তিনি লিখতে চেয়েছিলেন

আহমাদ মোস্তফা কামাল

কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গির চলে গেলেন! বিশ্বাসই হচ্ছে না। এত হাসিখুশি, এত প্রাণপ্রাচুর্যময়, তারুণ্যে ভরপুর একজন মানুষ এভাবে চলে যেতে পারেন?

কাছের মানুষদের বা বন্ধুদের বা শুভাকাঙ্ক্ষীদেরকে আমাদের অনেক কথা বলার থাকে। বলি-বলি করেও বলা হয় না, হয়তো ভাবি--সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না, বলবো কখনো। আর যদি একটু আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবার ব্যাপার থাকে, মানে একটু লিখে-টিখে জানানো, তখন হয়তো আরেকটু সময় নিতে হয়। আরেকটু পড়ে, আরেকটু গুছিয়ে লিখতে ইচ্ছে করে। এই করতে করতে সময় বয়ে যায়।
আর এর মধ্যে যদি আকস্মিকভাবে চলে যান কেউ, তখন মনের মধ্যে কথাগুলো গুমরে মরে, বুক ভারি হয়ে থাকে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। জাহাঙ্গির ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুর পর আমারও এখন এই অবস্থা। তাঁকে, তাঁর লেখা নিয়ে অনেক কথা বলার ছিল আমার, বলা হলো না! এত তাড়াতাড়ি চলে যাবেন তা তো ভাবিনি, সামনে দীর্ঘ জীবন পড়ে আছে--এই ভেবে আলস্য কাটিয়ে উঠিনি, এখন অপরাধবোধে ভুগছি।

১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামে তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয়। আমি তখন কয়েক মাসের জন্য চট্টগ্রামে ছিলাম। শহরটা আমাকে অসম্ভব মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু আমি ছিলাম একা। ওখানে আমার কোনো বন্ধু ছিল না, পরিচিতজনের সংখ্যাও ছিল নগণ্য। ওই অসম্ভব সুন্দর শহরে আমার সময়গুলো তাই কেটে যাচ্ছিল ভয়াবহ একাকিত্বের মধ্যে দিয়ে। নির্জনতাপ্রিয় মানুষ হলেও আমি আড্ডা দিতে পছন্দ করি, ঢাকায় নিয়মিত আড্ডা দিতামও, ওখানে গিয়ে তার ছেদ পড়লো। হাঁপিয়ে উঠেছিলাম প্রায়। এরকম এক নিঃসঙ্গ সময়ে জানতে পারি - কথাশিল্পী হুমায়ুন মালিক আছেন এই শহরে, জাদুঘরে কর্মরত। যোগাযোগ করতেই তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন আর তাঁর আমন্ত্রণ রক্ষার জন্য একদিন গেলাম তাঁর কর্মস্থলে। সেখানেই পরিচয় হলো জাহাঙ্গির ভাইয়ের সঙ্গে। তখনও তিনি তেমনভাবে লেখালেখি শুরু করেননি (সম্ভবত ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রথম গল্প ছাপা হয় মুক্তকণ্ঠ'র খোলা জানালায়), তাঁকে আমার চেনার কথাও নয়, তবু প্রথম আলাপেই কয়েক ঘণ্টা পার হয়ে গেল। কারণটি সহজেই অনুমেয়। আমাদের ছিল আলাপ করার মতো কমন একটি প্রসঙ্গ- সাহিত্য। আড্ডা দিতে দিতে তাঁকে আবিষ্কার করলাম দারুণ এক পাঠক হিসেবে। ক্লাসিক সাহিত্য তো বটেই, সমকালীন লেখালেখি নিয়ে তাঁর পঠনপাঠন-জানাশোনা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একজন 'পাঠক' এতটা পড়তে পারেন? তাও সমকালীন লেখা? আমি তখন নিতান্তই তরুণ লেখক, একটা মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে, তবে পত্রপত্রিকায় প্রচুর লিখছি, দেখলাম - তিনি আমার সব লেখাই পড়েছেন! পাঠকরা তো এত সমকালীন থাকেন না, সাধারণত প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখাই পড়েন তারা; লেখকরাই কেবল সমকালীন তরুণদের লেখালেখি নিয়ে এতটা খোঁজখবর রাখেন। একটু কৌতূহল নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম - তিনি নিজে লেখেন কী না। তিনি স্মিত হেসে বললেন,--লিখতে চাই, কিন্তু জীবনটাকে একটু গুছিয়ে নিয়ে...।' ততক্ষণে কথায় কথায় জানা হয়ে গেছে যে, তিনি বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় এবং আরেক কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামানের সহপাঠী। তবু তাঁর কথা শুনে অগ্রজের ভঙ্গিতে বললাম - 'জীবন তো কখনো গোছানো যায় না জাহাঙ্গির ভাই, ওটা আমৃত্যু অগোছালো রয়ে যায়। লিখতে চাইলে এক্ষুণি বসে যান। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।' তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন, এই হাসিটা আমৃত্যু ধরে রেখেছিলেন তিনি। বললেন- ‌’ঠিকই বলেছেন, কিন্তু সময় এত দ্রুত ফুরাবে কেন? আমাদের আরো অনেকদিন বাঁচতে হবে।'

