অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
১
মাঝে বহু বছর কেটে গেছে। ও টেরও পায় নি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রথমেই ফেলে আসা এতো গুলো বছরের পরিবর্তনখুঁজে বার করার চেষ্টা করল সাত্ত্বিক। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে এসে চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
চারদিকে ছুটোছুটি - ব্যস্ততা। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই লোকে ছুটে চলেছে এয়ারপোর্ট কানেক্টিং ট্রেনের খোঁজে, ট্যাক্সির খোঁজে।লক্ষ্য করছে না বাইরের সাদা মেঘ ছড়ানো নীল আকাশকে। লক্ষ্য করছে না কিছু দুরে বসা একঝাঁক পায়রাকে।জানে না একটা মুহূর্ত হঠাৎ সব কিছু পালটে দিতে পারে। সব পরিচয় মুছে দিতে পারে। অকারণ হয়ে যেতে পারে সব ব্যস্ততা।
এ শহর যত খারাপই হোক না কেন, এ শহর ওর আপনার শহর। এখানকার বাতাস ওর বড় প্রিয়। এখানের বাতাসে মিশে আছে ওর প্রিয়জনের ডাক। আনন্দে উত্তেজনায় ওর মনে হল চিৎকার করে বলে ওঠে- আমি এসে গেছি। তোমাদের সব অপেক্ষা শেষ।
ট্রলিব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে ও এগিয়ে গেল সামনের ট্যাক্সিটার দিকে।
-লেক গার্ডেনস।
- ১০০ টাকা বেশি লাগবে। ফেরার সময় প্যাসেঞ্জার পাব না।
হেসে উঠল সাত্ত্বিক। অনেক কিছুই পালটাই নি। রাস্তায় বেশ কিছু দামী বিদেশি ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে। রাস্তা একটু ভালো হয়েছে। এয়ারপোর্টের সামনের বেশ কিছু জায়গায় চলন্ত রাস্তা হয়েছে। কিন্তু লোকের অভ্যেস কি আর অত সহজে পাল্টায়!
গাড়ী তে উঠে জানলা নামিয়ে বাইরের বাতাসের স্পর্শ পেতে চাইল সাত্ত্বিক।
সামনে থেকে ড্রাইভার বলে উঠল - সর্বনাশ! করছেনটা কি! আজকেও খবরে দেখেছেন! এ হাওয়াতে সাংঘাতিক বিষ মিশে আছে। বেশি নিশ্বাস নিলেই, ফুড়ুৎ। প্রতি মিনিটে জীবন থেকে পাঁচ মিনিট মাইনাস। চারদিকে ক্যান্সার কিরকম বেড়েছে দেখেছেন!
ওর অবশ্য বিষাক্ত হাওয়ায় কিছু আসে যায় না। তবু জানলা তুলে দিল সাত্ত্বিক। কাঁচের বাইরের শহর টার সঙ্গে একটু দূরত্ব রাখাই বোধহয় ভালো। অনেকেই মাথায় হেলমেটের মতো কিছু একটা পরে রেখেছে। নাক-মুখ ঢাকা একটা কাঁচের আবরণে।
ওর কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করেই লোকটা বলে উঠল - অনেক দাম বুঝলেন, আমাকেও টাকা জমিয়ে কিনতে হবে একটা। ওর মধ্যে অক্সিজেন আছে।তা আপনি আসছেন কোথা থেকে? ওখানে এরকম নেই?
- নিউইয়র্ক। হয়ত ওখানেও আছে। খেয়াল করি নি।
লোকটা একটু অবাক হল উত্তরটা শুনে।- সে কি, খেয়াল করেন নি! কেন রাস্তায় বেশি বেরোন না বুঝি!
সাত্ত্বিককে চুপ থাকতে দেখে লোকটা ফের বলে উঠল – অবশ্য হবেই বা কি করে! লোকে তো শুনেছি ওদেশে গাড়ি ছাড়া রাস্তাতে বেরোয়ই না। তাই না!
লোকটা মাথা ঘুরিয়ে পিছনে সাত্ত্বিকের দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল সাত্ত্বিক।
গাড়ীতে জিপিএস বসান। গাড়ি নিজের মতো এগিয়ে চলেছে। লোকটা শুধু স্টিয়ারিং– এ হাত রেখে বসে আছে।
লোকটার ড্রাইভার হিসেবে কি কাজ বুঝতে না পেরে সাত্ত্বিক প্রশ্ন করে উঠল –আচ্ছা গাড়ি চালাতে আপনাকে তো কিছুই করতে হয় না। তা হলে আপনার কাজটা কি?
মুচকি হেসে লোকটা বলে উঠল – প্রশ্নটা হল, গাড়িটা কার? না বসে থাকলে ‘আমার গাড়ি’র জায়গায়, ‘গাড়ির আমি’ হয়ে যাবো না তো? যা শুনছি চারদিকে!আমাদের সব চাকরি যেতে বসেছে রোবট গুলোর হাতে।এয়ারপোর্টের বাইরেও যত সিকুইরিটি দেখলেন, সবই রোবট। বোঝেন নি তো!আমিও প্রথমে বুঝতাম না। একদম মানুষের মতো চেহারা, একটু ভালো দেখতে এই আর কি!আর সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা ওভাবে কাজ করে যায়। ভাবুন তো!
- একটু থেমে গর্বের হাসি হেসে লোকটা ফের বলে উঠল - আপনার কি মনে হয়? মানুষের যুগ শেষ? এবার রোবটদের যুগ? ওরা তো প্রায় সবদিক দিয়েই আমাদের আগে। কি খাটতে পারে ভাবা যায়! আর কোন ভুলচুক নেই। তবে আমাদের সঙ্গে তর্কে ওরা পেরে উঠবে না। আমার গিন্নির সঙ্গে তো নয়ই। - নিজের মনেই হেসে উঠল লোকটা।
চুপ করে রইল সাত্ত্বিক। অনেক পুরোনো স্মৃতি ভিড় করছিল।
উত্তর না পেয়ে একটু যেন ক্ষুণ্ণ হল লোকটা। ফের বলে উঠল – আসলে আজকাল কথা বলার লোকই তো পাওয়া যায় না। সবাই হয় বিষাক্ত বাতাসের ভয়েনাক মুখ ঢেকে বসে আছে, না হলে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। সামনে কে আছে তাকেই খেয়াল করছে না। সামনের লোকই সব থেকে দূরে। তাই না!
