বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
ভগীরথ মিশ্র জন্মসূত্রে মেদিনীপুরের মানুষ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি থানার সাঁতরাপুর গ্রামে জন্ম তাঁর। লেখালেখি শুরু করেন সত্তরের দশকে। সেই সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে লিখলেন তাঁর আবাল্যের গ্রামের গল্প। বাল্য-কৈশোরের গ্রামীণ দৃশ্যপট—স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে উঠে এল তাঁর লেখার বিষয়—পটভূমি। গ্রাম সম্পর্কে তিনি এক জায়গায় বলেছেন—“একেবারে সামন্ততান্ত্রিক পরিমণ্ডল, ঘরে ও বাইরে। চারপাশে আদিবাসীদের গ্রাম। সন্ধে প্রহরে মাদলের দ্রিমি দ্রিমি বোল ভেসে আসে হাওয়ায়। শাল-মহুয়ার জঙ্গল নিরন্তর হাতছানি দিয়ে ডাকে।”
তাঁর বহু গল্পের কেন্দ্রে এরকম সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম। আদিবাসী মানুষজন। শাল-মহুয়ার জঙ্গল। ভগীরথের লেখক সত্তার বৈশিষ্ট্য এই গ্রামীণতা। তিনি বিশ্বাস করেন গ্রামীণ ভারতবর্ষে। সেখানে সেই অর্থে শহরের কোনও অস্তিত্বই নেই। এমনকি কলকাতা শহরটাকেও তাঁর মনে হয় বৃহদাকার গ্রাম। সত্যিই তো শহরের মধ্যেও লুকিয়ে আছে গ্রাম। গ্রাম্যতা সেখানেই বেশি। তাই তিনি বলেন একজন লেখককে জীবনে অন্তত একটি গ্রামের গল্প লিখতে হয়—না হলে তার ‘কলমশুদ্ধি’ হয় না। এরকম একটি বোধ ও চেতনা থেকে তিনি গল্প লেখেন।
#
ভগীরথ মনে করেন, শোষণ মানুষের একটা অতি প্রয়োজনীয় প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ শোষণ করে। প্রতিটি মানুষই তার থেকে দুর্বলকে শোষণ করে। না হলে বেঁচে থাকতেই পারবে না। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো সময়কালটিই তো একটা ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন শোষণের ইতিহাস। শুধু মাত্র খাদ্যের প্রয়োজনেও মানুষ শোষণ করতে বাধ্য। ভগীরথ তাঁর বহু গল্পে এই ভাবনাটিকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন।
যেমন তাঁর ‘রাবণ’ গল্পটি। গল্পের প্রধান চরিত্র রাবণ মাঝি ছোটবেলায় জমিদার সতীকান্ত সিংহের কোপানলের শিকার হয় সপরিবারে। রাবণের বাবা দিদি ভাই সবাই চরম লাঞ্ছিত হয়। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সিংহ। উপবাসে-ভিক্ষে করে-জঙ্গলের ফল-পাকুড় খেয়ে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। তার আঠারো বছরের দিদি সিংহবাবুর কামনার শিকার হয়। পরে মরতেও হয় তাকে। তারপর রাবণ শুধু ‘পেটভাতুয়ায়’ শক্তিচঁদের বাড়ির কাজ করে। গুড়ের মহালের গুড় জাল দেয়। এভাবে প্রতিমুহুর্তে শোষিত হতে হতে এক সহৃদয় বিডিও সাহেবের কল্যানে ঘোড়ার গাড়ি পেয়ে যায় ব্যাঙ্ক থেকে। পরে নিজেই মহাল খোলে গুড়ের। ‘আড়াই কুড়ি উম্বরের’ রাবণের ‘বিয়া’ করা হয় না আর।
আজন্ম শোষিত লাঞ্ছিত রাবণ আজ শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তার মহালের রাতের জাগুয়া প্রহরাজ বেজের স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে প্রহরাজকে হত্যা করে। শুধু হত্যা নয়, যেভাবে প্রহরাজকে খুন করে রাবণ, তা সকল নৃশংসতাকে হার মানায়। প্রহরাজকে সে অত্যধিক মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে দেয়। দুগাছা মোটা পাটের দড়ি দিয়ে তেঁতুল গাছের সঙ্গে বেড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। হাত-পা কষে বাঁধা। বেহুঁশ প্রহরাজ জিজ্ঞেস করে, “আমাকে বাঁইধ্ল্যে ক্যানে রাবণদা ? বাঁইধ্ল্যে ক্যানে ?” রাবণের অভয় বাণী, “অমনি রে। ভয় পাস্ নাই।”
তার পরনের কাপড় খুলে মুখ বেঁধে দেয় রাবণ। দড়িগাছা দিয়ে পা থেকে গলা অবধি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধে। তার নিজের বর্ণনায়—
গুড়ের মিঠে গন্ধে গাছের বিষ পিঁপড়েরা প্রহরাজের সর্বাঙ্গে কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দেয়। মর্ম-বিদারক মৃত্যুমুখে ফেলে রাবণ প্রহরাজের ঘরের দিকে এগোয়। কিন্তু ঘরের কাছে এসে সামলে নেয় নিজেকে। “আজ রাতে কদাচ লয়। সতীকান্ত সিংহবাবু বারবার বলতেন, ‘কোনও অবস্থাতেই সংযম হারাতে না।’ যে রমণীর সোয়ামী লরক-যন্তণ্ণা পেতে পেতে মরছে শীতের রাতে, তেঁতুল তলায়, নিঃশব্দে,—উহার সাথে সহবাস! মহাপাপ হব্যেক তাতে। আর একথা দুনিয়ার কে-ই বা না জানে যে পাপ উয়ার বাপকেও নাই ছাড়ে!”
একজন খুনির মুখে পাপ-পুণ্যের কথা! মানুষটাকে খুন করবার জন্য তার মনে কোনও পাপবোধ জন্মায়নি। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসকে ভয়ানক পাপ মনে করছে সে। এবং নিজেকে সংযতও করছে। এখানে কোথায় যেন তার মধ্যে একটা সততা দেখি। একজন নৃশংস মানুষের মধ্যেও তার মতো বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ থাকে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখি এই ধরনের চরিত্র নির্মাণে লেখক একপেশে হয়ে যান। ভগীরথ এই খল চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সে পথে হাঁটেননি। একটিমাত্র বাক্য খরচ করে লম্পট চরিত্রটির মধ্যেও একটা স্বাভাবিকতা নিয়ে এলেন। তার মধ্যে একটু মায়া ঢেলে দিলেন। আর তাতে এই খলচরিত্রটাও একরঙা না হয়ে স্মরণীয় হয়ে উঠল। গল্পকারের স্বাতন্ত্র্য এখানেই। মানুষ খুনের এহেন পদ্ধতি বাঙালি পাঠক এর আগে দেখেনি।
#
এই শোষক শোষিতের বিষয়টি তাঁর গল্পগুলিতে কত বিচিত্রভাবেই না এসেছে। উল্লেখ করতে পারি তাঁর ‘জাইগেনসিয়া’ গল্পটির কথা। জাইগেনসিয়া আসলে এলা গাছ। গোলাপের মতো দেখতে। কিন্তু গোলাপ নয়। কষ্ট সহিষ্ণু এই গাছ কাদা জল রুক্ষ মাটি যেকোনো জায়গায় বেঁচে যায়। গোলাপ গাছের চোখ বেরোলে সেই চোখ কেটে বসিয়ে দিতে হয় এই এলা গাছের ডালে। সুখি গোলাপ কাদায় বাঁচে না। জংলা এলা গাছ সকল ঝক্কি সামলায়। আর গোলাপ শুধু এর রস খেয়ে ফুল ফোটায়।
বড়লোক গোপেশ্বর পালের মস্ত নার্সারি। কত জায়গায় তার গাছ যায়। আর সেই নার্সারির মালি নকুল। নকুলের গায়ের যা জোর, যা স্বাস্থ্য তাতে সে সত্তর বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারত। গোপেশ্বর তার নার্সারির ব্যবসার কথা ভেবে নকুলকে বিয়ে করতে না বলেছিল। তার বাড়িতে কয়েকজন বিধবা আছে। নকুলকে বলেছিল তাদের সঙ্গে সাধ-আহ্লাদ মিটাতে। ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে সে সামলাবে—“খাটালে রোজ দুধ মিললে কোন উজবুক গাই পোষে!” কিন্তু নকুল কথা শোনেনি। ঐ বিধবাদের একটাকে একদিন হুট করে বিয়ে করে বসল। মালি হিসেবে সে বড় ভালো বলে তাকে তাড়াতে পারল না।
নকুল এখন রাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে। তার ঘাঢ়ে কে যেন চেপে আছে তিন পুরুষ ধরে। গোপেশ্বর বেতন বাড়ায় না। তার বউ বলে অন্য কোথাও কাজ নিতে কিন্তু তা হবার উপায় নেই। কোন যুগ থেকে সে ঢুকেছে গোপেশ্বরের বাড়িতে। বছর শেষ হওয়ার আগে কিছু নগদে আগাম নিত। তা শোধ দিত না। সুদে আসলে বেড়ে যেত খাটালির দিন। বছর দশেক আগে শেষবার খোঁজ নিয়েছিল। তখনই মূল খাটালির উপর আরও বছর আটেক বেড়েছে। তারপর আর খবর নেয়নি।
বৃষ্টি হলে নিজের ঘরের কথা না ভেবে দৌড়োয় নার্সারিতে খোলা সারের বস্তা চাপা দিতে। দুবেলা বউ ছেলেকে ভালো করে খেতে দিতে পারে না, এদিকে গোপেশ্বরের সম্পত্তি বাড়তে থাকে। নকুল যেন নিজেই একটা এলা গাছ—জাইগেনসিয়া। আর গোপেশ্বর সুখি গোলাপ। অন্যের রক্ত-রস শুষে নিজে ফুল ফোটায়। এরমধ্যে এক রাতে সে দৌড়ে যায় নার্সারিতে। গোলাপের ডালগুলোকে কেটে মাটিতে পুঁতে দেয়। শ’য়ে শ’য়ে। সারারাত। আর তার গাঁটে গাঁটে এলাগাছের চোখ বসিয়েছে। সুখি গোলাপের ডালে কীকরে শিকড় হবে গোপেশ্বর জানতে চাইলে সে বলে—“হত্যে ও তো পারে। খাদ্য জুগান পেয়্যে পেয়্যে ইরা মেড়া মের্যে গেঁইছে এক্কেরে। দিন কতক রস না পেল্যে, আপ্সে শিকড় ছাড়তে বাধ্য। না খেয়্যেঁ কে আর মরত্যে চায় এই দোনিয়ায়?”
গোপেশ্বর থমথমে মুখে বলে—“যদি বাঁচেও, উপরের এলা গাছে ফুল ফুটবেক?” একটু চুপ থেকে সে উত্তর দেয়—“ফুটত্যেও তো পারে গ’ পালের পো। কে আর পরীক্ষা কর্যে দেখ্যেছে কুন্ দিন?” সারা বাগানে ঘুরে গোপেশ্বর বিরক্ত হয়ে দেখে গোলাপগুলোর গোড়ায় গোড়ায় এলা গাছের ঝাড় লকলকিয়ে বেড়েছে।
নকুল বোঝে তাকে সহজে ছাড়বে না গোপেশ্বর। সে নার্সারির কুঠরি থেকে সারের বস্তা বার করে এনে ছড়িয়ে দিল এলাগাছের গোড়ায়—“খা’। চটপট খেয়্যে ফ্যাল। অত খাটালি কর্যে দিনরাত কাদো-মাটিতে বস্যে বস্যে রস তুলিস্ তুয়ারা। টুকচান লা হয় খেল্যো তুয়াদের ব্যাটা-বেটিরা। উয়ারা তো তুয়াদের ঘাড়ের উপর বস্যে মজাসে খেত্যেই আছে, বারোমাস, তিরিশ দিন।”
গোপেশ্বরের সমস্ত সংগ্রহ নিঃশেষ করে উঠে দাঁড়াল নকুল। পাগলের মতো বুক চাপড়াতে লাগল এক অস্থির উন্মাদনায়।
এই গল্পে নকুল এবং এলাগাছ একাকার হয়ে গেছে। শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষ নকুল বুঝে নিতে পেরেছে নিজেদের ক্ষমতা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। আর এই অধিকার বুঝে নেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। সত্তর-আশির দশকের পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মানচিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বদল ঘটছে। মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করবার দিন শেষ হয়ে আসছে। মৌনমুখে জেগে উঠছে প্রতিবাদের ভাষা। ভগীরথ এই সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন শিল্পের আধারে। তাই তো এই জাইগেনসিয়ার রূপক। এলাগাছের ব্যঞ্জনা। এই ঐতিহাসিক মানচিত্র তুলে ধরবার ক্ষেত্রে লেখকের শিল্প-সত্তা ম্লান হয়ে যায়নি। ভগীরথের গল্পের স্বাতন্ত্র্য এখানেই।
এই সমাজ-বাস্তবতা কিছুটা অন্যভাবে এসেছে ‘ব্যাক্ড়া’ গল্পে। শিবের গাজনের একটি অনুষঙ্গ ব্যাকড়া। মেদিনীপুরে এই ধর্মীয় প্রথার বিশেষ প্রচলন আছে। গাজনের সময় শিবের বিশেষ ব্রতী ভক্ত এই ব্যাকড়ারা। ঢাকের তালে তালে এরা নাচে। নাচতে নাচতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। আবার ঢাকের তালে তালেই চেতনা পায়। ব্যাকড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে ঢাক ও ঢাকি। এই ব্যাকড়ার জন্য ঢাকে বিশেষ তাল তুলতে হয়। গাজনের ঢাকে কাঠি পড়লে ক্ষেপে যায় ব্যাকড়ারা। বনজঙ্গল চিরে ছুটে আসে শব্দ লক্ষ্য করে। ব্যাকড়া ও ঢাকির রগড়ের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক—
আপাতভাবে মনে হয় পুরো ব্যাপারটা সাজানো। বউ-ঝিদের মন ভোলানোর বন্দোবস্ত। আলোচ্য গল্পে বটাইয়েরও তাই মনে হয়েছিল। বটাইচাঁদ মাঝি দর্শকের জায়গা থেকে চলে এসেছিল মতিলালের সামনে। এক নাগাড়ে ঘন্টা দুই নেচেও ছিল। তার পর ব্যাক্ড়া ঢাকের মাতাল করা শব্দের শিকার হয়ে গেল। দু-ঘড়ি বেলায় যখন সানাই আর ঢাক বেজে উঠল তখন বটাই দাঁতন করছিল নিমগাছের তলায় বসে। একমনে শুনছিল ঢাকের বাদ্যি। খানিকবাদে গায়ে একটা শিরশিরানিভাব। রক্তের মধ্যে দপদপানি। একটা তাল বাজে তার মগজে। আর বটাই সেই তালে মাথা নাড়ছিল ধীরে ধীরে। “মস্তিষ্ক থেকে তালটা নাচতে নাচতে নামতে লাগলো বটাইয়ের শরীর বেয়ে। বটাই সামনে তাল ঠুকতে লাগলো, আর একটু একটু করে গিলতে লাগলো ভেসে আসা ঢাকের বাদ্যি। হাঁড়িয়ার চুমুকে চুমুকে শরীরের শিরশিরানি যেমন বেড়ে যায় একটু একটু করে, ঠিক তেমনি ঢাকের শব্দটা বটাইয়ের কান বেয়ে, শরীরের প্রতি রক্তকণা অস্তি-মজ্জার সঙ্গে মিশে, নেশাটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রমশ। ঢাকগুলো যেন ওদের ভাষায় ডাকছিল বটাইকে। বটাই নিজেকে সামলাতে পারছিল না কিছুতেই।”
তারপর জয়বাবা সন্তোষেশ্বর—পাতালফোঁড়—মহাদেব বলে ছুটে যায় ঢাকের শব্দ লক্ষ করে। সে যেন ঢাকি মতিলালের হাতের পুতুল। যতক্ষণ ঢাক বাজবে ততক্ষণ থামবার সাধ্য নেই তার। তার মরণ বাঁচন যেন মতিলালের হাতে। ঘন্টা খানেক নাচের পর সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সবাই ধরাধরি করে পৌঁছে দেয় বাড়িতে। পর পর তিনদিনই এমন হয়। ঢাকের শব্দ শুনে ছুটে যায়। পাগলের মতো নাচে। জ্ঞান হারিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে পড়ে থাকে। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রতিবেশীদের বুদ্ধিতে চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাজনের সময় বটাই ঢাকের শব্দ শোনা মাত্র ঘরে ঢুকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। আগড় ঘুলঘুলি বন্ধ করে বসে থাকে সে। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বছরের পর বছর এভাবেই ‘নরকযন্ত্রণা’ সহ্য করতে হয় তাকে।
অবশ্যি ঢাকের বাদ্যি মাত্রেই মাদকতা নয়। ‘ঢাক বড় রহস্যময় বস্তু’। সময় বিশেষে তার ভূমিকাও বিশেষ বিশেষ রকম। এগল্পে ঢাকের বিবিধ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। দুর্গা পূজার ঢাকের বাদ্যির তাল লয় আলাদা। প্রাণ জুড়িয়ে যায় তাতে। আর গাজনের ঢাকের আর এক বোল। মাথায় নেশা ধরিয়ে দেয়। আবার কৃষক নেতা সদানন্দ মাঝির বাড়িতে ইদানিং যে ঢাক বাজে তার শব্দ মানুষকে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিশ শতকের সত্তর-আশির দশকে—বামফ্রণ্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলিতে ব্যাপক হারে ভূমিসংস্কার হয়। অপারেশন বর্গার সুফল পেতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করা হয় অতিরিক্ত জমি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের হাতেও কিছু ক্ষমতা আসে। জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে আন্দোলন শুরু হয়। গ্রামীণ জমিদাররা তখন আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে কৌশলে জিইয়ে রাখতে চায় নিজেদের বিপুল সম্পত্তি। প্রতিপত্তিও। এই গল্পের চন্দ্রকান্ত মুখুজ্জে জমির উর্ধ্বসীমার বাইরে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি রেখেছে। বিভিন্ন গ্রামের লোকজনদের নামে। স্বর্গত লোকজনদের নামে, ঠাকুর দেবতার নামেও। সদানন্দের প্রাসঙ্গিক বক্তব্য—“শুধু চাকর-বাকর, অনুগতই না, ঠাকুর দ্যাবতা, রড়া-পাথরই না, গাছ-পালা কুত্তা বিল্লির নামেও জমিন রেখেছে শালারা।” চাউলকুন্ডি মৌজার তিনশো সাত দাগের দশ বিঘে জমিটা বটাইর নামে রেখেছে চন্দ্রকান্ত। পরে তার একান্ত অনুগত মতিলালকে দিয়ে দিতে চায় সেই জমি। কারণ হবু বউ টুলির কথায় বটাই রেজিস্ট্রির দিন ফিরে আসে রাস্তা থেকে। অথচ একদিন এই বটাই সদানন্দের নেতৃত্বে গরীবদের লড়াইতে যোগ দিতে চায়নি। গ্রামের বহু ক্ষেতমজুরই চন্দ্রকান্তবাবুদের ভয়ে, ভিটে থেকে উচ্ছেদ হবার ভয়ে পিছিয়ে ছিল। মাঝি পাড়া থেকে মিটিং-এর ডাক এলে ‘গা বড় খ্যারাব। থন্ডি-কাশ-জ্বর’—এই অজুহাতে এড়িয়েছে।
কিন্তু কতদিন আর এড়াবে! এ যে ভূমিহীনদের প্রাণের লড়াই। আর সে নিজেও তো প্রায় ভূমিহীন—দরিদ্র। চৈত্র-বৈশাখে গাজনের ঢাকের বাদ্যির ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না সে। কাজ কর্মের অভাবে খাবারও জোটে না। নিরম্বু উপবাসে কাটাতে হয় প্রায়। এই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মতিলাল তার লালসার থাবা বাড়ায় বটাইয়ের বউ টুলির দিকে। এর থেকে বাঁচার জন্য টুলি সন্তোষেশ্বরী মন্দিরে ভগবানের কাছে তার আর্জি জানায়। মতিলালকে খুঁজতে এসে বউয়ের কান্নাভেজা কথাগুলো কানে যায় তার—“হেই বাবা। মরদটাকে মোর ভালা করি দও। ব্যাকড়াভর উঁটিই লও অর উপর থিকে। হেই বাবা। ভোকে পাগল হই রই। কত আর ঠেকাই রাখবা মতিলালকে? কত আর লুকাই বুলবা এমা-সেমা দিন দিন। এক পেট ভোখলি, কত আর সামলাই রাখবা—নিজেকে? হেই বাবা গরিব মানুষের ঘরে এ ঘোড়ারোগ ক্যানে ঢুকালে, হেই বাবা!”
