মুজিব ইরমের গল্পের বই ‘বাওফোটা’ নিয়ে আলোচনা

গল্পের সাথে এক যুগ

শিপা সুলতানা

একটা গল্প লিখেছিলাম অনেক দিন আগে...
কত আগে?
অনেক দিন...

ততদিনে কবিতার রাজপুত্রের(কেউ কেউ বলেন বরপুত্র) লেখা তিনটি উপন্যাস পাঠ শেষ হয়েছে। কেন জানি কবিতার কারিগরেরা গদ্যের মাঠে হাঁটাহাঁটি করলে ভালো লাগে না আমার, কিন্তু মুজিব ইরমের তিনটি উপন্যাস আমাকে নিরেখ গদ্যের তৃপ্তি দিয়েছিল, তাই মুখ তুলে তাকালাম। প্রথম লেখা প্রেমপত্রের মতই লাল হওয়া মুখে একটি পুরাণ ডায়েরি দিলেন আমার হাতে। আমি সদ্য সদ্য চিংড়ি (শিবশংকর পিল্লাই) পড়া শেষ করেছি। তখনো আমি নির্জন এক পাথরের অন্ধকারে নৌকাভর্তি রূপা নয়, জীবনের অন্বেষায় বসে আছি, তবু ডায়েরির পাতা উল্টেপাল্টে আমার পাশে বসা আশ্চর্য এক মানুষ দেখি, গল্পটি পড়তে থাকি।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নব্বই দশক হচ্ছে অনুকরণ প্রিয় বিগত ও আধুনিক বাংলার উন্মেষ পর্ব, প্রসবকালও বলা যায়। উত্তরনকালে ভয় শংকা দ্বিধা সংকোচ থাকে, এই রকম বিভ্রান্তির সময়ে বিভ্রান্ত কিছু চরিত্রের আখ্যান বাওফোটা গল্পটি। দুয়ারে বিংশ শতাব্ধি আর অন্দরে প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার! বিভ্রান্তির কালে তরুণের দমবন্ধ লাগে, প্রতিনিয়ত দ্বিধা তাকে দুভাগ করে রাখে, সময়েরও আগে মানুষের খোল বদলানো তাকে আহত করে, সে কেবল মায়ের আশ্রয়ে ফিরতে চায়। দুর্নীতির শহরে তার দমবন্ধ লাগে। দীর্ঘ বারিষার ভ্যাপসা গন্ধ শহরের আনাচে-কানাচে, তার কেবল বাওফোটা লাগে!

অনেকদিন ভেবেছি কেনো কিছু লিখতে হবে, কেনো লিখতেই হবে! জীবনতো কেবল গদ্যের মাঠ নয়, দীর্ঘমেয়াদী এক যুদ্ধের নাম। সেখানে গদ্যের আবশ্যকতা কি? কেনো কুয়াশা এবং ধূলায় ভিজে ভিজে অরুন্ধতি রায় লিখে গেলেন দ্যা গড অব স্মল থিংস, প্যারিসের স্বর্ণ যুগে শ্বেতাঙ্গিনী বধুকে পাশে রেখে জল, কাদা, কাম ও মগজের অন্ধকার নিয়ে গড়েপিঠে লালসালু বুনলেন কেনো সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ! খয়েরি আলোয় নির্জন পাবে বসে ধুঁকে ধুঁকে কাফকা কেনো খোদাই করলেন মেটামরফসিস! কেনো কেবল ধন নয় জন নয়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কাম এবং ধানের গন্ধ গেঁথে গেলেন খোয়াবনামায়!... কেনো তবে লিখতে হবে না?

