একদিন অনেক রাতে

দিব্যেন্দু পালিত

তেমন কোনও কাজ ছিল না বলে কমপিউটার খুলে বসেছিল নীলা। তাতেও যে খুব মন লাগছিল তা নয়, আজকাল যে-কোনও কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই সে উল্টোপাল্টা ভাবে। দুপুরে এক বার দেখেছিল, এখনও দেখল ই-মেলে কোনও মেসেজ নেই। তাতে হতাশ হলেও দুঃখিত হল না সে। কে-ই বা পাঠাবে! শেষ মেসেজ পাঠিয়েছিল তার দাদা হিন্দোল, কাল বিকেলে, এখানে ক’দিন ছুটি কাটিয়ে মুম্বই পৌছনোর খবর জানিয়ে দু’লাইনের মেসেজ। কমপিউটার কোম্পানিতে কাজ করে বলে নিজের পি-সি হওয়ার পর-পরই কলকাতার বাড়ির জন্যেও কিনে দিয়েছে একটা। কাছেই একটা সেন্টারে তিন মাসের ট্রেনিং নিয়ে কাজটা শিখে নিয়েছিল নীলা।
তাদের বাড়িতে থেকে এম এ পড়ছে খুড়তুতো বোন শ্বেতা, সেও শিখেছে। এখন কখনও যে যার একা-একা, কখনও দু’জনে ভাগাভাগি করে মাউস ঘোরায়, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট খোলে। কাজের কাজ আর কী হয়!
সুইচ অফ করে উঠে পড়ল নীলা। হঠাৎই তার মনে পড়ল খানিক আগে টেলিফোন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ধরতে ছুটে গিয়েছিল শ্বেতা— সেও প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেল, এমুখো হয়নি আর। দুপুরের রোদ নরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পার্ক সার্কাসে কাদের বাড়ি যাবে বলে একসঙ্গে বেরিয়েছে বাবা-মা। খুলে কিছু না বললেও নীলা অনুমান করতে পারে আবার গেল কোনও পাত্রপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে, মাঝে মাঝে যেমন যায়। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মা শুধু বলেছিল, আমরা একটু বেরুব, সন্ধে নাগাদ ফিরে আসব; তোমরা দুই বোন সাবধানে থেকো, ইত্যাদি। যদি পাত্রপক্ষের সঙ্গেই দেখা করতে যায়, তা হলে নিশ্চয়ই তারই জন্য। শ্বেতা বাবার খুব প্রিয় ভাইঝি হলেও তার বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কাকার; তা ছাড়া সে নীলার চেয়ে পাক্কা ছ’বছরের ছোট, এখনও পড়াশুনো শেষ হয়নি, হঠাৎ তার জন্য পাত্র খোঁজার দরকার যে হবে না, সেটা নীলার চেয়ে ভাল আর কে জানে!

গত চার-পাঁচ বছরে বেশ কয়েকটা সম্বন্ধ এসেছিল তার; দেখেও গেছে তিন-চার পক্ষ— একটার তো চিঠিও ছাপতে চলে গিয়েছিল, কিন্তু কোনওটাই লাগেনি শেষ পর্যন্ত। হ্যাফা কি একটা! মাঝখানে শ্যামবাজারের কাছে একটা স্কুলে লিভ ভ্যাকান্সিতে শিক্ষিকার চাকরি পেয়েছিল, মাস চারেক আগে সেটাও গেছে। তখন থেকেই বাড়িতে বসে বসে মুঠোয় ইঁদুর ধরে কমপিউটার নিয়ে খেলা। কাজের মধ্যে পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে টেলিফোনে গল্প করা কী মাঝেমধ্যে শ্বেতার সঙ্গে বাজারে কী সিনেমা বা নাটক দেখতে যাওয়া— বেশ বুঝতে পারে মেদ জমছে শরীরে। শ্বেতারই বা যখন-তখন সঙ্গ দেওয়ার মতো সময় কোথায়!
মাঝে মাঝে ঈর্ষা হয় নীলার, মন খারাপও হয় শ্বেতাকে দেখে। তার চেয়ে ছ’বছরের ছোট, দেখতে ভাল আর বেশ স্মার্টও। যে-দিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরতে দেরি হয়, নীলা ধরে নেয় নিশ্চয়ই প্রেমট্রেম করছে। সে-সব দিনে শ্বেতার চোখমুখ ঘন হয়ে ওঠে। তার পর কখনও যে ফোনে অনেক ক্ষণ ধরে কথা বলে, সে কার সঙ্গে! একদিন বিকেলে কেমিস্ট শপে যেতে যেতে দূর থেকে দেখেছিল একটা মাজা-মাজা রঙের বেশ হ্যাণ্ডসাম যুবকের সঙ্গে হাসাহাসি করতে করতে এগিয়ে আসছে শ্বেতা। দূর থেকেই হঠাৎ তাকে দেখে থমকে দাঁড়াল, তার পর যুবকটিকে কিছু বলতে সে পিছন ফিরে জোর হাঁটা দিল। সেদিনও শ্বেতার মুখচোখ বদলে গিয়েছিল। কোন অনুভূতি আচ্ছন্ন করে রাখে ওকে, নীলা কী বুঝবে। শুধু এক অচেনা দুঃখে ওর মন খারাপ করে।

