সাধন চট্টোপাধ্যায়
দেখতে দেখতে লম্বা সময় পেরিয়ে গেল। গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে বর্তমানে শূন্য দশকের বিদায় অবধি নিরলস গল্পচর্চায় আমার গল্পভুবনের ফসল প্রায় পাঁচ শতাধিক। কাঁচা বয়সের অত্যুৎসাহের পালে সম্পাদকদের স্নেহের আনুকূল্য মিলতেই সৃষ্টির নৌকোটি তড়তড়িয়ে ছুটতে শুরু করেছিল। তার খোলে ফসলের স্তূপ তুলে নেয়ার খেলায় টের পাইনি, কত অংশ শাঁস, বয়ে বেড়াবার যোগ্যই বা কতখানি।
সে-বয়সে ভাববার তাগিদ ছিল না। সময়, দেশদশ, মানুষের সকল স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন ও জীবনবিভূতির লীলাখেলা যে-ভাবে আমাকে জাগিয়ে তুলত, পাঠকদের মধ্যে তা চাড়িয়ে দেয়ার নেশায় গল্প লিখেছি। নগর ও জিলাশহরের খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকা থেকে অর্বাচীন-- গল্প পাঠানোর আমন্ত্রণ পেলেই দিয়েছি সাড়া। সে-সবের মধ্যে আশি বছরের ঐতিহ্য-গৌরবের পত্রিকা যেমন আছে, একটি প্রসবেই আয়ু ফুরিয়েছে--এর সংখ্যাও কম নয়। লেখা পাঠাতে পত্রিকার বাদবিচার করিনি। সকলের প্রতি সম্ভ্রম ও মান্যতায় আজও আমি বিশ্বাস রাখি। হয়তো কোনো পত্রিকার গল্পে আশানুরূপ সাড়া জাগেনি, কোনোটা বা অতিনন্দিত হয়েছে। সৃষ্টির রহস্যের চাবিকাঠি কে খুঁজে পায়? কিন্তু কোনো আমন্ত্রণেই চিন্তা-মননের ফাঁকি, দায়সারা গোছের খর্বকায় খেলায় ভাবের ঘরে চুরি করিনি। প্রতিটি নতুন গল্পের আয়োজন আমাকে তাড়া দেয় পূর্ববর্তীটির মান ছাড়িয়ে যেতে। আমি-ই আমার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বাংলা গল্পের ধারাটি বরাবরই ঋদ্ধ। উৎসে রবীন্দ্রনাথ থেকে আজ পর্যন্ত এর দিগন্তে কারো না কারও কলমের স্পর্শে সম্প্রসারণ ঘটছে। গানের মতো বাঙালি জাতির গৌরবের সম্পদ ছোটগল্প। এর চর্চা নিরলস সাধনার দাবি রাখে। শিল্পে চূড়ান্ত বলে কিছু হয় না। সৃষ্টিকর্তাকে আজীবন কানমলা খেতে হয়। তাই ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী--যখনই ভেবেছি একটি গল্প লিখে, পরবর্তীটি নীরবে বুঝিয়ে দিয়েছে এর কোনো সংজ্ঞা হয় না। একটি কাঠামোর আদল যদি কোনো লেখায় সোচ্চার হল, পরের লেখাটিই তা গিলে খেয়ে নিয়েছে। এটাকেই কি বিনির্মাণ বলে? শুনেছি বিনির্মাণের ইতিহাস ধরে কোনো লেখকের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা হয়--কী ভাবে নিজেকে তিনি ভেঙে গেছেন ক্রমাগত।
অনেকেই বলতে চান ছোটগল্প সমাজের আয়না। সামনে দাঁড়ালে যার যার আত্মকৃতি ও সময়কে দেখতে পাবেন। আমার ধারণা আয়নায় বস্তুর যথাযথ ছাপ পড়ে মাত্র। আসলে ওটা হওয়া দরকার ভাঙা আয়না। টুকরো টুকরো কাচগুলো যেখানে চূরচূর সাজানো। সম্মুখে দাঁড়ালেই বিনির্মিত হতে হয়। সহজে পৌঁছে-যাওয়ার যে-কোনো মাধ্যম আজ ছোটগল্পের আদল হয়ে উঠতে পারে। এমনকি, নতুন উদ্ভাবনার আধুনিক বিজ্ঞাপনজগৎও ছোটগল্পের সীমানাকে নতুন মাত্রা দিতে পারে। তাই ভালো গল্পের পাশাপাশি জরুরি হচ্ছে, পুরনো সীমাস্থানকে একটু বাড়িয়ে তোলা। যেমন চলছে তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে। যদি কোনো লেখকের দু-পাঁচটি গল্পও কলম্বাসের মতো সফলতা পায়, বাকি গড়পড়তা হলেও লেখক ক্ষমার্হ। ছড়রায় লক্ষ্যভেদ একটি গুলিতেই। ছুড়তে হয় ঝাঁকে ঝাঁকে।