হ্যাঁ, লেখালেখিই করতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু জীবনটা একটু 'গুছিয়ে' নিতে গিয়ে বড্ড দেরি হয়ে গিয়োছিল, এবং আমার মনে হতো--এই 'দেরি' হয়ে যাওয়াতে তিনি লজ্জায় বিমূঢ় হয়ে ছিলেন ওই সময়! শেষ পর্যন্ত আদৌ তিনি জীবনকে গুছিয়ে নিতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না, কোনো লেখকই তা পারেন না। হয় সহজ-সামাজিক জীবন নয়তো ব্যর্থ-অসামাজিক লেখক জীবন, দুটোর একটাকে বেছে নিতে হয়। দুটোই একসঙ্গে চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার লেখকদের জন্য। যদি লিখতেই হয়, তাহলে আগে জীবন গোছানোর চিন্তা করে খুব একটা লাভ নেই। দুটো কাজ সমান্তরালভাবে করাই ভালো। যাহোক, এর বছরখানেক পর যখন তিনি লিখতে শুরু করলেন, প্রায় স্রোতের মতো লেখা বেরুতে লাগলো তাঁর। অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম প্রতি সপ্তাহে প্রায় প্রতিটি পত্রিকায় তাঁর লেখা। মনে হলো, অনেক কথা জমা হয়ে আছে তাঁর, এবং দ্রত সেগুলো বলে ফেলতে চান। এ ছিল আরেক বিস্ময়! একজন মানুষ একসঙ্গে এত লেখা লিখতে পারেন! প্রায় দশবছর ধরে একটানা এভাবে লিখে যেন একটু বিরতি চাইলেন তিনি। কমিয়ে আনলেন লেখার পরিমাণ। সব মিলিয়ে তাঁর লেখালেখির বয়স পনের বছরের মতো। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তেরটি বই। অগ্রন্থিত আরো অনেক লেখাও নিশ্চয়ই রয়ে গেছে। তার মানে, অল্প সময়েই অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

