মনোজিৎকুমার দাস
প্রত্যেকেরই জীবন প্রদীপ এক সময় নিভে যায়, কিন্তু তা যদি অসময়ে নিভে যায় তবে তা বড়ই দু:খ ও বেদনার । বাংলা সাহিত্যের প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ( ১৯৬৩- ২০১৫) এর জীবন প্রদীপ অসময়ে নিভে যাওয়াটা বড়ই হৃদয় বিদারক।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রামের বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা ( চলতি দায়িত্ব) হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ৭ মার্চ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে চট্টগ্রাম ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কুমিল্লা স্টেশনে তাকে নামানো হয়। দ্রুত ভর্তি করা হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ওই দিন দুপুরে তিনি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
মর্মান্তিক খবরটা ৭ মার্চ বিকাল ৩টার দিকে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে প্রথম দেখে হতবাক হয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সুস্থসবল একজন চিকিৎসক মানুষ , একদিন আগেও তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, হঠাৎ কীভাবে মারা গেলেন ! পরমুহূর্তেই ফেসবুকে বিভিন্ন সাহিত্যিক বন্ধু ও অন লাইন পত্রিকায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ আসতে থাকায় নিশ্চিত হলাম কামারুজ্জামান ভাই মারা গেছেন।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় ‘কথা’র নামের কথা সাহিত্যের ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই লেখালেখির সূত্রে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা। আর সেই থেকেই তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি আমাকে নিয়মিত ‘ কথা’ পাঠাতে থাকেন। তিনি ২০০৫ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি তার প্রথম গল্প সংকলন ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’ আমাকে পাঠিয়ে একটা রিভিউ করতে অনুরোধ করেন। পরবর্তীকালে তিনি আমাকে ‘স্বপ্নবাজি’ ও ‘ পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী’ ইত্যাদি গল্প ও উপন্যাসও পাঠান। পর্যায়ক্রমে তার গল্প ও উপন্যাসের উপর রিভিউ করি, যেগুলে বিভিন্ন সাহিত্যের কাগজে প্রকাশিত হয়।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৬৩ সালে মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার সরিষাপুর পৈত্রিক বাড়িতে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথম দিকের সময়টা অতিবাহিত হয়। স্কুল ও কলেজের পড়শোনা গ্রাম এবং গ্রামের পাশের শহরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একাডেমিক ডিগ্রি লাভ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে থেকে। তিনি একজন চিকিৎসক হয়েও বাংলা সাহিত্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন আপন ইচ্ছা ও আগ্রহে। নিজস্ব ঘরাণায় গল্প লেখার মাধ্যমে বাংলাসাহিত্য জগতে তার প্রথম পদচারণা। তিনি ব্যাতিক্রমী আঙ্গিকে গল্প লিখতে প্রয়াসী হন। তিনি ৬০ এর অধিক গল্প লিখেছেন। গল্প লিখতে গিয়ে তিনি গতানুগতিক ধারায় মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। গল্প নির্মাণে বিষয় বৈচিত্র , ভাষার কারুকার্য, কথ্যভাষার প্রয়োগ ও কাঠামোয় নবতর মাত্র দান করতে তিনি সচেষ্ট হন।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর খাঁটি গ্রামীণ পরিবেশ থেকে উঠে আসা একজন সার্থক সৃজনশীল কথা সাহিত্যিক। নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ , শিক্ষাদীক্ষার কথা তিনি শুনিয়েছেন ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় । ‘আমার জন্ম একবারে বিশুদ্ধ গ্রামে, অনেকটা ভাটি আর অনেকটা উজানের ভেতর, মানে এমন এক জায়গায় আমার জন্ম- গ্রামঘেষা শহর, একেবারেই গ্রাম। জন্ম আমার মামা বাড়িতে- শুধু আমি নয়, আমরা নয় ভাইবোনের জন্ম সেখানে। এটা কেন হলো। এ প্রশ্নে মা হাসেন, এখানেও আড়াল, মায়ের আড়াল। যৌথ পরিবারে নানান বঞ্চনার আড়াল।’ যৌথ পরিবারের দ্বন্দ্ব ও অহংকার দুটোই ছিল। কামরুজ্জামানের কৈশোর আর যৌবনের প্রারম্ভের শিক্ষাদীক্ষা গ্রামকে কেন্দ্র করেই আবর্তীত হয়েছে। সে সময়ের স্কুল ও কলেজ জীবন কেমন সাদামাটা ছিল তারই ছবি আমরা দেখতে পাই তার নিজের জবানীতে। ‘ আমি পড়াশোনা করেছি গ্রামের স্কুলে, নাম তার সরিষাপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল: হাই স্কুল হচ্ছে--- ক্লাস সিক্সে পড়েছি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরস্থ সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে: সেভেন থেকে এসএসসি পড়েছি বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার কলেজ ছিল বাজিতপুর ডিগ্রী কলেজে, মেডিক্যাল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে।’ গ্রাম থেকেই তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তাই তার গল্প উপন্যাসে গ্রামের মানুষের কথা নানা অনুষঙ্গে উঠে এসেছে। গ্রামের মানুষের সুখ - দু:খ, হাসি - আনন্দ, দ্বন্দ্ব - সংঘাতের চিত্র তিনি গল্পের পরতে পরতে তুলে ধরেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তার কৈশোরের গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম চিত্র তিনি তার গল্প উপন্যাসে তুলে ধরেছেন, যা তার সত্য কথনের পরিচয় বহন করে। সে সময়ের গ্রাম বাংলার যে চিত্র ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় তা নি:সন্দেহে গ্রাম বাংলার প্রতি ভালবাসারই পরিচায়ক। ‘আমার এখনও মনে আছে, ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ই নৌকা মার্কার মিছিল নিয়ে পাশের থানা নিকলি চলে গেয়েছিলাম, শেখ সাবের মিটিং বলে কথা! আমার হাটু পর্যন্ত লেগেছিল অজ¯্র ধুলাবালি। এখনও যেন সেই ধুলাবালির কড়ামিঠে গন্ধ পাই। কথাক্রমেই বলি, আমাদের সময় পায়ে জুতো, প্যান্ট ইত্যাদির প্রচলনও তেমন ছিল না। আহা মোর পদরেখা, সে তো ঢেকে দিতে থাকি, মানে রেগুলার জুতা-স্যান্ডেল পরি সেভেন-এইটে পাঠকালে।আমি তো প্যান্ট-বেল্ট ইত্যাদি ব্যবহার করি কলেজে যাওয়ার পর। আসলে গ্রামীণ জীবনই আমার সহজভাবে উপভোগ করতে পারতাম ।আমার তো মনে পড়ে না কোনদিন কোচিং বা প্রাইভেট পড়েছি!’