হু – বলে একটা অস্ফুট আওয়াজ করল সাত্ত্বিক। - হ্যা, তা ঠিক। আমি আসলে বহু বছর বাদে কলকাতায় এলাম তো। তাই অবাক হয়ে আমার পুরোনো শহর দেখছি।
- কতো বছর বাদে?
- পঁচিশ বছর।
- বলেন কি? সে তো বহু দিন। আপনার কেউ নেই বুঝি এখানে! - একটু থেমে লোকটা আবার বলে উঠল - অবশ্য আসবেনই বা কেন? কি আছে এ শহরে? ওই ঐতিহাসিকরা আসতে পারে, অনেক বছর আগে কিরকম জীবন ছিল তা জানতে। কারণ এখানে তো আর কোন উন্নতি হয় নি, অথচ সারা পৃথিবী এগিয়ে গেছে। অথবা যারা জল নিয়ে গবেষণা করে, তারা আসতে পারে।
- কেন? জল নিয়ে গবেষণা করতে এখানে আসবে কেন?
- আরে মশাই, তাও জানেন না! শহর টা ডুবতে বসেছে,সে খবর রাখেন তো? শহরের ধার দিয়ে পাঁচিল করার কথা হচ্ছে। যাতে জল না ঢোকে। পুরো সুন্দরবন তো জলের তলায় চলে গেছে। এখন কলকাতা নিয়ে চিন্তা।
- সেকি!
- সমুদ্র দিন কে দিন উপরে উঠে আসছে। ওই কি গ্লোবাল ওয়ারমিং না কি বলে না! বলা হচ্ছে পুরো শহর নাকি জলের তলায় চলে যাবে। পরের বার এলে দেখবেন নৌকায় করে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ী যাচ্ছেন। হাসছেন! মনে রাখবেন শঙ্করের কথা খুব একটা ভুল হয় না।আমি তো আরেকটু টাকা জমলেই কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে যাবো। কে বলতে পারে ঘুম থেকে উঠলাম, দেখলাম খাট জলে ভাসছে।
লোকটার কথা শুনতে শুনতে সাত্ত্বিক বাইরের দিকে দেখছিল।
একটা জিনিস সত্যি কমে নি। তা হল ট্রাফিক জ্যাম। সামনে বিশাল গাড়ির লাইন।
- আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল হয় নি। এই সময়ে বাইপাসের উপরে জল রেশনের লাইন পড়ে।
- জল রেশন!তার মানে?
- আপনি কি মঙ্গল থেকে আসছেন মশাই! কিছুই খবর রাখেন না! পানীয় জলের কথা বলছি–কে কতটা পাবে, তার তো কোটা ঠিক করা থাকেজানেন নিশ্চয়ই। তাসেই অনুযায়ী এখান থেকে জল নিয়ে যেতে হয়। মাসের মধ্যে কয়েক দিন হয়। আজকের কথা খেয়াল ছিল না। আমার গিন্নি ওদিকটা সামলায়। অনেক ঝামেলা বুঝলেন। সারা মাস তার পরে মেপে মেপে জল খেতে হয়। তবু আমার কিছু চেনা লোকে ছিল বলে, কিছুটা বেশি পাই।
- পানীয় জল! তা দাম কত পড়ে?
- এ কি সোনা বা হীরে পেয়েছেন। যে টাকা ফেলবেন আর যা চাইবেন তা পেয়ে যাবেন! টাকা দিয়ে কি আর জল পাওয়া যায়! তা হলে তো আমার মতো লোকের জলই জুটত না। তাই না!ভাগ্য ভালো, সরকার জল নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে আমজনতার জন্যে জল বন্টন করে, যাতে কেউ বেশি জলের ভাগ না কিনে নিতে পারে। বুঝলেন?
তেমন সাড়া না পেয়েও কথা বলতেই থাকে লোকটা।
সাত্ত্বিকের সেদিকে মন নেই। ওর শুধু মনে পড়ছিল ওর ছোটবেলার কথা। মার কথা। সাদা দেওয়ালটার কথা। যে দেওয়ালটাও রঙ পেন্সিলের দাগে ভরিয়ে দিয়েছিল। ছাদের পায়রা গুলোকে খেতে দেওয়ার কথা। বাবার কাছে গল্প শোনার কথা। স্কুলের বন্ধু দের কথা। ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভাঙ্গার কথা। জ্বর হলে মার সারা রাত ধরে কপালে জলপটি দেওয়ার কথা।
এ সবযেন ঠিক কালকের ঘটনা।
তারপরই মনে পড়ল সেদিনটার কথা। হঠাৎ করে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে যেন সারা বাড়ীটা দুলে উঠল। ওকে সেদিন যেতে হয়েছিল ওই বাড়ীর আশি তলায়। ওর মনে হল যেন হঠাৎ করে ৮০ তলার সব জানলা কেউ খুলে দিয়েছে। ভেতরের আলো সব নিভে গেল। গরম হাওয়া, ধুলো আর ইটের টুকরো এসে ঝাপটা মারল সারা শরীরে।দম বন্ধ হওয়া পোড়া ধোঁয়া। আর মনে পড়ল না কিছু।
লোকটা রাস্তা ভালোই চেনে। বড় রাস্তা ছেড়ে শহরের অলি গলি ধরে এগিয়ে চলেছে।
খানিকবাদে অধৈর্য হয়ে সাত্ত্বিক বলে উঠল – আর কতক্ষণ লাগবে?
