প্রাসাদ

দীপেন ভট্টাচার্য



হেমন্ত

বিকেল গড়াল। এক সূর্যে চমকে উঠল আলো আর তার মেহগনি রঙ ছড়িয়ে পড়ল দিগন্তে সিঁদুর-মেঘের ওপর, অবতল আকাশের গায়ে লাগানো বহুদূরের হলুদ বনের পেছন দিয়ে। আলো ছিটকে পড়ল এই ঘরের বেগুনি কোণে, টেবিলের ওপরে রাখা লাল বুদবুদের ল্যাম্পে যা বহুদিন কাজ করে না।
বহুদিন বিদ্যুৎ ছিল না--অসংখ্য মোমবাতির অবশেষ ছড়ানো ঘরের মেঝেতে--যেখানে এককালে ছিল সেই মোমেরই পালিশ, আজ শতাব্দীর সময়ে তা রুক্ষ্ম কাঠ, মর্মরের কিছু অংশ, বাকিটা শুধুই পাথর। এমনিতর বিকেল নামছে অগুন্তি দিন ধরে, কালের হিসেব নেই, বয়সের হিসেব নেই, শুধু রয়েছে ঋতুর হিসেব--হেমন্ত গড়িয়ে একদিন শীত আসবে, হলদে পাতা থেকে সাদা তুষার। আজ হেমন্ত অথচ দিগন্তে কালচে মেঘ, বর্ষা শেষ হয়েছে বহুদিন, হয়তো বছর দশেক হবে।

তবু বাতাসে রয়ে গেছে শেষ বৃষ্টির গন্ধ। সোঁদা গরম বাতাস বাইরের অ্যাসফাল্ট থেকে বিরাট খোলা জানালা বেয়ে এই দক্ষিণমুখী ঘরে এসে ঢোকে। গলা বাড়ালেই দেখা যায় বহু নিচে কালো পিচের রাস্তা, সাদা অ্যাসফাল্ট, সবজে হলদেটে গাছের মাথা। বৃক্ষরাজি পৃথিবীর আদি অংশীদার, তারা শীতের জন্য প্রস্তুত।

শীত আসছে--গাছেরা সন্ত্রস্ত অথচ অভিব্যক্তিহীন, আর এটাই তাকে ভীত করে তুলতো সবচেয়ে বেশি। প্রতি বিকেলে সে জানালায় আঠার মত লেগে থাকতো দিগন্তের দিকে, নিচে গাছের দিকে চেয়ে। শীত আসছে। হেমন্তের পালা শেষ হয়েছে, আসছে তুষার--তুষারপর্ব। ওঃ! কতোদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে।

হয়তো এক প্রাচীন বসন্তে তৈরি হয়েছিল এই প্রাসাদের সব করিডরগুলো, আকাশে তখনো মেঘ জমে নি। বিশালাকায় গ্রানাইট, কোয়ার্ৎজ আর কংক্রীট খণ্ডে গড়ে উঠেছিল আকাশচুম্বী আকৃতি। অসংখ্য লম্বা সমান্তরাল করিডোর মিলিয়ে গিয়েছিল কোনও এক অন্ধকার পৃথিবীতে। সবজেটে ম্যালাকাইট-দেয়ালে ছিল খচিত কুলুঙ্গি, বহুকাল আগে সেখানে হয়তো ছিল প্রাগৈতিহাসিক মূর্তি। আজ সেই স্থান শূন্য যেমন শূন্য এই বিশাল আকাশচুম্বী প্রাসাদ।

বৈকাল জানালা থেকে সরে আসে। সে তাকায় ঘরের নোনা-ধরা দেয়ালের দিকে। কবে তৈরি হয়েছে এই দেয়াল সে জানে না। সে শুধু অনুভব করে ঐ দেয়াল আর ঐ ঘরের সাথে তার একাত্মতা, তার বয়সও বাড়ছে বৈকালের মতো। বয়স বাড়ছে সেকেন্ড, ঘণ্টা, কালের হিসেবে।

আগে কোনদিন সে হেমন্ত অনুভব করে নি--গাছের পাতার রঙ বদলে যাওয়া দেখে নি। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময় উত্তুরে দ্রাঘিমার বনবীথির বর্ণালী দেখার জন্য। দূরের বনে আগুন লাগে, সবুজ পাতা ক্রমাগত হয়ে যায় হলদে বাদামি খয়েরি লাল। বৈকাল অনুভব করে সেই রঙের কারুকাজে দীর্ঘায়িত হেমন্ত তার মনে দাগ কাটছে আর কাটছে। প্রথমে ধীরে খুব ধীরে, তারপর ভারি পাথরের মত প্রকৃতি তার ভার নামাচ্ছে তার হৃদয়ে, হৃদয়ের গভীরে। আগে কোনদিন সে এতোটা বোঝে নি। আগে কোনদিন সে এতটা একা ছিল না।

আজ বহু বছর হয়ে গেল বৈকাল উঠে এসেছিল দক্ষিণের উপত্যকা পার হয়ে চিরহরিৎ বনের মাঝ দিয়ে গভীর এক গিরিখাত অতিক্রম করে এই প্রাসাদের ধারে। সেই দিন হঠাৎ করেই বনের মাঝে তার সামনে উন্মোচিত হয়েছিল এই বিশাল প্রাসাদ, তার চূড়ায় জমেছিল কুয়াশা।