এই সময়ে তাঁর সঙ্গে যে খুব গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তা নয়। দুজন দু-শহরে, দেখা হয় বছরে একবার, বন্ধুত্ব হওয়ার সুযোগ কোথায়? তবে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। তারচেয়ে বড়ো কথা, আমরা দুজনই দুজনের লেখা ও কর্মকান্ডের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি রেখেছিলাম। অনেক সময়ই আমার নানা লেখা নিয়ে তিনি লিখিত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সবসময় তা আমার পক্ষে গিয়েছে তাও নয়, বরং বেশ সমালোচনামূলক প্রতিক্রিয়াও পেয়েছি তাঁর কাছ থেকে। আমি সাধারণত বিতর্ক এড়িয়ে চলি বলে লিখিতভাবে ফিরতি প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি, তবে কথা বলে পরষ্পরের কাছে পরিষ্কার থেকেছি সবসময়। একটা দারুণ উষ্ণ আর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল তাঁর সঙ্গে, এবং এর প্রধান কৃতিত্ব তাঁরই। যাঁরা আমাকে চেনেন, তাঁরা জানেন--আমি যোগাযোগ রক্ষায় খুবই অপটু, কিন্তু যাঁর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় আমার, এক যুগ যোগাযোগ না হলেও সেই সম্পর্ক অমলিন থাকে। তিনি যেহেতু স্বভাবের দিক থেকে আমার মতো অসামাজিক ছিলেন না, যোগাযোগহীনতার দায় থেকে তিনি সহজেই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। আর তাঁর আন্তরিকতার প্রমাণ নানাভাবে পাওয়া যেত তাঁর কথাবার্তা-কাজকর্ম থেকেই। যেমন, বছর কয়েক আগে আমার এক জন্মদিনের সকালে তিনি ফোন করে বললেন- 'আজকে সারাদিন আপনার সঙ্গে কাটাবো।' কথাটিকে স্বাভাবিক শুভেচ্ছা হিসেবেই গ্রহণ করলাম আমি, মানে-- এক শহরে থাকলে হয়তো সারাদিন আড্ডা দিতেন, বা এখন আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে, এইরকম কিছু। কিন্তু দুদিন পরই এক চমক এলো। কুরিয়ারে একটা চিঠি, তাঁর লেখা। ওইদিন, সারাদিন ভরেই তিনি আমার বই পড়েছেন, একটা বই সম্পূর্ণই পড়ে ফেলেছেন একদিনে, পড়ার পর তাঁর কী ধরনের অনুভূতি হয়েছে সেইসব লিখে পাঠিয়েছেন চিঠিতে। তাহলে আমার সঙ্গে দিন কাটানো মানে আমার বই পড়া? এটা তো তখন ভাবিনি! সত্যিই দারুণ মুগ্ধ আর বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন। এইরকম আরো কত টুকরো টুকরো স্মৃতি! তাঁর লেখা নিয়েও আমি কথা বলেছি, খোলামেলাভাবেই বলেছি। এ ছিল এমন এক সম্পর্ক, সমালোচনা করলেও যে সম্পর্কে দাগ পড়তো না।

লেখালেখি শুরু করার আগে দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল তাঁর, যা লিখেছেন যত্ন নিয়ে লিখেছেন। ছোটকাগজ 'কথা' সম্পাদনা করেছেন, সেখানেও দারুণ যত্নের ছাপ। দারুণ পরিশ্রমী, যত্নশীল, কমিটেড এক লেখক ছিলেন তিনি। আর মানুষ হিসেবে ছিলেন অসাধারণ বন্ধুবৎসল, সদাহাস্যময়, শুদ্ধ মনের - যিনি কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে নিজের মনে দাগ পড়তে দিতেন না। এতগুলো বছর ধরে এত এত স্মৃতি, কখনো মনোমালিন্য হয়েছে বলে মনে পড়ে না। তিনিই হতে দিতেন না। এমনকি কোনো বিষয়ে তর্ক হলেও সম্পর্কে তার ছাপ পড়তে দিতেন না। তাঁর উষ্ণ আন্তরিকতা, সহমর্মিতা আর শুভকামনা সবসময়ই জানিয়ে দিতো - একজন বন্ধু আমার পাশে আছেন, একজন ভাই আমার কাঁধে হাত রেখেছেন।

বিদায় জাহাঙ্গির ভাই। আমারও হয়তো খুব বেশিদিন সময় নেই হাতে। যতদিন আছি এখানে, আপনাকে মনে রাখবো - শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায়। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