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীররের লেখালেখির সূত্রপাত স্কুল কলেজের জীবন থেকে তা তার লেখা থেকে জানা যায়--‘আমার সাহিত্যচর্চার প্রাথমিক ধারণাটা স্কুল- কলেজে খানিকটা ছিল, আমরা কলেজ ওয়াল ম্যাগাজিন বের করতাম। সেই ওয়াল ম্যাগাজিনে মেডিক্যাল কলেজেও ছিল।’
তার সাহিত্যকর্মের উপর আলোচনা করার আগে একজন চিকিৎসক হয়ে লেখালেখির জগতে পুরোপুরি ভাবে আসার ইতিবৃত্তটা তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি কীভাবে কথাসাহিত্যের জগতের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তা তার সম্পাদিত কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ ‘ কথা’ প্রকাশের প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন- ‘সময়টা আমরা আমাদের করতে চাইলাম, আমরা আমাদের সময়কে কথা দিয়ে ভরাট করতে চাইলাম- সেই সময় ২০০২ এর মাঝামাঝি তখন। তখনই কথা সাহিত্য নিয়ে একটা ছোটকাগজ করার কথা ভাবি আমরা। আমার যত দূর মনে পড়ছে আমি প্রথমেই মনোবাসনার কথা গল্পকার - কবি আহমেদ মুনিরকে জানাই। একে একে নির্মাণ সম্পাদক রেজাউল করিম সুমন আর উত্তরমেঘ সম্পাদক নাসিরুল ইসলাম জুয়েলকে বলি। একবারেই প্রাথমিকভাবে কার্যত আমরা চারজনই এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা চালাচালি করি। পরিকল্পনা গড়ি, ফের তা আমরাই লন্ডভন্ড করি । আবার নানান ভাবে একে সাজানোর বায়না ধরি! এক পর্যায়ে এর সাথে অনুবাদক- সাহিত্যিক জি, এইচ. হাবীবকে আমাদের সঙ্গী হিসাবে পাই । চট্টগ্রামস্থ ফুলকি, বৌদ্ধমন্দিরের পাশের লাকি হোটেল, ডিসি হিল, আমার বাসায় অনেক কথা হয়, অনেক পরিকল্পনা চলতে থাকে গল্পকার হুমায়ূন মালিক, মোহাম্মদ শামছুজ্জামান, জাহেদ মোতালেবও এক সময় তাতে যুক্ত হন। আমার মনে পড়ছে, ছোটকাগজটির নামকরণ ঠিক করতেই আমরা ম্যালা কথাবার্তা চালাই। কারণ আর ঠিক করতেই পারছিলাম না। গল্পকথা,গল্পসমূহ, কথকতা, কথা, এবং গল্প, শাহেরজাদা ইত্যাদির পর অনেকটা হুট করে আমরা কথাকেই স্থির হই।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী গ্রামীণ মানুষের জীবনে যে সব ভোগান্তিকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন সেই সব অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি তার ছোটগল্পগুলো লেখেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, ওই সময়ের তার নিজের দেখাশোনার কথা আমরা জানতে পারি ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় থেকে। ‘ যুদ্ধের গল্পে আসি । তখন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মিজু মামা ছিলেন আমাদের সার্বিক গাইড। সেই মামা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একবারে ষড়যন্ত্রের শিকারে পড়ে একাত্তরের একেবারের শেষ দিকে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা দেখলাম আরেক যুদ্ধ। মানুষ বিজয়ে চারপাশ কাঁপছে, আমরা স্বজন হারানোর শোকে, বিচার- প্রার্থনায় সদাকাতর। আবারও দেখলাম, যুদ্ধ যে শেষ হবার নয়! সশস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির প্রতি নেশা জাগল। মানুষ সমানে এই রাজনীতির প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছে। আমার আপন ভাই সাম্যবাদী দলের সঙ্গে সংশিষ্টতায় জেলে যেতে বাধ্য হলেন।’ এ সব রক্তাক্ত অধ্যায়ের কামরুজ্জামানের কিশোর মনে যে দাগ কাটে তার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই অনেক গল্পে। ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় একথা এ ভাবে উল্লেখ করেছেন,‘ফলত রক্ত, যুদ্ধ আর মৃতের রক্তাক্ত চিৎকার আমার কথাশিল্পে বার বার আসে।’ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর হত্যা, আন্দোলন, সামরিক শাসন , সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্র ইত্যাদি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেও এ সবের ভেতরে মানুষের জাগরণের স্বপ্নকেও প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। তিনি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা, চিন্তা চেতনা , মেধা মননের মাধ্যমে যে গল্পসংকলন ,উপন্যাস ও প্রবন্ধসংকলনগুলো রচনা করেন তা হলো: ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (২০০৫) ’‘ স্বপ্নবাজি ’, ‘পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ( ২০০৬)’ ,‘কতিপয় নি¤œবর্গীয় গল্প(২০১১)’, ‘ভালবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয়’(২০১৪)‘জয়বাংলা ও অন্যান্য গল্প’ ‘কমলনামা(২০১৫)’ ও ’ দেশবাড়ি শাহবাগ’, ‘কথার কথা’ (১০টি সাক্ষাৎকার), ‘যখন তারা যুদ্ধে’, ‘উপন্যাস বিনির্মাণ’, ‘উপন্যাসের জাদু’, ‘গল্পের গল্প’, ‘কথা শিল্পের জল- হাওয়া’ ইত্যাদি ।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের প্রথম গল্প সংকলন ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’ এ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর পর্বের অজ¯্র মৃত্যু, রক্ত ঝরা বেদনাদীর্ণ গল্পের প্রতি আমরা দৃষ্টিপাত করতে পারি। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের লেখা ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’ গল্পসংকলনের ১২টি গল্প পড়লে সহজেই উপলব্ধি করা যায় তিনি গল্পের ভাষায় জাদুময়তা আর সাঙ্কতিক বিন্যাসে নবতরমাত্রা দানে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি চরম সাহসিকতার সাথে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের আচরণের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যার মধ্যে ন্যায় অন্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিনির্মাণ আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। তিনি এ গল্প সংকলনে ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’, ‘শিস দেয় রাস্তাটি’, ‘সর্পকাল’, ‘এখানে চিহ্ন সংগ্রহ করা হয়’, ‘ মৃত্যু জনিত শোকপ্রণালী ’, ‘জল যখন লাল বর্ণ নেয়’, ‘যুদ্ধলগন’, ‘আসুন বাড়িটি লক্ষ করি’, ‘হারুনকে নিয়ে একদা এক গল্প তৈরি হয়’, ‘অচিন রোসনাই’, ‘ যেভাবে তিনি খুন হতে থাকেন ,’‘ এ তবে ছায়ার গল্প’, গল্পগুলোতে আমাদের সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মানুষের ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেছেন গল্পের নানা ঘটনার মাধ্যমে।
‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’ এর গল্পসংকলন থেকে দুটো গল্পের উপর সংক্ষেপে আলোচন করলে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গল্প লেখার ধারা সম্বন্ধে আমাদের মনে ধারণা জন্মাবে। এ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’। গল্পকার বিশেষ অনুষঙ্গে গল্প বলেছেন । এ গল্পে মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বের ঘটনা প্রবাহকে উপস্থাপনা করেছেন বিশেষ ঘরাণায়,যার মধ্যে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের ইতিহাস গল্পের আকারে বিধৃত হয়েছে। মায়ের অনুরোধে যুবকটি তার বাবার বন্ধু বড়–য়া কাকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মিউজিয়ামটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় সন্ধ্যার একটু আগে। শহরের অভিজাত ক্লাবটি পেরোনোর পরই সাতরাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ডটি তার চোখে পড়ে। সে দেখতে পায় সাইনবোর্ডটি থেকে অনবরত রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে! এ রক্তপাতে সে ভিজে যায়। সে রিক্সা থেকে নেমে ভয়তাড়িত মনে তীর চিহ্নিত পথে এগিয়ে যেতে থাকলে তার চোখে পড়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে থাকা আর একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটিতে লেখা-- মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম । সে এগিয়ে গিয়ে মিউজিয়ামে প্রবেশের টিকিট কাটে। সে টিকিট কালেক্টরের হাতের দগদগে দুর্গন্ধময় হাত এবং দগদগে ঘায়ের মতো ছাপ মারা টিকিটটি দেখে অবাক হয়। সে মুখোমুখি হয় টিকিট চেকার, গেইটম্যান, সিকিউরিটি অফিসারের। সে সিকিউরিটি অফিসারকে তার মায়ের পরিচয়পত্রটি দেখালে তিনি তা না দেখে পাশে সরিয়ে রেখে বলেন,‘ --ওই হলো আর - কী, আপনি এখনই বলা শুরু করবেন, যখন আপনি মায়ের পেটে সাতমাসের ভ্রণ, তখনই আপনার বাবা বিলোনিয়া বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধে চলে গেল। এই তো?’ যুবকটি দেখতে পায় সাততলা মিউজিয়ামটি রক্ত-রঙের ওমে সারা শরীর ডুবিয়ে আছে। সে বড়–য়া কাকাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে মাকে বলে যে বড়–য়া কাকাকে কোনদিনই ওখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এ কথা তার বিশ্বাস করতে চায় না। সে তার যুবক ছেলেটিকে বলে চলে কীভাবে তার বাবা যুদ্ধ করতে করতে পাকআর্মিদের হাতে তার বাবা সহ চারজন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ে টচারিং ক্যাম্পে নির্যাতনের মধ্যে আছেন। যুবকটির বড়–য়া কাকা বিহারি বাবুর্চির কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছিল যে ১০৫ নম্বর রুমে তাদের বেয়াদবির বিচার হচ্ছে । সে মাকে কথা দেয় যে বাবার টর্চারের জায়গা সে খুঁজে বের করবে।
যুবকটি পরদিন মিউজিয়ামটিতে পৌঁছে সরাসরি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সে নিচতলা থেকে রক্তের ঘ্রাণ পেতে শুরু করে। সে সিড়িতে রক্তের দাগ দেখতে পায়। অভ্যর্থনা কক্ষের লোকটি যুবকটিকে বলে, ‘ একবারের প্রথম দিকে ইনচার্জ সাহেব ভাবতেন--- শুধু রক্ত দিয়ে মিউজিয়ামটি সাজাবেন কী করে? কিন্তু কিছু মানুষ যেন টাটকা রক্ত ম্যানেজ করার জন্য তৈরি হয়েই ছিল।’
যুবকটিকে নিয়ে ডিসপ্লে অফিসার ইনচার্জ সাহেবের চেম্বারে ঢোকেন। যুবকটি দেখতে পায় ইনচার্জ সাহেব গদিওয়ালা চেয়ারের সুদৃশ্য তোয়ালের উপর দিয়ে দুটি হাত পিছনে দিয়ে একহাতের আঙুল দিয়ে অন্যহাত পেঁচিয়ে ধরে রেখেছেন । এক সময় ইনচার্জ অফিসার জেগে ওঠে গমগমে আওয়াজে কথা বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই যুবকটিকে সাথে নিয়ে পূবদিকে হাঁটতে থাকেন। সামনেই পড়ে লাইব্রেরী, যার বেশির ভাগ অংশ এখন স্যুয়েরেজের মোটাসোটা লাইন হয়ে চলে গেছে নদীর দিকে। চলমান রক্ত দিয়ে শুধু নদী --নালা নয়, আকাশও রাঙানো যায়। এ গল্পের শেষাংশটুকু লেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃত করলে বোদ্ধা পাঠক গল্পটিকে মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে পারবেন বলে মনে করি। ‘ দুজন আবারও হাঁটেন ১০১,১০২, ১০৩, ১০৪, রুম পেরিয়ে ১০৫ নাম্বারের সামনে থামলেই বড়ো একটা চিৎকার যুবকটি শুনতে পায়। আশপাশে শুধু নয় চারদিকে তাকালেও শব্ধটির উৎপত্তিস্থল ঠাহর করতে পারে না। কাউকে কি কুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে কেউ!!! সেই চিৎকারটি এক সময় তামাটে রোদের মতো সর্বাাঙ্গে ঝাপ্টা মারে। রক্তের ফোয়ারার ভিতর যুবকটি এক সময় একেবারে জব্দ হয়ে যায়।’
‘ যুদ্ধ লগন’ এ গল্পসংকলনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু ’মাস পরে সোহানপুরের শিপন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে আখাউড়া বর্ডার ক্রস করে আগরতলা চলে যায়। অন্যদিকের তাদের সোহানপুরের কায়েছালী নিজে রাজাকারের খাতায় নাম লেখায় এবং সোহনপুরের যুব সমাজকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে আহ্বান করে।কায়েছালী খাকি ড্রেস পরে কাঁধে চাইনিজ রাইফেল ঝুলিয়ে সহযোগীদের নিয়ে সোহনপুরের সুর্মা আক্তারদের বাড়িতে আসে , শিপনের সাথে সুর্মা আক্তারের ভালবাসার সম্পর্কের কথা কায়েছালী জেনেই সে শিপনের বাড়ি যাবার আগে সুর্মা আক্তারদের বাড়িতে এসে তার মাকে বলে ‘--কিয়ো চাচী, জামাইরে যুদ্ধে পাডাইলানি? সুর্মা আক্তারের মা ঘোমটার আড়ালে নিজেকে সঁপে রেখেই বলতে থাকে- পুলিশ বেডা ইতা কী ক! নিজের বইনরে বুঝি কলঙ্কিনি করতো চাও!’ সুর্মা আক্তারের মায়ের কথায় কায়েছালী খুশি হয়ে সিগারেটে জোরে জোরে টান দিয়ে সে নিজেই বারান্দায় রাখা হাতলওয়ালা চেয়ারটাতে বসে সুর্মা আক্তার কোথায় জানতে চেয়ে তাকে পান বানিয়ে আনতে বলে তার মায়ের কাছে। ‘- সে তো ঘরে নাই গো বাজান। - নিহি! কই গেল?- কমনে কই? খালের পড়োনি গেল?’ কায়েছালী সুমা আক্তারের মাকে বলে ‘ - হেরে জানাইয়া দিয়ো, মাঙ্গের জয় বাংলার বেপর্দা চলাচলতি আমার বালা লাগে না।’ সে আদেশ দেওয়ার সুরে বলে ‘- শিপুইন্যে নডির পুত বাচতে চাইলে ক্যাপ্টিন ছারের অমহে হাজিরা দিতে কইবা। মার্ত দুই কান দিন টাইম দিলাম।’
কায়েছালীর তিন সহযোগী বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে বলে সে পুরুষবিহীন বাড়ির পশ্চিম ঘরের বারান্দায় আবার এসে বসে। সুর্মা আক্তারের মা পানের বাটিতে দুই খিলি পান দিতে এলে কায়েছালীর মধ্যে লালসা জেগে উঠে। সুর্মা আক্তারকে নিরালা পেয়ে কায়েছালী উত্তেজিত হয়ে কী কাজ করে তার বর্ণনা গল্পকার এভাবে তুলে ধরেছেন ‘- সুর্মা আক্তারের মায়ের পাকনা কলার মতন চামড়ায় আবৃত হাতের দিকে নজর পড়ে কায়েছালীর। মন-মনুরায় অস্থিরতা জাগ্রত হতে থাকে। --- এ মুহূর্তে ক্যাপ্টেন স্যারের অতি স্বাধীন তেষ্টা তার শরীরেও ভর করে। প্যান্টের ভিতরে পড়ে থাকা শিশ্মটিকে যথারীতি স্বাধীন করে দেয়। তখন হঠাৎই সুর্মা আক্তারদের ঘরে ঢুকে পড়ে কায়েছালী, সুর্মা আক্তারের মা আঁতকে উঠার টাইমও পায় না। তাকে জাপটে ধরে কায়েছালী।--- ঝাপটে -কামড়ে -লেপ্টে সুর্মা আক্তারের মাকে একাকার করতে থাকে। কায়েছালীর শক্ত শরীরের নিচে তার জমানো শক্তি ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে। ’
প্রতিদিনের মতন সেদিনও সোহনপুরের জলখেলি নদী দিয়ে মাত্র দেড়মাইল দূরের সরারচর হাইস্কুলের মিলিটারিদের ক্যাম্প থেকে লাশ ভেসে আসে। মইদুল মেম্বারের মেয়ে সুর্মা আক্তার জলখেলি নদীর পানিতে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা লাশ দেখে চিৎকার দিয়ে বলে,‘ দেহো গো আম্মা, এইডা মনে অই শিপুইন্যে ভাইজানের লাশই। আল্লা গো, পেটটাদি ঢুলডার লাহান ফুইল্ল গেছিগে।’ শিপনের লাশ জলখেলিতে ভাসতে দেখে সুর্মা আক্তারের কান্না থামে না।
যেদিন শিপনের লাশটি জলখেলি নদীতে ভেসে উঠে তার সাতদিন আগে শিপনকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আগরতলা থেকে সোহানপুরে আসে এবং গোপনে হাদী প্রধানের ক্যাম্প করে।।তারা জয়নাল গাজীর বাড়ির পাশের ছোট রাজাকার ক্যাম্প থেকে দুটো চাইনীজ রাইফেল , একটা বন্ধুক ও চারটা কিরিচ দখল করে। মান্দারকান্দি ব্রিজের সেন্টিবক্স দখল করতে শিপনের সন্দেহ হয় কেন সেন্টিবক্সটা শূন্য। কোন কিছু ভাববার আগেই সোহানপুরের মাটি গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে। চারদিক থেকে আক্রমণের হাদী প্রধানের বাড়ির গোপন ক্যাম্পটা পাঞ্জাবীদের দখলে চলে যায়। নয়জনের দলটার পাঁচজন জায়গাতেই মারা যায়, দু’জন পালিয়ে যায় আর গুলি খেয়ে মিলিটারীদের হাতে ধরা পড়ে আর দ’ুজন। রাতের অন্ধকারে নদী থেকে শিপনের লাশ তুলে জঙ্গলের মধ্যে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার পর কায়েছালী কিছুদিন গা ডাকা দিয়ে থাকার পর মাতব্বরদের ম্যানেজ করে নিজ গ্রামে আবার পাকাপোক্ত ভাবে আসন গাড়ে।
