গল্প বলা ও দেখানো

সাজেদা হক

মনে করেন, সম্পত্তির বাটোয়ারা নিয়ে দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্ব। এটুকুই বলা যায়। কিন্তু ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে এটা দেখাতে পারাটাই নৈপূণ্য। আবার রাগ বা হিংসার মধ্যে পার্থক্য আছে। বললেই চলে না, তার উদাহরণ দিয়ে দিতে হয়। বর্ণনা করতে হয়। আর এটাই দক্ষতা।

গল্প যেমন বলা যায়, তেমনি দেখানোও যায়। বলা আর দেখানো, দুটো ভিন্ন বিষয়। দুটোই গল্পের জন্য জরুরি। কোনো কম, কোনোটা বেশি। বলা আর দেখানো শব্দ দুটির মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। পাঠকপ্রিয়তা পেতে একজন লেখকের সবচেয়ে বড় দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়, তার গল্পের ধরণ দেখে। লেখকের জাতও চেনা যায় বলতে পারেন। তিনি কতটা দক্ষতার সঙ্গে গল্পটা বলছেন, নাকি দেখাচ্ছে্‌ তা সহজেই বুঝে যান সচেতন পাঠক। যে লেখক যত বেশি সচেতন ও পারদর্শী, তিনি তত সুন্দর, সহজ ও সাবলীলভাবে গল্পকে উপস্থাপন করতে পারেন।


সাধারণত চরিত্রের অনুভূতি (চিন্তা, কাজ, অঙ্গভঙ্গি ইত্যাদি) বোঝানোর জন্য গল্পকার দেখানোর সাহায্য নেন। গল্প বলার জন্য ‘পেয়েছি, খেয়েছি, হয়েছে’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করেন। কিন্তু পেয়েছি, খেয়েছি, হয়েছে কিংবা হচ্ছে না-এ জাতীয় শব্দ থেকেই কি পুরো ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়? ঘটনার বর্ণনা পাওয়ার স্বাদ মেটে পাঠকের?

উদাহরণ:

বহুদিন পর মেয়েকে ফিরে পেয়ে যেন আটকে থাকা দমটা প্রাণ ফিরে পেল বাদল। মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্খায় কাটিয়ে দেয়া এতোটা বছরের তৃষ্ণা যেন আজ মিটল। যখন জড়িয়ে ধরে মেয়ে তাকে বাবা ডাকল। কতদিন এই বাবা ডাক শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। মেয়ের মাথায় স্নেহের পরশ, আর নিজের অজান্তেই চোখের কোনে চিক চিক করছে আনন্দঅশ্রু। বাবা-মেয়ের এমন মিলনে দৃশ্য সত্যিই বিরল। এতো সুখে অনেকদিন ভাসেনি বাদল। সামান্য আনন্দঅশ্রুকে তার জীবনের সঞ্চিত সব সম্পদের চেয়েও বেশি মনে হল। মিথিলার মুখের বাবা ডাকটাই এতোদিনের সব দুঃখ-কষ্ট মিলিয়ে দিল। গর্বে ভরে দিল তার অন্তর।

কি আছে এই অনুচ্ছেদে

...উপরের অনুচ্ছেদটিতে কি প্রকাশ পাচ্ছে? নিসন্দেহে আবেগ। অনুভূতির প্রকাশ প্রকট। মেয়ের বাবা ডাকে বাবার চোখে অশ্রু। পিতা-কন্যার সম্পর্কের নতুন মোড়। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবনা, অতীতের গ্লানি থেকে মুক্তি, সবই আছে। কিন্তু সবশেষে বাদলের এই যে অনুভূতি ‘সারাজীবনের কষ্ট ভুলিয়ে দিয়ে গর্বিত করল মিথিলা-- এর কি খুব বেশি দরকার আছে?

