আফ্রিকান সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের অনবদ্য আখ্যান
তুষার তালুকদার
সাহিত্য ও ইতিহাস পড়ে পুরোদস্তুর লেখক হবেন--চিনুয়া আচেবের এমন স্বপ্নই তাঁকে লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছিল। তরুণ বয়সে এক-আধবার ভেবেছিলেন ডাক্তার হবেন। পরে দেখলেন, সাহিত্যের হাতছানিকে তাঁর পক্ষে না করা একেবারেই অসম্ভব। মোটাদাগে এই হচ্ছে আচেবের যাত্রা শুরুর কথা। লেখালেখির শুরু থেকেই নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্প নির্মাণের কাজে নেমেছিলেন। বিশ্বাস করতেন মানুষের কল্যাণে শিল্প, শিল্পের কল্যাণে মানুষ নয়। শিল্পের যে নিজস্ব একটা যাচাই-বাছাই আছে, তা কেবলই মানবতার মঙ্গলসাধনের জন্য।
যাঁরা ভাবেন, মানুষের কাছে শিল্পের কোনো দায়বদ্ধতা, নেই তাদের উদ্দেশে আচেবের বক্তব্য: 'অনাদিকাল থেকে শিল্প মানবকল্যাণে নিয়োজিত, সমস্ত মহত্ সাহিত্যকর্মই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের কথা মাথায় রেখে।' আফ্রিকার লেখকদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত--এ সম্পর্কে আচেবের ধারণাটা আলোচনার শুরুতে সংক্ষেপে বলতে চাই। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন ঔপন্যাসিক তাঁর জনগোষ্ঠীর শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। আফ্রিকার লেখকগোষ্ঠীকে এমন একটি সময়োচিত সংস্কৃতি নির্মাণে এগিয়ে আসা উচিত, যেখানে আফ্রিকার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বিদ্যমান মূল্যবান বিষয়াবলি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যা-কিছু ভালো--এ দুয়ের মধ্যে একটি মেলবন্ধন ঘটবে। এবং অবশ্যই এ সংস্কৃতিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী হতে হবে।
আচেবের লেখায় নাইজেরিয়া তথা গোটা আফ্রিকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পে গল্পে তিনি আফ্রিকার হেরোডোটাস। সমগ্রতা থেকে ক্ষুদ্রতায় যাত্রা করার একটি প্রয়াস তাঁর প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে সুস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মাঝেও এ-প্রবণতাটি বিদ্যমান। 'চিলেকোঠার সেপাই' পড়লেই তা বোঝা যায়। এককথায়, 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' পুরো আফ্রিকার একটি মাইক্রো-চিত্র।
'থিংস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাস হিসেবে তিনটি ভিন্ন ধারার যোগ্যতা বহন করে। সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক--এ তিনটি দিক থেকে এ উপন্যাসটিকে বিবেচনা করা যায়। ওমোফিয়া গ্রামের ইবো জনগোষ্ঠীর সামাজিক জীবনধারাকে তুলে ধরেছে এ উপন্যাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদিম এই সমাজ অপরিবর্তিত অবস্থায় চলে আসছে। ঐতিহ্যকে লালন করে অভ্যস্থ এই সমাজের সাথে বহির্বিশ্বের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। যে মানুষই এ সমাজে প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করে, তাকেই সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হয়। আদিম এ সমাজের বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, অর্থনীতি, আত্মীয়তার বন্ধন ইত্যাকার নানা বিষয়ের মাধ্যমে একটি যুগের সামাজিক চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাই একে সামাজিক উপন্যাস বললে ভুল হবে না বলে আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে প্রাক-শিল্পযুগীয় একটি সংস্কৃতির মানুষজন কীভাবে প্রথা-শাসিত জীবন যাপন করছিল তার একটি মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসটি একধাপ এগিয়ে নিজেকে নৃ-তাত্ত্বিক গুণে সমৃদ্ধ করেছে। এটি সবারই জানা, আচেবে ইতিহাসের একজন বোদ্ধা পাঠক ছিলেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি যথাযথ রেখে কিছু চরিত্র ও ঘটনার উদ্ভাবন করে আচেবে ইতিহাসের কাছে নিষ্ঠাবান ও সত্ থেকেছিলেন, যেমনটি থেকেছিলেন স্যার ওয়াল্টার স্কটও। এদিক বিবেচনায় এটি একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস। বস্তুত, চরিত্র তৈরি করেছিলেন সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের মেরুকরণকালে মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যখন ইবো সমাজের বহু বছরের মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও সংস্কতির স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করে নিজ প্রতিপত্তি স্থাপনের নগ্ন মহড়া শুরু করে, তখনই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ওকনকো এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এবং শেষপর্যন্ত এ আরোপিত সংস্কৃতি মেনে না নিতে পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়; তবুও আদর্শচ্যুত হয়নি, স্বীয় সম্মানকে বিসর্জন দেয়নি। 