বাংলাদেশের সিরিয়াস ধারার গল্প : খণ্ডিত পাঠ

শিমুল মাহমুদ

গল্প বলা এবং শোনা মানুষের চিরন্তন ও সর্বাপেক্ষা আদিম মানস তাড়না। কোনোরকম গবেষণা ছাড়াই বলা সম্ভব, সভ্যতার উৎসলগ্নে পৌরাণিক গল্পের মৌখিক অবকাঠামো, রূপকথা অথবা ফোক-বিলিভের ভেতর গল্পের উৎস অনুসন্ধান করা অবশ্যই যৌক্তিক। এর পর আসে গল্পের বিকাশ ও আঙ্গিক বিবেচনার প্রশ্ন। প্রকৃত প্রস্তাবে মানবচেতনায় উদ্ভাসিত অভিজ্ঞতা প্রকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে যে মানব-ভাষার প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল সেই প্রাথমিক আদিম ভাষার ভেতরই লুকিয়ে ছিল গল্প বলার প্রেরণা।
এই প্রেরণালব্ধ জীবনযাপনের গল্প আমাদের হাতে এসে পৌঁছানো যৌক্তিক না হলেও সভ্যতা আরও খানিকটা অগ্রসর হলে আমরা উদাহরণ হিসেবে আমাদের হাতে অনেক গল্পই পেয়েছি এবং আমাদের মনে রাখতে হবে প্রাপ্ত উদাহরণের বাইরেও প্রতিটি জাতি অথবা মানবগোষ্ঠীরই রয়েছে হাজার রকমের লোকজ গল্প, যা অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মকথার মর্যাদায় বিবর্তিত হয় অথবা হয়ে ওঠে মিথ।

এ পর্যন্ত ছোটগল্পের উৎস বিবেচনায় পাওয়া যায় ইজিপসিয়ানদের The Tale of khafri, The Tale of Ahuri; ভারতীয়দের Tobit, Susanna and the Elders, Bel and the Dragon; হিব্রু সাহিত্যে Tobit, Susanna and the Elders, Bel and the Dragon; চাইনিজদের The Peach-Blossom Fountain, The Lute-Girl`s Lament; কেলটিকদের The Fate of Deirdre, The Dream of Maxen Wledig, Queen Guenever`s Maying; মিডিয়াভেল ফ্রান্সে পাওয়া যায় The Tale of king Coustans the Emperor, Aucassin and Nicolette; মিডিয়াভেল ইতালিয়ান Tales from the Gesta Romanorum; এর বাইরে রয়েছে ক্লাসিক্যাল, রয়েছে স্ক্যানডিনেভিয়ানদের গল্প, অ্যারাবিয়ানদের গল্প, পারসিয়ানদের প্রভৃতি ছাড়াও যিশু খ্রিস্টের বিষয়টিও স্মরণে আনতে হবে। কেননা জেসাস ক্রাইস্ট নামে আদৌ কেউ ছিলেন কিনা, নাকি প্রাচীন গল্পের উপকরণ হিসাবে গল্প পরম্পরায় ধর্মের প্রায়োগিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিষয়টি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তা পুনঃগবেষণার অবকাশ রাখে। কেন-না :

“জেসাসের গল্প বলেছেন শুধু সুসমাচার লেখকেরা, সে সময়ের আর কেউ বলেননি। প্রথম শতকে রোম সাম্রাজ্যে অন্তত ষাটজন ঐতিহাসিক লিখছিলেন ইতিহাস, তাঁরা কেউ জেসাসের কথা লেখেননি। জেসাস ঐতিহাসিক ব্যক্তি হলে তাঁদের কেউ না কেউ জেসাসের উল্লেখ করতেন; কিন্তু উল্লেখ করেননি, কেননা তাঁরা ইতিহাস লিখছিলেন, কিংবদন্তি তৈরী করছিলেন না। এখন এটা স্বীকৃত যে সুসমাচারগুলো, - মথি, মার্ক, লুক, যোহন - যেগুলো ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে খ্রিস্টধর্ম - জেসাসের শিষ্যদের লেখা নয়; সুসমাচার প্রণেতারা জেসাসকে দেখেননি। সুসমাচারগুলো লেখা হয়েছিলো জেসাসের কথিত ক্রুশকাঠে প্রাণ দেয়ার চল্লিশ থেকে আশি বছর পরে, লিখেছিলেন নামপরিচয়হীন লেখকেরা। এগুলোর মধ্যে মথি, মার্ক, লুকের বিষয় একই; ভাষাও অনেকটা এক। সম্ভবত মার্কই সবচেয়ে পুরোনো, আর অন্যগুলো এটির নকল। তাই এগুলিতে যে কাহিনী ও কথা আছে, তা কোনো বাস্তব মানুষের নয়। ঐতিহাসিক বই নয় এগুলো; এগুলো সুসমাচার প্রণেতাদের বিশ্বাস অনুসারে লেখা জেসাসপুরাণ”। (হুমায়ুন আজাদ, আমার অবিশ্বাস : ১৯৯৭)

একইভাবে পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ মিথ-পুরাণ থেকে শুরু করে লোকজ উপাদানের ভেতর ছোটগল্পের উৎস খুঁজে বের করা সম্ভব। এবং মনে রাখতে হবে এই গল্পগুলো একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আটকে না থেকে বিবর্তন পরম্পরায় বিকশিত হয়েছে। এই বিবর্তন পরম্পরার সূত্র ধরেই একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় কাহিনি আরেকটি ধর্মে ঢুকে পড়েছে। যেমন, ইসলাম ধর্মের অধিকাংশ কাহিনিই খ্রিস্টান ধর্মে বর্তমান; সেই সাথে পাওয়া যাবে ইহুদি ধর্মে। উদাহরণ হিসাবে আদম-হাওয়ার আদি গল্পটির উপস্থিতি তিনটি ধর্মেই রয়েছে। একইভাবে হিব্রু ভাষার আদি গল্পে পাওয়া যায় আব্রাহাম কর্তৃক নিজ পুত্র ইসমায়েলকে বলি দেবার কাহিনি; যা কিনা ইসলামে এসে অলৌকিক মর্যাদা বা বিধাতার বাণীতে রুপান্তরিত হয়েছে। অধিকাংশ ধর্ম গ্রন্থেই পশুবলি যজ্ঞের কাহিনিগুলোর উৎস মানব প্রজাতির পশুচারী জীবনকে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে। এভাবে ভাবলে দেখা যাবে মানব সভ্যতায় ছোটগল্পের উৎস মানব জাতির ধর্মীয় গ্রন্থসমূহের ভেতরই লুকিয়ে রয়েছে; লুকিয়ে রয়েছে মিথের ভেতর ও লোককাহিনির ভেতর।

সুতরাং শুধু সাহিত্য বিবেচনায় নয় বরং ছোটগল্পের উৎস অনুসন্ধানে আমরা পেতে পারি মানব সভ্যতা বিকাশের পেছনে বিধাতা, দেব-দেবী, সৃষ্টিকর্তা, ভগবান, তানরি, আল্লাহ, বিবিধ বিশ্বাসজ্ঞাপক অলৌকিক ধারণা ও টোটেম বিশ্বাসের ধারাবাহিক প্রভাবের কার্যকারণসমূহ।

(কিছুদিন আগেও অর্থাৎ ১৯৫০ সালের আগে তুরস্কে কেউ ‘আল্লাহ’ শব্দটি উচ্চারণ করতেন না; বরং তুর্কি ভাষায় বলতেন ‘তানরি’; ‘আল্লাহ আকবর’ না বলে এর পরিবর্তে বলতেন ‘তানরি উলমুদ’ এবং কুরআন শরিফ তুর্কি ভাষায় পাঠ করা হতো।)

So he becomes the medicine-man or witch-doctor of his tribe. From the white frozen wastes around the pole, where the Eskimo ranges, to the hot, steaming forests of the Congo, where the pigmy moves like a shadow through the bush, the magical art of the short story flourishes. And alongside this development of superstition, the kindly play of humorous fancy and interest in the character of one`s neighbours goes on. The common people, dragooned and oppressed and terrified by their chiefs, elders, and witch-doctors, turn for relief to the short story, and weave around their camp-fires amusing and satirical anecdotes about some humble creature of the wilds who triumphs over all his powerful enemies.3


সুতরাং আমরা পেয়ে যাই তুখোড় ব্রিলিয়ান্ড পশু-পাখি বিষয়ক গল্পের সিরিজ; যা কিনা আমাদের ব্যবহারিক জীবনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। শেয়ালের গল্প, ইঁদুরের গল্প অথবা অন্যান্য ছোট ছোট পশু পাখিকে আশ্রয় করে তৈরী হয়েছে যেমন সারস ও বাঘ, কাছিম ও খরগোস অথবা টুনটুনি পাখির গল্প। একইভাবে আমেরিকার নিগ্রোদের লোককথাগুলো ছোটগল্পের আদি রূপকল্পের এক শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।


সম্ভবত ছয় হাজার আটশ বছর আগে মিশরের সম্রাট ছিলেন খুফু; যে কিনা ছিল এক মহান পিরামিড নির্মাতা। তাঁর দরবারের প্রথা অনুসারে প্রতিদিন তাঁর পুত্রদেরকে প্রাচীন ইন্দ্রজাল সম্পর্কিত একটি করে গল্প বলতে হতো। এক্ষেত্রে খুফুর জেষ্ঠ পুত্র খাফ্রি যে গল্পটি বলেছিলো তা সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীন গল্পগুলোর মধ্যে একটি। এবং সম্ভবত ৩৪৫৯ খ্রিস্টপূর্বে শ্রুতিশাস্ত্রের সাহায্যে খাফ্রির গল্পগুলো প্রথমবারের মত লিপিবদ্ধ হয়েছিল।

(Edited by J.A. Hammerton, The Masterpiece Library of short stories-Voll-1,ÔÔThe Early storie-Tellers’’, (London : The Educational Book Company Limited), P., 2-3.

Thus the modern short-story writer can claim one of the most ancient kings in the world as the father of his art, One who lived long before Homer or any known poet.)

সে যাই হোক না কেন, এখন আমাদের প্রশ্ন সভ্যতার আদিলগ্নে যাত্রা শুরু করে গল্প আজ কোথায় পৌঁছিছে? এ কথা ঠিক যে বাংলা ভাষায় গল্প নিয়ে রয়েছে অজস্র অনুসন্ধান, মত ও রুচি; রয়েছে নানা ক্যাটাগরির পাঠক। এক্ষেত্রে শিল্পের মানদণ্ড বিতর্কিত বিষয় হলেও আমরা আমাদের সিরিয়াস ধারার গল্পের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে সীমিত ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করতে পারি। এক্ষেত্রে শুরুতেই কায়েস আহমেদের গল্প আমাদেরকে খানিকটা ধাক্কা দিলেও আমরা ঠিক ততটা হোচট খাইনি; অথবা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর গল্পের ভেতর উপন্যাসের ব্যপ্তি প্রকাশ করার চেষ্টা করলেও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন খানিকটা; কেন-না তিনি উপন্যাস লিখতে বসেননি লিখতে বসেছেন গল্প। এর পর যখন তিনি উপন্যাস লিখলেন তখন বোঝা গেল, বাংলা সাহিত্যে ইলিয়াসের জন্মই হয়েছিলো উপন্যাস লেখার জন্য; এমন উপন্যাস, যা এর আগে বাংলা ভাষায় আর কেউ লেখার স্পর্ধা দেখাননি।

