গুন্টার গ্রাস: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির বিতর্কিত ও নন্দিত কলমযোদ্ধার মহাপ্রয়াণ


----------------------------------------------------------------
মনোজিৎকুমার দাস 

বর্ণময় সাহিত্য জীবনের অধিকারী সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী জার্মান লেখক গুন্টার গ্রাস (১৯২৭- ২০১৫) । তাঁর সৃষ্টিকর্ম বিচিত্রধর্মী। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ভাস্কর ও গ্রাফিক ডিজাইনার। জার্মান সাহিত্যের এ সব্যসাচী লেখক গুন্টার গ্রাস ৮৭ বছর বয়সে দীর্ঘ সাহিত্য সাধনা ও সাফল্য লাভের পর ১৩ এপ্রিল ২০১৫ সালে জার্মানির লুবেক শহরে লোকান্তরিত হন।


গুন্টার গ্রাস তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম ’ (১৯৫৯) এর জন্যে ১৯৯৯ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের জন্যে গ্রাসের নাম ঘোষণা করে সুইডিশ একাডেমি সাইটেশনে বলে, গ্রাসের বিতর্কিত মতামতের সাথে তাদের অমিল থাকা সত্ত্বেও তারা গ্রাসকে বিশ্বের একজন উঁচুমানের লেখক বলে অভিহিত করছেন। তাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানির কালজয়ী লেখক হিসাবে তাঁকে বিবেচনা করেন। একাডেমি নোবেল ঘোষণায় জানায় “ জার্মানির কৃষ্ণ অধ্যায়গুলোকে গুন্টার গ্রাস ইতিহাসের বিস্মৃত, বিলুপ্ত মুখচ্ছবিকে মূর্ত করে তুলেছেন ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসে। জার্মান ভাষায় গ্রাসের চমৎকার বাক্য বিন্যাস ও অপরিমেয় দৃঢ়তা ও মুনশীয়ানা টমাস ম্যানের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।” সুইডশ একডেমি ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাস সম্বন্ধে আরো বলে, “যুদ্ধের ফলে শিল্প সাহিত্য আর নৈতিক ধ্বংসের পর এ উপন্যাসটা জার্মান সাহিত্যে নতুন দিগন্তের দ্বার মোচন করে দেয়।” অন্যদিকে, ১৯৯১ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী নাদিন গোর্ডিমার গুন্টার গ্রাসের‘ দ্য টিন ড্রাম’ সম্বন্ধে ১৯৯৯ সালে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন, “ গ্রাসের লেখায় খুবই রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্ব বহন করে , বিশেষ করে দ্বিতীয় যুদ্ধের পর জার্মানির রেঁনেসাস এর ক্ষেত্রে। জার্মানরা যা যা করেছিল তিনি কখনোই তা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। ”

গুন্টার গ্রাস ১৯২৭ সালের ১৬ অক্টোবর জার্মানির লংফোর, ফ্রি সিটি অফ ড্যানজিগ (বর্তমান জিডানস্কে, পোলান্ড) এ জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম গুন্টার উইলহেম গ্রাস। জন্মের পর থেকে তাঁর জীবন উত্থান -পতন, জয় -পরাজয়ে ভরা। গুন্টার গ্রাস বেড়ে ওঠেন অতি সাধারণ এক পরিবারে। তাঁর পিতা উইহেম গ্রাস ছিলেন প্রোটেস্ট্যান্ট এথনিক জার্মান। অপরপক্ষে, তাঁর মা হেলেন গ্রাস ছিলেন কাশুবিয়ান- পোলিশ বংশোদ্ভুত রোমান ক্যাথলিক। মা - বাবা একই ধর্মের দু’ধর্মীয় মতের হলেও গুন্টার গ্রাস ক্যাথলিক হিসাবেই বেড়ে উঠেন। তাঁর বাবা -মা একটা মুদির দোকান চালাতেন ড্যানজিগে, তাদের খরিদ্দারের সংখ্যা ছিল খুবই কম, ফলে সব সময় তাদেরকে আর্থিক অচ্ছলতার মাঝ দিয়ে চলতে হতো। তাদের পরিবারটি ছোট্ট একটা অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করত।