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর খিজির ও চেংটুও ওকনকোর মতো প্রতিবাদী। গরু চুরি বন্ধ করতে না পারলেও খয়রার গাজীর লোকজনের হাতে জীবন বিসর্জনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি চেংটু। অপরদিকে খিজিরও সমাজে অসাম্য কিংবা অসঙ্গতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। মহাজনদের মতো মানুষদের নিষ্পেষণে খিজিরের হূদয় দগ্ধ হয়। তাই সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত মহাজন গুন্ডা লাগিয়ে তাকে আহত করে। তবুও সে মাথা নোয়াবার নয়। যদিও দুটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু উদ্দেশ্য ওই একই—আরোপিত অন্যায় শাসন ও শোষণ মেনে না নেওয়া। তবে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু অন্যরকম।
চিনুয়া আচেবে ভাষার মৌখিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' লিখিছিলেন। এদিক থেকে তাঁকে উত্তরাধুনিক ঔপন্যাসিক গার্সিয়া মার্কেজ, বোর্হেস ও মারিও বার্গাস ইয়োসার সাথে তুলনা করা যায়। আফ্রিকার বিভিন্ন সমাজে রয়েছে গল্প বলার এক বর্ণালি ইতিহাস। আচেবেও ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছিলেন। তাই গল্প বলার একটি জাত প্রবণতা তাঁর কোনো উপন্যাসেই বিস্মৃত হয়নি। 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও আচেবে নিজ ভাষার বহু শব্দ ও প্রবাদ এতে জুড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, যেসব শব্দ ভাষান্তর-যোগ্য নয় সেসব শব্দ হুবহু রাখা উচিত কিংবা সেসবের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে মাধ্যম হবে ইংরেজি ভাষা। কারণ আফ্রিকায় এত ভাষা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে, এক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা আরেকটি গোষ্ঠীর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। এমন একটি একক শক্তিশালী ভাষা আফ্রিকায় নেই, যা সবাই বুঝতে পারে কিংবা তা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। তবে আচেবে দৃঢ়ভাবে এও জানিয়েছিলেন যে, ইংরেজিটা হতে হবে আফ্রিকীয় ইংরেজি অর্থাৎ আফ্রিকীয় লেখকেরা পাশ্চাত্যকে অনুকরণ না করে তাঁদের মতো করে নিজস্বতা বজায় রেখে ইংরেজি লিখবেন। এ ইংরেজি হবে আফ্রিকীয় ভাবনা প্রকাশের উপযোগী ও সহজবোধ্য। অপরপক্ষে, আফ্রিকীয় আরেক লেখক এনগোগি আচেবের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ইংরেজি নয় বরং যার যার মাতৃভাষায় লেখার মাধ্যমে আফ্রিকীয় নানা সংস্কৃতির প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব। তবে ইউরোপীয়দেরকে সত্যিকার আফ্রিকার ইতিহাস সম্পর্কে জানান দিতে গেলে ইংরেজি ভাষার কোনো বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছিলেন চিনুয়া আচেবে।
'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এর নানাদিক আলোচনার পূর্বে আফ্রিকাকে ইউরোপীয় লেখকেরা কোন চোখে দেখতেন, তা জানা সমীচীন। ব্যাখ্যায় না যেয়ে ইংরেজ লেখক জোসেফ কনরাডের 'হার্ট অব ডার্কনেস' উপন্যাসটিকে এ ক্ষেত্রে অন্যতম উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আচেবের মতামত, 'কনরাড তাঁর এ উপন্যাসের মাধ্যমে আফ্রিকীয়দের বিমানবিকীকরণ করেছেন। কনরাড একজন 'রক্তচোষা বর্ণবাদী'। তবে উপন্যাসটির মাধ্যমে তিনি বর্ণবাদমূলক যেসব কুসংস্কারের আবিষ্কার করেছেন, তা-ই কেবল তাঁর মূল শক্তির জায়গা।' এ প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছিলেন, 'কনরাড ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির কথা একবারেই মেনে নিতে পারেননি।' তাই প্রখ্যাত সমালোচক রবার্ট সায়গলকে ধার করে এবং আচেবেকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে বলতে দ্বিধা নেই, 'হার্ট অব ডার্কনেস' আফ্রিকীয়দের সত্য ও প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