এই গল্প সংকলনের অন্যান্য গল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকাল পর্বের অস্থিরতা, সামরিক শাসন, ধর্মীয় নির্মমতা, এনজিও’র মহাজনী ক্রিয়াকলাপের নানা অনুষঙ্গ তিনি এই সংকলনের গল্পগুলোতে তুলে ধরেছেন। তিনি তার গল্প গুলোতে পরিবার, সমাজ ভাঙার কথা উপস্থাপন করেছেন। এক কথায় বলতে হয় তিনি গল্প লেখার প্রথাসিদ্ধ রীতির গন্ডি পেরিয়ে নবতর মাত্রা দান করেছেন । কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর আমাদের সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের যাপিত জীপনের গল্প গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন ‘কতিপয় নি¤œবর্গীয় গল্প’ সংকলনটিতে, যা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত।
‘ পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ’ সমাজের অপাঙতেয় দেহজীবীদের নিয়ে লেখা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের বাস্তবধর্মী উপন্যাস। প্রগতিশীলতার বাস্তবধর্মী দলিল তার উপন্যাস পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী। তিনি সমকালের অতি বাস্তব চরিত্র, অনুষঙ্গ ও ঘটনা প্রবাহকে চিত্রিত করতে কতটা সাবলীল ভাবে তার জলন্ত দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে কতটা সাহসী তার নজির এই উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ঔপন্যাসিকরা সমাজের অন্তজ শ্রেণীর কিংবা নি¤œবর্গের মানুষের সমাজ সংসার, পরিবারপরিজনদের নিয়ে রচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ , সতীনাথ ভাদুড়ী, মহাশ্বেতা দেবীর কথা বলা যায়। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর লেখা পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসে পদ্মানদীর পাড়ে একদল দেহজীবী নারীর গল্প পূণাঙ্গরূপে উঠে আসার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি তার প্রথম প্রয়াসে বাংলা উপন্যাসে সাহিত্যে পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী’র মতো একটি ক্লাসিকধর্মী উপন্যাস রচনা করে একজন নবীন লেখক হিসাবে বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে সমর্থ হন। কান্দুরি মাসি এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। লেখক জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গে পতিতালয়ের মেয়েগুলোর যন্ত্রণার কথা সরাসরি উপস্থাপন করেছেন। এ উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য পদ্মা নদী গোয়ালনন্দ এবং মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও রংপুর সহ নানা এলাকার পটভূমিকায় ওই ভাষা আর নানা অনুষঙ্গকে লেখক তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন। বাংলা উপন্যাস ও গল্পে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তার অন্যান্য গল্পে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন সাবলীল ভঙ্গিতে। তিািন এই উপন্যাসে এই প্রয়াসকে বলবত রাখায় তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় লেখক বাস্তবধর্মী সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমরা দেখার চেষ্টা করবো তার সৃজনশীলতার সাহসী বিনির্মাণের প্রতি। দেহজীবী মহিলাদের কেন্দ্র করে এ উপন্যাস আবর্তীত। এ উপন্যাসে এমন সব মহিলাদের গল্প উঠে এসেছে যারা নিজেদের দেহ বিক্রি করে দিনাতিপাত করে। লেখকের লেখক থেকে উপলব্ধি করা যায়, একজনের মধ্যে বহুজনের গল্প। সেই একজন হতে পারে বহুজন তার মানে সেই একজন হতে পারে হয় মুক্তি, না হয় শরীফা কিংবা চামেলী, আয়েশা, জরিনা না হয় ওদেরই ভেতর থেকে যে -কেউ। ওরা একজনই বহুজন, বহুজনই একজন। এদের যেমন আলাদা করে চেনা মুশকিল, তেমনি মানুষও বলতে গেলে একজনই। এমনই ঘরের দরজা, শরীর বা প্রতীক্ষা দিয়ে এক এক গল্প তৈরি করে। অথবা একটা গল্পকেই বহুজন মিলিয়ে একজন হওযার বেতরে সময় পার করতে থাকে। এদের তবু মানুষ বলে চিহ্নিত করতে হয়, আর মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই থেকে যায়। ওরা নিজেদের কিছু কথা, কিন্তু যন্ত্রণা না হয় হাহাকারের কথাই বলে যায়। লেখক চরিত্রকে বড় করে না দেখিয়ে মানুষকেই বড় করে দেখিয়েছেন। মানুষের যাপিত জীবনে বাস্তবতার চেয়ে বড় কিছু আছে বলে লেখক মনে করেননি। এর ফলশ্রুতিতে তিনি দেহজীবীদের নিয়েই উপন্যাস লিখতে সাহসী হয়েছেন। সময় নিরন্তর বয়ে গেলেও সময়ের পালা বদল হয়। সময়ের দিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে জনপদের মানুষের অবয়বেও পরিবর্তন যথানিয়মে ঘটে। স্থান , কাল, জনপদের মানুষের পালা বদলের সঙ্গে সব কিছু বদলায়। একজন দক্ষ লেখকের চোখে সর্বক্ষেত্রে পালা বদলের ছবি অবশ্রই ধরা পড়ে। তিনি সমাজের সেই পালাবদলকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করে নির্মাণ করেছেন তার এ উপন্যাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাষাও বদলায়। লেখক উপন্যাসে মানুষের ভাষা বদলের ছবি উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে। স্লাং বা সভ্যভব্য ভাষার সীমারেখা ভেঙে গেছে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই। লোকায়ত ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যপ্রবাহে তা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, আর তাতে জীবনের শক্তি এক এক ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। পদ্মাপাড়ের ওই দেহজীবী মানবীদের জীবনে কতিপয় সম্ভাবনা অথবা যন্ত্রণার ছবি আছে তার এ ইপন্যাসে। অনাদি অতীত থেকে দেশে দেশে একদল মানবী সমাজ সংসারের নিষ্পেষণে এ পেশাটাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে, যার নিবৃত্তি আজও ঘটেনি আমাদের পোড় খাওয়া সমাজ ব্যবস্থা থেকে। ওইসব দেহজীবী নারীদের আশা আকাঙ্খা, প্রেম ভালোবাসা আছে তার জ্বলন্ত দলির নির্মাণ করেছেন লেখক । নি:সন্দেহে লেখকের এটি একটি বড় ধরনের সাফল্য।
নদীকে ঘিরে আবর্তীত এ সব দেহজীবীর জীবন নদীর সঙ্গে তাদের জীবনের এক অভিনব প্রতিযোগিতা লক্ষ করবেন। দেহজীবী মানবীদের সঙ্গে যেসব পুরুষদের সম্পৃক্ততা তাদের নিষ্ঠরতা , খলতা আছে, আছে প্রেম ভালোবাসার অনুষঙ্গও। পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসের নামকরণেরই আছে দ্বিমাত্রা জীবন প্রবাহের নিরন্তর বহমানতা। পতিতাবৃত্তি মূলত নিষিদ্ধ। তবে একদল নারী এ বৃত্তিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তা লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। লেখক এ উপন্যাসে দেখানোর চেষ্ট করেছেন সমাজ আর কালের প্রেক্ষাপটে আজ পতিতাদের যৌনকর্মী হিসাবে আখ্যায়িত করা হলেও তারা কি সমাজে যথাযথ স্থান পেয়েছে? হ্যাঁ, ‘ পদ্মা’ সহসায় ভাঙে আর গড়ে , তার সঙ্গে ‘দ্রৌপদীর’র যোগসূত্রও জীবন প্রবাহের ভাঙা আর গড়ার যোগসূত্র। উপন্যাসটিতে বিধৃত হয়েছে দেহজীবী মানবীর জীবন শক্তি,কষ্ট ,স্মৃতি, ব্যথা - বেদনা, আর তার ভেতর আনন্দ, যার নিজের দেহ বিক্রি করে তারাও জীবনও বহন করে। তাদের পঙ্কিল জীবনের মাঝা হাসি- কান্না , সুখ- দু:খ, রাগ- অনুরাগসহ মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তির নানা অনুষঙ্গ। এ জন্যেই এদের মানুষ বলে চিহ্নিত করা হয়, আর মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই থাকে সে কথাটাই লেখক পদ্মাপাড়ের পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন। একথা নি:সন্দেহে বলা যায় এই ঔপন্যাসিক পদ্মপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন।