ব্যাক্ড়াভরকে আর ডরায় না বটাই। বউকে বলে—“মতিলালকে খুঁজি। শালার কাটিতে কতো জোর, একটিবার দেখতে চাই সেটা।”
শেষরাতে আবার বেজে ওঠে ঢাক। ডিম-ডিম, ডিডিম-ডিম... শব্দে সদানন্দের উঠোনে ঢাক বাজছে। এ ঢাক চার পাশের ক্ষেতমজুর ও ভাগচাষিদের ডাকছে। জরুরি খবর আছে। ভোর হবার আগে সকলকে জানাতে হবে। সামনের বর্ষায় বেনাম জমি দখলের লড়াই হবে। জোতদার আর পুলিশ রুখতে চায় সর্বশক্তি দিয়ে। শেষ রাতের বাতাসে ঢাকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। “বটাইয়ের কানের মধ্যে দিয়ে যে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে রক্তে রক্তে। মস্তিষ্কের মধ্যে একটা তাল বাজছে যেন। নতুন তাল। বটাই এক মুহুর্ত ইতস্তত করল। তার পর টুলির হাতখানা চেপে ধরে আচম্বিতে দৌড় মারল ঐ ঢাকের বাদ্যিকে নিশানা করে।”
এভাবে এক বাদ্যির নেশা কাটিয়ে আর এক বাদ্যির নেশায় মেতে ওঠে। বটাইয়ের এই উত্তরণ গ্রামীণ কৃষকের উত্তরণ। অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এভাবেই নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় পেয়েছে গ্রামীণ কৃষক। বেরিয়ে এসেছে জোতদার জমিদারের শিকল ছিঁড়ে।
এখানে বটাই একজন ব্যক্তিমাত্র নয়, সে একটি সমগ্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। ভগীরথের গল্পে ব্যক্তির গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ব্যক্তির থেকে সমষ্টিকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর বহু গল্পের ব্যক্তি চরিত্ররা আসলে বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এটা তাঁর গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য। গোষ্ঠী-সমষ্টি-কৌম তাঁর গল্পের কেন্দ্রে।
এখানেই উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর গল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য—ভৌগোলিকতা। শহর-মফস্সল সবই এসেছে তাঁর গল্পে। কিন্তু গ্রামেরই প্রাধান্য দেখি। আরও স্পষ্ট করে বললে মেদিনীপুরের—পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রাম—গ্রামীণ জীবন। শুধু পটভূমি পরিবেশ হিসেবে নয়, গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে গ্রাম। সেই গ্রাম এসেছে তার সকল ভৌগোলিকতা নিয়ে। সত্তর-আশির দশকে বাংলার গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তিত গ্রাম সবাক হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পে। এক-আধজন মানুষের জীবন-চর্যায় বদল আসেনি। গ্রামের সামগ্রিক যাপনচিত্রে বদল এসেছে। সেই বদলটাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ভগীরথ। শুধু ‘ব্যাক্ড়া’ গল্পে নয়, আরও বহু বহু গল্পে।
#
‘লেবারণ-বাদ্যিগর’ গল্পে আর এক ঢাকির প্রসঙ্গ। আর এক বাদ্যিকরের কথা। এই বাদ্যিকরের নাম লেবারণ। গাজনের বাদ্যি মাঝে মাঝে বাজালেও লেবারণ প্রধানত বিয়ের বাদ্যি বাজায়। ফুলশয্যার রাতে বর কনেকে নিয়ে যখন ঘরে খিল দেয়, তখন লেবারণ উঠোনে নেচে নেচে ঢোল বাজায় ঝাঁ গুড় গুড়, ঝাঁ গুড়। বহু জায়গায় এখনও বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে ব্যান্ড-পার্টি তাসাপার্টি বাজনা-বাদ্যির চল আছে।
নিজের ঘরে বউ না থাকলেও মেয়ে মানুষ নিয়ে কম নাড়া চাড়া করেনি লেবারণ। মালতী সুবচনী ললিতে কারো ঘরেই বারণ নেই তার। কিন্তু ‘সাঁঝের আঁধারে মেয়া মাইন্ষের ঘরে পা টিপে টিপে ঢোকা, আর ফুলশয্যের রাতে বৌয়ের ঘরে ঢোকা’ যে একই ব্যাপার নয় তা জানে লেবারণ। অথচ তারও বউকে নিয়ে ফুলশয্যায় যাওয়ার কথা ছিল। বিয়ে হয়েছিল তারও। অবশ্য বিয়ের ঘটনা আজ আর তার ভালো করে মনে পড়ে না। তখন তার বয়স সাত; আর বউয়ের দুই। কোলে চড়ে গিয়েছিল সে। বিয়ে করে ফিরেও ছিল কোলে চড়ে। হলুদ জলে ছোপানো ছোট আট হাত ধুতি পরিয়ে কীসব যেন হয়েছিল। অতি আবছা একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গোছের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে তার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝেছিল তার জন্য একজন দিন গুনছে।
বউ ঘরে আনার প্রসঙ্গ ওঠে লেবারণের বয়স যখন সতেরো। তার মনও আনচান করেছিল। পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছিল বারবার। বউ আনার দিন স্থির করতে গেল রসিক খুড়ো। শালপাতা দিয়ে মোড়া মাটির গাড়ুতে বোঁদের মেঠাই, হলুদে ছোপানো লালা পেড়ে শাড়ি, গুয়া পান সবই নিয়ে গেল। পরদিন বিকেলে ফিরে হতাশ করল লেবারণকে। তার ‘শউর’ বলেছে—“রূপার বাজু দিবার হক্ দ্যালো লেবারণের বাপের। সেটা দিতে লাগবে। আর লাগবে বাড়তি দুকুড়ি টাকা।”
তার জ্বালা বোঝে না কেউ। বছর খানেক এ নিয়ে গণ্ডগোল চলে। বউ আর আসে না। বাবা মা মরল। তারপর থেকে সে একা।
গল্পের শেষে অন্য এক চমক। রোহিণীতে বাজাতে এসে যে বউটার সঙ্গে রগড় করে সেই রাইমনিই তার পূর্ব স্ত্রী, শশী বাগলার মেয়ে। তা জানা ছিল না তার। রাইমনির ঘরে রাত কাটাতে আসে লেবারণ। আর রাইমনি লেবারণের গ্রামের নাম শুনে ভাবে তার পূর্ব স্বামীকে সে নিশ্চয়ই চিনবে। তার বিয়ের গল্প বলে। নিজের বউয়ের বিয়ের গল্প শুনতে হয় তাকে! সারা গায়ে কাঁটা দেয় তার। আঠাশ বছর বয়সে বউকে প্রথম দেখে সে। পলকহীন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে।
রাইমনি এখন অন্যের স্ত্রী। তার বাবা টাকার লোভে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছিল তার। কিন্তু রাইমনির অন্তরে প্রথম স্বামীর প্রতি প্রেম জেগে আছে আজও। তা বুঝতে পেরে লেবারণ জানতে চায়—এখন যদি সে এসে তাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। কিন্তু বুড়াকে ছেড়ে যাবে না সে। তৃপ্ত মুখে রাইমনি বলে একবার সে ফিট হয়ে গেছিল। “বুড়ার সে কি মড়াকান্না। ট্যাস্কি ভাড়া করে সদরে লি যাতে চায়।” রাইমনির চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে হতাশ হয় সে। রাইমনি তারপর বলে—“তুমার সাথে তার দেখা হলে বলো, সে যেন একটা বে’ করে সনসারী হয়। বলো, রাইমণির এই মিনতি তার ছিচরণে।”
লেবারণের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। রাইমণির স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মনটা স্পষ্ট হয়ে উঠল তার সামনে। তারপর রাইমণির সামনে থেকে কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচল সে।
লেবারণ একজন শিল্পী। শিল্পীর সংযম তার মধ্যে আছে। তাই সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সে রাইমণিকে তার লালসার শিকার করেনি। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছে সে। নিজেকে লুকোতে চেয়েছে। চমৎকার একটি প্রেমের গল্প হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত। লক্ষ করবার মতো এই প্রেমবোধ। রাইমণি তার শৈশবে বিয়ে করা, না দেখা বরকে ভালোবাসে। আবার অতি বৃদ্ধ বর্তমান স্বামীর প্রতি এই কিশোরীর প্রেমেরও ঘাটতি নেই। আমাদের প্রথাগত প্রেম বোধকে এগল্পে ভেঙে দিয়েছেন লেখক। ভগীরথের প্রেমের গল্পও তথাকথিত প্রেমের গল্পের মতো নয়।
ভগীরথ তাঁর গল্পে যৌন-প্রসঙ্গগুলির অবতারণা করেন অদ্ভুতভাবে। ‘রাবণ’, ‘জাইগেনসিয়া’ ‘ব্যাকড়া’ বা ‘লেবারণ বাদ্যিকর’—সবকটি গল্পে যৌনতার একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তা চরিত্র ও বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অন্যরকম এক যৌন ডিকশন তৈরি করেছে। একটিও যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহার না করে, যৌনদৃশ্যের অবতারণা না করেও লেখক বুঝিয়ে দেন বিষয়ের অন্তর্গত এই যৌন-প্রসঙ্গের কথা। যৌন-মনস্তত্ত্বের চমৎকার রূপায়ন ঘটেছে তাঁর গল্পগুলিতে।
#
ভগীরথ ব্যক্তিজীবনে নানান কিছুর চর্চা করেন। ম্যাজিক বনসাই কুটুম-কাটাম ইত্যাদি। এর কয়েকটির উপর তাঁর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে। আর এই সব চর্চাকে অনেকক্ষেত্রেই গল্পের বিষয় করে তোলেন। ওই বিষয়গুলির আলোচনা করবার জন্য গল্প লেখেন না। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাও সম্পৃক্ত হয়ে যায় গল্প লেখার সময়। শিল্প সৃষ্টির সময়। এবং কখনও-ই তা উক্ত বিষয়ের ঘেরাটোপে আটকে থাকে না। শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে ওঠে। আর এভাবেই ভগীরথের গল্পের বিষয়ের পরিধি ব্যপ্ত হয়। বৈচিত্র্য আসে তাতে। উল্লেখ করা যেতে পারে ‘কুটুক-কাটাম’ গল্পটির। এই গল্পের উৎপল কুটুম-কাটাম করে। ‘অভিব্যক্তি’ নামে তার শিল্পশালা আছে প্রত্যন্ত গ্রামে। কাঠ-কুটো, শিকড়-বাকড়ের মধ্যে হরেক ভঙ্গিমার মানুষ আর জীবজন্তুর শরীরকে অভিব্যক্ত করে। শুকনো একটা সাধারণ ডালে কী আশ্চর্য শিল্প-সামগ্রী লুকিয়ে থাকে তা বার করে সে। শুকনো ডাল নুনোতম কাটাছাঁটার ফলে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সুচাঁদ ওতোল দুই সহকারী তার। প্রতি বছর একটি উৎসবের আয়োজন করা হয় অভিব্যক্তিতে। কলকাতা থেকে বিখ্যাত শিল্পীরা আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আসে।
সেই উৎসবের প্রেক্ষাপটে এই গল্প। এসেছে অনেকের সঙ্গে শিল্পী কৃষ্ণা। সঙ্গে তার স্বামী তেলের ব্যবসায়ী সুরজিৎ। নিজের কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না সে। তাকে বড্ড বেরসিক মনে করে কৃষ্ণা। এখানে এসেছে মহুয়ার লোভে। সারাক্ষণ মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে সে। শিল্প-ইত্যাদির ব্যাপারে কোনও হুঁশ নেই তার। এরমধ্যে উৎপল সকলকে বলে এত কুটুম-কাটামের মধ্যে তার নিজের হাতের কোন্গুলো তা বলে দিতে পারলে সেগুলি দিয়ে দেবে। এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সকলেই প্রদর্শনীর মধ্যে খুঁজে বেড়ায় উৎপলের কাজ।
পরদিন বিদায় বেলায় একে একে সকলে জানায় তাদের দুটি করে নির্বাচন। কিন্তু সঠিক উত্তর দিতে পারে না কেউই। সুরজিৎ হঠাৎ একটা চান্স নিতে চায়। কৃষ্ণা স্বামীর এই প্রগলভতায় একটু বিরক্তই হয়। সুচাঁদ আর ওতোল ক্লান্ত শরীরে অতিথিদের সুটকেস বইছিল। সুরজিৎ তাদের দিকে তাকিয়ে বলে—“এই লরেল আর হার্ডি”।
উৎপল ভাষাহীন দাঁড়িয়েছিল তফাতে। সহসা ছুটে এসে সে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সুরজিৎকে। সুরজিৎ ঢুলু ঢুলু চোখে বলে—“দে এবার, মূর্তিদুটোকে দিয়ে দে আমায়। দে—দে—দে—।”
‘বনসাই পাল ও পুজো/৯২’ নামেও একটি গল্প আছে তাঁর। সেখানে বেঁটে মানুষ আর বনসাইকে একই পঙক্তিতে বসানো হয়েছে। তাই এহেন নামকরণ তার।