এবার বলি আচেবের চোখে দেখা আফ্রিকার কথা। 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এ যেভাবে আফ্রিকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চিত্রিত হয়েছে, তা এককথায় অনবদ্য। প্রথমবারের মতো বিশ্বপাঠকেরা আচেবের বর্ণনায় আফ্রিকাকে নতুনভাবে জানল। এ জানা পূর্বাপর সব জানা থেকে ভিন্ন। এ ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল কেবল একজন নাইজেরীয় আফ্রিকার কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন বলে। মোটাদাগে, আচেবের আগ পর্যন্ত আফ্রিকার ওপর লেখা প্রায় সব আখ্যানে-ই 'পক্ষপাতমূলক' ব্যাপারটি ছিল। এর মানে, ইউরোপীয় লেখকেরা আফ্রিকীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস বর্ণনায় সব ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারেননি। যাহোক, আফ্রিকীয় সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির থাবা--এই হচ্ছে মোটাদাগে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট', যার সম্ভাব্য বাংলা আমি দিয়েছি 'সবকিছু ভেঙে পড়ে'। চিনুয়া আচেবে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের 'দ্য সেকেন্ড কামিং' কবিতা থেকে ধার করে তাঁর উপন্যাসটির নাম দিয়েছিলেন 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'। পঙক্তি দুটি এমন--
'Things fall apart, the centre can not hold;
Mere anarchy is loosed upon the world.'
অর্থাৎ, সবকিছু ভেঙে পড়ে, কেন্দ্র ধরে রাখতে পারছে না। অরাজকতায় ছেয়ে যায় পৃথিবী। আচেবের প্রেক্ষাপটে এই কেন্দ্র হচ্ছে সংস্কৃতি। অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসন বা থাবাই হল অরাজকতা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করে ফেলেছে আফ্রিকীয় সংস্কৃতিকে। আচেবের প্রশ্ন, তবে কি নিজস্ব সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাবে? উত্তরও তিনি দিয়েছিলেন--না।
এ পর্যায়ে গল্পটি বলা জরুরি। গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় মেধা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের কারণে পুরো এলাকার শাসনকর্তাদের একজন হয়ে ওঠে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওকনকো। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ সে পার্শ্ববর্তী গ্রামেরও প্রতিনিধির দায়িত্ব পায়। গ্রামের মহান ব্যক্তি এজেন্ডোর শেষকৃত্যানুষ্ঠানকালে অপ্রত্যাশিতভাবে তার বন্দুকের গুলিতে মৃত ব্যক্তির ছেলে নিহত হলে তাকে সাত বছরের জন্য নিবার্সিত জীবন যাপন করতে হয়। নির্বাসন থেকে ফিরে সে পুরো গ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পায়। তার ছেলেসহ বহু গ্রামবাসী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। সাদা চামড়ার লোকেরা সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করছে, যুগ যুগ ধরে পালিত ঐতিহ্য, প্রথা বিটিশ উপনিবেশবাদের থাবায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। ওকনকো এসব মেনে নিতে না পেরে স্থানীয় গীর্জা পুড়িয়ে দিল। নানা অপরাধের কারণে একপর্যায়ে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করল। পরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছিল বটে। কিন্তু এত দিনে তার সব স্বপ্ন শেষ। রাগে, ক্ষোভে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রতিনিধি-প্রধানকে হত্যা করল সে। তখন তার আর বুঝতে বাকি নেই যে, এখন ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। আত্মপ্রত্যয়ী ওকনকো আত্মসম্মান রক্ষার্থে আত্মহত্যা করল। তার এই আত্মহত্যা জানান দিল, ইবো সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে; ইবো ঐতিহ্যের অবসান হবে। এখানেই আচেবের যুক্তি, ছোট ছোট নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি তাদের নিজেদের দুর্বলতার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। উত্তরণের উপায় হলো স্বীয় সংস্কৃতির সাথে বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটানো। তাঁর মতে, সংস্কৃতি কোনো স্থির বস্তু নয়। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ঠেকানো অসম্ভব। পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করে, স্বীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য প্রথাকে বজায় রেখে বিদেশি সংস্কৃতির যা ভালো, তা গ্রহণ করা উচিত। আচেবের এ ধারণার সাথে একমত পোষণ করেছেন ফ্রানজ ফ্যানোও।
সবশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে চাই, 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' একটি আফ্রিকীয় ক্ল্যাসিক। যদিও অনেক সমালোচক বলে থাকেন, এই আখ্যানের চরিত্রায়নে দুর্বলতা লক্ষণীয়, শ্বাশত কোনো থিম বা ভাব এর নেই যে, প্রজন্মান্তরে মানুষ এ থেকে জরুরি কিছু পাবে। তাঁদের উদ্দেশে বলতে হবে, সংস্কৃতির যে দ্বন্দ্ব আচেবে দেখিয়েছেন, তা চিরকালীন। বিশ্বায়নের এ যুগেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে। এদিক বিবেচনায় নিজস্ব সংস্কৃতি ও আরোপিত কিংবা অগ্রসরমান সংস্কৃতি--এ দুয়ের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় ঘটবে, তা জানতে আচেবের আলোচিত উপন্যাসটির চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে!