এই স্পর্ধার সাথে সহমত প্রকাশ করে ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও বলা সম্ভব, ছোটগল্পে এসে এই স্পর্ধা থেমে থাকেনি। ফলে হাসান আজিজুল হক রাঢ় অঞ্চলের তারাশঙ্করের বিস্তারিত বর্ণনাকৌশল থেকে নিজেকে সাবধানে সরিয়ে নিয়ে এনে কাহিনি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রকাশযোগ্য গল্পকে রাখলেন আড়ালে। তিনি যা বলতে চান, পাঠককে তা চোখে আঙুল দিয়ে না দেখিয়ে সেই দেখার দায়িত্বটা তিনি পাঠকের ওপর ছেড়ে দেন আর নিয়ন্ত্রণ-সুতোটা রাখেন নিজের হাতে। ফলে আমরা বুঝতে পারি না রাতের আবছায়া অন্ধকারে উদ্দেশ্যহীন কিশোরেরা কেনই-বা শকুনের পেছনে ছুটতে থাকে আর শেষ পর্যন্ত যে মেসেজ পাঠকের মগজে হাসান প্রবেশ করিয়ে ছাড়েন তার জন্য পাঠক মোটেও প্রস্তুত থাকেন না। আমরা উপলব্ধি করি এবং দিব্যচোখে দেখতে পাই, দ্বি-জাতিতত্ত্বের তকমায় নিজের মা-মাটি নিজের কাছে হয়ে উঠেছে অবৈধ; অবৈধ শিশুর শরীর খুবলে খাচ্ছে শকুনেরা। সহসাই এই ‘শকুন’ সমাজ-রাজনীতির পাশাপাশি মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা যাবতীয় অপশক্তির প্রতীক রূপে প্রকাশ পায়। এভাবে হাসান আজিজুল হকের হাতে এসে ‘ভাষা-প্রতীক’ হয়ে ওঠে গোষ্ঠীচেতনার বাহন। ফলে সেই প্রতীকের ভেতর থেকে একে একে প্রকাশ পায় আপাত সত্য, অতিবাস্তব জগত। আমরা জানি, আপাত বাস্তবতার মুখোশে প্রকাশিত সত্যের আড়ালে ক্রিয়াশীল থাকে কার্যকারণসূত্র। কোনো ঘটনার পেছনের কারণ মোটেও সুনির্দিষ্ট কোনো ঘটনার ভেতর আটকে থাকে না বরং সেই ঘটনার পেছনে সংযুক্ত থাকে চেইন অব কমান্ডের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘঘটনাপ্রবাহ আর পারিপার্শ্বিক অনুষঙ্গসমূহ। হাসান আজিজুল হকের গল্পের ‘ভাষা-প্রতীক’ পাঠকের চোখকে সেই ধারাবাহিক অনুন্মোচিত কার্যকারণের দিকে দৃষ্টি রাখবার ব্যবস্থা করে দেয়। ফলে হাসানের গল্পে ‘প্রতীক’ শুধুমাত্র শাব্দিক অর্থের ভেতর সীমাবদ্ধ না থেকে বহুমাত্রিক অর্থপ্রকাশজ্ঞাপক মাত্রায় উন্নীত হয়। তারাশঙ্করের ক্ষমতা এই জাগায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছিলো; তিনি ভাষার এই জায়গাটি কখনও আবিষ্কার করতে সক্ষম হননি। চেষ্টা করেছিলেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র, কিন্তু গোষ্ঠী অপেক্ষা ব্যক্তিকে প্রধান করে দেখার কারণে প্রতীকের সীমানা বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি।

যাই হোক, সাম্প্রতিক বাংলা ছোটগল্পে নিরীক্ষা চলমান। তবে সবার লেখায় অবশ্যই নয়; বরং অধিকাংশ গল্পকারগণ বাংলা ছোটগল্পের ভাষা কেন কীভাবে কী প্রয়োজনে পাল্টে গিয়েছে তা অনুসন্ধান করার প্রয়োজন বোধ করেন না; অথচ বিষয়টি সৃজনশীলতার প্রশ্নে অনিবার্য। ছোটগল্পের প্রতিষ্ঠিত ফরমুলা অনুসারে যারা গল্প লিখতে আসেন তাদের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতার প্রশ্নটি অবান্তর। অথচ সব যুগেই দেখা যায় অধিকাংশই আগে-ভাগে জেনে শুনে প্রস্তুতি নিয়ে গল্পের ফরমুলা অনুসারে গল্প লেখার জন্যই গল্প লিখেতে বসেন। সেখানে ব্যক্তি-মানুষ, মানব-পরিবার, রাষ্ট্র, ঐতিহ্য-বিশ্বাস-ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মানবচেতনার সাথে ব্যক্তিমানুষ ও গোষ্ঠীমানুষের দ্বন্দ্বটি ঠিক কোথায় আর তা কীভাবে ভাষায় প্রতিফলিত করা সম্ভব এত কিছুর জন্য নিজেদের ঠিক দায়বদ্ধ মনে করেন না তারা। মনে করলে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক অথবা সৈয়দ শামসুল হকের পর হুমায়ূন আহমদই হতেন টার্নিং মোমেন্টের লেখক। কিন্তু সে ধৈর্য তাঁর ছিলো না; জনপ্রিয়তা ছিলো তাঁর লেখার মানদণ্ড। সে অর্থে শহীদুল জহির অথবা হুমায়ূন মালিক মোটেও জনপ্রিয় লেখক নন। তাঁদের নাম যে কজন জানেন সে কজনের মধ্যে দশ ভাগও তাঁদের গল্প-উপন্যাসের সাথে পরিচিত কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ আছে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন? কেন এই ধারার গল্পকারগণ পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছেন না? কিন্তু এই জিজ্ঞাসার পাশাপাশি আমাদের এও মনে রাখতে হবে, এই পাঠকপ্রিয়তা না পাওয়ার ভেতরই লুকিয়ে আছে বাংলা ভাষায় সিরিয়াস ধারায় যে গল্প সৃষ্টি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে সেই লেখাগুলোর নান্দনিক মর্যাদা। আমরা জানি সংখ্যা গরিষ্ঠ পাঠক কোনো কালেই সমকাল থেকে এগিয়ে থাকা শিল্প-সাহিত্যের সমান্তরালে পথ চলতে পারেনি। জীবনানন্দের সময় তাঁর কবিতা পাঠ করে রস আস্বাদনের মত লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। আমরা এখনও কমলকুমার মজুমদারের লেখার সাথে পরিচিত নই। অথচ ইনারা অনেক আগেই গত হয়েছেন; তাই বলে কি তাঁরা জনপ্রিয়তা পাবেন না? না পাবেন না। কেন-না চূড়ান্ত অর্থে জীবনদর্শনের এতটা গভীরে অনুপ্রবেশের জন্য অধিকাংশ পাঠক দায়বদ্ধ নন, প্রস্তুত নন অথবা বাধ্য নন। রাগসঙ্গীত শোনার জন্য দর্শক সিনেমা হলে অথবা টিভির পর্দার সামনে বসেন না। যিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনার জন্য জায়গা খোঁজেন তিনি জেনে বুঝেই তা অনুসন্ধান করেন; তার সাথে অধিকাংশই থাকেন না। তাই বলে কি রাগ-সঙ্গীতকে খারিজ করে দেয়া সম্ভব? এখানে কি সংখ্যা গরিষ্ঠতার প্রশ্ন ওঠে? চূড়ান্ত অর্থে শিল্পের বিষয়টা এমনই। এতে হতাশ হবার কিছু নেই। যিনি হালকা রিক্রিয়েশনের জন্য গল্প পাঠ করবেন তাদের জন্য লেখক সংখ্যা অনেক বেশি; বেশি প্রকাশক সংখ্যা। ফলে সংগত কারণেই শহীদুল জহির অথবা হুমায়ূন মালিকের মত গল্পকারদের গল্প হাতের নাগালে না থাকলেও অবাক হবার কিছু নেই।

যেহেতু হালকা লেখার লেখকসংখ্যা ও পাঠকসংখ্যা বেশি সেহেতু সিরিয়াস ধারার গল্পের প্রসঙ্গ উঠলে সংগত কারণেই এই সময়ের গল্প নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার মতো প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। কেউ বলছেন গল্পের জন্য বিগত দশকের কাঠামোই পাঠকপ্রিয়তার জন্য লাগসই ফরমুলা; এর সাথে শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের একরৈখিকতা থাকলে চলবে না অথবা একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ফোকাস রেখে অগ্রসর হলেই যথেষ্ট নয় বরং এর সাথে থাকতে হবে Informing idea আবার কারো মতে Unity of impression; অথবা analisis of situation -র বিকাশ। আসলে একজন প্রতিভাবান লেখক এত আটঘাট বেঁধে লিখতে হয়তো আসেন না; অবশ্য হুমায়ূন মালিকের গল্প পাঠে কখনো এমন মনে হতে পারে যে, তিনি বুঝে শুনে আটঘাট বেঁধেই গল্প লিখতে এসেছেন; কিন্তু শহীদুল জহির উদ্দেশ্যহীনভাবেই লিখতে লিখতে শেষ পর্যন্ত একটা গোষ্ঠীগত মানবজীবনের ভগ্নাংশ উপস্থাপন করে বসেন এবং তিনি পাঠকদের সহানুভূতি আদায়ের জন্য যতটা নয় তার চেয়ে বেশি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য লেখার আঙ্গিকে বিরক্তির সমাবেশ ঘটান; অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবে না হলেও ওটাই তাঁর লেখার ধরন; এর থেকে তিনি বের হতে পারেন না। এ কারণেই হয়তো তিনি পাঠকের কাছ থেকে অধিক পরিশ্রম ও মনোযোগ দাবি করেন। তিনি ষ্পষ্ট করেই বলেন:

“সনাতন ধারায় যদি আমি লিখতাম তাহলে আমার ভাষা বা পদ্ধতি নিয়ে এত উচ্চকিত কথাবার্তা হতো না- কারণ ওই ধারার সঙ্গে পাঠক সমালোচকরা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। [...] কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য আমি পাঠকদের বিভ্রান্তও করতে চাই, তবে বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্য সেটা করি না। দুটো কারণে সেটা করি। প্রথমত, আমার বিষয়টি যেন বেশি উচ্চকিত হয়ে না ওঠে। দ্বিতীয়ত, আমি পাঠকদের কাছ থেকে অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করি। আমি অনেক ডিমান্ডিং, আমার লেখা পাঠকদের কাছে অনেক বেশি ডিমান্ড করে”।

(মোহাম্মদ আবদুর রশীদ সম্পা., শহীদুল জহির স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : পাঠক সমাবেশ, ২০১০, পৃ., ৫৯০ : আমার অনেক লেখায় আমি ঘোর তৈরি করে তার ভেতরে মূল বিষয়টা ছেড়ে দিয়েছি। যেমন ধরেন, ‘আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস’ বা ‘ডুমুরখেকো মানুষ’-এর মতো গল্পে অনেক বড় একটা আবর্ত তৈরি করে তার মধ্যে আরেকটি গল্প ডুবিয়ে দেওয়া আছে। আমি চাই পাঠকরা সেই গল্পটিকে, সেই বিষয়টিকে খুঁজে নিক। হ্যাঁ, এগুলো ইচ্ছেকৃত। কিন্তু সেটা পাঠকদের দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য নয়, বরং পাঠকদের কাছ থেকে অনেক বেশি ডিমান্ড করার জন্য, অনেকটা মনোযোগ কামনা করার জন্য, আর যে গল্পটা ডুবিয়ে রাখা হয়েছে সেই গল্পটাকে উচ্চকিত করে না ফেলার জন্য, যাতে সেটা চোখে পড়ার মতো না হয়, সেটা যেন সাহিত্যের সীমা - মানে আমি যাকে সাহিত্যের সীমা মনে করি, এটা বিতর্কিত বিষয় মনে হতে পারে- সেই সীমার মধ্যে থাকে, এইসব চিন্তা থেকে এটা হয়। আমি আসলে কোনোকিছুকে উচ্চকিত করে তুলি না, একটা ঘোরের মধ্যে মিশিয়ে তাকে উপস্থাপন করি।)

হ্যাঁ ডিমান্ড তিনি আশা করতেই পারেন; পাঠক সে ডিমান্ড মেটাতে প্রস্তুত না থকলেও তিনি তা আশা করেন; ফলে তাঁর পাঠক হয়ে ওঠে সীমিত এবং নির্দিষ্ট; যেমনটি ঘটতে দেখা যায় হুমায়ূন মালিকের ক্ষেত্রে। তাঁর ‘স্বপ্নভূমে আগ্রাসন’ এর মানুষগুলোকে বুঝতে হলে দৈনন্দিন সমাজের ভেতর লুকিয়ে থাকা বিবিধ কৌশল, সমাজে প্রতারকদের চাহিদা ও জনপ্রিয়তার কারণ, অথবা গল্পমধ্যে উচ্চকিত হয়ে ওঠা ‘স্বপ্নের’ প্রতীকী তাৎপর্য আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলে পাঠক বিরক্ত হবেন এ ধরনের গল্প পাঠে। কিন্তু আমরা জানি জমাট বরফের নিচেই রয়েছে পিপাসা নিবারণকারী শীতল জল। ফলে সংগত কারণেই হুমায়ূন মালিকের প্রকাশক ‘ক্ষয়িষ্ণু মানবের পোর্টফোলিও’ তে লেখেন, ‘হুমায়ূন মালিকের সুচারু কথাশিল্পের অস্থিমজ্জায় মিশে আছে বিশ্বে একক শক্তির উত্থানে বিপন্ন সমাজতন্ত্র, বাজার অর্থনীতির হীনস্বার্থান্বেষে নিষ্পেষিত মানবতা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন দলিত করা সাম্প্রদায়িক দৌরাত্ম ও নৈরাজ্য, বিপন্ন পরিবেশ, সামাজিক ও লিঙ্গ বৈষম্য, দারিদ্র ও শোষণ বিষয়ে দৃঢ়, সুতীক্ষ্ণ, লক্ষ্যভেদী বক্তব্য।’ (হুমায়ূন মালিক, ক্ষয়িষ্ণু মানবের পোর্টফোলিও, ঢাকা : নবরাগ প্রকাশনী, ২০০৫, ২য় ফ্লপি)

