অনিল ঘোষের গল্প : নসিবন কথা

...... তারপর আমরা ছুটতে শুরু করলাম।ছুটছি তো ছুটছিই।কোনও হুঁশ নেই।অন্ধকারে রঙকানা তালকানার মতো।কোথায় যাচ্ছি জানি না, কেন যাচ্ছি তাও না।শুধু জানি যেতে হবে। কোথাও একটা যেতে হবে।এই বিষ বাতাস থেকে দূরে, গিলতে আসা রক্তচোখ পেরিয়ে, হাড় হিম করা ‘ধর শালা মার শালা’ গর্জন এড়িয়ে, রক্ত-আগুন-চিৎকার-লাঠি-বোমা-বন্দুক-সড়কি-বল্লম-কাতান-চাপাতি-- সব সব পার হয়ে যেতে হবে, যতদূর যাওয়া যায়।শুধু ছুট আর ছুট। এই ছোটায় থামা চলে না।

থেমেছ কি মরেছ।বাঁচানোর কেউ নেই।প্রথমে যাবে ইজ্জত, পরে জান।দুটোই তো মানুষের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে দামি, দরকারিও বটে।এ দুটো না থাকলে আর কী থাকল!এ দুয়ের মায়া থাকে তো থেমো না। ছুট লাগাও।
   শুরুতে তবু ছোটার মধ্যে তবু একটা শৃঙ্খলা ছিলসেটা বোধহয় সন্ধে রাততখন আমরা পরস্পরকে দেখছিলাম, চিনছিলামতখন কতজন ছিলাম? গুনে দেখিনিগোনার মতো মনের অবস্থা ছিল নাতবে যারা ছিল তারা চেনা জানাগাজি পুকুরের পাশে বিশাল শিমুল গাছটার নিচে জড়ো হচ্ছিলাম, একজন দুজন করেসেটা ছিল অন্ধকার জায়গাঅন্ধকারে অন্ধকার হওয়ার সুবিধাকেউ আমাদের দেখবে না, বুঝবেও নাতখনও কেউ আমাদের দেখছিল না সত্যি, চেনার তো কথাই নয়তবু জানতাম এখানে থাকা চলবে না যেতে হবেসোনাডাঙার পাশ গলে ততক্ষণে শুরু  হয়ে গেছে আগুনের নাচন কোঁদনমুখে ধর শালা মার শালা, আজ তোদের কোন বাপ ঠেকায়-- এসব চিৎকারবুঝতে পারছিলাম আর সময় নেইএবার পাড়ি দিতে হবে অজানা পথ ধরেঅন্ধকার সঙ্গে নিয়েসেই গাজি পুকুরের পাশ দিয়ে, উত্তরের বিল ছুঁয়ে, পাটখেত মাড়িয়ে চলেছিআর পিছু পিছু তাড়া করে আসছিল ওই উন্মত্ত চিৎকার সেইসঙ্গে আগুনের নাচুনিতবু সে চলায় একটা ছন্দ ছিল আমরা পরস্পরকে দেখছিলামকথা বলছিলাম খোঁজ নিচ্ছিলামকেউ একটু টাল খেলে হাত বাড়িয়ে ধরছিলামসবাই তো সমান নয় দলে অল্পবয়সি যেমন আছে, তেমন আছে মধ্যবয়সি, আছে সদ্য পোয়াতি থেকে খালাস হওয়া ঘরের বিবি দলে পুরুষ কেউ নেই থাকার কথাও নয়তারা তো আগেই সরে পড়েছিলআমরাই সরিয়ে দিয়েছিলামআমাদের রেহাই মিললেও মিলতে পারে, কিন্তু পুরুষের কোনও রেহাই নেইকল্লা নিয়ে গেণ্ডুয়া খেলবেকিন্তু এও তো সত্যি আমাদের জানের থেকে ইজ্জতের দাম বেশিআমাদেরও সরে যেতে হবেহবেইভেড়িপথে চলা যাবে নাওখানে আগুন হাতে ওরা দাঁড়িয়েআজ ওরা মুক্তকচ্ছকিছুই শুনবে না, মানবেও নামানবে কেন?কাল দেশজুড়ে ভোটদেশের মন্ত্রীসান্ত্রী ঠিক হবেকারা ঠিক করবে? জ্ঞানীগুণী মানুষরা বলেন, দেশের মানুষ ঠিক করবেতাই কি!