গ্রাসের কিশোর বয়সটা তেমন সুখময় ছিল না। তিনি ১৯৪৪ সালে ১৬ বছর বয়সে জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং হিটলারের ইয়ুথ ব্রিগেডের একজন সদস্য হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকে প্রত্যক্ষ করেন। তিনি ১৯৪৫ সালের মে মাসে কিশোর সৈনিক হিসাবে নাজি স্পেশাল ইউনিটের ওয়াফেন এসএস-এ যোগদান করেন। সংক্ষিপ্ত পরিসেবা প্রদানের পর মার্কিনবাহিনী তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে এপ্রিলে তিনি মুক্তি পান।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা পরবর্তীকালে গুন্টার গ্রাস নিজেই ব্যক্ত করেছেন। হিটলার জার্মানির ক্ষমতা দখল এবং তাদের নিজস্ব শহর ফ্রি সিটি অফ ড্যানজিগে নিয়ন্ত্রণ লাভ করার সময় গ্রাসের বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। তার চার বছর পরে গ্রাস দ্য হিটলার ইয়ুথ মুভমেন্টে যোগদান করেন, তিনি ১৯৯২ সালে WHYY's Fresh Air কে বলেন,“ এ দলে ১০ বছর বয়সী একটা বালকের পক্ষে যোগদান করা ছিল একটা বিস্মকর ব্যাপার। সেখানে একটা পতাকা, একটা তাবু, আর ছিল বয়েসস্কাউটসের খেলাধুলোর মতো ব্যাপারস্যাপার। বলতে গেলে বলতে হয় ,প্রথম দিকে এটা ‘ রাজনৈতিক ছিল না। কিন্তু এটা এক সময় ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হয়ে গেল। সে সময় হিটলারের ইয়ুথ মুভমেন্ট সত্যি সত্যি নাৎসিদের সফল প্রচার প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল।”

এক সময় গ্রাস সাবমেরিন সার্ভিসে স্বেচ্ছাসেবক হলেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে তা একটা ট্যাঙ্ক ইউনিটে পরিণত হল। “ যুদ্ধের শেষ বছরে আমি ১৬ বছর বয়সে একজন সৈনিক হলাম।” গ্রাস তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেন। “ ১৭ বছর বয়সে যুদ্ধ শেষ হলে আমাকে একটা আমেরিকান প্রিজন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হলে আমি একজন যুদ্ধবন্দী হলাম। ধীরে ধীরে আমি আবিষ্কার করলাম আসলে কী ঘটেছিল। প্রথম দিকে আমি বিশ্বাস করতাম না---- আমি ভাবলাম , তারা যা যা আমাদেরকে বলছে তা তাদের প্রোপাগান্ড ছিল। জার্মানির জনগণের পক্ষে এটা করা সম্ভব না।” নুরেমবার্গে নাজি ওয়ার ক্রিমিনালস এর বিচারের ফলে সত্যিটা বুঝতে পেরেছিলেন বলে গ্রাস বলেন। এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন , “ আমি রেডিওতে আমার সাবেক ইয়ুথ লিডারের কথা শুনলাম----- তিনি বললেন হ্যাঁ এটা সত্যি। এটা ছিল ভয়ঙ্কর। সেই মুহূর্ত থেকে এটা পরিষ্কার হল কী ঘটেছিল। সেই সত্যিটা কখনোই আমার পিছু ছাড়েনি।

১৯৫২ সালে ফেডারেল রিপালিক অফ জার্মান ছিল নতুন রাষ্ট্র , আর সে সময়ে গ্রাসের জীবনে বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটতে থাকে। শিল্পকলার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে তিনি ভাস্কর্য ও গ্রফিক ডিজাইনে পড়াশোনা করলেন। সে সময়ই তিনি জাজ ব্যান্ডে যোগদান করে বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন।

গ্রাস ১৯৫২ সালে বার্লিনে চলে যান , ভর্তি হন ওখানকার স্টেট একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। ওখানে গ্রফিক ডিজাইনের চাকরিও করেন। ১৯৫০ এর দশক থেকেই তিনি কবিতা ও নাটকের স্ক্রিপটস লিখতে শুরু করেন। তিনি বিকল্পধারার তরুণ লেখকদের সংগঠন ‘ গ্রুপ ৪৭’ এর সঙ্গে যুক্ত হন। আর সে সময় থেকেই তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে থাকে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায়। ১৯৫৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘অ্যাডভান্টেজেস অফ মুরহেন্স ’ বিদ্রুপাত্মক ও পরাবাস্তব অনুষঙ্গে লেখেন ।

১৯৫৪ সালে তিনি সুইডিশ নৃত্যশিল্পী আন্না মার্গারেট শোয়ার্জকে বিয়ে করেন। তার আগে থেকেই তার লেখালেখির সূত্রপাত। লেখালেখির তাগিদেই তিনি অনুকূল পরিবেশের সন্ধান করেন।এ কারণেই গ্রাস ১৯৫৬ সালে বেশ কিছুদিনের জন্যে তাঁর প্রথম স্ত্রী আন্না আর যমজ দুই সন্তানসহ প্যারিসে বসবাস করেন। সেখানে থেকে তিনি জার্মান জাতির অতীতের বাস্তবতাকে তাঁর লেখার মাধ্যমে তুলে ধরতে সচেষ্ট হন। প্যারিসে বসেই গ্রাস তাঁর মাস্টরপিস ‘দ্য টিন ড্রাম’ (১৯৫৯) রচনা করেন। তারপর একে একে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউজ’(১৯৬১), ‘ডগ ইয়ার্স ’( ১৯৬৩) নামে আরো দুটো উপন্যাস রচনা করেন ।‘দ্য টিন ড্রাম’টি ব্যাপক ভাবে সাফল্য লাভের পর তিনি জার্মানীতে ফিরে আসেন।

