উঝোওদিনমা ইউওলা
উঝোওদিনমা ইউওলা'র প্রবন্ধ ''দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি' : চিনুয়া আচেবে'স মেমোয়ার অভ ওয়ার' অবলম্বনে ট্র্যান্সক্রিয়েশন : হুমায়ূন কবির
আমি যখন হাইস্কুলে পড়তাম, তখনই প্রথম চিনুয়া আচেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কিন্তু আমি অনেক আগ থেকেই তার কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম...ঠিক এভাবেই নাইজেরিয়ার তরুণ লেখক উঝোওদিনমা ইউওলা, আচেবে সম্পর্কে লিখতে শুরু করেন। আমার মা একদিন বিকালে চা-নাস্তার ব্যবস্থা করে ছিলেন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আর, আমাদের ওয়াশিংটন ডি. সি.'র বাড়িতে তিনি এসেছিলেন এবং আমি আর আমার ভাই বোনেরা তাকে আংকেল বলে সম্মোধন করেছিলাম...বাচ্চাদের জন্য তাঁর জীবন বৃত্তান্ত লেখার জন্যে মা সহকারী লেখক হিসেবে কাজ করেছিলেন তখন।
বাগানে হুইলচেয়ারে বসে মাথায় কালো টুপিপরা বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখে যে হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য । আমি খুবই অবাক হয়েছি যখন তার আফ্রিকার সাহিত্যের পরবর্তী বিকাশের ভিত্তি বা বলা যায় বীজগর্ভ-বই 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' পড়েছি । উঝোওদিনমা ইউওলা তাঁর প্রবন্ধে লেখেন-- ১৯৮২ সালের প্রবন্ধ 'দ্য ট্রাবল উইদ নাইজেরিয়া-য় আমি খুব ভাল ভাবেই লক্ষ্য করেছি একজন রাগী মানুষের সংকল্প ও যুক্তিতর্কগুলো, যা এখনও ভাবায় সারা বিশ্বকে । লোকটি বাবার কাছে স্মৃতিচারণ করছিলেন আমাদের লিভিং রুমে বসে, যখন আমার বন্ধুর মা ডগ-ইয়ারডের 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' বইটিতে স্বাক্ষরের জন্য তার সামনে ধরল তখন তিনি বললেন 'জানি সত্যিই বইটি আপনার বইটি পড়া আছে' -- ওটা বিনয়-ই ছিল;- যা সত্যি থেকে বেশি ছিল না বরং সত্যিই ছিল।
আচেবের কাজগুলো আফ্রিকান সাহিত্যের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি এখন আফ্রিকার লেখক বা অলেখকদের কাছে এক রোল মডেল । তাঁর প্রথম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী উপন্যাস 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' ১৯৫৮ সালে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে প্রায় ১২ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে । এটাকে ইংরেজি ভাষার প্রধান উপন্যাসের সমতুল্য ধরা হয়, এমনকি কালো মানুষদের ব্যান্ড দ্য রুটস-এর হিপ হপ এ্যালবামকেও বিশেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এটি । কনরাডের হার্ট অফ ডার্কনেসের ওপর লিখিত তাঁর প্রবন্ধগুলির ভিতর গভীর জ্ঞান সন্নিবেশিত রয়েছে, কনরাডকে বুঝতে গেলে এসব লেখা পড়তেই হয়। তবে, এখানে বিশেষ কিছু কথা আছে। কনরাডকে আচেবে এক নতুন চেহারায় উন্মোচন করেছেন। শাদা চামড়ার চোখে এই পৃথিবীর কালো মানুষেরা কেমন-- কনরাড যেন নীরব থাকেন এখানে। আচেবে তার 'দ্য ট্রাবল উইদ নাইজেরিয়া-য়, দেশ-শাসন সংক্রান্ত যে-সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন, তার বেশিরভাগই সমাধান করা হয়নি তাই তিনি নাইজেরিয়ার জাতীয় সম্মান গ্রহণে দুইবার অসম্মতি জানান । কিন্তু এই আলোর শিক্ষক তাঁর সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ব্যক্তিগত পরিচয় সাধনে ফোকাস করে রেখেছিলেন উত্তর ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের--যারা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য লেখক ।