বাংলাসাহিত্যের গল্প উপন্যাসের নতুন ধারার অন্যতম পথিকৃত কমলকুমার মজুমদারে সাহিত্যকর্মের প্রতি কামারুজ্জামান বিশেষ ভাবে অনুরক্ত ছিলেন। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘কথা’র শেষ সংখ্যাটি কমলকুমার মজুমদারের উপর করেছিলেন তাঁর জন্মশতবর্ষ ২০১৪ সালে পড়ায় । ১৩ জুন -২০১৪ তারিখে চেরাগি পাহাড়ের ‘খড়িমাটি’ আয়োজিত বাংলাসাহিত্যের নতুন ধারার অন্যতম পথিকৃত কমলকুমার মজুমদারে জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর আলোচক হিসাবে যে বক্তব্য দেন তার একটা অংশ ছিল এমন ‘-কমলকুমার তো কোনো সোজাসাপ্টা লেখক বা মানুষ নন। তার তো সমাজ ছিল, মানুষের সঙ্গে পরিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সংস্কার যেমন ছিল তার ছিল তুমুল ভালবাসা। মানুষের প্রতিই তার পক্ষপাত আর ভালোবাসা।’
মানুষ হিসাবে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর বড় মনের মানুষ ও সত্যপথের পথিক ছিলেন। নির্দ্ধিধায় বলা যায়, প্রতিশ্রুতিশীল এ কথাসাহিত্যিকের অকাল প্রয়াণে বাংলাসাহিত্যের বড়ই ক্ষতি হলো। তবুও বলতে হয় তার অমর সৃষ্টিগুলোই তাকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে চিরভাস্বর করে রাখবে। পরিশেষে, তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
প্রত্যেকেরই জীবন প্রদীপ এক সময় নিভে যায়, কিন্তু তা যদি অসময়ে নিভে যায় তবে তা বড়ই দু:খ ও বেদনার । বাংলা সাহিত্যের প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর ( ১৯৬৩- ২০১৫) এর জীবন প্রদীপ অসময়ে নিভে যাওয়াটা বড়ই হৃদয় বিদারক।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর চাকরি সূত্রে চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের চট্টগ্রামের বিভাগীয় চিকিৎসা কর্মকর্তা ( চলতি দায়িত্ব) হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ৭ মার্চ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে চট্টগ্রাম ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে কুমিল্লা স্টেশনে তাকে নামানো হয়। দ্রুত ভর্তি করা হয় কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ওই দিন দুপুরে তিনি হাসপাতালে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন।
মর্মান্তিক খবরটা ৭ মার্চ বিকাল ৩টার দিকে ফেসবুকের স্ট্যাটাসে প্রথম দেখে হতবাক হয়ে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সুস্থসবল একজন চিকিৎসক মানুষ , একদিন আগেও তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে, হঠাৎ কীভাবে মারা গেলেন ! পরমুহূর্তেই ফেসবুকে বিভিন্ন সাহিত্যিক বন্ধু ও অন লাইন পত্রিকায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ আসতে থাকায় নিশ্চিত হলাম কামারুজ্জামান ভাই মারা গেছেন।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সম্পাদনায় ‘কথা’র নামের কথা সাহিত্যের ছোটকাগজ প্রকাশিত হয়। সে সময় থেকেই লেখালেখির সূত্রে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা। আর সেই থেকেই তার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তিনি আমাকে নিয়মিত ‘ কথা’ পাঠাতে থাকেন। তিনি ২০০৫ সালের জুলাইয়ের মাঝামাঝি তার প্রথম গল্প সংকলন ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’ আমাকে পাঠিয়ে একটা রিভিউ করতে অনুরোধ করেন। পরবর্তীকালে তিনি আমাকে ‘স্বপ্নবাজি’ ও ‘ পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী’ ইত্যাদি গল্প ও উপন্যাসও পাঠান। পর্যায়ক্রমে তার গল্প ও উপন্যাসের উপর রিভিউ করি, যেগুলে বিভিন্ন সাহিত্যের কাগজে প্রকাশিত হয়।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৬৩ সালে মামাবাড়িতে। কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার সরিষাপুর পৈত্রিক বাড়িতে তার শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথম দিকের সময়টা অতিবাহিত হয়। স্কুল ও কলেজের পড়শোনা গ্রাম এবং গ্রামের পাশের শহরে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে একাডেমিক ডিগ্রি লাভ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে থেকে। তিনি একজন চিকিৎসক হয়েও বাংলা সাহিত্যে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন আপন ইচ্ছা ও আগ্রহে। নিজস্ব ঘরাণায় গল্প লেখার মাধ্যমে বাংলাসাহিত্য জগতে তার প্রথম পদচারণা। তিনি ব্যাতিক্রমী আঙ্গিকে গল্প লিখতে প্রয়াসী হন। তিনি ৬০ এর অধিক গল্প লিখেছেন। গল্প লিখতে গিয়ে তিনি গতানুগতিক ধারায় মধ্যে আবদ্ধ থাকেননি। গল্প নির্মাণে বিষয় বৈচিত্র , ভাষার কারুকার্য, কথ্যভাষার প্রয়োগ ও কাঠামোয় নবতর মাত্র দান করতে তিনি সচেষ্ট হন।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর খাঁটি গ্রামীণ পরিবেশ থেকে উঠে আসা একজন সার্থক সৃজনশীল কথা সাহিত্যিক। নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ , শিক্ষাদীক্ষার কথা তিনি শুনিয়েছেন ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় । ‘আমার জন্ম একবারে বিশুদ্ধ গ্রামে, অনেকটা ভাটি আর অনেকটা উজানের ভেতর, মানে এমন এক জায়গায় আমার জন্ম- গ্রামঘেষা শহর, একেবারেই গ্রাম। জন্ম আমার মামা বাড়িতে- শুধু আমি নয়, আমরা নয় ভাইবোনের জন্ম সেখানে। এটা কেন হলো। এ প্রশ্নে মা হাসেন, এখানেও আড়াল, মায়ের আড়াল। যৌথ পরিবারে নানান বঞ্চনার আড়াল।’ যৌথ পরিবারের দ্বন্দ্ব ও অহংকার দুটোই ছিল। কামরুজ্জামানের কৈশোর আর যৌবনের প্রারম্ভের শিক্ষাদীক্ষা গ্রামকে কেন্দ্র করেই আবর্তীত হয়েছে। সে সময়ের স্কুল ও কলেজ জীবন কেমন সাদামাটা ছিল তারই ছবি আমরা দেখতে পাই তার নিজের জবানীতে। ‘ আমি পড়াশোনা করেছি গ্রামের স্কুলে, নাম তার সরিষাপুর ফ্রি প্রাইমারী স্কুল: হাই স্কুল হচ্ছে--- ক্লাস সিক্সে পড়েছি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরস্থ সরারচর শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ে: সেভেন থেকে এসএসসি পড়েছি বাজিতপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার কলেজ ছিল বাজিতপুর ডিগ্রী কলেজে, মেডিক্যাল চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে।’ গ্রাম থেকেই তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তাই তার গল্প উপন্যাসে গ্রামের মানুষের কথা নানা অনুষঙ্গে উঠে এসেছে। গ্রামের মানুষের সুখ - দু:খ, হাসি - আনন্দ, দ্বন্দ্ব - সংঘাতের চিত্র তিনি গল্পের পরতে পরতে তুলে ধরেছেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। তার কৈশোরের গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম চিত্র তিনি তার গল্প উপন্যাসে তুলে ধরেছেন, যা তার সত্য কথনের পরিচয় বহন করে। সে সময়ের গ্রাম বাংলার যে চিত্র ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় তা নি:সন্দেহে গ্রাম বাংলার প্রতি ভালবাসারই পরিচায়ক। ‘আমার এখনও মনে আছে, ক্লাস ফোরে পড়ার সময়ই নৌকা মার্কার মিছিল নিয়ে পাশের থানা নিকলি চলে গেয়েছিলাম, শেখ সাবের মিটিং বলে কথা! আমার হাটু পর্যন্ত লেগেছিল অজ¯্র ধুলাবালি। এখনও যেন সেই ধুলাবালির কড়ামিঠে গন্ধ পাই। কথাক্রমেই বলি, আমাদের সময় পায়ে জুতো, প্যান্ট ইত্যাদির প্রচলনও তেমন ছিল না। আহা মোর পদরেখা, সে তো ঢেকে দিতে থাকি, মানে রেগুলার জুতা-স্যান্ডেল পরি সেভেন-এইটে পাঠকালে।আমি তো প্যান্ট-বেল্ট ইত্যাদি ব্যবহার করি কলেজে যাওয়ার পর। আসলে গ্রামীণ জীবনই আমার সহজভাবে উপভোগ করতে পারতাম ।আমার তো মনে পড়ে না কোনদিন কোচিং বা প্রাইভেট পড়েছি!’
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীররের লেখালেখির সূত্রপাত স্কুল কলেজের জীবন থেকে তা তার লেখা থেকে জানা যায়--‘আমার সাহিত্যচর্চার প্রাথমিক ধারণাটা স্কুল- কলেজে খানিকটা ছিল, আমরা কলেজ ওয়াল ম্যাগাজিন বের করতাম। সেই ওয়াল ম্যাগাজিনে মেডিক্যাল কলেজেও ছিল।’