এই তো প্রায় এসে গেছি- বড় জোর আর আধঘণ্টা। কলকাতার রাস্তায় সময় বলা আর মেয়ে দের মন বোঝা একই রকম শক্ত!- বলে একটু খুকখুক করে হেসে ফের বলে উঠল-
- তা দাদা শুনেছি আমেরিকার রোবট গুলো নাকি আরও বুদ্ধিমান, শুধু মানুষের মতো দেখতেই নয়, মানুষের মতো বুদ্ধিও ধরে। তাই নাকি! এখানকার গুলো ভারি বোকা। যেটুকু বলা হবে – ব্যাস সেটুকুই। সেদিন দেখি এয়ারপোর্টের গেটের একটা সিকুরিটির রোবট এয়ারপোর্টেরই এক বড় অফিসারকে আটকে দিয়েছে, আইডি নেই বলে। কিছুতেই ঢুকতে দিল না। অথচ ওই অফিসার রোজ দশবার করে ঢোকে বেরোয়। শুধু তখন আইডি ফেলে এসেছে ভুল করে। ঢুকতেই দিল না শেষ মেশ। বলুন তো কি বুদ্ধি!ওরা নিয়ম ভাঙতেই শেখে নি।
লোকটা কথা বলেই চলল। সাত্ত্বিক অবশ্য আর শুনছিল না। ওর মনে হচ্ছিল ও হঠাৎ করে ফিরে গেছে ছোটবেলার কোন একদিনে। জানলার বাইরের শহর এত বছরের না বলা কথা একসঙ্গে ওকে বলতে চাইছে।
২
- এবার খেতে চলে এসো। আর কতক্ষণ বসে থাকবে!
- আসছি। ওর সঙ্গে আরেকটু কথা বলে নি। আজ ওর জন্মদিন। ভুলে গেছো!
- সে তো তুমি গত দু ঘণ্টা ধরে এক কথা বলছ। আর কত কথা বলবে।
- দেখছ না। বাবু কি অত তাড়াতাড়িছাড়ে!
মানিকবাবুর রোজই এই এক অভিজ্ঞতা। বহু বছর হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে ২০০১ এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে টুইন টাওয়ারে টেররিষ্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। কিন্তু ওনার স্ত্রী মিনু এখনও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি। আজও তাই। আজ আবার ওর জন্মদিন। সকাল থেকে মানিক বাবুর মন তাই এমনিতেই খারাপ।
ওনার স্ত্রী কথা বলে চলেছে। খানিক দূরে ওনার ছেলের ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকে রোজকার মতো শোনা যাচ্ছে ছেলের গলা-
- তা মা, তোমার শরীর ভালো আছে তো?
- আর ক^বার জিজ্ঞেস করবি! বয়সের সঙ্গে শরীর তো একটু খারাপ হবেই। পায়ের ব্যথা টা একটু বেড়েছে এই আর কি!তা তুই এবার এদেশে চলে আয়। আর কত দিন ওদেশে থাকবি!
- আসব মা, রিসার্চটা প্রায় শেষের দিকে।
- আর কত দিন ওই এক কথা বলবি। বাবারও বয়স হয়েছে। এ বয়সে বাইরের সব ঝুট ঝামেলা মেটান কি সহজ!সেদিন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। তুই এলে একটা ভরসা হয়।
কথা চলতেই থাকে।
আরও আধঘণ্টা বাদে ধৈর্য হারালেন মানিক বাবু।
সামনে ছেলের হলোগ্রামটার দিকে আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন মানিক বাবু- আর কত দিন বলব- ও নেই।ও আমাদের ছেড়ে বহু বছর আগে চলে গেছে।
- কি আবোল তাবোল বলছ। বাবু তো সামনেই বসে আছে। কখন থেকে আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে আমেরিকা থেকে। শুনতে পাচ্ছ না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার কানটাও গেছে।– বলে থেমে আবার ছেলের দিকে মুখ করে বলে উঠলেন - বাবু এবার তুই এখানে এলে তোর বাবার কানটা ডাক্তারকে দিয়ে ভালো করে দেখিয়ে নিস। তা আজকে কি খাবি? হাবিজাবি কিছু খাস না। বড় রোগা হয়ে গেছিস।
- তুমি পাগল হয়ে গেছ। - বলে সামনের তাকে রাখা একটা পুরনো লালচে খবরের কাগজ নিয়ে সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠলেন মানিক বাবু। - এই যে পড়ো হেডলাইন নিউজ। নিউইয়র্ক টাইম্সের ২০০১ এর ১২ ই সেপ্টেম্বরের কাগজ টা দেখিয়ে উনি ফের বলে উঠলেন- U. S. Attacked, Hijacked Jets destroy twin towers..” – দেখতে পাচ্ছ। আমাদের বাবুও ঠিক সেই সময়ে ওই বিল্ডিং এ ছিল। তার দুদিন বাদে ওর একেবারে ভারতে ফিরে আসার কথা ছিল। আমাদের কাছে। কই – তা হল কই! ও আর কোনদিন আসবে না। কতদিন আর এককথা বলব!
- কি যা তা বলছ। ওর সঙ্গে তো আমার রোজ কথা হয়। ওই দেখ না আমার সঙ্গে কথা বলছে।
- পুরো ব্যাপারটাই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।ভারচুয়ালরিয়ালিটি। ওর ত্রিমাত্রিক ছবি প্রোজেক্ট করা হচ্ছে।ওকে দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধির মাধ্যমে কথা বলানো হচ্ছে, যাতে তোমার প্রশ্নের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে উত্তর দেয়। কেন তুমি বোঝ না ও রোজ তোমাকে সাজান গোছানো কিছু কথা শোনায়।
একটু থেমে মানিক বাবু ফের বল উঠলেন- কয়েক বছর আগে তোমার জন্য এই যন্ত্রটা অনেক দাম দিয়ে কিনে এনেছিলাম। ডাক্তারের পরামর্শে। ভেবেছিলাম তুমি কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তা না- আরও খারাপ হল। তুমি এখন ভাব ওটাই আসল। ওটাই আসল জগৎ। ওকে নিয়ে সারাদিন পড়ে থাক।
- মজা করছ তাই না!