আকাশ জুড়ে কালো মেঘ নেমেছিল, সূর্য ছিল না, শুধু মেঘ আর দিগন্তের মাঝে কিছুটা পরিষ্কার সাদা নীলচে ফালি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ সরে গিয়েছিল। সাদা সূর্য ঠিকরে পড়েছিল স্বচ্ছ কাঁচের ওপর, লক্ষ জানালা ঝিলিক দিয়ে উঠল চোখ-ধাঁধানো আলোয়। উত্তরের বাতাস বনের ত্রিকোণ গাছগুলোর ওপর দিয়ে নিয়ে এসেছিল পুরোনো পাথরের গন্ধ। উচ্চ দ্রাঘিমার বন মাটি আকাশ আর শরৎ ছিল, আর ছিল সেই প্রাসাদ। ধূসর পাথরখণ্ডের সুউচ্চ অট্টালিকা। তার শীর্ষে সোনালি দণ্ড সূর্যালোকে ঝলকিত।

সূর্যের শেষ রশ্মিটা মিলিয়ে গেলে এক লাল আভা দিগন্তে ভেসে রইল। বৈকাল তিনটে মোমবাতি জ্বালায়। মোমবাতির আলোয় তার তিনটে ভুতূড়ে ছায়া দুলতে থাকে।

প্রাসাদের পরিধি জুড়ে শ'য়ে শ'য়ে মূর্তি সে আবিষ্কার করেছিল। কালো পাথরের নারী ও পুরুষ। কিন্তু বহুকাল প্রকৃতির নানা তাণ্ডবে, জলের নিচে অনেক বছর থাকার ফলে সেগুলো এখন ধ্বংসাবশেষ। তাদের পোশাকের ধরন নির্দিষ্ট করা যায় না, সুস্পষ্টভাবে মুখের গঠন বোঝা যায় না। প্রাসাদের নির্মাতাদের শেষ প্রতীক কিন্তু নির্মাতারা হারিয়ে গেছে পার্থিব দৃশ্যপটের অন্তরালে।

রাত্রি নেমে আসে প্রতিদিনের মত সেই অমোঘতা নিয়ে। নিঝুম নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের রাত্রি। ঠাণ্ডা বাতাসে ভেসে আসে গাছের পাতার আওয়াজ।

বৈকাল ঘরের কোণায় রাখা একটা পুরু মোটা খাতা তুলে নেয়। বাদামি মলাটের খাতা--এক কোণা ছেঁড়া। যেদিন সে উঠে এসেছিল প্রাসাদে তার ছয় মাস পর সে পৌঁছেছিল কেন্দ্রীয় অংশের আশি তলায়। সে'খানেই একটি ঘরে পড়েছিল এই খাতাটি--এই বিরাট প্রাসাদে মানব হস্তলিপির একমাত্র নিদর্শন। এটি একটি দিনলিপি, বৈকাল অসংখ্যবার তার পাতা উল্টিয়েছে, পড়েছে। অতীতের সঙ্গে দিনলিপিটি তার একমাত্র যোগাযোগ।

কিছু অতীতের তিন পথিক। বৈকালের মত তারাও ছিল এই প্রাসাদে আগন্তুক। মহাপ্লাবনের সময় উঠে এসেছিল তারা এই প্রাসাদে। তাদের এই দিনলিপি বর্ষার এক খতিয়ান, মহাপ্রসাদের ব্যাপক বর্ণনা। বৈকাল পড়তে আরম্ভ করে।




অতীতের তিনজন

".....এবার আমরা লাগলাম শ্যাওলা পরিষ্কার করতে। ওপরের তলার ব্যালকনি থেকে জল চুঁইয়ে জানালার কার্নিস বেয়ে এসে পড়ত ঘরের দেয়ালে। কয়েক বছরের নিরবচ্ছিন্ন বর্ষায় বিশাল হলঘরের চারটি দেয়ালই নীলচে নরম শ্যাওলার পুরু আবরণে ঢেকে গিয়েছিল। নীল শ্যাওলা নেমেছিল ঘরের মেঝেতে। পিচ্ছিল স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে আলো আসতে পারত শুধু দক্ষিণ দিক থেকে, আর সে আলো ছিল সবসময়ই বৃষ্টির জলে ঢাকা।

পরে আমরা বাড়ির উত্তর দিকে প্রবেশের চেষ্টা করি। বিশাল পরজীবী লতাগুল্মে ভরা ছিল সেই দিকটা। ঘন শিকড়ের আস্তরণে প্রতিটি ঘর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। দু-একটি দরজা ভেঙে আমরা ঢুকেছিলাম, সেখানে ভেতরের উদ্ভিদজগৎ আমাদের এক পা'র বেশি এগুতে দেয় নি।

দক্ষিণ অংশের যে কয়েক হাজার ঘরের মধ্যে দিয়ে আমরা যেতে পেরেছি তার কোনটিতেই কোনও আসবাবপত্র ছিল না। ছিল না এমন কোনও চিহ্নই যা দিয়ে বোঝা যায় প্রাসাদের আদি-অধিবাসীদের পরিচয়। দক্ষিণ অংশ দিয়ে ভ্রমণের সময় একমাত্র যে জীবন্ত বস্তুর সাক্ষাৎ আমরা পেয়েছি তা হচ্ছে সাদা ঠোঁট ও কালো শরীরের কিছু পাখি--পুরো একটা ঘর জুড়ে ছিল তাদের আস্তানা। ভাঙা কাচের জানালা দিয়ে তারা যাতায়াত করত অবাধে কোনও এক অজানা গন্তব্যে।

কোথায় যায় সেই পাখি? চারিদিকে থই থই জল--দিগন্তের পার পর্যন্ত।

প্রতিদিন জল বাড়ছে। জল বাড়ছে স্তম্ভের আকারে। জল আমাদের তাড়া করে করে নিয়ে যায় প্রাসাদের ওপরে। প্রথমদিকে জল বাড়ছিল খুব তাড়াতাড়ি। এক বছরে আমরা পৌঁছেছিলাম সম্মেলনকক্ষে, তিন বছরে গ্রন্থাগারে (যেখানে একটি বইও ছিল না)। আর এখনকার হারে জল বাড়লে মাত্র দু'বছরে আমরা পৌঁছে যাব কেন্দ্রীয় অংশের সবচেয়ে ওপরের তলায়।