মিথিলার বাবা বরণের এই যে দৃশ্য, এটাতে গর্ব অনুভব প্রকাশের খুব বেশি প্রয়োজন আছে কি? এটিকে গল্প লেখার ব্যাকরণে বলা হয় আরইউই (রেসিস্ট দ্য আর্গু টু এক্সপ্লেইন), অর্থাৎ বর্ণনা করার সীমাবদ্ধতা। তাই লেখার সময় এই সীমাবদ্ধতার কথা মনে রাখতে হবে প্রত্যেক লেখককেই।


অতিরিক্ত বর্ণনা

অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। হোক সে বলা বা বর্ণনা কিংবা দেখানো। তাছাড়া পাঠক তো আর বোকা নন। কেউ চালাকি করার চেষ্টা করলে তারা খুব সহজেই তা ধরতে পারেন। তাই কোন কিছুর অতিরিক্ত প্রকাশ বা প্রকাশের ধরণ আপনার গল্পের গতি কমিয়ে দিতে পারে।

উদাহরণ:

দম আটকে গর্তের মধ্যে কোনমতে বসে আছে করিম। কোন শব্দ করছে না। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছে না সে। সঙ্গে থাকা রহিমের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, চুপ, শব্দ করিস না। দাঁত মুখ শক্ত করে গর্তের দেয়াল ঘেঁষে সেঁটে থাকল। মনে মনে ভাবতে লাগল, এই বুঝি তার জীবনের শেষ ক্ষণ। আর পৃথিবীতে বেঁচে থাকা হবে না তার। মনে পড়ে গেলা ছোটবেলার সেই সোনাভানের মুখ। তার হাসি, মায়াময় চোখ, বাকা চাহনি, আর সেই দুরন্তপনা। মনে পড়ে গেলো সোনাভানকে নিয়ে তৈরি কবিতার কথাও। এখন আর ভয় পাচ্ছে না করিম। বাতাসে এখন সোনাভানের ঘ্রাণ। করিম সেই ঘ্রাণে বুঁদ। নির্ভয়ে দম নিচ্ছে করিম। আহা! তার সোনাভান, কোথায় ছিল এতোদিন।



এই অনুচ্ছেদের ভুল

কোন কোন ক্ষেত্রে ভয় প্রকাশের এটি একটি উত্তম অনুচ্ছেদ। করিমের অঙ্গভঙ্গি, চিন্তার ব্যপ্তি, অনুভুতি-অনুভবের স্মৃতিচারণ- মন্দ না। কিন্তু পাঠক হিসেবে আপনার মনেও কি খটকা লাগছে না। মনে হচ্ছে না, এটা বাড়াবাড়ি। আপনার কি মনে হচ্ছে না, এতোটা লেখার আসলে এখানে দরকার নেই। ঠিক ধরেছেন, আসলেই অতিরিক্ত হয়ে গেছে বেশি। এটাকে বলে অতিরিক্ত নাটকীয়তা। লেখক হিসেবে এটা করা থেকে অবশ্যই দুরে থাকতে হবে।



উক্তি লিখবেন যেভাবে

আপনার চরিত্রকে উক্তির সাহায্যে প্রকাশ করবেন কিভাবে? ভেবেছেন কখনও? কারণ এটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। উক্তির মাধ্যমে খুব সহজে পাঠকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা যায়, করতে পারেন। কারণ উক্তি হলো আপনার চরিত্রের ভাষা

ধরুন, আপনি কোন একটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, বিমানবন্দরের রাস্তাটা কোনটা এটা আপনি জানেন না। ওখানেই দাড়িয়ে আপনি পর পর কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেন, রাস্তাটা কোন দিকে? সবাই কি একই উত্তর দেবে? খেয়াল করে দেখবেন, একেক জনের উত্তর হবে একেকরকম। প্রত্যেকেই আলাদা ঢংয়ে উত্তর দেবে। প্রত্যেকের নিজস্ব একটা বলার ধরন থাকে যা সবার সঙ্গে মিলবে না। এই প্রশ্নের সাধারণ উত্তর কি হতে পারে।
কেউ বলবে--ওহ, আমি আসলে জানিনা।
 আবার কেউ বলবে--দুঃখিত আমার জানা নেই।
কেউ আবার বলবে--না, আমার কোনো ধারণা নেই।
আবার কেউ কেউ বলবে--না, ভাই, আমি জানিনা, আমিও এই এলাকায় নতুন।
কেউবা বলবে--জ্বি জানি, এই পথে যান।
এমনও হতে পারে, কি পারে না? সুতরাং আপনার চরিত্র কিভাবে বলে তার উপর নির্ভর করবে উক্তি কি হবে। আর এই বলাটা নির্ণয় করতে লেখক হিসেবে কিছু কৌশল মনে রাখতে পারেন।