গ্রাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ (১৯৫৯), ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউজ ’(১৯৬১),‘ ডগ ইয়ার্স ’( ১৯৬৩) উপন্যাসত্রয়ে জার্মান জাতির অতীতের ঘটনা প্রবাহকে গ্রাস বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উপস্থাপন করেন । এ তিনটি উপন্যাস আলাদা আলাদা ভাবে তিনি রচনা করলেও এগুলো তাঁর জন্ম শহর ড্যানজিগের প্রেক্ষাপটে রচিত একটি টিলজির এক এক খন্ডও বটে । গ্রাস তাঁর উপন্যাস ত্রয়ে আংশিক ভাবে তুলে ধরেছেন জার্মান সেনাবাহিনীতে যেন তাঁরই কাজের ফিরিস্তি, যুদ্ধ কয়েদী হিসাবে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় বন্দী জীবনেরই অভিজ্ঞতার কথা। এ উপন্যাস ত্রয়ে নাজি মতবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে জার্মানদের প্রতিক্রিয়া, যুদ্ধের আতঙ্ক এবং হিটলারের পরাজয়ের পর নাজিবাহিনীর অপরাধ সম্পর্কে বিস্তারিত ঘটনা প্রবাহকে গুন্টার গ্রাস সত্য কথনের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন।

জার্মান ভাষায় লেখা গ্রাসের প্রথম উপন্যাস ‘ডাই ব্লেশট্রোমেল’(১৯৫৯) কে র‌্যালফ মানহেইম ১৯৬১ সালে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন ‘ দ্য টিন ড্রাম’ নামে। র‌্যালফ মানহেইমের সুখপাঠ্য অনুবাদে পাঠক এ উপন্যাসে গ্রাসের সৃজনশীলতার প্রমাণ পান। গুন্টার গ্রাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস অভিজ্ঞতার আলোকে লেখেন। তাঁর এ উপন্যাসটি পোলান্ডে তাঁর ছোটবেলার শহর ড্যানজিগকে নিয়ে আবর্তীত। ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র অস্কার বামন আকৃতির এক ড্যানজিগ বালক। সে নাজি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয়। একজন শিশু হয়েও ধুরন্ধর ও নিষ্ঠুর বয়স্কদের জগতের জার্মান ও পোলদের দ্বন্দ্ব সংঘাত আর লড়াইয়ে কথা ছেলেটি প্রকাশ করে। খেলনা ড্রাম বাজিয়ে কাচ ভাঙার আর্তনাদ সৃষ্টির মাধ্যমে সে তার ক্ষোভ ও অনুভূতি প্রকাশ করে। তার চারপাশের সক্রিয় দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিক , আর ভোগবাদী নিষ্ঠুর মানুষের পদচারণা। গুন্টার গ্রাস এ উপন্যাসে কেন্দ্রীয় চরিত্র অস্কারের পরাবাস্তব ও অ্যাডভেঞ্চারের মাধ্যমে নাৎসীবাদ এবং পেটিবুর্জোয়া শ্রেণীর উত্থান কাহিনি উঠে এসেছে। অস্কার ড্রাম পেটায়, তার আকাশ ফাটানো আওয়াজ কানে ঢোকে বজ্রপাতের মতো। কানের পর্দা ছিঁড়ে চলে যায় মগজর মধ্যে, তারপর মগজ থেকে শিরাগুলোর মাঝ দিয়ে রক্তের ভেতরে মিশে যায়। অস্কারের ওইটুকু হাতের বাড়ি এতটাই প্রচন্ড যে তা ছাপিয়ে ওঠে মেশিনগান স্টেনগানের ব্রাশফায়ারকে। গুন্টার গ্রাস মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে প্রায় ছ’শ পৃষ্ঠার এ উপন্যাস রচনা করেন। আত্মজীবনীমূলক অনুষঙ্গে লেখা গ্রাসের এ উপন্যাস নায়ক অস্কার গ্রাসের মতোই ড্যানজিগের ছেলে। সে গ্রাসের মতো এক হিসাবে একজন শিল্পীও বটে, কারণ সে একজন ড্রামবাদক। উপন্যাসটি পড়ে মনে হয়, গ্রাস নিজের জীবনেরই অনেক অনুভূতি ও ঘটনা ,তা বাস্তব বা অবাস্তব অনুষঙ্গে অস্কার জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে। অস্কার একটি মানসিক রোগের হাসপাতালে পরীক্ষাধীন অবস্থায় ত্রিশ বছর বয়সে স্মৃতিচারণ করেছে। তার স্মৃতিচারণার সহায়ক তার ড্রাম। একটি টিনের ড্রাম তিন বছর বয়সে সে তার মায়ের কাছ থেকে উপহার পেয়েছিল। টিনের ড্রাম বাজিয়ে স্মৃতিচারণ করেছে সে। মায়ের জন্ম থেকে স্মৃতিচারণ শুরু। অস্কার আত্মপীড়ক, সে ইচ্ছে করেই আঘাত করে নিজের শরীরের গড়ন খাটো করে নেয়। গুন্টার গ্রাস এ নায়কের মাধ্যমে একবার হিটলারের আদমীদের প্রচার সভা বানচাল করিয়েছেন এবং যুদ্ধের সময় প্রচার বিভাগে বাদ্যকর হিসেবে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ত্রিশ বছর বয়সে পৌঁছে অবিবাহিত অস্কার জীবনের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, তার জীবনে যতো মেয়ে এসেছে সবাই কালো ডাইনী, আর যারা আসবে তারাও তাই হবে। গ্রাস এ উপন্যাসটিতে কষ্টেসৃষ্ট হাসি কৌতুক পরিবেশন করেছেন। গুন্টার গ্রাস এ উপন্যাসে জীবনের হৃদয়হীন বর্বরতার দিকটা অস্কারের জীবন কাহিনিতে তুলে ধরেছেন তা অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করলে আমরা অনায়সেই বুঝতে পারি হিটলারের বর্বর শাসন এবং যুদ্ধোত্তর জার্মানীতে মানবতার ললিত বাণী কতটা অর্থহীন ছিল।