তার সাহিত্যকর্মের উপর আলোচনা করার আগে একজন চিকিৎসক হয়ে লেখালেখির জগতে পুরোপুরি ভাবে আসার ইতিবৃত্তটা তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি কীভাবে কথাসাহিত্যের জগতের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন তা তার সম্পাদিত কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ ‘ কথা’ প্রকাশের প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন- ‘সময়টা আমরা আমাদের করতে চাইলাম, আমরা আমাদের সময়কে কথা দিয়ে ভরাট করতে চাইলাম- সেই সময় ২০০২ এর মাঝামাঝি তখন। তখনই কথা সাহিত্য নিয়ে একটা ছোটকাগজ করার কথা ভাবি আমরা। আমার যত দূর মনে পড়ছে আমি প্রথমেই মনোবাসনার কথা গল্পকার - কবি আহমেদ মুনিরকে জানাই। একে একে নির্মাণ সম্পাদক রেজাউল করিম সুমন আর উত্তরমেঘ সম্পাদক নাসিরুল ইসলাম জুয়েলকে বলি। একবারেই প্রাথমিকভাবে কার্যত আমরা চারজনই এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা চালাচালি করি। পরিকল্পনা গড়ি, ফের তা আমরাই লন্ডভন্ড করি । আবার নানান ভাবে একে সাজানোর বায়না ধরি! এক পর্যায়ে এর সাথে অনুবাদক- সাহিত্যিক জি, এইচ. হাবীবকে আমাদের সঙ্গী হিসাবে পাই । চট্টগ্রামস্থ ফুলকি, বৌদ্ধমন্দিরের পাশের লাকি হোটেল, ডিসি হিল, আমার বাসায় অনেক কথা হয়, অনেক পরিকল্পনা চলতে থাকে গল্পকার হুমায়ূন মালিক, মোহাম্মদ শামছুজ্জামান, জাহেদ মোতালেবও এক সময় তাতে যুক্ত হন। আমার মনে পড়ছে, ছোটকাগজটির নামকরণ ঠিক করতেই আমরা ম্যালা কথাবার্তা চালাই। কারণ আর ঠিক করতেই পারছিলাম না। গল্পকথা,গল্পসমূহ, কথকতা, কথা, এবং গল্প, শাহেরজাদা ইত্যাদির পর অনেকটা হুট করে আমরা কথাকেই স্থির হই।’
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী গ্রামীণ মানুষের জীবনে যে সব ভোগান্তিকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন সেই সব অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি তার ছোটগল্পগুলো লেখেন। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, ওই সময়ের তার নিজের দেখাশোনার কথা আমরা জানতে পারি ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় থেকে। ‘ যুদ্ধের গল্পে আসি । তখন স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা মিজু মামা ছিলেন আমাদের সার্বিক গাইড। সেই মামা মুক্তিযোদ্ধা হয়ে একবারে ষড়যন্ত্রের শিকারে পড়ে একাত্তরের একেবারের শেষ দিকে মারা যান। মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা দেখলাম আরেক যুদ্ধ। মানুষ বিজয়ে চারপাশ কাঁপছে, আমরা স্বজন হারানোর শোকে, বিচার- প্রার্থনায় সদাকাতর। আবারও দেখলাম, যুদ্ধ যে শেষ হবার নয়! সশস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির প্রতি নেশা জাগল। মানুষ সমানে এই রাজনীতির প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেছে। আমার আপন ভাই সাম্যবাদী দলের সঙ্গে সংশিষ্টতায় জেলে যেতে বাধ্য হলেন।’ এ সব রক্তাক্ত অধ্যায়ের কামরুজ্জামানের কিশোর মনে যে দাগ কাটে তার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই অনেক গল্পে। ‘নিজেকে নিজের মনে দেখা’ শীর্ষক স্মৃতিচারণায় একথা এ ভাবে উল্লেখ করেছেন,‘ফলত রক্ত, যুদ্ধ আর মৃতের রক্তাক্ত চিৎকার আমার কথাশিল্পে বার বার আসে।’ কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর হত্যা, আন্দোলন, সামরিক শাসন , সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্র ইত্যাদি কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেও এ সবের ভেতরে মানুষের জাগরণের স্বপ্নকেও প্রত্যক্ষ করতে সক্ষম হন। তিনি তার বাস্তব অভিজ্ঞতা, চিন্তা চেতনা , মেধা মননের মাধ্যমে যে গল্পসংকলন ,উপন্যাস ও প্রবন্ধসংকলনগুলো রচনা করেন তা হলো: ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম (২০০৫) ’‘ স্বপ্নবাজি ’, ‘পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ( ২০০৬)’ ,‘কতিপয় নি¤œবর্গীয় গল্প(২০১১)’, ‘ভালবাসা সনে আলাদা সত্য রচিত হয়’(২০১৪)‘জয়বাংলা ও অন্যান্য গল্প’ ‘কমলনামা(২০১৫)’ ও ’ দেশবাড়ি শাহবাগ’, ‘কথার কথা’ (১০টি সাক্ষাৎকার), ‘যখন তারা যুদ্ধে’, ‘উপন্যাস বিনির্মাণ’, ‘উপন্যাসের জাদু’, ‘গল্পের গল্প’, ‘কথা শিল্পের জল- হাওয়া’ ইত্যাদি ।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের প্রথম গল্প সংকলন ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’ এ মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর পর্বের অজ¯্র মৃত্যু, রক্ত ঝরা বেদনাদীর্ণ গল্পের প্রতি আমরা দৃষ্টিপাত করতে পারি। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের লেখা ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’ গল্পসংকলনের ১২টি গল্প পড়লে সহজেই উপলব্ধি করা যায় তিনি গল্পের ভাষায় জাদুময়তা আর সাঙ্কতিক বিন্যাসে নবতরমাত্রা দানে প্রয়াসী হয়েছেন। তিনি চরম সাহসিকতার সাথে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রের আচরণের চিত্র অঙ্কন করেছেন, যার মধ্যে ন্যায় অন্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিনির্মাণ আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারি। তিনি এ গল্প সংকলনে ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম’, ‘শিস দেয় রাস্তাটি’, ‘সর্পকাল’, ‘এখানে চিহ্ন সংগ্রহ করা হয়’, ‘ মৃত্যু জনিত শোকপ্রণালী ’, ‘জল যখন লাল বর্ণ নেয়’, ‘যুদ্ধলগন’, ‘আসুন বাড়িটি লক্ষ করি’, ‘হারুনকে নিয়ে একদা এক গল্প তৈরি হয়’, ‘অচিন রোসনাই’, ‘ যেভাবে তিনি খুন হতে থাকেন ,’‘ এ তবে ছায়ার গল্প’, গল্পগুলোতে আমাদের সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের মানুষের ভোগান্তির চিত্র তুলে ধরেছেন গল্পের নানা ঘটনার মাধ্যমে।
‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’ এর গল্পসংকলন থেকে দুটো গল্পের উপর সংক্ষেপে আলোচন করলে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের গল্প লেখার ধারা সম্বন্ধে আমাদের মনে ধারণা জন্মাবে। এ গল্প সংকলনের প্রথম গল্প ‘মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম ’। গল্পকার বিশেষ অনুষঙ্গে গল্প বলেছেন । এ গল্পে মুক্তিযুদ্ধোত্তর কালপর্বের ঘটনা প্রবাহকে উপস্থাপনা করেছেন বিশেষ ঘরাণায়,যার মধ্যে এক রক্তাক্ত অধ্যায়ের ইতিহাস গল্পের আকারে বিধৃত হয়েছে। মায়ের অনুরোধে যুবকটি তার বাবার বন্ধু বড়–য়া কাকার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে মিউজিয়ামটির উদ্দেশ্যে রওনা হয় সন্ধ্যার একটু আগে। শহরের অভিজাত ক্লাবটি পেরোনোর পরই সাতরাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ডটি তার চোখে পড়ে। সে দেখতে পায় সাইনবোর্ডটি থেকে অনবরত রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে! এ রক্তপাতে সে ভিজে যায়। সে রিক্সা থেকে নেমে ভয়তাড়িত মনে তীর চিহ্নিত পথে এগিয়ে যেতে থাকলে তার চোখে পড়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে থাকা আর একটা সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডটিতে লেখা-- মৃতের কিংবা রক্তের জগতে আপনাকে স্বাগতম । সে এগিয়ে গিয়ে মিউজিয়ামে প্রবেশের টিকিট কাটে। সে টিকিট কালেক্টরের হাতের দগদগে দুর্গন্ধময় হাত এবং দগদগে ঘায়ের মতো ছাপ মারা টিকিটটি দেখে অবাক হয়। সে মুখোমুখি হয় টিকিট চেকার, গেইটম্যান, সিকিউরিটি অফিসারের। সে সিকিউরিটি অফিসারকে তার মায়ের পরিচয়পত্রটি দেখালে তিনি তা না দেখে পাশে সরিয়ে রেখে বলেন,‘ --ওই হলো আর - কী, আপনি এখনই বলা শুরু করবেন, যখন আপনি মায়ের পেটে সাতমাসের ভ্রণ, তখনই আপনার বাবা বিলোনিয়া বর্ডার ক্রস করে যুদ্ধে চলে গেল। এই তো?’ যুবকটি দেখতে পায় সাততলা মিউজিয়ামটি রক্ত-রঙের ওমে সারা শরীর ডুবিয়ে আছে। সে বড়–য়া কাকাকে খুঁজে না পেয়ে ফিরে এসে মাকে বলে যে বড়–য়া কাকাকে কোনদিনই ওখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এ কথা তার বিশ্বাস করতে চায় না। সে তার যুবক ছেলেটিকে বলে চলে কীভাবে তার বাবা যুদ্ধ করতে করতে পাকআর্মিদের হাতে তার বাবা সহ চারজন মুক্তিযোদ্ধা ধরা পড়ে টচারিং ক্যাম্পে নির্যাতনের মধ্যে আছেন। যুবকটির বড়–য়া কাকা বিহারি বাবুর্চির কাছ থেকে খবর নিয়ে এসেছিল যে ১০৫ নম্বর রুমে তাদের বেয়াদবির বিচার হচ্ছে । সে মাকে কথা দেয় যে বাবার টর্চারের জায়গা সে খুঁজে বের করবে।
