গৌতম চক্রবর্তী
গরমে সবাই দরদর করে ঘামছে। মাস্টার এসে বললেন, ভূগোল পড়াটা আজ ঘরে নয়, আমগাছের নিচে হোক! ঝিরঝিরে হাওয়ায়, গাছের নিচে ব্ল্যাকবোর্ডে মাস্টারমশায় ইংল্যান্ডের মানচিত্র আঁকলেন, শুরু হল ক্লাস। সব গ্রামেই এক চেনা পাগল থাকে। এই গ্রামেও ছিল। গাছের নিচে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের জটলা দেখে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বোর্ডে-আঁকা মানচিত্রটি হাত দিয়ে খসখস করে মুছে দিয়ে বলল, 'আমাদের ওগিডি গাঁয়ের দক্ষিণ দিকের জঙ্গলটার গল্প শুনেছিস?' পাগলকে কে আর ঘাঁটাতে যায়! মাস্টারও চুপচাপ গল্প শুনলেন।
গরমে সবাই দরদর করে ঘামছে। মাস্টার এসে বললেন, ভূগোল পড়াটা আজ ঘরে নয়, আমগাছের নিচে হোক! ঝিরঝিরে হাওয়ায়, গাছের নিচে ব্ল্যাকবোর্ডে মাস্টারমশায় ইংল্যান্ডের মানচিত্র আঁকলেন, শুরু হল ক্লাস। সব গ্রামেই এক চেনা পাগল থাকে। এই গ্রামেও ছিল। গাছের নিচে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রীদের জটলা দেখে সে হঠাৎ এগিয়ে এসে বোর্ডে-আঁকা মানচিত্রটি হাত দিয়ে খসখস করে মুছে দিয়ে বলল, 'আমাদের ওগিডি গাঁয়ের দক্ষিণ দিকের জঙ্গলটার গল্প শুনেছিস?' পাগলকে কে আর ঘাঁটাতে যায়! মাস্টারও চুপচাপ গল্প শুনলেন।
গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত আত্মজীবনীতে
ছোটবেলার এ অভিজ্ঞতা জানিয়ে চিনুয়া আচেবে লিখেছিলেন, 'পাগলই সার সত্য বুঝেছিল। আমাদের
শুধু ঔপনিবেশিক ইতিহাস, ভূগোল বুঝলে চলবে না। নিজের গ্রাম, সেখানকার মানুষ ও সভ্যতাকে
জানতে হবে।' এটিই তার শেষ বই। ২০১৩-র ২১ মার্চ, ৮৩ বছর বয়সে চলে গেলেন।
আত্মজীবনীর নাম: দেয়ার ওয়জ আ
কান্ট্রি: আ পার্সোনাল হিস্ট্রি অব বায়াফ্রা। মাত্র তিন বছর আয়ুর এক দেশ: বায়াফ্রা।
ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার সাত বছর পর, ১৯৬৭ সালে নাইজেরিয়ায় শুরু হয়েছিল
গৃহযুদ্ধ। দেশের দক্ষিণ-পূর্বে ইগবো জনজাতিই তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্য দিকগুলিতে ইয়োরুবা,
হাউসা জনজাতিরা সংখ্যায় বেশি। কিন্তু ইগবোরা ইংরেজি শিক্ষায় এগিয়ে। চাকরি, ব্যবসা,
সবেতেই তাদের প্রাধান্য। কেন একটি জনজাতির ভাগেই যাবতীয় সুযোগ? সরকারি মদতে ইগবোদের
এড়িয়ে অন্যদের নানা সুবিধা দেয়া শুরু হলো।
চিনুয়া আচেবে তখন নাইজেরিয়ার
বিখ্যাত লেখক, বেতারের ডিরেক্টর। তিনিও ইগবো। রাজধানী লাগোসে তার বাড়িতে বোমা পড়ল।
ইগবোরা কয়েক দিন পরে নাইজেরীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল, তৈরি হল নতুন
দেশ বায়াফ্রা। তার রাষ্ট্রদূত চিনুয়া আচেবে। নাইজেরীয় সরকার বীভৎস ভাবে দমন করেছিল
সে গৃহযুদ্ধ। সেনাবাহিনির অত্যাচার তো ছিলই, খাদ্য ও ত্রাণ দিতে-আসা বিমানগুলিকে ধাওয়া
করত যুদ্ধ-বিমান। অনাহারে, অপুষ্টিতে মারা গিয়েছিলেন প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ। পরবর্তী
কালে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত নাট্যকার ওলে সোয়েঙ্কা তখন চিনুয়ার আমন্ত্রণে বায়াফ্রায়
যান। লাগোসে ফেরার পর পুলিশ তাকে মারতে মারতে জেলে ঢুকিয়ে দেয়। মৃত্যুর আগে চিনুয়া
আচেবে বইয়ের নামকরণেই জানিয়ে গেলেন, তার আত্মজীবনী সেই ক্ষণজীবী দেশের ইতিহাস। প্রয়াত
সাহিত্যিককে তা হলে কী বলব? বিচ্ছিন্নতাবাদী?