- না না মিনু। মজা করছি না। ও নেই। কতবার বলব ও নেই। আজ থেকে বহু বছর আগে ও চলে গেছে। আর কোন দিন ও আর আমাদের মধ্যে ফিরবে না। তা না হলে যে ছেলে সারাক্ষণ এতো মা- মা করতো , সে এত বছরে একবারও এখানে আসত না!–
- বলে এগিয়ে গেলেন মানিক বাবু –ঘরের অন্য প্রান্তে গিয়ে সুইচ টা বন্ধ করতেই মুহূর্তে ঘরের পরিবেশ বদলে গেল। ঘরের মধ্যে থেকে ছেলের ত্রিমাত্রিক ছবি, শব্দ সব মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।
উনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন- দেখলে কোথায় গেল আমাদের বাবু! সামনে দেখো শুধু সাদা দেওয়াল। কই আছে আর কিছু! শুধু একটা সুইচ – আর সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওর চেহারা, ওর কথা।
দেওয়ালের উপরে পরম স্নেহের সঙ্গে হাত বোলালেন মানিক বাবু। সাদা দেওয়ালের উপরে আবছা হয়ে আসা রঙ পেন্সিলের দাগগুলোতে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলে উঠলেন- কেউ নেই। শুধু সাদা দেওয়াল। আমরা বহু দিন আগেই ওকে – আর বলতে পারলেন না মানিক বাবু। দেওয়ালের দিকে মুখ করে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলেন।
ওনার স্ত্রী এবার সোফা ছেড়ে উঠে দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার পরে দেওয়ালের উপরে হাত বুলিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন- তোমার চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে বাবু চলে গেল। -বাবু ! বাবু! কোথায় তুই। - তার পরে মানিক বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন - ও তো রোজ আসে। দেখবে আবার কাল আসবে। এখানেও একদিন আসবে। রিসার্চ শেষ হলেই। শুনলে না কথা দিল। ও কখনওকথার খেলাপ করে না। তোমার কথা সব মিথ্যে, সব মিথ্যে।
ঠিক এসময় বাইরের দরজায় যেন বেলটা বেজে উঠল।
- কে? কে? – মিনু চেঁচিয়ে উঠল।
সোফার উপরে বসে পড়লেন মানিক বাবু।
- বাইরে কেউ নেই। ও তোমার মনের ভুল। এখন আর কে আসবে!
বেলটা আবার বেজে উঠল। দরজায় ধাক্কার শব্দ। পরপর চারবার।
- বাবু! বল বাবু ছাড়া আর কেউ কোনদিন এ দরজায় এ ভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
আবার দরজায় ধাক্কা। মিনু দরজার দিকে জোর পায়ে এগিয়ে যান। পিছনে পিছনে খানিকটা অবাক ভাবে মানিকবাবুও এগিয়ে যান।
দরজার বাইরে এক অচেনা বছর পঁচিশেকের ভারি সুন্দর দেখতে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ।
হঠাৎ করে হকচকিয়ে দিয়ে মিনুকে জড়িয়ে ধরল ছেলেটা। বলে উঠল – আমি ফিরে এসেছি মা। ফিরে এসেছি। ওরা আমাকে ফের প্রাণ দিয়েছে।
- বলে হাত দেখিয়ে বলে উঠল – এই চামড়া নকল। সরালে দেখবে স্টিলের প্লেট। আমি রোবট হতে পারি। কিন্তু আসলে আমি তোমারই ছেলে। আমার ব্রেনই হল আমার পরিচয়। আর তোমার ছেলের সেই ব্রেনই ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে আমার রোবট শরীরে, যাতে আমি মানুষের মতো হই।আর তাই তো আমার একটাই পরিচয়- আমি সাত্ত্বিক – তোমাদের ছেলে সাত্ত্বিক।
তাই সবার আগে প্রাণ পেয়েই তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এলাম।
বলে জুতো পরেই গটগট করে এগিয়ে গিয়ে সাদা দেওয়ালের সামনে গিয়ে বলে উঠল –এ দেওয়ালের রঙ সাদা নয়।দেখছ না রঙ পেন্সিলের দাগ গুলো এখনও স্পষ্ট।
তারপরে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরল মানিকবাবুকে। মানিকবাবু টের পেলেন হাত গুলো লোহার হলেও কেমন যেন আপনার। আর হাবভাব ঠিক যেন সাত্ত্বিকেরই মত।
-------------
রচনাকাল
২ রা এপ্রিল ২০১৫
লেখক পরিচিতি
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
জন্ম ১৮ এপ্রিল ১৯৭০, কলকাতায়। লেখালেখির শুরু ১৯৯৪ এ কিশোর ভারতী ও আনন্দমেলার পাতায়। লেখার বিষয় প্রধানত বিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান, রহস্য হলেও কিশোরসাহিত্যের অন্য ধারাতেও সমান স্বচ্ছন্দ ও জনপ্রিয়।
১
মাঝে বহু বছর কেটে গেছে। ও টেরও পায় নি। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে প্রথমেই ফেলে আসা এতো গুলো বছরের পরিবর্তনখুঁজে বার করার চেষ্টা করল সাত্ত্বিক। এয়ারপোর্টের বাইরে বেরিয়ে এসে চুপ করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
চারদিকে ছুটোছুটি - ব্যস্ততা। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই লোকে ছুটে চলেছে এয়ারপোর্ট কানেক্টিং ট্রেনের খোঁজে, ট্যাক্সির খোঁজে।লক্ষ্য করছে না বাইরের সাদা মেঘ ছড়ানো নীল আকাশকে। লক্ষ্য করছে না কিছু দুরে বসা একঝাঁক পায়রাকে।জানে না একটা মুহূর্ত হঠাৎ সব কিছু পালটে দিতে পারে। সব পরিচয় মুছে দিতে পারে। অকারণ হয়ে যেতে পারে সব ব্যস্ততা।
এ শহর যত খারাপই হোক না কেন, এ শহর ওর আপনার শহর। এখানকার বাতাস ওর বড় প্রিয়। এখানের বাতাসে মিশে আছে ওর প্রিয়জনের ডাক। আনন্দে উত্তেজনায় ওর মনে হল চিৎকার করে বলে ওঠে- আমি এসে গেছি। তোমাদের সব অপেক্ষা শেষ।
ট্রলিব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে ও এগিয়ে গেল সামনের ট্যাক্সিটার দিকে।
-লেক গার্ডেনস।
- ১০০ টাকা বেশি লাগবে। ফেরার সময় প্যাসেঞ্জার পাব না।
হেসে উঠল সাত্ত্বিক। অনেক কিছুই পালটাই নি। রাস্তায় বেশ কিছু দামী বিদেশি ট্যাক্সি দেখা যাচ্ছে। রাস্তা একটু ভালো হয়েছে। এয়ারপোর্টের সামনের বেশ কিছু জায়গায় চলন্ত রাস্তা হয়েছে। কিন্তু লোকের অভ্যেস কি আর অত সহজে পাল্টায়!