#
কত বিচিত্র রকমের চরিত্রের ভিড় ভগীরথের গল্পে। অদ্ভুত রকম পেশার মানুষ সব। ‘পটিদার’ গল্পে এসেছে এক পটিদার—পটুয়ার কথা। বাংলা গল্পে পটুয়ারা নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখানে যে পটুয়ার কথা বলেছেন লেখক তার কথা আমাদের কাছে নতুন বইকি। পটের ছবি আঁকা বা ছবি দেখিয়ে গান গাওয়া নয়, এই গল্পের ঝলক পটিদার মরা মানুষের ছবি আঁকে। আত্মীয়-স্বজনদের ছবি এঁকে দেখায় তাদের মৃত পূর্ব পুরুষ স্বর্গে কেমন আছে। কতটা সুখে বা কষ্টে আছে। সব পটুয়ারা মৃত মানুষদের দেখতে পায় না। তার জন্য গুণিন হতে হয়।
আগে কেবল মরবার সময়, পুড়িয়ে-টুড়িয়ে এসে পটিদার ডেকে ফটো আঁকাত মরে যাওয়া বাপ-মায়ের। এই লোক থেকে গিয়ে মানুষটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছল, কেমন রয়েছে এই সব দেখার জন্য। এখন মানুষের হাতে অনেক টাকা প্রতি বছর বার্ষিকির দিনে পটিদার ডাকে। আর পটিদার কাগজের উপর কাঠকয়লা দিয়ে একটা মানুষের মতো ছবি এঁকে বলে—বাপ/মা কষ্টে আছে। পরার কাপড় পর্যন্ত নেই—এইসব বলে কাপড়-চোপড় সিধে নিয়ে ফেরে।
তবে এই গল্পের ঝলকের আঁকার হাতটি চমৎকার। গুণিন-বিদ্যার সঙ্গে ছবি আঁকাটাও শিখেছিল সে। অভাবের সংসার। বিয়ের পর থেকে বউয়ের সঙ্গে তার রুগ্ন মায়ের খিটিমিটি লেগেইছিল। এখন বছর দুই বউয়ের পরামর্শে মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে ঘর থেকে। মাঝে মাঝে মা এসে কান্নাকাটি করে কিছু আদায় করে নিয়ে যায়।
এই ঝলক গরুড় মণ্ডলের মায়ের বার্ষিকিতে গেছে ছবি আঁকতে। বড়লোক গরুড়ের দেওয়ার হাতটাও বেশ। তাই আগে থেকেই তার মায়ের সম্বন্ধে কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে গেছে। ছবিটি এঁকে উল্টে রাখে সে। বাড়ির লোকজন ছাড়া পাড়াপ্রতিবেশীরাও ভিড় করেছে। ঝলক সকলকে সরিয়ে আলাদা করে গরুড়কে ডেকে ছবিটি দেখায়। সে ছবি দেখে আঁতকে ওঠে গরুড়—
সকলের সামনে এরকম ছবিটা না দেখিয়ে বিবেচকের কাজ করে ঝলক। তাই গরুড় তার নির্দেশ মতো সবই কিনে এনে দেয়—একটা ভালো দেখে শাড়ি, মাথার জন্য এক শিশি জবাকুসুম তেল, গায়ে মাখবার জন্য কেজিটাক সরষের তেল, চাল-ডাল-আনাজপাতি, আলতা, সিঁদুর, মাথা পরিষ্কার করার জন্য শ্যাম্পু, ভালো দেখে একটা টনিক, এক বোতল হরলিক্স।
খেয়েদেয়ে গড়িয়ে বিকেলে বেরোতে একটু দেরি হয়ে যায় ঝলকের। পাঁচ কিলোমিটার পথ। ঝলক জোরে পা চালায়। ভুতডাঙার শ্মশানের কাছে আসতেই অন্ধকার নামে। বুকটা ঢিপ ঢিপ করে। সহসা চোখের সামনে ছায়া মূর্তি। সারা গায়ে একগাছা সুতো নেই। ‘কে’—জিজ্ঞেস করলে খনখনে গলায় উত্তর আসে—“সে কী বাপ? ধিয়ানযোগে আমাকে দেইখ্যে আমার ফোটো এঁইক্যে অত বাহবা পেলি, আর স্বচক্ষে সুমুখে দেইখ্যেও চিনতে লারছু?” তারপর বলে—“আমার ব্যাটা যে সিধেপাতি পাঠালেক তুয়ার হাত দিয়ে, উগুলান তো কই আমাকে দিলি নাই।”
এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি তার। ভয়ে কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে রেখে জোরে পা চালায়। বাড়ি গিয়ে শোনে তার মা এসেছিল। বউ তার দুবরাজপুর যাওয়ার কথা জানিয়ে বিদায় করেছে। পরদিন সকালে হাটখোলার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অকস্মাৎ তার নজর যায় গাছের তলার দিকে। যেন ভুত দেখে সে। সেখানে বসে তার মা। গরুড় মণ্ডলের বাড়িতে পাওয়া নতুন শাড়িটা বেশ পেঁচিয়ে পরেছে। কপালে সিঁদুর। পায়ে আলতা। সামনে জবাকুসুম তেলের শিশি। রাজ-রাজেশ্বরীর ভঙ্গিমায় বসেছে মা। ব্যাটার চোখাচোখি হতে ঠোঁটের কোণে হাসল বুড়ি—“এক চিলতে ভারী মিহি-চিকন হাসি। সকালের নরম রোদ্দুরের সঙ্গে সেই হাসি মিশে যায় নিঃশেষে।”
ভগীরথের গল্পে একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে দারিদ্র্য। কিন্তু লেখকের বলার কৌশলে সেই দারিদ্র্য হাঁ মুখ করে থাকে না সবসময়। কিন্তু তাঁর গল্পের পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারেন গল্পের গ্রামীণ এই মানুষগুলির সংকট। খাদ্যের সংকট। সেই সংকট বা দারিদ্র্য মানুষকে নুইয়ে দেয়।
কিন্তু সবসময় নোয়াতে পারে না তা মানবিকতাকে। আত্মসম্মানকে। দারিদ্র্যের সেই জোর বোধহয় নেই। অন্তত হতদরিদ্র নকুলের সম্মানবোধকে নোয়াতে পারেনি। ‘কুঁজোপানা মানুষ’ গল্পের নকুলের।
সাধারণভাবে গ্রামের মানুষদের কিছুটা করুণার চোখে দেখে শহরের মানুষ। বিশেষ করে গ্রামের যেসব মানুষ কর্মসূত্রে শহরে থাকে, ভালো চাকরি করে তারা মাঝে সাঝে গ্রামে এলে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের, পুরনো বন্ধুদের নানাভাবে সাহায্য করে। এই সাহায্যের মধ্যে যতটা না সহানুভূতি থাকে তার থেকে বেশি থাকে দয়া দেখিয়ে নিজেকে সম্মানিত করবার প্রবণতা। ভালো চাকুরে বন্ধুদের কাছে গাঁয়ের দরিদ্র মানুষদেরও প্রত্যাশা থাকে। ‘কুঁজোপানা মানুষ’ গল্পের কেন্দ্রে এরকমই একটা বিষয় উঠে এসেছে। এই গল্পের কথক অমিত কলকাতার মস্ত চাকুরে। বছরে এক-আধবার গ্রামের বাড়িতে আসে। তখন নানা মানুষ নানান আবদার নিয়ে আসে তার কাছে। মেলার সময় পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। নকুল তার নাম। ছোটবেলা থেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান নকুল অমিতদের সকল আবদার মেটাত। গাছে উঠে ফল পাড়া থেকে পুকুর থেকে পদ্মচাকি তুলে আনা সবই সে একা করত।
নকুল গুছিয়ে কথা বলতে পারে। ধীরে ধীরে তার কথার বাঁধুনি আরও ভালো হয়েছে। নিজের দারিদ্র্যের কথা বলে। ছেলেটাকে না পড়িয়ে বাধ্য হয়ে লোকের বাড়িতে বাগাল হিসেবে রেখেছে। অমিতের মনে হয় কথার মনোহর ফাঁদ পাততে চাইছে নকুল। ছেলেবেলার সবই তার মনে আছে। স্মরণ করিয়ে দেয় নানা স্মৃতি। এই প্রসঙ্গে নকুল বলে—“তুমার তো সারাজীবনটাই পুঁজি, আমার যে ওই ছেলেবেলাটুকু ছাড়া আর পুঁজি বলতে কিছুই নাই।”
বন্ধুকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে দুজনে জিলিপি খায়। অমিত পয়সা দিতে চাইলে বাধা দেয় সে। বলে—“তুমি কেন দিবে? আমিই তো ডাকিয়া আনিয়া খাবালাম তুমাকে।” প্রায় জবরদস্তি দাম মেটায় নকুল। অমিতের মনে হয় বড় কোনও দাঁও মারতে চায় সে। একশোটাকার একটা নোট বার করে পকেটে রাখে। সুযোগ বুঝে দেবে। নকুল জানায় তার ছেলে মেলায় আসবে বলে অপেক্ষা করছে। মেলা দেখতে সে পয়সা দেবে। অমিত আরও একশো টাকার নোট পার্স থেকে বার করে পকেটে রাখে। একসময় নকুলের ছেলেও আসে। তাকে প্রণাম করে। আর তখনই দুশো টাকা বার করে তার হাতের দিকে বাড়ায় অমিত। নকুল আচমকা হাঁ-হাঁ করে ওঠে—“বাচ্চা ছেলিয়ার হাতে অত টাকা দেয় কেউ?” নিজে সে ছেলেকে একটাকা দিয়ে বিদায় করে।
নকুল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে করকরে টাকাগুলোর দিকে। অমিত বাড়ি যাবে বলে ছল করে পকেটে টাকাগুলো ভরে পা বাড়ায়। তার ধারণা ছিল নকুল এবার টাকা চাইবে। ডাকবে। ডাকলও সে। কিন্তু টাকার জন্য নয়। খুব ম্রিয়মাণ মুখে বলে—“ভাল থেকো। আবার আইলে যেন দেখা হয়। কখন যে আস, চলিয়া যাও, খাটাবাটায় ব্যস্ত থাকি, জানতেও পারি না।” খুব ধীর লয়ে কথাগুলো বলে তার কুঁজোপানা শরীরটাকে প্রাণপণে সোজা রাখবার চেষ্টা চালাতে চালাতে মানুষজনের ভিড়ে হারিয়ে গেল।
পকেটে করকরে নোটগুলো নিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যায় অমিত। দারিদ্র্য নকুলকে একেবারে কুব্জ করে দিয়েছে। কিন্তু তারমধ্যেও সে তার আত্মসম্মান বোধকে নুইয়ে দেয় না। বড়লোক বন্ধুর কাছে দয়া ভিক্ষা করেনি। আবার যেন দেখা হয়—এইটুকু চায় সে। শৈশবের বন্ধুত্বকে এরই মধ্যে অটুট রাখতে চেয়েছে। এবার বুঝি মস্ত চাকুরে সমাজের উঁচু তলার মানুষ অমিতই কুঁজো হয়ে যায়। এই গল্পের মধ্যে কোনও চমক নেই। লেখক নিঃশব্দে আমাদের শহুরে শিক্ষিত বড়লোকিয়ানার পিঠে সপাটে চাবুক মেরেছেন। আমাদের অবক্ষয়ী মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করেছেন ভগীরথ।
#
গ্রামীণ লোকাচার-কিংবদন্তী-মিথ-সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে বহু গল্প লিখেছেন ভগীরথ। এগুলিকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেন তিনি। আসলে সামগ্রিক গ্রামীণ আবহকে গল্পে নিয়ে আসতে চান। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য তাঁর ‘কাকচরিত্র’ গল্পটি। গ্রামের দিকে বিশ্বাস কাক ছদ্মবেশী মহাকাল। সাধ্য-সাধনা করে মানুষ কাকাসিদ্ধ হতে পারে। তারা কাকচরিত্র জানে। কাকের ভাষা বোঝে। কাকেদের হাজার ভাবগতিক নখদর্পণে তাদের। কাক দেখে বলে দিতে পারে মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ। এক কাকচরিত্রের কথা উঠে এসেছে এই গল্পে।
আরেকটি একটি গ্রামীণ কুসংস্কার—ধর্মীয় প্রথা অবলম্বন করে লেখা ‘ঘাতক’ গল্পটি। শ্যামা পূজার রাতে বহু জায়গায় আজও রটন্তী কালীর পূজা হয়। সাধারণভাবে শ্মশানে এই পূজা হয় বলে একে শ্মশানকালীও বলা হয়। এগল্পে শিয়ার বিঁধার রটন্তী কালীর প্রসঙ্গ এসেছে। এই কালী পূজার দিন রাতে এক এক জায়গায় হাজার হাজার পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। এতগুলো পশুর বলি দেয় একটি মাত্র মানুষ। সেই ঘাতক নির্দিষ্ট থাকে। প্রতি বছর সেই এই কাজটি করে। বংশানুক্রমে এই কাজ করে যায় তারা। আলোচ্য গল্পের ঘাতক করালী বাগদী। আর পুরোহিত পীতাম্বর মহাপাত্র। বলি দেওয়ার কাজে ঘাতকের একজন সহকারী থাকে। করালীর সহকারী গজ বাউরী অদ্ভুত কৌশলে পাঁঠার চারটে পা খিঁচে ধরে। পাঁঠা চিৎকার করে ওঠে ‘মা মা’ করে। সেই শব্দকে ছাপিয়ে বেজে ওঠে ঢাক ঢোল কাঁসর-ঘন্টা। তার সঙ্গে যোগ হয় শতশত পুণ্যার্থীর কণ্ঠ—মা, মাগো, করালবদনী, নৃমুণ্ডধারিণী। দয়া কর্ মা। তুষ্ট হ’।
পাঁচশো বাহাত্তরতম এবং শেষতম পাঁঠা বলি সমাপ্ত করে লুটিয়ে পড়ে আশি বছরের বৃদ্ধ করালী। সারাটা দিন অসুস্থ ছিল করালী। পূজার থানে আসার পথে একবার নেতিয়েও পড়েছিল। হাঁপানি রোগী। তার উপর সারাশরীর জুড়ে দগদগে ঘা, চুলকানি, চাকাচাকা দাগ। এতগুলো পশুবলি দেওয়ার ধকল সহ্য করতে পারে না। অবশ্য পুটিন্দর রানার মতো বিশ্বাসে অন্ধ কেউ কেউ বলে—“বলি দিতে ফের শরিরের ধকল হয় নাকি ? পাঁঠা কি উ কাটে ?...আরে উয়ার সাধ্যি কি, রাতভর হাজার হাজার পাঁঠা একনাগাড়ে কাটে। মায়ের মহিমা ছাড়া কিছো হয়?” রটন্তীকালীর স্থায়ী পুরোহিত পীতাম্বর মহাপাত্র অসুস্থ অজ্ঞান করালীর ওপর মন্ত্রঃপুত জল ছিটোতে থাকে আর মন্ত্র পড়ে চেঁচিয়ে—“ওঁ কালী কালী মহাকালী, চামুণ্ডা মুণ্ডমালিনী...। মাগো, জীবের কল্যাণে তুই-ই তো খড়্গরূপিণী হয়ে ছাগের পশু জন্ম বিনাশ করলি মা। ঘাতক তো উপলক্ষ মা। ওর সাথে ছলনা কেন ?”