গুন্টার গ্রাস শুধুমাত্র একজন ঔপন্যাসিক ,কবি, একজন ভাস্কর ও ডিজাইনার হয়েই ওইগুলোর মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন না। প্যারিস থেকে ফেরার পর তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির ( এসডিপি) সদস্য পদ লাভ না করেও এসডিপি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। । ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে তিনি উইলি ব্রান্ডটকে সমথর্ন এবং তার পক্ষে ক্যাম্পেন করেন। তিনি আনুষ্ঠনিকভাবে ১৯৮২ সালে এসডিপি তে যোগদান করেন। প্রায় ১০ বছর পার্টিতে থাকার পর জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের ব্যাপারে দলের নিয়ন্ত্রণমূলক কঠোর নীতির প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেন।।

আবারো গুন্টার গ্রাসের ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসের প্রসঙ্গ বলতে হয়। নির্দ্ধিধায় বলতে হয়, ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি তাঁর মাস্টারপিস হিসাবে বিবেচিত। যদিও প্রথম দিকে জার্মানীতে গ্রাসের ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসটি শুধুমাত্র নন্দিতই হয়নি, নিন্দিতও হয়েছিল কারণ তাদের দৃষ্টিতে গুন্টার গ্রাস এমন সব বিষয় সকলের সামনে নগ্নরূপে হাজির করেছেন যা তখন পর্যন্তও জার্মানদের কাছে ছিল নিষিদ্ধ বিষয় হিসাবে গণ্য। এ উপন্যাসটি রচনার ২০ বছর পর ১৯৭৯ সালে একে অবলম্বন করে চলচ্চিত্র তৈরি হলে ওই বছরই শ্রেষ্ঠ বিদেশী গল্প অবলম্বনে ছায়াছবি ক্যাটাগরিতে অস্কার পুরস্কার লাভ করে। তারপর থেকে এ উপন্যাসের জনপ্রিয়তা ব্যাপক ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিশ্ব সাহিত্যে পাঠক ,বোদ্ধা ও সমালোচকদের কাছে আজও এ উপন্যাসটি বিশেষ সমাদৃত। সে সময় সালমান রুশদীর মতো বিশ্ব সাহিত্যের খ্যাতিমান তরুণ ঔপন্যাসিকও বিশেষ আঙ্গিক ও ঘরাণায় লেখা এ উপন্যাসের প্রশংসা করেন। ৪০ বছর পর ১৯৯৯ সালে এ উপন্যাসই তাঁকে জার্মান সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।

গ্রাস ২০০৯ সালে নিজের বিস্ময়ের কথা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসকে বলেন। কেন বইটি এতটা পাঠক প্রিয় হল সে প্রশ্নের জবাবে গ্রাস বলেন যে জার্মানির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়ের ইতিহাস , যা সাধারণ মানুষের জীবনের চরম ভোগান্তির উপর আলোকপাত করা হয়েছে, আর সেকারণেই এটা উত্তম বই হিসাবে বিবেচিত হয়েছে।