বাড়ির দুটো টেলিফোনের একটা থাকে তাদের বেডরুমের কাছাকাছি প্যাসেজে। অন্যটা একতলায়। দোতলার চারটে বেডরুমের একটিতে থাকে বাবা-মা, অন্য দুটিতে তারা দুই বোন, শেষের ঘরটা দাদার— ঝাড়পোছ করার জন্যে মাঝেমধ্যে খোলা হলেও এমনিতে বন্ধই থাকে। প্যাসেজের টেলিফোনে একটা প্যারালাল করা আছে নীচে লিভিং রুমে, যেমন একতলার টেলিফোনে কানেকশন আছে ওপরে। কিচেন, ডাইনিং রুম, বাবার স্টাডি এবং অফিস, সব নীচে হওয়ায় নীচের টেলিফোনটাই ব্যবহার হয় বেশি। মজা হল, ফাঁকা বাড়িতে দোতলায় থাকলেও টেলিফোন করতে শ্বেতা প্রায়ই চলে যায় নীচের তলায়। কাছাকাছি নীলা আছে ভাবলেই বুঝি ওর প্রাইভেসি নষ্ট হয়!
কিন্তু খানিক আগে ফোনটা এসেছিল এই ফ্লোরেই। নীলা কমপিউটারে ব্যস্ত থাকায় ছুটে গিয়ে ‘হ্যালো’ বলেছিল শ্বেতা। তার পর আর খেয়াল রাখেনি। এখন ভাবল, হঠাৎ সব চুপচাপ হয়ে গেল কেন!
ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও শ্বেতাকে দেখতে পেল না নীলা। না টেলিফোনের কাছে, না ওর নিজের ঘরে, না মা-বাবার ঘরে। দুটো বাথরুমের দরজাও খোলা! সামান্য বিচলিত হয়ে নীচের তলায় খুঁজতে যাচ্ছিল নীলা, কয়েক ধাপ সিঁড়ি নামতে না নামতেই বাঁকের আগে থমকে দাঁড়াল সে। বন্ধ সদর দরজার পাশে শ্বেতাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে একটা লোক। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। বাকি সিঁড়িগুলো ধকধক করে নেমে গেল নীলার বুকের মধ্যে, শুকিয়ে গেল গলা, কেমন একটা ছটফটে ভাব ছড়িয়ে পড়ল শরীরে। তখনকার বুদ্ধিতে আর নীচে না নেমে ওপরে উঠে পালাতে চাইছিল নীলা, হঠাৎ দেখল তাকে দেখতে পেয়ে শ্বেতার দু’হাতের বেষ্টনী থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে দ্রুত বেরিয়ে যাচ্ছে সেই লোকটা— হ্যাঁ, সেই যুবকটিই, যাকে এর আগে এক দিন দূর থেকে দেখেছিল শ্বেতার সঙ্গে, রাস্তায়। যাকে, এত কাছ থেকে দেখায় মনে পড়ল, কখনও কখনও অন্য মেয়েদের সঙ্গেও ঘুরতে দেখেছে। দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলে ও-ই তো হিরো সেজে ঘুরঘুর করে মেয়েদের আশপাশে।