গাড়ী তে উঠে জানলা নামিয়ে বাইরের বাতাসের স্পর্শ পেতে চাইল সাত্ত্বিক।
সামনে থেকে ড্রাইভার বলে উঠল - সর্বনাশ! করছেনটা কি! আজকেও খবরে দেখেছেন! এ হাওয়াতে সাংঘাতিক বিষ মিশে আছে। বেশি নিশ্বাস নিলেই, ফুড়ুৎ। প্রতি মিনিটে জীবন থেকে পাঁচ মিনিট মাইনাস। চারদিকে ক্যান্সার কিরকম বেড়েছে দেখেছেন!
ওর অবশ্য বিষাক্ত হাওয়ায় কিছু আসে যায় না। তবু জানলা তুলে দিল সাত্ত্বিক। কাঁচের বাইরের শহর টার সঙ্গে একটু দূরত্ব রাখাই বোধহয় ভালো। অনেকেই মাথায় হেলমেটের মতো কিছু একটা পরে রেখেছে। নাক-মুখ ঢাকা একটা কাঁচের আবরণে।
ওর কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করেই লোকটা বলে উঠল - অনেক দাম বুঝলেন, আমাকেও টাকা জমিয়ে কিনতে হবে একটা। ওর মধ্যে অক্সিজেন আছে।তা আপনি আসছেন কোথা থেকে? ওখানে এরকম নেই?
- নিউইয়র্ক। হয়ত ওখানেও আছে। খেয়াল করি নি।
লোকটা একটু অবাক হল উত্তরটা শুনে।- সে কি, খেয়াল করেন নি! কেন রাস্তায় বেশি বেরোন না বুঝি!
সাত্ত্বিককে চুপ থাকতে দেখে লোকটা ফের বলে উঠল – অবশ্য হবেই বা কি করে! লোকে তো শুনেছি ওদেশে গাড়ি ছাড়া রাস্তাতে বেরোয়ই না। তাই না!
লোকটা মাথা ঘুরিয়ে পিছনে সাত্ত্বিকের দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল সাত্ত্বিক।
গাড়ীতে জিপিএস বসান। গাড়ি নিজের মতো এগিয়ে চলেছে। লোকটা শুধু স্টিয়ারিং– এ হাত রেখে বসে আছে।
লোকটার ড্রাইভার হিসেবে কি কাজ বুঝতে না পেরে সাত্ত্বিক প্রশ্ন করে উঠল –আচ্ছা গাড়ি চালাতে আপনাকে তো কিছুই করতে হয় না। তা হলে আপনার কাজটা কি?
মুচকি হেসে লোকটা বলে উঠল – প্রশ্নটা হল, গাড়িটা কার? না বসে থাকলে ‘আমার গাড়ি’র জায়গায়, ‘গাড়ির আমি’ হয়ে যাবো না তো? যা শুনছি চারদিকে!আমাদের সব চাকরি যেতে বসেছে রোবট গুলোর হাতে।এয়ারপোর্টের বাইরেও যত সিকুইরিটি দেখলেন, সবই রোবট। বোঝেন নি তো!আমিও প্রথমে বুঝতাম না। একদম মানুষের মতো চেহারা, একটু ভালো দেখতে এই আর কি!আর সাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা ওভাবে কাজ করে যায়। ভাবুন তো!
- একটু থেমে গর্বের হাসি হেসে লোকটা ফের বলে উঠল - আপনার কি মনে হয়? মানুষের যুগ শেষ? এবার রোবটদের যুগ? ওরা তো প্রায় সবদিক দিয়েই আমাদের আগে। কি খাটতে পারে ভাবা যায়! আর কোন ভুলচুক নেই। তবে আমাদের সঙ্গে তর্কে ওরা পেরে উঠবে না। আমার গিন্নির সঙ্গে তো নয়ই। - নিজের মনেই হেসে উঠল লোকটা।
চুপ করে রইল সাত্ত্বিক। অনেক পুরোনো স্মৃতি ভিড় করছিল।
উত্তর না পেয়ে একটু যেন ক্ষুণ্ণ হল লোকটা। ফের বলে উঠল – আসলে আজকাল কথা বলার লোকই তো পাওয়া যায় না। সবাই হয় বিষাক্ত বাতাসের ভয়েনাক মুখ ঢেকে বসে আছে, না হলে ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। সামনে কে আছে তাকেই খেয়াল করছে না। সামনের লোকই সব থেকে দূরে। তাই না!
হু – বলে একটা অস্ফুট আওয়াজ করল সাত্ত্বিক। - হ্যা, তা ঠিক। আমি আসলে বহু বছর বাদে কলকাতায় এলাম তো। তাই অবাক হয়ে আমার পুরোনো শহর দেখছি।
- কতো বছর বাদে?