‘দ্য টিন ড্রাম’ প্রাথমিক সাফল্যের পর গ্রাস লিখে চলেন একের পর এক নাটক, আত্মজীবনী কবিতা ও উপন্যাস। এগুলোর মধ্যে ছিল রূপথার আদলে ‘দ্য ফাউন্ডার’, ‘দ্য র‌্যাট এন্ড কল অফ দি টোড’ ইত্যাদি। জার্মানির এক বিপতœীক এবং পোলান্ডের এক বিধবাকে নিয়ে লেখা কৌতুক আর রোমঞ্চে ভরা ‘দ্য র‌্যাট এন্ড কল অফ দি টোড’ বইতে গ্রাস সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। গ্রাস এ সব বইয়ের জন্যে জার্মানির বিবেক হিসাবে বিবেচিত হন।

গ্রাসের লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউজ’ (১৯৬১) । জার্মানীর যুদ্ধোত্তর নতুন প্রজন্মের তরুণ সমাজেকে নিয়ে লেখা‘ ক্যাট অ্যান্ড মাউজ ’এ গ্রাস মুক্ত মনে আয়রন ক্রশকে নিয়ে অনেক অনেক রঙ্গ রসিকতা করেছেন, আর সেই রঙ্গ রসিকতার মধ্যে নাজি বাহিনীর বর্বরতা, উন্মত্ততার অনুষঙ্গ তিনি তুলে ধরেছেন। দ্য টিন ড্রাম(১৯৫৯),‘ ক্যাট অ্যান্ড মাউজ’ (১৯৬১), ‘ডগ ইয়ার্স’ ( ১৯৬৩) এ উপন্যাস ত্রয়ের তৃতীয় ‘ ডগ ইয়ারস ’ এ গ্রাস যুদ্ধোত্তর জর্মান তরুণ তরুণীদের চোখে ঐন্দ্রজালিক চশমা পরিয়ে দিয়েছেন যার ভেতর দিয়ে তারা পরিষ্কার ভাবে তাদের নির্দোষ পূর্বসুরিরা সে সময় কী ভূমিকায় ছিল তাই তিনি দেখাতে চেয়েছেন।

প্যারিসে বসবাস কালে গ্রাস কবিতা ও নাটক নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। তাঁর লেখক জীবনের প্রথম দিকে তিনি ফরাসি অ্যাবসার্ড নাট্যকার আয়োনেক্সা, বেকেট ও জাঁ জেনের প্রভাব পড়ে বলে মনে হয়। গ্রাসের লেখা নাটকগুলোতে অ্যাবসার্ট অনুষঙ্গ উঠে এসেছে।

নাটক, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা মিলিয়ে গুন্টার গ্রাসের গ্রন্থের সংখ্যা ৩০ এর অধিক। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য অন্যান্য রচনাগুলো হল: ‘ ক্যাট এন্ড মাউস’(১৯৬১),‘ ডগ ইয়ারস’(১৯৬৩),‘দ্য প্লিবিয়ানস রিহার্স দি আপরাইজি’ (১৯৬৬), ‘লোকাল এ্যানেসথেটিক’ (১৯৬৯),‘ ফরম দি ডায়েরি অফ এ ¯েœইল’(১৯৭২), ‘দ্য ফাউন্ডার’ (১৯৭৭), ‘দ্য মিটিং অ্যাট টেলগেট’(১৯৮১)‘হেডবার্থস অর জার্মানস অর ডায়িং আউট’( ১৯৮০), ‘দ্য র‌্যাট’ (১৯৮৬), ‘শো ইওর টাঙ’(১৯৮৮), ‘ দ্য কল অফ দ্য টোড’ (১৯৯২),‘ এ ডিসটান্ট’ (১৯৯৫), ‘মাই সেঞ্চুরি ’(১৯৯৯), ‘ক্র্যাবওয়াক’ ( ২০০২), ‘ ওয়াট মাস্ট বি সেইড,’ ( ২০০৬) এবং ‘পিলিং দ্য ওনিয়ন’( ২০০৬)। প্রসঙ্গত আবারও বলতে হয়, জার্মান ভাষায় লেখা তাঁর অধিকাংশ বইয়ের অনুবাদক রালফ ম্যানহেইম।

এ থেকে দেখা যায় তাঁর সাহিত্যকর্মের ভাণ্ডার বিশাল। তিনি উপন্যাসের সাথে সাথে কবিতা, নাটক রচনা করেন। তাঁর অধিকাংশ লেখাই রাজনৈতিক অবস্থার ও সামাজিক টালমাল অনুষঙ্গ উঠে এসেছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ১৯৪৫ সালে বাল্টিক সাগরে একটা রিফিউজি ডুবে যাওয়া ১৯৫৩ সালে সাবেক পূর্ব জার্মানিতে জাগরণের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা,১৯৬৪ সালে ছাত্র আন্দোলন, পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির ফেডারেল ইলেকশন ক্যাম্পেন ও রাজনৈতিক সম্পর্কে কথা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে ।