তা হলে আমাদের গাঁয়ে এত মোটর বাইকের আনাগোনা কেন? আমরা কাকে ভোট দেব না দেব তা নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন? ওরাই নাকি সব ঠিক করে দেবে! তাই যদি হয় তবে আমাদের কী দরকার!অতএব গ্রাম ছেড়ে বেরোও দৌড় লাগাওহ্যাঁ, আজ ওরা অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছে আমাদের তাড়া লাগানোরআমাদের দৌড় করানোরমোটর বাইকের ভটভট আওয়াজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেআপনি বলবেন পুলিশ কী করছে? পুলিশ! হাসালেন মশাই পুলিশই তো ওদের বাইকে চেপে ঘুরছেএই অবাধ ময়দানে আমরা কেউ না, কিছু নাআমাদের যেন ছোটাই ভবিতব্যতাই ছুটছিএখন ওই বাইকওয়ালাদের রাজত্বওদের দেখার কেউ নেই, বলারও নেই বাধাই বা দেবে কে! কে আছে দুনিয়ায় যে ওইসব বুনো হায়নাগুলোকে বলবে, ঠিক নয়, তোমরা ঠিক করছ না!কে বলবে? কেউ নাকেমন যেন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতো ওরা ছুটে বেড়াচ্ছেচোখে দাউদাউ আগুনের লেলিহান শিখাবুকের মধ্যে রক্তের উদগ্র নেশাযাকে পাবে তাকে পাঠাবে জন্মের ওপারেজানি, ওদের সামনে ভালোমন্দ কথা বলে কোনও লাভ নেইএখন ওরা চিনবেও না মা বোন ভাবি বউ দিদি মাসি খালা পিসি ফুফু বলেঅথচ চেনা তো সবাইকতদিন এসেছে আমাদের ঘরেদোরেবসেছেখেয়েছেহেসে হেসে কথাও বলেছেআড্ডা ইয়ার্কি কতকিছুই তো হয়েছে ওদের সঙ্গেএখন সেসব ভাবলে মনে হয় স্বপ্নমনে হয় সেসব কিছুই ঘটেনিওসব আমাদের কথা-কল্পনা-কাহিনিএকটা রং, একটা পতাকা, মনের বিশ্বাস, মুখের কথা-- সবকিছু আলাদা করে দিতে পারেওরা এখন আমাদের চেনে নাজানে নানেশাগ্রস্ত পুরুষের মতো এক-একটা বাড়িতে ঢুকে পড়েছে কারও হাত ধরে, চুল ধরে টেনে টেনে আনছে বাইরেচোখে মুখে পৈশাচিক উল্লাসযেন যুদ্ধ জয় করেছেকাদের উপর? না,এই মেয়েমানুষগুলোর উপরআমরা যেন ওদের জয়ের উপকরণওদের অর্জিত সম্পত্তিঅতএব দেদার ভোগ করোতাই তো করতে চেয়েছিলভেবেছিল আমরা অবলাকোনও বাধাই দিতে পারব নাসেটা কী করে সম্ভব!আমরা কি এতটাই নখদন্তহীন!না, আমরা পারিনি আত্মসমর্পণ করতেলড়াই আমরাও জানি সে লড়াই আরও সাংঘাতিক তার নমুনা ওদের চোখে-মুখে-পেটে-পিঠে দগদগে ঘা হয়ে প্রমাণ দিচ্ছেঅস্ত্র আমাদেরও আছে হাতের নখ আছে, ঘরে দা আছে, বঁটি আছে, কাঁচি আছে, ছুরি আছেছাড়িনি একটাকেওলড়বি!আয় লড়ার স্বাদ জম্মের মতো ঘুচিয়ে দেব, আয়--
   প্রথম চোটে ওরা সেই মার খেয়ে পালিয়েছেতারপর ফিরে এসেছে দ্বিগুণ তিনগুণ হয়েআরও আগুন নিয়ে, হিংসায় উন্মত্ত হয়েকালবোশেখি ঝড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের ঘরদোরের উপর, মানুষজনের উপর এরপর ছোটা ছাড়া আমাদের আর কী করার আছে!