তুষার তালুকদার
সাহিত্য ও ইতিহাস পড়ে পুরোদস্তুর লেখক হবেন--চিনুয়া আচেবের এমন স্বপ্নই তাঁকে লেখক হিসেবে গড়ে তুলেছিল। তরুণ বয়সে এক-আধবার ভেবেছিলেন ডাক্তার হবেন। পরে দেখলেন, সাহিত্যের হাতছানিকে তাঁর পক্ষে না করা একেবারেই অসম্ভব। মোটাদাগে এই হচ্ছে আচেবের যাত্রা শুরুর কথা। লেখালেখির শুরু থেকেই নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাসকে প্রাধান্য দিয়ে শিল্প নির্মাণের কাজে নেমেছিলেন। বিশ্বাস করতেন মানুষের কল্যাণে শিল্প, শিল্পের কল্যাণে মানুষ নয়। শিল্পের যে নিজস্ব একটা যাচাই-বাছাই আছে, তা কেবলই মানবতার মঙ্গলসাধনের জন্য।
যাঁরা ভাবেন, মানুষের কাছে শিল্পের কোনো দায়বদ্ধতা, নেই তাদের উদ্দেশে আচেবের বক্তব্য: 'অনাদিকাল থেকে শিল্প মানবকল্যাণে নিয়োজিত, সমস্ত মহত্ সাহিত্যকর্মই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের কথা মাথায় রেখে।' আফ্রিকার লেখকদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত--এ সম্পর্কে আচেবের ধারণাটা আলোচনার শুরুতে সংক্ষেপে বলতে চাই। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন ঔপন্যাসিক তাঁর জনগোষ্ঠীর শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক। আফ্রিকার লেখকগোষ্ঠীকে এমন একটি সময়োচিত সংস্কৃতি নির্মাণে এগিয়ে আসা উচিত, যেখানে আফ্রিকার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বিদ্যমান মূল্যবান বিষয়াবলি ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির যা-কিছু ভালো--এ দুয়ের মধ্যে একটি মেলবন্ধন ঘটবে। এবং অবশ্যই এ সংস্কৃতিকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী হতে হবে।
আচেবের লেখায় নাইজেরিয়া তথা গোটা আফ্রিকার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অনুপুঙ্খ বর্ণনা উপস্থাপিত হয়েছে। গল্পে গল্পে তিনি আফ্রিকার হেরোডোটাস। সমগ্রতা থেকে ক্ষুদ্রতায় যাত্রা করার একটি প্রয়াস তাঁর প্রায় প্রতিটি উপন্যাসে সুস্পষ্ট। বাংলা সাহিত্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মাঝেও এ-প্রবণতাটি বিদ্যমান। 'চিলেকোঠার সেপাই' পড়লেই তা বোঝা যায়। এককথায়, 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' পুরো আফ্রিকার একটি মাইক্রো-চিত্র।
'থিংস ফল অ্যাপার্ট' উপন্যাস হিসেবে তিনটি ভিন্ন ধারার যোগ্যতা বহন করে। সামাজিক, নৃ-তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক--এ তিনটি দিক থেকে এ উপন্যাসটিকে বিবেচনা করা যায়। ওমোফিয়া গ্রামের ইবো জনগোষ্ঠীর সামাজিক জীবনধারাকে তুলে ধরেছে এ উপন্যাস। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আদিম এই সমাজ অপরিবর্তিত অবস্থায় চলে আসছে। ঐতিহ্যকে লালন করে অভ্যস্থ এই সমাজের সাথে বহির্বিশ্বের বিন্দুমাত্র যোগাযোগ নেই। যে মানুষই এ সমাজে প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করে, তাকেই সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে মনে করা হয়। আদিম এ সমাজের বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, অর্থনীতি, আত্মীয়তার বন্ধন ইত্যাকার নানা বিষয়ের মাধ্যমে একটি যুগের সামাজিক চেতনা প্রস্ফুটিত হয়েছে। তাই একে সামাজিক উপন্যাস বললে ভুল হবে না বলে আমার