গ্রাস জার্মনির রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত হওয়ায় তাঁর সৃজনশীল রচনার সংখ্যা কমে যেতে থাকে। তাহলেও ষাট ও সত্তর দশকের জার্মানির সে সময়ের ইতিহাস, রাজনীতি, নারীবাদ, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে লিখতে থাকেন।সে সময়ে লেখা তাঁর ‘ইন ফ্রম দ্য ডায়েরি অফ’ (১৯৭২) এ তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পলিসির শম্বুক গতিকে রূপকের আদলে তুলে ধরছেন। অন্যদিকে, ‘দ্য ফাউন্ডার’ (১৯৭৭) পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নিয়ে কৌতুক ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন। আশির দশকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন, আর এ কারণে তিনি লেখালেখি থেকে বেশ একটু সরে আসেন। এ সময় তিনি জার্মানিতে আমেরিকার পারমাণিক মিসাইল স্থাপনের বিরোধিকতায় ক্যাম্পেন শুরু করেন। তিনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বিশেষ করে নিকারাগুয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্টের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন। পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে তিনি ভাবিত হন এবং পরিবেশ বান্ধব পৃথিবীর জন্যে তিনি ক্যাম্পেন শুরু করেন। এ সময় তিনি রচনা করেন ‘ হেডবার্থ’ (১৯৭৯) ও ‘দ্য মিটিং অ্যাট টেলগেট’(১৯৮১)।

এখানে বলে রাখা ভাল বিশ শতকের জার্মান লেখকদের মধ্যে গুন্টার গ্রাসই ছিলেন সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত।জার্মান গুন্টার গ্রাস তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য টিন ড্রাম’ এর জন্যে নন্দিত হলেও বিতর্কের পড়েন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের বহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছিলেন সে কথা ইউরোপবাসীরা প্রথম জানতে পারে ২০০৬ সালের আগস্ট মাসে তাঁর ‘ পিলিং দ্য ওনিয়ন’ শীর্ষক স্মৃতিকথা প্রকাশের পরে থেকে। ২০০৬ সালে তিনি নিজেই স্বীকার করতে বাধ্য হন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তিনি নিজে পুরোপুরি নিষ্পাপ ছিলেন না। ভয়ঙ্কর ওয়াফেন এস এস এর সাবেক সদস্য ছিলেন। গ্রাস ‘ পিলিং দ্য ওনিয়ন’ বইতে আত্মবিশ্লেষণ ওই ঘটনা জানার পর ইউরোপের মানুষ অবাক হয়ে পড়ে। তিনি নাৎসী বাহিনীর পক্ষে কাজ করলেও তিনি ছিলেন নাৎসী বিরোধী লেখক হিসাবে পরিচিত ছিলেন, কারণ তিনি মূলত যুদ্ধের পর থেকেই নাৎসী বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। ‘ দ্য টিন ড্রাম’ এর ব্যাপক সাফল্যের পর তিনি জার্মানীতে ফিরে আসেন। ১৯৭৮ সালে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে ১৯৭৯ সালে উটে গ্রুনেট বিয়ে করেন। দ্বিতীয় পক্ষে তাঁর দু’সন্তান আছে।

২০১২ সালে গুন্টার গ্রাস জার্মান ভাষায় একটি প্রতিবাদী কবিতা লেখেন, যা হেথার হর্নের ইংরেজি ভাষান্তর ‘ হোয়াট মাস্ট বি সেড’ নামে প্রকাশিত হয়। এ কবিতায় গ্রাস ইসরাইলকে সামরিক সাহায্য দেওয়ায় জন্যে জার্মানির সামরিক সাহায্য দেওয়ার জন্য জার্মানির সমালোচনা করা হয়। হোয়াট মাস্ট বি সেড’ এর কবিতার লিখে গুন্টার গ্রাস ইসরাইলের আগ্রাসী কর্মকান্ডের সমালোচনা করলে পুনরায় পশ্চিমাদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয় ।

জার্মান ভাষায় লেখা গ্রাসের মূল এ কবিতাটি জার্মানির ‘সুদ ডয়েচে জাইট’ু এ ২০১২ সালের ৪ এপ্রিল পত্রিকায় প্রকাশের পর ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা গ্রাসকে প্রচন্ডভাবে নিন্দা জানাতে কার্পণ্য করে না।হেথার হর্নের ইংরেজি ভাষান্তরিত গ্রাসের ‘ হোয়াট মাস্ট বি সেইড’ কবিতা থেকে কিছুটা এখানে স্বকৃত বঙ্গানুবাদ দেখা যেতে পারে। ।

What Must Be Said

By Gunter Grass

Why do I stay silent, conceal for too long
What clearly is and has been
Practiced in war games, at the end of which we as survivors
Are at best footnotes.