   আমি জানি লেখক মশাই, আপনি আমার আমার ভাষায় লিখতে পারবেন নাআমার যন্ত্রণার্ত অনুভূতি আপনার শব্দে কীভাবে অনুরণন তুলবে জানি নাআপনার ভাষা পরিশীলিতআপনি সেই ভাষায় লিখবেনসেই ভাষায় শোনাবেন বাকি পৃথিবীর লোকজনকেহ্যাঁ, আমি চাই আমাদের যন্ত্রণার কথা সবাই শুনুকতা যে ভাষায় হোক না কেন! সবাই জানুক পৃথিবীতে আমরা একা নই অত্যাচার নিষ্পেষণের কোনও দেশ বিদেশ নেইআর তার শিকার আমরা, মেয়েরা
   আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন আমি এতসব জানলাম কী করে!সেটাই স্বাভাবিক গরিব রাজমিস্ত্রির ঘরের বিবি আমি নসিবনএতসব গভীর জ্ঞানের কথা আমার জানার কথা নয়, বলার তো নয়ইহ্যাঁ, এটা সত্যি আমি গ্রামের মেয়ে আমার বাপ চাষিবাসী মানুষনুন আনতে পান্তা ফুরনো সংসারসেখান থেকে এই রাজমিস্ত্রির ঘরেঅবস্থার বিশেষ কোনও হেরফের হয়নিদুঃখের অন্ধকার বাপের ঘরেও ছিল, এখানেও আছেতবে একটা কথা বলি আমি একেবারে গো মুখ্যু ছিলাম না-ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিলামতারপর যা হয়, ‌মেয়েমানুষের অত বিদ্যের কী দরকার, তো বারমুখো হবে ইত্যাদি প্রভৃতি কথায় আমার গোবেচারা বাপ আর কী করে, সম্বন্ধ ডেকে বিয়ে দিয়ে দিলঘর বদল হলেও লেখাপড়ার ইচ্ছেটা একেবারে মরে যায়নিমিস্ত্রির ঘরে একটু লেখাপড়ার দরকার হয় তবে বলব কাকে! উনি তো মাসের অর্ধেক দিন বাড়িই থাকেন নাকাঁহা কাঁহা মুলুক ছুটছেন কাজের তাড়নায় মাস কলকাতা তো পরের মাস মুর্শিদাবাদ এই করেই কাটছে আমার ঘর-সংসার-জীবনওএই যে এত কাণ্ড ঘটল, আমার উনি এর কিছুই জানেন না উনি এখন আছেন নদিয়ায়মাঝেমধ্যে ফোন করেন মোবাইলেএই একটা জিনিস উনি আমায় এনে দিয়েছেনখবর দেওয়া নেওয়ার আর কোনও সমস্যা নেইবোতাম টিপলেই গলা পাওয়া যায়নিশ্চিন্ত হওয়া যায় বেশএই তো সেদিন কী একটা কথা বললেন, শুনে মনটা বেশ দমে গেলযে অভিনেতার ছবি দেখতে খুব ভালো লাগত, তিনি এমপি হয়ে কী সাংঘাতিক কথাই না বলতে পারলেন!দলের লোকজনকে দিয়ে রেপ করিয়ে দেবেন! কোনও ভিলেনকেও এত কুৎসিত কথা বলতে শুনিনিওঁর কথাগুলো তখন অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল, এখন আর হয় নাএই প্রাণপণ ছোটার সময় মনে হয়, নাহ, কোনও কিছুই অবিশ্বাস্য নয় সবই সম্ভব
   এমন সম্ভব কাণ্ড কত ঘটছে ওই তো ভাঙড় পার হলেই কলকাতার গা ঘেঁসা সেই গ্রামটাসেখানে ফুটফুটে একটা মেয়েকে কী নির্মমভাবেই না ধর্ষণ করল! তাতেও রেহাই নেই মেয়েটার গলা টিপে তো মারলই, তার দু-ঠ্যাঙ চিরে ফেলে দিল খালের জলেতাই নিয়ে কী তোলপাড় কাণ্ড! ওই গ্রামের মহিলারা প্রতিবাদ করেছিল, তাতে ওরা হয়ে গেল উগ্রপন্থীকী দারুণ ব্যাপার!এতবড়ো কাণ্ড ঘটে গেল, অথচ কিছু বলা যাবে নাএমনকী মেয়েটির পরিবারকে টাকাপয়সা চাকরির লোভ দেখিয়ে মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলসেদিন আমাদের গাঁয়ের হাটে মনু ব্যাপারি শুধু বলেছিল, শালা, রাজ্যে ঘুষ দিয়ে রেপকেসও বন্ধ করে দেবে!
