সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর মারা যান। মাত্র এক মাস আগে ১২ আগস্টে যেখানে গণহত্যা হয়ে গেছে—শতাধিক নকশালপন্থী খুন হয়েছেন ওই একদিন রাত্রে—বরানগরে আমাদের ফ্লাটটা ছিল তার কেন্দ্রে। সকালে রেডিওয় খবর শুনে সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি টালায় যাই। লেখকদের মধ্যে ওই ঘনঘোর নকশাল আমলে নকশালদের সেই কোর এরিয়ায় একজন লেখকের টিকিও দেখা যায়নি—বিশেষত আনন্দবাজার থেকে সন্তোষকুমার ঘোষ সহ কারুকে দেখিনি। সকলেরই মৃত্যুভয়। কার লাশ কোথায় পড়ে যাবে, কেউ জানে না।
শুধু রমাপদ চৌধুরীকে দেখেছিলাম, কিন্তু উনিও শবমিছিলে হাঁটেন নি। তারাশঙ্করের শবযাত্রায় আমি গ্রে স্ট্রিট পর্যন্ত হেঁটেছিলাম—দৌড়েছিলাম বলাই ভালো, কারণ প্রাণ ভয়ে শোভাযাত্রাটি স্বয়ং দৌড়োচ্ছিল নিমতলা শ্মশানের দিকে। না, একজনও লেখক বা কবি সেই শবযাত্রায় ছিল না। তবু ওরই মধ্যে দেখেছিলাম, শ্যামপুকুর স্ট্রিটের মুখে ৪-৫ জন কৌতুহলী গৃহিণী আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন সোজা ছুটে এসেছেন রান্নাঘর থেকে। মনে আছে, তিনি হাতের তেলহলুদ ও মুখের ঘাম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছছিলেন। সেই মুখটিও মনে পড়ে। উত্তর কলকাতার এক বা দু’কামরা বাসাবাড়ির এইসব ঘর্মাক্ত গৃহবধুর মুখ যে কেনো দুর্গাপ্রতিমার ধড়ে বারবার দেখা যায়। এঁদের জন্য তখনো সপ্তাহে দুটি বাংলা উপন্যাস লাইব্রেরি থেকে আসে। এবং কারা নিয়ে গিয়েছিল এই শোভাযাত্রা বলে বিশ্বাস করবেন কি? বড়বাজার যুব কংগ্রেস! শবযাত্রী সবাই অবাঙালি। যাত্রাধ্বনি কী ছিল, তা-ও বলছি। জানি, কেউ বিশ্বাস করবেন না, তবু। শবযাত্রার ধ্বনি ছিল—একজন; ‘তারাশঙ্কর বন্দুপাধ্যায়’, সকলে মিলে ‘অমর রহে!’ মৃতদেহ তোলবার সময় এক-আধবার হরিধ্বনি হলেও পথে ‘রামনাম সত্য হ্যায়’ ধ্বনিই উঠেছিল।
২.
তারাশঙ্করের সঙ্গে আমি মাত্র একবারই কথা বলেছি। স্বতঃপ্রবৃত হয়ে আমি একদিন ওঁর টালার বাড়িতে যাই। তখন বিকেলবেলা। আমি ভেবেছিলাম একজন মুনিঋষিকে দেখব। তার বদলে দেখলাম, যোগভ্রষ্ট তিতিবিরক্ত একজন মানুষ, গলয় রুদ্রাক্ষ, খালি গা, মোটা উপবীত, পরনে লাল পট্টবস্ত্র। ‘পুজোয় বসতে যাচ্ছিলাম’, উনি আমাকে বলেছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি। আমার প্রথম মিনিবুক—৩২ পাতা ডাবলপ্যাক সিগারেট প্যাকেটের মতো সাইজ। তখন হৈ-চৈ চলছে মিনিবুক নিয়ে। পি.টি.আই। নিউজ হয়েছে। ভারতের অনেক কাগজেই গণেশ পাইন-কৃত মিনিবুকের প্রচ্ছদের ছবি। আমার গল্পের নাম ছিল ‘বিপ্লব ও রাজমোহন।’
আশ্চর্য, দেঝলাম তারাশঙ্কর সবই জানেন। কিন্তু যখন ওই মিনিবুক তাঁর হাতে দিলাম, বললেন, ‘চারটে কেন?’