It is the alleged right to first strike
That could annihilate the Iranian people--
Enslaved by a loud-mouth
And guided to organized jubilation--
Because in their territory,
It is suspected, an atom bomb is being built.

Yet why do I forbid myself
To name that other country
In which, for years, even if secretly,
There has been a growing nuclear potential at hand
But beyond control, because no testing is available?

যা বলতেই হবে গুন্টার গ্রাস কেন আমি চুপ করে আছি, দীর্ঘকাল কেন চুপ করে আছি এটা পরিষ্কার যে যুদ্ধ যুদ্ধ খোলার চলছে, যুদ্ধ শেষে আমরা কেউ কেউ টিকে থাকবো বেশি হলেও পাদটীকা হয়ে।

অভিযোগ আছে প্রথম আঘাতে ইরানিদের ধ্বংস করে দেওয়ার- হুঙ্কারের বশ্যতায় আর সংগঠিত উল্লাসে- কারণ সন্দেহ করা হয় , তাদের ভূখন্ডে , তারা একটা পরমাণু তৈরি করছে।

তবুও কেন আমি মুখে কুলুপ এটে রেখেছি অন্য দেশের নাম করতে যে দেশ বছরের পর বছর গোপন করে রেখেছে , হাতে আছে তার পরমাণু বোমা, নেই কিন্তু নিয়ন্ত্রণ, কারণ নেই কোন তদন্ত?

গুন্টার গ্রাস ‘যা বলতেই হবে ’ কবিতাটিতে ইসরাইলকে বিশ্বশান্তির জন্যে হুমকি হিসাবে উল্লেখ করেন। এ কবিতাটিতে তিনি তাঁর নিজের দেশ জার্মানিরও সমালোচনা করতে দ্বিধা করেন না। এ কবিতাটা প্রকাশের পরপরই ইসরাইলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলি ইয়াশি নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসকে ইসরায়েলে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। গ্রাসের এ কবিতাটা ফিলিস্তিনিদের দ্বারা নন্দিত হয়। অন্যদিকে, ইহুদি কিংবা ইহুদি নয় এমন ব্যক্তিদের দ্বারা কবিতাটি নিন্দিত হয়। অনেকে গ্রাসকে ইহুদি বিদ্বেষী বলে অভিহিত করতেও পিছপা হয় না। তাঁকে ইহুদি বিদ্বেষী বলা হতে পারে এটা জেনেও তিনি ভয়ভীতিকে তোয়াক্কা না করে ‘হোয়াট মাস্ট বি সেইড’ কবিতাটির নিচের স্তবকটিতে কী বলেছেন তা দেখা যেতে পারে।

Why do I say only now,
Aged and with my last ink,
That the nuclear power of Israel endangers
The already fragile world peace?
Because it must be said What even tomorrow may be too late to say


উপরের অংশের বাংলা করলে দাঁড়ায়:

কেন শুধুমাত্র এখন আমি বলছি, এ বয়সে আমার শেষ কালি দিয়ে, যে ইসরায়েলের পরমাণু শক্তি বিশ্বশান্তিকে ইতিমধ্যেই বিপন্ন করেছে? কারণ একথা অবশ্যই বলতে হবে কাল তা বললে বেশি দেরি হয়ে যেতে পারে।’

ইসরায়েল ও তার সমর্থকরা ইতিহাস টেনে এনে গুন্টার গ্রাসকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের কুখ্যাত নাৎসী বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ওয়াফেন- এস এস গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা তুলতে দ্বিধা করে না। তার কিন্তু ভুলে যান গুন্টার গ্রাস তাঁর ‘দ্য টিন ড্রাম’ উপন্যাসটিতে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর নির্মমতাকে তুলে ধরেছেন নির্দ্ধিধায়। তিনি বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর বিরোধিতা করেন, যা আগেও উল্লেখ করা হয়েছে।

সুইডিশ একাডেমি এ উপন্যাসের জন্যে তাঁকে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করে গ্রান্টার গ্রাস শুধুমাত্র তাঁর উপন্যাসে মধ্যে নিজেকে নিবদ্ধ করে না রেখে পরাশক্তির আণবিক যড়যন্ত্রকে ধিক্কার দেওয়ার জন্যে ইউরোপের তরুণ তরুণীদের সাথে নিয়ে তিনি মিছিলে নেমে সাহসী ভূমিকা রাখেন।