   এই কথায় কী কাণ্ডই না ঘটল!মনু ব্যাপারির মাল তো লুঠ হলই, তাকে মেরেধরে হাট থেকে বার করে দেওয়া হলসেদিন আমার উনি ছিলেন ওই হাটে ঘরে এসে বলেছিল, খ্যাপাটে কুত্তাও এমন কাণ্ড করে নাএদের ব্যাপার সাপার যা দেখছি, তাতে যে-কোনও সময় ঘটনা ঘটে যাবে
   ওর কথা কত অভ্রান্ত ছিলঘটনার কোনও নিয়ম কানুন, দিনক্ষণ লাগে নাএকটা স্ফুলিঙ্গর শুধু দরকার হয়আর সেটা পড়তেই শুরু হল দাবানল  
   এখন যতটা সহজে বলতে পারছি, তখন পরিস্থিতি তত সহজ ছিল না সেই আতঙ্ক, সেই সন্ত্রাসের পরিবেশ আমাদের চারপাশে অদ্ভুত বলয় তৈরি করছিলসেখান থেকে বার হওয়া সহজ ছিল নাতখন আমরা -জন ছিলাম?গুনিনিসেই মানসিকতা ছিল না তখন তো একটাই লক্ষ্যপেরোতে হবে সন্ত্রাসের বেড়াজাল, পার হতে হবে আতঙ্কের নদীযে করেই হোক বাঁচতে হবেবাঁচা!কী মিষ্টি একটা শব্দযেন ওটা চাইলেই পাওয়া যায়যেন ওটা একটা লজেঞ্চুসবাবা মা- কাছে আবদার করলাম আর হাতের মধ্যে এসে গেলজানি, ওটা সম্ভব নয় কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করার জন্যই তো আমরা ছুটে চলেছিকোথাও যদি সেই বাঁচার ঠিকানা পাওয়া যায়কেউ যদি বাতলে দিতে পারে
   হ্যাঁ আমি নসিবন আমার বাঁচার কথা শুধু আমি নই, আমার সঙ্গে যারা আছে তারা সকলেআমরা বাঁচতে চাই সেটা কুকুর বিড়ালের মতো নয় মানুষের মতোআমরা মানুষঅতএব মানুষের মতো বাঁচবার অধিকার নিশ্চয়ই আমাদের আছেঅধিকারকী সাংঘাতিক শব্দ! যেন অন্যায় একটা আবদারআমাদের বাঁচা মরা-- কোনওটাই তো আমাদের ইচ্ছাধীন নয়এসব যেন অন্যের খেয়াল খুশিতারাই ঠিক করে দেবে আমরা কীভাবে চলব, বলবনা হলে পরিণতি এই দৌড়এই পলায়নআপনি বলবেন, এসব কথা কাগজের লোকেরা জানে না? টিভির ক্যামেরা জানে না? হাসির কথা মশাই দুনিয়ার -টা খবর ওখানে পৌঁছয়!-জন জানতে পারে!আপনি তো জানেন না, যেই ভোটের বাদ্যি বাজে আর আমাদের কপালে ভাঁজ পড়েজানি আবার ছোটার প্রস্তুতি নিতে হবে
   শুরু তো এভাবেই হয় এবারেও তার ব্যতিক্রম হল নাএবারেও দেখছি রঙের বাহারকোনওটা ফিকে, কোনওটা গাঢ় বিরোধী বলে তো কিছু নেই, তবু নিজেদের মধ্যে আকচা আকচি কি কম! বলে আমি সাচ্চা তুই নকল, আমি আদি, তুই উড়কি এসি জুড়কে বসিছিস, বলে তার উলটোএই নিয়ে ঠেলাঠেলি, মারামারিআর তার দায় পোহাতে হয় আমাদেরওই যে বললাম ভোটের বাদ্যি ওটা বাজলেই বাইক পার্টির দাপট বেড়ে যায়ঘরে ঘরে এসে চোখ মুখ রাঙিয়ে বলে, আমরা যারে বলব ভোট তারে দোবাশুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত হয়ে আমাদের গাঁয়ের বুড়ো মানুষ রহিম শেখ মুখ খিঁচিয়ে বলেছিল, ভোট কারে দোবো তোমগা বলতি হবে? ক্যানে?