- পঁচিশ বছর।
- বলেন কি? সে তো বহু দিন। আপনার কেউ নেই বুঝি এখানে! - একটু থেমে লোকটা আবার বলে উঠল - অবশ্য আসবেনই বা কেন? কি আছে এ শহরে? ওই ঐতিহাসিকরা আসতে পারে, অনেক বছর আগে কিরকম জীবন ছিল তা জানতে। কারণ এখানে তো আর কোন উন্নতি হয় নি, অথচ সারা পৃথিবী এগিয়ে গেছে। অথবা যারা জল নিয়ে গবেষণা করে, তারা আসতে পারে।
- কেন? জল নিয়ে গবেষণা করতে এখানে আসবে কেন?
- আরে মশাই, তাও জানেন না! শহর টা ডুবতে বসেছে,সে খবর রাখেন তো? শহরের ধার দিয়ে পাঁচিল করার কথা হচ্ছে। যাতে জল না ঢোকে। পুরো সুন্দরবন তো জলের তলায় চলে গেছে। এখন কলকাতা নিয়ে চিন্তা।
- সেকি!
- সমুদ্র দিন কে দিন উপরে উঠে আসছে। ওই কি গ্লোবাল ওয়ারমিং না কি বলে না! বলা হচ্ছে পুরো শহর নাকি জলের তলায় চলে যাবে। পরের বার এলে দেখবেন নৌকায় করে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ী যাচ্ছেন। হাসছেন! মনে রাখবেন শঙ্করের কথা খুব একটা ভুল হয় না।আমি তো আরেকটু টাকা জমলেই কলকাতা ছেড়ে বাইরে চলে যাবো। কে বলতে পারে ঘুম থেকে উঠলাম, দেখলাম খাট জলে ভাসছে।
লোকটার কথা শুনতে শুনতে সাত্ত্বিক বাইরের দিকে দেখছিল।
একটা জিনিস সত্যি কমে নি। তা হল ট্রাফিক জ্যাম। সামনে বিশাল গাড়ির লাইন।
- আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল হয় নি। এই সময়ে বাইপাসের উপরে জল রেশনের লাইন পড়ে।
- জল রেশন!তার মানে?
- আপনি কি মঙ্গল থেকে আসছেন মশাই! কিছুই খবর রাখেন না! পানীয় জলের কথা বলছি–কে কতটা পাবে, তার তো কোটা ঠিক করা থাকেজানেন নিশ্চয়ই। তাসেই অনুযায়ী এখান থেকে জল নিয়ে যেতে হয়। মাসের মধ্যে কয়েক দিন হয়। আজকের কথা খেয়াল ছিল না। আমার গিন্নি ওদিকটা সামলায়। অনেক ঝামেলা বুঝলেন। সারা মাস তার পরে মেপে মেপে জল খেতে হয়। তবু আমার কিছু চেনা লোকে ছিল বলে, কিছুটা বেশি পাই।
- পানীয় জল! তা দাম কত পড়ে?
- এ কি সোনা বা হীরে পেয়েছেন। যে টাকা ফেলবেন আর যা চাইবেন তা পেয়ে যাবেন! টাকা দিয়ে কি আর জল পাওয়া যায়! তা হলে তো আমার মতো লোকের জলই জুটত না। তাই না!ভাগ্য ভালো, সরকার জল নিয়ন্ত্রণ করে। এভাবে আমজনতার জন্যে জল বন্টন করে, যাতে কেউ বেশি জলের ভাগ না কিনে নিতে পারে। বুঝলেন?
তেমন সাড়া না পেয়েও কথা বলতেই থাকে লোকটা।
সাত্ত্বিকের সেদিকে মন নেই। ওর শুধু মনে পড়ছিল ওর ছোটবেলার কথা। মার কথা। সাদা দেওয়ালটার কথা। যে দেওয়ালটাও রঙ পেন্সিলের দাগে ভরিয়ে দিয়েছিল। ছাদের পায়রা গুলোকে খেতে দেওয়ার কথা। বাবার কাছে গল্প শোনার কথা। স্কুলের বন্ধু দের কথা। ফুটবল খেলতে গিয়ে পা ভাঙ্গার কথা। জ্বর হলে মার সারা রাত ধরে কপালে জলপটি দেওয়ার কথা।
এ সবযেন ঠিক কালকের ঘটনা।
তারপরই মনে পড়ল সেদিনটার কথা। হঠাৎ করে একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণে যেন সারা বাড়ীটা দুলে উঠল। ওকে সেদিন যেতে হয়েছিল ওই বাড়ীর আশি তলায়। ওর মনে হল যেন হঠাৎ করে ৮০ তলার সব জানলা কেউ খুলে দিয়েছে। ভেতরের আলো সব নিভে গেল। গরম হাওয়া, ধুলো আর ইটের টুকরো এসে ঝাপটা মারল সারা শরীরে।দম বন্ধ হওয়া পোড়া ধোঁয়া। আর মনে পড়ল না কিছু।
লোকটা রাস্তা ভালোই চেনে। বড় রাস্তা ছেড়ে শহরের অলি গলি ধরে এগিয়ে চলেছে।
খানিকবাদে অধৈর্য হয়ে সাত্ত্বিক বলে উঠল – আর কতক্ষণ লাগবে?