আচেবে এই নভেম্বরে বিরাশি-তে পা দেবেন, তাঁর 'দেয়ার ওয়াজ এ ক্যান্ট্রি'-তে নিশ্চয় নতুন স্মৃতিকথা আছে যা তিনি আমাদের বলতে চান এবং এই বইতে একজন লেখকের জীবন দর্শনের সব উপাদান রয়েছে । সেখানে তাঁর এতিম বাবা কিভাবে খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন সেই গল্প রয়েছে । তিনিই দেখেছিলেন আচেবের শিক্ষার প্রতি ভালবাসা । আবার কিভাবে আচেবের ব্যক্তি জীবনে দুই ধর্মের প্রভাব পড়েছিল সেই অভিজ্ঞতাও, আবার খ্রিস্টধর্ম কিভাবে তাঁর উপন্যাসগুলোর ওপর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং কিভাবে তিনি তা মোকাবেলা করেন, তাঁর কর্মজীবন। তাঁর স্ত্রী অকোলাই শেষ ৫৬ বছর ধরে তাঁকে যে শক্তি যোগিয়েছেন। টনি মরিসন, যিনি আচেবের স্মৃতিকথাগুলোকে বাতিল করে বলেছিলেন, কমপক্ষে আমার কাছে আপনার জীবন তেমন আকর্ষনীয় না । ১৯৬৭-১৯৭০ সালের নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গেই আচেবের জীবন দর্শন পাওয়া যায় (যা নাইজেরিয়া বায়াফ্রা নামে পরিচিত), এ যুদ্ধে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, যাদের অধিকাংশ ছিল জাতিগত ভাবে ইগবো এবং আচেবে ছিলেন তাদেরই একজন । উত্তর নাইজেরিয়ায় ব্যাপকহারে ইগবোদের হত্যা করার পর এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আর তাদের হত্যা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল কিছু শিক্ষিত অক্সফোর্ডিয়ান কর্নেল। অডুম্যাগয়ু অযুকয়ু ইগবো-শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, এমনকি গৃহযুদ্ধের প্রভাব দেখাও অসম্ভব নয় । অনেক ইগবোদের জন্য তা এখনও ব্যক্তিগত। যখন আমি দাদিদের কাছে যুদ্ধের জীবন সম্পর্কে জানতে চাই, তখন তারা শুধু তাদের মাথা ঝাঁকান এবং বলেন ,এটা খুব ভয়ানক ছিল । আমার পিতামহ নাইজেরিয়ান জঙ্গি ও বোমারু বিমানের পাইলটদের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকে মরণকে অবলোকন করেছেন, যা আচেবের 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি-তে রয়েছে। আমার বাবা-মা প্রাথমিকভাবে উত্তেজিত হয়েই বলেছিলেন বায়াফ্রার স্বাধীনতার কথা এবং যা অনুসরন করেছে ভয়, বঞ্চনা এবং শেষ পর্যন্ত একটা পরম ক্লান্তির কথা । শিশুরা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিল। যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব সমানভাবে পড়েছিল জাতীয় রাজনৈতিক সিস্টেমে ।
আচেবে বেশ দৃঢ়ভাবেই লিখেছেন কিভাবে একটি দেশ তার মানুষকে গুরুত্ব দিবে। তাঁর কাল্পনিক চরিত্রকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য লিখেছেন। উপনিবেশবাদ ও নাইজেরিয়ান সমাজ সম্পর্কে সমালোচনা করে নানামাত্রিক লেখা তিনি লিখেছেন।