   কথা এইটুকুইএতেই আমরা চিহ্নিত হয়ে গেলাম শত্রুপক্ষ, বিরোধী একটা অজুহাতের বোধহয় দরকার ছিল সেটা ঘটল মইন আলি খুন হলেমইন আলি তো ওদেরই লোকতবে তিনি আদি না নব, সাচ্চা না ঝুটা-- সেটা আমাদের কারও জানার কথা নয় কিন্তু আমরা চিহ্নিত হয়ে গেলাম মইন আলির খুনি হিসেবে অতএব ছোটা ছাড়া আর কী করণীয় আছে!

##

......তারপর তো আমরা ছুটছিছুটতে ছুটতে গ্রামের বাইরেসেটা একটা ফাঁকা মাঠলক্ষ্যহীনভাবে ছুটতে ছুটতে এসে এই প্রথম থমকে দাঁড়ালামএরপর কোথায় যাব!কোনদিকে! যেদিকে তাকাই সেদিকেই তো মাঠমধ্যে মধ্যে পাটখেতএতক্ষণে থমকে দাঁড়িয়ে নিজেদের দিকে তাকানোর ফুরসত হলতখনই আবিষ্কার করলাম আমরা আটজনআটজনই মেয়েমানুষছিলাম তো অনেকেইঅন্ধকারে কে কোথায় ছিটকে গেল জানি নাএখন থিতু হতেই আরও একটা আবিষ্কার চমকে দিলআমাদের মধ্যে দুজনের গায়ে কোনও কাপড় নেই পুরো উলঙ্গসেলিনা আর শারমিন কত বয়েস হবে! প্রায় পনেরো আর কুড়িএই উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়েদুটি দেখছি যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে উঠবেএখন না হয় রাত রাত্রির কালো নিজেই এক আবরণকিন্তু আলো ফুটলে কী হবে! তখন কে আড়াল দেবে! কী করেই বা লোভের হাত থেকে বাঁচবে! লোভ তো সর্বত্রউলঙ্গ মেয়েমানুষের শরীর দেখার চোখের অভাব আছে নাকি!এখন এদের কী করে নিয়ে যাব লোকসমাজে!আমরা নিজেরাও কোথায় যাচ্ছি জানি নাআদৌ যাচ্ছি কি? নাকি পিছু হটছি!
