচ আমাদের অঞ্চলে ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নানাভাবে মাখামাখি করে আছে পারিবারিক, গ্রাম, মহল্লার সিদ্ধান্তের উপর। এশিয়া, আফ্রিকার অনেক অঞ্চলে শুধু পরিবার না কোন সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মৃত পুর্বপুরুষের আত্মার সঙ্গে পরামর্শ করারও রেওয়াজ আছে। এখন এই যে যৌথতা, তা কি একটা দুর্বলতা না শক্তি? আধুনিক সমাজতাত্বিকরা আবার এও দেখাচ্ছেন কি করে পাশ্চাত্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্রের চর্চা করতে গিয়ে ব্যক্তিস্বর্বস্বতায় উপনীত হয়েছে। বুর্জুয়া সভ্যতা যে একক যুক্তিবাদী ব্যক্তির আদর্শ তুলে ধরেছিলো তা কতটা কাম্য তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পোষ্ট কলোনিয়াল তাত্ত্বিকরা, সাব অলটার্ন ষ্টাডিজের সমাজভাবুকরা। তারা ‘বিকল্প আধুনিকতার‘ কথা তুলেছেন। যাহোক, সেসব ভিন্ন আলোচনার ব্যাপার। আমি বলছিলাম শহীদুল জহির কি করে আমাদের এই জনপদের যৌথ চরিত্রটা তার গল্প, উপন্যাসে তুলে এনেছেন। বিশ্বায়নের কালে আমাদের সমাজের যৌথ চরিত্রও ক্রমশ ভাঙ্গছে। নাগরিক জীবনে তো তার ভাঙ্গন শুরু হয়েছে বহু আগেই। পুরনো ঢাকার জীবনে সেই নাগরিক যৌথতা এখনও হয়তো কিছুটা অবশিষ্ট আছে, যদিও তা ধ্বংসের দিকেই যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে জীবনানন্দ দাসের ‘রুপসী বাংলা’র কবিতাগুলোর কথা। এই বইটার নাম জীবনানন্দ কিন্তু দিয়েছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নিলিমা’। বইটা তার মৃত্যুর পর প্রথম প্রকাশিত হয় এবং প্রকাশকরা এর নাম দেন ‘রুপসী বাংলা’। নগরায়নের চাপে ভীত সন্ত্রস্থ বাংলার প্রকৃতিকে অক্ষরে ধরে রাখবার জন্য বাংলার প্রকৃতি নিয়ে এই অসাধারন কবিতাগুলো লিখেছিলেন জীবনানন্দ। কেউ একজন বলেছিলো যদি কোনোদিন এমন হয় পারমানবিক বোমায় উড়ে গেল এই বাংলা অঞ্চল, তার আর কোন চিহ্ন রইল না। সেই হারানো বাংলাকে যদি তখন আবার রিকনষ্ট্রাক্ট করার প্রয়োজন পড়ে তবে তা সম্ভব হতে পারে রুপসী বাংলার কবিতার লাইনগুলো থেকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যেভাবে দ্রুত আমাদের যৌথতা হারাচ্ছি, ক্রমশ ব্যক্তিসর্বস্বতার দিকে ধাবিত হচ্ছি তাতে আমাদের এই যৌথ জীবনের রুপ খুঁজতে একদিন হয়তো আমাদের ফিরতে হবে শহীদুল জহিরের গল্পগুলোর দিকে, যেখানে আমরা দেখবো দক্ষিন মৈশুন্দির একটা ছেলে কেন ময়মনসিং যেতে চাচ্ছে সে কথা ভেবে পুরো মহল্লাবসীদের আর ঘুম আসছে না। আমাদের যৌথ জীবনের চমৎকার ডকুমেন্টেশন শহীদুল জহিরের এই লেখাগুলো।

শহীদুল জহিরের আরেকটা প্রবণতা আমি লক্ষ্য করি। দেখতে পাই প্রায়শই তার গল্পগুলোর ভিতরে তিনি নানারকম সম্ভাবনা তৈরি করেন। যেমন ধরা যাক তিনি লিখছেন, ‘আহারে আবদুল হালিম, আহারে আমার পোলা, বলে তার মা হয়ত কাঁদে, নিরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা হয়ত এই কান্নার শব্দ শুনতে পায়, অথবা পায় না, অথবা তার মা হয়ত আর কাঁদে না, হয়ত এতদিন পর ভুতের গলির লোকেরাও আবদুল হালিমের কথা ভুলে যায়, অথবা তারা হয়ত একেবারে ভুলেও যায় না।’ এভাবে তার গল্পে তিনি প্রায়ই ‘হয়ত‘ কথাটা ব্যাবহার করেন। ‘হয়ত‘ শব্দটা ব্যাবহার করে একটা গল্পের অনেকগুলো পসিবিলিটি তিনি তৈরি করেন। আবদুল হালিমের কথা যদি মহল্লার লোকেরা ভুলে যায় তাহলে গল্পটা একরকম হবে, আর যদি ভুলে না যায়, তাহলে গল্পটা অন্যরকম হতে পারে। অর্থাৎ একটা ঘটনার নানা রকম পরিনতি হতে পারে, ঘটনার ভেতর নানারকম সম্ভাবনা সুপ্ত থাকে। এটাও আমাদের এই অঞ্চলের বাস্তবতার একটা বৈশিষ্ট্য। আমাদের বাস্তবতা খুবই আনপ্রেডিক্টেবল। এই আনপ্রেডিক্টটেবিলিটি আমাদের এই অঞ্চলের জনপদকে বুঝবার একটা চাবি। আবারও যদি আমি পশ্চিমের কথা বলি, তাহলে দেখবো পশ্চিম দীর্ঘদিন একটা চর্চার মধ্য দিয়ে, বুর্জুয়া রাস্ট্রকাঠামোতে কতগুলো সিস্টেম ডেভেলপ করেছে। সবকিছুকেই তারা প্রেডিক্টিবিলিটির আওতায় আনতে চেষ্টা করেছে, সেখানে আনপ্রেডিক্টটিবিলিটির জায়গা নেই। আমি বৃটেনের যে শহরে থাকি সেখানে বাড়ি থেকে বের হয়ে সাড়ে আটটার একটা বাস ধরে আমি ইউনিভার্সিটিতে যাই, বাসষ্টপে নেমে ১৫ মিনিট হেঁটে আমার অফিসে পৌঁছাই, সেখানে পথে একজন গিটার বাদককে একটা গিটার বাজাতে দেখি, একজন ভিক্ষুককেও দেখতে পাই, একজন পত্রিকা বিক্রি করে। গত চার বছরে এই দৃশ্যপটের কোনো পরিবর্তন আমি দেখিনি। সাড়ে আটটার বাসটা সাড়ে আটটাই আসে। সামান্য এদিক ওদিক হয় হয়তো কখনো। এটা খুবই কেজো ব্যাপার, চমৎকার। কিন্তু অন্যভাবে দেখলে ব্যাপারটা খুব মনোটনাস। এখানে কোন সারপ্রাইজ নাই, একধরনের স্থবিরতা আছে। আমি যখন ঢাকায় আমার উত্তরার বাসা থেকে মহাখালী যেতাম, এই পথটুকু আমার কাছে প্রতিদিন ছিলো নতুন। পুরো পথটাতে কখন কি ঘটবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিলো না । পথের মাঝখানে বিরাট একটা বোমা টোমা ফেটে রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, বিরাট একটা মিছিলের কারণে আমি দু’ঘন্টা বসে থাকতে পারি। পথে প্রতিদিন কত নতুন ঘটনা, দৃশ্য, মানুষ। আমার প্রায় প্রতিটা দিনই ছিলো ভিন্ন। এধরনের অনিশ্চয়তার জন্য আমার একটা প্রস্তুতি ছিলো। এখন বৃটেনে বাস স্ট্যান্ডে যখন দাঁড়িয়ে থাকি এবং কোনদিন যদি বাসটা পাঁচ মিনিট লেট হয় আমি নার্ভাস বোধ করতে থাকি। অনিশ্চয়তাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা আমার ওখানে গিয়ে কমে গেছে। তাহলে এই অনিশ্চয়তার একটা সম্ভাবনা, একটা শক্তির ব্যাপারও আছে। যে সম্ভাবনার ব্যাপারগুলো অনেকটাই সীমিত হয়ে এসেছে পশ্চিমের দেশগুলোতে। এবং সত্যি বলতে তৃতীয় বিশ্বের এই আনপ্রেডিক্টিবিলিটি, এই কেওস, এই প্রতি মুহুর্তের সারপ্রাইজকেই সাহিত্যের পুঁজি করে বিশ্ব মাতিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার লেখকরা। পাশ্চাত্যের আপাত গোছানো সমাজের বিপরীতে ল্যাটিল আমেরিকার অগোছালো জীবনের মেধাবী রুপায়ন সাহিত্যে এক নতুন বর্নাঢ্যতার জন্ম দিয়েছে। ল্যাটিন আমেরিকার লেখকদের সেই পথ ধরে আমাদের জনপদের এই অনিশ্চিয়তা এবং বিবিধ সমান্তরাল সম্ভাবনার ব্যাপারগুলো শহীদুল তার লেখায় চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন।

এই কথার সুত্র ধরে ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা আসে। ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্য প্রসঙ্গেই ম্যাজিক রিয়েলিজম বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচিত। এবং শহীদুল জহিরের লেখার প্রসঙ্গেও নানাভাবে ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যাপারটার কথা উঠে থাকে। এও একটা বিস্তারিত আলাপের ব্যাপার যে সুযোগ এই বক্তৃতার পরিসরে নাই। সহজ কথাতে বলতে গেলে ম্যাজিক রিয়েলিস্ট সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটা খুবই বাস্তববাদী বর্ননার ভিতরে হঠাৎ এমন একটা অনুষঙ্গ এসে পরে যেটা ঠিক যুক্তির বিচারে ধোপে টেকে না। যুক্তিনির্ভর আর যুক্তিহীন ব্যাপারগুলো অবলীলায় পাশাপাশি ঘটতে থাকে। আমি এখানে পাশ্চাত্য বুর্জুয়া যুক্তিবাদীতার কথা বলছি। মার্কেজের গল্পে বহুভাবে এই যাদু বাস্তবতার ব্যাপার এসেছে। একটা মেয়ে বিভিন্ন জিনিসে হাত দিচ্ছে এবং তার কোনটা নীল হয়ে যাচ্ছে, কোনটা লাল হয়ে যাচ্ছে, তা দেখে মেয়েটার দাদী বলছে , ‘তুই তো প্রেমে পড়েছিস।