আমরা জানি যে আচেবে তাঁর থিংকর ফল অ্যাপার্ট-এ নাইজেরিয়াকেই দেখিয়েছেন ,মূলত তিনি সেই সব দৃশ্য দেখে কি অনুভব করেছিলেন তা লিখেন নি বরং কী স্বচক্ষে দেখেছিলেন তারই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তারঁ বইতে । যুদ্ধের বর্ণনা লেখা সহজ নয় এবং সেটা যদি নিজের লেখা হয়, তাহলে একটি মহাকাব্যে পরিনত হয় । তিনি বলেন--'আমার মতই যারা বায়াফ্রার যুদ্ধের সাথে পরিচিত, আমি এই গল্পগুলো অনেকবার শুনেছি, আমি নিজে বোমায় আমার বাবার বাড়ি উড়িয়ে দিতে দেখেছি যেখানে আমার বাবার শৈশব কেটেছে।' এইসব থেকেই বোঝা যায় তারঁ লেখায় কেমন করে যুদ্ধের আকার আকৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন ।
আচেবের সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপারগুলো হল বিমান আক্রমন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের যুদ্ধে হারানো, যুদ্ধের পর জীবনের দুঃসহ চিত্রগুলো। আজ, মানুষ তাঁকে শিক্ষক, প্রকাশক, বায়াফ্রা প্রজাতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রদূত এবং অধ্যাপক হিসেবে স্মরণ করবে। 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি' লেখা শেষ হল আমরা দেখলাম আচেবে আশা করেছেন, নাইজেরিয়ার জন্য আমাদের জাতীয় বিবেকের ভুমিকা পালনে এগিয়ে আসা উচিত ।
আচেবের স্মৃতিকথার পূর্বাভাষগুলোয় ঠিক কি ছিল তার বর্ণনা আছে তাঁরই উপন্যাস 'এ ম্যান অফ দ্য পিপলে' । তাঁর ভবিষৎবাণী সত্য হতে পারে কোন সহিংসতার মধ্য দিয়ে এই ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে । যদিও আচেবে নাইজেরিয়াতে বসবাস বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ তাঁর শরীর পক্ষাঘাত গ্রস্থ হয়েছিল। তবুও তিনি বুঝতে পারতেন দেশের দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষদের, জাতীয় সমস্যাগুলোকে, মৌলবাদী ইসলামী রাজনৈতিক দল বোকো হারামের ভয়কে, সাধারণ মানুষের হতাশাকে । আচেবে লিখেছেন, 'এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটবে শুধু মাত্র বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ।' মানুষের অধিকারের জন্য ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন যা বিশ্ব ও তার দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করত। আচেবে বিনয়ের সাথে লিখেছেন, 'আমার সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি প্রতিবাদী লেখক নই।' তিনি আফ্রিকান সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে মুক্তির জন্য লিখে গেছেন যেখানে প্রতিবাদের সুর ঠিকই রয়েছে । আচেবের অন্যান্য কাজের মত এই বইটিও যুদ্ধের অগ্রগতি ও বর্তমানের সহিংসতার উপস্থিতি লক্ষনীয় যা এটিকে সার্বজনীন করে তুলেছে । নোংরা রাজনৈতিক মাধ্যম থেকে উদ্দীপ্ত সাম্প্রদায়িক ঘৃণাই যে সিরিয়া ভাঙার কারণ, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে হুমকি বা রেসারেসি চলছে এই সব নিয়ে 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি'তে খুব ভালভাবে বলা আছে যে, যুদ্ধ কখনও শান্তি আনে না, যুদ্ধের পরিণাম যে নির্মম হয়, তাই । এটা তাঁর অন্য কোন কাজের সাথে মিলবে না যেমন, থিংকস ফল অ্যাপার্ট । কিন্তু এটা লেখা খুবই কঠিন ছিল একজন বিরাশি বছর বয়স্ক লোকের পক্ষে, যা আফ্রিকান সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে স্থান দিয়েছে । যদিও 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি'-তে ইতিহাস, ব্যক্তি জট পাকিয়ে যায়, তবুও এতে একটি অদ্ভুত দুনিয়াও তৈরি হয় যেখানে আচেবে অদ্ভুত এক পৃথিবীর সন্ধান পান ।