--‘রেখে দিন, কাউকে পড়তে কেন?’
ধীরে ফেরত দিলেন তিনটে কপি। খুব ক্লান্তভাবে বললেন, ‘দরকারের বেশি জিনিস রাখবার জায়গা আমার আর নেই।‘
আমি ‘বিপ্লব ও রাজমোহন’ গল্পটির নতুনত্ব বোঝাতে গিয়ে (যাতে উনি অবহেলা না করেন বা পড়তে প্রলুব্ধ হন) ওঁকে বলেছিলাম, ‘দেখুন, এটা আসলে একজন লোক তার স্ত্রীর অবর্তমানে তার বুক সেলফটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তারই বর্ণনা—যেভাবে খেলার রিলে হয় আর কী—কারণ, খুব দ্রুত পুড়ে যাচ্ছে তো, সেই দ্রুততা ভাষাতেও এসে যাচ্ছে, ভাষা আর সম্পূর্ণ হতে পারছে না। নায়কের রিলের ভাষাও জ্বলে যাচ্ছে আর কী—শুধু একটা বই-ই শেষ পর্যন্ত আর পুড়ল না, আর সেটা হল—‘ এই পর্যন্ত বলে নিয়ে প্রতিক্রিয়ার জন্য আমি চোখ তুলি।
আমি চুপ এবং তারাশঙ্কর চুপ। দেখলাম খর্বকায় হলেও খুব উঁচু হয়ে গেছেন কীভাবে, কোনো অলৌকিক উপায়ে আমাপেক্ষা উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘অ্যাডভোকেসি কোরো না। লেখার কথা বলবে লোকে। লেখক নয়।’ তাঁর মুখ থেকে শোনা দুটি কথাই জীবনের অমূল্য নির্দেশ হয়ে আছে।
৩.
কিন্তু তারাশঙ্কর যখন এক তলার পাশের ঘরে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তখন সত্যিই এক অবাক কান্ড ঘটেছিল। এমন অলৌকিক ঘটনা আমার জীবনে দুটি নেই।
উঁচু দেওয়ালে (প্রদর্শনীর মতো আই-লেভেলে নয়) সারবন্দী স্বরচিত তৈলচিত্রগুলির একটির দিকে আঙুলিসঙ্কেত করে তারাশঙ্কর আমাকে বলেছিলেন, ‘ওই দ্যাখো পাখি।‘
--হাঁসুলুবাঁকের?’
--‘হ্যাঁ’।
--‘আর ওই যে বসন...ঠাকুরঝি! আর ওই করালিচরণ। ওরা সব...’—তারপর বাকিটা বিড়বিড়। বা, কথা জড়িয়ে গেল তাঁর।
ঠিক তখনই দেখলাম স্কাইলাইট দিয়ে প্রবেশ করে একটি সূর্যাস্ত-রশ্মি পাখির হাতে... পাখির মেটেসিঁদুরবর্ণ স্তনবৃন্তটি বনবন করে ঘরছে বলে মনে হয়—ঘোর আক্রোশে পাখি তার স্রষ্টার দিকে যেন একটা বল্লম ছুড়ে মারতেই উদ্যত—রক্তিম পট্টবস্ত্র আর রুদ্রাক্ষ গলায় তারাশঙ্কর সেদিনের সেই মৌনমুখর বিকেলবেলায় কেমন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠেছিলেন! কী-এক মায়াবী যাদুবল আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক সময়-ক্যাপসুলের মধ্যে, যেখানে শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যানি আর বৈদিক মন্ত্রধ্বনি, একদিন যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল ‘মা নিষাদ’! এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই উনি মারা যান।