বিশ্বাস। অন্যদিকে প্রাক-শিল্পযুগীয় একটি সংস্কৃতির মানুষজন কীভাবে প্রথা-শাসিত জীবন যাপন করছিল তার একটি মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসটি একধাপ এগিয়ে নিজেকে নৃ-তাত্ত্বিক গুণে সমৃদ্ধ করেছে। এটি সবারই জানা, আচেবে ইতিহাসের একজন বোদ্ধা পাঠক ছিলেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটটি যথাযথ রেখে কিছু চরিত্র ও ঘটনার উদ্ভাবন করে আচেবে ইতিহাসের কাছে নিষ্ঠাবান ও সত্ থেকেছিলেন, যেমনটি থেকেছিলেন স্যার ওয়াল্টার স্কটও। এদিক বিবেচনায় এটি একটি সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস। বস্তুত, চরিত্র তৈরি করেছিলেন সংস্কৃতির দ্বন্দ্বের মেরুকরণকালে মানুষের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি যখন ইবো সমাজের বহু বছরের মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা ও সংস্কতির স্বকীয়তাকে বিনষ্ট করে নিজ প্রতিপত্তি স্থাপনের নগ্ন মহড়া শুরু করে, তখনই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ওকনকো এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। এবং শেষপর্যন্ত এ আরোপিত সংস্কৃতি মেনে না নিতে পেরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়; তবুও আদর্শচ্যুত হয়নি, স্বীয় সম্মানকে বিসর্জন দেয়নি। 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর খিজির ও চেংটুও ওকনকোর মতো প্রতিবাদী। গরু চুরি বন্ধ করতে না পারলেও খয়রার গাজীর লোকজনের হাতে জীবন বিসর্জনে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেনি চেংটু। অপরদিকে খিজিরও সমাজে অসাম্য কিংবা অসঙ্গতি সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। মহাজনদের মতো মানুষদের নিষ্পেষণে খিজিরের হূদয় দগ্ধ হয়। তাই সে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত মহাজন গুন্ডা লাগিয়ে তাকে আহত করে। তবুও সে মাথা নোয়াবার নয়। যদিও দুটি উপন্যাসের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, কিন্তু উদ্দেশ্য ওই একই—আরোপিত অন্যায় শাসন ও শোষণ মেনে না নেওয়া। তবে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটি একটু অন্যরকম।
চিনুয়া আচেবে ভাষার মৌখিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' লিখিছিলেন। এদিক থেকে তাঁকে উত্তরাধুনিক ঔপন্যাসিক গার্সিয়া মার্কেজ, বোর্হেস ও মারিও বার্গাস ইয়োসার সাথে তুলনা করা যায়। আফ্রিকার বিভিন্ন সমাজে রয়েছে গল্প বলার এক বর্ণালি ইতিহাস। আচেবেও ছোটবেলা থেকে গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছিলেন। তাই গল্প বলার একটি জাত প্রবণতা তাঁর কোনো উপন্যাসেই বিস্মৃত হয়নি। 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও আচেবে নিজ ভাষার বহু শব্দ ও প্রবাদ এতে জুড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, যেসব শব্দ ভাষান্তর-যোগ্য নয় সেসব শব্দ হুবহু রাখা উচিত কিংবা সেসবের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তবে সব ক্ষেত্রে মাধ্যম হবে ইংরেজি ভাষা। কারণ আফ্রিকায় এত ভাষা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে যে, এক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা আরেকটি গোষ্ঠীর কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে। এমন একটি একক শক্তিশালী ভাষা আফ্রিকায় নেই, যা সবাই বুঝতে পারে কিংবা তা দিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। তবে আচেবে দৃঢ়ভাবে এও জানিয়েছিলেন যে, ইংরেজিটা হতে হবে আফ্রিকীয় ইংরেজি অর্থাৎ আফ্রিকীয় লেখকেরা পাশ্চাত্যকে অনুকরণ না করে তাঁদের মতো করে নিজস্বতা বজায় রেখে ইংরেজি লিখবেন। এ ইংরেজি হবে আফ্রিকীয় ভাবনা প্রকাশের উপযোগী ও সহজবোধ্য। অপরপক্ষে, আফ্রিকীয় আরেক লেখক এনগোগি আচেবের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, ইংরেজি নয় বরং যার যার মাতৃভাষায় লেখার মাধ্যমে আফ্রিকীয় নানা সংস্কৃতির প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করা সম্ভব। তবে ইউরোপীয়দেরকে সত্যিকার আফ্রিকার ইতিহাস সম্পর্কে জানান দিতে গেলে ইংরেজি ভাষার কোনো বিকল্প নেই বলে মত দিয়েছিলেন চিনুয়া আচেবে।
'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এর নানাদিক আলোচনার পূর্বে আফ্রিকাকে ইউরোপীয় লেখকেরা কোন চোখে দেখতেন, তা জানা সমীচীন। ব্যাখ্যায় না যেয়ে ইংরেজ লেখক জোসেফ কনরাডের 'হার্ট অব ডার্কনেস' উপন্যাসটিকে এ ক্ষেত্রে অন্যতম উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আচেবের মতামত, 'কনরাড তাঁর এ উপন্যাসের মাধ্যমে আফ্রিকীয়দের বিমানবিকীকরণ করেছেন। কনরাড একজন 'রক্তচোষা বর্ণবাদী'। তবে উপন্যাসটির মাধ্যমে তিনি বর্ণবাদমূলক যেসব কুসংস্কারের আবিষ্কার করেছেন, তা-ই কেবল তাঁর মূল শক্তির জায়গা।' এ প্রসঙ্গে এডওয়ার্ড সাঈদ বলেছিলেন, 'কনরাড ঔপনিবেশিক যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির কথা একবারেই মেনে নিতে পারেননি।' তাই প্রখ্যাত সমালোচক রবার্ট সায়গলকে ধার করে এবং আচেবেকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে বলতে দ্বিধা নেই, 'হার্ট অব ডার্কনেস' আফ্রিকীয়দের সত্য ও প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ।
এবার বলি আচেবের চোখে দেখা আফ্রিকার কথা। 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'-এ যেভাবে আফ্রিকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চিত্রিত হয়েছে, তা এককথায় অনবদ্য। প্রথমবারের মতো বিশ্বপাঠকেরা আচেবের বর্ণনায় আফ্রিকাকে নতুনভাবে জানল। এ জানা পূর্বাপর সব জানা থেকে ভিন্ন। এ ভিন্নতা সৃষ্টি হয়েছিল কেবল একজন নাইজেরীয় আফ্রিকার কণ্ঠস্বর হয়েছিলেন বলে। মোটাদাগে, আচেবের আগ পর্যন্ত আফ্রিকার ওপর লেখা প্রায় সব আখ্যানে-ই 'পক্ষপাতমূলক' ব্যাপারটি ছিল। এর মানে, ইউরোপীয় লেখকেরা আফ্রিকীয় সংস্কৃতি ও ইতিহাস বর্ণনায় সব ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারেননি। যাহোক, আফ্রিকীয় সংস্কৃতির ওপর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির থাবা--এই হচ্ছে মোটাদাগে 'থিংস ফল অ্যাপার্ট', যার সম্ভাব্য বাংলা আমি দিয়েছি 'সবকিছু ভেঙে পড়ে'। চিনুয়া আচেবে আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটসের 'দ্য সেকেন্ড কামিং' কবিতা থেকে ধার করে তাঁর উপন্যাসটির নাম দিয়েছিলেন 'থিংস ফল অ্যাপার্ট'। পঙক্তি দুটি এমন--
'Things fall apart, the centre can not hold;
Mere anarchy is loosed upon the world.'