আমার আখ্যান নিয়ে নানা প্রসঙ্গে পাঠকদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সিংহভাগই ইতিবাচক। একটি বিস্ময় তবু বিপন্ন করে আমাকে। ভালোলাগার কার্যকারণ নিয়ে কোনো পাঠকের বিশ্লেষণ। গভীর মনোযোগে শোনার পর, মিলিয়ে দেখি আমার উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। লেখক যেভাবে তারে ঝঙ্কার দিতে চেয়েছে, পাঠকের আনন্দ ভিন্ন কম্পনে বেজেছে। এটাই কি তত্ত্বকথায় বলে পাঠান্তরে অর্থভেধ? হয়তো। বিষয়টি ভেবে কৌতুক বোধ করেছি। বারবার স্মরণে এসেছে রবীন্দ্রনাথের লাইন, তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে, হে ছলনাময়ী।
একটি সকৌতুক ছলনা সম্প্রতি আমাকে বিস্মিত করেছে। আমার 'স্টিলের চঞ্চু' গল্পটি ইদানীং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের পাঠসূচিতে ঢোকার পর, বাজার চলতি যত সহায়িকা বেরিয়েছে কোনোটির সঙ্গেই দ্বিতীয়র সাযুজ্য নেই কোনো। সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য। এমন কি ধন্দ লাগছে লেখক কি এ-সবের ধারেকাছেও অবস্থান করছেন? হয়তো মিখাইল বাখতিন একেই বলতে চেয়েছেন পাঠান্তরের বহুস্বর এবং লেখকের একক কর্তৃত্বের অবসান। আমরা যারা গত শতাব্দীর সত্তরের ঝোড়োহাওয়ায় সাহিত্যের আঙিনায় ছুটেছিলাম, নতুন নতুন তত্ত্বকথা, উত্তর উপনিবেশিকতা ও তৃতীয় বিশ্বের কথাসাহিত্য যেমন চেতনায় তাঁদের ছায়া ফেলেছিল, দেশজ শিকড় হিসাবে পুরাণ, লোককাহিনী ও মিথ-এর সন্ধান, বিনির্মাণের তাগিদও কম জরুরি ছিল না তাঁদের কাছে। আমার গল্পের ভুবনে সে-সবের প্রয়াস হয়তো মনোযোগ দিলে খুঁজে পাওয়া যাবে।
পানশিলা, ৫ জানুয়ারি, ২০১২
দেখতে দেখতে লম্বা সময় পেরিয়ে গেল। গত শতাব্দীর সত্তর দশক থেকে বর্তমানে শূন্য দশকের বিদায় অবধি নিরলস গল্পচর্চায় আমার গল্পভুবনের ফসল প্রায় পাঁচ শতাধিক। কাঁচা বয়সের অত্যুৎসাহের পালে সম্পাদকদের স্নেহের আনুকূল্য মিলতেই সৃষ্টির নৌকোটি তড়তড়িয়ে ছুটতে শুরু করেছিল। তার খোলে ফসলের স্তূপ তুলে নেয়ার খেলায় টের পাইনি, কত অংশ শাঁস, বয়ে বেড়াবার যোগ্যই বা কতখানি।
সে-বয়সে ভাববার তাগিদ ছিল না। সময়, দেশদশ, মানুষের সকল স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন ও জীবনবিভূতির লীলাখেলা যে-ভাবে আমাকে জাগিয়ে তুলত, পাঠকদের মধ্যে তা চাড়িয়ে দেয়ার নেশায় গল্প লিখেছি। নগর ও জিলাশহরের খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকা থেকে অর্বাচীন-- গল্প পাঠানোর আমন্ত্রণ পেলেই দিয়েছি সাড়া। সে-সবের মধ্যে আশি বছরের ঐতিহ্য-গৌরবের পত্রিকা যেমন আছে, একটি প্রসবেই আয়ু ফুরিয়েছে--এর সংখ্যাও কম নয়। লেখা পাঠাতে পত্রিকার বাদবিচার করিনি। সকলের প্রতি সম্ভ্রম ও মান্যতায় আজও আমি বিশ্বাস রাখি। হয়তো কোনো পত্রিকার গল্পে আশানুরূপ সাড়া জাগেনি, কোনোটা বা অতিনন্দিত হয়েছে। সৃষ্টির রহস্যের চাবিকাঠি কে খুঁজে পায়? কিন্তু কোনো আমন্ত্রণেই চিন্তা-মননের ফাঁকি, দায়সারা গোছের খর্বকায় খেলায় ভাবের ঘরে চুরি করিনি। প্রতিটি নতুন গল্পের আয়োজন আমাকে তাড়া দেয় পূর্ববর্তীটির মান ছাড়িয়ে যেতে। আমি-ই আমার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী।