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর মারা যান। মাত্র এক মাস আগে ১২ আগস্টে যেখানে গণহত্যা হয়ে গেছে—শতাধিক নকশালপন্থী খুন হয়েছেন ওই একদিন রাত্রে—বরানগরে আমাদের ফ্লাটটা ছিল তার কেন্দ্রে। সকালে রেডিওয় খবর শুনে সেখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি টালায় যাই। লেখকদের মধ্যে ওই ঘনঘোর নকশাল আমলে নকশালদের সেই কোর এরিয়ায় একজন লেখকের টিকিও দেখা যায়নি—বিশেষত আনন্দবাজার থেকে সন্তোষকুমার ঘোষ সহ কারুকে দেখিনি। সকলেরই মৃত্যুভয়। কার লাশ কোথায় পড়ে যাবে, কেউ জানে না।
শুধু রমাপদ চৌধুরীকে দেখেছিলাম, কিন্তু উনিও শবমিছিলে হাঁটেন নি। তারাশঙ্করের শবযাত্রায় আমি গ্রে স্ট্রিট পর্যন্ত হেঁটেছিলাম—দৌড়েছিলাম বলাই ভালো, কারণ প্রাণ ভয়ে শোভাযাত্রাটি স্বয়ং দৌড়োচ্ছিল নিমতলা শ্মশানের দিকে। না, একজনও লেখক বা কবি সেই শবযাত্রায় ছিল না। তবু ওরই মধ্যে দেখেছিলাম, শ্যামপুকুর স্ট্রিটের মুখে ৪-৫ জন কৌতুহলী গৃহিণী আগে থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন সোজা ছুটে এসেছেন রান্নাঘর থেকে। মনে আছে, তিনি হাতের তেলহলুদ ও মুখের ঘাম শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছছিলেন। সেই মুখটিও মনে পড়ে। উত্তর কলকাতার এক বা দু’কামরা বাসাবাড়ির এইসব ঘর্মাক্ত গৃহবধুর মুখ যে কেনো দুর্গাপ্রতিমার ধড়ে বারবার দেখা যায়। এঁদের জন্য তখনো সপ্তাহে দুটি বাংলা উপন্যাস লাইব্রেরি থেকে আসে। এবং কারা নিয়ে গিয়েছিল এই শোভাযাত্রা বলে বিশ্বাস করবেন কি? বড়বাজার যুব কংগ্রেস! শবযাত্রী সবাই অবাঙালি। যাত্রাধ্বনি কী ছিল, তা-ও বলছি। জানি, কেউ বিশ্বাস করবেন না, তবু। শবযাত্রার ধ্বনি ছিল—একজন; ‘তারাশঙ্কর বন্দুপাধ্যায়’, সকলে মিলে ‘অমর রহে!’ মৃতদেহ তোলবার সময় এক-আধবার হরিধ্বনি হলেও পথে ‘রামনাম সত্য হ্যায়’ ধ্বনিই উঠেছিল।
২.
তারাশঙ্করের সঙ্গে আমি মাত্র একবারই কথা বলেছি। স্বতঃপ্রবৃত হয়ে আমি একদিন ওঁর টালার বাড়িতে যাই। তখন বিকেলবেলা। আমি ভেবেছিলাম একজন মুনিঋষিকে দেখব। তার বদলে দেখলাম, যোগভ্রষ্ট তিতিবিরক্ত একজন মানুষ, গলয় রুদ্রাক্ষ, খালি গা, মোটা উপবীত, পরনে লাল পট্টবস্ত্র। ‘পুজোয় বসতে যাচ্ছিলাম’, উনি আমাকে বলেছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি। আমার প্রথম মিনিবুক—৩২ পাতা ডাবলপ্যাক সিগারেট প্যাকেটের মতো সাইজ। তখন হৈ-চৈ চলছে মিনিবুক নিয়ে। পি.টি.আই। নিউজ হয়েছে। ভারতের অনেক কাগজেই গণেশ পাইন-কৃত মিনিবুকের প্রচ্ছদের ছবি। আমার গল্পের নাম ছিল ‘বিপ্লব ও রাজমোহন।’
আশ্চর্য, দেঝলাম তারাশঙ্কর সবই জানেন। কিন্তু যখন ওই মিনিবুক তাঁর হাতে দিলাম, বললেন, ‘চারটে কেন?’