‘ কিম্বা মাঠে চাদর বিছিয়ে গল্প করছে কয়জন হঠাৎ এক দমকা হাওয়া বইল তো দেখা গেলো চাদর সমেত সবাই আকাশে ভাসছে। খুব যৌক্তিক বাস্তব গল্পকাঠামোর ভেতর মার্কেজ খুব মাজাদার ভঙ্গীতে এইসব আপাত অবাস্তব ব্যাপারগুলো ব্লেন্ড করেছেন। একটু আগে বাস্তবতার যে আনপ্রেডিক্টিবিলিটির কথা বলাছিলাম এর সঙ্গে এধরনের যাদু বাস্তবতার সম্পর্ক রয়েছে। তবে মনে রাখা দরকার যে যাদু বাস্তবতা নেহাত ল্যাটিন আমেরিকার নিজস্ব কোন সম্পত্তি নয়। তাদের লেখকরা এর একটা সৃজশীল রুপ দিয়েছেন মাত্র। যুক্তির শাসনের বাইরের নানা অনুষঙ্গ আমাদের লোক গল্প কাহিনীর, পালা, কথকতার ভেতর ব্যাপকভাবে রয়ে গেছে। যেমন ধরা যাক জনপ্রিয় লোককাহিনী ‘রুপবান’। সেখানে বারো বছরের একটা মেয়ের স্বামী হচ্ছে বারো দিনের একটা ছেলে এবং সেই বার দিনের একটা শিশু স্বামীকে কোলে নিয়ে বার বছর ধরে মেয়েটা বনের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখন সাধারন যুক্তিপরম্পরায় এ এক অসম্ভব পরিস্থিতি কিন্তু এনিয়ে কেউ কখনও প্রশ্ন তুলে নি। যুক্তির শাসনের বাইরে এই পালা কাহিনী দেখে চোখের জলে ভেসেছে মানুষ। তো এও এক যাদুবাস্তবতার উদাহরন। এই যুক্তির শাসনের বাইরে থাকবার উপাদান পাশ্চাত্য লোককাহিনীতেও আছে কিন্তু পাশ্চাত্য আধুনিক সাহিত্য নিজেদের বুর্জুয়া যুক্তির শাসনে বেধেছে। ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যিকারা আধুনিক সাহিত্যের এই শাসনকে উপেক্ষা করে যাদু বাস্তাবতার যুক্তিকেই তাদের সাহিত্যের যুক্তি করে তুলেছিলেন। মার্কেজ, ফুয়েন্টস, কার্পেন্টিয়ের, বোর্হেস প্রমুখ এক নুতন ধারার সাহিত্য চর্চার সূচনা করে বিশ্ব সাহিত্যে একটা দমকা হাওয়া তুলেছিলেন। শহীদুল জহির সাহিত্যে এই যাদু বাস্তবতার ধারনা দিয়ে অনুপ্রানিত ছিলেন এবং তার নিজের লেখায় তা চর্চা করবার চেষ্টা করেছেন। বাস্তবতার আর অবাস্তবতার দোলচালের নানা মজাদার উদাহরন আছে তার গল্পে। ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ গল্পটাতে দেখা যাচ্ছে একজন রাস্তার ধারে ওষুধ বিক্রির ক্যানভাসার পকেট থেকে একটা হাড় বের করে সামনের দর্শকদের দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘এটা কি?‘ তারপর শহীদুল বর্ননা করছেন, দর্শকরা যদিও সবাই দেখছে ওটা নেহাতই একটা হাড়, কিন্তু একটা পরিচিত জিনিসকে যখন সামনে রেখে জিজ্ঞাসা করা হয় এটা কি, তখন সেটা রহস্যময় হয়ে যায়। তখন সবাই ভাবতে থাকে তাহলে আমি যেটা ভাবছি, এটা হয়তো সেটা না, এটা নিশ্চয়ই অন্যকিছু। এভাবে কিছুক্ষন তাদের সেই দ্বিধার মধ্যে রাখে ক্যানভাসার। তারপরে সে নিজ থেকেই বলে যে, এটা একটা হাড়। তখন উপস্থিত দর্শকরা বেশ নিশ্চিন্ত হয় এবং তাদের মুখে হাসি দেখা যায়। তারা আস্বস্থ হয় যে তারা যা ভাবছিলো জিনিসটা তাই। কিন্তু তার পর পরই ক্যানভাসার দর্শকদের আবার কনফিউজড করে তোলেন। সে বলে, না, এটা কিন্তু হাড় না, এটা হচ্ছে একজন মেয়েমানুষ, যার নাম হচ্ছে প্রীতিলতা। তখন সেই দর্শক এবং পাঠক ঐ হাড় খন্ডের ভেতর একজন মেয়েকে দেখতে শুরু করে। একটা অস্থিখন্ডকে প্রসারিত করে ক্রমশ একজন নারীতে রূপান্তরিত করেন শহীদুল। এরপর আরও বিচিত্র ব্যাপার ঘটতে থাকে গল্পে। আমরা দেখি সেই ক্যানভাসার একটা অদ্ভুত প্রাসাদে গিয়ে ঢুকছে। প্রাসাদে ঢুকবার