যুবকটি পরদিন মিউজিয়ামটিতে পৌঁছে সরাসরি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সে নিচতলা থেকে রক্তের ঘ্রাণ পেতে শুরু করে। সে সিড়িতে রক্তের দাগ দেখতে পায়। অভ্যর্থনা কক্ষের লোকটি যুবকটিকে বলে, ‘ একবারের প্রথম দিকে ইনচার্জ সাহেব ভাবতেন--- শুধু রক্ত দিয়ে মিউজিয়ামটি সাজাবেন কী করে? কিন্তু কিছু মানুষ যেন টাটকা রক্ত ম্যানেজ করার জন্য তৈরি হয়েই ছিল।’
যুবকটিকে নিয়ে ডিসপ্লে অফিসার ইনচার্জ সাহেবের চেম্বারে ঢোকেন। যুবকটি দেখতে পায় ইনচার্জ সাহেব গদিওয়ালা চেয়ারের সুদৃশ্য তোয়ালের উপর দিয়ে দুটি হাত পিছনে দিয়ে একহাতের আঙুল দিয়ে অন্যহাত পেঁচিয়ে ধরে রেখেছেন । এক সময় ইনচার্জ অফিসার জেগে ওঠে গমগমে আওয়াজে কথা বলতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই যুবকটিকে সাথে নিয়ে পূবদিকে হাঁটতে থাকেন। সামনেই পড়ে লাইব্রেরী, যার বেশির ভাগ অংশ এখন স্যুয়েরেজের মোটাসোটা লাইন হয়ে চলে গেছে নদীর দিকে। চলমান রক্ত দিয়ে শুধু নদী --নালা নয়, আকাশও রাঙানো যায়। এ গল্পের শেষাংশটুকু লেখকের লেখা থেকে উদ্ধৃত করলে বোদ্ধা পাঠক গল্পটিকে মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে পারবেন বলে মনে করি। ‘ দুজন আবারও হাঁটেন ১০১,১০২, ১০৩, ১০৪, রুম পেরিয়ে ১০৫ নাম্বারের সামনে থামলেই বড়ো একটা চিৎকার যুবকটি শুনতে পায়। আশপাশে শুধু নয় চারদিকে তাকালেও শব্ধটির উৎপত্তিস্থল ঠাহর করতে পারে না। কাউকে কি কুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারছে কেউ!!! সেই চিৎকারটি এক সময় তামাটে রোদের মতো সর্বাাঙ্গে ঝাপ্টা মারে। রক্তের ফোয়ারার ভিতর যুবকটি এক সময় একেবারে জব্দ হয়ে যায়।’
‘ যুদ্ধ লগন’ এ গল্পসংকলনের বাস্তব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের গল্প। যুদ্ধ শুরু হওয়ার দু ’মাস পরে সোহানপুরের শিপন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে আখাউড়া বর্ডার ক্রস করে আগরতলা চলে যায়। অন্যদিকের তাদের সোহানপুরের কায়েছালী নিজে রাজাকারের খাতায় নাম লেখায় এবং সোহনপুরের যুব সমাজকে রাজাকারের খাতায় নাম লেখাতে আহ্বান করে।কায়েছালী খাকি ড্রেস পরে কাঁধে চাইনিজ রাইফেল ঝুলিয়ে সহযোগীদের নিয়ে সোহনপুরের সুর্মা আক্তারদের বাড়িতে আসে , শিপনের সাথে সুর্মা আক্তারের ভালবাসার সম্পর্কের কথা কায়েছালী জেনেই সে শিপনের বাড়ি যাবার আগে সুর্মা আক্তারদের বাড়িতে এসে তার মাকে বলে ‘--কিয়ো চাচী, জামাইরে যুদ্ধে পাডাইলানি? সুর্মা আক্তারের মা ঘোমটার আড়ালে নিজেকে সঁপে রেখেই বলতে থাকে- পুলিশ বেডা ইতা কী ক! নিজের বইনরে বুঝি কলঙ্কিনি করতো চাও!’ সুর্মা আক্তারের মায়ের কথায় কায়েছালী খুশি হয়ে সিগারেটে জোরে জোরে টান দিয়ে সে নিজেই বারান্দায় রাখা হাতলওয়ালা চেয়ারটাতে বসে সুর্মা আক্তার কোথায় জানতে চেয়ে তাকে পান বানিয়ে আনতে বলে তার মায়ের কাছে। ‘- সে তো ঘরে নাই গো বাজান। - নিহি! কই গেল?- কমনে কই? খালের পড়োনি গেল?’ কায়েছালী সুমা আক্তারের মাকে বলে ‘ - হেরে জানাইয়া দিয়ো, মাঙ্গের জয় বাংলার বেপর্দা চলাচলতি আমার বালা লাগে না।’ সে আদেশ দেওয়ার সুরে বলে ‘- শিপুইন্যে নডির পুত বাচতে চাইলে ক্যাপ্টিন ছারের অমহে হাজিরা দিতে কইবা। মার্ত দুই কান দিন টাইম দিলাম।’
কায়েছালীর তিন সহযোগী বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করতে বলে সে পুরুষবিহীন বাড়ির পশ্চিম ঘরের বারান্দায় আবার এসে বসে। সুর্মা আক্তারের মা পানের বাটিতে দুই খিলি পান দিতে এলে কায়েছালীর মধ্যে লালসা জেগে উঠে। সুর্মা আক্তারকে নিরালা পেয়ে কায়েছালী উত্তেজিত হয়ে কী কাজ করে তার বর্ণনা গল্পকার এভাবে তুলে ধরেছেন ‘- সুর্মা আক্তারের মায়ের পাকনা কলার মতন চামড়ায় আবৃত হাতের দিকে নজর পড়ে কায়েছালীর। মন-মনুরায় অস্থিরতা জাগ্রত হতে থাকে। --- এ মুহূর্তে ক্যাপ্টেন স্যারের অতি স্বাধীন তেষ্টা তার শরীরেও ভর করে। প্যান্টের ভিতরে পড়ে থাকা শিশ্মটিকে যথারীতি স্বাধীন করে দেয়। তখন হঠাৎই সুর্মা আক্তারদের ঘরে ঢুকে পড়ে কায়েছালী, সুর্মা আক্তারের মা আঁতকে উঠার টাইমও পায় না। তাকে জাপটে ধরে কায়েছালী।--- ঝাপটে -কামড়ে -লেপ্টে সুর্মা আক্তারের মাকে একাকার করতে থাকে। কায়েছালীর শক্ত শরীরের নিচে তার জমানো শক্তি ক্রমশ স্তিমিত হয়ে আসে। ’
প্রতিদিনের মতন সেদিনও সোহনপুরের জলখেলি নদী দিয়ে মাত্র দেড়মাইল দূরের সরারচর হাইস্কুলের মিলিটারিদের ক্যাম্প থেকে লাশ ভেসে আসে। মইদুল মেম্বারের মেয়ে সুর্মা আক্তার জলখেলি নদীর পানিতে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা লাশ দেখে চিৎকার দিয়ে বলে,‘ দেহো গো আম্মা, এইডা মনে অই শিপুইন্যে ভাইজানের লাশই। আল্লা গো, পেটটাদি ঢুলডার লাহান ফুইল্ল গেছিগে।’ শিপনের লাশ জলখেলিতে ভাসতে দেখে সুর্মা আক্তারের কান্না থামে না।
যেদিন শিপনের লাশটি জলখেলি নদীতে ভেসে উঠে তার সাতদিন আগে শিপনকে করে মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি আগরতলা থেকে সোহানপুরে আসে এবং গোপনে হাদী প্রধানের ক্যাম্প করে।।তারা জয়নাল গাজীর বাড়ির পাশের ছোট রাজাকার ক্যাম্প থেকে দুটো চাইনীজ রাইফেল , একটা বন্ধুক ও চারটা কিরিচ দখল করে। মান্দারকান্দি ব্রিজের সেন্টিবক্স দখল করতে শিপনের সন্দেহ হয় কেন সেন্টিবক্সটা শূন্য। কোন কিছু ভাববার আগেই সোহানপুরের মাটি গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে। চারদিক থেকে আক্রমণের হাদী প্রধানের বাড়ির গোপন ক্যাম্পটা পাঞ্জাবীদের দখলে চলে যায়। নয়জনের দলটার পাঁচজন জায়গাতেই মারা যায়, দু’জন পালিয়ে যায় আর গুলি খেয়ে মিলিটারীদের হাতে ধরা পড়ে আর দ’ুজন। রাতের অন্ধকারে নদী থেকে শিপনের লাশ তুলে জঙ্গলের মধ্যে দাফন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার পর কায়েছালী কিছুদিন গা ডাকা দিয়ে থাকার পর মাতব্বরদের ম্যানেজ করে নিজ গ্রামে আবার পাকাপোক্ত ভাবে আসন গাড়ে।
এই গল্প সংকলনের অন্যান্য গল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকাল পর্বের অস্থিরতা, সামরিক শাসন, ধর্মীয় নির্মমতা, এনজিও’র মহাজনী ক্রিয়াকলাপের নানা অনুষঙ্গ তিনি এই সংকলনের গল্পগুলোতে তুলে ধরেছেন। তিনি তার গল্প গুলোতে পরিবার, সমাজ ভাঙার কথা উপস্থাপন করেছেন। এক কথায় বলতে হয় তিনি গল্প লেখার প্রথাসিদ্ধ রীতির গন্ডি পেরিয়ে নবতর মাত্রা দান করেছেন । কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর আমাদের সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের যাপিত জীপনের গল্প গভীর মমতায় তুলে ধরেছেন ‘কতিপয় নি¤œবর্গীয় গল্প’ সংকলনটিতে, যা তার বাস্তব অভিজ্ঞতা সিঞ্চিত।