গ্রন্থাগারটি ছিল আমাদের প্রিয় জায়গা। শ'য়ে শ'য়ে শূন্য বইয়ের তাক বিশাল ঘরটিকে ঘিরে ছিল। আমরা মোটামুটি সেটিকে বাসযোগ্য করে এনেছিলাম, কিন্তু ছ'মাসের বেশি সেখানে আমরা থাকতে পারি নি। সেই ক'টি মাসে অর্ধেক বইয়ের তাক আমরা পুড়িয়েছি, বাকি অর্ধেক দড়ি বেঁধে বর্তমানের বাসস্থানে উঠিয়ে এনেছি। এই জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে দক্ষিণ অংশের কয়েক হাজার ঘরের দরজা রয়েছে। প্রাসাদের নিচে আমরা আবিষ্কার করেছিলাম খাদ্যসামগ্রী, অশেষ ছিল সেই সঞ্চয়। সেই সম্ভার আমরা বছরের পর বছর ওপরে উঠিয়েছি।

বর্ষা চলছে আজ পনেরো বছর। জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায় মহাপ্লাবনের সমুদ্র, অতিকায় স্ফীত কোনও দানব। তার সীমাহীন জলরাশি ঢেকে রাখে অতীতের সামান্য স্মৃতিটুকুও। আর সামান্য বাতাসে তার উন্মত্ত ফেনিল ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়ে এই প্রাসাদের দেয়ালে, কেঁপে ওঠে বাড়ি। স্পন্দিত দেয়ালে কান রেখে আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি তিনটি অস্থিভূত প্রাগৈতিহাসিক জীব।

ইঞ্জিনিয়ার রিভা ও শেইন বলেছে কোনও এক বিশাল সামুদ্রিক প্রাণী নাকি তারা দেখেছে। রাত্রিবেলা বৃষ্টির জল ছাপিয়ে আমাদের কানে যেন ভেসে আসে কোনও এক হুঙ্কার ধ্বনি। আমাদের দৃষ্টিতে ভাসে জলের বহু নিচে সেই জীবের দ্রুত সঞ্চালন, তীব্র গতিতে তার দেহ আঘাত করে প্রাসাদের নিমজ্জিত ঘরগুলোকে। কেঁপে ওঠে বাড়ি, খসে পড়া পলেস্তরা। ঘরের মোমবাতিতে আমাদের চোখের আতঙ্ক ঠিকরে পড়ে।

দিনের বেলা আমরা মুখ বের করে বৃষ্টির স্বাদ অনুভব করি এক তিক্ত অনুভূতি নিয়ে। এই বর্ষা আমাদের নৈর্ব্যক্তিক শত্রু, বৃষ্টি আমাদের কারারক্ষী। প্রকৃতির শেষ খেলায় আমাদের বন্দিত্বের ভূমিকা কী আমরা চিন্তা করি। আমরা চিন্তা করি আকাশে উড়বার, জলে সাঁতার কাটবার, আবার মাটিতে হাঁটবার। এই তিনজন মানুষের মত অসহায় জীব আর পৃথিবীতে নেই।

আর এই প্রাসাদের কোনও দেয়ালেই কোনো ছবি ছিল না, ছিল না কোনও বই, আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, পরিধেয় বস্ত্র। এমন কিছুই ছিল না যা দিয়ে পরিচয় পাওয়া যায় সেই সুদক্ষ প্রকৌশলী লোকদের যারা এই বিশাল প্রাসাদ নির্মাণ করেছে। যদি কোনোদিন বর্ষা থামে, যদি কোনোদিন জল নেমে যায়, যদি কোনো চিহ্ন এখানে নিচের ঘরগুলোতে থাকে....."


৩.

বোধিবৃক্ষ

"...আজ ইঞ্জিনিয়ার শেইন তার জীবনের সব্চেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি শোনালেন।

সে অনেকদিন আগের কথা। বর্ষা নামবার দশ বারো বছর আগে। কোনও একটা কাজে তাকে গ্রামে যেতে হয়েছিল....

অন্য কোনও শব্দ ছিল না। নিস্তব্ধতা, প্রান্তর আর মাঠ পেরিয়ে ব্যাঙের ডাক। পায়ের চাপে মাটি ভেঙে যাচ্ছিল আর ছলকে উঠছিল জল। মাঠ পেরুতে পেরুতেই সন্ধ্যা হয়ে আসল। লাল থেকে ধূসর হয়ে মুহূর্তে বদলে গেল আকাশ। দিগন্তে মেঘ সরে গেল, উঠে আসতে শুরু করল গ্রীষ্মের তারারা। নবমীর চাঁদের হালকা জ্যোৎস্নায় কাটা ফসলের ওপর সোনালি আলো চমকাতে লাগল। দূরে, অনেক দূরে কালো গাছের সারির আবছায়া ভাব। আর কোনও আলো নেই--একেবারেই নেই। ব্যাঙের নিরবচ্ছিন্ন আওয়াজ ছিল, অন্য শব্দ ছিল না।

শহরের বাজারে তাকে বলেছিল, 'এই রাস্তা ধরে চলে যাবেন, মাঠ পেরিয়ে মাইল চারেক গেলেই বড় রাস্তা।' সে হাঁটছে ঘণ্টা দুই হবে। মাঠের মাঝে কোনও রাস্তা সে দেখে নি--শুধু ছিল মাইলের পর মাইল কাটা ফসল।

এতদূর আসে ফসল কাটতে, সে ভেবেছে। সে ভেবেছে সেই পরিশ্রমের কথা, মাইলের পর মাইল ফসল বয়ে নিয়ে যাবার।

নাকি ট্রাক্টর নেমে গেছে? টায়ারের কোনও দাগ সে দেখে নি।

আর তখনই তার মনে হল ব্যাঙের ডাকটা হঠাৎ থেমে গেল। একেবারেই চুপচাপ, নেমে এল কোথা থেকে এক নিটোল নিস্তব্ধতা। ঝিঁঝিঁ ডাকছিল না। সে থেমে গেল। কান পেতে রইল। উত্তর আকাশে তখন সপ্তর্ষি ঘুরছে ঘড়ির কাঁটার মত।

আর কখনই সে এরকম নিস্তব্ধতা অনুভব করে নি? কোনও কিছুরই শব্দ নেই, বাতাস নেই, গাছের পাতার সিরসির নেই, জল ছলকে উঠছে না। শুধু দূরে, অনেক দূরে আকাশের গায়ে আঁকা গাছের সারি।

এই কি চরম নিস্তব্ধতা?