পর একটা যাদু বাস্তব পরিস্থিতির জন্ম হয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই যাদু বাস্তবতার ধারনাকে বেশ আরোপিত ভাবে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। এই গল্পের শেষে যাদু বাস্তব এই দৃশ্যটিকেও আমার তেমন মনে হয়েছে। তেমনি ‘কাঠুরিয়া ও দাঁড়কাক’ নামের তার অসাধারন একটা গল্প আছে যার শেষ দৃশ্যে যখন তিনি দেখাচ্ছেন কাকগুলো কাঠুরিয়াকে তাদের ঠোঁটে করে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন যাদু বাস্তবতার ডোজটা একটু বেশীই হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। প্রায় সরাসরি মার্কেজকে যেন হাজির করা হয়েছে। যাদু বাস্তবতা শহীদুলকে খানিকটা পেয়ে বসেছিলো। তার শেষ উপন্যাস ‘মুখের দিকে দেখি‘ অত্যন্ত শক্তিশালী একটি লেখা হওয়া সত্বেও অনেক ক্ষেত্রেই এই ম্যাজিক রিয়েলিজমের উপাদানের ব্যবহার মাত্রা ছাড়িয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে সন্দেহ নাই তিনি কথাসাহিত্যে যে অদ্ভুত অনেক যাদুর মুহুর্ত তৈরী করেছেন তার উদাহরন আমাদের সাহিত্যে দ্বিতীয়টা নাই।

আবার আগের কথাটায় ফিরি। আমাদের এই জনপদের ভেতরের চেহারাটা শহীদুল ধরেছেন একেবারে নিংড়ে। এখানকার মানুষের যৌথ চরিত্র, বাস্তবতার নানা সম্ভাবনা, যুক্তি আর যুক্তিহীনতার সহঅবস্থান এসব নিয়েই আমাদের এই জনপদ। বিশ্বায়নের চাপে যা কাঁপছে অবিরাম। আমাদের জনপদের এইসব বৈশিষ্ট্যকে দুর্দশা আর অক্ষমতার চিহ্ন হিসেবেই দেখানো হয় সবসময়। কিন্তু ব্যাপার তো তা নাও হতে পারে। এগুলোও তো হতে পারে ভবিষ্যত সভ্যতা তৈরীর প্রয়োজনীয় রসদ। আমাদের একটা ধারনা তৈরি করে দেয়া হয়েছে যে, সভ্যতার ট্রেন হচ্ছে একটাই। যে ট্রেনটা পৌছেছে ইংল্যান্ডে, আমেরিকায়। সভ্যতার মনজিলে মকসুদে পৌঁছাতে হলে ইউরোপ, আমেরিকা যে ট্রেনে চেপেছে আমাদের সেই ট্রেনেই চাপতে হবে। আমরা কিছু দুর্ভাগা জাতি সেই ট্রেন ফেইল করে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছি পরের ট্রেনটা ধরবো বরে। কিন্তু এটাই কি শেষ কথা। আমাদের কি ঐ একই ট্রেন ধরতে হবে? নতুন কোন ট্রেন লাইন ধরে সভ্যতা কি নতুন কোন স্টেশনে গিয়ে পৌঁছাতে পারে না? ইউরোপ তাদের সে ষ্টেশনে পৌঁছাতে যেমন অর্জন করেছে হারিয়েছেও অনেক। পাশ্চাত্যের অর্জন আর প্রাচ্যের শক্তি মিলিয়ে নতুন একটা সভ্যতার দিকে কি আমারা যাত্রা করতে পারি না? অলটারনেটিভ মর্ডানিটির কথা যে সমাজতাত্বিকরা বলছেন তারা এমন একটা তর্কই তুলছেন। শহীদুল জহিরের সাহিত্য আমাকে এইসব সমাজ ভাবনার দিকেও টেনে নিয়ে যায়।

সংক্ষেপে শহীদুল জহিরের গল্প, উপন্যাসের বিষয়ের কথা যদি বলি তাহলে বলতে হবে যে তার লেখার প্রধানতম একটা থিম মুক্তিযুদ্ধ। নানভাবে, ঘুরেফিরে, মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তিনি তার লেখায় এনেছেন। আগেই বলেছি আমার মতে এ যাবৎ লেখা মুক্তিযুদ্ধের সেরা উপন্যাস ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা‘। ‘মুক্তিযুদ্ধ‘ এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা‘ ইত্যাদি শব্দগুলোকে নিয়ে তো নানা রকম লেবু চটকানো হয়েছে, বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কথা তো এই যে, বাংলাদেশের অস্তিত্ব, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এই মুক্তিযুদ্ধের ভাবনার বাইরে দাঁড়াবার কোন উপায় নাই। সেই বোধ থেকেই শহীদুল জহির তার অভিনব গদ্যে এদেশের প্রান্তিক মানুষের জীবনে মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাতকে তুলে এনেছেন বার বার। মহল্লার মানুষ অপ্রস্তুতবাবে মুখোমুখি হয়েছে যুদ্ধের নির্মমতার। মহল্লার রঙ্গ পিয়সী কাজের মেয়েটা পুরুষ চিনলেও রাজাকার চেনেনি। ফলে রাজাকারের সঙ্গে রঙ্গ করতে গিয়ে নিহত হয় সে। মুক্তিযুদ্ধ শহরের ছোট ছোট গলি, মহল্লার প্রান্তিক মানুষকে কি ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছিলো, তছনছ করেছিলো তাদের জীবন, বদলে দিয়েছিলো সবকিছু তার অনুপুঙ্খ ব্যাতিক্রমধর্মী বয়ান আছে শহিদুলের গল্পে। মুক্তিযুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশের কোনদিকে এগিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নাই। মুক্তিযুদ্ধের নানা মাত্রাকে চিনে নেবার প্রয়োজন পড়বে আমাদের বারবার। তখনও আমাদের ফিরতে হবে শহিদুলের কাছেই। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নাগরিক মাত্রার নানা ব্যাতিক্রমী ছবি আছে তার লেখায়।

তিনি প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিনের সংগ্রামের নানা বিচিত্র ধরনও উপস্থিত করেছেন তার লেখায়। ‘মুখের দিকে দেখি’ গল্পটায় দেখা যাচ্ছে পুরান ঢাকার একটা ছেলে বানরের দুধ খেয়ে বড় হচ্ছে। এবং ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে তার মা যখন হঠাৎ একদিন দেখতে পেলো যে, একটা দুগ্ধবতী বানর, তার বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াচ্ছে, স্তন দিচ্ছে, সে বাধা দিল না। তারপরে সেই মহিলা সময় হলেই তার বাচ্চাটাকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিতো যাতে বানরটা এসে বাচ্চাটাকে দুধ খাওয়াতে পারে। এ কাজটা সে করতো কারণ তার নিজের স্তনে দুধ ছিলো না, এবং তার দুধ কিনার পয়সাও ছিলো না। দারিদ্রকে এরকম অভিনবভাবে প্রকাশ করবার উদাহরন আমি দেখিনি বাংলা সাহিত্যে। বাই দি ওয়ে, বানর যে পুরান ঢাকার জনপদের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা শহীদুলই প্রথম তুলে ধরলেন সাহিত্যে। পুরান ঢাকার প্রেক্ষপাটে আরো কেউ কেউ লিখেছেন, ইলিয়াস ভাইও লিখেছেন কিন্তু এই দিকটাতে কেউ চোখ দেননি। এর ভেতর দিয়ে শহীদুল আমাদের এনথ্রোপোসেন্ট্রিক বা মনুষ্যমুখী সাহিত্যের শেকলও কিছুটা ভাঙ্গলেন। তো বলছিলাম, ‘মুখের দিকে দেখি‘ উপন্যাসটার কথা। সেখানে আমরা দেখি বানরের দুধ খেয়ে বড় হয়ে উঠা সেই ছেলেটা শেষ পর্যন্ত বিএমডাবলু গাড়ির চোর চক্রের সদস্য হয়। এই ছেলেটির জীবনের ভিতর দিয়ে পুরো বাংলাদেশের ভেতরের চেহারারা তুলে আনেন শহীদুল, বিশেষ করে নব্বই দশকের মার্কেট ইকোনমির বাঁধভাঙ্গা প্রভাবে কি করে এই জনপদের চেহারাটা বদলেছে, ভেতরের আন্তসম্পর্কগুলো কিভাবে টুকরো টুকরো করে নতুন রূপ নিয়েছে তার অসাধারণ বয়ান আছে এ উপন্যাসে। এছাড়া তার গল্পে, উপন্যাসে নানাভাবে বারবারই ঘুরেফিরে এসেছে অসাম্প্রদায়িকতার বিষয়টা। অসাধারণ মমতায় এ অঞ্চলের সংখ্যালঘু মানুষের কথা তুলে এনেছেন তিনি। বাম ধারার রাজনীতি করা বিপ্লবী চরিত্রের কথাও আমরা পেয়েছি তার গল্পে। মোটা দাগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং বাম রাজনীতির প্রতি সহানভুতি ফুটে উঠে তার লেখায়। শহিদুলের রাজনৈতিক বিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে কথা বলারও সুযোগ এখানে নেই। বক্তৃতা এমনিতেই দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।