পরিচিতি
হুমায়ুন কবীর
উঝোওদিনমা ইউওলা'র প্রবন্ধ ''দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি' : চিনুয়া আচেবে'স মেমোয়ার অভ ওয়ার' অবলম্বনে ট্র্যান্সক্রিয়েশন : হুমায়ূন কবির
আমি যখন হাইস্কুলে পড়তাম, তখনই প্রথম চিনুয়া আচেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কিন্তু আমি অনেক আগ থেকেই তার কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম...ঠিক এভাবেই নাইজেরিয়ার তরুণ লেখক উঝোওদিনমা ইউওলা, আচেবে সম্পর্কে লিখতে শুরু করেন। আমার মা একদিন বিকালে চা-নাস্তার ব্যবস্থা করে ছিলেন তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আর, আমাদের ওয়াশিংটন ডি. সি.'র বাড়িতে তিনি এসেছিলেন এবং আমি আর আমার ভাই বোনেরা তাকে আংকেল বলে সম্মোধন করেছিলাম...বাচ্চাদের জন্য তাঁর জীবন বৃত্তান্ত লেখার জন্যে মা সহকারী লেখক হিসেবে কাজ করেছিলেন তখন।
বাগানে হুইলচেয়ারে বসে মাথায় কালো টুপিপরা বয়স্ক ভদ্রলোকের মুখে যে হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল, তা ভাষায় প্রকাশ করা দুঃসাধ্য । আমি খুবই অবাক হয়েছি যখন তার আফ্রিকার সাহিত্যের পরবর্তী বিকাশের ভিত্তি বা বলা যায় বীজগর্ভ-বই 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' পড়েছি । উঝোওদিনমা ইউওলা তাঁর প্রবন্ধে লেখেন-- ১৯৮২ সালের প্রবন্ধ 'দ্য ট্রাবল উইদ নাইজেরিয়া-য় আমি খুব ভাল ভাবেই লক্ষ্য করেছি একজন রাগী মানুষের সংকল্প ও যুক্তিতর্কগুলো, যা এখনও ভাবায় সারা বিশ্বকে । লোকটি বাবার কাছে স্মৃতিচারণ করছিলেন আমাদের লিভিং রুমে বসে, যখন আমার বন্ধুর মা ডগ-ইয়ারডের 'থিংকস ফল অ্যাপার্ট' বইটিতে স্বাক্ষরের জন্য তার সামনে ধরল তখন তিনি বললেন 'জানি সত্যিই বইটি আপনার বইটি পড়া আছে' -- ওটা বিনয়-ই ছিল;- যা সত্যি থেকে বেশি ছিল না বরং সত্যিই ছিল।
আচেবের কাজগুলো আফ্রিকান সাহিত্যের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তিনি এখন আফ্রিকার লেখক বা অলেখকদের কাছে এক রোল মডেল । তাঁর প্রথম এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী উপন্যাস 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' ১৯৫৮ সালে প্রকাশ হওয়ার পর থেকে প্রায় ১২ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে । এটাকে ইংরেজি ভাষার প্রধান উপন্যাসের সমতুল্য ধরা হয়, এমনকি কালো মানুষদের ব্যান্ড দ্য রুটস-এর হিপ হপ এ্যালবামকেও বিশেভাবে অনুপ্রাণিত করেছে এটি । কনরাডের হার্ট অফ ডার্কনেসের ওপর লিখিত তাঁর প্রবন্ধগুলির ভিতর গভীর জ্ঞান সন্নিবেশিত রয়েছে, কনরাডকে বুঝতে গেলে এসব লেখা পড়তেই হয়। তবে, এখানে বিশেষ কিছু কথা আছে। কনরাডকে আচেবে এক নতুন চেহারায় উন্মোচন করেছেন। শাদা চামড়ার চোখে এই পৃথিবীর কালো মানুষেরা কেমন-- কনরাড যেন নীরব থাকেন এখানে। আচেবে তার 'দ্য ট্রাবল উইদ নাইজেরিয়া-য়, দেশ-শাসন সংক্রান্ত যে-সমস্যাগুলো তুলে ধরেছিলেন, তার বেশিরভাগই সমাধান করা হয়নি তাই তিনি নাইজেরিয়ার জাতীয় সম্মান গ্রহণে দুইবার অসম্মতি জানান । কিন্তু এই আলোর শিক্ষক তাঁর সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং ব্যক্তিগত পরিচয় সাধনে ফোকাস করে রেখেছিলেন উত্তর ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকদের--যারা ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য লেখক ।