এক সময় করালীর চেতনা আসে। এই করালীর বংশের ঘাতক হওয়ারও ইতিহাস আছে। কামেশ্বর বাগদীর ছেলেপুলে হচ্ছিল না। তার বউ শিয়ারবিঁধার চামুণ্ডা কালীর থানে ‘লিরম্বু’ হত্যা দেয় তিন দিন তিন রাত। তৃতীয় নিশিতে মা স্বপ্নে বলেন—“অরে কামেশ্বরিয়ার বউ, তুয়ার মরদকে বল্, মোর থানে ঘাতক হয়ে বলি দিক পশু। তুয়ারা হ’ শিয়ারবিঁধার চামুণ্ডা-কালীর ঘাতক বংশ। তুয়ার ভুবনভুলানো ছেইলা হবেক্। তার বাহু হবেক কলা গাছের গুঁড়িটি। তার অঙ্গের বর্ণ হবেক্ সোনার পারা। পলাশ পুষ্পের পারা আঁখি।” বউয়ের মুখে সব শুনে কামেশ্বর ছুটে যায় কালীর পুরোহিত মহাপাত্রদের বাড়ি। আর সেই বছরই রটন্তী-কালীর পুজোয় কামেশ্বর হেতার তুলল হাতে। কামেশ্বরের ছেলে হল চামুণ্ডা প্রসাদ। তার গায়ের রঙ যদিও ভুষা কালো। সেই কামেশ্বর করালীর ঠাকুদ্দার বাপ। সেই থেকে এই বংশের এই ধারা। করালীর পর তার ছেলে রটন্তী প্রসাদ হবে ঘাতক—“এ হল বংশের ধারা। ডুলুং নদীর জলের পারা। এক জল বয়ে যায় নীচালীর পানে। অন্য জল সে থান পূরণ করে। ফাঁকা থাকে না তিল—প্রমাণ ঠাঁই।” করালীর বউ অগ্নি মেনে নিতে পারেনি এই বলি। তাই করালী যেবার হেতার ধরলো সেবারই অগ্নি সম্পর্ক ঘুচিয়ে গ্রাম ছাড়লো।
একই গ্রামে একই সমাজে, এমনকি একই পরিবারে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে মানসিকতার ভিন্নতা চোখে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। এই গল্পেও এসেছে সেই প্রসঙ্গ। অনেকসময় গ্রামীণ অনুষঙ্গে মনে হয় এই বিশ্বাস-সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলি সামগ্রিকভাবে একটি গ্রাম সমাজের অমোঘ বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি মানুষের চেতনায় এগুলি ক্রিয়াশীল। অনেক গল্পকার তাঁদের লেখায় বিষয়গুলিকে এভাবেই তুলে ধরেন। ভগীরথ কিন্তু তাঁর এই গল্পে গ্রামীণ সংস্কারগুলির টলমলে অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বহু বছরের প্রচলিত দৈবী-বিশ্বাসেরও বদল ঘটছে। তাই গল্পেই দেখি মিটিং-এ কিছু শিক্ষিত যুবক বলীর বিরোধিতা করেছে। কৌমের মধ্যেও যে চিন্তার স্তরে, মানুষের বোধের জায়গায় ভিন্নতা থাকে তা ভগীরথ অস্বীকার করেননি। আর এই ভিন্নতা মানুষের সংসারকে, সম্পর্ককে, জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত এই গল্পে তা-ই দেখা গেল।
#
বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের ধারাটি ক্রম ক্ষীয়মাণ। সমসাময়িক যে অল্প কয়েকজন লেখক এই হাসির গল্পের ধারটিকে আজও বহমান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভগীরথ মিশ্র। প্রচুর হাসির গল্প লিখেছেন তিনি। ‘সরস গল্প’, ‘হাস্যৌষধি’ ইত্যাদি হাসির গল্পের পৃথক সংকলনও আছে তাঁর। তাঁর বহু গল্পের বিন্যাসের মধ্যেই আছে হাস্যরস। কোনও কোনও গল্পের বিষয়টাই হাসির। প্রকৃতপক্ষে তাঁর অধিকাংশ হাসির গল্পের বিষয়ই হাসির। এদিক থেকে অন্যান্য হাসির গল্পের লেখকের থেকে তিনি স্বতন্ত্র। স্যটায়ার এবং উইটের ঝাঁঝের থেকে বিশুদ্ধ হিউমার-ই বেশি এসেছে তাঁর গল্পে। হিউমারের মধ্যে মাঝে মাঝে হয়তো ঝিলিক দিয়ে ওঠে স্যাটায়ারের দ্যুতি। কিন্তু সেই স্যটায়ারও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঝাঁঝহীন। তাঁর হাসির গল্পগুলির জনপ্রিয়তার মূলেও এই হিউমার। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে হাস্যরস। কথার মারপ্যাঁচ, সংলাপ, শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাসে কৌতুকমণ্ডিত হয়ে ওঠে ভগীরথের গল্পের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট। হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেন তাঁর গল্পের পাঠক।
উল্লেখ করতে পারি ‘ফায়দা’ গল্পটির কথা। একজন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পোলিটিসিয়ান ষড়াননদার গল্প। কথক তথা লেখকের সহপাঠী। ছোটখাট নাদুসনুদুস চেহারার মানুষ। শৈশব থেকেই বিনয়ের অবতার। মানুষের সেবা করবার জন্যেই যেন জন্ম তার। যে কোনো নগণ্য ইস্যু থেকে ফায়দা তোলার ক্ষমতা ছিল। আর তার ফায়দা তুলবার কায়দাগুলো ছিল অন্য ধরনের। যেমন—“কাউকে টুপি পরাতে চাইলে, সে ভুলেও টুপির ধার-পাশ দিয়ে যেত না। শুরু করত একেবারে মোজা দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে..., নিঃশব্দে..., গুঁড়ি মেরে মেরে সে একটু একটু করে মাথার দিকে এগোত। অপর পক্ষ টের পাওয়া তো দূরের কথা, আন্দাজ করতেও পারত না, কী ঘটতে চলেছে ওর বরাতে। এক সময় নিঃশব্দ বধ হয়ে যেত।”
অযোধ্যা কাণ্ডে তার প্রতিক্রিয়া—“বহু দিন বাদে একটা মওক্কা পাইসি, ভাই।...পোলিটিসিয়ানদের কপালে অমন মওক্কা কদাচিৎ আসে”। এহেন ষড়াননদাকে পাড়ার ছেলেদের অনুরোধে পুষ্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার জন্য আহ্বান করতে যান লেখক। কিন্তু সেখানে কোনও ফায়দা নেই বলে আসতে চায়নি সে। লেখক তাকে বাতলে দেন ফুল থেকে অযোধ্যা যাওয়ার রুট—“ফুল থেকে ফল, ফল থেকে বীজ, বীজ থেকে গাছ, তা থেকে চলে যাও অশ্বত্থ ও আম গাছে, অশ্বত্থ ও আম, দুয়ে মিলে অশ্বত্থামা, তার থেকে মহাভারত, সেই প্রসঙ্গে রামায়ণ, আর, রামায়ণ মানেই অযোধ্যা।”
রুটটা লম্বা মনে হওয়ায় লেখক সর্ট-রুট বলে দেন—“ফুল—ফল—বীজ—গাছ—অর্জুনগাছ—অর্জুন মানেই বিরাট যোদ্ধা, আর যোদ্ধা থেকেই অযোধ্যা।”
বড় খুশি হয় সে। কয়েকটা পুষ্প প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছে বলে আক্ষেপ করে ষড়াননদা—হায়, হায়, ফুলকে আন্ডার-এস্টিমেট কইর্যা একডা ডাহা ফুলিশ কাম কইর্যা ফ্যালসি, ব্রাদার। আমার মতো ‘ফুল’ আর ভূ-ভারতে দুইট্টা নাই।”
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ থাকলেও মজা আর কৌতুকের কাছে সেই বিদ্রূপ ম্লান হয়ে যায়। ভগীরথের হাসির গল্পের বিশেষত্ব এখানেই। শুধু এই গল্পে নয়, তাঁর বহু হাসির গল্পে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের কেন্দ্রে থাকেন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা। ‘একটি নির্বাচনী বক্তৃতা’ গল্পের এম পি পাঁচবছরে কী কী কাজ করতে পেরেছেন তার ফিরিস্তি দিয়েছেন দ্বিতীয়বার নির্বাচনের আগে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারিত্ব। সেই সমস্যা কতটা দূর করেছেন তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন। তাতে দেখছি নিজের তিন ছেলে শুধুই নয়, তাঁর আত্মীয়-স্বজনদেরও চাকরি দিয়েছেন। যারা অশিক্ষিত তাদের লোন ইত্যাদি করে দিয়েছেন। নিজের আখের গোটানোর কথা বিস্তারিতভাবে বলে তিনি পরিষ্কার বলেন—
ভোট প্রার্থীর এহেন যুক্তিকে সত্যিই অস্বীকার করা যায় না। আরও বহু গল্পে ভগীরথ এভাবে সংলাপের মাধ্যমে গল্পকে রসঘন করে তুলেছেন। ‘কালচার দিয়া দ্যান’ গল্পের পুলিশ অফিসার বক্তৃতার সময় অনায়াসেই মিলিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ ও পুলিশকে। রবীন্দ্র সঙ্গীত উদ্ধৃত করে চোর-গৃহস্থ-পুলিশের সংলাপ সৃষ্টি করে কৌতুক রসমণ্ডিত করে তোলেন গল্পকে।
‘ঢেঁকিকল’ গল্পের বিদ্রূপের কেন্দ্রেও মহামান্য পণ্ডিত মন্ত্রী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের এই মন্ত্রী কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ক্ষ্যাপাবাবার আশীর্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন বলে মফস্সলের বিজ্ঞান মেলায় এসেছিলেন। সকাল থেকে পূজাপাঠ করে বেরোনোর সময় সেচভবনের দারোয়ান আচমকা হেঁচে ফেলায় পাক্কা দুমিনিট বসে গিয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয়বার বেরোতে যাবেন এমন সময় সেচভবনের দেওয়ালে পিঠ চিতিয়ে শুয়ে থাকা টিকটিকিটি পরপর দুবার টিক্-টিক্ করে ডেকে উঠেছে বলে তাঁকে আরও দুমিনিট বসে যেতে হয়েছে। তৃতীয়বার বেরোনোর এক মিনিট আগে বারবেলা পড়ে যাওয়ায় তিনি অপেক্ষা করেছেন চল্লিশ মিনিট। বিজ্ঞানমেলায় যাওয়ার আগে গেছেন চামুণ্ডা কালীর মন্দিরে। সেখান থেকে ক্ষ্যাপাবাবার প্রসাদ পেয়ে তারপর মেলায়। সেখানেও পিছন থেকে তাঁর সেকরেটারি ডেকেছিল বলে তোরণের কাছ থেকেই ফিরে যান তিনি। গাড়িতে কিছুক্ষণ বসে তারপর আসেন মেলায়। অথচ তাঁর বক্তৃতায় বিজ্ঞান প্রযুক্তির কথা বলেন, মানুষকে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের অন্ধকূপ থেকে টেনে তোলার কথা বলেন।
বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শনীর প্রথম স্থানাধিকারী মানবের মডেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা তাঁর। আর পর্দা সরানোর পর দেখা যায় কখন মডেলটি বদলে ফেলেছে প্রতিযোগী মানব নামের ক্ষ্যাপাটে ছেলেটি। সেখানে একটি নতুন মডেল—ক্ষ্যাপাবাবার আদলে একটি দাড়ি-গোঁফওয়ালা সন্ন্যাসীর মূর্তির সামনে মাথায় টুপি পরা এক মোটাসোটা ভূঁড়িওয়ালা হোঁদল কুতকুত মূর্তি দণ্ডায়মান, এই হল মডেল। সুইচ টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠল মূর্তি দুটি।
এবং তিনি যে একটি বিজ্ঞান মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে মন্ত্রীমশাই দু’হাত জড়ো করে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন ক্ষ্যাপা বাবার মডেলকে।
এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রীকে বিদ্রূপ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিদ্রূপের উপর পড়েছে চমৎকার এক হাসির মোড়ক। তাই আপাতভাবে তীক্ষ্ণ নয় সেই আক্রমন। উইট এবং স্যাটায়ারের সংমিশ্রণ-ই গল্পটির বিশিষ্টতা।
তবে সমসময় যে হাসি ও মজার মোড়কে আক্রমণ করেন তা নয়। ভগীরথের অনেক গল্পে এসেছে তীব্র তীক্ষ্ণ স্যাটায়ার। আর তাঁর এই স্যাটায়ারধর্মী গল্পগুলির আক্রমণের লক্ষ সাধারণভাবে প্রযুক্তি ও যন্ত্রসভ্যতা। যে প্রযুক্তি মানুষের জীবনের অনেক গভীরে ঢুকে যায় অনায়াসে। আবেগ কেড়ে নেয় তার বেগ। মোশন শুষে নেয় আমাদের সকল ইমোশন। তাঁর ‘ফ্যামিলি প্যাশন সেট’ গল্পে এই যান্ত্রিকতার প্রতি তীব্র আক্রমণ। এই গল্পে দেখি অদ্ভুত এক যন্ত্র। আদর খাওয়ার যন্ত্র।
নির্বাক নয়, সবাক আদর। সাউন্ড-সিস্টেমও রয়েছে এতে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে কার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে তা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে গল্পের কথক—আবিষ্কারককে। আর সেই সূত্রে ভগীরথ দেখিয়েছেন আমাদের সম্পর্কগুলিও কীরকম যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। প্রাত্যহিকতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যান্ত্রিকতা। আমাদের আবেগহীন যান্ত্রিকতা, যন্ত্র-নির্ভরতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ভগীরথ। তাঁর গল্পের তীব্র স্যাটায়ার নাড়িয়ে দিয়ে যায় পাঠকের অস্তিত্ব।
#
ভগীরথের গল্পবিশ্বের বিশিষ্টতা শুধু বিষয় বা উপস্থাপনের জন্য নয়। তাঁর গদ্যভাষাও গল্পগুলিকে স্বতন্ত্র করেছে। সেখানে দেখি চরিত্রদের সংলাপ ছাড়াও গদ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে গ্রামীণ ডায়ালেক্ট। গ্রাম-জীবনের প্রতিদিনের নিত্য ব্যবহৃত বাক্য শব্দ ধ্বনির ব্যবহারে স্বতন্ত্র এক গল্পভাষা নির্মাণ করেছেন ভগীরথ। বিষয়ের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা এই গদ্যভাষা গল্পের আবহে বাড়তি মাত্রা যোগ দেয়।
ভগীরথের সময়ে অনেকের গল্পেই এসেছে গ্রাম। গ্রামীণ পটভূমি, চরিত্র, বিষয়। কিন্তু এত এত গ্রামের গল্পের ভিড়েও ভগীরথের গল্পের গ্রামকে—তাঁর গল্পকে আলাদা করে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না মনস্ক পাঠকের। স্বতন্ত্র এক গ্রামীণ আকাশ দেখি তাঁর গল্পে। চেনা গ্রামকে কিছুটা অন্যভাবে তুলে ধরেন তিনি। কখনো-বা গ্রাম সম্পর্কে আমাদের আজন্ম লালিত বিশ্বাস নাড়িয়ে দেয়। গ্রাম—গ্রামের মানুষ সম্পর্কে শহুরে মানুষের আপাত ধারণাগুলোকে ভেঙে দেয় ভগীরথের গল্প। শহরে যেমন নানারকম মানুষ থাকে, গ্রামের মানুষও তেমনি সরল-জটিল ভালো-মন্দে ভরা। হিংসা ঈর্ষা শত্রুতায় গ্রামের মানুষেরাও কম যায় না। গ্রামীণ প্রাত্যহিকতার জীবন্ত সত্যকে তুলে ধরেন তিনি।
আর সেই প্রাত্যহিকতায় সম্পৃক্ত হয়ে থাকে সমসময়ের রাজনৈতিক অনুষঙ্গগুলিও। বিশেষ করে তাঁর প্রথম দিকের গল্পে এই সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে। খুব কম লেখকই সত্তর-আশির দশকের ঐ ঐতিহাসিক অনুষঙ্গকে লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অভিঘাত প্রবলভাবে এসেছে তাঁর গল্পে। আসলে এই অভিঘাত শহরের তুলনায় গ্রামগুলোতেই বেশি করে পরিবর্তন এনেছিল। গ্রামীণ মানুষের ভিতরতন্ত্রীতে ঘা দিয়েছিল। গ্রাম সমাজের শোষক শোষিতের সমস্ত অভ্যস্ত ছককে পাল্টে দিয়েছিল। তাঁর গল্পের পাঠক্রিয়ায় এই কালান্তরকে ধরা যায়। কিন্তু এই কালান্তর—এই অস্তিরতার সময় তাঁর গল্পের গল্পত্বকে ছাড়িয়ে উচ্চকিত হয়ে থাকে না। আশ্চর্য দক্ষতায় গল্পের ভিতরে ভিতরে ধরা থাকে সময়ের জলছবি। ফলে ভগীরথের গল্পভুবন যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তাঁর গল্পের গ্রামের ভুবনও স্বতন্ত্র পড়ে।
এই ভুবনায়নের যুগে সারা পৃথিবী একটিই বৃহত্তর গ্রাম। সেই ভুবনগ্রামের বাসিন্দারা আর নিজেদের তো শহুরে বলে দাবি করতে পারেন না। এহেন প্রেক্ষাপটে ভগীরথের গল্পকে আর গ্রামের গল্প বলে স্বতন্ত্র সারিতে সরিয়ে রাখার জো থাকে না। তাই ভগীরথের গ্রামজীবনের গল্পও প্রকৃত প্রস্তাবে বৃহৎ ভুবনেরই গল্প হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে এই ভুবনগ্রামের বাসিন্দাদের গল্পও।
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
রাজ অ্যাপার্টমেন্ট, ডি সি আর রোড, মুখার্জি বাগান, চন্দননগর, হুগলী-৭১২১৩৬
ভগীরথ মিশ্র জন্মসূত্রে মেদিনীপুরের মানুষ। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়ি থানার সাঁতরাপুর গ্রামে জন্ম তাঁর। লেখালেখি শুরু করেন সত্তরের দশকে। সেই সংকটময় সময়ে দাঁড়িয়ে লিখলেন তাঁর আবাল্যের গ্রামের গল্প। বাল্য-কৈশোরের গ্রামীণ দৃশ্যপট—স্মৃতির ভাণ্ডার থেকে উঠে এল তাঁর লেখার বিষয়—পটভূমি। গ্রাম সম্পর্কে তিনি এক জায়গায় বলেছেন—“একেবারে সামন্ততান্ত্রিক পরিমণ্ডল, ঘরে ও বাইরে। চারপাশে আদিবাসীদের গ্রাম। সন্ধে প্রহরে মাদলের দ্রিমি দ্রিমি বোল ভেসে আসে হাওয়ায়। শাল-মহুয়ার জঙ্গল নিরন্তর হাতছানি দিয়ে ডাকে।”
তাঁর বহু গল্পের কেন্দ্রে এরকম সামন্ততান্ত্রিক গ্রাম। আদিবাসী মানুষজন। শাল-মহুয়ার জঙ্গল। ভগীরথের লেখক সত্তার বৈশিষ্ট্য এই গ্রামীণতা। তিনি বিশ্বাস করেন গ্রামীণ ভারতবর্ষে। সেখানে সেই অর্থে শহরের কোনও অস্তিত্বই নেই। এমনকি কলকাতা শহরটাকেও তাঁর মনে হয় বৃহদাকার গ্রাম। সত্যিই তো শহরের মধ্যেও লুকিয়ে আছে গ্রাম। গ্রাম্যতা সেখানেই বেশি। তাই তিনি বলেন একজন লেখককে জীবনে অন্তত একটি গ্রামের গল্প লিখতে হয়—না হলে তার ‘কলমশুদ্ধি’ হয় না। এরকম একটি বোধ ও চেতনা থেকে তিনি গল্প লেখেন।
#
ভগীরথ মনে করেন, শোষণ মানুষের একটা অতি প্রয়োজনীয় প্রবৃত্তি। সেই প্রবৃত্তির তাড়নায় মানুষ শোষণ করে। প্রতিটি মানুষই তার থেকে দুর্বলকে শোষণ করে। না হলে বেঁচে থাকতেই পারবে না। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পুরো সময়কালটিই তো একটা ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন শোষণের ইতিহাস। শুধু মাত্র খাদ্যের প্রয়োজনেও মানুষ শোষণ করতে বাধ্য। ভগীরথ তাঁর বহু গল্পে এই ভাবনাটিকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন।
যেমন তাঁর ‘রাবণ’ গল্পটি। গল্পের প্রধান চরিত্র রাবণ মাঝি ছোটবেলায় জমিদার সতীকান্ত সিংহের কোপানলের শিকার হয় সপরিবারে। রাবণের বাবা দিদি ভাই সবাই চরম লাঞ্ছিত হয়। ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সিংহ। উপবাসে-ভিক্ষে করে-জঙ্গলের ফল-পাকুড় খেয়ে নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রেখেছে। তার আঠারো বছরের দিদি সিংহবাবুর কামনার শিকার হয়। পরে মরতেও হয় তাকে। তারপর রাবণ শুধু ‘পেটভাতুয়ায়’ শক্তিচঁদের বাড়ির কাজ করে। গুড়ের মহালের গুড় জাল দেয়। এভাবে প্রতিমুহুর্তে শোষিত হতে হতে এক সহৃদয় বিডিও সাহেবের কল্যানে ঘোড়ার গাড়ি পেয়ে যায় ব্যাঙ্ক থেকে। পরে নিজেই মহাল খোলে গুড়ের। ‘আড়াই কুড়ি উম্বরের’ রাবণের ‘বিয়া’ করা হয় না আর।
আজন্ম শোষিত লাঞ্ছিত রাবণ আজ শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তার মহালের রাতের জাগুয়া প্রহরাজ বেজের স্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়ে প্রহরাজকে হত্যা করে। শুধু হত্যা নয়, যেভাবে প্রহরাজকে খুন করে রাবণ, তা সকল নৃশংসতাকে হার মানায়। প্রহরাজকে সে অত্যধিক মদ খাইয়ে বেহুঁশ করে দেয়। দুগাছা মোটা পাটের দড়ি দিয়ে তেঁতুল গাছের সঙ্গে বেড় দিয়ে শক্ত করে বাঁধে। হাত-পা কষে বাঁধা। বেহুঁশ প্রহরাজ জিজ্ঞেস করে, “আমাকে বাঁইধ্ল্যে ক্যানে রাবণদা ? বাঁইধ্ল্যে ক্যানে ?” রাবণের অভয় বাণী, “অমনি রে। ভয় পাস্ নাই।”
তার পরনের কাপড় খুলে মুখ বেঁধে দেয় রাবণ। দড়িগাছা দিয়ে পা থেকে গলা অবধি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গাছের সঙ্গে বাঁধে। তার নিজের বর্ণনায়—
আড়ত থেকে একখানা গুড়ের পায়া এনে গাছের তলায় রাখি। তারপর খাবলা খাবলা গুড় নিয়ে যেমন করে আবড়া মেয়ার গায়ে তেল-হলুদ মাখায় বিয়ার আগে, ঠিক তেমনি করে মাখাতে থাকি প্রহরাজের সারা গায়ে। বেশ পরিপাটি করে মাখাই। নাকের ছ্যাঁদা, কানের গর্ত, চোখ, মুখ, লিঙ্গ, অণ্ডকোষ—কিছুই বাদ দিই না।
গুড়ের মিঠে গন্ধে গাছের বিষ পিঁপড়েরা প্রহরাজের সর্বাঙ্গে কুরে কুরে ঝাঁঝরা করে দেয়। মর্ম-বিদারক মৃত্যুমুখে ফেলে রাবণ প্রহরাজের ঘরের দিকে এগোয়। কিন্তু ঘরের কাছে এসে সামলে নেয় নিজেকে। “আজ রাতে কদাচ লয়। সতীকান্ত সিংহবাবু বারবার বলতেন, ‘কোনও অবস্থাতেই সংযম হারাতে না।’ যে রমণীর সোয়ামী লরক-যন্তণ্ণা পেতে পেতে মরছে শীতের রাতে, তেঁতুল তলায়, নিঃশব্দে,—উহার সাথে সহবাস! মহাপাপ হব্যেক তাতে। আর একথা দুনিয়ার কে-ই বা না জানে যে পাপ উয়ার বাপকেও নাই ছাড়ে!”