না, এই তো বুকের আওয়াজ রয়েছে। মস্তিষ্কে হৃৎস্পন্দনের শব্দ। কপালের দু'পাশে কৃত্রিম যান্ত্রিক শব্দ। মাথা ধরে গেল তার।

তোমাকে যদি এক শব্দরোধী ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়, আর দেয়ালে এঁকে দেয়া হয় দূরের গাছের সারি, তখন আবছায়া আলোয় বিশাল নীরবতায় দাঁড়িয়ে থাকো তুমি সেই ঘরের মাঝে।

সারাজীবন আমি নিস্তব্ধতা চেয়ে এসেছি, ভাবল সে। এই কি তাই? মহাশূন্যের প্রান্তরে, সভ্যতা থেকে জীবন থেকে বহুদূরে, ধূমকেতুর লেজের ধাবমান গতির পশ্চাতে, সূর্যকে লক্ষ আলোকবর্ষ পেছনে ফেলে তুমি যে নিস্তব্ধতা চাও এই কি সেই? কী আশ্চর্য, সে ভাবল। যেন এই মুহূর্তটির জন্য সে হেঁটেছে দু'টি ঘণ্টা, আর লক্ষ সাধনের পর তার আর কোনও উদ্দেশ্য নেই। এই হল মহাকালের আদিরূপ। শুধু অনুভব, এক আবেগহীন অনুভব। গ্রীষ্মের এক রাত্রি, স্বাতী নক্ষত্র, সপ্তর্ষির তারারা, জলাভূমি, কাটা ফসল আর শেইন এক আশ্চর্য বন্ধনে বাঁধা।

আর তখনই সে দৌড়াতে আরম্ভ করল। তার পায়ে ছিল ভারি বুট। বিশাল পদক্ষেপে দু'পাশে জল ছিটকে পড়তে লাগল। দৌড়াচ্ছিল সে এক অজানা লক্ষ্যে--আগের পথ হারিয়ে গিয়েছিল কোথায়। তার বড় পদক্ষেপে কিন্তু নৈঃশব্দের নিটোলতা ভেঙে যাচ্ছিল না। পৃথিবীর শব্দ আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সে অনুভব করছিল গতি--নৈঃশব্দের গতি ও সঙ্গীত। তার সকল চেতনায় মূর্ছনা তুলছিল শব্দহীন সঙ্গীত।

সে জানে না এমনি করে চলেছে কতোক্ষণ। সেই নির্বাক অভিযান হঠাৎ থেমে গেল। হাঁফিয়ে গিয়েছিল সে, কিন্তু তার শ্বাসের শব্দ শোনা গেল না। এক বায়ুহীন মাধ্যমে কোন শব্দ বাহিত হচ্ছিল না। ভীষণ ক্লান্তিতে সে কোনও অবলম্বনের জন্য হাত বাড়াল। আর তখনই তার হাতে ঠেকল গাছের বাকল।

সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিশাল মহীরুহ। সহস্র বছরের পুরাতন বটবৃক্ষ। বিশাল তার ব্যাস, সহস্র মূল নেমে এসেছে কাণ্ড থেকে মাটিতে। চাঁদ ততোক্ষণে উঠে এসেছে মাথার ওপর, তার হালকা হলুদ আলোয় সবুজ পাতা ঝলকাচ্ছিল।

সে দাঁড়িয়ে ছিল এক বৃক্ষ-সাম্রাজ্যের বাইরে। ধাপে ধাপে সেই বৃক্ষ উঠে গেছে ভেতরে আর বিশাল জট পাকিয়ে রেখেছে কেন্দ্রে। ভেতরে তার যেন অন্তহীন অন্ধকার। কোথায় ছিল এই বটবৃক্ষ এতক্ষণ? মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটবার সময় এটিকে তো দেখতে পাবার কথা ছিল।

মাথায় শিশিরের ফোঁটা পড়ে। হিম পড়তে শুরু করেছে--ভরা গ্রীষ্মেও এই বৃক্ষরাজ্য যেন শীতের দখলে। মাটি ভিজে ভিজে। সে প্রবেশ করল বৃক্ষসাম্রাজ্যে। আর তখনই মনে হয় এক মুহূর্তের জন্য বয়ে গেল বাতাস, সহস্র বটমূল কাঁপল, পাতা সিরসির করে উঠল। সেটা শুধু এক সেকেন্ডের জন্যই, তারপর আবার সব শান্ত। যেমন ছিল তেমনই। সে থামল, কান পাতল, পাতার আড়ালে কি কোনও শব্দ আছে? হৃৎস্পন্দন ব্যতীত অন্য শব্দ ছিল না। ওপরে আকাশ আর দেখা যাচ্ছিল না, ডালপালায় সব ঢাকা। অন্ধকার গাঢ় হয়ে ওঠে, সে এগিয়ে যায় কেন্দ্রে।

সহস্র বছরের প্রান্তে ভবিষ্যতের আশায় থাকে এক বোধিবৃক্ষ। কেন্দ্রে পৌঁছায় সে, হাত রাখে বটমূলে। আর মুহূর্তে তার শরীরে খেলে যায় বিদ্যুৎ তরঙ্গ।