এখন প্রশ্ন হলো এতকিছু বুঝে উঠতে হলে পাঠককে কতটুকু শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন; বোধ করি শুধু শিক্ষিত হলেই যথেষ্ট নয় তাকে দিব্যদৃষ্টির অর্থাৎ প্রজ্ঞাশীলও হতে হবে; ফলে সঙ্গত কারণেই প্রচল সমাজব্যবস্থায় পাঠকের সংখ্যা কমতে থাকা স্বাভাবিক; ফলে সিরিয়াস ধারার লেখার সাথে জনপ্রিয় ধারার লেখার তুলনা করা অথবা জনপ্রিয়তাকে লেখার মানদণ্ড হিসেবে মনে করা সব সময়ের জন্যই অযৌক্তিক।

যদি বলা হয়, বিষয়বস্তুর সিরিয়াসন্যাসটা ঠিক রেখে পাঠকপ্রিয়তা পাবার জন্য কোনো জুতসই ভাষা কি তৈরি করা সম্ভব নয়? সিরিয়াস ধারার গল্পকারগণ তাঁদের লেখায় এ ধরনের জটিল জায়গাগুলো পাঠকের সহজবোধ্যতার জন্য তাদের ভাষাকে রিফর্ম করেন না কেন? না রিপিয়ার করার বা রিফর্ম করার মত যোগ্যতা তাঁদের নেই; ওই না থাকাটাই তাঁদের বৈশিষ্ট্য; এবং মনে রাখতে হবে ভাষাকৌশলের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেন না বলেই তাঁরা সৃজনশীল। কাজেই গতানুগতিক ফরমেটে তাঁরা চলবেন না; এজন্যই আর দশ জন থেকে তাঁরা পৃথক এবং দাম্ভিক। দাম্ভিক এবং পৃথক এ কারণে যে, তাঁরা শেষ পর্যন্ত সিরিয়াস ধারার পাঠককে এমন এক শিল্পবাস্তবতার ভেতর ঠেসে ধরেন, পাঠক অনেকটা যেন দম বন্ধ করে মরতে বসেন; এই ভয়ানক দমবদ্ধকর মানসবাস্তবতার ভেতরে ধরে রাখা, এই ক্ষমতা এই সময়ের খুব কম গল্পকারের ভেতর দেখা যায়; কাজেই আপাতভাবে যে নির্বোধ চটুল পাঠকেরা শহীদুল জহিরকে অথবা হুমায়ূন মালিককে দূরে সরিয়ে রাখেন, তারা আজও বোধ করি তাঁদের গল্পে অনুপ্রবেশ করতে পারেননি।

প্রশ্ন উঠতে পারে অনুপ্রবেশ করতে হবে কেন? হ্যাঁ বর্তমান যুগপ্রেক্ষাপটের সংকটের যথার্থতা চেতনায় ফুটিয়ে তুলতে হলে অনুপ্রবেশের প্রয়োজন রয়েছে। সরাসরি প্রবেশে এখন আর জীবনের গভীরতলতে ছুঁয়ে দেখা সম্ভব নয়। এই সময়ের সমাজসংকট আর ব্যক্তিমানস-সংকট উভয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক এখন আর সরাসরি কার্ল মার্ক্স দিয়ে তত্ত্বে আটকিয়ে ফেলা সম্ভব নয়; সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি এখনকার সভ্যতা গণতন্ত্রের মোক্ষম প্রয়োগবাদকেও খারিজ করে দিয়েছে। এই সময়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষি করপোরেট লাইফের নাগরিকগণের এখন আর গোষ্ঠীতে বিশ্বাস নেই; আবার বিচ্ছিন্নবাদিতায়ও বিশ্বাস নেই; বিশ্বাস নেই সাম্প্রদায়িকতায় অথবা অসাম্প্রদায়িকতায়; ধর্মে অথবা ধর্মহীনতায়; আস্তিকতায় অথবা নাস্তিকতায়। এত কিছু ভাববার মত সময় তাদের নেই; তারা কোনো ফরমুলা অথবা ছকের ভেতর আটকে থাকতে রাজি নয়; অথবা তারা এখন বউ ছেলেমেয়ের ভেতর আটকে থাকতে গিয়ে ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী আর অসহায় হয়ে ওঠে; এমন কী এই প্রজন্মও এখন আর ঐতিহ্যনির্ভর পরিবার প্রথার ভেতর আটকে থেকে সভ্যতার অসম্ভব সম্ভবনাকে পাশ কাটিয়ে থাকতে প্রস্তুত নয়; ফলে পিতার পরিচয় ও স্থান পাল্টে যেতে শুরু করেছে। সুতরাং যৌক্তিক কারণেই এখনকার করপোরেট সমাজ পুত্রের বয়েসি ব্যক্তিকে প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রকের চেয়ারে বসাতে শুরু করেছে; আর তখন ঐ পুত্রের কাছে পরিবারের প্রথাগত সেন্টিম্যান্ট স্বাভাবিকভাবেই বিরক্তের পরিবেশ সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় শুধুমাত্র আইডিয়ার তথ্যচিত্র অথবা ঘটনার ডিটেইলস অথবা উপস্থাপনার ঐক্যরীতিই ছোটগল্পের অপরিহার্য কৃৎকৌশল নয়। এগুলি পৃথক পৃথক প্রকৌশলে সব সময় গল্পে প্রযোজ্য হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো কৃৎকৌশল যথেষ্ট নয় বরং সেইসাথে গল্পের জন্য প্রয়োজন বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত সংকট প্রকাশের প্রকাশযোগ্য ভাষাযোগ্যতা; বিশেষ করে গল্পের মূল ক্রাইসিস যখন হয়ে উঠবে নান্দনিক উপস্থাপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য; তখন তা হতে পারে সরাসরি; অথবা অবভাস আশ্রিত। কিন্তু গল্পকার যদি তার কেন্দ্রীয় ক্রাইসেসকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হন তা হলে তা শুধুমাত্র গল্প বলার ভেতরই আটকে থাকে; সেক্ষেত্রে গল্প শোনার ইচ্ছা পাঠকের মিটতে পারে বটে কিন্তু তা গল্প শোনা পর্যন্তই; তা পাঠককে গল্প পাঠের পরবর্তী ইনটেলেকচুয়াল এক্সারসাইজের ভেতর নিয়ে যেতে পারে না। আর আমরা বলতে চাই, যে শিল্পের রস গ্রহণের পর তা আমাদের মগজে ইনটেলেকচুয়াল এক্সারসাইজকে ক্রিয়াশীল করতে ব্যর্থ হয় সে শিল্প তাৎক্ষণিক রঙ মাত্র, যার থাকে না কোনো সুদূর প্রসারি উদ্ভাসন। এই উদ্ভাসনকে প্রয়োজনে শিল্পে রূপ দেওয়া সম্ভব; তা প্রতিভাধরগণ করে থাকেন; তারা প্রয়োজনে উদ্ভাসনকে বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে নেন ডিটেইলসে; যদি প্রয়োজন হয় তবেই। তা না হলে শুধুমাত্র সিম্বল আর ইঙ্গিতের মাধ্যমেও গল্পের মোক্ষম মেসেজটিকে পাঠকের মগজে গেঁথে দেওয়া সম্ভব নয়।

যেমন দেখা যায়, শহীদুল জহির এর ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’-র ক্ষেত্রে। এখানে সমাজের রগরগে চটকদার অসঙ্গতিকে উপস্থাপন করা হয়েছে; যা অধিকাংশ গল্পকারদের জন্য বেশ আকর্ষণীয় উপাদান; কিন্তু শহীদুল জহির আপাত রগরগে রাজনীতিক উপাদেয় ঘটনাবলীর ভেতরের ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চটুল খেলায় অবতীর্ণ না হয়ে মনোযোগী হয়েছেন শাসক আর শোষিতের দৈনন্দিন সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কারে। তিনি নির্বোধ পাঠককে, জীবন সম্পর্কে উদাসীন শিক্ষিতদের অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা দেবার দায়িত্ব পালন করেছেন তাঁর গল্পের মধ্য দিয়ে।
এক্ষেত্রে পাঠককে প্রথমে তাঁর গল্পের পাঠ গ্রহণ করতে হবে। এবং পাঠগ্রহণ যাতে যথার্থ হয় এ জন্য তিনি গল্পের আঙ্গিকের ভেতর প্রবেশ করান অপ্রচল পদ্ধতি; যা ঠিক আমাদের চেনা জানা গল্পের সাথে খাপ খায় না; অথবা আমরা গল্প বলতে যা বুঝি, এ ঠিক তা নয়। যেমন তিনি গল্পের শুরুতেই ছক কেটে বেড়াল আর ইঁদুরের অবস্থান দেখিয়ে দিচ্ছেন; তিনি একটি পরিচিত খেলাকে ভিজ্যুয়াল করে তোলার চেষ্টা করছেন; এবং করতে গিয়ে তিনি ঘুরে ফিরে একই দৃশ্য অথবা একই কথকতা অথবা একই ঘোর সৃষ্টি করে পাঠককে সম্মোহিত করার চেষ্টা করছেন; কিন্তু তিনি নিজে থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন না বরং তিনি কথা না বলে জনগণকে দিয়ে টুকরো টুকরো কথা বলিয়ে নিচ্ছেন; পুরান ঢাকার গল্প; গল্প ঠিক না দৈনন্দিন জীবনের খুটিনাটি; মনে হতে পারে এ সবকিছুই অর্থহীন; তিনি হয়তো নিজেও জানেন না তিনি ঠিক কী বলতে চান; বরং কথা বলতে বলতে তার ভেতর দিয়েই তিনি তৈরি করে নিচ্ছেন তার প্রকাশযোগ্য বিষয়; কিন্তু এ বিষয়ে সতর্ক; পাঠক যেন বুঝে তা ধরতে না পারেন এ জন্য তিনি ঘোর সৃষ্টি করেন; পাঠকদেরকে বিভ্রান্ত করেন; আর এই অবসরে আড়ালে রাখেন প্রকৃত গল্প; আড়ালে রাখেন গল্পের প্রকৃত রহস্য। আর এ অবস্থা তৈরি করতে না পারলে পাঠক চূড়ান্ত পাঠ গ্রহণে ব্যর্থ হবেন; সুতরাং পাঠককে প্রচলিত মানব-জীবন বিষয়ে যথার্থ শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে তাকে গল্পের বিবিধ অলিগলি অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হবে।