লেখকের বাড়ির উঠান, মাথার উপর ভরা চাঁদ, আমাদের হাসির তুড়ে একপাশের শুকনো পাতা উড়ে যাচ্ছে বাড়ির অন্য পাশে, বরাবরের মত নির্জন শ্রোতা মুজিব ইরম। অদ্ভূত কাণ্ড ঘটেছে পাড়ার মসজিদে, মাইক চুরি গেছে, যারা সালিশ ডেকেছে, তারাই নাকি চোর! এটাই সিস্টেম হয়ে গেছে। তখনি লেখকের মাথায় জন্ম ইমাম। আমাদের হাসি থামছিল না। কোথা থেকে উদয় হলেন বড় ভাই, আমাদের হাসিতে বাড়ির লাগোয়া গোরস্থানে কবরবাসীদের ঘুম ভেঙ্গে গেছে! কবরের সেই ভয়, অজানা ভীতি এবং মুক্তি আকাঙ্ক্ষার গল্প- দেওলা।

ইংলান্ডে সামারে রাত আসে দশটার পর। পেছনের বাগানে হাঁটুভাঙ্গা গাছে আপল আসে হাজারে হাজার! বিরাটাকার সাইজের জন্য গৃহপ্রবেশ ঘটে না তাদের, কিন্তু সারাটা সামার সেই গাছের দিকে তাকিয়েই ফুরিয়ে যায় আমাদের মা ছেলের। গাছভর্তি কাঠবিড়ালি। একটা আপেলে বসে আর একটা জাপটে ধরে কুট করে কামড় বসায় তারা, লেজ নাড়ে ডানে বামে, ছেলেটা খিলখিল টিলটিল করে হাসে আর আমাদের সেই ৩৩-এর মহিলা বয়ান করেই যাচ্ছেন সতিনের দেয়া দুঃখ, স্বামীর বেদনা। স্বামী ছয়মাস তার ঘর করেন, ছয়মাস সতিনের ঘর করতে যান দেশে, সেই ছয়মাস সতিনের সাথে স্বামীকে জড়িয়ে সম্ভব অসম্ভব সব রোমান্স কল্পনা করে মহিলার অবস্থা 'পরানে না ধরে। মুজিব ইরম ঘরে ফিরেন আটটায়, মহিলা লাজুক মুখে ফিরে যান, হালকা চালে লেখা মনে হলেও দীর্ঘ দীর্ঘ গ্রীষ্মের দুঃখতাপে উষ্ণ হয়ে আছে গল্পটি।

মানুষের জৈবিক ইচ্ছার অবসান ঘটে না আমৃত্যু, অঙ্গে অঙ্গে ক্ষয় ধরে, নানান সংকেত আসে নানান ভাষায়, কিন্তু মগজের ভেতর জেগে থাকে অতৃপ্ত বাসনা, তাই ভাতের বিনিময়ে বৃদ্ধ জয়দুল মিয়া ক্রয় করে তরুণী লতিফাকে, তরুণী বঁধুকে উষ্ণতা দিতে অক্ষম জয়দুল মিয়া, জরা তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে রাত নিশি হলে, অথচ অপমান যেন পুরাটাই নববধু লতিফার, বৃদ্ধা জা' তাকে দেখলেই শারীরিক গপ শুনতে চায়, অথচ ভাতের বিনিময়ে বৃদ্ধ লন্ডন প্রবাসীর কাছে বিয়ে দেয়া তার চেয়েও তার বাপ মার অপমান, তাই মিথ্যে মিথ্যে রাতের গল্প করে সে, সংসারে অভিজ্ঞ বিড়াল তার জা, তার মুচকি হাসি অস্থির করে লতিফাকে, তাই খামাকা ভোরের গোসল সেরে শব্দ তুলে কাপড় ঝাড়ে সে, যেন বৃদ্ধ জয়দুল মিয়ার জরাকে রোদে শুকাতে দেয়, জা'কে বলেই ফেলে 'জুয়ান পুরুষের চেয়ে অধিক সক্ষম তার স্বামী। এই বেদনা থেকে তার মুক্তি মিলবে হয়ত কোনোদিন, সেদিকে কোনো ইঙ্গিত নয়, ভাতবন্ধকী এক নারীর বেদনার আখ্যান জোয়ানকি।

কেন কাউকে কিছু লিখতেই হয়! ঘাম এবং কাম পরিবেষ্টিত থেকেও মার্কেজকে লিখতে হলো নিঃসঙ্গতার একশ বছর। গোপনে গোপনে আজন্ম পুষতে হয় এক নানার হাতি(ভৈকম মুহম্মদ বশীর), নির্জনে বসে বসে পুরান ঢাকার পুরান মহলের ছাল ওঠা দেয়াল, কাবাব বিক্রেতা বিহারী বুড়ো, শিউলিফুল গেঁথে গেঁথেই গেলেন শহীদুল জহির। মুজিব ইরমকে ফের জিজ্ঞেস করলাম: কেন লিখেই যাচ্ছ? উত্তর পাই-- জানি না, কিছুই জানি না!

