কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও তাঁর লেখা

কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ও তাঁর লেখা
শ্রাবণী দাশগুপ্ত


মাত্র অর্ধেক জীবন কাটিয়ে চলে গেছেন লেখক। নিজের লেখা সম্বন্ধে বলে গেছেন, 'আমার গল্প গল্প হয় কিনা এ দায়িত্বই তো নিতে পারব না' কিম্বা, 'গল্প লেখাটা হচ্ছে গিয়ে আমার অক্ষমতাকে ঢেকে রাখার এক ধরনের প্রচেষ্টামাত্র'।

লেখক, মাত্র পঞ্চাশেই আপনার বিদায় নেওয়া 'অপূরণীয় ক্ষতি' কিনা, তা সময় বলতে পারবে, তবে লেখাগুলো থেকে মনে হল কী জবরদস্ত প্রতিবাদী কলম থেকে কালি শুকিয়ে গেল।

তাঁর লেখা পড়ছিলাম গল্পপাঠ ওয়েবজিনে। আসলে ওই যে বলে না, এপার বাংলা ওপার বাংলা/মধ্যিখানে চর--চর একটা আছেই, তবে যোগাযোগের সেতুও হয়েছে।

তাঁর প্রকাশিত বইয়ের নামগুলো সর্বনেশে, চমকে দেয় বারবার--মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম, কতিপয় নিম্নবর্গীয় গল্প, পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী।

প্রেক্ষাপট মুক্তিসংগ্রাম, তার পরবর্তী দৈন্য আর অসহায়তা এবং অত্যাচার। সমকালীন রাজনৈতিক পটে নিজেকে বসিয়ে লিখেছেন ছোটোগল্প, বিস্ময়করভাবে সংখ্যা মাত্র পঞ্চাশ! তাঁর লেখা পড়তে গিয়ে থামতে হয় বারবার, কোনো feel good atmosphere না পেয়ে কেমন দম আটকে আসে। যতটুকু বুঝেছি, মনমেজাজ ঠাণ্ডা করা হাওয়ার চলাচল থাকে না বরং রক্তের গন্ধ, পচা লাশের উৎকট চেহারা, সাপের মত গোপন হিংসাশ্রয়ী সমাজের মাথা অবলীলায় তাঁর লেখার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। ধ্বস্ত পাঠকের আর লুকনোর জায়গা নেই। চেতনার ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে লেখক বলেন, এই সত্যি, এই বাস্তব, এই নিয়তি। শাবলের গুঁতোয় থেঁতলে যায় বোধ। বাস্তব পেরিয়ে ক্রমাগত ঢুকেছেন জাদু দুনিয়াতে। আসলে চারপাশ যখন চেপে ধরে নিঃশ্বাস আটকে দেয়, তখন পরাবাস্তব আশ্রয় করে, স্বপ্ন দেখে বাঁচার রাস্তাটুকুই খোলা থাকে। এই স্বপ্ন কখনো কখনো সামূহিক হয়ে উঠছে, 'আমাদের স্বপ্ন কি জ্ঞানীদের স্বপ্নের ভিতর চালান করে স্বপ্নের বেসাতি করছি?'

লেখককে তাঁর লেখা দিয়ে চেনা যায়, মানে তিনি চিনিয়ে দেন। তখন তাঁর root/origin পাঠককে আগ্রহী করে। এই লেখক দেশভাগ (১৯৪৭) দেখেন নি, একাত্তরে বালক-- কিন্তু বালকোত্তীর্ণ পরিণতি এসেছে পারিপার্শ্বিক দেখে--রাজাকার ও মুক্তিযোদ্ধা! গ্রামের সঙ্গে আত্মিক যোগ (এটি হয়ত ঈর্ষাজনকভাবে বাংলাদেশের তাবৎ লেখকের। গ্রামই ভিত্তি, সমৃদ্ধ গ্রামবাংলা স্বপ্নে ভাসে বারবার), ধুলোমাটিকাদা পা, ধর্মের অশ্লীল গর্জন, প্রান্তিক মানুষের ক্লিষ্ট যাপন তাঁকে আহত করছে। লিখছেন, 'মানুষের ভিতরে যে প্রীতিময় মাখামাখি করার সত্তাটা ছিল তা দেশভাগই নষ্ট করে দিয়েছে'।

তাঁর স্বপ্ন-উদ্যান abstract--গল্পের উপাদান কতখানি নিয়ম-সংজ্ঞা মেনে, বুঝিনি। অমোঘ কিছু আপ্তবাক্য পেয়েছি, 'আইন কিছু না, এইডা হইল গিয়া নিজেরে গুছাইয়া রাখার একখান ফক্করবাজি।' ভেবে দেখি বারবার, কী বলেন কী লেখক! স্বপ্ন-উদ্যান কোথায়, খোঁজ দেননি, বলছেন 'শহরের কোনদিকে তা আমরা বলতে পারি না'। পাঠক খুঁজছে, নিশ্চয়ই আছে, আছে কোথাও--এই abstraction, এই আশা জাগানো, বাঁচার জন্যে খুব শীতে একটু হলেও উষ্ণতা দেয়। প্রতিষ্ঠিত ধর্মকে কেটেছেন ফালা করে, 'প্রত্যেক ধর্মের অন্তর্জগতেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ আছে। ধর্ম তো আসলে জাদু, মানুষকে হিপ্নোটাইজ করার কারিগর।' ভীষণ তীব্র ও স্পষ্ট অন্তর্দৃষ্টি এবং তার প্রকাশও ভণিতাশূন্য। এইগুলো এসেছে গল্পের ডালপালায় জড়িয়ে, জ্ঞান দেওয়ার মতো নয়, অচ্ছেদ্যভাবে। নিজেই জানাচ্ছেন তাঁর গল্পের অনেকের পরত, খুলে খুলে প্রবেশ করতে হয়।