তখনই ঝলমল করে ওঠে গাছ। আলোয় আলোয় একাকার। স্বর্ণাভ আলো ঠিকরে পড়ে কাণ্ড থেকে, শাখা-প্রশাখা ঝলকায় হলুদ রঙে, পাতা জ্বলে ওঠে সবজেটে। বিশাল বৃক্ষ টিউবলাইটের মত জ্বলে ওঠে, স্বচ্ছ আলোয়। আর এক চক্রাকার বেগুনি আভা সমস্ত গাছটাকে ঘিরে নেমে আসে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে। শেইন হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

হে ঈশ্বর! মূঢ় স্থবির জীবনে আলো ঝলকাল। নবমীর এই রাতে সমস্ত চান্দ্রীয় আলো, গ্রীষ্মের সৌরীয় আলো, লুব্ধকের আলো, পৃথিবীর সমস্ত মৃত্তিকা-প্রদত্ত আলো ঝলকাল ঐ গাছের মাঝে। তুষ্ণীক বৃক্ষ কথা বলল আলোর ভাষায়। হাজার বছরের আহরিত শক্তি--ক্লোরোফিলে ক্লোরোফিলে সঞ্চিত ধ্বনি ভেসে উঠল চেতনার ওপর। চেতনা--বৃক্ষচেতনা। বৃক্ষ কি অনুভব করেছে মানুষের উপস্থিতি? কথা বলতে চেয়েছে তার সঙ্গে? হয়তো কোনোদিন মানুষ আসে নি মাঠের এই প্রান্তে। সহস্র বছর বৃক্ষ অপেক্ষা করেছে একটি মানুষের উপস্থিতির জন্য, আর আজ এই বিশাল মহীরুহ অনুভব করেছে তার পদভার, হৃৎপিণ্ডের শব্দ, শরীরের সঞ্চালন।

অনুভব করেছে এবং উত্তর দিয়েছে।

কেন দিয়েছে সে তা জানে না। কি সংকেতের অপেক্ষা করছিল এই মহীরুহ? শেইনের হাল্কা পদচারণাকে কি সে ভেবেছিল কোনো মহাজাগতিক বার্তা?

উত্তর দিয়েছিল আলোর ভাষায়। কিন্তু এই আলোর ঝলকানির মাঝে কি অর্থ লুকিয়ে ছিল? যে জীবনসত্তার জন্য বৃক্ষ অপেক্ষা করছিল সে সত্তা গাছের ভাষা জানে। কিন্তু সে কি সেই সত্তা? সে সেই মানুষ নয় যার জন্য বৃক্ষ এতকাল অপেক্ষা করেছিল। আর আজ সহস্র বছরের সঞ্চিত শক্তি ও জ্ঞান নিঃশেষ হয়ে গেল। এক বিশাল বেদনাবোধে সে নতজানু হয়ে বসে পড়ে।

ইঞ্জিনিয়ার শেইন তার গল্প শেষ করে। আমরা নিশ্চুপ বসে থাকি, আমাদের নীরবতায় অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পরে শেইন বলে, 'যদি আমি মূঢ় মানুষ না হতাম তবে সেই সংকেতের মর্ম হয়তো উদ্ধার করতে পারতাম। কিন্তু সবার মতোই আমি ছিলাম নির্বোধ, প্রকৃতির ইঙ্গিত বোঝার চেষ্টা আমি করি নি। আর শোনো তোমরা, এতোদিন এই প্রাসাদে থাকার পর আমি অনুভব করেছি এই প্রাসাদের চেতনা। তোমরা চিনতে পার নি সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ। সেই চেতনা যেন ঐ বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বোধি মহীরুহের শিকড়ের মত, তার বিস্তার প্রসারিত হচ্ছে পৃথিবীর গভীরে। তোমরা জানো মাঝে মাঝে এই বাড়ি কেঁপে ওঠে। তার কারণ কি জানো? তার কারণ এই বর্ষায় এই প্রাসাদ প্রাণ পাচ্ছে আর তার শিকড় আরো জোরে মাটিকে আঁকড়ে ধরছে। হ্যাঁ, শিকড়--এই প্রাসাদের শিকড়। কোনও বর্ষার, ভূমিকম্পের, তুষারের সাধ্য নেই তাকে স্পর্শ করে। তারপর একদিন হয়তো সেই বিশাল মহীরুহের মতোই সে জ্বলে উঠবে। পৃথিবীর সমস্ত শক্তি ঝলসাবে তার পাথরের দেয়ালে, কাঠের দরজায়, জানালার কাচে, স্ফটিকের ঝাড়- লণ্ঠনে।'

আমরা চুপ করে রইলাম। আমি ভাবলাম সেই প্রকৌশলী জাতির কথা, যারা এই প্রাসাদ তৈরি করেছে। কী তাদের ভাষা, কী তাদের প্রকৃতি? কোন ইচ্ছায় তারা এই প্রাসাদ ছেড়ে চলে গেছে? কীসের জন্য?