বিস্ময় ও উত্তেজনা প্রশমিত করতে ঘরে ঢুকে তখনও সুইচ অফ না-করা কমপিউটারের মাউসটা মুঠোয় নিয়ে এলোপাতাড়ি টিপতে লাগল নীলা। খুড়তুতো হোক বা মামাতো, শ্বেতা তার বোন। বাবা-মা নেই বাড়িতে, তবু দিদি আছে— তা সত্ত্বেও মেয়েটা এতটাই বেপরোয়া যে বাইরে থেকে লোক ঢুকিয়ে এইসব! লোকটাই বা এল কী করে! যত দূর মনে পড়ে, দোতলার প্যাসেজে ফোন বাজতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল শ্বেতা, নীলা অন্যমনস্ক ছিল, তার পরের ঘটনা কিছুই জানে না। কিন্তু ঘটনা ঘটেছে।
এটা কি পরিকল্পিত ছিল? শ্বেতা জানত এ রকমই হবে? নাকি সে বাড়িয়ে ভাবছে! হয়তো ফোন আসার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও যোগ নেই। দুপুরের সুযোগে, বাবা-মাকে একসঙ্গে বেরিয়ে যেতে দেখে, কেউ বেল দিয়েছিল দরজায়— শ্বেতা দরজা খুলে দেয় এবং আক্রান্ত হয়। না, ঘটনা নিশ্চিত এ ভাবে ঘটেনি। যুবকটির চুম্বনে যে ভাবে সমর্পিত ছিল শ্বেতা, সেটা আক্রান্ত হওয়ার ধরন নয়— আক্রান্ত হলে নিশ্চয়ই চিৎকার করে উঠত শ্বেতা।
শ্বেতাকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে ব্যাপারটা। অবশ্য যদি সে সত্যি কথা বলে। এমনও হতে পারে, ঘটনাটা আজই প্রথম ঘটল না, আগেও ঘটেছে, শুধু চুমুই নয়, আরও বেশি কিছু, মানে— হঠাৎ রোমাঞ্চিত হয়ে নীলা ভাবল, এ সব ঘটনা ঘটানোর পক্ষে বাড়ি সবচেয়ে কম নিরাপদ। এই সে দিন একটা ধারাবাহিক উপন্যাসে পড়ছিল নায়ক নায়িকাকে নিয়ে গেছে হোটেলের ঘরে, তার পর—

কমপিউটার থেকে সরে এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়েছিল নীলা। এখন উত্তেজনায় মিশেছে ভয়, কানদুটো গরম, স্পষ্ট অনুভব করছিল চাপা ঘাম জমেছে কপালে, নাকের পাটায়, চিবুকে, গলায়। তাকে কেউ কখনও চুমু খায়নি। গল্প-উপন্যাসে কখনওসখনও চুমু খাওয়া বিষয়ে নায়ক কিংবা নায়িকার অভিজ্ঞতার বর্ণনা পড়লেও পায়ে পা জড়িয়ে সামান্য পাশ ফেরা ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। এই মুহূর্তের অভিজ্ঞতা অন্য রকম।
কিন্তু নিজেকে নিয়ে বিব্রত হয়ে থাকলেই চলবে নাকি! যুবকটি দরজা খুলে বেরিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে দ্রুত ক’ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে চলে এসেছিল সে; শ্বেতা নিশ্চয়ই তাকে লক্ষ করেনি। ইতিমধ্যে কেটে গেছে পাঁচ-সাত মিনিট সময়। শ্বেতা গেল কোথায়! টেলিফোন ধরতে যে ছুটে গিয়েছিল বেডরুম থেকে, দিদির চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্যে তার তো বেডরুমেই ফেরা উচিত। নাকি যুবকটির পিছু পিছু শ্বেতাও বেরিয়ে গেল!
নিজেকে যথাসাধ্য শান্ত করে একটু বা দুশ্চিন্তিত নীলা এ বার নীচের তলার দিকে পা বাড়াল। সদর দরজাটা যেমন-কে-তেমন বন্ধ, সিঁড়ির বাঁকের মুখে এসে এখন আর কোনও দৃশ্যই তার চোখে পড়ল না। পর পর সিঁড়ি নেমে দেখল লিভিং রুমের ডান দিকে সোফার ওপর হাতের তালুতে গাল পেতে খুবই চিন্তামগ্ন ভঙ্গিতে বসে আছে শ্বেতা। নীলার সিঁড়ি নামার শব্দটুকুও শুনতে পেয়েছে কি না সন্দেহ।