আচেবে এই নভেম্বরে বিরাশি-তে পা দেবেন, তাঁর 'দেয়ার ওয়াজ এ ক্যান্ট্রি'-তে নিশ্চয় নতুন স্মৃতিকথা আছে যা তিনি আমাদের বলতে চান এবং এই বইতে একজন লেখকের জীবন দর্শনের সব উপাদান রয়েছে । সেখানে তাঁর এতিম বাবা কিভাবে খ্রিস্টীয় ধর্মে দীক্ষা লাভ করেন সেই গল্প রয়েছে । তিনিই দেখেছিলেন আচেবের শিক্ষার প্রতি ভালবাসা । আবার কিভাবে আচেবের ব্যক্তি জীবনে দুই ধর্মের প্রভাব পড়েছিল সেই অভিজ্ঞতাও, আবার খ্রিস্টধর্ম কিভাবে তাঁর উপন্যাসগুলোর ওপর দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং কিভাবে তিনি তা মোকাবেলা করেন, তাঁর কর্মজীবন। তাঁর স্ত্রী অকোলাই শেষ ৫৬ বছর ধরে তাঁকে যে শক্তি যোগিয়েছেন। টনি মরিসন, যিনি আচেবের স্মৃতিকথাগুলোকে বাতিল করে বলেছিলেন, কমপক্ষে আমার কাছে আপনার জীবন তেমন আকর্ষনীয় না । ১৯৬৭-১৯৭০ সালের নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের প্রসঙ্গেই আচেবের জীবন দর্শন পাওয়া যায় (যা নাইজেরিয়া বায়াফ্রা নামে পরিচিত), এ যুদ্ধে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ মারা যায়, যাদের অধিকাংশ ছিল জাতিগত ভাবে ইগবো এবং আচেবে ছিলেন তাদেরই একজন । উত্তর নাইজেরিয়ায় ব্যাপকহারে ইগবোদের হত্যা করার পর এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আর তাদের হত্যা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল কিছু শিক্ষিত অক্সফোর্ডিয়ান কর্নেল। অডুম্যাগয়ু অযুকয়ু ইগবো-শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়, এমনকি গৃহযুদ্ধের প্রভাব দেখাও অসম্ভব নয় । অনেক ইগবোদের জন্য তা এখনও ব্যক্তিগত। যখন আমি দাদিদের কাছে যুদ্ধের জীবন সম্পর্কে জানতে চাই, তখন তারা শুধু তাদের মাথা ঝাঁকান এবং বলেন ,এটা খুব ভয়ানক ছিল । আমার পিতামহ নাইজেরিয়ান জঙ্গি ও বোমারু বিমানের পাইলটদের খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলেন সেখান থেকে মরণকে অবলোকন করেছেন, যা আচেবের 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি-তে রয়েছে। আমার বাবা-মা প্রাথমিকভাবে উত্তেজিত হয়েই বলেছিলেন বায়াফ্রার স্বাধীনতার কথা এবং যা অনুসরন করেছে ভয়, বঞ্চনা এবং শেষ পর্যন্ত একটা পরম ক্লান্তির কথা । শিশুরা প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিল। যুদ্ধের বিধ্বংসী প্রভাব সমানভাবে পড়েছিল জাতীয় রাজনৈতিক সিস্টেমে ।
আচেবে বেশ দৃঢ়ভাবেই লিখেছেন কিভাবে একটি দেশ তার মানুষকে গুরুত্ব দিবে। তাঁর কাল্পনিক চরিত্রকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য লিখেছেন। উপনিবেশবাদ ও নাইজেরিয়ান সমাজ সম্পর্কে সমালোচনা করে নানামাত্রিক লেখা তিনি লিখেছেন।