একজন খুনির মুখে পাপ-পুণ্যের কথা! মানুষটাকে খুন করবার জন্য তার মনে কোনও পাপবোধ জন্মায়নি। কিন্তু মৃত্যু পথযাত্রী মানুষের স্ত্রীর সঙ্গে সহবাসকে ভয়ানক পাপ মনে করছে সে। এবং নিজেকে সংযতও করছে। এখানে কোথায় যেন তার মধ্যে একটা সততা দেখি। একজন নৃশংস মানুষের মধ্যেও তার মতো বিশ্বাস-অবিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ থাকে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে দেখি এই ধরনের চরিত্র নির্মাণে লেখক একপেশে হয়ে যান। ভগীরথ এই খল চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে সে পথে হাঁটেননি। একটিমাত্র বাক্য খরচ করে লম্পট চরিত্রটির মধ্যেও একটা স্বাভাবিকতা নিয়ে এলেন। তার মধ্যে একটু মায়া ঢেলে দিলেন। আর তাতে এই খলচরিত্রটাও একরঙা না হয়ে স্মরণীয় হয়ে উঠল। গল্পকারের স্বাতন্ত্র্য এখানেই। মানুষ খুনের এহেন পদ্ধতি বাঙালি পাঠক এর আগে দেখেনি।
#
এই শোষক শোষিতের বিষয়টি তাঁর গল্পগুলিতে কত বিচিত্রভাবেই না এসেছে। উল্লেখ করতে পারি তাঁর ‘জাইগেনসিয়া’ গল্পটির কথা। জাইগেনসিয়া আসলে এলা গাছ। গোলাপের মতো দেখতে। কিন্তু গোলাপ নয়। কষ্ট সহিষ্ণু এই গাছ কাদা জল রুক্ষ মাটি যেকোনো জায়গায় বেঁচে যায়। গোলাপ গাছের চোখ বেরোলে সেই চোখ কেটে বসিয়ে দিতে হয় এই এলা গাছের ডালে। সুখি গোলাপ কাদায় বাঁচে না। জংলা এলা গাছ সকল ঝক্কি সামলায়। আর গোলাপ শুধু এর রস খেয়ে ফুল ফোটায়।
বড়লোক গোপেশ্বর পালের মস্ত নার্সারি। কত জায়গায় তার গাছ যায়। আর সেই নার্সারির মালি নকুল। নকুলের গায়ের যা জোর, যা স্বাস্থ্য তাতে সে সত্তর বছর পর্যন্ত কাজ করতে পারত। গোপেশ্বর তার নার্সারির ব্যবসার কথা ভেবে নকুলকে বিয়ে করতে না বলেছিল। তার বাড়িতে কয়েকজন বিধবা আছে। নকুলকে বলেছিল তাদের সঙ্গে সাধ-আহ্লাদ মিটাতে। ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে সে সামলাবে—“খাটালে রোজ দুধ মিললে কোন উজবুক গাই পোষে!” কিন্তু নকুল কথা শোনেনি। ঐ বিধবাদের একটাকে একদিন হুট করে বিয়ে করে বসল। মালি হিসেবে সে বড় ভালো বলে তাকে তাড়াতে পারল না।
নকুল এখন রাতে ধড়ফড় করে উঠে বসে। তার ঘাঢ়ে কে যেন চেপে আছে তিন পুরুষ ধরে। গোপেশ্বর বেতন বাড়ায় না। তার বউ বলে অন্য কোথাও কাজ নিতে কিন্তু তা হবার উপায় নেই। কোন যুগ থেকে সে ঢুকেছে গোপেশ্বরের বাড়িতে। বছর শেষ হওয়ার আগে কিছু নগদে আগাম নিত। তা শোধ দিত না। সুদে আসলে বেড়ে যেত খাটালির দিন। বছর দশেক আগে শেষবার খোঁজ নিয়েছিল। তখনই মূল খাটালির উপর আরও বছর আটেক বেড়েছে। তারপর আর খবর নেয়নি।
বৃষ্টি হলে নিজের ঘরের কথা না ভেবে দৌড়োয় নার্সারিতে খোলা সারের বস্তা চাপা দিতে। দুবেলা বউ ছেলেকে ভালো করে খেতে দিতে পারে না, এদিকে গোপেশ্বরের সম্পত্তি বাড়তে থাকে। নকুল যেন নিজেই একটা এলা গাছ—জাইগেনসিয়া। আর গোপেশ্বর সুখি গোলাপ। অন্যের রক্ত-রস শুষে নিজে ফুল ফোটায়। এরমধ্যে এক রাতে সে দৌড়ে যায় নার্সারিতে। গোলাপের ডালগুলোকে কেটে মাটিতে পুঁতে দেয়। শ’য়ে শ’য়ে। সারারাত। আর তার গাঁটে গাঁটে এলাগাছের চোখ বসিয়েছে। সুখি গোলাপের ডালে কীকরে শিকড় হবে গোপেশ্বর জানতে চাইলে সে বলে—“হত্যে ও তো পারে। খাদ্য জুগান পেয়্যে পেয়্যে ইরা মেড়া মের্যে গেঁইছে এক্কেরে। দিন কতক রস না পেল্যে, আপ্সে শিকড় ছাড়তে বাধ্য। না খেয়্যেঁ কে আর মরত্যে চায় এই দোনিয়ায়?”
গোপেশ্বর থমথমে মুখে বলে—“যদি বাঁচেও, উপরের এলা গাছে ফুল ফুটবেক?” একটু চুপ থেকে সে উত্তর দেয়—“ফুটত্যেও তো পারে গ’ পালের পো। কে আর পরীক্ষা কর্যে দেখ্যেছে কুন্ দিন?” সারা বাগানে ঘুরে গোপেশ্বর বিরক্ত হয়ে দেখে গোলাপগুলোর গোড়ায় গোড়ায় এলা গাছের ঝাড় লকলকিয়ে বেড়েছে।
নকুল বোঝে তাকে সহজে ছাড়বে না গোপেশ্বর। সে নার্সারির কুঠরি থেকে সারের বস্তা বার করে এনে ছড়িয়ে দিল এলাগাছের গোড়ায়—“খা’। চটপট খেয়্যে ফ্যাল। অত খাটালি কর্যে দিনরাত কাদো-মাটিতে বস্যে বস্যে রস তুলিস্ তুয়ারা। টুকচান লা হয় খেল্যো তুয়াদের ব্যাটা-বেটিরা। উয়ারা তো তুয়াদের ঘাড়ের উপর বস্যে মজাসে খেত্যেই আছে, বারোমাস, তিরিশ দিন।”
গোপেশ্বরের সমস্ত সংগ্রহ নিঃশেষ করে উঠে দাঁড়াল নকুল। পাগলের মতো বুক চাপড়াতে লাগল এক অস্থির উন্মাদনায়।
এই গল্পে নকুল এবং এলাগাছ একাকার হয়ে গেছে। শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষ নকুল বুঝে নিতে পেরেছে নিজেদের ক্ষমতা। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। আর এই অধিকার বুঝে নেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলির একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। সত্তর-আশির দশকের পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মানচিত্রটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার বদল ঘটছে। মুখ বুঝে অত্যাচার সহ্য করবার দিন শেষ হয়ে আসছে। মৌনমুখে জেগে উঠছে প্রতিবাদের ভাষা। ভগীরথ এই সমাজবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন শিল্পের আধারে। তাই তো এই জাইগেনসিয়ার রূপক। এলাগাছের ব্যঞ্জনা। এই ঐতিহাসিক মানচিত্র তুলে ধরবার ক্ষেত্রে লেখকের শিল্প-সত্তা ম্লান হয়ে যায়নি। ভগীরথের গল্পের স্বাতন্ত্র্য এখানেই।
এই সমাজ-বাস্তবতা কিছুটা অন্যভাবে এসেছে ‘ব্যাক্ড়া’ গল্পে। শিবের গাজনের একটি অনুষঙ্গ ব্যাকড়া। মেদিনীপুরে এই ধর্মীয় প্রথার বিশেষ প্রচলন আছে। গাজনের সময় শিবের বিশেষ ব্রতী ভক্ত এই ব্যাকড়ারা। ঢাকের তালে তালে এরা নাচে। নাচতে নাচতে বেহুঁশ হয়ে পড়ে। আবার ঢাকের তালে তালেই চেতনা পায়। ব্যাকড়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে ঢাক ও ঢাকি। এই ব্যাকড়ার জন্য ঢাকে বিশেষ তাল তুলতে হয়। গাজনের ঢাকে কাঠি পড়লে ক্ষেপে যায় ব্যাকড়ারা। বনজঙ্গল চিরে ছুটে আসে শব্দ লক্ষ্য করে। ব্যাকড়া ও ঢাকির রগড়ের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক—
মতিলাল বাজাচ্ছিল। পেটাই শরীর। মাথা কালিবর্ণ ঝাঁকড়া চুল বাদ্যির তালে তালে ঝাপটা মারছিল চোখে। লাল ভাটার মতো চোখদুটো কেবল জ্বলছিল আর নিভছিল। ব্যাক্ড়ারা নাচছিল মতিলালের ঢাকের সুমুখে। বাদ্যির তালে বার বার ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ঢাকের ওপর। হেইও। মতিলাল তাল ঠুকে এগিয়ে আসে দুপা। চওড়া কাঁধে ঢাকের দড়ি টেঁসে বসেছে। দরদরিয়ে ঘাম ঝরছে। খামালুর মতো ডুমো ডুমো পেশী ফুলে ফুলে উঠেছে বাহুতে, দাপনায়, পায়ের ডিমে। ব্যাক্ড়াদের সমবেত তাড়া খেয়ে দুপা পিছিয়ে যায় মতিলাল। পর মুহুর্তে হেইও বলে ব্যাক্ড়াদের তাড়া করে।
আপাতভাবে মনে হয় পুরো ব্যাপারটা সাজানো। বউ-ঝিদের মন ভোলানোর বন্দোবস্ত। আলোচ্য গল্পে বটাইয়েরও তাই মনে হয়েছিল। বটাইচাঁদ মাঝি দর্শকের জায়গা থেকে চলে এসেছিল মতিলালের সামনে। এক নাগাড়ে ঘন্টা দুই নেচেও ছিল। তার পর ব্যাক্ড়া ঢাকের মাতাল করা শব্দের শিকার হয়ে গেল। দু-ঘড়ি বেলায় যখন সানাই আর ঢাক বেজে উঠল তখন বটাই দাঁতন করছিল নিমগাছের তলায় বসে। একমনে শুনছিল ঢাকের বাদ্যি। খানিকবাদে গায়ে একটা শিরশিরানিভাব। রক্তের মধ্যে দপদপানি। একটা তাল বাজে তার মগজে। আর বটাই সেই তালে মাথা নাড়ছিল ধীরে ধীরে। “মস্তিষ্ক থেকে তালটা নাচতে নাচতে নামতে লাগলো বটাইয়ের শরীর বেয়ে। বটাই সামনে তাল ঠুকতে লাগলো, আর একটু একটু করে গিলতে লাগলো ভেসে আসা ঢাকের বাদ্যি। হাঁড়িয়ার চুমুকে চুমুকে শরীরের শিরশিরানি যেমন বেড়ে যায় একটু একটু করে, ঠিক তেমনি ঢাকের শব্দটা বটাইয়ের কান বেয়ে, শরীরের প্রতি রক্তকণা অস্তি-মজ্জার সঙ্গে মিশে, নেশাটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল ক্রমশ। ঢাকগুলো যেন ওদের ভাষায় ডাকছিল বটাইকে। বটাই নিজেকে সামলাতে পারছিল না কিছুতেই।”
তারপর জয়বাবা সন্তোষেশ্বর—পাতালফোঁড়—মহাদেব বলে ছুটে যায় ঢাকের শব্দ লক্ষ করে। সে যেন ঢাকি মতিলালের হাতের পুতুল। যতক্ষণ ঢাক বাজবে ততক্ষণ থামবার সাধ্য নেই তার। তার মরণ বাঁচন যেন মতিলালের হাতে। ঘন্টা খানেক নাচের পর সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। সবাই ধরাধরি করে পৌঁছে দেয় বাড়িতে। পর পর তিনদিনই এমন হয়। ঢাকের শব্দ শুনে ছুটে যায়। পাগলের মতো নাচে। জ্ঞান হারিয়ে দাঁত খিঁচিয়ে পড়ে থাকে। প্রাণ যায় যায় অবস্থা। প্রতিবেশীদের বুদ্ধিতে চৈত্র-বৈশাখ মাসে গাজনের সময় বটাই ঢাকের শব্দ শোনা মাত্র ঘরে ঢুকে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়। আগড় ঘুলঘুলি বন্ধ করে বসে থাকে সে। ভ্যাপসা গরমের মধ্যে বছরের পর বছর এভাবেই ‘নরকযন্ত্রণা’ সহ্য করতে হয় তাকে।
অবশ্যি ঢাকের বাদ্যি মাত্রেই মাদকতা নয়। ‘ঢাক বড় রহস্যময় বস্তু’। সময় বিশেষে তার ভূমিকাও বিশেষ বিশেষ রকম। এগল্পে ঢাকের বিবিধ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। দুর্গা পূজার ঢাকের বাদ্যির তাল লয় আলাদা। প্রাণ জুড়িয়ে যায় তাতে। আর গাজনের ঢাকের আর এক বোল। মাথায় নেশা ধরিয়ে দেয়। আবার কৃষক নেতা সদানন্দ মাঝির বাড়িতে ইদানিং যে ঢাক বাজে তার শব্দ মানুষকে বাঁচতে উদ্বুদ্ধ করে।
বিশ শতকের সত্তর-আশির দশকে—বামফ্রণ্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগুলিতে ব্যাপক হারে ভূমিসংস্কার হয়। অপারেশন বর্গার সুফল পেতে শুরু করে সাধারণ মানুষ। ভূমিহীনদের মধ্যে বিলি করা হয় অতিরিক্ত জমি। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের হাতেও কিছু ক্ষমতা আসে। জোতদার জমিদারদের বিরুদ্ধে সমবেত ভাবে আন্দোলন শুরু হয়। গ্রামীণ জমিদাররা তখন আইনের ফাঁক ফোকর খুঁজে কৌশলে জিইয়ে রাখতে চায় নিজেদের বিপুল সম্পত্তি। প্রতিপত্তিও। এই গল্পের চন্দ্রকান্ত মুখুজ্জে জমির উর্ধ্বসীমার বাইরে বেনামে প্রচুর সম্পত্তি রেখেছে। বিভিন্ন গ্রামের লোকজনদের নামে। স্বর্গত লোকজনদের নামে, ঠাকুর দেবতার নামেও। সদানন্দের প্রাসঙ্গিক বক্তব্য—“শুধু চাকর-বাকর, অনুগতই না, ঠাকুর দ্যাবতা, রড়া-পাথরই না, গাছ-পালা কুত্তা বিল্লির নামেও জমিন রেখেছে শালারা।” চাউলকুন্ডি মৌজার তিনশো সাত দাগের দশ বিঘে জমিটা বটাইর নামে রেখেছে চন্দ্রকান্ত। পরে তার একান্ত অনুগত মতিলালকে দিয়ে দিতে চায় সেই জমি। কারণ হবু বউ টুলির কথায় বটাই রেজিস্ট্রির দিন ফিরে আসে রাস্তা থেকে। অথচ একদিন এই বটাই সদানন্দের নেতৃত্বে গরীবদের লড়াইতে যোগ দিতে চায়নি। গ্রামের বহু ক্ষেতমজুরই চন্দ্রকান্তবাবুদের ভয়ে, ভিটে থেকে উচ্ছেদ হবার ভয়ে পিছিয়ে ছিল। মাঝি পাড়া থেকে মিটিং-এর ডাক এলে ‘গা বড় খ্যারাব। থন্ডি-কাশ-জ্বর’—এই অজুহাতে এড়িয়েছে।
কিন্তু কতদিন আর এড়াবে! এ যে ভূমিহীনদের প্রাণের লড়াই। আর সে নিজেও তো প্রায় ভূমিহীন—দরিদ্র। চৈত্র-বৈশাখে গাজনের ঢাকের বাদ্যির ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় না সে। কাজ কর্মের অভাবে খাবারও জোটে না। নিরম্বু উপবাসে কাটাতে হয় প্রায়। এই দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে মতিলাল তার লালসার থাবা বাড়ায় বটাইয়ের বউ টুলির দিকে। এর থেকে বাঁচার জন্য টুলি সন্তোষেশ্বরী মন্দিরে ভগবানের কাছে তার আর্জি জানায়। মতিলালকে খুঁজতে এসে বউয়ের কান্নাভেজা কথাগুলো কানে যায় তার—“হেই বাবা। মরদটাকে মোর ভালা করি দও। ব্যাকড়াভর উঁটিই লও অর উপর থিকে। হেই বাবা। ভোকে পাগল হই রই। কত আর ঠেকাই রাখবা মতিলালকে? কত আর লুকাই বুলবা এমা-সেমা দিন দিন। এক পেট ভোখলি, কত আর সামলাই রাখবা—নিজেকে? হেই বাবা গরিব মানুষের ঘরে এ ঘোড়ারোগ ক্যানে ঢুকালে, হেই বাবা!”