বুর্জোয়া সমাজে শ্রমজীবি মানুষ মানুষের আওতায় পড়ে না, তাদের বেঁচে থাকা পুরাটাই প্রকৃতি নির্ভর, সোজা কথায় ইশ্বরের কৃপায়। বুর্জোয়াদের হাত অমিমাংসিত লম্বা। একজন নদীনির্ভর মানুষের কাছ থেকে তার পুত্রের অধিক নৌকা কেড়ে নেয় তারা, সাথে কেড়ে নেয় নিকট ও অদূর ভবিষ্যত। নদীর এপার ওপার জুড়ে যে-ব্রিজ তৈরি হয়, পেশা হারানো একজন খেয়ানির কাছে তা তার কবর রচনার সমতুল্য।

ধনীক শ্রেণির মানুষ শুধু পশুপ্রাণিকেই খামার বন্দি করেনি, মানুষকেও পদানত করে পুস্য করেছে। মানুষ হয়ত জানেও না কোন জন্মের পাওনা শোধ করে যাচ্ছে তারা। ভাতবন্দি বন্ধি মানুষগুলা না ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে কোনো এক সোনালি ভোর, তার জন্য মুক্তি নিয়ে আসবে, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষের বেদনার নাম -বিছালমাইর।

লেখককে যদি জিজ্ঞেস করা হয়: কী আছে গল্পে? উনি বলবেন- জানি না তো! অর্থাৎ কোনো রূপকথা নেই, রূপকথাতে রাজা-উজির, রাজকুমারী-রূপারকাঠি, পঙ্খিরাজের ডানা থাকে। গল্পে জীবন ছাড়া কিছুই থাকে না। ‘পাইকার’- এক কঠোর জীবনের চিত্র।

প্রকৃতপক্ষে কিছুই বদলায় না, ঠাট বাট ফর্ম বদলায়, হাতের বদলে হাতিয়ার আসে, খোলের ভেতরটা অবিকৃতই থাকে, চর দখল শেষ হলে পাড় দখলে হাত পড়ে, তারপর মাঠ ঘাট বন্দর দখল শেষ করে নিরস্ত্র মানুষের কলিজায়। নিরন্তর বয়ে চলা আধিপত্যের বিস্তার ছুলফি গল্পে।

বাওফোটা গ্রন্থে আরো আরো গল্প আছে, গল্পগুলো নিয়ে প্রায় বারো বছর গল্প হয়েছে লেখকের সাথে, কোনটিই তার অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে নেয়া নয়, তাই কল্পনার বন থেকে বাড়তি কোনো রঙের প্রলেপ পড়েনি তাতে, যেহেতু অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে নেয়া, বাহুল্য বর্জনের প্রয়াস ছিল গ্রন্থের আদিঅন্তে।

আমি আবারও জানতে চেয়েছি: কী হবে এই গল্পগুলোর? জানি না, কিছুই জানি না! উত্তর তার।

এই-ই ভাল, কালের গর্ভে নিবেদন, কাল বড় নিষ্ঠুর, না ছেঁকে কিছুই তুলবে না তার কঠিন নিক্তিতে। প্রতিটি লেখকেরই গোপন বাসনা থাকে পাঠকের মন জয়ের পাশাপাশি কাল নামক কঠিন বৈতরণী পার হওয়া। সে-ভার লেখকের উপরই থাক, আমি তো তার গুনমুগ্ধ পাঠক, ঘরের মানুষ।




লেখক পরিচিতি
শিপা সুলতানা

লন্ডন প্রবাসী
কবি ও গল্পকার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