গুন্টার গ্রাস দুই জার্র্মানির একত্রীকরণ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে তাঁকে বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় তোলেন। গ্রাস সমালোচনার জবাব দেন ‘ দ্য কল অফ টোড’ (১৯৯২) ও‘ঠুফা অ্যাফিল্ড’( ১৯৯৫) উপন্যাস দুটোতে। এ উপন্যাস দুটো কিন্তু সমাদৃত হয়নি। গ্রাসের আশংকা ছিল যে ্দুই জার্মাানি এক হলে জাতি ও রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়বে, আর যদি দুর্বল নাও হয় তবে অতীতের নাৎসীবাদের ভয়াবহতাকে ভুলে যাবে। এ বিষয় নিয়ে তিনি ‘ক্র্যাবওয়াক’(২০০২) নামে একটি উপন্যাস লেখেন। ‘দ্য টিন ড্রাম’ এর পরে এ উপন্যাসটিকে তাঁর আর একটি শ্রেষ্ট কাজ বলে বিবেচনা করা হয়। এ উপন্যসটিতে তিনি দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর কালপর্বে জার্মাানদের দুর্গতির কথা ব্যক্ত করেছেন ,যে কথা প্রায়ই চেপে রাখা হত । এ উপন্যাসটি পাঠক ও সমালোচকদের দ্বারা সমাদৃত হয়। তিনি দু’খন্ডে তাঁর নিজের স্মৃতিকথা লেখেন এবং কয়েকটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করেন। এগুলোও অল্পবিস্তর বিতর্কের মুখে পড়ে।৬০ বছর বয়সে গ্রাস নাজি সেনাবাহিনীতে তাঁর নিজের ভূমিকা সম্বন্ধে তিনি বিরোধিতার মুখোমুখি হন। সেটা ছিল ২০০৭ সালের নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির ঘটনা। সেখানে গ্রাস বলেন তিনি যখন একজন লেখক হলেন তখন তিনি সঠিক পথটাকে বুঝতে পারলেন তার দেশের পাপের জন্যে তাঁকে কিছু বলতে হবে। “আমি আমার সময়ের কথা লিখলাম, আমার প্রজন্মে আমার দেশে কী ঘটেছিল তা আমার লেখায় প্রকাশ পেল। ” তিনি বলেন,“ আমি প্রশ্নের মুখোমুখি হলাম। সেখান থেকে বেরিয়ে যাবার উপায় ছিল না।”

গ্রুন্টার গ্রাস তাঁর সাহিত্য কর্মের জন্যে যে পুরস্কারগুলো পান তা হল: সাহিত্যে নোবেল, গেওর্গ ব্যুশনার পুরস্কার, অনারারি ফেলো অফ দ্য রয়েল সোসাইটি অফ লিটারেচার,প্রিন্স অফ অস্ট্রিয়াস পুরস্কার ইত্যাদি।। গুন্টার গ্রাসের সাহিত্য ও শিল্পকর্মের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশে ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর জার্মানির লুবেক শহরে ‘ গুন্টার গ্রাস হাউস: ফোরাম ফর লিটারেচার এন্ড আর্ট’ এর উদ্বোধন করা হয়। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী লেখক গুন্টার গ্রাস যে একজন উঁচুমাপের চিত্র শিল্পী ও ভাস্কর , তা অনেকেই জানেন না। জার্মানির লুবেক শহরে ‘ গুন্টার গ্রাস হাউস: ফোরাম ফর লিটারেচার এন্ড আর্ট’ জাদুঘরে তাঁর আঁকা,এচিং, লিথোগ্রাফি, জলরং অয়েল পেন্টিংএর প্রায় ১১শ’ শিল্পকর্ম আছে । তাঁর অমর সাহিত্যকর্মের কিছু পান্ডুলিপিও আছে। ওখানের তাঁর কিছু ভাস্কর্যও আছে।

গ্রুন্টার গ্রাস বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ছিলেন। তিনি দু’বার বাংলাদেশে আসেন। প্রথম বার ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতা থেকে স্ত্রী উটে গ্রাসকে সঙ্গে আমাদের দেশে আসেন। পুরানো ঢাকার বাঙালি বাসিন্দাদেরকে চিনবার চেষ্টা করেন। ১৯৮৬ আগস্ট থেকে ১৯৮৭ সালের জানুযারি পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস কলকাতা শহরের ভাগ্যবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে তিনি একজন সাধারণ মানুষের মতো বিচরণ করেছিলেন। তার আগেও তিনি আর একবার কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে যে বই লিখেছিলেন তার ইংরেজি ভাষান্তর শো ইউর ট্যাঙ প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইটি কলকাতা থেকে বাংলায় জিভ কাটো লজ্জায় নামে প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনি ভাগ্যহতদের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে সাহসী ভুমিকা রাখেন। দ্বিতীয়বার ২০০১ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। সদ্য প্রয়াত অমর শিল্পী গ্রন্টার গ্রাসকে অকৃত্তিম শ্রদ্ধা জানাই। তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্মের মাঝে চিরভাস্বর হয়ে থাকুন।




লেখক পরিচিতি
কবি, গল্পকার, প্রবন্ধকার ও অনুবাদক।

মাগুরা। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