ব্যাক্ড়াভরকে আর ডরায় না বটাই। বউকে বলে—“মতিলালকে খুঁজি। শালার কাটিতে কতো জোর, একটিবার দেখতে চাই সেটা।”
শেষরাতে আবার বেজে ওঠে ঢাক। ডিম-ডিম, ডিডিম-ডিম... শব্দে সদানন্দের উঠোনে ঢাক বাজছে। এ ঢাক চার পাশের ক্ষেতমজুর ও ভাগচাষিদের ডাকছে। জরুরি খবর আছে। ভোর হবার আগে সকলকে জানাতে হবে। সামনের বর্ষায় বেনাম জমি দখলের লড়াই হবে। জোতদার আর পুলিশ রুখতে চায় সর্বশক্তি দিয়ে। শেষ রাতের বাতাসে ঢাকের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। “বটাইয়ের কানের মধ্যে দিয়ে যে আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে রক্তে রক্তে। মস্তিষ্কের মধ্যে একটা তাল বাজছে যেন। নতুন তাল। বটাই এক মুহুর্ত ইতস্তত করল। তার পর টুলির হাতখানা চেপে ধরে আচম্বিতে দৌড় মারল ঐ ঢাকের বাদ্যিকে নিশানা করে।”
এভাবে এক বাদ্যির নেশা কাটিয়ে আর এক বাদ্যির নেশায় মেতে ওঠে। বটাইয়ের এই উত্তরণ গ্রামীণ কৃষকের উত্তরণ। অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এভাবেই নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন হয়েছে, নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় পেয়েছে গ্রামীণ কৃষক। বেরিয়ে এসেছে জোতদার জমিদারের শিকল ছিঁড়ে।
এখানে বটাই একজন ব্যক্তিমাত্র নয়, সে একটি সমগ্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধি। ভগীরথের গল্পে ব্যক্তির গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ব্যক্তির থেকে সমষ্টিকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর বহু গল্পের ব্যক্তি চরিত্ররা আসলে বিশেষ কোনও সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে। এটা তাঁর গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য। গোষ্ঠী-সমষ্টি-কৌম তাঁর গল্পের কেন্দ্রে।
এখানেই উল্লেখ করা যেতে পারে তাঁর গল্পের আরেকটি বৈশিষ্ট্য—ভৌগোলিকতা। শহর-মফস্সল সবই এসেছে তাঁর গল্পে। কিন্তু গ্রামেরই প্রাধান্য দেখি। আরও স্পষ্ট করে বললে মেদিনীপুরের—পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রাম—গ্রামীণ জীবন। শুধু পটভূমি পরিবেশ হিসেবে নয়, গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে গ্রাম। সেই গ্রাম এসেছে তার সকল ভৌগোলিকতা নিয়ে। সত্তর-আশির দশকে বাংলার গ্রামীণ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন। সেই পরিবর্তিত গ্রাম সবাক হয়ে উঠেছে তাঁর গল্পে। এক-আধজন মানুষের জীবন-চর্যায় বদল আসেনি। গ্রামের সামগ্রিক যাপনচিত্রে বদল এসেছে। সেই বদলটাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন ভগীরথ। শুধু ‘ব্যাক্ড়া’ গল্পে নয়, আরও বহু বহু গল্পে।
#
‘লেবারণ-বাদ্যিগর’ গল্পে আর এক ঢাকির প্রসঙ্গ। আর এক বাদ্যিকরের কথা। এই বাদ্যিকরের নাম লেবারণ। গাজনের বাদ্যি মাঝে মাঝে বাজালেও লেবারণ প্রধানত বিয়ের বাদ্যি বাজায়। ফুলশয্যার রাতে বর কনেকে নিয়ে যখন ঘরে খিল দেয়, তখন লেবারণ উঠোনে নেচে নেচে ঢোল বাজায় ঝাঁ গুড় গুড়, ঝাঁ গুড়। বহু জায়গায় এখনও বিয়ে বাড়ি উপলক্ষে ব্যান্ড-পার্টি তাসাপার্টি বাজনা-বাদ্যির চল আছে।
নিজের ঘরে বউ না থাকলেও মেয়ে মানুষ নিয়ে কম নাড়া চাড়া করেনি লেবারণ। মালতী সুবচনী ললিতে কারো ঘরেই বারণ নেই তার। কিন্তু ‘সাঁঝের আঁধারে মেয়া মাইন্ষের ঘরে পা টিপে টিপে ঢোকা, আর ফুলশয্যের রাতে বৌয়ের ঘরে ঢোকা’ যে একই ব্যাপার নয় তা জানে লেবারণ। অথচ তারও বউকে নিয়ে ফুলশয্যায় যাওয়ার কথা ছিল। বিয়ে হয়েছিল তারও। অবশ্য বিয়ের ঘটনা আজ আর তার ভালো করে মনে পড়ে না। তখন তার বয়স সাত; আর বউয়ের দুই। কোলে চড়ে গিয়েছিল সে। বিয়ে করে ফিরেও ছিল কোলে চড়ে। হলুদ জলে ছোপানো ছোট আট হাত ধুতি পরিয়ে কীসব যেন হয়েছিল। অতি আবছা একটা ধোঁয়া ধোঁয়া গোছের স্মৃতি আজও রয়ে গেছে তার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝেছিল তার জন্য একজন দিন গুনছে।
বউ ঘরে আনার প্রসঙ্গ ওঠে লেবারণের বয়স যখন সতেরো। তার মনও আনচান করেছিল। পাখা মেলে উড়ে যাচ্ছিল বারবার। বউ আনার দিন স্থির করতে গেল রসিক খুড়ো। শালপাতা দিয়ে মোড়া মাটির গাড়ুতে বোঁদের মেঠাই, হলুদে ছোপানো লালা পেড়ে শাড়ি, গুয়া পান সবই নিয়ে গেল। পরদিন বিকেলে ফিরে হতাশ করল লেবারণকে। তার ‘শউর’ বলেছে—“রূপার বাজু দিবার হক্ দ্যালো লেবারণের বাপের। সেটা দিতে লাগবে। আর লাগবে বাড়তি দুকুড়ি টাকা।”
তার জ্বালা বোঝে না কেউ। বছর খানেক এ নিয়ে গণ্ডগোল চলে। বউ আর আসে না। বাবা মা মরল। তারপর থেকে সে একা।
গল্পের শেষে অন্য এক চমক। রোহিণীতে বাজাতে এসে যে বউটার সঙ্গে রগড় করে সেই রাইমনিই তার পূর্ব স্ত্রী, শশী বাগলার মেয়ে। তা জানা ছিল না তার। রাইমনির ঘরে রাত কাটাতে আসে লেবারণ। আর রাইমনি লেবারণের গ্রামের নাম শুনে ভাবে তার পূর্ব স্বামীকে সে নিশ্চয়ই চিনবে। তার বিয়ের গল্প বলে। নিজের বউয়ের বিয়ের গল্প শুনতে হয় তাকে! সারা গায়ে কাঁটা দেয় তার। আঠাশ বছর বয়সে বউকে প্রথম দেখে সে। পলকহীন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে।
রাইমনি এখন অন্যের স্ত্রী। তার বাবা টাকার লোভে অন্যত্র বিয়ে দিয়েছিল তার। কিন্তু রাইমনির অন্তরে প্রথম স্বামীর প্রতি প্রেম জেগে আছে আজও। তা বুঝতে পেরে লেবারণ জানতে চায়—এখন যদি সে এসে তাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে। কিন্তু বুড়াকে ছেড়ে যাবে না সে। তৃপ্ত মুখে রাইমনি বলে একবার সে ফিট হয়ে গেছিল। “বুড়ার সে কি মড়াকান্না। ট্যাস্কি ভাড়া করে সদরে লি যাতে চায়।” রাইমনির চোখে মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে হতাশ হয় সে। রাইমনি তারপর বলে—“তুমার সাথে তার দেখা হলে বলো, সে যেন একটা বে’ করে সনসারী হয়। বলো, রাইমণির এই মিনতি তার ছিচরণে।”
লেবারণের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। রাইমণির স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ মনটা স্পষ্ট হয়ে উঠল তার সামনে। তারপর রাইমণির সামনে থেকে কোনও রকমে পালিয়ে বাঁচল সে।
লেবারণ একজন শিল্পী। শিল্পীর সংযম তার মধ্যে আছে। তাই সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও সে রাইমণিকে তার লালসার শিকার করেনি। স্বামীর প্রতি তার ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়েছে সে। নিজেকে লুকোতে চেয়েছে। চমৎকার একটি প্রেমের গল্প হয়ে উঠেছে শেষ পর্যন্ত। লক্ষ করবার মতো এই প্রেমবোধ। রাইমণি তার শৈশবে বিয়ে করা, না দেখা বরকে ভালোবাসে। আবার অতি বৃদ্ধ বর্তমান স্বামীর প্রতি এই কিশোরীর প্রেমেরও ঘাটতি নেই। আমাদের প্রথাগত প্রেম বোধকে এগল্পে ভেঙে দিয়েছেন লেখক। ভগীরথের প্রেমের গল্পও তথাকথিত প্রেমের গল্পের মতো নয়।
ভগীরথ তাঁর গল্পে যৌন-প্রসঙ্গগুলির অবতারণা করেন অদ্ভুতভাবে। ‘রাবণ’, ‘জাইগেনসিয়া’ ‘ব্যাকড়া’ বা ‘লেবারণ বাদ্যিকর’—সবকটি গল্পে যৌনতার একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু তা চরিত্র ও বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অন্যরকম এক যৌন ডিকশন তৈরি করেছে। একটিও যৌনগন্ধী শব্দ ব্যবহার না করে, যৌনদৃশ্যের অবতারণা না করেও লেখক বুঝিয়ে দেন বিষয়ের অন্তর্গত এই যৌন-প্রসঙ্গের কথা। যৌন-মনস্তত্ত্বের চমৎকার রূপায়ন ঘটেছে তাঁর গল্পগুলিতে।
#
ভগীরথ ব্যক্তিজীবনে নানান কিছুর চর্চা করেন। ম্যাজিক বনসাই কুটুম-কাটাম ইত্যাদি। এর কয়েকটির উপর তাঁর আলোচনা গ্রন্থও রয়েছে। আর এই সব চর্চাকে অনেকক্ষেত্রেই গল্পের বিষয় করে তোলেন। ওই বিষয়গুলির আলোচনা করবার জন্য গল্প লেখেন না। তাঁর সেই অভিজ্ঞতাও সম্পৃক্ত হয়ে যায় গল্প লেখার সময়। শিল্প সৃষ্টির সময়। এবং কখনও-ই তা উক্ত বিষয়ের ঘেরাটোপে আটকে থাকে না। শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে ওঠে। আর এভাবেই ভগীরথের গল্পের বিষয়ের পরিধি ব্যপ্ত হয়। বৈচিত্র্য আসে তাতে। উল্লেখ করা যেতে পারে ‘কুটুক-কাটাম’ গল্পটির। এই গল্পের উৎপল কুটুম-কাটাম করে। ‘অভিব্যক্তি’ নামে তার শিল্পশালা আছে প্রত্যন্ত গ্রামে। কাঠ-কুটো, শিকড়-বাকড়ের মধ্যে হরেক ভঙ্গিমার মানুষ আর জীবজন্তুর শরীরকে অভিব্যক্ত করে। শুকনো একটা সাধারণ ডালে কী আশ্চর্য শিল্প-সামগ্রী লুকিয়ে থাকে তা বার করে সে। শুকনো ডাল নুনোতম কাটাছাঁটার ফলে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সুচাঁদ ওতোল দুই সহকারী তার। প্রতি বছর একটি উৎসবের আয়োজন করা হয় অভিব্যক্তিতে। কলকাতা থেকে বিখ্যাত শিল্পীরা আর্ট কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা আসে।
সেই উৎসবের প্রেক্ষাপটে এই গল্প। এসেছে অনেকের সঙ্গে শিল্পী কৃষ্ণা। সঙ্গে তার স্বামী তেলের ব্যবসায়ী সুরজিৎ। নিজের কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না সে। তাকে বড্ড বেরসিক মনে করে কৃষ্ণা। এখানে এসেছে মহুয়ার লোভে। সারাক্ষণ মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে আছে সে। শিল্প-ইত্যাদির ব্যাপারে কোনও হুঁশ নেই তার। এরমধ্যে উৎপল সকলকে বলে এত কুটুম-কাটামের মধ্যে তার নিজের হাতের কোন্গুলো তা বলে দিতে পারলে সেগুলি দিয়ে দেবে। এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। সকলেই প্রদর্শনীর মধ্যে খুঁজে বেড়ায় উৎপলের কাজ।
পরদিন বিদায় বেলায় একে একে সকলে জানায় তাদের দুটি করে নির্বাচন। কিন্তু সঠিক উত্তর দিতে পারে না কেউই। সুরজিৎ হঠাৎ একটা চান্স নিতে চায়। কৃষ্ণা স্বামীর এই প্রগলভতায় একটু বিরক্তই হয়। সুচাঁদ আর ওতোল ক্লান্ত শরীরে অতিথিদের সুটকেস বইছিল। সুরজিৎ তাদের দিকে তাকিয়ে বলে—“এই লরেল আর হার্ডি”।
থমকে দাঁড়িয়েছে সুচাঁদ আর ওতোল, স্বল্প পরিচ্ছদে এই শীতের সকালে অল্প অল্প কাঁপছে, আবার অধিক পরিশ্রমে ঘাম জমেছে মুখে। এবং সকলে তাকিয়ে দেখল কী উজ্জ্বল ভাষাময় চোখদুটি, কুৎসিত দুটি অবয়বের মধ্যে, কী জীবন্ত!