এই তো প্রায় এসে গেছি- বড় জোর আর আধঘণ্টা। কলকাতার রাস্তায় সময় বলা আর মেয়ে দের মন বোঝা একই রকম শক্ত!- বলে একটু খুকখুক করে হেসে ফের বলে উঠল-
- তা দাদা শুনেছি আমেরিকার রোবট গুলো নাকি আরও বুদ্ধিমান, শুধু মানুষের মতো দেখতেই নয়, মানুষের মতো বুদ্ধিও ধরে। তাই নাকি! এখানকার গুলো ভারি বোকা। যেটুকু বলা হবে – ব্যাস সেটুকুই। সেদিন দেখি এয়ারপোর্টের গেটের একটা সিকুরিটির রোবট এয়ারপোর্টেরই এক বড় অফিসারকে আটকে দিয়েছে, আইডি নেই বলে। কিছুতেই ঢুকতে দিল না। অথচ ওই অফিসার রোজ দশবার করে ঢোকে বেরোয়। শুধু তখন আইডি ফেলে এসেছে ভুল করে। ঢুকতেই দিল না শেষ মেশ। বলুন তো কি বুদ্ধি!ওরা নিয়ম ভাঙতেই শেখে নি।
লোকটা কথা বলেই চলল। সাত্ত্বিক অবশ্য আর শুনছিল না। ওর মনে হচ্ছিল ও হঠাৎ করে ফিরে গেছে ছোটবেলার কোন একদিনে। জানলার বাইরের শহর এত বছরের না বলা কথা একসঙ্গে ওকে বলতে চাইছে।
২
- এবার খেতে চলে এসো। আর কতক্ষণ বসে থাকবে!
- আসছি। ওর সঙ্গে আরেকটু কথা বলে নি। আজ ওর জন্মদিন। ভুলে গেছো!
- সে তো তুমি গত দু ঘণ্টা ধরে এক কথা বলছ। আর কত কথা বলবে।
- দেখছ না। বাবু কি অত তাড়াতাড়িছাড়ে!
মানিকবাবুর রোজই এই এক অভিজ্ঞতা। বহু বছর হয়ে গেছে। একমাত্র ছেলে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে ২০০১ এ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে টুইন টাওয়ারে টেররিষ্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। কিন্তু ওনার স্ত্রী মিনু এখনও ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে নি। আজও তাই। আজ আবার ওর জন্মদিন। সকাল থেকে মানিক বাবুর মন তাই এমনিতেই খারাপ।
ওনার স্ত্রী কথা বলে চলেছে। খানিক দূরে ওনার ছেলের ত্রিমাত্রিক ছবি দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকে রোজকার মতো শোনা যাচ্ছে ছেলের গলা-
- তা মা, তোমার শরীর ভালো আছে তো?
- আর ক^বার জিজ্ঞেস করবি! বয়সের সঙ্গে শরীর তো একটু খারাপ হবেই। পায়ের ব্যথা টা একটু বেড়েছে এই আর কি!তা তুই এবার এদেশে চলে আয়। আর কত দিন ওদেশে থাকবি!
- আসব মা, রিসার্চটা প্রায় শেষের দিকে।
- আর কত দিন ওই এক কথা বলবি। বাবারও বয়স হয়েছে। এ বয়সে বাইরের সব ঝুট ঝামেলা মেটান কি সহজ!সেদিন রাস্তায় পড়ে গিয়েছিল। তুই এলে একটা ভরসা হয়।
কথা চলতেই থাকে।
আরও আধঘণ্টা বাদে ধৈর্য হারালেন মানিক বাবু।
সামনে ছেলের হলোগ্রামটার দিকে আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলেন মানিক বাবু- আর কত দিন বলব- ও নেই।ও আমাদের ছেড়ে বহু বছর আগে চলে গেছে।
- কি আবোল তাবোল বলছ। বাবু তো সামনেই বসে আছে। কখন থেকে আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছে আমেরিকা থেকে। শুনতে পাচ্ছ না। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার কানটাও গেছে।– বলে থেমে আবার ছেলের দিকে মুখ করে বলে উঠলেন - বাবু এবার তুই এখানে এলে তোর বাবার কানটা ডাক্তারকে দিয়ে ভালো করে দেখিয়ে নিস। তা আজকে কি খাবি? হাবিজাবি কিছু খাস না। বড় রোগা হয়ে গেছিস।
- তুমি পাগল হয়ে গেছ। - বলে সামনের তাকে রাখা একটা পুরনো লালচে খবরের কাগজ নিয়ে সামনে ছুঁড়ে দিয়ে বলে উঠলেন মানিক বাবু। - এই যে পড়ো হেডলাইন নিউজ। নিউইয়র্ক টাইম্সের ২০০১ এর ১২ ই সেপ্টেম্বরের কাগজ টা দেখিয়ে উনি ফের বলে উঠলেন- U. S. Attacked, Hijacked Jets destroy twin towers..” – দেখতে পাচ্ছ। আমাদের বাবুও ঠিক সেই সময়ে ওই বিল্ডিং এ ছিল। তার দুদিন বাদে ওর একেবারে ভারতে ফিরে আসার কথা ছিল। আমাদের কাছে। কই – তা হল কই! ও আর কোনদিন আসবে না। কতদিন আর এককথা বলব!
- কি যা তা বলছ। ওর সঙ্গে তো আমার রোজ কথা হয়। ওই দেখ না আমার সঙ্গে কথা বলছে।
- পুরো ব্যাপারটাই কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।ভারচুয়ালরিয়ালিটি। ওর ত্রিমাত্রিক ছবি প্রোজেক্ট করা হচ্ছে।ওকে দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধির মাধ্যমে কথা বলানো হচ্ছে, যাতে তোমার প্রশ্নের মতো করে সাজিয়ে গুছিয়ে উত্তর দেয়। কেন তুমি বোঝ না ও রোজ তোমাকে সাজান গোছানো কিছু কথা শোনায়।
একটু থেমে মানিক বাবু ফের বল উঠলেন- কয়েক বছর আগে তোমার জন্য এই যন্ত্রটা অনেক দাম দিয়ে কিনে এনেছিলাম। ডাক্তারের পরামর্শে। ভেবেছিলাম তুমি কিছুটা হলেও শান্তি পাবে। স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তা না- আরও খারাপ হল। তুমি এখন ভাব ওটাই আসল। ওটাই আসল জগৎ। ওকে নিয়ে সারাদিন পড়ে থাক।
- মজা করছ তাই না!