নীলা ভেবে নিল কী কী জিজ্ঞাসা করবে শ্বেতাকে। নির্জন দুপুরে একটা উটকো লোক বাড়িতে ঢুকে তার যুবতী বোনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে, এটা কোন ধরনের অপরাধ তা সে জানে না। পুলিশে জানানো উচিত কি না তাও জানে না। পুলিশ জিজ্ঞেস করতে পারে, সবই বুঝলাম, কিন্তু কালপ্রিটটাকে দরজা খুলে দিল কে? অবশ্যই শ্বেতা। কিন্তু, শ্বেতা যদি সমস্তই অস্বীকার করে! হ্যাঁ, অস্বীকার করবে যদি ঘটনাটার সঙ্গে ও নিজেও যুক্ত থাকে। তা ছাড়া, পুলিশে জানানো মানে দশকান হবে, মুখে মুখে ছড়াবে রসালো গল্প, লোকে আঙুল তুলে দেখাবে তাদের বাড়ির দিকে, তাদের দিকে। সে বড় লজ্জার!
না, পুলিশ-টুলিশ ভেবে লাভ নেই। তবে তার বোনের যাতে বারোটা না বাজে সেটাও দেখা জরুরি। শ্বেতাকে জিজ্ঞেস করে যদি তেমন বোঝে তা হলে মাকে জানাবে। বাবাকে জানানো হবে কি না তা বুঝবে মা।
এ সব ভাবতে ভাবতে আবার সেই দৃশ্যটায় ফিরে এল নীলা। শ্বেতার জায়গায় নিজেকে ভেবে রোমাঞ্চিত হল সারা শরীর। কেউ চুমু খাওয়া দূরে থাক, এতটা বয়স পর্যন্ত কোনও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তাকে জড়িয়ে ধরেনি। অথচ তার চেয়ে কয়েক বছরের ছোট শ্বেতা— হতে পারে সে শ্বেতার মতো চটকদার নয়, কিন্তু সেও তো একটি মেয়ে, যুবতী, তারও তো ইচ্ছে করে!

এখন শ্বেতার সামনে। চোখাচোখিও হয়েছে। কিন্তু নানা রকম ভাবনা ও অনুভূতিতে নিজেকে কেমন জবুথবু লাগল নীলার। কথা ফুটল না মুখে। কিছুটা ফ্যাকাশে ও বদলানো মুখচোখ নিয়ে নীলাকে দেখছিল শ্বেতা। দিদিকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সামান্য ভুরু কোঁচকাল তার; ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে কোনও চিহ্ন মুছল, নাকি পেতে চাইল কোনও পুরনো হতে থাকা স্বাদ, কে বলবে! তার পর ওড়নাটা কামিজের বুক ও কাঁধের কাছে ঠিকঠাক করে জিজ্ঞেস করল, ‘ও ভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন! কিছু বলবে?’
কী স্মার্ট মেয়ে রে বাবা, এমন ভাবে প্রশ্ন করছে যেন কিছুই ঘটেনি! নীলা বুঝল প্রথম দানটা হেরে গেছে শ্বেতার কাছে, পুরোপুরি হেরে যাওয়ার আগে তাকে শক্ত হতে হবে।
‘ছেলেটা কে ছিল!’
‘কোন ছেলেটা!’ আরও এক বার মুখের রেখা পাল্টাল শ্বেতার, আত্মরক্ষার গলায় বলল, ‘কার কথা বলছ!’
‘ন্যাকামি করিস না! ছেলে তো নয়, একটা ধাড়ি মদ্দা!’ নীলা নিজেকে ফিরে পাচ্ছিল, গলায় শাসন ফুটিয়ে বলল, ‘আমি সব দেখেছি। লোকটা কিস করছিল তোকে। আমাকে দেখে দরজা খুলে পালাল!’
‘কী বলছ!’
‘ঠিকই বলছি। তলে তলে এই! টেলিফোন ধরবার নাম করে—। উফ! বাবা-মা জানলে তোকে রক্ষে রাখবে ভেবেছিস!’ একটা ঢোঁক গিলে নীলা বলল, ‘একটা যুবতী মেয়ে— এখনও বিয়ে হয়নি, ভয়ডর বলে কিছু নেই!’
শ্বেতা উঠে দাঁড়াল। মুঠো শক্ত। নীলাকেই দেখছে। সেই দৃষ্টিতে ধরা পড়ে যাওয়া ছাড়াও আছে ক্ষোভ, জ্বালা। আচ্ছা, সে যদি হঠাৎ সিঁড়ির বাঁকে গিয়ে না দাঁড়াত, তা হলে আরও কতক্ষণ ধরে চুমু খেত লোকটা? শ্বেতা কি কোনও অপূর্ণতা বোধ করছে, সেই জন্যেই ক্ষুব্ধ!
শ্বেতা হঠাৎ বলল, ‘আমার কথা বলতে ভাল লাগছে না। প্লিজ, আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’
‘তার মানে তুই কিছু বলবি না!’
‘হ্যাঁ, তাই।’ প্রায় বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলল শ্বেতা, ‘তুমি যা খুশি ভাবতে পারো। আমাকে— প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন—’
‘ঠিক আছে।’ দমে গিয়ে নীলা বলল, ‘আমাকে না বলিস, মা-বাবাকে বলিস। আমি ওদের যা বলার বলব। এত বড় একটা ঘটনা— সবই তো তোর ইচ্ছেমতো হবে না!’