উৎপল ভাষাহীন দাঁড়িয়েছিল তফাতে। সহসা ছুটে এসে সে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল সুরজিৎকে। সুরজিৎ ঢুলু ঢুলু চোখে বলে—“দে এবার, মূর্তিদুটোকে দিয়ে দে আমায়। দে—দে—দে—।”
‘বনসাই পাল ও পুজো/৯২’ নামেও একটি গল্প আছে তাঁর। সেখানে বেঁটে মানুষ আর বনসাইকে একই পঙক্তিতে বসানো হয়েছে। তাই এহেন নামকরণ তার।
#
কত বিচিত্র রকমের চরিত্রের ভিড় ভগীরথের গল্পে। অদ্ভুত রকম পেশার মানুষ সব। ‘পটিদার’ গল্পে এসেছে এক পটিদার—পটুয়ার কথা। বাংলা গল্পে পটুয়ারা নতুন কিছু নয়, কিন্তু এখানে যে পটুয়ার কথা বলেছেন লেখক তার কথা আমাদের কাছে নতুন বইকি। পটের ছবি আঁকা বা ছবি দেখিয়ে গান গাওয়া নয়, এই গল্পের ঝলক পটিদার মরা মানুষের ছবি আঁকে। আত্মীয়-স্বজনদের ছবি এঁকে দেখায় তাদের মৃত পূর্ব পুরুষ স্বর্গে কেমন আছে। কতটা সুখে বা কষ্টে আছে। সব পটুয়ারা মৃত মানুষদের দেখতে পায় না। তার জন্য গুণিন হতে হয়।
আগে কেবল মরবার সময়, পুড়িয়ে-টুড়িয়ে এসে পটিদার ডেকে ফটো আঁকাত মরে যাওয়া বাপ-মায়ের। এই লোক থেকে গিয়ে মানুষটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছল, কেমন রয়েছে এই সব দেখার জন্য। এখন মানুষের হাতে অনেক টাকা প্রতি বছর বার্ষিকির দিনে পটিদার ডাকে। আর পটিদার কাগজের উপর কাঠকয়লা দিয়ে একটা মানুষের মতো ছবি এঁকে বলে—বাপ/মা কষ্টে আছে। পরার কাপড় পর্যন্ত নেই—এইসব বলে কাপড়-চোপড় সিধে নিয়ে ফেরে।
তবে এই গল্পের ঝলকের আঁকার হাতটি চমৎকার। গুণিন-বিদ্যার সঙ্গে ছবি আঁকাটাও শিখেছিল সে। অভাবের সংসার। বিয়ের পর থেকে বউয়ের সঙ্গে তার রুগ্ন মায়ের খিটিমিটি লেগেইছিল। এখন বছর দুই বউয়ের পরামর্শে মাকে তাড়িয়ে দিয়েছে ঘর থেকে। মাঝে মাঝে মা এসে কান্নাকাটি করে কিছু আদায় করে নিয়ে যায়।
এই ঝলক গরুড় মণ্ডলের মায়ের বার্ষিকিতে গেছে ছবি আঁকতে। বড়লোক গরুড়ের দেওয়ার হাতটাও বেশ। তাই আগে থেকেই তার মায়ের সম্বন্ধে কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে গেছে। ছবিটি এঁকে উল্টে রাখে সে। বাড়ির লোকজন ছাড়া পাড়াপ্রতিবেশীরাও ভিড় করেছে। ঝলক সকলকে সরিয়ে আলাদা করে গরুড়কে ডেকে ছবিটি দেখায়। সে ছবি দেখে আঁতকে ওঠে গরুড়—
কি না গরুড় মণ্ডলের মা, ওপারে গিয়ে তার পরনে একটা ছৈতা অবধি জুটছে নাই, এক্কেরে ল্যাংটো হইয়া দিন কাটাচ্ছে বুড়ি। টুকচান তেল বিহনে উয়ার মাথার চুল যেন বাবুই পাখির বাসা। সারা শরীলে পাকা চালকুমড়ার পারা খড়ি ফুইট্যে রয়েছে।
সকলের সামনে এরকম ছবিটা না দেখিয়ে বিবেচকের কাজ করে ঝলক। তাই গরুড় তার নির্দেশ মতো সবই কিনে এনে দেয়—একটা ভালো দেখে শাড়ি, মাথার জন্য এক শিশি জবাকুসুম তেল, গায়ে মাখবার জন্য কেজিটাক সরষের তেল, চাল-ডাল-আনাজপাতি, আলতা, সিঁদুর, মাথা পরিষ্কার করার জন্য শ্যাম্পু, ভালো দেখে একটা টনিক, এক বোতল হরলিক্স।
খেয়েদেয়ে গড়িয়ে বিকেলে বেরোতে একটু দেরি হয়ে যায় ঝলকের। পাঁচ কিলোমিটার পথ। ঝলক জোরে পা চালায়। ভুতডাঙার শ্মশানের কাছে আসতেই অন্ধকার নামে। বুকটা ঢিপ ঢিপ করে। সহসা চোখের সামনে ছায়া মূর্তি। সারা গায়ে একগাছা সুতো নেই। ‘কে’—জিজ্ঞেস করলে খনখনে গলায় উত্তর আসে—“সে কী বাপ? ধিয়ানযোগে আমাকে দেইখ্যে আমার ফোটো এঁইক্যে অত বাহবা পেলি, আর স্বচক্ষে সুমুখে দেইখ্যেও চিনতে লারছু?” তারপর বলে—“আমার ব্যাটা যে সিধেপাতি পাঠালেক তুয়ার হাত দিয়ে, উগুলান তো কই আমাকে দিলি নাই।”
এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি তার। ভয়ে কাঁধের ঝোলাটা নামিয়ে রেখে জোরে পা চালায়। বাড়ি গিয়ে শোনে তার মা এসেছিল। বউ তার দুবরাজপুর যাওয়ার কথা জানিয়ে বিদায় করেছে। পরদিন সকালে হাটখোলার রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অকস্মাৎ তার নজর যায় গাছের তলার দিকে। যেন ভুত দেখে সে। সেখানে বসে তার মা। গরুড় মণ্ডলের বাড়িতে পাওয়া নতুন শাড়িটা বেশ পেঁচিয়ে পরেছে। কপালে সিঁদুর। পায়ে আলতা। সামনে জবাকুসুম তেলের শিশি। রাজ-রাজেশ্বরীর ভঙ্গিমায় বসেছে মা। ব্যাটার চোখাচোখি হতে ঠোঁটের কোণে হাসল বুড়ি—“এক চিলতে ভারী মিহি-চিকন হাসি। সকালের নরম রোদ্দুরের সঙ্গে সেই হাসি মিশে যায় নিঃশেষে।”
ভগীরথের গল্পে একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে দারিদ্র্য। কিন্তু লেখকের বলার কৌশলে সেই দারিদ্র্য হাঁ মুখ করে থাকে না সবসময়। কিন্তু তাঁর গল্পের পাঠকমাত্রেই বুঝতে পারেন গল্পের গ্রামীণ এই মানুষগুলির সংকট। খাদ্যের সংকট। সেই সংকট বা দারিদ্র্য মানুষকে নুইয়ে দেয়।
কিন্তু সবসময় নোয়াতে পারে না তা মানবিকতাকে। আত্মসম্মানকে। দারিদ্র্যের সেই জোর বোধহয় নেই। অন্তত হতদরিদ্র নকুলের সম্মানবোধকে নোয়াতে পারেনি। ‘কুঁজোপানা মানুষ’ গল্পের নকুলের।
সাধারণভাবে গ্রামের মানুষদের কিছুটা করুণার চোখে দেখে শহরের মানুষ। বিশেষ করে গ্রামের যেসব মানুষ কর্মসূত্রে শহরে থাকে, ভালো চাকরি করে তারা মাঝে সাঝে গ্রামে এলে আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের, পুরনো বন্ধুদের নানাভাবে সাহায্য করে। এই সাহায্যের মধ্যে যতটা না সহানুভূতি থাকে তার থেকে বেশি থাকে দয়া দেখিয়ে নিজেকে সম্মানিত করবার প্রবণতা। ভালো চাকুরে বন্ধুদের কাছে গাঁয়ের দরিদ্র মানুষদেরও প্রত্যাশা থাকে। ‘কুঁজোপানা মানুষ’ গল্পের কেন্দ্রে এরকমই একটা বিষয় উঠে এসেছে। এই গল্পের কথক অমিত কলকাতার মস্ত চাকুরে। বছরে এক-আধবার গ্রামের বাড়িতে আসে। তখন নানা মানুষ নানান আবদার নিয়ে আসে তার কাছে। মেলার সময় পুরনো এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। নকুল তার নাম। ছোটবেলা থেকেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান নকুল অমিতদের সকল আবদার মেটাত। গাছে উঠে ফল পাড়া থেকে পুকুর থেকে পদ্মচাকি তুলে আনা সবই সে একা করত।
নকুল গুছিয়ে কথা বলতে পারে। ধীরে ধীরে তার কথার বাঁধুনি আরও ভালো হয়েছে। নিজের দারিদ্র্যের কথা বলে। ছেলেটাকে না পড়িয়ে বাধ্য হয়ে লোকের বাড়িতে বাগাল হিসেবে রেখেছে। অমিতের মনে হয় কথার মনোহর ফাঁদ পাততে চাইছে নকুল। ছেলেবেলার সবই তার মনে আছে। স্মরণ করিয়ে দেয় নানা স্মৃতি। এই প্রসঙ্গে নকুল বলে—“তুমার তো সারাজীবনটাই পুঁজি, আমার যে ওই ছেলেবেলাটুকু ছাড়া আর পুঁজি বলতে কিছুই নাই।”
বন্ধুকে মিষ্টির দোকানে নিয়ে গিয়ে দুজনে জিলিপি খায়। অমিত পয়সা দিতে চাইলে বাধা দেয় সে। বলে—“তুমি কেন দিবে? আমিই তো ডাকিয়া আনিয়া খাবালাম তুমাকে।” প্রায় জবরদস্তি দাম মেটায় নকুল। অমিতের মনে হয় বড় কোনও দাঁও মারতে চায় সে। একশোটাকার একটা নোট বার করে পকেটে রাখে। সুযোগ বুঝে দেবে। নকুল জানায় তার ছেলে মেলায় আসবে বলে অপেক্ষা করছে। মেলা দেখতে সে পয়সা দেবে। অমিত আরও একশো টাকার নোট পার্স থেকে বার করে পকেটে রাখে। একসময় নকুলের ছেলেও আসে। তাকে প্রণাম করে। আর তখনই দুশো টাকা বার করে তার হাতের দিকে বাড়ায় অমিত। নকুল আচমকা হাঁ-হাঁ করে ওঠে—“বাচ্চা ছেলিয়ার হাতে অত টাকা দেয় কেউ?” নিজে সে ছেলেকে একটাকা দিয়ে বিদায় করে।
নকুল একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে করকরে টাকাগুলোর দিকে। অমিত বাড়ি যাবে বলে ছল করে পকেটে টাকাগুলো ভরে পা বাড়ায়। তার ধারণা ছিল নকুল এবার টাকা চাইবে। ডাকবে। ডাকলও সে। কিন্তু টাকার জন্য নয়। খুব ম্রিয়মাণ মুখে বলে—“ভাল থেকো। আবার আইলে যেন দেখা হয়। কখন যে আস, চলিয়া যাও, খাটাবাটায় ব্যস্ত থাকি, জানতেও পারি না।” খুব ধীর লয়ে কথাগুলো বলে তার কুঁজোপানা শরীরটাকে প্রাণপণে সোজা রাখবার চেষ্টা চালাতে চালাতে মানুষজনের ভিড়ে হারিয়ে গেল।
পকেটে করকরে নোটগুলো নিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যায় অমিত। দারিদ্র্য নকুলকে একেবারে কুব্জ করে দিয়েছে। কিন্তু তারমধ্যেও সে তার আত্মসম্মান বোধকে নুইয়ে দেয় না। বড়লোক বন্ধুর কাছে দয়া ভিক্ষা করেনি। আবার যেন দেখা হয়—এইটুকু চায় সে। শৈশবের বন্ধুত্বকে এরই মধ্যে অটুট রাখতে চেয়েছে। এবার বুঝি মস্ত চাকুরে সমাজের উঁচু তলার মানুষ অমিতই কুঁজো হয়ে যায়। এই গল্পের মধ্যে কোনও চমক নেই। লেখক নিঃশব্দে আমাদের শহুরে শিক্ষিত বড়লোকিয়ানার পিঠে সপাটে চাবুক মেরেছেন। আমাদের অবক্ষয়ী মূল্যবোধের পুনঃপ্রতিষ্ঠাও করেছেন ভগীরথ।
#
গ্রামীণ লোকাচার-কিংবদন্তী-মিথ-সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে বহু গল্প লিখেছেন ভগীরথ। এগুলিকে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেন তিনি। আসলে সামগ্রিক গ্রামীণ আবহকে গল্পে নিয়ে আসতে চান। প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ্য তাঁর ‘কাকচরিত্র’ গল্পটি। গ্রামের দিকে বিশ্বাস কাক ছদ্মবেশী মহাকাল। সাধ্য-সাধনা করে মানুষ কাকাসিদ্ধ হতে পারে। তারা কাকচরিত্র জানে। কাকের ভাষা বোঝে। কাকেদের হাজার ভাবগতিক নখদর্পণে তাদের। কাক দেখে বলে দিতে পারে মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ। এক কাকচরিত্রের কথা উঠে এসেছে এই গল্পে।
আরেকটি একটি গ্রামীণ কুসংস্কার—ধর্মীয় প্রথা অবলম্বন করে লেখা ‘ঘাতক’ গল্পটি। শ্যামা পূজার রাতে বহু জায়গায় আজও রটন্তী কালীর পূজা হয়। সাধারণভাবে শ্মশানে এই পূজা হয় বলে একে শ্মশানকালীও বলা হয়। এগল্পে শিয়ার বিঁধার রটন্তী কালীর প্রসঙ্গ এসেছে। এই কালী পূজার দিন রাতে এক এক জায়গায় হাজার হাজার পাঁঠাবলি দেওয়া হয়। এতগুলো পশুর বলি দেয় একটি মাত্র মানুষ। সেই ঘাতক নির্দিষ্ট থাকে। প্রতি বছর সেই এই কাজটি করে। বংশানুক্রমে এই কাজ করে যায় তারা। আলোচ্য গল্পের ঘাতক করালী বাগদী। আর পুরোহিত পীতাম্বর মহাপাত্র। বলি দেওয়ার কাজে ঘাতকের একজন সহকারী থাকে। করালীর সহকারী গজ বাউরী অদ্ভুত কৌশলে পাঁঠার চারটে পা খিঁচে ধরে। পাঁঠা চিৎকার করে ওঠে ‘মা মা’ করে। সেই শব্দকে ছাপিয়ে বেজে ওঠে ঢাক ঢোল কাঁসর-ঘন্টা। তার সঙ্গে যোগ হয় শতশত পুণ্যার্থীর কণ্ঠ—মা, মাগো, করালবদনী, নৃমুণ্ডধারিণী। দয়া কর্ মা। তুষ্ট হ’।
করালী বাগদীর হাতের খাঁড়া হাউইয়ের মতো সাঁই করে উঠে গেল আকাশে। পরমুহুর্তে আছড়ে পড়ল ছাগ শিশুর কালো কুচকুচে ঘাড়ের ওপর। মুহুর্তে দুফাঁক হলো শরীর। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। মুণ্ডু আর ধড় ছিটকে পড়ল দু’দিকে।
পাঁচশো বাহাত্তরতম এবং শেষতম পাঁঠা বলি সমাপ্ত করে লুটিয়ে পড়ে আশি বছরের বৃদ্ধ করালী। সারাটা দিন অসুস্থ ছিল করালী। পূজার থানে আসার পথে একবার নেতিয়েও পড়েছিল। হাঁপানি রোগী। তার উপর সারাশরীর জুড়ে দগদগে ঘা, চুলকানি, চাকাচাকা দাগ। এতগুলো পশুবলি দেওয়ার ধকল সহ্য করতে পারে না। অবশ্য পুটিন্দর রানার মতো বিশ্বাসে অন্ধ কেউ কেউ বলে—“বলি দিতে ফের শরিরের ধকল হয় নাকি ? পাঁঠা কি উ কাটে ?...আরে উয়ার সাধ্যি কি, রাতভর হাজার হাজার পাঁঠা একনাগাড়ে কাটে। মায়ের মহিমা ছাড়া কিছো হয়?” রটন্তীকালীর স্থায়ী পুরোহিত পীতাম্বর মহাপাত্র অসুস্থ অজ্ঞান করালীর ওপর মন্ত্রঃপুত জল ছিটোতে থাকে আর মন্ত্র পড়ে চেঁচিয়ে—“ওঁ কালী কালী মহাকালী, চামুণ্ডা মুণ্ডমালিনী...। মাগো, জীবের কল্যাণে তুই-ই তো খড়্গরূপিণী হয়ে ছাগের পশু জন্ম বিনাশ করলি মা। ঘাতক তো উপলক্ষ মা। ওর সাথে ছলনা কেন ?”