অন্যান্য গল্পকারদের ক্ষেত্রে যেমন ঘটে থাকে একটি রগরগে সমস্যা অথবা প্রেমের গল্প; যা সাধারণত টেলিফিল্মে দেখা যায় শহীদুল জহির অথবা হুমায়ূন মালিক সতর্কভাবে সে পথ এড়িয়ে চলেন। শহীদুল জহির পুরাণ ঢাকার জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়ে অন্দরমহলে চোখ রাখেন; অর্থহীন বিষয়ের ভেতর থেকে টেনে বের করে আনেন অর্থময়তা; এ অবস্থায় আমাদের চোখের ওপর ঘটতে থাকা দৈনন্দিন জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা প্রকৃত কারণসমূহের প্রকৃত চেহারা আবিষ্কারে সক্ষম হই; আমরা হতবাক ও শিহরিত হই। শহীদুল জহির তখন একজন মাত্র থাকেন না হয়ে ওঠেন বহু; তিনি নিজে কথা বলেন না; বরং আমি থেকে হয়ে ওঠেন আমরা।
“জহির ‘সিংগুলার’ নাম্বার থেকে কেন ‘প্লুরাল’ নাম্বারে গেলেন? ‘আমি’ নয় ‘আমরা’, ‘মহল্লার লোকেরা’, ‘তারা দেখতে পেলো’ ইত্যাদির দ্বারা তিনি কি যূথবদ্ধতা বা ‘মৌমাছিতন্ত্রে’র প্রতিই ইঙ্গিত দিয়েছেন? ‘আমার’ পদবাচ্যমূলক অস্তিত্বের চাইতে ‘আমাদের অস্তিত্ব’ অর্থবহ ও কাঙ্ক্ষিত। এর ভেতর দিয়ে যৌথ জীবনযাপনবোধ, সামাজিক-সামষ্টিক সত্যের শাশ্বত দিকটিই উন্মোচন করতে চেয়েছেন জহির। ‘আমিত্ব’ নয় ‘আমরা’ - কেননা ‘আমিত্ব’ খণ্ডিত, ‘আমরা’ই পূর্ণাঙ্গ”।(মোহাম্মদ আবদুর রশীদ সম্পা., শহীদুল জহির স্মারকগ্রন্থ, পৃ., ১৯)
যাই হোক না কেন, একক আমিও এক অর্থে বহু-র প্রতিনিধি; লেখকরা সবই পারেন, একককে বহু, আবার বহুকে একক বৈশিষ্ট্যে; এখানেই শিল্পের কারিশমা। যেমন শিল্পের কারিশমা প্রকাশ করতে গিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, একটি ভালো ছোটগল্প নির্মাণের পূর্বশর্ত কী হতে পারে? যদিও ভালো গল্প বলতে আসলে কী বোঝানো হয়ে থাকে তা পরিষ্কার করা সম্ভব নয়; কেন-না ভালো গল্প নির্ভর করে কেমন পাঠকের জন্য তা উপস্থাপিত হলো; আমরা সিরিয়াস ধারা বলে আগেভাগেই একখানা ধারণাকে আকড়ে ধরে আছি; অবশ্য আমাদের আলোচনার সীমাবদ্ধতা এখানেই, পূর্বনির্ধারিত ধারণা অনুসারে অগ্রসর হওয়া; এতে নিরপেক্ষতা বলে কিছু থাকে না; অবশ্য নিরপেক্ষতা বলে কিছু নেই; একটা কিছুকে ধরে নিয়ে তার কনটেন্ট নিয়ে গুণাগুণ খতিয়ে দেখা মাত্র। এক্ষেত্রে আমরা ধরে নিয়েছিলাম সিরিয়াস পাঠক আর সিরিয়াস ধারার গল্প; এই সিরিয়াস ধারার গল্পের ভেতর আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে হুমায়ূন মালিকের ‘স্পাইডার-ম্যান কিংবা কালপুরুষ যখন তার নতুনতর ফর্মুলাটি নিয়ে এলেন’ শিরোনামের গল্পটিকে নির্বাচন করছি। প্রথমত বিশাল শিরোনাম আমাদের বিক্ষিপ্ত চেতনার ভেতর এক ধরনের কৌতূহল জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করলে আমরা হুমায়ূন মালিকের নিয়ন্ত্রণহীন বাক্যবিলাসের ভেতর ঠাই খুঁজে বের করার চেষ্টায় যত্মশীল হই; কিন্তু কোথাও বিশ্রাম অথবা থামার জায়গা পাই না; অর্থাৎ লেখক ক্রমাগত ধাক্কা দিয়ে অথই জীবনের গভীরে তলহীন প্রবহমানতার ভেতরে আমাদের ঠেলে দিতে ইচ্ছুক। আমরাও যেন মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেই; কিন্তু এই মহাজনদের এখন আর সাধারণ চোখে দেখা যায় না, তারা এক একজন রক্ষাকর্তা সেজে বসেছেন; ফলে তথাকথিত মহাজনরা কিছুটা বিব্রত হয়ে ওঠে। কর্পোরেট লাইফের দাদনব্যবসা নিয়ে এগিয়ে আসে এনজিও, ব্যাংক ব্যবসায়ী; মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায় সামন্ত সমাজের প্রথাগত প্রচলিত প্রথা। সামন্ত সমাজের প্রথাগত চেইন ভেঙে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এর ফলাফলে শোষণের মাত্রাটা কোন পর্যায়ে উঠে যাচ্ছে; প্রশ্ন এখানেই আটকে থাকে না; আমরা দেখতে পাই শোষণের কলাকৌশল আরও শৌল্পিক আকার নিয়ে শোষিতদের সম্মোহিত করতে শুরু করেছে। আর যেহেতু সাধারণ পাঠক গল্পটি পাঠ করছেন না, সেহেতু পাঠকের ভেতরে ক্রমাগত জীবনের নানাতল আবিষ্কারের নেশা চেপে বসলে পাঠক দেখতে পান প্রতিদিনের জীবন এমন এক তামাশায় মেতে উঠেছে যার ভেতরে রয়েছে দাদন ব্যবসার নোতুন ফরমুলা। ফলে, ‍

“তাহারা তাহারে ঘিরিয়া ঘিরিয়া নাচে, হাসে, তাহারে ঘিরিয়া স্বপ্ন দেখে, আপন দুঃখে তাহারে ঘিরিয়াই কান্দে, রাগ করে, তার বুদ্ধিও ঋণ নেয়

মালকিন যখন বোঝে হাসের অংশিদার হওয়া আবিরন সবার সামনে বুক টান টান করে হাঁটছে কিন্তু তলে তলে গোপন ঘা তাকে ঝেঁকে ধরেছে তখন আর তাকে কাজে রাখবেন না বলে তিনি তারে ছে... ছে... করে তাড়ান, যেন ও ঘা ঘিনঘিন এক কুত্তি, তখন তাড়িত যুবতীকে ড্রইংরুম থেকে মালিকের ইশারা (এতদিন তক্কে তক্কে ছিলেন যিনি), ঠিক আছে সোনার হাঁসের পিছে ছুটে আর যদি কামের ডিস্টার্ব না করিস... বলতে বলতে লোকটা তার বুকে হাত চালান দেয়, হতাশ

আরে বুক শুকনা বইলাই না বাচ্চা মরলো

সহসাই সাহেবের চুম্বনরত ঠোঁট অনুভব করে আবিরনের গালে ক্যান্সার জাতীয় কোনো ঘার পুঁইজ...”

(হুমায়ূন মালিক, মেঘমালা ও কালপুরুষ)


মৃত্যুর সীমানা থাকা সত্ত্বেও মানব জীবনকে যেমন নির্দিষ্ট কোনো সীমানায় আটকে ফেলা সম্ভব নয় তেমনই ছোটগল্পেও মানবজীবনের থাকে না কোনো সমাপ্তি অথবা সীমানা। সুতরাং বাক্যগঠনের ক্ষেত্রে ‘দাড়ি’ চিহ্ন দিয়ে মানবজীবনের ছবিকে আটকে দিতে বাধ্য নন হুমায়ূন মালিক অথবা শহীদুল জহির। হুমায়ূন মালিক নিজে গল্প বলার চেষ্টা করলেও পাত্রপাত্রিদেরকেও সহসা সচকিত করে তোলেন একই বাক্যগঠনের মধ্য দিয়ে; আবার সেই বাক্যের ভেতরে প্রবেশ করান পরিবেশ ও চিরন্তন ইমেজ, ফলে সহসাই ভেঙে যায় প্রচল বাক্য গঠনরীতি; অতীত বর্তমান ভবিষ্যত, পাত্রপাত্রীর মনোজগত এমনকি পারিপার্শ্বিকতা পর্যন্ত এসে ঠাই নেয় একই বাক্যের ভেতর। এ অবস্থায় পাঠক একই সাথে সময়ের বিবিধ তল ও ঘটনার বিবিধ তলকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হবার সুযোগ পেয়ে যান; এ অবস্থায় ঘটনার ধারাবাহিকতা যৌক্তিকভাবেই ভেঙে যায়। ফলে পাঠক একই ঘটনার ভেতরে অবস্থান করলেও বহুবিধ ঘটনার ভেতর যাতায়তের সুযোগ লাভ করেন। একটি ভালো ছোটগল্প নির্মাণের জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে মানবজীবনের এই অসীমতাকে গল্পে উপস্থাপন করার পূর্বতাড়না থাকতে হবে; এই তাড়না যদি লেখকের ভেতর অঙ্করিত না হয় তবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই শুধুমাত্র কাহিনি নির্মাণের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠবেন এবং গল্পের ঘটনার সাথে নিজেও উদ্দেশ্যহীন হয়ে উঠবেন। সুতরাং ঘটনা বড় বিষয় নয়, অর্থাৎ গল্প নয়; বরং ঘটনাবিন্যাসে যখনই সংযোজিত হয় ঘটনাপ্রবাহ, ঘটনার ছবি অথবা নাটকীয়তার অতিরিক্ত একটি উপলব্ধিজাত জগত তখনই গল্প শুধুমাত্র ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ না থেকে সার্থক ছোটগল্পের সীমানায় প্রবেশ করে। আর তা যদি গল্পে সম্ভব না হয় তা হলে আমরা দৈনিক কাগজের রিপোর্ট পাঠকেই যথেষ্ট মনে করতাম, ছোটগল্প পাঠের আর কোনো প্রয়োজন হতো না।

সুইজারল্যান্ডের গল্পকার পেটার বিকসেল-এর গল্পে দেখা যায় ছোট ছোট ঘটনা ও ছবি। আর কিছুই নেই। নেই লেখকের উপস্থিতি ও ব্যাখ্যা। ঘটনা বিশ্লেষণের কোনো ঝোঁক নেই। কিন্তু ছোট ছোট ছবি পাঠককে পৌঁছে দেয় অমীমাংসিত সত্যভাষ্যের জগতে। পাঠক হাবুডুবু খায়। পাঠকের মস্তিষ্ক উস্কে ওঠে। অবশ্য গল্প পাঠের এ সীমানায় পৌঁছিতে হলে পাঠকের মগজেও ঘিলু থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে অবশ্যই উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে শাহাদুজ্জামান এর ‘এক কাঁঠাল পাতা আর এক মাটির ঢেলার গল্প’, ‘ক্যালাইডোস্কোপ’, ‘মিথ্যা তুমি দশ পিঁপড়া’, ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত’, ‘স্যুট-টাই অথবা নক্ষত্রের দোষ’, ‘কারা যেন বলছে’, ‘কতিপয় ভাবুক’, ‘কিছু শিরনামা’ এরকম আরও কিছু গল্পের। পেটার বিকসেল এর গল্পের সাথে শাহাদুজ্জামানের পার্থক্য শাহাদুজ্জামান পেটারের মত ঘটনা নির্মাণের চেষ্টা না করে চিরায়ত গল্পের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন; আর প্রয়োজনে গল্পের ভাষার ভেতরে নিজেও প্রবেশ করেন; মন্তব্য জুড়ে দেন, কাব্য জুড়ে দেন, পাঠককে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দেন; তখন পাঠকের হাতে নানা অপশন এসে ভিড় করে, পাঠক প্রয়োজন মাফিক তা নির্বাচন করেন; ফলে তাঁর গল্প ব্যাপ্তি লাভে সহজেই পাঠকের কাছ থেকে শুবিধে আদায় করে নেয়। যেমন :

ক.

“মহিষ ও প্রজাপতি

ভরা পূর্ণিমায় একটি মহিষ ডুবে আছে পুকুরে। তার চোখ রহস্যময় হয়ে ফুটে আছে পানির উপর। মহিষের গা ঘেঁষে নৌকায় বসে আছে যুবক আর একজন গ্রামীণ মানুষ।

মানুষটি তাকে বলে, এ পুকুরের নিচে আছে সোনার কলস। কলসেরা সাত বোন। আজ মধ্যরাতে ভেসে উঠবে তাদের মধ্যে সবচাইতে ছোট রূপসী বোনটি।

যুবক মনে মনে বলে - হে মানুষ তোমার অপরূপ সারল্যটি আমাকে উপহার দাও।

অনেক গভীর রাতে রূপসী বোন আসে না, আসে লালচে হলুদ একটি প্রজাপতি। প্রজাপতিটি এসে বসে ডুবন্ত মহিষের ভাসতে থাকা চোখের পাতার উপর। তারপর আলতো করে প্রজাপতিটি তার শুঁড় বোলায় মহিষের চোখের মণিতে। মহিষ তখন অঝোরে কাঁদে। মহিষের চোখ থেকে ঝরতে থাকা কান্না তখন প্রজাপতিটা শুষে শুষে পান করে।

যুবক রুদ্ধশ্বাসে কামনা করে, এ দৃশ্য শেষ হবার আগে তার যেন মৃত্যু না হয়”।

(শাহাদুজ্জামান, কয়েকটি বিহ্বল গল্প/ কিছু শিরনামা)

খ.