--‘রেখে দিন, কাউকে পড়তে কেন?’
ধীরে ফেরত দিলেন তিনটে কপি। খুব ক্লান্তভাবে বললেন, ‘দরকারের বেশি জিনিস রাখবার জায়গা আমার আর নেই।‘
আমি ‘বিপ্লব ও রাজমোহন’ গল্পটির নতুনত্ব বোঝাতে গিয়ে (যাতে উনি অবহেলা না করেন বা পড়তে প্রলুব্ধ হন) ওঁকে বলেছিলাম, ‘দেখুন, এটা আসলে একজন লোক তার স্ত্রীর অবর্তমানে তার বুক সেলফটা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তারই বর্ণনা—যেভাবে খেলার রিলে হয় আর কী—কারণ, খুব দ্রুত পুড়ে যাচ্ছে তো, সেই দ্রুততা ভাষাতেও এসে যাচ্ছে, ভাষা আর সম্পূর্ণ হতে পারছে না। নায়কের রিলের ভাষাও জ্বলে যাচ্ছে আর কী—শুধু একটা বই-ই শেষ পর্যন্ত আর পুড়ল না, আর সেটা হল—‘ এই পর্যন্ত বলে নিয়ে প্রতিক্রিয়ার জন্য আমি চোখ তুলি।
আমি চুপ এবং তারাশঙ্কর চুপ। দেখলাম খর্বকায় হলেও খুব উঁচু হয়ে গেছেন কীভাবে, কোনো অলৌকিক উপায়ে আমাপেক্ষা উচ্চতাবিশিষ্ট হয়ে ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘অ্যাডভোকেসি কোরো না। লেখার কথা বলবে লোকে। লেখক নয়।’ তাঁর মুখ থেকে শোনা দুটি কথাই জীবনের অমূল্য নির্দেশ হয়ে আছে।
৩.
কিন্তু তারাশঙ্কর যখন এক তলার পাশের ঘরে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তখন সত্যিই এক অবাক কান্ড ঘটেছিল। এমন অলৌকিক ঘটনা আমার জীবনে দুটি নেই।
উঁচু দেওয়ালে (প্রদর্শনীর মতো আই-লেভেলে নয়) সারবন্দী স্বরচিত তৈলচিত্রগুলির একটির দিকে আঙুলিসঙ্কেত করে তারাশঙ্কর আমাকে বলেছিলেন, ‘ওই দ্যাখো পাখি।‘
--হাঁসুলুবাঁকের?’
--‘হ্যাঁ’।
--‘আর ওই যে বসন...ঠাকুরঝি! আর ওই করালিচরণ। ওরা সব...’—তারপর বাকিটা বিড়বিড়। বা, কথা জড়িয়ে গেল তাঁর।
ঠিক তখনই দেখলাম স্কাইলাইট দিয়ে প্রবেশ করে একটি সূর্যাস্ত-রশ্মি পাখির হাতে... পাখির মেটেসিঁদুরবর্ণ স্তনবৃন্তটি বনবন করে ঘরছে বলে মনে হয়—ঘোর আক্রোশে পাখি তার স্রষ্টার দিকে যেন একটা বল্লম ছুড়ে মারতেই উদ্যত—রক্তিম পট্টবস্ত্র আর রুদ্রাক্ষ গলায় তারাশঙ্কর সেদিনের সেই মৌনমুখর বিকেলবেলায় কেমন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে উঠেছিলেন! কী-এক মায়াবী যাদুবল আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক সময়-ক্যাপসুলের মধ্যে, যেখানে শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যানি আর বৈদিক মন্ত্রধ্বনি, একদিন যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল ‘মা নিষাদ’! এই ঘটনার কয়েকমাস পরেই উনি মারা যান।
2 মন্তব্যসমূহ
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনতারাশঙ্কর "চট্টো"পাধ্যায় নয় "বন্দ্যো"পাধ্যায় (শিরোনাম)।
উত্তরমুছুন