কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর : একজন কথা-র কথাশিল্পীর অসীমে যাত্রা

অনিন্দ্য আসিফ

২০০৬ সালের কোনও এক রৌদ্রস্নাত দুপুরকে স্মরণ করি। আজ বড় বেশি স্মরণে আসে সেই দুপুর। বেশ রোদ। কিন্তু নদীতীরবর্তী হওয়ায় দত্ত স্টুডিওতে ধড়ফড়িয়ে বাতাস ঢুকছে। ফটোগ্রাফার আসলাম ডাক দিয়ে বলল, চিটাগং থেকে তোমার নামে পার্সেল এসেছে। তখনাবধি চট্টগ্রামে আমার কেউ ছিল না। না আত্মীয়, না পরিচিতজন। নিউজপেপার, নিউজ চ্যানেলে কেবল নানা কর্ম-অপকর্মের বন্দর নগরী হিসেবে চট্টগ্রামকে জানা হত মাঝে মাঝে।


পার্সেল হাতে নেওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সাথে এক প্রকার আত্মীয়তায় জড়িয়ে যেতে লাগলাম। কারণ পার্সেলটা পাঠিয়েছেন ‘কথা’ কাগজের সম্পাদক কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর। প্যাকেট খুলে কথা-র ১ম, ২য় ও ৩য় সংখ্যাটা পেয়ে এবং পড়ে দারুণ লাগল। বিশেষতঃ তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার স্টাইলটা। সবশেষ সংখ্যা পর্যন্ত তাঁর এই স্টাইলটা অব্যাহত ছিল। পড়লে মনে হয় আমি নিজেও ঐ সাক্ষাৎকার, আড্ডার অংশ। তখন মনে হল তাঁর সাথে আরও আগে জানাশোনা থাকা উচিত ছিল। যেহেতু কী অদ্ভুত তখনই প্রথম জানলাম তিনি আর আমি এক-ই জেলার, পাশাপাশি থানার মানুষ।

আমি তাঁকে ফোন দিলাম। বিকেলে। দলা দলা চমৎকার বাতাস বিরাজমান ছিল তখন। তারচে চমৎকার ছিল ফোনে তাঁর কণ্ঠস্বর। পরিস্কার, স্মিতহাস্য। সত্যি বলতে এতোটা অমায়িক, প্রাণবন্ত কিন্তু ব্যক্তিত্বপ্রবল লেখক, সম্পাদক সর্বোপরী মানুষ আমি পাইনি। আমি কথা-য় লেখার আয়তন জানিয়ে পাঠাতে চাইলাম। তিনি বললেন, আয়তন কোনও ব্যাপার না। কথা মান বিবেচনায় লেখা চাপে। আমি দশ হাজার শব্দের একটা গল্প পাঠালাম। কিছুদিন পর তিনি ফোন করলেন। বললেন, লেখাটা আমার খুব মজা লেগেছে।

তিনি খুব মজারও মানুষ ছিলেন। কেননা তার পর থেকে প্রায় সময় তাঁর সাথে ফোনে কথা হত এবং তার ফলে তাঁর এই গুণের ব্যাপার বুঝতে পেরেছ্। আমি এখন কোনও জনপ্রিয় এমনকি মিডিয়াবাজদের খপ্পরে থাকা সমসাময়িক লেখক, সম্পাদককে খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন দিই না। কারণ তাদের ফোন দিলে তারা নিজেদের যেন অতিমানব ভেবে বসে। অথচ শেষ দিকে জাহাঙ্গীর ভাই কথাসাহিত্যে বেশ পরিচিত মুখ এবং জনপ্রিয়ও হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর পা মর্তেই ছিল। যেকোনও সময় কোনও লেখক অথবা বইয়ের খোঁজ চাইলে অবলীলায় যেন নিজের দায়িত্ব ভেবে দিতেন।

এই অসাধারণ মানুষের সাথে আমার দেখা হতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত লেগে গেল। কেননা তিনি বাড়িতে খুব একটা আসতেন না অথবা কর্মব্যস্ততার দরুণ খুব একটা থাকতেন না। সেদিন তাঁর জন্মভিটা বাজিতপুরে লেখক শিবির ‘কোর্টমার্শাল’ নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। কলেজের মাঠে। মুক্ত মঞ্চে। সংস্কৃতিকর্মী ও লেখক রাতুল হরিৎ-এর আমন্ত্রণে আমি গিয়েছিলাম। ফোন করে জানলাম জাহাঙ্গীর ভাই বাজিতপুরেই আছেন। সন্ধ্যায় নাটক দেখতে আসবেন।

নাটক শুরু হওয়ার আগে আমার সামনে চোখে চশমাধারী এক বিশাল দেহী, শান্ত, স্মিতহাস্য মানুষকে দেখলাম। ফেসবুকে দেখা একটা ছবির হুবুহু ফটোকপি যেন। জেনে নিলাম ইনি কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর।

নাটক শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত গল্প, গল্পকার এবং এই দুইয়ের ধরণ-ধারণ এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক কথা হল। তারপর আলাপ হ’ল ছোট কাগজ আর ছোট কাগজের বর্তমান দর্শন নিয়ে। এক ফাঁকে আমি গল্পবিষয়ক একটি কাগজ করার পরিকল্পনার কথা তাঁকে বললাম। তিনি বললেন, কাগজ করার আগে ভালো করে ভেবে নাও যে এ’টা তুমি কেন করবে? তাঁর আত্মজিজ্ঞাসার এই দর্শনটা আমার দারুণ লাগল।

নাটক শেষে তিনি আমাকে তাঁর সাথে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু রাতুল হরিৎ দিতে চাইলেন না। আমরা আমাদের প্রথম এবং শেষবার মুখোমুখিতা থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। পরদিন ট্রেনে আমি যখন কিশোরগঞ্জমুখী তিনি তখন চট্টগ্রামমুখী। তিনি ফোন দিয়ে আমার অবস্থান এবং কুশলাদি জানতে চাইলেন। আমি বললাম দেখা না হলে আমি জানতাম না যে আপনি কতোটা নিরহংকারী আর সজ্জ্বন লোক। তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। দীর্ঘব্যবধানের দূরত্বে থাকা বিপরীতমুখী দু’টো ট্রেনের যেন মেলবন্ধন ঘটে গেল। এই হলেন কথা-র কথাশিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর।


তার বেশ কিছুদিন পর অনুপ্রাণন কাগজে তাঁর এক লেখায় জানলাম তিনি অদিতি ফাল্গুনীর সমসাময়িক লেখক। আমার খটকা লাগল। ফোন করলাম। তিনি বললেন, আসলে আমি লেখালেখিতে বেশ দেরিতে এসেছি। যে কারণে বয়সে ছোট হয়েও অদিতি আমার সমাসাময়িক। তারপর বললেন, ও হ্যাঁ, ইদানিং দেখছি তোমার গল্পে জটিলতা ঢুকে যাচ্ছে। প্রথমদিকের সহজবোধ্যতা যেন হারিয়ে ফেলছ। এমন কেন করছ? অকস্মাৎ এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হব ভাবিনি। আসলে এই উত্তরটা আমারও জানা ছিল না। এই উত্তরটা কখনও দেয়া হবে না ভাবিনি। কিন্তু তাই হল। এক কাককর্কশ দুপুরে রাতুল হরিৎ ফোন করে বললেন, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর আর নেই। আমার জীবনে এরচে’ করুণ বাক্য কখনও শুনিনি। পড়িওনি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