আমরা জানি যে আচেবে তাঁর থিংকর ফল অ্যাপার্ট-এ নাইজেরিয়াকেই দেখিয়েছেন ,মূলত তিনি সেই সব দৃশ্য দেখে কি অনুভব করেছিলেন তা লিখেন নি বরং কী স্বচক্ষে দেখেছিলেন তারই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তারঁ বইতে । যুদ্ধের বর্ণনা লেখা সহজ নয় এবং সেটা যদি নিজের লেখা হয়, তাহলে একটি মহাকাব্যে পরিনত হয় । তিনি বলেন--'আমার মতই যারা বায়াফ্রার যুদ্ধের সাথে পরিচিত, আমি এই গল্পগুলো অনেকবার শুনেছি, আমি নিজে বোমায় আমার বাবার বাড়ি উড়িয়ে দিতে দেখেছি যেখানে আমার বাবার শৈশব কেটেছে।' এইসব থেকেই বোঝা যায় তারঁ লেখায় কেমন করে যুদ্ধের আকার আকৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন ।
আচেবের সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপারগুলো হল বিমান আক্রমন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের যুদ্ধে হারানো, যুদ্ধের পর জীবনের দুঃসহ চিত্রগুলো। আজ, মানুষ তাঁকে শিক্ষক, প্রকাশক, বায়াফ্রা প্রজাতন্ত্রের জন্য রাষ্ট্রদূত এবং অধ্যাপক হিসেবে স্মরণ করবে। 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি' লেখা শেষ হল আমরা দেখলাম আচেবে আশা করেছেন, নাইজেরিয়ার জন্য আমাদের জাতীয় বিবেকের ভুমিকা পালনে এগিয়ে আসা উচিত ।
আচেবের স্মৃতিকথার পূর্বাভাষগুলোয় ঠিক কি ছিল তার বর্ণনা আছে তাঁরই উপন্যাস 'এ ম্যান অফ দ্য পিপলে' । তাঁর ভবিষৎবাণী সত্য হতে পারে কোন সহিংসতার মধ্য দিয়ে এই ১৫ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালে । যদিও আচেবে নাইজেরিয়াতে বসবাস বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ তাঁর শরীর পক্ষাঘাত গ্রস্থ হয়েছিল। তবুও তিনি বুঝতে পারতেন দেশের দুর্নীতিগ্রস্থ মানুষদের, জাতীয় সমস্যাগুলোকে, মৌলবাদী ইসলামী রাজনৈতিক দল বোকো হারামের ভয়কে, সাধারণ মানুষের হতাশাকে । আচেবে লিখেছেন, 'এই ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটবে শুধু মাত্র বর্তমান দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারলে এবং শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ।' মানুষের অধিকারের জন্য ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রাম করেছিলেন যা বিশ্ব ও তার দেশের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করত। আচেবে বিনয়ের সাথে লিখেছেন, 'আমার সংজ্ঞা অনুযায়ী আমি প্রতিবাদী লেখক নই।' তিনি আফ্রিকান সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে মুক্তির জন্য লিখে গেছেন যেখানে প্রতিবাদের সুর ঠিকই রয়েছে । আচেবের অন্যান্য কাজের মত এই বইটিও যুদ্ধের অগ্রগতি ও বর্তমানের সহিংসতার উপস্থিতি লক্ষনীয় যা এটিকে সার্বজনীন করে তুলেছে । নোংরা রাজনৈতিক মাধ্যম থেকে উদ্দীপ্ত সাম্প্রদায়িক ঘৃণাই যে সিরিয়া ভাঙার কারণ, ইসরাইল ও ইরানের মধ্যে হুমকি বা রেসারেসি চলছে এই সব নিয়ে 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি'তে খুব ভালভাবে বলা আছে যে, যুদ্ধ কখনও শান্তি আনে না, যুদ্ধের পরিণাম যে নির্মম হয়, তাই । এটা তাঁর অন্য কোন কাজের সাথে মিলবে না যেমন, থিংকস ফল অ্যাপার্ট । কিন্তু এটা লেখা খুবই কঠিন ছিল একজন বিরাশি বছর বয়স্ক লোকের পক্ষে, যা আফ্রিকান সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে স্থান দিয়েছে । যদিও 'দেয়ার ওয়াজ এ কান্ট্রি'-তে ইতিহাস, ব্যক্তি জট পাকিয়ে যায়, তবুও এতে একটি অদ্ভুত দুনিয়াও তৈরি হয় যেখানে আচেবে অদ্ভুত এক পৃথিবীর সন্ধান পান ।
পরিচিতি
হুমায়ুন কবীর
গল্পকার।
0 মন্তব্যসমূহ