   কথাটা পড়তেই অন্ধকার কোণ থেকে কে যেন বলে উঠল, তাতে কী, এভাবে তো ফেলে যাওয়া যাবে না
   কে বলল! কে! ভালো করে তাকিয়ে দেখি সাগর মণ্ডলের বউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে বউ কোথা থেকে এল! তো আমাদের পাড়ার নয়ওরা থাকে চরপাড়ায়আমাদের গ্রামের থেকে একটু দূরে, বিদ্যাধরী খালপাড়েওদের গ্রামেও কি জল্লাদরা গিয়েছে?বাইক নিয়ে তাড়া করেছে?জিজ্ঞেস করতেই কেমন ঝেঁঝে উঠল বউটা, করবে না! ভোট দোব বলিছি না! তাতেই তো বাবুদের ঘুম ছুটে গেছেতাইতে লাঠি গুলি বোমা চলল
   দেখলাম বীরপাড়ার ঝুমরি সর্দার, বিশাখা মাঝি আর লেটুস নামের আধবুড়ি, যে কথাও বলে না বোবা একেবারে-- এরাও আছেগ্রামদেশে থাকলে একটু আধটু মুখচেনা হয়ইসেই সূত্রে কেউই অচেনা নয়তবে অন্তরঙ্গতা বলতে যা বোঝায় তেমন কেউই নয়তারপরে  আমরা ভিনধর্মের মানুষ যারা পাশাপাশিও থাকতাম নাএকটু আধটু মুখ বেঁকাবেঁকি কি ছিল না?আমাদের সব ভালো আর ওদেরটা খারাপ-- এমন কথা কি চালাচালি হত না? হতএদিক ওদিক সবদিকেই হতসেইসব মানুষেরা কোন মন্ত্রবলে আজ একসঙ্গে পাশাপাশি, ঘেঁসাঘেঁসি এতক্ষণ ছুটে এলাম!ভারি মজা তো!তা হলে বলতে হয় বিপদ কোনও ধর্ম মানে না, সম্প্রদায় মানে না, জাত বেজাত মানে না সবাইকে এক দাঁড়িপাল্লায় ওজন করেসবার পিছনেই হা রে রে করে তাড়া করে আসে!আর সব থেকে মুশকিল তো আমাদের, মানে এই মেয়েমানুষদেরআমাদের ইজ্জতের উপর হামলাটা যেন বিরাট পৌরুষের উদাহরণ
   এই তো গেল পঞ্চায়েত ভোটের সময় সেদিনও আমাদের এমন ছুটতে হয়েছিল বনবাদাড় ভেঙেপিছু পিছু তাড়া করে আসছিল মোটর বাইক, ধর শালি মার শালি চিৎকারসেইসময় সবেরা, ভরা পোয়াতি মেয়েটা, আর পারছিল নাউপায় না পেয়ে নুরু গাজির গোয়াল ঘরে সেঁধোতে হয়েছিলবাইরে বাইকের ভটভট আর ভিতরে জন্মের আকুতি শব্দ করলেই টের পেয়ে যাবেতাই বাধ্য হয়ে মা আর বাচ্চার মুখ চেপে ধরতে হয়েছিলমা তবু জোয়ান বয়সি, ধকল সামলাতে পেরেছিল কিন্তু বাচ্চাটা পারেনিসরব দুনিয়ায় নীরবতার লাথি মেরে চলে গিয়েছিল চিরতরে
   সেই সবেরা বসে আছে আলের ধারেআগে খুব কাঁদত, এখন আর কাঁদে নাচুপচাপ হয়ে গেছে সেআমি ওর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বলল, এবার কোনদিকে?
   এটা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন কথাটা সবার মনেই আছে, কিন্তু উত্তর জানা নেইআমি চুপ করে থাকলামসবেরা আবার বলল, কোনদিকে যাবি কিচু ভেবিছিস?
   মাথা নেড়ে জানালাম, না ভাবিনি
   সবেরা নিজের মনে হেসে উঠল, কোনও দিক নেই তবু আমরা পাগলপারা ছুটতিছি!হায় রে--