আমি শেষ করবো তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে দু’একটা কথা বলে। আপনারা অনেকে জানেন যে শহীদুল জহির উচ্চপদস্থ একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি যখন মারা যান তখন সম্ভবত জয়েন্ট সেক্রেটারি পদে ছিলেন। তার দাপ্তরিক নাম শহীদুল হক আর সাহিত্যিক নাম শহীদুল জহির। শহীদুল হক এবং শহীদুল জহির কিন্তু ভিন্ন দুজন মানুষ। শহীদুল হক গম্ভীর, কেতাদুরস্থ সফল আমলা। কিন্তু শহীদুল জহির ভেতর ভেতর ব্যাপক কৌতুকপ্রবন আর কল্পনার দুরগামী এক যাত্রী। তবে দু ক্ষেত্রেই মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন খুব স্বল্পবাক, ভেতর গোটানো। যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শহীদুল জহিরের লেখার সঙ্গে মানুষ হিসেবে শহীদুল ছিলেন ইলিয়াসে একেবারে বিপরীত স্বভাবের। ইলিয়াস ছিলেন মহা আড্ডাবাজ আর শহীদুল একেবারে ভীড় এড়ানো মানুষ। আমি নিজে আগ্রহী হয়ে ঠিকানা যোগাড় করে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তিনি তখন বেইলী রোডের সরকারী কোয়ার্টারে থাকতেন। প্রথম তার বাসায় গিয়ে সত্যি বলতে বেশ ধাক্কাই খেয়েছিলাম। দিনের বেলা প্রায় অন্ধকার একটা রুমের ভেতর থাকতেন তিনি। ঘরে একটা চৌকি, বেতের কয়েকটা শেল্ফ, ছাত্রদের হোষ্টেলে সস্তা এই শেলফগুলো দেখা যায়, একটা আলনা, একটা টেবিল, সেখানে একটা ল্যাপটপ। একদিকে একটা টেলিভিশন, দু’টা বেতের চেয়ার। মশারীর দু‘টা প্রান্ত জানালার শিকের সাথে বাধা। এই তার ঘর। আমার প্রথম ঘরে ঢুকে মনে হয়েছিলো দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্টের‘ রাসকলনিকভের ঘরটা সম্ভবত এমন ছিলো। রাসকলনিকভ, যার কাজ ছিলো শুধু ভাবা। তো একজন জয়েন্ট সেক্রেটারীর বাসা এমন হবে তার মানসিক প্রস্তুতি আমার ছিলো না। আর আপনারা যারা তার সম্পর্কে জানেন তারা জানবেন যে তিনি অকৃতদার ছিলেন, বিয়ে করেননি। তো একাকী, দুই রুমের সরকারী কোয়ার্টারের একটা রুম নিয়ে তিনি থাকতেন। একেবারে ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ তার ছিলো যাদের সঙ্গে শুধু তিনি কথাবার্তা বলতেন। তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা বেশ একটু অস্বস্থিকরই ছিলো আমার। তাকে কোন প্রশ্ন করলে তিনি এক দুই কথায় উত্তর দিয়ে আবার চুপ হয়ে যেতেন। নিজে থেকে কোন কথাই বলতেন না। অনেকক্ষন পাশাপাশি বসে থাকলেও তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করলে তিনি মুখ খোলেননি। প্রথম পরিচয়ে মনে হয়েছে অদ্ভুত নিমগ্নতা তার চারপাশে একটা দুরত্ব তৈরী করে রেখেছে। যাহোক পরবর্তী কয়েকটা সাক্ষাতের পর ধীরে ধীরে তার সঙ্গে এনগেজড হওয়া গেছে। এবং একবার এনগেজড হলে দেখেছি তিনি একটু একটু করে অনেক কথা বলেন, মজাদার আলাপ করেন। তার সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে, তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে, তার প্রেম, তার সংসার করা না করা ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার আড্ডা দেয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সামাজিক যোগাযোগ ইত্যাদির ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ ছিলো না। কেউ খুব আগ্রহী হয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি তার মর্যাদা দিতেন। অনেকেই তার সাক্ষাৎকার নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং তিনি তাদের সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। কিন্তু কোন রকম সাহিত্য গোষ্ঠী রক্ষা করা, সাহিত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া এসবে তার কোন আগ্রহ ছিলো না। আমার মনে আছে একদিন তার লেখা নিয়ে আলোচনা চক্র হবে, কিছু তরুন তাকে আগেই জানিয়েছিলো এবং অনুরোধ করেছিলো তাকে সেখানে উপস্থিত থাকার জন্য। আমি সেদিন উনার বাসায় ছিলাম, আমি বললাম যে আমি যাচ্ছি ঐ আলোচনায়, আপনি যাবেন না? আমি জানতাম তার ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ নিয়ে আলাপ করবে কয়জন তরুণ। তো উনি বললেন, আজকে বাংলাদেশের একটা ক্রিকেট খেলা আছে, টেলিভিশনে বসে ওটা তিনি দেখবেন। আর বলেছিলেন মনে আছে, ‘পাঠকের কাছ থেকে দূরে থাকাই ভালো।’ আমাদের সাহিত্য অঙ্গনে তো নানারকমের দলাদলির ব্যাপার আছে, গোষ্ঠী আছে, শিষ্য আছে, গুরু আছে, কে কোন দশকের বড় লেখক তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তো উনি এসবের থেকে শত হাত দুরে থাকতে চাইতেন। এসব নিয়ে কথা হতো তার সঙ্গে। তিনি খুব কৌতুক বোধ করতেন এইসব সাহিত্যিক আস্ফালন দেখে। একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে সাহিত্যের আড্ডায় একসময় যেতেন তিনি কিন্তু সেসব আড্ডা থেকে ফিরে তার মনে হতো সারা গায়ে কে যেন আঁচড় কেটেছে। কথাটা প্রায় মনে পড়ে আমার। ব্যক্তিগত আলাপে আমাকেও বলেছিলেন একদিন, একে অন্যের পিঠ চাপড়ানো কিম্বা একে অন্যকে খামচে দেয়া, এই তো সাধারণ প্রবণতা আমাদের সাহিত্য মহলে। ফলে উনি এসব এড়িয়ে চলতেন। তার অল্প ক‘জন সাহিত্যপ্রেমিক বন্ধু ছিলো মাত্র। তিনি একটা গভীর মগ্নতায়, নিভৃতে প্রায় ধ্যানের মত করে লেখালেখি করতেন। লেখকের কাজ হচ্ছে আন্তরিকতার সাথে, শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখে যাওয়া, সেটা তিনি করে গেছেন। কিছু প্রখ্যাত অগ্রজ লেখক কিভাবে তাকে উপেক্ষা করেছেন সে কথা তিনি জানিয়েছিলেন আমাকে। প্রকাশকের কাছ থেকেও কেমন অবহেলা তিনি পেয়েছেন সেটা আমি নিজে দেখেছি। কিন্তু এসবে তোয়াক্কা ছিলো না তার। তিনি বরং একটা কমার দুঃখে এক গল্প দু‘বার করে ছাপিয়েছেন। শহীদুল কোন সাহিত্য সভার সভাপতি হননি কোনদিন, কোন টেলিভিশন টক শোতেও অংশ নেননি। কিন্তু তাতে তরুনদের তাকে খুঁজে নিতে সমস্যা হননি। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তার আশ্চর্য সাহিত্য সৃষ্টির ব্যাপারে ক্রমশই আরো বেশী করে আগ্রহী হয়ে উঠছে। তার প্রমান এই মিলনায়তনেই আমি দেখতে পাচ্ছি। শুধুমাত্র শহীদুল জহির সম্পর্কে কথা শুনবার জন্য আজকে যে এতজন উপস্থিত হয়েছেন তা দেখে সত্যিই আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। সৎ সাহিত্য ধীরে, গোপনে মানুষের বুকে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

শহীদুল জহির প্রসঙ্গে আমার ব্যক্তিগত একটা দুঃখের ব্যাপার আছে। আমার এক বন্ধু আছেন কানাডায়, হাসনু, উনি বাংলা জার্নাল বলে একটা পত্রিকা করেন। হাসনু আমাকে অনুরোধ করেছিলেন শহীদুল জহিরের সঙ্গে একটা কথোপকথনে বসতে যা তিনি তার পত্রিকায় ছাপাবেন। আমি শহীদুলের লেখার আগ্রহী পাঠক আর আমার লেখার সঙ্গে শহীদুল জহিরেরও মোটামুটি পরিচয় আছে, ফলে কথা ছিলো আমরা আমাদের পরস্পরের ভাবনা, লেখা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলবো। উনি তখন বেইলি রোডের সরকারী কলোনিতে থাকেন। তো উনার সাথে টেলিফোনে কথা হলো যে আমি পরবর্তী এক শুক্রবার তার বাসায় যাবো। শুক্রবারই আমাদের দু‘জনের ছুটি। কিন্তু আনফর্চুনেটলি যে শুক্রবারে তার বাড়িতে যাবার কথা ঠিক তার আগের সপ্তাহে তিনি মারা গেলেন হার্ট এ্যাটাক হয়ে। তো সেটা আমার একটা খুব ব্যক্তিগত বেদনার জায়গা যে তার সঙ্গে একটা ফর্মাল কথোপকথন, যা রেকর্ডেড হয়ে থাকতে পারতো, তার সুযোগটা আমি