এক সময় করালীর চেতনা আসে। এই করালীর বংশের ঘাতক হওয়ারও ইতিহাস আছে। কামেশ্বর বাগদীর ছেলেপুলে হচ্ছিল না। তার বউ শিয়ারবিঁধার চামুণ্ডা কালীর থানে ‘লিরম্বু’ হত্যা দেয় তিন দিন তিন রাত। তৃতীয় নিশিতে মা স্বপ্নে বলেন—“অরে কামেশ্বরিয়ার বউ, তুয়ার মরদকে বল্, মোর থানে ঘাতক হয়ে বলি দিক পশু। তুয়ারা হ’ শিয়ারবিঁধার চামুণ্ডা-কালীর ঘাতক বংশ। তুয়ার ভুবনভুলানো ছেইলা হবেক্। তার বাহু হবেক কলা গাছের গুঁড়িটি। তার অঙ্গের বর্ণ হবেক্ সোনার পারা। পলাশ পুষ্পের পারা আঁখি।” বউয়ের মুখে সব শুনে কামেশ্বর ছুটে যায় কালীর পুরোহিত মহাপাত্রদের বাড়ি। আর সেই বছরই রটন্তী-কালীর পুজোয় কামেশ্বর হেতার তুলল হাতে। কামেশ্বরের ছেলে হল চামুণ্ডা প্রসাদ। তার গায়ের রঙ যদিও ভুষা কালো। সেই কামেশ্বর করালীর ঠাকুদ্দার বাপ। সেই থেকে এই বংশের এই ধারা। করালীর পর তার ছেলে রটন্তী প্রসাদ হবে ঘাতক—“এ হল বংশের ধারা। ডুলুং নদীর জলের পারা। এক জল বয়ে যায় নীচালীর পানে। অন্য জল সে থান পূরণ করে। ফাঁকা থাকে না তিল—প্রমাণ ঠাঁই।” করালীর বউ অগ্নি মেনে নিতে পারেনি এই বলি। তাই করালী যেবার হেতার ধরলো সেবারই অগ্নি সম্পর্ক ঘুচিয়ে গ্রাম ছাড়লো।
একই গ্রামে একই সমাজে, এমনকি একই পরিবারে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে মানসিকতার ভিন্নতা চোখে পড়ে। এটাই স্বাভাবিক। এই গল্পেও এসেছে সেই প্রসঙ্গ। অনেকসময় গ্রামীণ অনুষঙ্গে মনে হয় এই বিশ্বাস-সংস্কার সংক্রান্ত বিষয়গুলি সামগ্রিকভাবে একটি গ্রাম সমাজের অমোঘ বৈশিষ্ট্য। প্রতিটি মানুষের চেতনায় এগুলি ক্রিয়াশীল। অনেক গল্পকার তাঁদের লেখায় বিষয়গুলিকে এভাবেই তুলে ধরেন। ভগীরথ কিন্তু তাঁর এই গল্পে গ্রামীণ সংস্কারগুলির টলমলে অবস্থানকে স্পষ্ট করেছেন। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বহু বছরের প্রচলিত দৈবী-বিশ্বাসেরও বদল ঘটছে। তাই গল্পেই দেখি মিটিং-এ কিছু শিক্ষিত যুবক বলীর বিরোধিতা করেছে। কৌমের মধ্যেও যে চিন্তার স্তরে, মানুষের বোধের জায়গায় ভিন্নতা থাকে তা ভগীরথ অস্বীকার করেননি। আর এই ভিন্নতা মানুষের সংসারকে, সম্পর্ককে, জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে। শেষ পর্যন্ত এই গল্পে তা-ই দেখা গেল।
#
বাংলা সাহিত্যে হাস্যরসের ধারাটি ক্রম ক্ষীয়মাণ। সমসাময়িক যে অল্প কয়েকজন লেখক এই হাসির গল্পের ধারটিকে আজও বহমান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ভগীরথ মিশ্র। প্রচুর হাসির গল্প লিখেছেন তিনি। ‘সরস গল্প’, ‘হাস্যৌষধি’ ইত্যাদি হাসির গল্পের পৃথক সংকলনও আছে তাঁর। তাঁর বহু গল্পের বিন্যাসের মধ্যেই আছে হাস্যরস। কোনও কোনও গল্পের বিষয়টাই হাসির। প্রকৃতপক্ষে তাঁর অধিকাংশ হাসির গল্পের বিষয়ই হাসির। এদিক থেকে অন্যান্য হাসির গল্পের লেখকের থেকে তিনি স্বতন্ত্র। স্যটায়ার এবং উইটের ঝাঁঝের থেকে বিশুদ্ধ হিউমার-ই বেশি এসেছে তাঁর গল্পে। হিউমারের মধ্যে মাঝে মাঝে হয়তো ঝিলিক দিয়ে ওঠে স্যাটায়ারের দ্যুতি। কিন্তু সেই স্যটায়ারও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঝাঁঝহীন। তাঁর হাসির গল্পগুলির জনপ্রিয়তার মূলেও এই হিউমার। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বজায় থাকে হাস্যরস। কথার মারপ্যাঁচ, সংলাপ, শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাসে কৌতুকমণ্ডিত হয়ে ওঠে ভগীরথের গল্পের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট। হাসতে হাসতে এগিয়ে চলেন তাঁর গল্পের পাঠক।
উল্লেখ করতে পারি ‘ফায়দা’ গল্পটির কথা। একজন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পোলিটিসিয়ান ষড়াননদার গল্প। কথক তথা লেখকের সহপাঠী। ছোটখাট নাদুসনুদুস চেহারার মানুষ। শৈশব থেকেই বিনয়ের অবতার। মানুষের সেবা করবার জন্যেই যেন জন্ম তার। যে কোনো নগণ্য ইস্যু থেকে ফায়দা তোলার ক্ষমতা ছিল। আর তার ফায়দা তুলবার কায়দাগুলো ছিল অন্য ধরনের। যেমন—“কাউকে টুপি পরাতে চাইলে, সে ভুলেও টুপির ধার-পাশ দিয়ে যেত না। শুরু করত একেবারে মোজা দিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে..., নিঃশব্দে..., গুঁড়ি মেরে মেরে সে একটু একটু করে মাথার দিকে এগোত। অপর পক্ষ টের পাওয়া তো দূরের কথা, আন্দাজ করতেও পারত না, কী ঘটতে চলেছে ওর বরাতে। এক সময় নিঃশব্দ বধ হয়ে যেত।”
অযোধ্যা কাণ্ডে তার প্রতিক্রিয়া—“বহু দিন বাদে একটা মওক্কা পাইসি, ভাই।...পোলিটিসিয়ানদের কপালে অমন মওক্কা কদাচিৎ আসে”। এহেন ষড়াননদাকে পাড়ার ছেলেদের অনুরোধে পুষ্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার জন্য আহ্বান করতে যান লেখক। কিন্তু সেখানে কোনও ফায়দা নেই বলে আসতে চায়নি সে। লেখক তাকে বাতলে দেন ফুল থেকে অযোধ্যা যাওয়ার রুট—“ফুল থেকে ফল, ফল থেকে বীজ, বীজ থেকে গাছ, তা থেকে চলে যাও অশ্বত্থ ও আম গাছে, অশ্বত্থ ও আম, দুয়ে মিলে অশ্বত্থামা, তার থেকে মহাভারত, সেই প্রসঙ্গে রামায়ণ, আর, রামায়ণ মানেই অযোধ্যা।”
রুটটা লম্বা মনে হওয়ায় লেখক সর্ট-রুট বলে দেন—“ফুল—ফল—বীজ—গাছ—অর্জুনগাছ—অর্জুন মানেই বিরাট যোদ্ধা, আর যোদ্ধা থেকেই অযোধ্যা।”
বড় খুশি হয় সে। কয়েকটা পুষ্প প্রদর্শনীর আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছে বলে আক্ষেপ করে ষড়াননদা—হায়, হায়, ফুলকে আন্ডার-এস্টিমেট কইর্যা একডা ডাহা ফুলিশ কাম কইর্যা ফ্যালসি, ব্রাদার। আমার মতো ‘ফুল’ আর ভূ-ভারতে দুইট্টা নাই।”
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ থাকলেও মজা আর কৌতুকের কাছে সেই বিদ্রূপ ম্লান হয়ে যায়। ভগীরথের হাসির গল্পের বিশেষত্ব এখানেই। শুধু এই গল্পে নয়, তাঁর বহু হাসির গল্পে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের কেন্দ্রে থাকেন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা। ‘একটি নির্বাচনী বক্তৃতা’ গল্পের এম পি পাঁচবছরে কী কী কাজ করতে পেরেছেন তার ফিরিস্তি দিয়েছেন দ্বিতীয়বার নির্বাচনের আগে। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা বেকারিত্ব। সেই সমস্যা কতটা দূর করেছেন তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়েছেন। তাতে দেখছি নিজের তিন ছেলে শুধুই নয়, তাঁর আত্মীয়-স্বজনদেরও চাকরি দিয়েছেন। যারা অশিক্ষিত তাদের লোন ইত্যাদি করে দিয়েছেন। নিজের আখের গোটানোর কথা বিস্তারিতভাবে বলে তিনি পরিষ্কার বলেন—
আমাকে ভোট দিলেই আপনাদের সমৃদ্ধি এবং এলাকার উন্নয়ন সুনিশ্চিত ও ত্বরান্বিত হবে। কারণ, আমার নিজের জন্য যা-যা করবার সবই করে নিয়েছি। আমার ছেলেমেয়ে, আত্মীয়-পরিজন সবাইয়েরই গতি হয়ে গিয়েছে। কেউই বাকি নেই। কাজেই, আমাকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করলে আমি মনপ্রাণ ঢেলে কেবল আপনাদের তথা সমগ্র এলাকার সমৃদ্ধি এবং উন্নয়নের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারব। অপরপক্ষে, নতুন কাউকে ভোট দিয়ে এম পি বানালে, সে তো প্রথম পাঁচ বছর কেবল নিজেরটা গুছোতেই ব্যস্ত থাকবে। হয়ত বা পরবর্তী পাঁচ বছরে আপনাদের জন্য কাজকর্ম করবে। অর্থ্যাৎ, নতুন কাউকে ভোট দেওয়া মানে নিজেদের তথা এলাকার সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাঁচটি বছর পিছিয়ে যাওয়া।
ভোট প্রার্থীর এহেন যুক্তিকে সত্যিই অস্বীকার করা যায় না। আরও বহু গল্পে ভগীরথ এভাবে সংলাপের মাধ্যমে গল্পকে রসঘন করে তুলেছেন। ‘কালচার দিয়া দ্যান’ গল্পের পুলিশ অফিসার বক্তৃতার সময় অনায়াসেই মিলিয়ে দেন রবীন্দ্রনাথ ও পুলিশকে। রবীন্দ্র সঙ্গীত উদ্ধৃত করে চোর-গৃহস্থ-পুলিশের সংলাপ সৃষ্টি করে কৌতুক রসমণ্ডিত করে তোলেন গল্পকে।
‘ঢেঁকিকল’ গল্পের বিদ্রূপের কেন্দ্রেও মহামান্য পণ্ডিত মন্ত্রী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের এই মন্ত্রী কতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ক্ষ্যাপাবাবার আশীর্বাদ গ্রহণ করতে পারবেন বলে মফস্সলের বিজ্ঞান মেলায় এসেছিলেন। সকাল থেকে পূজাপাঠ করে বেরোনোর সময় সেচভবনের দারোয়ান আচমকা হেঁচে ফেলায় পাক্কা দুমিনিট বসে গিয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয়বার বেরোতে যাবেন এমন সময় সেচভবনের দেওয়ালে পিঠ চিতিয়ে শুয়ে থাকা টিকটিকিটি পরপর দুবার টিক্-টিক্ করে ডেকে উঠেছে বলে তাঁকে আরও দুমিনিট বসে যেতে হয়েছে। তৃতীয়বার বেরোনোর এক মিনিট আগে বারবেলা পড়ে যাওয়ায় তিনি অপেক্ষা করেছেন চল্লিশ মিনিট। বিজ্ঞানমেলায় যাওয়ার আগে গেছেন চামুণ্ডা কালীর মন্দিরে। সেখান থেকে ক্ষ্যাপাবাবার প্রসাদ পেয়ে তারপর মেলায়। সেখানেও পিছন থেকে তাঁর সেকরেটারি ডেকেছিল বলে তোরণের কাছ থেকেই ফিরে যান তিনি। গাড়িতে কিছুক্ষণ বসে তারপর আসেন মেলায়। অথচ তাঁর বক্তৃতায় বিজ্ঞান প্রযুক্তির কথা বলেন, মানুষকে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের অন্ধকূপ থেকে টেনে তোলার কথা বলেন।
বিজ্ঞান মডেল প্রদর্শনীর প্রথম স্থানাধিকারী মানবের মডেলের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করার কথা তাঁর। আর পর্দা সরানোর পর দেখা যায় কখন মডেলটি বদলে ফেলেছে প্রতিযোগী মানব নামের ক্ষ্যাপাটে ছেলেটি। সেখানে একটি নতুন মডেল—ক্ষ্যাপাবাবার আদলে একটি দাড়ি-গোঁফওয়ালা সন্ন্যাসীর মূর্তির সামনে মাথায় টুপি পরা এক মোটাসোটা ভূঁড়িওয়ালা হোঁদল কুতকুত মূর্তি দণ্ডায়মান, এই হল মডেল। সুইচ টিপে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নড়েচড়ে উঠল মূর্তি দুটি।
জীবন্ত হয়ে উঠল টুনি বাল্ব লাগানো ক্ষ্যাপাবাবার চোখদুটি। ডান হাতখানা ক্রেনের মতো উঠে গেল ওপরে, আশীর্বাদ দানের মুদ্রায়। আর টুপিওয়ালা মূর্তিখানি একবার সাষ্টাঙ্গে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, পর মুহূর্তে উঠে দাঁড়াল—আবার লুটিয়ে পড়ল, আবার উঠে দাঁড়াল—আবার, বারবার, ঢেঁকি যেমন করে ধান ভানার সময় বারংবার ওঠে নামে, ঠিক তেমনিভাবেই ওঠানামা করতে লাগল মূর্তিখানি।
এবং তিনি যে একটি বিজ্ঞান মেলার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে মন্ত্রীমশাই দু’হাত জড়ো করে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন ক্ষ্যাপা বাবার মডেলকে।
এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিজ্ঞান প্রযুক্তি মন্ত্রীকে বিদ্রূপ করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিদ্রূপের উপর পড়েছে চমৎকার এক হাসির মোড়ক। তাই আপাতভাবে তীক্ষ্ণ নয় সেই আক্রমন। উইট এবং স্যাটায়ারের সংমিশ্রণ-ই গল্পটির বিশিষ্টতা।
তবে সমসময় যে হাসি ও মজার মোড়কে আক্রমণ করেন তা নয়। ভগীরথের অনেক গল্পে এসেছে তীব্র তীক্ষ্ণ স্যাটায়ার। আর তাঁর এই স্যাটায়ারধর্মী গল্পগুলির আক্রমণের লক্ষ সাধারণভাবে প্রযুক্তি ও যন্ত্রসভ্যতা। যে প্রযুক্তি মানুষের জীবনের অনেক গভীরে ঢুকে যায় অনায়াসে। আবেগ কেড়ে নেয় তার বেগ। মোশন শুষে নেয় আমাদের সকল ইমোশন। তাঁর ‘ফ্যামিলি প্যাশন সেট’ গল্পে এই যান্ত্রিকতার প্রতি তীব্র আক্রমণ। এই গল্পে দেখি অদ্ভুত এক যন্ত্র। আদর খাওয়ার যন্ত্র।
ধরুন, আপনি দিনান্তে কাজকর্ম সেরে ঘরে ফিরলেন। ক্লান্ত শরীর। বিপর্যস্ত মন। আপনার মেম-সাহেবটি হয়ত উইক-এন্ডে বাইরে গিয়েছেন বয়-ফ্রেন্ডের সঙ্গে। সারাদিন একনাগাড়ে খাটা খাটনির পর আপনার ইচ্ছে হল, বৌয়ের একটুখানি আদর খেতে। যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে দুরন্ত যুবতীর রক্তিম ঠোঁটের ওপর ঠোঁট চেপে ধরে তিন নম্বর সুইচটা টিপুন। অমনি যান্ত্রিক ঠোঁট নড়তে থাকবে চুক্ চুক্ করে। রেগুলেটর চালিয়ে আপনি ‘কিস’-এর ডিগ্রী কমাতে বাড়াতে পারেন। ধরুন, বউয়ের ‘কিস’ খেতে খেতে আপনার মনটা সহসা নিবিড় আলিঙ্গনের জন্য চনমনিয়ে উঠলো। টিপে দিন চার নম্বর সুইচ। অমনি, দু’পাশ থেকে ফোম-রবারের এক জোড়া সুদৃশ্য নরম হাত আপনাকে বেষ্টন করবে নিবিড় ভাবে। এখানেও আপনি আলিঙ্গনের ডিগ্রি বাড়াতে কমাতে পারেন রেগুলেটর চালিয়ে। এই একই পন্থায় আপনি আপনার বাচ্চাদের আদর নিতে পারেন। আপনার ফুটফুটে মেয়েটি আপনাকে কচি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারে। এইভাবেই আপনি বুড়ো বয়সে পরিত্যক্ত হয়েও আপনার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনির আদর ও আলিঙ্গন পেতে পারেন ইচ্ছে মত।
নির্বাক নয়, সবাক আদর। সাউন্ড-সিস্টেমও রয়েছে এতে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে কার কী অভিজ্ঞতা হয়েছে তা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে গল্পের কথক—আবিষ্কারককে। আর সেই সূত্রে ভগীরথ দেখিয়েছেন আমাদের সম্পর্কগুলিও কীরকম যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। প্রাত্যহিকতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যান্ত্রিকতা। আমাদের আবেগহীন যান্ত্রিকতা, যন্ত্র-নির্ভরতাকে চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ভগীরথ। তাঁর গল্পের তীব্র স্যাটায়ার নাড়িয়ে দিয়ে যায় পাঠকের অস্তিত্ব।
#
ভগীরথের গল্পবিশ্বের বিশিষ্টতা শুধু বিষয় বা উপস্থাপনের জন্য নয়। তাঁর গদ্যভাষাও গল্পগুলিকে স্বতন্ত্র করেছে। সেখানে দেখি চরিত্রদের সংলাপ ছাড়াও গদ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে গ্রামীণ ডায়ালেক্ট। গ্রাম-জীবনের প্রতিদিনের নিত্য ব্যবহৃত বাক্য শব্দ ধ্বনির ব্যবহারে স্বতন্ত্র এক গল্পভাষা নির্মাণ করেছেন ভগীরথ। বিষয়ের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা এই গদ্যভাষা গল্পের আবহে বাড়তি মাত্রা যোগ দেয়।
ভগীরথের সময়ে অনেকের গল্পেই এসেছে গ্রাম। গ্রামীণ পটভূমি, চরিত্র, বিষয়। কিন্তু এত এত গ্রামের গল্পের ভিড়েও ভগীরথের গল্পের গ্রামকে—তাঁর গল্পকে আলাদা করে চিনে নিতে অসুবিধে হয় না মনস্ক পাঠকের। স্বতন্ত্র এক গ্রামীণ আকাশ দেখি তাঁর গল্পে। চেনা গ্রামকে কিছুটা অন্যভাবে তুলে ধরেন তিনি। কখনো-বা গ্রাম সম্পর্কে আমাদের আজন্ম লালিত বিশ্বাস নাড়িয়ে দেয়। গ্রাম—গ্রামের মানুষ সম্পর্কে শহুরে মানুষের আপাত ধারণাগুলোকে ভেঙে দেয় ভগীরথের গল্প। শহরে যেমন নানারকম মানুষ থাকে, গ্রামের মানুষও তেমনি সরল-জটিল ভালো-মন্দে ভরা। হিংসা ঈর্ষা শত্রুতায় গ্রামের মানুষেরাও কম যায় না। গ্রামীণ প্রাত্যহিকতার জীবন্ত সত্যকে তুলে ধরেন তিনি।
আর সেই প্রাত্যহিকতায় সম্পৃক্ত হয়ে থাকে সমসময়ের রাজনৈতিক অনুষঙ্গগুলিও। বিশেষ করে তাঁর প্রথম দিকের গল্পে এই সমাজ-রাজনৈতিক বাস্তবতা একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে। খুব কম লেখকই সত্তর-আশির দশকের ঐ ঐতিহাসিক অনুষঙ্গকে লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের অভিঘাত প্রবলভাবে এসেছে তাঁর গল্পে। আসলে এই অভিঘাত শহরের তুলনায় গ্রামগুলোতেই বেশি করে পরিবর্তন এনেছিল। গ্রামীণ মানুষের ভিতরতন্ত্রীতে ঘা দিয়েছিল। গ্রাম সমাজের শোষক শোষিতের সমস্ত অভ্যস্ত ছককে পাল্টে দিয়েছিল। তাঁর গল্পের পাঠক্রিয়ায় এই কালান্তরকে ধরা যায়। কিন্তু এই কালান্তর—এই অস্তিরতার সময় তাঁর গল্পের গল্পত্বকে ছাড়িয়ে উচ্চকিত হয়ে থাকে না। আশ্চর্য দক্ষতায় গল্পের ভিতরে ভিতরে ধরা থাকে সময়ের জলছবি। ফলে ভগীরথের গল্পভুবন যেমন স্বতন্ত্র, তেমনি তাঁর গল্পের গ্রামের ভুবনও স্বতন্ত্র পড়ে।
এই ভুবনায়নের যুগে সারা পৃথিবী একটিই বৃহত্তর গ্রাম। সেই ভুবনগ্রামের বাসিন্দারা আর নিজেদের তো শহুরে বলে দাবি করতে পারেন না। এহেন প্রেক্ষাপটে ভগীরথের গল্পকে আর গ্রামের গল্প বলে স্বতন্ত্র সারিতে সরিয়ে রাখার জো থাকে না। তাই ভগীরথের গ্রামজীবনের গল্পও প্রকৃত প্রস্তাবে বৃহৎ ভুবনেরই গল্প হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে এই ভুবনগ্রামের বাসিন্দাদের গল্পও।
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা
রাজ অ্যাপার্টমেন্ট, ডি সি আর রোড, মুখার্জি বাগান, চন্দননগর, হুগলী-৭১২১৩৬
1 মন্তব্যসমূহ
খুবই মনোগ্রাহী।
উত্তরমুছুন