'একটা দ্বন্দ্ব না থাকলে সামগ্রিক জীবন হত কি করে?' বলছেন কামরুজ্জামান। দ্বন্দ্ব তাঁর লেখার চরিত্রে বারবার ঢুকেছে, মানবিক করেছে, বাস্তব করেছে তাদেরকে। আসুন বাড়িটা লক্ষ্য করি--গল্পের নাম। পুরনো হেলে-পড়া বাড়ির চরিত্র বর্ণনা করছেন লেখক স্বয়ং--'বাড়িটা সামন্ত আবহের প্রতীক, তাই সেজদার ভঙ্গিতেই ক্রমশঃ নুয়ে পড়ছে।' সেজদার ভঙ্গিতে নুয়ে পড়া--এই যে প্রতীক, এর মধ্যে অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। যা ছিল, যা আছে, যা নেই, অথবা যা বদলাবে।

যুদ্ধ লগন আর একটি--'গলায় কম করে হলেও পাঁচটা পোঁচ। ২০/২৫টা ছোট মাছ সেই পোঁচের পচাগলা মাংসের গর্তে ঢুকে আছে।' 'পাঁচটা মাস ধরে জলখেলি তো লাশর জামিনদারীই নিয়েছে।' চেতনার অন্তর্দেশ খুঁচিয়ে দিয়ে যাচ্ছে এই কাহিনি। শিপুন নামের মুক্তিযোদ্ধার মাকে ধর্ষণ করছে রাজাকার কায়েছালী। মাত্র কয়েকটা বাক্যেই বলা-- ঘটনার বীভৎসতা গলা চেপে ধরেছে।

অসাধারণ ভাষা আর উপমা ব্যবহার করছেন লেখক। মাটির ধুলো থেকে, গাছের পাতা থেকে, লতা থেকে তুলে নিচ্ছেন তাদের। কথোপকথনে সম্পূর্ন গ্রামীন দৈনন্দিনতা। আরোপিত নয়, চলমান ভাষা। মধ্যবিত্তসুলভ সাজানো ভাঁড়ানো ন্যাকামি নেই, গায়ে গতরে গেঁয়ো ভাষা, '--সূর্মা আক্তার কই? হেরে পান বানাইতে কও। -- হে ত গরে নাই বাজান। --তাই নিহি? কই গেল?' অভ্যেস না থাকলে বুঝতে খানিক অসুবিধে হতে পারে, তাতে লেখকের অবশ্যই কিছু আসে যায়না। বোঝার দায় পাঠকের। এখানে দুএকটা কথা স্বীকার না করে উপায় নেই, এপার বাংলার লেখকের অধিকাংশ এই মৃত্তিকাসংযোগ হারিয়েছেন কয়েক দশক আগে। কার্পেট আর সোফায় সাজানো ঘরে বসে যা লেখা হয়, তা লেখকদের স্বীয় মেধা ও প্রচুর সাহিত্যপাঠের ফলফসল। সমাজপট পাল্টাচ্ছে বলে শহরমুখীদের অন্য ধরণের crises নিয়ে বেশি লেখা হচ্ছে। যার ফলে সেখানে মাটির ভাষায় কথা মধ্যবিত্তের শৌখিন ভাবন-গড়ন দিয়ে তৈরি হয়, বেশ মেকি লাগে। একসময়ে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বা একটু পরের সমরেশ বসু ও সমকালিন আরও কেউ যখন লিখছেন, সে-লেখা মাটি-ছোঁওয়া সাধারণদের (subaltern) মত করে বলা। ওপার বাংলার লেখকেরা কিন্তু আজও সামগ্রিকভাবে গ্রামকে কেন্দ্রায়িত করে, বঞ্চিত, ক্লিন্ন, অভাবী, শঠ মানুষদের কথা বলেন। হ্যাটস্‌ অফ সেজন্যে।

যাই হোক, আলোচ্যে ফেরা যাক। একঘেয়েমি তখনই, যখন এক theme, এক সমাজপ্রেক্ষিত, ভাবনা, দর্শন নিয়ে চরিত্রগুলো নাম বদলে আসে। কামরুজ্জামানের লেখাতেও খানিকটা আছে তা। তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আশার সন্ধান দিয়ে রাখেন মিস্টিসিজমের হাত ধরে, --'জীবনকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্নময় রাখতে হয়।'

যুদ্ধলগন গল্পের শেষে, শিপুইন্যার কবরের পাশে বেড়ে ওঠা আমগাছের পূর্ণতা দেখে ধন্দে পড়ে কায়েছালী। এই ইঙ্গিত জয়ের ইঙ্গিত, বাঁচার ইঙ্গিত। অপ্রাসঙ্গিকভাবে, বিভূতিভূষণের 'পুঁইমাচা' কাহিনীর শেষ বাক্যটি মনে পড়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