হারিয়েছি। তার মৃত্যুতে ভীষণ শকড হয়েছিলাম। আমি বরাবরই গভীর আগ্রহে থাকতাম কবে তিনি আবার ভুতের গলি বা দক্ষিন মৈশুন্দির মজাদার নতুন একটা গল্প নিয়ে হাজির হবেন। শহীদুলের মৃত্যুর পর পরই পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছিলাম, ‘থেমে গেলে দক্ষিন মৈশুন্দির গল্প‘ এই শিরোনামে। সে লেখার তার মৃত্যু সংবাদের স্মৃতিচারণ করেছিলাম। মনে আছে আমি সেদিন অফিস থেকে ফিরছিলাম। গাড়িতে ছিলাম। আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে জানায় যে শহীদুল জহির মারা গেছেন। স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম। বিষন্নতা ঝেপে ধরেছিলো আমাকে। আমার মনে আছে, একটা ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি দেখছিলাম পাশের ফুটপাতের উপর একটা ১০/১২ বছরের খুব দরিদ্র এক কিশোরী, ৫/৬ বছরের একটা ছোটো ছেলেকে শক্ত হাতে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা হয়তো তার ভাই। খুব কৌতুহলদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে আমি জাস্ট আগের দিনই একটা লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তার একটা গল্প পড়ছিলাম, সম্ভবত সেটাই তার শেষ প্রকাশিত গল্প। সেই গল্পে ঠিক এরকম এক কিশোরী আর একটা ছোট ছেলেকে নিয়ে একটা দৃশ্য ছিলো। যাদু বস্তবতার মত আমার মনে হচ্ছিল যেন বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে দৃশ্যটা উঠে এসে রচিত হয়ে আছে ফুটপাতের উপর। সেই গল্পটার কয়েকটা লাইন আপনাদের আমি পড়ে শোনাচ্ছি এখন। গল্পটার নাম ‘ দি মিরাকল অফ লাইফ’। তিনি লিখছেন, ‘একটা কিশোরী, কিংবা ছেমরি, অথবা মাইয়া, যাই হোক, তাকে নিয়া কি করা যায়? তার নাম কিছু একটা হইতে পারে। কারণ সে মানুষ, মানুষের তো নাম থাকে, তাই হয়ত তার নাম আছে, হয়ত তার নাম পরী, লালু কিংবা আয়শা। সে যদি রেললাইনের কিনারায় বাবুই পাখির বাসার মতন তালি মারা ছিঁড় ছিড়া বাসার পচা নর্দমার পাশে খাড়ায় তখন তার মায়ে দৌড় পারে। তার মায়ে যাইয়া কার কার ভাত রান্ধে, সালুন রান্ধে, রুটি বানায়। কারা কারা যেনো তা খায়। হয়ত তারা গাইল পারে, ‘এইসব কি রান্দস মাতারি।‘ তখন সে, হয়ত পরী, কিংবা হয়ত পরিবানু, অথবা লালু সে রেললাইনের কিনারায় দয়াগঞ্জ কিংবা স্বামীবাগে কোনো ছোটো ভাই কিংবা ছোটো বোনের হাত ধরে খাড়ায়া থাকে। এবং তখন তার বাপেও দৌড়ায়। সেও যেনো কই কই যায়। হয়ত সে কিছু করে, কার রিক্সা চালায়, কার ঠ্যালাগাড়িতে হাত লাগায়, কিংবা হয়ত সে কিছুই করে না। সে পেটে শুল বেদনা নিয়া শুইয়া থাকে। তখন পরীকে নিয়া কি করা যায়? নেতা কিংবা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারী কিংবা সিভিল সোসাইটি কেউ জানে না আমরা এই পরীকে নিয়া কি করবো। এই পরীকে নিয়ে কি করা যায়, আমরা ভেবে পাই না।’

শহীদুল জহির এভাবেই গভীর মমতায় বাংলাদেশ নামের ভূখন্ডের একেবার ভেতরের বেদনা, সংকট আর সম্ভাবনা যাদুকরের মত তুলে এনেছেন তার অনন্য সাধারন গদ্যে। যত দিন যাবে শহীদুল জহিরকে আমাদের নতুন করে খুঁজে নিতে হবে বলেই আমার বিশ্বাস। আজকে আমি শহীদুল জহির নিয়ে কিছু কথা বলবার সুযোগ পেয়েছি বলে খুবই ভালো লাগছে। এই সুযোগটা দেবার জন্য আবারো ধন্যবাদ জানাই বাঙলার পাঠশালাকে। আর এতক্ষন আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনবার জন্য আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. আপনার মূল‍্যায়ন এভাবেই হয়তো পাঠকের পাঠ-বৈচিত্রে উৎসাহ যোগায়। ধন‍্যবাদ।

    উত্তরমুছুন