   আমার কেমন রাগ হল আমি যেন ওদের আসতে বলেছি পিছু পিছু! তোরা যা না যেদিকে খুশিকিন্তু বলা গেল নাদেখলাম সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেযেন আমি মানে সমাধানআমি যেন পথের সন্ধান জানিহাসি পেলপথ চলতে যেমন সঙ্গীর দরকার হয় তেমনই দরকার একটা দিশার, যে পথ দেখাবে ওরা কি আমাকে তাই ভাবছে নাকি!হায় রে কপাল! আমি নিজেই হাতড়ে বেড়াচ্ছি এই অন্ধকারেসত্যিই তো কোথায় যাব!কোথায় আছে আমাদের সুস্থ সুন্দর জীবনের ঠিকানা!সবখানেই তো খিকখিক করে হাসছে ওই হায়নাগুলোযে প্রশ্নের উত্তর জানি না সেটাই যখন ঘিরে ধরছে তখন কেমন উত্তেজিত হয়ে গেলাম ঝেঁঝে বললাম, সেসব পরে হবেখন, আগে এই ন্যাংটো মেয়েদুটোর কী বেবস্থা করা যায় বলদিনি?এদের তো শ্যাল শকুনে ছিঁড়ে খাবে
   আমার কথা শেষ হয়নি, সাগর মণ্ডলের বউ নিজের পরনের শাড়ি ফ্যাস করে ছিঁড়ে ফেললনিজের মনে বলল, আমরা হচ্ছি তিন বিয়োন বউ, আঙগা আর ঢাকাঢুকির কী দরকার! এই শাড়ি লুঙ্গির পারা বুকপিঠ ঢেকে জইড়ে নে ভালো করে
   বলে শাড়ির অর্ধেকটা ছিঁড়ে শারমিনের দিকে ছুঁড়ে দিলওর দেখাদেখি আরও একবার ফ্যাস করে শব্দ উঠলএবার ঝুমরি সর্দার বলল, মেয়ামানুষ ক্যানো যে জন্মায় কে জানে!তার বুক ঠেলে ওঠপে,পাছা ভারী হবে, আর তাই নে হামলে পড়বে সবাই--বলতে বলতে তারও শাড়ির অর্ধেকটা উড়ে গিয়ে পড়ল সেলিনার উপরঝুমরি মুখ খিঁচিয়ে বলল, নে ঢাক ভালো করে
   অন্ধকার কোণ থেকে বিশাখা মাঝি বলে উঠল, আরে কী বলিস তুই! ওই যারা ঝাঁপাতি আসে তদের জম্মো দেওয়ার নেগে, বড়ো করার নেগে, মানুষ করার নেগে এসব দরকার হয়ওই জানোয়ারগুলোর জন্ম তো আদাড় বাদাড় থে হয়নি, এই শরীল থে হইছেএই বুকের দুধ খেয়ে তবেই বেড়কে উঠিছে
   সবেরা বলল, ওরা যেদি আঙগা শরীল থে নেমকে আসে তবে ওদের অ্যাত ডর কীয়ের নেগে!
   অন্ধকারে খস খস শব্দ হচ্ছেদেখলাম চার মেয়েমানুষ লুঙ্গির মতো বুকপিঠ ঢেকে নিয়েছে দেখাচ্ছে অদ্ভুতকিন্তু এখন এই নিয়ে কেউ কোনও কথা বলল নাসবাই ভাবছে সামনে কী আছে? কী হবে দিনের আলোয়?কোথায় যাব আমরা?যেখানেই যাই না কেন, বাঁচতে কি পারব? সবেরার কথা শুনে একটু চমকে উঠলামওর কথা বরাবরই বাঁকাসোজা কথা যেন বলতেই জানে নাতবে দেখলাম ওর কথার কেউ কোনও জবাব দিচ্ছে নাসবাই কেমন চুপচাপতাই বুঝি সবেরা আবার বলে উঠল, কথাটা ভেবকে দ্যাখ
   আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, ভেবকে আর কী করব!বেইরে য্যাখন পড়েছি ত্যাখন কোথাও একটা যেতি হবে
   কোথায় যাবি!যেখানে যাবি সেখানে কি বাঁচবি?
   সাগর মণ্ডলের বউ বলল, বাঁচব না য্যাখন, মরতি তো পারব
   তা এই বীরত্বটা আঙগা গাঁয়ে গে দেখালি হত না!
   এই সময় শারমিন বলে উঠল, আমি একটা কথা বলব!
   আমি প্রায় খিঁচিয়ে বললাম, তোর আবার কী কথা!ছোটো মানুষ তুই
   বিশাখা বলল, আহা বলুক না আমরা সবাই এখন এক ঠেঁয়ে আছি, বাঁচলি বাঁচপ, মরলি মরব
   আমরা চুপ করে গেলাম একটু পরে শারমিন বলল, ওরা তো চাইছিল আমরা গাঁ খালি করে পেলকে যাইএটা তো ওদের জিত
   ঝুমরি সর্দার মুখ ঝামরে বলে উঠল, ঠিক বলিছিসআসলে ওরা ভয় পেইছেতাই তো গাঁ খালি করে দেছে
   সবেরা বলল, তা আমরা যদি ঘুরকে দাঁড়াতি পারি, পারবে ওরা ঠেকাতি!
   আমি প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, কী বলিস তুই!আঙগা পেলি ওরা ছিঁড়কে খাবেবুঝতি পারতিছিস নে!