বইয়ে কিন্তু ঘুরেফিরে এসেছে নাইজেরিয়ার
কথা। ছোটবেলায় দেখা পাগল থেকে আজকের নাইজেরিয়ার রাজনীতি, দুর্নীতি সবই। 'দুর্নীতিগ্রস্ত
দেশ, টাকা দিয়ে লোকে ভোটে দাঁড়াতে পারে। যত দিন না নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন তৈরি
হবে, গণতান্ত্রিক কাঠামোর পূর্ণ সংস্কার ঘটবে, নাইজেরিয়ার সমস্যা মিটবে না।' বায়াফ্রা
ঘটেছিল কেন? শিক্ষাদীক্ষা এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও ইগবোদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। কোনও
দেশ যদি বিশেষ নাগরিক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শোধ নিতে চায়, মেধার বদলে মধ্যমেধাকেই মাপকাঠি
তৈরি করে, তার কপালে সমূহ অন্ধকার। দেশকে মানুষ নানা ভাবে ভালবাসতে পারে, ভালবেসে সমালোচনাও
করতে পারে। শুধু রাষ্ট্রীয় বয়ানটির প্রতি আনুগত্য রাখতে হবে এমন নয়। এই লেখককে বুঝে
নিতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।
চিনুয়া আচেবের প্রথম পরিচয় কী?
আধুনিক আফ্রিকান উপন্যাসের জনক। ১৯৫৮ সালে তার প্রথম উপন্যাস 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' বেরোনোর
পর সারা দুনিয়ায় তোলপাড়। নাইজেরিয়া তখন ব্রিটিশ শাসনে। সরকারি বেতারে চাকরি করতে
করতেই চিনুয়া ইংরেজি ভাষায় ওই উপন্যাস লেখেন। কেন?--আমরা উপনিবেশবাদীদের ভাষা ব্যবহার
করে, তাদেরই শেখানো উপন্যাস নামক কাঠামোটিতে নিজেদের কথা বলতে চেয়েছিলাম। আমাদের গল্প
অন্যরা বলবে কেন? আমরাও বলব-- এই স্মৃতিচারণ লেখকের।
আমাদের গল্প অন্যরা বলবে কেন? প্রশ্নটা
চিনুয়া আচেবেকে বরাবর তাড়া করেছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তৃতায় বলেছেন,
'জোসেফ কনরাড এক নির্লজ্জ সাম্রাজ্যবাদী। আফ্রিকা নিয়ে পশ্চিমের লেখালেখিতে কালো মানুষদের
বন্য বলে দেখানো হত। কারণ, ও ভাবে মানুষকে না দেখলে দাসব্যবসা চলে না।' আফ্রিকাই সব
নয়। দক্ষিণ কোরিয়ার এক ভদ্রমহিলা 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' পড়ে লেখককে চিঠি লিখেছিলেন--'আমি
অবাক। পরে বুঝলাম, ওরাও জাপানি উপনিবেশে ছিল। পৃথিবীতে অনেকের গল্পই থামিয়ে দেয়া
হয়েছে'--লিখেছেন চিনুয়া।
স্বাধীন নাইজেরিয়াকেও তিনি ছেড়ে
কথা বলেননি। 'আ ম্যান অব দ্য পিপল' উপন্যাসে দেখা গেল, সদ্য-স্বাধীন এক দেশ। রাজনীতিকদের
দুর্নীতি তুঙ্গে। সংস্কৃতিমন্ত্রী নাংগা দুর্নীতিতে জড়িয়ে প্রচুর সম্পত্তির মালিক,
বন্ধু ওডিলির প্রেমিকাকেও সে ফুসলে নিয়ে যায়। বিরোধী দলের প্ররোচনায় ওডিলি রাজনীতিতে
নামে, দুই পক্ষের গুন্ডারা দেশে তাণ্ডব শুরু করে। অবশেষে সেনাবিদ্রোহ। উপন্যাসটা তখনও
বেরোয়নি, এক সন্ধ্যায় চিনুয়া আচেবে, ওলে সোয়েঙ্কারা বসে আড্ডা মারছেন। আর এক লেখক