বাংলা গল্পের ধারাটি বরাবরই ঋদ্ধ। উৎসে রবীন্দ্রনাথ থেকে আজ পর্যন্ত এর দিগন্তে কারো না কারও কলমের স্পর্শে সম্প্রসারণ ঘটছে। গানের মতো বাঙালি জাতির গৌরবের সম্পদ ছোটগল্প। এর চর্চা নিরলস সাধনার দাবি রাখে। শিল্পে চূড়ান্ত বলে কিছু হয় না। সৃষ্টিকর্তাকে আজীবন কানমলা খেতে হয়। তাই ছোটগল্পের সংজ্ঞা কী--যখনই ভেবেছি একটি গল্প লিখে, পরবর্তীটি নীরবে বুঝিয়ে দিয়েছে এর কোনো সংজ্ঞা হয় না। একটি কাঠামোর আদল যদি কোনো লেখায় সোচ্চার হল, পরের লেখাটিই তা গিলে খেয়ে নিয়েছে। এটাকেই কি বিনির্মাণ বলে? শুনেছি বিনির্মাণের ইতিহাস ধরে কোনো লেখকের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা হয়--কী ভাবে নিজেকে তিনি ভেঙে গেছেন ক্রমাগত।
অনেকেই বলতে চান ছোটগল্প সমাজের আয়না। সামনে দাঁড়ালে যার যার আত্মকৃতি ও সময়কে দেখতে পাবেন। আমার ধারণা আয়নায় বস্তুর যথাযথ ছাপ পড়ে মাত্র। আসলে ওটা হওয়া দরকার ভাঙা আয়না। টুকরো টুকরো কাচগুলো যেখানে চূরচূর সাজানো। সম্মুখে দাঁড়ালেই বিনির্মিত হতে হয়। সহজে পৌঁছে-যাওয়ার যে-কোনো মাধ্যম আজ ছোটগল্পের আদল হয়ে উঠতে পারে। এমনকি, নতুন উদ্ভাবনার আধুনিক বিজ্ঞাপনজগৎও ছোটগল্পের সীমানাকে নতুন মাত্রা দিতে পারে। তাই ভালো গল্পের পাশাপাশি জরুরি হচ্ছে, পুরনো সীমাস্থানকে একটু বাড়িয়ে তোলা। যেমন চলছে তৃতীয় বিশ্বের নানা দেশে। যদি কোনো লেখকের দু-পাঁচটি গল্পও কলম্বাসের মতো সফলতা পায়, বাকি গড়পড়তা হলেও লেখক ক্ষমার্হ। ছড়রায় লক্ষ্যভেদ একটি গুলিতেই। ছুড়তে হয় ঝাঁকে ঝাঁকে।
আমার আখ্যান নিয়ে নানা প্রসঙ্গে পাঠকদের ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। সিংহভাগই ইতিবাচক। একটি বিস্ময় তবু বিপন্ন করে আমাকে। ভালোলাগার কার্যকারণ নিয়ে কোনো পাঠকের বিশ্লেষণ। গভীর মনোযোগে শোনার পর, মিলিয়ে দেখি আমার উদ্দেশ্য থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। লেখক যেভাবে তারে ঝঙ্কার দিতে চেয়েছে, পাঠকের আনন্দ ভিন্ন কম্পনে বেজেছে। এটাই কি তত্ত্বকথায় বলে পাঠান্তরে অর্থভেধ? হয়তো। বিষয়টি ভেবে কৌতুক বোধ করেছি। বারবার স্মরণে এসেছে রবীন্দ্রনাথের লাইন, তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে, হে ছলনাময়ী।
একটি সকৌতুক ছলনা সম্প্রতি আমাকে বিস্মিত করেছে। আমার 'স্টিলের চঞ্চু' গল্পটি ইদানীং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের পাঠসূচিতে ঢোকার পর, বাজার চলতি যত সহায়িকা বেরিয়েছে কোনোটির সঙ্গেই দ্বিতীয়র সাযুজ্য নেই কোনো। সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্য। এমন কি ধন্দ লাগছে লেখক কি এ-সবের ধারেকাছেও অবস্থান করছেন? হয়তো মিখাইল বাখতিন একেই বলতে চেয়েছেন পাঠান্তরের বহুস্বর এবং লেখকের একক কর্তৃত্বের অবসান। আমরা যারা গত শতাব্দীর সত্তরের ঝোড়োহাওয়ায় সাহিত্যের আঙিনায় ছুটেছিলাম, নতুন নতুন তত্ত্বকথা, উত্তর উপনিবেশিকতা ও তৃতীয় বিশ্বের কথাসাহিত্য যেমন চেতনায় তাঁদের ছায়া ফেলেছিল, দেশজ শিকড় হিসাবে পুরাণ, লোককাহিনী ও মিথ-এর সন্ধান, বিনির্মাণের তাগিদও কম জরুরি ছিল না তাঁদের কাছে। আমার গল্পের ভুবনে সে-সবের প্রয়াস হয়তো মনোযোগ দিলে খুঁজে পাওয়া যাবে।
পানশিলা, ৫ জানুয়ারি, ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