   শারমিন বলল, পারছি তো, পেরি কী করব! তোমরা আমারে একটা জাগা দেখাওদিনি যেখানে মান ইজ্জত নে বাঁচতি পারব!দেখাও--
   এই মান ইজ্জত ব্যাপারটা কী বলদিনি!এটা কোথাকে থাকে?সবেরা বলে উঠলতার গলায় কেমন ব্যঙ্গের সুর, এই যে শরীল, এখানেই কি ইজ্জত? এই যে বুক, পাছা, এই যে জম্মোদ্বার-- এখানে ইজ্জত? শালার ইজ্জতটা কোনহানে লুক্যে আচে বলদিনি?
   সবেরার কথার তোড়ে থুতু আসছিল পিক পিক করে ছিটকে পড়ছিল চারপাশেআমার কেমন হাসি পেয়ে গেল সবেরার কথায় বললাম, ক্যানে, কী করবি?
   সবেরা বলল, তবে তারে আচ্ছা করে পিটকে দেতাম
   এই সময় সেলিনা বলল, আঙগা ইস্কুলির মাস্টার বলে, ইজ্জত আসলে সম্মানযাদের মাথা উঁচু তারাই ইজ্জতদার
   সবেরা বলল, তবে শালা মাথাই যদি কাটা গেল তবে শরীলের কী দাম! তো এমনিতেই যাবেবলতে বলতে সবেরা উঠে দাঁড়ায়সবার দিকে আঙুল তুলে বলে, ডর নাগতেছে!ডরটা কীয়ের!শরীলডা বাঁচলিই কি বাঁচা নাকি!ইজ্জত নে যেদি বাঁচতি হয় তবে শরীলের কতা ভাবলি চলবে না তো এমনিও যাবে অমনিও যাবেতবে বুঝকে দেব না ক্যানে মেয়ামানুষ হলিও আঙগা ইজ্জত আচেচল, ফিরকে যাইলড়তি হয় ওহানে লড়ব, মরতি হয় ওহানে মরব
   আমি চমকে উঠলাম বললাম, কী বলিস, হেই সবেরা?
   হক কতা বলতিছিওরা আমারে খাবে! খাক না কতজন আসপে!চারজনা পাঁচজনা! আসুকছিঁড়ুকমেয়ামানুষ দুর্বল ভেবকে যা খুশি করবে! অত সোজা! কতা দিচ্চি একটারেও ফিরতি দোব না মেয়ামানুষ চাইলি কী না করতি পারে!আমরা য্যামন ভালোবাসতি পারি, ত্যামন ঝাড়েবংশে নিকেশও করতি পারিআয়দিনি, আর দিক করিস নে
   আমি না বলে পারলাম না, আরে এতটা পথ ভেঙি এসি এখন এইসব বলতিচিস--!
   সবেরা বলল, আরে ভাবতিছি তো অনেকখন ধরে পথ খুঁজতি খুঁজতিই তো হেদিয়ে মরলাম পথ কি সহজে পাওয়া যায় নাকি!আর সেটা য্যাখন পেইচি বসে থাকপ ক্যানে!চল ঘরকে ফিরি, ওটাই আঙগা জাগা
   বলতে বলতে সবেরা এগিয়ে যায় একা পুব আকাশ সামান্য আলোর ছিটে পাখি ডাকছে কেমন মায়াবী সুরে সবেরা একবারও পিছন না ফিরে এগিয়ে চলল কে গেল না গেল ওর যেন কোনও ভ্রূক্ষেপ নেইআমরা সাতজন ওর দিকে তাকাই কী করব বুঝতে পারছি না মা, ওই দ্যাখো, বোবা বুড়ি লেটুস হঠাৎ দৌড়তে শুরু করল সবেরার পিছু পিছু ওর দেখাদেখি ঝুমরু সর্দারবাকিরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে বোধহয় আমার অনুমতি চাইছে আমি কী বলব বুঝতে পারছি না সত্যিই তো আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি কিছুই তো জানি না দিশাহীন সেই যাত্রার থেকে সবেরার দেখানো পথে গিয়ে দেখিই না কী হয়!
   মাথা নেড়ে বললাম, চল যাই--
  
    


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