‘ পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী ’ সমাজের অপাঙতেয় দেহজীবীদের নিয়ে লেখা কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের বাস্তবধর্মী উপন্যাস। প্রগতিশীলতার বাস্তবধর্মী দলিল তার উপন্যাস পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী। তিনি সমকালের অতি বাস্তব চরিত্র, অনুষঙ্গ ও ঘটনা প্রবাহকে চিত্রিত করতে কতটা সাবলীল ভাবে তার জলন্ত দৃষ্টান্ত উপস্থাপনে কতটা সাহসী তার নজির এই উপন্যাস। বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য ঔপন্যাসিকরা সমাজের অন্তজ শ্রেণীর কিংবা নি¤œবর্গের মানুষের সমাজ সংসার, পরিবারপরিজনদের নিয়ে রচনা করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ , সতীনাথ ভাদুড়ী, মহাশ্বেতা দেবীর কথা বলা যায়। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর লেখা পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসে পদ্মানদীর পাড়ে একদল দেহজীবী নারীর গল্প পূণাঙ্গরূপে উঠে আসার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি তার প্রথম প্রয়াসে বাংলা উপন্যাসে সাহিত্যে পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী’র মতো একটি ক্লাসিকধর্মী উপন্যাস রচনা করে একজন নবীন লেখক হিসাবে বাংলা সাহিত্যে নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে সমর্থ হন। কান্দুরি মাসি এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। লেখক জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গে পতিতালয়ের মেয়েগুলোর যন্ত্রণার কথা সরাসরি উপস্থাপন করেছেন। এ উপন্যাসের প্রধান উপজীব্য পদ্মা নদী গোয়ালনন্দ এবং মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও রংপুর সহ নানা এলাকার পটভূমিকায় ওই ভাষা আর নানা অনুষঙ্গকে লেখক তার উপন্যাসে তুলে এনেছেন। বাংলা উপন্যাস ও গল্পে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তার অন্যান্য গল্পে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন সাবলীল ভঙ্গিতে। তিািন এই উপন্যাসে এই প্রয়াসকে বলবত রাখায় তাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই বলতে হয় লেখক বাস্তবধর্মী সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। আমরা দেখার চেষ্টা করবো তার সৃজনশীলতার সাহসী বিনির্মাণের প্রতি। দেহজীবী মহিলাদের কেন্দ্র করে এ উপন্যাস আবর্তীত। এ উপন্যাসে এমন সব মহিলাদের গল্প উঠে এসেছে যারা নিজেদের দেহ বিক্রি করে দিনাতিপাত করে। লেখকের লেখক থেকে উপলব্ধি করা যায়, একজনের মধ্যে বহুজনের গল্প। সেই একজন হতে পারে বহুজন তার মানে সেই একজন হতে পারে হয় মুক্তি, না হয় শরীফা কিংবা চামেলী, আয়েশা, জরিনা না হয় ওদেরই ভেতর থেকে যে -কেউ। ওরা একজনই বহুজন, বহুজনই একজন। এদের যেমন আলাদা করে চেনা মুশকিল, তেমনি মানুষও বলতে গেলে একজনই। এমনই ঘরের দরজা, শরীর বা প্রতীক্ষা দিয়ে এক এক গল্প তৈরি করে। অথবা একটা গল্পকেই বহুজন মিলিয়ে একজন হওযার বেতরে সময় পার করতে থাকে। এদের তবু মানুষ বলে চিহ্নিত করতে হয়, আর মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই থেকে যায়। ওরা নিজেদের কিছু কথা, কিন্তু যন্ত্রণা না হয় হাহাকারের কথাই বলে যায়। লেখক চরিত্রকে বড় করে না দেখিয়ে মানুষকেই বড় করে দেখিয়েছেন। মানুষের যাপিত জীবনে বাস্তবতার চেয়ে বড় কিছু আছে বলে লেখক মনে করেননি। এর ফলশ্রুতিতে তিনি দেহজীবীদের নিয়েই উপন্যাস লিখতে সাহসী হয়েছেন। সময় নিরন্তর বয়ে গেলেও সময়ের পালা বদল হয়। সময়ের দিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে জনপদের মানুষের অবয়বেও পরিবর্তন যথানিয়মে ঘটে। স্থান , কাল, জনপদের মানুষের পালা বদলের সঙ্গে সব কিছু বদলায়। একজন দক্ষ লেখকের চোখে সর্বক্ষেত্রে পালা বদলের ছবি অবশ্রই ধরা পড়ে। তিনি সমাজের সেই পালাবদলকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অবলোকন করে নির্মাণ করেছেন তার এ উপন্যাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাষাও বদলায়। লেখক উপন্যাসে মানুষের ভাষা বদলের ছবি উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের মুখ দিয়ে। স্লাং বা সভ্যভব্য ভাষার সীমারেখা ভেঙে গেছে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতেই। লোকায়ত ভাষার স্বাচ্ছন্দ্যপ্রবাহে তা আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে, আর তাতে জীবনের শক্তি এক এক ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। পদ্মাপাড়ের ওই দেহজীবী মানবীদের জীবনে কতিপয় সম্ভাবনা অথবা যন্ত্রণার ছবি আছে তার এ ইপন্যাসে। অনাদি অতীত থেকে দেশে দেশে একদল মানবী সমাজ সংসারের নিষ্পেষণে এ পেশাটাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে, যার নিবৃত্তি আজও ঘটেনি আমাদের পোড় খাওয়া সমাজ ব্যবস্থা থেকে। ওইসব দেহজীবী নারীদের আশা আকাঙ্খা, প্রেম ভালোবাসা আছে তার জ্বলন্ত দলির নির্মাণ করেছেন লেখক । নি:সন্দেহে লেখকের এটি একটি বড় ধরনের সাফল্য।
নদীকে ঘিরে আবর্তীত এ সব দেহজীবীর জীবন নদীর সঙ্গে তাদের জীবনের এক অভিনব প্রতিযোগিতা লক্ষ করবেন। দেহজীবী মানবীদের সঙ্গে যেসব পুরুষদের সম্পৃক্ততা তাদের নিষ্ঠরতা , খলতা আছে, আছে প্রেম ভালোবাসার অনুষঙ্গও। পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসের নামকরণেরই আছে দ্বিমাত্রা জীবন প্রবাহের নিরন্তর বহমানতা। পতিতাবৃত্তি মূলত নিষিদ্ধ। তবে একদল নারী এ বৃত্তিকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তা লেখক চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। লেখক এ উপন্যাসে দেখানোর চেষ্ট করেছেন সমাজ আর কালের প্রেক্ষাপটে আজ পতিতাদের যৌনকর্মী হিসাবে আখ্যায়িত করা হলেও তারা কি সমাজে যথাযথ স্থান পেয়েছে? হ্যাঁ, ‘ পদ্মা’ সহসায় ভাঙে আর গড়ে , তার সঙ্গে ‘দ্রৌপদীর’র যোগসূত্রও জীবন প্রবাহের ভাঙা আর গড়ার যোগসূত্র। উপন্যাসটিতে বিধৃত হয়েছে দেহজীবী মানবীর জীবন শক্তি,কষ্ট ,স্মৃতি, ব্যথা - বেদনা, আর তার ভেতর আনন্দ, যার নিজের দেহ বিক্রি করে তারাও জীবনও বহন করে। তাদের পঙ্কিল জীবনের মাঝা হাসি- কান্না , সুখ- দু:খ, রাগ- অনুরাগসহ মানুষের জীবনের সহজাত প্রবৃত্তির নানা অনুষঙ্গ। এ জন্যেই এদের মানুষ বলে চিহ্নিত করা হয়, আর মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষই থাকে সে কথাটাই লেখক পদ্মাপাড়ের পদ্মাপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন। একথা নি:সন্দেহে বলা যায় এই ঔপন্যাসিক পদ্মপাড়ের দ্রৌপদী উপন্যাসে তুলে আনতে প্রয়াসী হয়েছেন।
বাংলাসাহিত্যের গল্প উপন্যাসের নতুন ধারার অন্যতম পথিকৃত কমলকুমার মজুমদারে সাহিত্যকর্মের প্রতি কামারুজ্জামান বিশেষ ভাবে অনুরক্ত ছিলেন। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের সম্পাদিত সাহিত্যের ছোট কাগজ ‘কথা’র শেষ সংখ্যাটি কমলকুমার মজুমদারের উপর করেছিলেন তাঁর জন্মশতবর্ষ ২০১৪ সালে পড়ায় । ১৩ জুন -২০১৪ তারিখে চেরাগি পাহাড়ের ‘খড়িমাটি’ আয়োজিত বাংলাসাহিত্যের নতুন ধারার অন্যতম পথিকৃত কমলকুমার মজুমদারে জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর আলোচক হিসাবে যে বক্তব্য দেন তার একটা অংশ ছিল এমন ‘-কমলকুমার তো কোনো সোজাসাপ্টা লেখক বা মানুষ নন। তার তো সমাজ ছিল, মানুষের সঙ্গে পরিপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সংস্কার যেমন ছিল তার ছিল তুমুল ভালবাসা। মানুষের প্রতিই তার পক্ষপাত আর ভালোবাসা।’
মানুষ হিসাবে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর বড় মনের মানুষ ও সত্যপথের পথিক ছিলেন। নির্দ্ধিধায় বলা যায়, প্রতিশ্রুতিশীল এ কথাসাহিত্যিকের অকাল প্রয়াণে বাংলাসাহিত্যের বড়ই ক্ষতি হলো। তবুও বলতে হয় তার অমর সৃষ্টিগুলোই তাকে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে চিরভাস্বর করে রাখবে। পরিশেষে, তার আত্মার শান্তি কামনা করি।
0 মন্তব্যসমূহ