- না না মিনু। মজা করছি না। ও নেই। কতবার বলব ও নেই। আজ থেকে বহু বছর আগে ও চলে গেছে। আর কোন দিন ও আর আমাদের মধ্যে ফিরবে না। তা না হলে যে ছেলে সারাক্ষণ এতো মা- মা করতো , সে এত বছরে একবারও এখানে আসত না!–
- বলে এগিয়ে গেলেন মানিক বাবু –ঘরের অন্য প্রান্তে গিয়ে সুইচ টা বন্ধ করতেই মুহূর্তে ঘরের পরিবেশ বদলে গেল। ঘরের মধ্যে থেকে ছেলের ত্রিমাত্রিক ছবি, শব্দ সব মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।
উনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন- দেখলে কোথায় গেল আমাদের বাবু! সামনে দেখো শুধু সাদা দেওয়াল। কই আছে আর কিছু! শুধু একটা সুইচ – আর সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। ওর চেহারা, ওর কথা।
দেওয়ালের উপরে পরম স্নেহের সঙ্গে হাত বোলালেন মানিক বাবু। সাদা দেওয়ালের উপরে আবছা হয়ে আসা রঙ পেন্সিলের দাগগুলোতে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলে উঠলেন- কেউ নেই। শুধু সাদা দেওয়াল। আমরা বহু দিন আগেই ওকে – আর বলতে পারলেন না মানিক বাবু। দেওয়ালের দিকে মুখ করে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলেন।
ওনার স্ত্রী এবার সোফা ছেড়ে উঠে দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার পরে দেওয়ালের উপরে হাত বুলিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন- তোমার চেঁচামেচিতে ভয় পেয়ে বাবু চলে গেল। -বাবু ! বাবু! কোথায় তুই। - তার পরে মানিক বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন - ও তো রোজ আসে। দেখবে আবার কাল আসবে। এখানেও একদিন আসবে। রিসার্চ শেষ হলেই। শুনলে না কথা দিল। ও কখনওকথার খেলাপ করে না। তোমার কথা সব মিথ্যে, সব মিথ্যে।
ঠিক এসময় বাইরের দরজায় যেন বেলটা বেজে উঠল।
- কে? কে? – মিনু চেঁচিয়ে উঠল।
সোফার উপরে বসে পড়লেন মানিক বাবু।
- বাইরে কেউ নেই। ও তোমার মনের ভুল। এখন আর কে আসবে!
বেলটা আবার বেজে উঠল। দরজায় ধাক্কার শব্দ। পরপর চারবার।
- বাবু! বল বাবু ছাড়া আর কেউ কোনদিন এ দরজায় এ ভাবে ধাক্কা দিয়েছে।
আবার দরজায় ধাক্কা। মিনু দরজার দিকে জোর পায়ে এগিয়ে যান। পিছনে পিছনে খানিকটা অবাক ভাবে মানিকবাবুও এগিয়ে যান।
দরজার বাইরে এক অচেনা বছর পঁচিশেকের ভারি সুন্দর দেখতে ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা ট্রলি ব্যাগ।
হঠাৎ করে হকচকিয়ে দিয়ে মিনুকে জড়িয়ে ধরল ছেলেটা। বলে উঠল – আমি ফিরে এসেছি মা। ফিরে এসেছি। ওরা আমাকে ফের প্রাণ দিয়েছে।
- বলে হাত দেখিয়ে বলে উঠল – এই চামড়া নকল। সরালে দেখবে স্টিলের প্লেট। আমি রোবট হতে পারি। কিন্তু আসলে আমি তোমারই ছেলে। আমার ব্রেনই হল আমার পরিচয়। আর তোমার ছেলের সেই ব্রেনই ট্রান্সপ্লান্ট করা হয়েছে আমার রোবট শরীরে, যাতে আমি মানুষের মতো হই।আর তাই তো আমার একটাই পরিচয়- আমি সাত্ত্বিক – তোমাদের ছেলে সাত্ত্বিক।
তাই সবার আগে প্রাণ পেয়েই তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে ছুটে এলাম।
বলে জুতো পরেই গটগট করে এগিয়ে গিয়ে সাদা দেওয়ালের সামনে গিয়ে বলে উঠল –এ দেওয়ালের রঙ সাদা নয়।দেখছ না রঙ পেন্সিলের দাগ গুলো এখনও স্পষ্ট।
তারপরে ফিরে এসে জড়িয়ে ধরল মানিকবাবুকে। মানিকবাবু টের পেলেন হাত গুলো লোহার হলেও কেমন যেন আপনার। আর হাবভাব ঠিক যেন সাত্ত্বিকেরই মত।
-------------
রচনাকাল
২ রা এপ্রিল ২০১৫
লেখক পরিচিতি
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
জন্ম ১৮ এপ্রিল ১৯৭০, কলকাতায়। লেখালেখির শুরু ১৯৯৪ এ কিশোর ভারতী ও আনন্দমেলার পাতায়। লেখার বিষয় প্রধানত বিজ্ঞান, কল্পবিজ্ঞান, রহস্য হলেও কিশোরসাহিত্যের অন্য ধারাতেও সমান স্বচ্ছন্দ ও জনপ্রিয়।
বাংলায় প্রকাশিত গ্রন্থ – মাঝে মাত্র চব্বিশ দিন, সঙ্কেত রহস্য, রহস্য যখন ডারউইন, রহস্য যখন নিজেকে নিয়ে, রহস্য যখন রক্তে, রহস্য যখন সংখ্যায়, গ্লোবাল ওয়ারমিং, এই পৃথিবী একশ বছর পরে ও অন্যান্য।
এছাড়া প্রকাশিত গল্প সংকলন : ভৌতিক অলৌকিক, নিয়ম যখন ভাঙ্গে, রাতের ট্রেনের সঙ্গী।
লেখকের একাধিক গল্প রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়েছে।
২ রা এপ্রিল ২০১৫
২ রা এপ্রিল ২০১৫
0 মন্তব্যসমূহ