অর্থাৎ, সবকিছু ভেঙে পড়ে, কেন্দ্র ধরে রাখতে পারছে না। অরাজকতায় ছেয়ে যায় পৃথিবী। আচেবের প্রেক্ষাপটে এই কেন্দ্র হচ্ছে সংস্কৃতি। অন্য সংস্কৃতির আগ্রাসন বা থাবাই হল অরাজকতা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি গ্রাস করে ফেলেছে আফ্রিকীয় সংস্কৃতিকে। আচেবের প্রশ্ন, তবে কি নিজস্ব সংস্কৃতি বিলীন হয়ে যাবে? উত্তরও তিনি দিয়েছিলেন--না।
এ পর্যায়ে গল্পটি বলা জরুরি। গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও স্বীয় মেধা, পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের কারণে পুরো এলাকার শাসনকর্তাদের একজন হয়ে ওঠে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ওকনকো। তার মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ সে পার্শ্ববর্তী গ্রামেরও প্রতিনিধির দায়িত্ব পায়। গ্রামের মহান ব্যক্তি এজেন্ডোর শেষকৃত্যানুষ্ঠানকালে অপ্রত্যাশিতভাবে তার বন্দুকের গুলিতে মৃত ব্যক্তির ছেলে নিহত হলে তাকে সাত বছরের জন্য নিবার্সিত জীবন যাপন করতে হয়। নির্বাসন থেকে ফিরে সে পুরো গ্রামে ব্যাপক পরিবর্তন দেখতে পায়। তার ছেলেসহ বহু গ্রামবাসী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। সাদা চামড়ার লোকেরা সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করছে, যুগ যুগ ধরে পালিত ঐতিহ্য, প্রথা বিটিশ উপনিবেশবাদের থাবায় বিনষ্ট হয়ে গেছে। ওকনকো এসব মেনে নিতে না পেরে স্থানীয় গীর্জা পুড়িয়ে দিল। নানা অপরাধের কারণে একপর্যায়ে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তার করল। পরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছিল বটে। কিন্তু এত দিনে তার সব স্বপ্ন শেষ। রাগে, ক্ষোভে স্থানীয় ব্রিটিশ প্রতিনিধি-প্রধানকে হত্যা করল সে। তখন তার আর বুঝতে বাকি নেই যে, এখন ধরা পড়লে মৃত্যু অনিবার্য। আত্মপ্রত্যয়ী ওকনকো আত্মসম্মান রক্ষার্থে আত্মহত্যা করল। তার এই আত্মহত্যা জানান দিল, ইবো সংস্কৃতি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মাঝে বিলীন হয়ে যাবে; ইবো ঐতিহ্যের অবসান হবে। এখানেই আচেবের যুক্তি, ছোট ছোট নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতি তাদের নিজেদের দুর্বলতার কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। উত্তরণের উপায় হলো স্বীয় সংস্কৃতির সাথে বিদেশি সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটানো। তাঁর মতে, সংস্কৃতি কোনো স্থির বস্তু নয়। সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকে ঠেকানো অসম্ভব। পরিবর্তনকে আলিঙ্গন করে, স্বীয় সংস্কৃতির অপরিহার্য প্রথাকে বজায় রেখে বিদেশি সংস্কৃতির যা ভালো, তা গ্রহণ করা উচিত। আচেবের এ ধারণার সাথে একমত পোষণ করেছেন ফ্রানজ ফ্যানোও।
সবশেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে চাই, 'থিংস ফল অ্যাপার্ট' একটি আফ্রিকীয় ক্ল্যাসিক। যদিও অনেক সমালোচক বলে থাকেন, এই আখ্যানের চরিত্রায়নে দুর্বলতা লক্ষণীয়, শ্বাশত কোনো থিম বা ভাব এর নেই যে, প্রজন্মান্তরে মানুষ এ থেকে জরুরি কিছু পাবে। তাঁদের উদ্দেশে বলতে হবে, সংস্কৃতির যে দ্বন্দ্ব আচেবে দেখিয়েছেন, তা চিরকালীন। বিশ্বায়নের এ যুগেও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে। এদিক বিবেচনায় নিজস্ব সংস্কৃতি ও আরোপিত কিংবা অগ্রসরমান সংস্কৃতি--এ দুয়ের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় ঘটবে, তা জানতে আচেবের আলোচিত উপন্যাসটির চেয়ে ভাল উদাহরণ আর কী হতে পারে!
1 মন্তব্যসমূহ
আন্তরিক ধন্যবাদ।খুবই সুন্দর তথ্যবহুল লেখা।যা থিংস ফল এপার্ট এর প্রতিটি স্তরকে স্পর্শ করেছে।
উত্তরমুছুন