নীলা সিঁড়ির দিকে এগোল। শ্বেতা যে ঘাবড়ে যাবে, তার পর অপ্রস্তুত হবে, তার পর অজুহাত খুঁজবে এবং তার পরেও যুক্তিতে দাঁড়াতে না পেরে কেঁদে ভাসাবে— এ রকমই ভেবেছিল সে, তখন অবস্থা বুঝে সে বুঝিয়েসুঝিয়ে ছেড়ে দেবে ওকে। কিন্তু, নীলাকে সেই সুযোগই দিল না মেয়েটা। বরং শেষ পর্যন্ত যা বলল তাতে তার অপমান বোধ করার কারণ আছে। এই কি তাদের দিদি আর বোনের গলায়-গলায় সম্পর্ক!
নিজের ঘরে পৌঁছতে পৌঁছতে অভিমানে উথলে উঠল নীলা। এক বার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, পর্দা সরিয়ে চোখ রাখল রাস্তায়। পাড়াটা এমনিতেই নির্জন, ছুটির দিন এবং এখনও পুরোপুরি বিকেল হয়নি বলে আরও নির্জন ও শান্ত লাগছে। একটা হাওয়া ছুঁয়ে গেল তাকে। এখন ফাল্গুন, বসন্তকাল, একটু আগে— কোনও ঘটনা ঘটবার আগে— কোকিলের ডাক শুনেছিল সে। কিন্তু হঠাৎই যেন কেমন হয়ে গেল সব! শ্বেতা যে এমন করবে ভাবতে পারেনি। আর কাউকে না বলুক, মাকে অন্তত ঘটনাটা জানাবে সে, জানাবেই; শ্বেতার ভালর জন্যই এটা করতে হবে তাকে।
পুরোপুরি আচ্ছন্নতায় পৌঁছে গিয়েছিল নীলা; কী ভাবছে, কেন ভাবছে, কিছুই আর মনে পড়ছিল না ঠিকঠাক। ঘুমের আগে যেমন হয়। হঠাৎ কাঁধে কারও স্পর্শে সচকিত হল সে। শ্বেতা।
নীলা তাকাতেই ভেঙে পড়ল শ্বেতা। মাথাটা দিদির কাঁধে রেখে কান্না মেশানো গলায় বলল, ‘আমি অন্যায় করেছি, দিদি। ওভাবে বলতে চাইনি। তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। প্লিজ, কাউকে কিছু বলিস না, দিদি—’

কিশোরী শ্বেতা এই ভাবেই কাঁদত। কিন্তু এখন ও পরিপূর্ণ যুবতী; তার ওপর আজ যা করল তার পর আর ওকে একেবারে সরল আর অসহায় ভাবলে চলবে না। তখন ওসব বলে নীলাকে সরিয়ে দিলেও ভয় পেয়েছে পরে। তবে কান্নাটা হয়তো মিথ্যে নয়।
‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ বোনকে আশ্বস্ত করে খাটে এনে বসাল নীলা। বলল, ‘আমি না হয় বললাম না কাউকে। কিন্তু আমার তো জানা দরকার। একটা ফোন এল, তুই ছুটে গেলি, তার পর আর সাড়াশব্দ নেই—! ফোনটাই বা করেছিল কে!’
ওড়নায় চোখ মুছল শ্বেতা। সোজাসুজি দেখল নীলাকে। তার পর আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘ও—’
‘ও মানে!’
‘যে এসেছিল। শ্যাম। আমিই ওকে বলেছিলাম ওই সময় টেলিফোনে হুইসল বাজালে আমি নেমে এসে দরজা খুলে দেব।’
‘হুইসল!’
যারা জানে তারা বুঝতে পারে। যদি অন্য কেউ ফোন ধরত!’