“কি করে কে জানে একদিন এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কাঁঠাল পাতা মাটির ঢেলাকে বললো, যেদিন বৃষ্টি নামবে সেদিন আমি তোমায় ঢেকে রাখবো আর মাটির ঢেলা কাঁঠাল পাতাকে বললো, যেদিন ঝড় উঠবে সেদিন আমি তোমায় আটকে রাখবো। তারপর দিন যায়। বৃষ্টি এলে কাঁঠাল পাতা ঢেকে রাখে মাটির ঢেলাকে আর ঝড় উঠলে মাটির ঢেলা আটকে রাখে কাঁঠাল পাতাকে। কিন্তু একদিন কি যে হলো, একই সাথে শুরু হলো ঝড় আর বৃষ্টি। ঝড়ে কাঁঠাল পাতা উধাও হয়ে গেল আকাশে আর বৃষ্টিতে মাটির ঢেলা আবার হারিয়ে গেল মাটিতে”।

(শাহাদুজ্জামান, কয়েকটি বিহ্বল গল্প/ এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প)


শাহাদুজ্জামানের গল্পের আঙ্গিক শহীদুল জহির অথবা হুমায়ূন মালিক থেকে ভিন্ন হলেও মনে রাখতে হবে এই সময়ের সিরিয়াস ধারার গল্পকারদের মধ্যে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছেন। এর কারণ তাঁর গল্পের জীবন-জিঙ্গাসা এই সময়ের জীবনবীক্ষণের সাথে সঙ্গতিসাধনে সক্ষম। তাঁর গল্প শুধুমাত্র একটি গল্পের ভেতর আটকে না থেকে পাঠককে আরও খানিকটা রহস্যের ভেতর ও জটিলতার ভেতর ঠেলে দেয়; যা আমরা সিরিয়াস ধারার লেখক-পাঠক আশা করে থাকি। যদিও আমরা স্বীকার করছি মূলত পঞ্চাশ দশকেই আমাদের সাহিত্যের ভিত্তি তৈরি হয়। এবং বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে সে সময়েই বেশি সংখ্যক ছোটগল্পকারের উপস্থিতি দেখা যায়; তারপরও সমকালে বাংলাদেশের ছোটগল্প অতিক্রম করেছে এমন একটা পথ যে পথ আমাদেরকে বাংলা ছোটগল্পের আঙ্গিক নিয়ে নোতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। ফলে এই সময়ে এসে মূলত একমাত্র পঞ্চাশ দশকেই আমাদের সাহিত্যের ভিত্তি তৈরি হয়েছে বিষয়টিকে আর এভাবে দেখার অবকাশ নেই বরং বলা সম্ভব এই সময়ে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার বাই-প্রোডাক্ট হিসাবে কিছু সংখ্যক লেখকের আগমন ঘটে।

এরই ধারাবাহিকতায় বলা হয়ে থাকে ষাট দশকের ছোটগল্পের জোয়ারের কথা এবং প্রায় প্রতিটি দশকের মতো এ সময়ের লেখকগনও বাঁক পরিবর্তনের দাবি করে থাকেন। যদিও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগ বিভাজনের বিষয়টি দশকের হিসাবে মোটেও যৌক্তিক নয়। কেননা এ কথা ঠিক যে, ষাট দশকের প্রিপারেশন শুরু হয়েছিলো বিভাগোত্তর সময় থেকে। ষাট দশকে যার ফলাফল আমরা পেতে শুরু করেছিলাম। তবে তা বাঁক পরিবর্তন ঠিক নয় বরং তা পুষ্টি লাভ করে মাত্র। বাঁক পরিবর্তনের বিষয়টি আঙ্গিকগত যা আরো ব্যাপক যার ছিটেফোটা আশির দশকের পর থেকে দেখা যেতে শুরু করেছে। যে নিরীক্ষার কারণে ও বিষয়শৈলীর কারণে বিষয়টিকে বিবেচনা করার চেষ্টা করা হচ্ছে তা আগামীতে একটা নির্দিষ্ট প্রকরণগত অবয়ব লাভ করবে বলে বিশ্বাস করা যেতে পারে। কেননা নব্বই এর গল্প সে রকম ইঙ্গিতই দিয়ে আসছে।

হুমায়ূন মালিকের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘মৃত্যুঞ্জয়ের সপ্তম জন্ম’; এই গ্রন্থের প্রথম গল্প, ‘মানুষ কিংবা প্রজাপতির অমরত্ব’; এ এক নতুন টেকনিকে নির্মিত গল্প; সম্ভবত বাংলা ছোটগল্পে এভাবে শুধুমাত্র একটিমাত্র প্রতীককে আধুনিক বিশ্বের জলবায়ু-সংকটের বিপরীতে আধুনিক বাজার অর্থনীতির বসুন্ধরা বিধ্বংসী চরিত্রে উপস্থাপন করার রীতি এই প্রথম। প্রতীকটি ‘বসুন্ধরা’; একটি নারী চরিত্র; শেষাবধি আধুনিক বিশ্বের বাজারি চক্রান্তে ক্রমাগত এই নারী ধর্ষিতা হয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত, প্রকৃতির ওজন স্তর ক্রমাগত ছিদ্র হতে থাকে আর,

“এক বিরাণ প্রান্তরে উষরবালি, পাথরের উপর বিধ্বস্ত পড়ে আছে বসুন্ধরা। জরায়ুতে দুঃসহ যন্ত্রণা। সেখানে এক জ্বলন্ত কিম্ভূত গ্রহ বেড়ে উঠছে। আর মরে যাচ্ছে ও”।

(হুমায়ূন মালিক, মৃত্যুঞ্জয়ের সপ্তম জন্ম/মানুষ কিংবা প্রজাপতির অমরত্ব)


অর্থাৎ মরে যাচ্ছে বসুন্ধরা নামের নারী অর্থাৎ পৃথিবী। এই পৃথিবী আমাদের মা; এই মা অভিধার পৃথিবী কীভাবে আধুনিক বিশ্বে তার আধুনিক সন্তানদের দ্বারা ধর্ষিতা হচ্ছে তা দেখানো হয়েছে এই গল্পে। লেখক হিসেবে গল্পটি পাঠ না করলে বোঝা যাবে না এই সময়ের ছোটগল্পকার কীভাবে তার লেখার কলাকৌশলকে ক্রমাগত বদলে নিতে শুরু করেছে ক্রমাগত নিত্যনোতুন বিশ্বসংকটের সমান্তরালে। অথচ যে রবীন্দ্রনাথের হাতে আমাদের ছোটগল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল সেই সময় থেকে আমরা কীভাবে কতটুকু এগিয়েছি তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।


আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্র বলয়ের গল্পকারদের প্রেসক্রিপশন ছিল ছোটগল্পের মধ্যে দুএকটি কাহিনি থাকবে, তিনচারটি তৈরি ঘটনা থাকবে, আর ছোটখাট একটা নাটকীয় ইমেজ, বাঙালি সেন্টিমেন্ট, লোকবিশ্বাস আর বিরহবোধ অথবা সংসার বৈরাগ্য অথবা ‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না ইহা দূরেও ঠেলিয়া দেয়’ এ ধরনের বিবিধ বিষয়াদি। বাঙালি সাধারণ হাসান-হোসেনের ধার করা কারবালার কাহিনির পাশাপাশি অপু-দূর্গা, দেবদাস-পারু সকলের জন্য হৃদয় উন্মুক্ত করে রাখলেন। সেখানে মহেষের জন্য কষ্টের দীর্ঘশ্বাস ঝরতে থাকে; সেইসাথে জোহরার মৃত এক জোড়া বাস্ত-সাপের জন্য হা-হুতাশ বাড়তে থাকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এসে বাঙালি পাঠকদের রুচিতে খানিকটা ধাক্কা দিলেন। ফলে পাঠকদের পক্ষে সম্ভব হলো ওয়ালীউল্লাহকে বুঝে উঠবার। এই সময়ে অর্থাৎ বিভাগপূর্ব ও বিভাগ উত্তর কালে আমরা পাচ্ছি সরদার জয়েন উদ্দীন, আলাউদ্দীন আল আজাদ, শামসুদ্দীন আবুল কালাম, শাহেদ আলী, আবদুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ। ইনারা সকলেই একাধারে মেধাবী এবং নৈরাশ্যবাদী। কেন-না কারো কাছেই বাংলাদেশ ও বাঙালি সমাজ দর্শনটি তখন পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। এবং সকলেই ছিলেন কলোনীর অধিবাসী। সুতরাং ওয়ালীউল্লাহ দীর্ঘদিন ইয়োরোপে বসবাস করে ‘দুইতীর’ (১৯৬৪) নামক যে গল্পগ্রন্থটি উপহার দিয়েছেন সেখানে বাঙালির পোশাকের অন্তরালে রয়ে গেছে সার্তের অসুস্থতা, সেইসাথে কাফকার নৈরাশ্য চেতনা। অবশ্য দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর আধা-নগরচেতনায় শিক্ষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী শ্রেণির কাছ থেকে তখনকার প্রেক্ষাপটে কোনো প্রায়োগিক সমাজবীক্ষণ আশা করাটা যৌক্তিক নয়।

এ অবস্থার মধ্য দিয়েই ছোটগল্পের ধারাবাহিকতাকে বহন করেছেন আবুল ফজল, শওকত ওসমান, বুলবুল চৌধুরী, আবু রুশ্দ, শাহেদ আলী, মহীউদ্দিন চৌধুরী, মবিনউদ্দীন আহমদ, আকবর হোসেন, আবু জাফর শামসুদ্দিন, আবু ইসহাক প্রমুখ ছোটগল্পকারগণ। যাঁরা কিনা বিভূতির নেশায় ডুবে থাকলেও তাঁদের মধ্য থেকে শওকত ওসমান এক ভিন্ন শিল্প কৌশলকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করতে পেরেছিলেন। হয়তো সে কারণেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সবার থেকে নিজেকে আলাদা করে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। এরই মাঝে লিখেছেন শওকত আলী, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতিকুল্লাহ, রাবেয়া খাতুন, জহির রায়হান, বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, মিরজা আবদুল হাই, সুচরিত চৌধুরী প্রমুখ ছোটগল্পকারগণ।


এ প্রসঙ্গে বলে রাখা যৌক্তিক, শ্রেণি সচেতনতা, সমাজের নিচু তলার মানুষদের প্রতি পক্ষপাত ইত্যাদি বিষয়গুলো যা কীনা রবীন্দ্রনাথেরই সরলরেখাধর্মী ব্যক্তি ও পরিবার নির্ভর ছোটগল্প; যেখানে রয়েছে নিচু তলার মানুষের প্রতি করুণা ও পক্ষপাত; যে কাহিনি উঠে এসেছে একটা করুণ ও ক্লান্ত ট্রাডিশনাল ঘটনাকে অবলম্বন করে পাক খেতে খেতে একটা সরলরেখায় মিলিত হয়ে স্থান-কাল-পাত্রের ঐক্যসূত্রে এসে মিলনাত্মক অথবা বিয়োগাত্মক চেতনায় এসে শেষ হয়েছে। এই একই নন্দনতত্ত্বের অনুসারি হয়েছেন ৪০/৫০ দশকের ছোটগল্পগুলিও; যা কিনা অবক্ষয়পূর্ণ আধুনিকতারই ফলাফল; ঔপনিবেশিক আধুনিকতারই ফলাফল। আমার মনে হয় সভ্যতার এই সংকটের বিষফল থেকে ষাটের দশকের গল্পকারগণও মুক্তি অর্জন করতে পারেন নি। এ অবস্থায় কোনো গ্রহণযোগ্য সমাজতাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত ছাড়াই গল্প লিখতে বসলেন ষাটের গল্পকারগণ। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং হাসান আজিজুল হক পর্যাপ্ত মূলধন সংগ্রহ করে তাঁদের লেখায় সমসাময়িক আধা-গ্রাম আধা-শহরকে চিত্রিত করলেন। পাঠকবর্গ বাজারের বালশোভন গল্প লুফে নিলেও (যেমন আজও পাঠকের মেধা হুমায়ূন আহমেদের ছেলেমিপনার ভেতর ঘুরপাক খায়) আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবু বকর সিদ্দিক, রাহাত খান, মাহমুদুল হক, রশীদ হায়দার, আহমদ ছফা, বিপ্রদাশ বড়ুয়া, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, পূরবী বসু, সুব্রত বড়ুয়া, বশীর আল হেলাল, কায়েস আহমেদ, বুলবুল ওসমান প্রমুখ ছোটগল্পকারদের অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ছোটগল্পের অন্তর্ভুবনে জেগে থাকলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত এবং হাসান আজিজুল হক। সেইসাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অল্প কিছু গল্পের কারণে ইনারা বিমর্ষও বোধ করলেন। অবশ্য এই বিমর্ষতা গল্প লেখার দায়বদ্ধতা থেকেই উৎসারিত। বুঝতে পারলেন বাংলা ছোটগল্পের জন্য নোতুন আঙ্গিক অপরিহার্য; কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব, যখন আমরা মামুন হুসাইন, কাজল শাহনেওয়াজ, সেলিম মোরশেদ, ওয়াসি আহমেদ, পারভেজ হোসেন, শহীদুল জহির অথবা হুমায়ূন মালিকের গল্প পাঠ করি তখন বুঝতে পারি বাংলা ছোটগল্প ইতিমধ্যে একটা বাঁক নিতে শুরু করেছে। এই সময়ের গল্প নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে গল্পকার মহীবুল আজিজ বলছেন:

“মনসামঙ্গলের কাহিনী এবং পূর্বসুরি হাসান আজিজুল হকের গল্পের চমৎকার (টুইস্টিং) ব্যবহারের মাধ্যমে মামুন হুসাইন যে বাস্তবের দিকে ইঙ্গিত করেন তা জাদুবাস্তব না হলেও কিম্ভূত বাস্তব নিঃসন্দেহে। কিন্তু বহু যুগের আদিম খোঁড়লে প্রোথিত এর শেকড়।

যে-নবত্ব মামুন বাংলাদেশের ছোটগল্পে প্রবর্তন করলেন তা প্রচলিত কাঠামোকে একেবারেই অস্বীকার করেছে। এই অস্বীকৃতির ভেতরে প্রসারিত হয়েছে বাঙলা ছোটগল্পের দিগন্ত”।

(মহীবুল আজিজ, কথাসাহিত্য ও অন্যান্য/মামুন হুসাইন : এ এক উত্থান)


এ সময়ের মামুন হুসাইনের গল্প নিয়ে হাসান আজিজুল হকও বাংলা ছোটগল্পের নতুন ধারা বিষয়ে আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। সার্বিক অর্থে এ সবকিছুই আমাদের জন্য পজেটিভ। শহীদুল জহির মামুন হুসাইনের গল্পে পোস্টমডার্ন গল্পের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছেন। নির্দিষ্ট বা ডেফেনিট কোনো গল্প না রেখে ইনডেফিনিটির দিকে এগিয়ে যাওয়া মামুন হুসাইনের গল্পে দেখা যায়। যা, পোস্টমর্ডান গল্পের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে।

“আমার ধারণা এইটা এভাবে আর কারও পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল না। ওয়াসির ডিটেইলের কাজ বা ভাষা ভালো। শুধু তাই বা কেন, ওয়াসি ভাল গল্প লেখেন। আমি একদম আলাদাভাবে কাজ শাহনেওয়াজের কাছিমগালার কথা বলব। এটা আমাদের গল্পসাহিত্যের অন্যমাত্রার একটা অসাধারণ গল্প”। (শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার)

তবে আমাদেরকে এক্ষেত্রে স্বীকার করতে হবে, আশি-নব্বইতে ছোটগল্পের যে বাঁক পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে তা শুধুমাত্র আশি-নব্বইয়ের তরুণদের হাতেই সম্ভব হয়নি বরং পূর্ববর্তীগণ যেমন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, হাসান আজিজুল হক, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত প্রমুখের লেখার মধ্য দিয়ে ছোটগল্পের আঙ্গিকগত ভাঙ্গাগড়ার খেলাটা শুরু হয়েছিলো। এরপর ল্যাটিন আমেরিকার জাদুবাস্তবতার ধারণা এসে যোগ হয় বাংলা ছোটগল্পে। অবশ্য শহীদুল জহির মনে করেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার বিষয়টি জানতেন; তা না হলে তিনি কীভাবে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ লিখলেন? যদিও মার্কেজের ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড’ স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে; ইংরেজিতে ১৯৭০ সালে আর এর আগে ১৯৬৮ তে প্রকাশ পায় ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। যাই হোক শহীদুল জহিরের লেখায় যে অর্থে ম্যাজিক রিয়ালিজমের ব্যবহারের কথা বলা হয়ে থাকে সে অর্থে আমি মনে করি না বরং তিনি রূপকথার চেয়েও অধিক বাস্তব যে জাদুবাস্তবতা তাকে পাশ কাটিয়ে সমাজের রূঢ় বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর গল্পের ভাষা নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। তিনি এক্ষেত্রে সতর্ক থেকেছেন; জেনে শুনেই ভাষার ভেতর সংলাপ প্রতিস্থাপন করেছেন; তাঁর মতে এতে পাঠক রিল্যাক্স পান; ফলে চিন্তাজগত প্রয়োজনীয় পথ খুঁজে পাওয়ার সুযোগ পায়। শহীদুল জহির সৃজনশীলতার প্রশ্নে বাংলা চলিত মান ভাষাকে যথেষ্ট মনে করেননি। শহীদুল জহিরের ভাষা বিষয়ক ভাবনা প্রকাশ করতে গিয়ে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর লিখেছেন :

“কথিত মান ভাষার উপর তাঁর (শহীদুল জহির) কোনোই আস্থা ছিল না। এতে ভাষার প্রাণ নষ্ট হচ্ছে বলে ক্ষণে ক্ষণে মত প্রকাশ করতেন। এতে ভাষা লুজ হয়ে যাচ্ছে বলেও জানাতেন। আমারও তাই মত ছিল। কথিত চলমান ভাষার উপর আমারও আস্থা নেই। ভাষাকে প্রাণ দিতে হলে, এতে জোয়ার আনতে হলে, জনপদের প্রবাহমানতা বজায় রাখতে হলে, ভাষাজনিত নানান সংস্কার ও নিয়মকে তছনছ করে দেয়া দরকার। বাক্যে এই জনপদকে গুরুত্ব দেয়া, এর ইতিহাসকে যথার্থভাবে ব্যক্ত করতে চাইলে ভাষার পরিবর্তন হতে বাধ্য। এই জনপদের ইতিহাস, শৃঙ্খল ভাঙার ধরন, ধর্মের আধিপত্য ইত্যাদি মিলে ভাষাকে বদলে নিতেই হবে। মানুষের চলাচল, রুজির ধরন, নগর গড়ে ওঠার কায়দা, মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম ইত্যাদি মিলে এর একটা আলাদা রূপ পাবেই”।

এ কথা ঠিক যে, ভাষা তার প্রয়োজনে আলাদা রূপ পাওয়ার চেষ্টা করলেও এই রূপ পরিবর্তনের বিষয়টা খুব আড়ালে খুব ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়। এই পরিবর্তনে সব লেখকই যে অংশ নেন এমন নয়; বরং অধিকাংশই অগ্রজদেরকে অনুসরণ করেন। এক্ষেত্রে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত আলী, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর মত লেখকদের প্রভাব সমকালে সৃজনশীলতার প্রশ্নে জরুরি। প্রভাবের বিষয়টি সৃজনশীলতার প্রশ্নে বাস্তব একটি বিষয়, যা এড়িয়ে চলা খুব অল্প সংখ্যক লেখকের জন্য সম্ভব। অধিকাংশ লেখকই প্রতিভাবান অগ্রজদের ভাষাকৌশলের প্রায়োগিক প্রভাব এড়িয়ে চলতে পারেন না। এক্ষেত্রে অপ্রচল অজনপ্রিয় সিরিয়াস ধারার ছোটগল্পকারগণ সুখপাঠ্য ভাষা অনুসরণ না করে; বলা চলে জেনে শুনেই তারা সুখপাঠ্য ভাষাকৌশল সচেতনভাবে অস্বীকার করে বর্তমান সমাজসংকট উপযুক্ত ভাষার অনুসন্ধান করেছেন।

সভ্যতা-বিজ্ঞান-বিশ্বরাজনীতি আর পৃথিবীর আবহাওয়া যদি পাল্টাতে থাকে তা হলে এই সময়ের শিল্পীগণ একটু ভিন্নভাবে আরো একটু সূক্ষ্ণভাবে ভাববেন এটাই স্বাভাবিক। আর সেই ভাবনা যদি ছোটগল্পে উঠে আসতে চায় তা হলে সে গল্পের কৃৎকৌশলতো একটু বদলাবেই। এই যে অনিবার্য পাল্টে যাবার সময় এসেছে এটা হচ্ছে বাংলা ছোটগল্পের একটা সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে যারা সূক্ষ্ণ থেকে সূক্ষ্ণতর বিষয়গুলিকে পর্যবেক্ষণ করতে ব্যর্থ হবেন তারা ছিটকে পড়বেন। জীবন উপলব্ধির সূক্ষ্ণতার কারণেই এখনকার কারো কারো ছোটগল্প আর সরল-কাহিনি নির্ভর নয় বরং তা মনন জগতের কার্যকলাপ নির্ভর, মস্তিষ্ক-নির্ভর।

এই সময়ের ছোটগল্প নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন সহজ বিষয়বস্তুকে বর্ণনায় দুর্বোধ্য, রহস্যময় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাব্যিকতাময় করার চেষ্টা চলছে; সৃজনশীলতার প্রশ্নে বিষয়টি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আলোচিত হওয়া উচিত। যারা হুমায়ূন মালিকের ‘মায়াবাস্তবের আত্মকথন’ অথবা ‘গোলাপ সংহিতা’ পাঠ করেছেন; এরকম শাহাদুজ্জামান, মামুন হুসাইন, ইমতয়িার শামীম, অথবা শহীদুল জহির থেকে পাঠ গ্রহণ করেছেন তারা অবশ্যই এই প্রশ্ন তুলতে পারেন। কিন্তু একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে যখন দেখা যায এই ধারার গল্পকারদের গল্প বলার কৌশল পরিবর্তন করলে সেই গল্পের ভেতর যে কনটেন্ট ঠেসে দেওয়া হয়েছিল তা আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; আসলে একটি উৎকৃষ্ট শিল্প যখন নির্মিত হয়ে যায় তখন তার আর কোনো বিকল্প খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়; এখানেই সৃজনশীলতার রহস্য। প্রকৃত বাস্তবতায় একজন শক্তিশালী ছোটগল্পকার সহজ বিষয়কে অযথা দুর্বোধ্য করে তুলেন না। আপাতদৃষ্টিতে পাঠক হয়তো ব্যর্থ পাঠক হিসাবে বিষয়টির মধ্যে কিছুই খুঁজে পাচ্ছেন না; ফলে পাঠকের কাছে বিষয়টিকে সহজ মনে হচ্ছে। কিন্তু মগজ খাটালে দেখা যাবে বিষয়টি ফালতু বা সহজ নয়; বরং সেই অনুন্মোচিত গূঢ় বিষয়টি প্রকাশের জন্য এটিই ছিলো একমাত্র উপযুক্ত ভাষাশৈলী। যেমন শহীদুল জহিরের ‘কোথায় পাব তারে’ গল্পটিকে আপাতভাবে ফানি অর্থহীন বলে মনে হতে পারে। লেখক নিজে বলছেন গল্পের ভেতর এক ধরনের ইয়ারকি আছে। কিন্তু এই গল্পের আব্দুল করিম বর্তমান ব্যস্তযুগের কর্মহীন প্রেমহীন যুবক। যার ভেতরে প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে অপ্রাপ্তিবোধজনিত বিষয়ের পরিপুরক স্বপ্ন। সে জেগে জেগে মনোজগতে তৈরি করতে থাকে শেফালি নামের একটি চরিত্র; হয়তো সে কোনোদিন কোনো স্থানে তাকে দেখেছিল; তার ভেতরেও আর দশজনের মত প্রেম জেগে ওঠে; কিন্তু প্রেম তার জন্য অ্যাবসার্ড; এই অ্যাবসার্ড বিষয়টিকে চূড়ান্ত সংকটের ভেতর ঠেলে দেবার জন্য লেখক দৈনন্দিন জীবনের ভেতর দিয়ে আব্দুল করিমের সাথে আমাদেরও স্বপ্ন দেখাতে থাকেন। একইভাবে ‘প্রথম বয়ান’ গল্পের ভেতরও দেখা যায় সংশয় আর অনিশ্চয়তা। দৈনন্দিন জীবনের ভেতর থেকে লেখক ক্রমশ টেনে বেড় করে নিয়ে আসতে শুরু করেন হারানো অতীত। আমরা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলে আমরাও গল্পের চরিত্রের মতো কেউ ঠিক সুখ বোধ করতে পারি না। পরিচিত স্ত্রী বা প্রেমিকাও বিনা কারণে বিনা অপরাধে বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে; আর আমরা কর্মব্যস্ত জীবনের মুখোমুখিতে নিজেরাই নিজেদের কাছে ক্রমাগত অচেনা হয়ে উঠি।