হয়তো-বা মহাবর্ষার প্রথম দিনে তারা প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল কাতারে কাতারে, ফেলে আসে নি এমন কোনোই চিহ্ন যা দিয়ে তাদের চেনা যাবে ভবিষ্যতে। তারপর সারিবদ্ধ হয়ে চলে গেছে এমন কোথাও যেখানে এই মহাপ্লাবন তাদের স্পর্শ করবে না।

কোথায় গিয়েছে তারা? হয়তো পৃথিবীর কোথাও নয়। আমরা জানালার বাইরে বৃষ্টির পর্দা ছাড়িয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকাই।"




সংশপ্তক যাদুকর


"...আজ ইঞ্জিনিয়ার রিভা তুরা শহরের কথা বলল। তুরা ছিল আমাদের কাছে কিংবদন্তীর শহর।

'আমার কাহিনী খুব বড় নয়। এই কাহিনীর কিছুটা তোমাদের জানা। আর যেটুকু আমার জানা তা আজ যেন খুব অস্পষ্ট আবছায়া। আমরা থাকতাম তুরা শহরের বাইরে--শহরতলীতে। শান্ত ছিল সেই জীবন। জানো তো একদিন আমরা সবাই শিশু ছিলাম। সেই শিশুরা খেলা করত এক মাঠে। অনেক দূরে তুরা শহরের আকাশচুম্বী অট্টালিকা দিগন্তে ছায়ার মত দাঁড়িয়ে থাকত। সন্ধ্যায় আকাশে দেখা দিত অদ্ভূত চাঁদ, আর নদীর ওপারে বৈদ্যুতিক ট্রেনগুলো তাদের কামরায় আলো জ্বালিয়ে চলে যেত কোনও রহস্যময় স্টেশনের দিকে। সূর্য জ্বলজ্বল করত মাথার ওপর, মাঝে মধ্যে মেঘে ঢাকা পরত সে। বৃষ্টি নামত। আমরা ভিজে ভিজে সেই মাঠে খেলতাম। আমাদের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এক নির্বিঘ্ন সুরে।

সেই সময়--একদিন সন্ধ্যা নামছে, আমরা খেলছি, এক লোক হাজির হল আমাদের শিশুদের মধ্যে। সে নিশ্চয় হেঁটে এসেছিল, কিন্তু মনে হল যেন সে হঠাৎই আবির্ভূত হয়েছে। তার দেহ ছিল এক লম্বা কালো আলখাল্লায় ঢাকা, তার মুখকে আমি ঠিক বর্ণনা করতে পারব না, কিন্তু সেই মুখ ছিল যেমন চমকপ্রদ তেমনি অশান্ত। তার বয়স বোঝা যায় না--বার্ধক্য, প্রৌঢ়ত্ব, তারুণ্যের এমনই মিশ্রণ। তার উপস্থিতি আমাদের হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। ক্ষণেকের জন্য মনে হয় তার অস্তিত্ব অলৌকিক।

সে বলে, "আমি সংশপ্তক যাদুকর। এমন কিছু নেই যা আমার অজানা, এমন কিছু নেই যা আমি পারি না, আর তোমাদের--শিশুদের--আমি দেখাব সেই অদ্ভূত যাদু।"

আমাদের চোখ কাঁপে, আমরা চুপ করে থাকি। আমরা অপেক্ষা করি এক অত্যাশ্চর্য ঘটনার জন্য।

অথচ সে তার আলখাল্লার পকেট থেকে বার করে সাধারণ তিনটে ফুল। বলে, "এই আছে, এই নেই। বল দেখি, শিশুরা, সেই ফুল কোথায় গেল?"

আমরা শিশুরা বড় নিষ্ঠুর ছিলাম। আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম--"ঐ তো, ঐ তো তোমার আলখাল্লার আস্তিনে লুকানো রয়েছে লাল ফুল।"

মুখ কালো হয়ে গেল সেই যাদুকরের। দণ্ডখানেক চুপ করে থেকে সে তিনটে রঙীন পালক বের করে আনে যেন কোথা থেকে। সে বলে-- "এই আছে, এই নেই, কোথায় গেল সেইসব পালক।"

আমরা ততোক্ষণে আরও সাহসী হয়ে উঠেছি। আবার আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম, "বাঃ, ঐ তো, ঐ তো তোমার লম্বা চুলের মাঝে জেগে আছে পালকের মাথা। তোমার সব যাদুই আমরা ধরে ফেলতে পারি।"

মুখে তার নেমে আসে অন্ধকার। সে বলল, ‘‘তোমরা শিশুরা কিছুই জানো না।" আমরা হেসে উঠলাম তাকে ব্যঙ্গ করে।

সংশপ্তক বলে ওঠে, ‘‘তোমরা শিশুরা কি ভবিষ্যৎ দেখতে চাও না? তোমরা কি এতই নির্বোধ?"

আমরা--অবুঝ শিশুরা--তার দিকে তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে।

সে বলল, ‘‘বেশ, তবে তাই হোক। সেই যাদুই হোক। তোমরা, বোধহীন শিশুরা, কি তাই দেখতে চাও?"

আমরা বলে উঠলাম, "চাই, তাই চাই। দেখাও তোমার নতুন যাদু।"

এক নির্লিপ্ত হাসিতে ভরে যায় তার অয়স্কঠিন মুখ, দুই চোখের মণিতে ঝলকে ওঠে বেদনা ও ক্রূরতার অসম মিশ্রণ। সে বলে, "তবে তাই হোক।"

সেই মুহূর্তেই এক অবর্ণনীয় গভীর আতঙ্কে আমরা বিহ্বল হয়ে গেলাম। সেই আদি অলৌকিকতার ছাপ যেন ফিরে আসে। আমাদের সবার মন জুড়ে কোনও এক সর্বগ্রাসী ধ্বংসের বোধন রণিত হয়। আমরা চেঁচিয়ে উঠি, "বন্ধ করো, বন্ধ করো তোমার যাদু।"

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

এক ভীষণ আবর্তে আমাদের পায়ের নিচে মাটি দুলে ওঠে, আমরা ছিটকে পড়ি মাটিতে। এক বিশাল ফাটল দেখা দেয় একটু দূরে, আর নদীতে ওঠে উঁচু ঢেউ। সেই ঢেউ ডুবিয়ে দেয় বেঁধে রাখা নৌকোগুলো। আমরা তাকাই নদীর ওপারে শহরের দিকে। যেন আমাদের তাকানোর জন্যই শহরের উঁচু আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলো অপেক্ষা করছিল। তারা ধ্বসে পড়তে আরম্ভ করল। বিশাল শহরের ধ্বংস হয়ে যেতে মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। আমরা শিশুরা কেঁদে উঠি, ফিরে তাকাই যাদুকরের দিকে। সংশপ্তক ততক্ষণে চলে গেছে।