নীলা কিছুই বুঝল না। যুবকটির নাম শ্যাম, সে হুইসল বাজায়। শ্বেতার প্রেমিক নাকি!
‘তা হলে তুই-ই দরজা খুলে দিয়েছিলি! এক বারও ভয় করল না, ওপরে দিদি আছে!’
‘তুমি তখন হাতে ইঁদুর ধরে ফুরফুর করে নাক ডাকছিলে—’
নীলা ভুরু কোঁচকাল। তার পর ভাবল, হতেও পারে— আজকাল প্রায় দুপুরেই সে ভাতঘুমে জড়িয়ে পড়ে।
‘তুই ভালবাসিস? তোর প্রেমিক?’
‘ধুস্!’ গলায় অবজ্ঞা ফুটিয়ে শ্বেতা বলল, ‘হায়ার সেকেণ্ডারিটাও পাস করতে পারেনি, ওর সঙ্গে কে প্রেম করবে!’
‘তবে?’
‘তবে আর কী!’
‘ভাল না বাসলে কেউ অমন বাড়িতে ডাকে, ঠোঁট বাড়িয়ে দেয়!’ নীলা বলল, ‘তুই জানিস তোরা কী করছিলি! এর পর যদি একটা বিপদ হয়!’
‘বিপদ হবে কেন! আমি কি কচি খুকি নাকি!’ শ্বেতার গলায় জড়তা নেই। অল্প হেসে বলল, ‘আসলে ও খুব ভাল চুমু খায়। প্রফেশনাল। যা করে তার জন্য টাকা নেয়। অনেক মেয়েই ওর সার্ভিস নেয়। সব বাঁধা রেট, আর, খুব সেফ। এর মধ্যে ভালবাসাটাসা আসছে কোত্থেকে!’
নীলা আকাশ থেকে পড়ল। সময় নিয়ে বলল, ‘এ রকম হতে পারে! অনেক মেয়ে— বিয়ের আগে—’
‘তোমার যত ব্যাকডেটেড ধারণা!’ শ্বেতা বলল, ‘এই লিবারেটেড যুগে সকলেই বয়স হলেই বিয়ে করতে বাধ্য নাকি! কিন্তু ভেতরের চাহিদাটা তো থাকে! ওরও একটা ইনকাম হয়।’ শ্বেতা থামল এবং বলল, ‘ওই কোয়ালিফিকেশনে কে চাকরি দেবে! শরীরটাই খাটাচ্ছে—’
সেই হাওয়াটা এখন আবার ঘরে এসে ঢুকছে। খানিক তার স্পর্শ নিয়ে নীলা জিজ্ঞেস করল, ‘কী নাম বললি? শ্যাম?’
‘আমাকে তাই বলেছে। কিন্তু ওর আরও নাম আছে— এক একজনকে এক-একটা বলে—’
‘থাকে কোথায়?’
‘ওই তো, ডি-সি ব্লকে।’ কৌতুক করার ধরনে বলল শ্বেতা, ‘আরও জানতে চাও? মামির সঙ্গে লিভ-টুগেদার করে। মামি ডিভোর্সি—’
‘বাঃ!’ কথাগুলো তার মনঃপূত হয়নি, সেটা বোঝাতেই যেন নীলা বলল, ‘তুই সত্যি বলছিস না মিথ্যে, বুঝতে পারছি না। আমি কাউকে বলব না কিছু— কিন্তু তুই সাবধানে থাকিস। এ সব ভাল নয়, মোটেই ভাল নয়—’
নীলা আবার জানলার কাছে ফিরে যেতে শ্বেতা বলল, ‘দিদি, আমি ঘরে যাচ্ছি। ঘুম পাচ্ছে—’
নীলা জবাব দিল না। জানলার গ্রিল ধরে হাওয়ায় মুখ ভাসিয়ে আবার একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল সে। সেদিন অনেক রাতে গোটা বাড়ি স্তব্ধ হয়ে গেলে শ্বেতার ঘরের দরজায় এসে টোকা দিল নীলা। শ্বেতা জেগে ওঠার পর অদ্ভুত চাপা কিন্তু অনুনয়ের গলায় বলল, ‘কাউকে বলিস না। শ্যামের সঙ্গে আমার একটু যোগাযোগ করিয়ে দিবি? ওকে আমার ভীষণ দরকার—’
শ্বেতা বুঝতে পারল না কে কথা বলছে, কেন বলছে; সে-ই বা কী বলবে। ক’মুহূর্ত পরে শুধু বলল, ‘এখন অনেক রাত, দিদি। শুয়ে পড় গিয়ে। কাল কথা বলব।’

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