কখনো বা নর-নারীর পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি ব্যতীতই অন্তরে নিছক একবারের উপলব্ধিই যে তাদেরকে প্রেমের পথে অগ্রসর করতে পারে, এমন অধরা বা বিমূর্ত মনোভঙ্গির প্রতিফলনও শহীদুল জহিরের গল্পের নায়ক-নায়িকার আচরণে পরিদৃষ্টমান। সর্বোপরি, মানব-মানবীর পারস্পরিক বোঝাপড়া ও একের প্রতি অন্যের আস্থা, নির্ভরতা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতার সমান্তরালে প্রেমের অতৃপ্তি ও আক্ষেপ, বিরহের তীব্র বেদনার্তি, সংশয়, বিকার ও ঈর্ষান্বিত মানসিকতার সমন্বয়ে তাঁর গল্পসমূহ বাস্তবতার শর্তে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকেও উত্তীর্ণ হয়েছে রসাশ্রিত শিল্পে। আবেগের যথেচ্ছ প্রকাশ ও অসংযমী বিস্তার, যৌন প্রসঙ্গসমূহের স্বেচ্ছাচারী চিত্রায়ণের পথ পরিহারপূর্বক যথাসম্ভব ইঙ্গিত, আভাস ও প্রতীকের আশ্রয়ে মানব-মানবীর অন্তর্জাগতিক স্বরূপ গ্রন্থণায় তিনি সচেতন, আন্তরিক এবং আত্মনিবিষ্ট কথাশিল্পী।

(তাশরিক-ই-হাবিব/শহীদুল জহিরের ছোটগল্পে নর-নারীর প্রেমভাবনা)


রহস্যময়তা এবং কাব্যিকতা গল্পের প্রয়োজনে বিষয়ের ওপর ভর করে একজন শক্তিশালী গল্পকারের হাত দিয়ে অবশ্যই উঠে আসতে পারে তা পক্ষান্তরে গল্পকে নান্দনিক মাত্রাই দান করে। এখন আর মেধাবী পাঠক শুধুমাত্র ঘটনার বয়ান শুনতে রাজি নন। তার জন্য দৈনিক সংবাদপত্রের শিরোনাম বড়োজোর সংবাদটি আগাগোড়া পাঠই যথেষ্ট। এই যে ঘটনাটি তিনি পাঠ করলেন তারপরের বিষয়গুলি তিনি জানেন না; অথবা এই ঘটনার অন্তরালে যে সত্যভাষ্যের জগতটি রয়েছে তা উন্মোচন করতে সংবাদপত্র ব্যর্থ। এক্ষেত্রে গল্পকারের কাছে কাহিনি অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ, কাহিনির ফলাফলে যে জীবন-জিজ্ঞাসা, যে মেসেজ, যে ক্রাইসেসটি পাঠকের মগজে তিনি উস্কে দিতে চান সেটি। ফলে ট্রাডিশনাল কাহিনির কাঠামোকে যখন লেখক ছোট করে দেখতে বাধ্য হলেন তখন গতানুগতিক গল্প পাঠে অভ্যস্ত পাঠকের কাছে মনে হতে থাকলো আসলে এর মধ্যে কোনো গল্প নেই। সুতরাং সৃষ্টি হলো গল্পহীনতার গল্প নামে একটি ধারণা। অথচ গল্পহীনতার গল্পের মধ্যেও রয়েছে অধিক ইঙ্গিতধর্মী তাৎপর্যধর্মী গল্পের অনুষঙ্গ ও ফলাফল। যখন আমরা সংবাদপত্রের রিপোর্টের মতো গল্পগুলি পাঠ করে আর তৃপ্তি পাই না তখন আমাদেরকে ফিরে আসতে হয় গল্পহীনতার গল্পের কাছে। আর এতে গল্প আছে অবশ্যই তবে তাকে উচ্চ গ্রামে টিউন করে নিতে হয়। সঙ্গীতে কথা আছে আর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত কথাহীন অথচ! উদাহরণ হিসেবে আমরা শাহাদুজ্জামানের ‘মারাত্মক নিরুপম আনন্দ’ শিরোনামের গল্পটি গ্রহণ করতে পারি। গল্পের ভেতর কোনো ঘটনা অথবা চরিত্র বিকশিত হতে দেখা যায় না। কিন্তু যখন দুজনের সংলাপ, তাও আবার কাব্যিক সাধু ভাষায় উচ্চারিত হতে থাকে, তখন সামান্য কৌতুহল নিয়ে পাঠ গ্রহণ করলে পাওয়া যায় মানবজীবন বিষয়ে চিন্তার খোরাক; এই চিন্তা মুহূর্তে আমাদেরকে দৈনন্দিন গ্লানী থেকে খানিকটা হলেও টেনে তোলে ওপরে। উদাহরণ:

“জ্যেষ্ঠ : বৃক্ষটি বাস্তবিকই মৃত। ক্ষণকাল পূর্বে অগণিত পক্ষী ঐ বৃক্ষের প্রতিটি শাখাপ্রশাখায় উপবিষ্ট ছিলো। পক্ষীগুলির দেহ সবুজ, ফলে তাহা পত্রের ভ্রম সৃষ্টি করিয়াছে, পক্ষীগুলির ওষ্ঠ রক্তিম, ফলে তাহা পুষ্পের ভ্রম সৃষ্টি করিয়াছে। পলকে সকল পক্ষী উড়িয়া যাওয়াতে এক্ষণে বৃক্ষের কঙ্কালটি উন্মোচিত হইয়াছে।

কনিষ্ঠ : বিস্মিত হইলাম। আমার অনুমান হইতেছে এই দৃশ্যটি যেন-বা জীবনেরই রূপক। জীবন যেন বাস্তবিক এইরূপ একটি মৃত বৃক্ষ বিশেষ। ইহার শাখায় উপবিষ্ট রঙিন পক্ষীর কারণেই তাহা বর্ণাঢ্য। অথচ যে কোনো মুহূর্তে পক্ষী উড়িয়া গিয়া নেপথ্যের করুণ কঙ্কালটি উন্মোচিত হইবার আশঙ্কা রহিয়াছে”।

(শাহাদুজ্জামান/মারাত্মক নিরুপম আনন্দ)

বিশ্বের সমকালীন ছোটগল্প আঙ্গিকগত গুণধর্মে যতটা সূক্ষ্ণতা অর্জন করেছে তেমন ভাষা-বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে ইদানিং আমাদের ভাষায় কাজ হচ্ছে না তা নয়। তবে সমস্যা হলো, পাঠক। পাঠক এখনো রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রের গল্প বলার ঢঙে সীমাবদ্ধ। সেখানে তীব্র ইঙ্গিধর্মী আবহ সংযোজন করলে তারা হাবুডুবু খান, বিরক্ত হন; বরং হুমায়ূন আহমেদের গল্পে সুখ বোধ করেন। বোরহেস-এর গল্প পাঠ করলে দেখা যায় সেখানে রয়েছে ঘনসংবদ্ধ রচনাবৈশিষ্ট্য; যা বহুমাত্রিক অর্থদ্যোতনা ধারণ করতে সক্ষম। এক মাত্রার বাক্যের মধ্যে ঠেসে দিয়েছেন বহুমাত্রিক অর্থমাত্রা ও ইঙ্গিত। যা পাঠককে আপাত অর্থময়তার জগত থেকে আরো দূরতম জগতে নিয়ে যায়; ক্রমাগত উন্মোচন করতে থাকে আরো দূরবোধ্য অথচ স্পর্শযোগ্য সত্যভাষ্যের জগত। ফলে যে জীবনবোধের সন্ধান তিনি দিয়ে থাকেন তা শুধুমাত্র একরৈখিক একটা নিরেট গল্পের মধ্য দিয়ে সম্ভব নয়; তা যত চমৎকার কাহিনিই হোক না কেন। মানুষের অন্তর্জগতকে সূক্ষ্ণ ও স্বচ্ছভাবে দেখার কৌশল ফ্লাড গল্পে সম্ভব নয়। তা শুধু কাহিনিই বর্ণনা করে অন্য কিছু নয়। এই অন্য কিছুর অনুসন্ধানে বিশ্বের সমকালীন ছোটগল্প ব্যস্ত। এই নিরীক্ষাটি নব্বই দশক থেকে আমাদের গল্পের ভাষাতেও শুরু হয়েছে। এটা এক ধরনের ইতিবাচক দিক। তবে আবারো বলতে হয়, ইয়োরোপে শিল্প সাহিত্যের যে কৃৎকৌশল আবিষ্কৃত হয় তা আমাদের এখানে পঞ্চাশ থেকে একশ বছর পরে এসে জোয়ার তোলে; আর সেই জোয়ারের ছিটেফোটাও আধুনিক পাঠক কমিনিকেট করতে পারেন না। সে কারণে বিশ্বসাহিত্যের কলাকৌশলের সাথে আমাদের সাহিত্যের অবস্থান বিবেচনা করা অনেকটা শ্লেষাত্মকও বটে।

বাংলাদেশের ছোটগল্পের একটি সিরিয়াস ধারা তৈরি হবার পেছনে অবশ্য রয়েছে বাজারী গল্পের অবদান; অর্থাৎ জনপ্রিয় ধারার গল্পের কথাও আমাদের বিবেচনায় আনা জরুরি। বাজারী গল্পকে খানিকটা পালিশ করে বিটিভি কালচারের রঙ চড়িয়ে, নান্দনিকতার উদ্দেশ্যহীন হাওয়া দুলিয়ে মঈনুল আহসান সাবের আরো শক্তিশালী করলেন। অথচ সুশান্ত মজুমদার, বারেক আবদুল্লাহ, মুস্তফা পান্না, সৈয়দ কামরুল হাসান ও হরিপদ দত্ত সমন্বয়ে ছোটগল্পের যে ঘরানাটি তৈরি হওয়া উচিত তা শুধুমাত্র সমাজনিরীক্ষাতেই বিনষ্ট হতে লাগলো। না পারলো কৃৎকৌশলগত কমিটমেন্ট দাঁড় করাতে; না পারলো কৃত্রিমতাকে পরিহার করতে। তবে তাঁরা বুঝতে পারলেন ছোটগল্পের বাজারী স্রোতকে খণ্ডন করা জরুরি। চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু ইতিমধ্যে রোগ দুরারোগ্য ব্যাধির মত ছড়াতে শুরু করেছে। এক নিষিদ্ধ রোগের তাড়নায় লেখক-পাঠক-সম্পাদক-প্রকাশকগণ যেন অপ-উত্তেজনায় মেতে উঠলো। ফলে সমাজ প্রেক্ষাপটে ঘটে গেল বড় রকমের একটা পরিবর্তন।

সুতরাং ওয়াহিদ রেজা গল্প লিখতে এসে সার্ত্রের সম্মানিতা বারবণিতাকে গল্পের কাঠামোতে পরিমাপ করে যে এক্সপেরিমেন্ট চালালেন তাতে করে সফলতার পরিবর্তে বিভ্রান্ত অবস্থার সৃষ্টি হলো। এই বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে পথ পরিষ্কার করে নিলেন ইমতিয়ার শামীম, মনিরা কায়েস, নাসরীন জাহান; তারা সামাজিক কমিটমেন্টকে ভেঙে দুমড়ে-মুচড়ে বাংলা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে একটা মোড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত সূচিত করলেন বটে, আবার সেই সাথে তাদের লেখক সত্ত্বা জনপ্রিয়তার বাজারে আশাবাদী হাতও প্রসারিত করলো।