পরদিন থেকে মহাবর্ষা শুরু হল।

তুরা শহরের সেই ধ্বংস হওয়াটা সবাই জানে--এক বিশাল ভূমিকম্পের পরিণতি। আমি জানি না সংশপ্তক এই মহাপ্লাবনে বেঁচে আছে কিনা। কিন্তু কেউ যদি বেঁচে থাকতে পারে সে হল এই সংশপ্তক যাদুকর। তার নিঃশব্দ পদচারণা যেন শুনতে পাই প্রাসাদের করিডরে। প্রতিটি দেয়ালের কোণে আমি অপেক্ষা করে থাকি কখন আচম্বিতে তার প্রাচীন অবয়ব আবার ভেসে উঠবে।'

রিভা চুপ করে যায়। জানালার বাইরে বৃষ্টিকণা আমাদের বিষাদকে ব্যঙ্গ করে যেন বিজয় উল্লাসে ঝরে। আমাদের চেতনায় বোধহীন প্রকৃতি হয়ে ওঠে পরন্তপ। আলোর ভাষায় কথা বলে এক বৃক্ষ, টেকটনিক সঞ্চালন করে এক যাদুকর, বনের মধ্যে বিশাল প্রাসাদ গড়ে এক অজানা অত্যাশ্চর্য সভ্যতা, বর্ষা থামে না এক যুগ ধরে। এক দুর্নিবার অলৌকিকতায় আমরা ভেসে যাই এক অমোঘ যবনিকার দিকে। মনে বাস করে এক অবোধ্যতা।"




তুষারপর্ব

এরপর দিনলিপির আর পাতা নেই। বহুদিনে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় থাকার ফলে বাকি সব পাতা খুলে পরে গেছে। বৈকাল চেয়ার ছেড়ে ওঠে। ডায়রিখানা রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বর্ষা শেষ হয়েছে, জল নেমে গেছে কবে, কতোদিন হেমন্ত চলেছে। প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে সেখানেই। হয়তো কারও ফিরে আসার অপেক্ষায়, সেই বোধিবৃক্ষের মতই। হয়তো-বা সেই সংশপ্তক যাদুকরের জন্যে।

সেই অতীতের তিনজন এই প্রাসাদের রহস্যের সমাধান পায় নি, ভাবে বৈকাল। তাদের হাতে যথেষ্ঠ সময় ছিল না, প্লাবনের শেষ সময় এই প্রাসাদ সম্পূর্ণভাবে ডুবে গিয়েছিল জলে। আর সে এখন একা। কতদিন সে ভ্রমণ করেছে প্রথম তলার ঘরগুলোতে যেখানে সেই তিন অভিযাত্রী প্রবেশ করতে চেয়েছিল। কতোদিন সে ঘুরেছে উত্তর অংশের ঘরগুলোয় যেখানে শুধুই ছিল মৃত উদ্ভিদ-লতার অবশেষ।

সামনে শীত আসছে, যদি কিছু জীবন্ত থাকে জমবে তা তুষারে।

মেঘ যখন মাথার ওপর থেকে সরে দিগন্তে লুকিয়ে পড়ল তখন ধীরে ধীরে জল যখন নেমে যেতে শুরু করল। মাটির নিচের তলাগুলো আস্তে আস্তে মুক্ত হল, পৃথিবীর গভীরে চলে গেল মহাবর্ষার জল। প্রতিদিন বৈকাল জলের সঙ্গে সঙ্গে নিচের তলাগুলোয় নামতে শুরু করল। নিচে আরো নিচে, কী রহস্য লুকানো মাটির তলায় লুকানো ঘরগুলোতে। সে আবিষ্কার করেছিল বিশাল গুদাম, মাটির নিচে সঞ্চয়ভাণ্ডার যা কিনা ছড়ান ছিল দশটি তলা জুড়ে।

অবশেষে একদিন জল মুক্ত হল শেষের তলাটি।

আর তার নিচে ছিল ধাতব শিকড়। বিশাল ব্যাসের অসংখ্য শিকড়, প্রাসাদের দেয়াল থেকে বেরিয়ে সেই শিকড় চলে গেছে মাটির অনেক নিচে। বহু নিচে, ভূগর্ভের জমাট অন্ধকারে, অনেক শিকড়ের আলিঙ্গনে প্রাসাদ তার অবস্থান সুদৃঢ় করেছে। ইঞ্জিনিয়ার শেইনের কথা সত্যি হয়েছে।

এই প্রাসাদের শিকড় আছে। এই শিকড় ধাতবই শুধু নয়, জৈবিকও বটে। কয়েক শতাব্দীর অস্তিত্ব প্রাসাদকে যেন দিয়েছে চেতনা আর তা মূর্ত হয়েছে ঐ শিকড়ে। উদ্ভিদের মূল আছে, মূল আছে সেই বোধিবৃক্ষের, আর আছে এই প্রাসাদের। লোহা, কংক্রিট, আর পাথরের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাসাদের শিকড়। জড় প্রাসাদ কয়েক শতাব্দীর কঠিন প্রকৃতিকে করেছে অগ্রাহ্য, তারপর মহাবর্ষায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রলম্বিত করেছে নিজে দেহ থেকে অজৈবিক শিকড়। প্রথমে তা সাহায্য করেছে নরম মাটিতে সেই সুবিশাল সৌধকে ভিত্তি দিতে। তারপর সেই কঠিন শিকড়ের সিলিন্ডারে এসেছে জৈবিক রস। জৈব শিকড় মাটির থেকে শক্তি আহরণ করে বাঁচিয়ে রেখেছিল প্রাসাদকে।