জে পি ক্লার্ক ছুটতে ছুটতে এলেন, 'পাণ্ডুলিপিটা পড়লাম। দারুণ লিখেছিস। শুধু সেনাবিদ্রোহটা
ঘটেনি, কিন্তু দুর্নীতি, গুণ্ডারাজ বাকি সব ঠিক।' লেখকদের কেউই তখন জানতেন না, রাস্তায়
সেনাবাহিনী নেমে পড়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে ইগবো বিদ্রোহ।
গৃহযুদ্ধের ২০ বছর পর, তার উপন্যাস
'অ্যান্টহিলস অব সাভানা।' কাঙ্গান নামে কাল্পনিক এক দেশ। গৃহযুদ্ধ শেষে ক্ষমতায় এসেছে
স্যাম। ক্রিস তথ্যমন্ত্রী। এদেরই বন্ধু খবরের কাগজের সম্পাদক ইকেম। সবাই বিলেতফেরত।
দেশের দুঃখ কিন্তু ঘোচেনি। ক্ষমতাসীন কালো মানুষদের চিন্তাভাবনাও এখন শ্বেতাঙ্গদের
মতো। নতুন ছাত্ররা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ে, তাদের জমায়েতে এক বৃদ্ধের বলা গল্পের
খেই ধরে ইকেম। গল্প তো শেষ হয় না, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চারিয়ে যায়।
১৯৮৭-র এই বই-ই চিনুয়া আচেবের
শেষ উপন্যাস। দুই দশক আগে লাগোসের রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় কোমরের নিচচ থেকে বাকিটা
অসাড়। তার পর আমৃত্যু হুইলচেয়ারে, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে। উপন্যাস
আর লেখেননি। সালমান রুশদি এক বার লিখেছিলেন, 'সাহিত্যের সঙ্গে লেখকের ঠিকানার সম্পর্ক
নেই।' চিনুয়া আচেবের ঠিক উল্টো কথা: 'ঘরের ঠিকানাই নিজেকে বোঝার একমাত্র উপায়।'
হুইলচেয়ারে বসেই ভারতীয় লেখক
বিদ্যাধর সুরজপ্রসাদ নইপলের সঙ্গে তার বিখ্যাত তর্ক। নইপলের উপন্যাস 'আ বেন্ড ইন দ্য
রিভার-এ নায়ক সালিমকে এক জন দূরে গ্রামের রাস্তা দেখিয়ে বলেছিল, 'ইতিহাস ওখানে থাকে
না।' তার পর বুকে টোকা মেরে: 'ইতিহাস এখানে থাকে। পুরনোকে পায়ে দলে বেরিয়ে পড়ো,
পিছুটান রেখো না।' হার্ভার্ডে বক্তৃতার মাঝেই চিনুয়া নিজের বুকে টোকা মেরে বলবেন,
'ইতিহাস শুধু এখানে থাকে না মিস্টার নইপল। সে গ্রামের ওই রাস্তায় থাকে। যারা মরে গেছে,
যারা বেঁচে আছে, ওই রাস্তায় হাঁটে, সকলকে নিয়েই আমার ইতিহাস।'
গ্রামে যারা উপনিবেশ পাততে এসেছিল,
তাদের কাছে গণতন্ত্রের বয়ান শিখেছিলেন বলেই কি ওই রাজনৈতিক প্রকরণের ওপর তার আস্থা?
'উপনিবেশের আগে ইগবো সমাজে কেন্দ্রীয় কোনো ব্যবস্থা ছিল না ঠিকই, কিন্তু গণতন্ত্র
ছিল। অনেক স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম ছিল। প্রতিট গ্রামেই ভিন্ন ভিন্ন দেবতা, কেউ ছোট-বড়
নয়। কেউ কেউ ছেলেদের নাম রাখত এজেবুলো। কথাটার মানে: রাজাই আসল শত্রু।' রাজাই আসল
শত্রু, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিয়ে যাও তো, কোনো সমাজে এভাবে ডাকতে শুনেছেন? কিন্তু
ইগবোরা ডাকত-- লিখেছিলেন চিনুয়া।
চিনুয়া আচেবের উত্তর-উপনিবেশবাদ
শুধু সাম্রাজ্য-বিরোধিতা নয়। গণতন্ত্রের বিকল্প বয়ানও।
0 মন্তব্যসমূহ