সুশান্ত মজুমদার বাংলা একাডেমীর ’বাংলাদেশের গল্প : সত্তর দশক’ সংকলনের ভূমিকাতে সত্তর দশকের গল্পকারদের নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত টেনে বলেছিলেন, “মেধা-মনন-রুচির দারুণ ক্ষয় হয়েছে সত্তরের দশকে। এরও প্রভাব পড়েছে সত্তরের গল্পে। রুদ্ধ হতে হতে ব্যক্তি হয়ে পড়ে ক্ষতাক্ত, ক্লেদপূর্ণ। এর কারণ এবং পরিণতি না বোঝার কারণে অনেক স্থুল, জলো, অসার কাহিনী গল্পের মোড়ক পরিয়ে পরিবেশন করেছেন সত্তর দশকের লেখকেরা। এর আগে কোনো দশকে এত সস্তা, চটুল, মধ্যবিত্তের সাধারণ কেচ্ছা লিখিত হয়নি। জনপ্রিয়তার টানে লেখার উপযোগিতা, লেখকের দায়িত্ব কোনো কোনো লেখকের কারণে উপেক্ষিত হয়েছে। শাস্ত্রবদ্ধ বুদ্ধি দিয়ে লেখা সমাজবাস্তবতায় গল্প হয়েছে কেবল লেখকের ইচ্ছাপূরণের কাহিনী। পাঠক মনে তাপ ছারিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে এসব গল্প-নির্দিষ্ট কোনো আলো পৌঁছে দিতে পারেনি। সমাজে শ্রেণী আছে, শ্রেণীদ্বন্দ্ব আছে, কিন্তু তা উল্লম্ফনের মাধ্যমে সংঘাতে নিয়ে এবং কাহিনীতে শোষিতের জয় দেখিয়ে লেখকরা বাহবা পেয়েছেন বটে, কিন্তু গল্পের জন্য লেখক শিল্পশর্ত পূরণ করতে পারেননি।”

আশির দশকে এসে মামুন হুসাইন ঠাস বুননে এক গল্পের ভিতর দশ-বার-আঠারো-আটাশ গল্প ঢুকিয়ে এমনি কাঁথা বুনলেন যে, শেষ পর্যন্ত নকশী কাঁথা বুনলেন নাকি দেশীয় ঐতিহ্যের চট সেলাই করলেন আকুল-পরানের আকুলতা তো তার দিশা পেলোই না, পাঠকের ত্রাহি ত্রাহি শ্বাস। আর কাজল শাহনেওয়াজ কাছিমগালাতে তিনশত বছরের আয়ুরেখাকে শহর আর গ্রামের কৃত্রিম রেলগাড়িতে চড়িয়ে নিশ্চিত অপেক্ষা করতে থাকলেন যে, ইস্টিশনটা খুব বেশি দূর নয়। এভাবে ইস্টিশনটা দূর নয় ভেবে আশির সকলেই বুদ্ধির কসরতে মল্লযুদ্ধে নেমে একটা বিজ্ঞভাব গোঁফে ঝুলিয়ে রাখলেন। কারণ এই করে বাংলা ছোটগল্পের কৃৎকৌশলগত বিষয়টি নোতুন করে বিবেচনার দাবি করে বসলো। কারণ এই সময়ের গল্পকে হতে হবে উঠতি শিক্ষিত উঠতি শহুরে নাগরিকদের জন্য।

তারপরও একথা স্বীকার করতেই হবে, আশির দশক সত্তর-এর বাজারী জনপ্রিয়তা থেকে নিজেদেরকে পৃথক করতে সক্ষম হয়েছেন এবং নব্বই-এর দশকের জন্য বড় রকমের পরিবর্তনটির ভিত্তিভূমি রচনা করেছেন আশির দশকের কেউ কেউ; বিশেষ করে যারা এখনো লিখছেন। বড় রকমের অরাজকতাটি ঘটেছে নব্বইয়ের শুরুতে, যা কিনা শেষে এসে বেগবান হয়েছে। প্রত্যেকে স্বঘোষিত গল্পকার ও কবি শিরোনামে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন। সুতরাং প্রত্যেকেই কাগজ প্রকাশ করলেন। আর সবচেয়ে মজার বিষয়টি হলো দশক শেষ না হতেই জনাব রবিউল করিম ‘নব্বই দশকের গল্প’ শিরোনামে একটি সংকলন সম্পাদনা করে ছোট গল্পকারের সার্টিফিকেটটি যেন কব্জা করে ফেললেন। তারপরও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, বাংলা ছোটগল্পের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে এই সংকলনটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।

নব্বইয়ের শুরুতেই বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছিল, ঔপনিবেশিক আধুনিকতার অসুস্থতা থেকে মুক্তি। তেমনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও তরুণ, অনতিতরুণ যাদের হাতে ছোটগল্প আবারও ভেঙে গেলো, পোস্টমর্ডানিজম আর উত্তর আধুনিকতা থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য সচেষ্ট হলেন। কেউ কেউ এতদিনে বুঝে ফেললেন যে, গলদটা আসলে কোথায়, আমরা কাদের সাংস্কৃতিক দায়ভার আজো বহন করে চলেছি। একদল আশির দশকের সাথে মার্চ করে গেলেন। ফলে তারা গল্প রচনার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। আরেকদল বাংলা ছোটগল্পের প্রকৃত ক্ষেত্রটিকে আবিষ্কারে মনোনিবেশ করলেন। এই দলটি অনুসন্ধান শুরু করলেন একেবারে সহজিয়া থেকে শুরু করে ধর্ম-লোকাচার ঐতিহ্য মিথ এর উৎসভূমির বিষয়কে আশ্রয় করে সমাজ বিবর্তনের রূপরেখাকে পুনঃযাচাই করে দেখা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আমরা প্রকৃত প্রস্তাবে ইয়োরো-কেন্দ্রিক জীবনবীক্ষণকে উপরিকাঠামো থেকে ব্যাখ্যা করে শহুরে ও গ্রামীণ জনপদের সরলরেখা নির্মাণ এবং কোন ক্ষেত্রে বাংলা ভাষাতে দ্বান্দ্বিক রূপ নির্মাণ করে ছোটগল্পের রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসময়হকে চিহ্নিত করেছি। নব্বই এর দশক এই রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের অসাড়তাকে সম্যক বাজিয়ে দেখলেন, উপলব্ধি করলেন বাংলা ছোটগল্পের বাঁক পরিবর্তনের সময়টি সমাগত।

সমাজবিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নব্বই এর দশক বুঝতে সক্ষম হলো যে, ৪৭ পরবর্তী পাকিস্তান উপনিবেশ আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিকৃত করেছে। গল্পে এক প্রকার ভীতির সঞ্চার করেছে। বাঙালিকে ডমিনেট করেছে পাঞ্জাবি-সিন্ধু-বেলুচ-লাহোর ও ইসলামাবাদের সংস্কৃতি। রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে হতে একাত্তরের মধ্য দিয়ে জাতিগত পরিচয়কে উদ্ধার করার পর একটি স্বাধীন দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতি হবে ধারাবাহিক ঐতিহ্যের অনুসারি অথবা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের মধ্যে নিজের আত্মপরিচয়কে খুঁজে নিবে, এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু হয়েছে উল্টো। আর এর মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধভিত্তিক ব্যর্থ গাল-গপ্প সৃষ্টির পর নব্বইয়ে এসে বাংলা ছোটগল্প পরিষ্কার দুটি ভাগে পৃথক হতে শুরু করলো। গ্লোবালাইজেশন কিংবা মুক্তবাজার অর্থনীতি সেই সাথে পূর্বসুরীদের প্রচুর ফর্মূলার দায়ভারকে বহন করে পশ্চিমা পোস্ট-মর্ডানিজমের অন্ধ অনুকরণে গল্পে অর্থহীন চটুল দাম্ভিকতা তথা দুর্বোধ্যতা সৃষ্টি করলেন গল্পকারগণ। বুননের পর বুনন, নৈরাশ্য, স্যাডিজম, যৌন অবদমন যা বাংলা ছোটগল্পের ভূমিতে অসংখ্যবার ঘটেছে, শুধু সময় আর পাত্রের পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র।

বস্তুত আশিতে পুষ্টি পেয়ে নব্বইতে এসে যে গুটিকয়েক গল্পকার নোতুন সমাজবীক্ষণ দ্বারা নিজেদের স্থিতধী করলেন, তাতে তারা বুঝতে সক্ষম হলেন যে, কিভাবে বাংলা ছোটগল্পের গতানুগতিক মেদবহুল শরীরকে ছেটে ফেলতে হবে। কিভাবে আপাত দৃষ্টিগ্রাহ্য নয় এমন ভয়াবহ সত্যকে গল্পে তুলে আনতে হবে। কিভাবে ছবি আঁকতে আঁকতে পাঠককে গল্পে অংশগ্রহণ করাতে হবে, পাঠককে দিয়েও গল্পের খানিকটা অংশ লিখিয়ে নিতে হবে, যাতে করে গল্পের প্রায়োগিক ইফেক্ট পাঠকের মানসলোকের যাবতীয় দরজা-জানালাগুলিকে উন্মুল করে দেয়। পাঠকের অবচেতনে, অবচেতনে যাতে করে গল্পের প্রায়োগিক ট্রিটমেন্টটি ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুতরাং ভাষা, গল্পকাঠামো, পটভূমি-নির্বাচন, জীবন-জিজ্ঞাসা, সর্বোপরি বাঙালি প্রজন্মের শেকড় সন্ধানের তাড়নায় এ সময়ের গল্পকারগণ পৃথক পথ আবিষ্কারে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণাদগ্ধ হলেন। প্রয়োজন নোতুন নন্দনের। এই নন্দনের প্রয়োজন দেখা দিল সমাজ প্রেক্ষাপটকে ভিন্নতর সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে দেখতে শেখার জন্য। এবং এই কৌণিক দৃষ্টিভঙ্গি তাদেরকে বিশ্লেষণী অথচ অতীত-বর্তমানকে দেখতে শেখাবার নির্মম বাস্তবতা উপহার দিল। যা কিনা স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ সমাজবাস্তবতার মধ্য দিয়েও সম্ভব হয়নি।

আলোচনা সার্বিক অর্থাৎ পুর্ণাঙ্গ নয়। অথবা সবাই আলোচনার সাথে একমত হবেন এটা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। তারপরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। যদিও সমকালীন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করলে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পারফেক্ট হয় না। কেননা এর সাথে জড়িয়ে থাকে সমকালীন সমাজের উত্তাপ ও মিডিয়ার রঙবাজি। সময়কে অতিক্রম করে যে সাহিত্য টিকে থাকে, তা নিয়ে আলোচনা করলে তা অপেক্ষাকৃত পারফেক্ট হবার সুযোগ পায়। কেননা এ অবস্থায় সমালোচক প্রভাবমুক্ত থাকার সুয়োগ পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ তেমন কিছু সৃষ্টি হলে এক সময়ে সে নিজেই তার সমালোচনার বিষয়টিকে সামালোচকদের নলেজে আনবে; এর জন্য ব্যস্ত হবার কী আছে। সিরিয়াস গল্প সমকালে অপেক্ষাকৃত কম পঠিত হয়; অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত হয়; আর তা অধিকাংশের চোখের আড়ালেই থেকে যায়। এর জন্য দুঃখ করার কিছু নেই। মিডিয়া যারা দখল করে থাকেন তাদের ভালো কিছু খুঁজে বের করে অতঃপর পাঠ করে এর স্বাদ আস্বাদন করার মতো এত সময় তাদের কোথায়? কাজেই তা লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেঁচে থাকা অবস্থায় তাঁর রচনা যতটা না পাঠ হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি পাঠ হচ্ছে এখন। অবশ্য আমাদের দেশের শিক্ষিত শ্রেণির একটা মোটা অংশ তাঁর নাম এখনো জানেন না; অথবা জানলেও তাঁকে পাঠ করেননি; অথবা দু একজন পাঠ করলেও তা পড়ে শেষ করতে পারেননি; অথবা শেষ করার ধৈর্য রাখেন না; অথবা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রফেসারকে জানি তাঁরা দীর্ঘদিন পড়া উচিত বিবেচনা করে ২/৪ মাসেও খোয়াবনামার একশ পৃষ্ঠার অধিক শেষ করতে না পেরে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছেন। প্রকৃত বাস্তবতা এমনই। তারপরও বাংলা ভাষায় আমাদের দেশে মর্যাদাসম্পন্ন ছোটগল্প সৃষ্টি হচ্ছে বলে দেখতে পাচ্ছি। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি নানাবিধ সামাজিক সংকটই সৃজনশীলতার পূর্বশর্ত; আমরা আধুনিক, আধা-আধুনিক, পিছিয়ে থাকা আধুনিক সকলেই কমবেশি সংকটের ভেতরই আমাদের জীবন নিয়ে টানাহেঁচড়া করে এক ধরনের ফাঁপড়ের ভেতর থাকি; সুতরাং এ অবস্থায় সৃজনশীলতা অব্যহত থাকাই স্বাভাবিক; এবং নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ ক্রমাগত গভীর পাঠের দিকে অগ্রসর হবে বলে আমার পর্যবেক্ষণ; সংখ্যায় তা যত কমই হোক না কেন।



লেখক পরিচিতি
শিমুল মাহমুদ
কবি। গল্পকার। প্রবন্ধকার।
শিক্ষক। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