কোনও এক অজানা কোলাহলে কেঁপে উঠেছিল লোহা-পাথরের শিকড়। সেই নির্জন মাটিতে চুঁইয়ে আসত বৃষ্টির জল। দুর্বার পিপাসায় প্রাণহীন ধাতু ও পাষাণ নড়ে উঠল। পৃথিবীর অন্ধকারে, প্রাগৈতিহাসিক মাটিতে আসে পরিবর্তন। জীবনের প্রার্থনায় কেঁপে উঠত বিশাল প্রাসাদ আর তার অভিব্যক্তি হল তার ভূগর্ভস্থ শিকড়ে। প্রাণ পেয়েছিল ধাতব পাষাণ।

পরদিন সকাল থেকে তুষার পড়া আরম্ভ হল। নিচের সমস্ত গাছের মাথা ঢেকে গেল নরম সাদা তুষারে। তার সমতল মসৃণতায় ঢেকে গেল দূরের বন। বৈকাল বুঝল এবার এসেছে তুষারপর্ব।

নক্ষত্রের আয়ু শেষ হয়, পৃথিবীরও বটে। এই প্রাসাদের একদিন শেষ আছে--এই চৌষট্টি হাজার ঘরের। বর্ষা শেষ হয়েছে কতকাল, হেমন্ত গেল চলে। এবার এল শীত প্রথমে নরম তুষার তারপর কঠিন বরফ নিয়ে। বরফ জমবে তলায় তলায়, প্রতিটি ঘরের মাঝে। কোনও জীবন নেই, নইলে বরফ জমতো হৃদয়ের গভীরে, মাটির নিচে গভীর শিকড়ে। জীবনের আকাঙ্ক্ষায় প্রাণ পেয়েছিল পাষাণ-ধাতু, আর প্রাণ পেয়েছিল বলেই তার আছে মৃত্যু।




বরফ

সে হাঁটছিল মাইলে পর মাইল। হয়তো কয়েক হাজার মাইল। ভয়ঙ্কর তুষারঝড় তার চোখকে প্রায় অন্ধ করে দিয়েছিল, বরফ-শীতল বাতাস আঙ্গুলগুলো অসার করে দিয়েছিল। বিশাল বরফের ঢিপিতে সে হোঁচট খাচ্ছিল। সে পার হয়েছিল বড় হিমবাহ, হিমবাহগুলো ইতিমধ্যে বইছিল পাহাড়ের গভীর গিরিখাত ভর্তি করে। বইছিল দক্ষিণ দিকে। মাঝে মধ্যেই সে দৌড়াচ্ছিল, এমনভাবে যেন তার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপরে সুর্যকে এর মধ্যে সে দেখে নি সে, মেঘে ঢাকা ছিল সেই আকাশ। যতই সে দক্ষিণদিকে যাচ্ছিল, ততই তার সামনে বিস্তৃত হচ্ছিল এক নিরবচ্ছিন্ন সাদা পৃথিবী, তার পথ সেই শুভ্রতায় হারিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সে জানতো তার পায়ের নিচে, কয়েক হাজার ফুট নিচে, রয়েছে এক প্রাচীন পথ যার সমান্তরাল রেখায় সে চলেছে।

অবশেষে একদিন সেই নিরবচ্ছিন শুভ্রতায় ব্যতিক্রম এনে দেখা দিল এক সোনালি চূড়া। শুধু সেই সময়ই যেন মেঘ সরে গিয়েছিল, সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ল সেই চূড়া থেকে, তার চোখ ধাঁধাল। বরফ ভেদ করে উঠেছিল সেই চূড়া। সে কাছে পৌঁছালে দেখল সেটির উচ্চতা হয়তো এক মানুষ সমান। হাত বাড়াতে তার দ্বিধা হচ্ছিল, তবু সে স্পর্শ করল সেই ধাতব সোনালি চূড়া। সে হয়তো আশা করছিল কিছু একটা ঘটবে তার হাতের স্পর্শে, হয়তো কিছুই আশা করছিল না। কিন্তু তার সারা মুখে দেখা দিল গভীর হতাশার ছাপ। দেরি হয়ে গেল, অনেক দেরি হল, সে ভাবল।

তারপর সংশপ্তক দক্ষিণের পথ ধরল।

বিশাল প্রাসাদ স্থবির হয়ে পড়ে রইল বরফের নিচে।

-------------------------------------------------------------------------------------------------

টীকা: প্রায় ৮৫০ থেকে ৬৩৫ মিলয়ন (৮৫ কোটি থেকে ৬৩.৫ কোটি) বছর পূর্বে একটি সময়পর্ব ছিল প্রবল শীতের। এই পর্বকে ভূতাত্ত্বিকরা নাম দিয়েছেন ক্রায়োজেনিয়ান। সেই সময়পর্বে স্টারটিয়ান ও মারিনোয়ান নামে এমন দুটি হিমবাহ যুগ ছিল যখন--অনেক বিজ্ঞানীদের মতে--সারা পৃথিবী বরফে ঢেকে গিয়েছিল।


লেখক পরিচিতি
দীপেন ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৫৯। আদি নিবাস এলেঙ্গা, টাঙ্গাইল।
বিজ্ঞানী। গল্পকার।

মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পদার্থবিদ্যায়  মাস্টার্স এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নিউ হ্যাম্পশায়ার থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট ইন্সটিটিউটের গবেষক ছিলেন। পরে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড ক্যাম্পাসে (ইউসিয়ার) গামা রশ্মি জ্যোতির্বিদ হিসেবে যোগ দেন। এ ছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। ১৯৭৫ সালে তিনি বন্ধুদের সহযোগিতায় 'অনুসন্ধিৎসু চক্র' নামে একটি বিজ্ঞান সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

 বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর প্রকাশিত বই : দিতার ঘড়ি, নিওলিথ স্বপ্ন, অভিজিৎ নক্ষত্রের আলো। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