১. উক্তিকারীর ভৌগলিক অবস্থান

২. উক্তিকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা

৩. উক্তিকারীর বয়স

৪. উক্তিকারীর ব্যক্তিত্ব

৫. উক্তিকারীর সম্পর্ক (বন্ধু-বসের সঙ্গে একইরকম উক্তি হবে না, যেমন এক হবে না বউ-বোন-বান্ধবীর সঙ্গে উক্তি)

৬. উক্তিকারী কোন চরিত্রের অধিকারী।

চরিত্রের মুখে ভাষা দেয়ার আগে এই বিষয়গুলি মনে রাখলে লেখকের জন্য সহায়ক হবে। তারপরও চরিত্রগুলোর মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য যোগ করতে পারেন। যা চরিত্রটির উক্তিগুলোকে পাঠকপ্রিয় করে তুলবে।

১. চরিত্রের শোনার অভ্যাস

২. চরিত্রের বোঝার অভ্যাস

৩. চরিত্রের স্থিরতা, বলিষ্ঠতা

৪. চরিত্রের স্পষ্টবাদিতা।

এসবই আপনার চরিত্রের মুখের ভাষা হয়ে বের হবে উক্তির মাধ্যমে আরো বেশি প্রাণ পাবে চরিত্র।


কিভাবে বিরক্তিকর উক্তি থেকে মুক্তি পাবেন?

অনেক সময় এতো বেশি উক্তি থাকে যে মুল গল্পই হারিয়ে যায়। বিশেষ করে টিভি নাটক বা সিনেমায় এমনটা বেশি দেখা যায়।

উদাহরণ:

আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানিনা। তারপরও ফোনালাপটা শেষ হলো এভাবে:

আমার মনে হয় পুলিশ ওখানে গিয়েছে?

ঠিক আছে, আমি বিষযটা দেখছি

পারবেন হ্যান্ডেল করতে”। গ্রেট

হ্যা, দেখছি।

ওকে, অনেক ধন্যবাদ।

অ্যানিওয়ে, আমাকে আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে।

ওকে, ঠিক আছে তাহলে পরে কথা বলি

ধন্যবাদ

আবার দেখা হবে।

ঠিক, আগামী শনিবার

হুম, ওইদিন ঠিক ছয়টায় এখানেই থাকবো আমরা।

দেখা হোক আবারও।

হুম।

এটা কি।

কিছু না

ভাবলাম, কিছু বললেন বোধ হয়।

না, না। তেমন কিছু না। গলায় কি যেন জমে ছিল ওটা পরিস্কার করছিলাম।

শ্লেষা মনে হয়

হুম।

এনিওয়ে।

এভাবে লিখতে থাকলে পাঠক আপনার উপন্যাস আর বেশিক্ষণ পড়বেন না। ভাল উক্তিও কিন্তু সৃষ্টিশীলতার অন্যতম ক্ষমতা। এখন ভাল লেখকই অসাধারণ সব উক্তির স্রষ্টা বা কারিগর।



কেন উক্তি ব্যবহার করবেন?

১. পাঠককে আপনার চরিত্রের ভাষার সঙ্গে পরিচিত করাতে উক্তি ব্যবহার করবেন।

২. গল্পে যখন উক্তি মুল বা প্রয়োজন তখন অবশ্যই উক্তি ব্যবহার করবেন। (যেমন বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে নায়ক নায়িকা। অচেনা পথ, অজানা জায়গা..তখন তো কথা বলতেই হবে।

৩. দৃশ্যের বর্ণনায় উক্তি ব্যবহার করুন।

অন্যসময় উক্তি শুধুই সুযোগ নয়, বরং উক্তিকে গুটিয়ে আনার একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে। যেমন:

.........এভাবে কত যে নাম না জানা বিষয বলা শুরু করলো ময়না। সে বলা যেনো থামেই না। কেবলি বয়ে চলে, বলতে বলতে সন্ধ্যা-রাত-ভোর হয়ে যায়, তবুও বলা থামে না ময়নার।



উক্তি লেখার পাঁচ নিয়ম

অনেক সময় কথার খাতিরে কথা বলা হয়ে যায়। দীর্ঘ হয় উপন্যাসের পাতা। কিন্তু ফলপ্রসু ছোট বাক্য বা উক্তিই যথেষ্ট। কিভাবে বাস্তবসম্মত উক্তি লেখা যায় তারও কৌশল আছে। এবারের আলোচনা তা নিয়েই।

১.উক্তিকে তথ্যকেন্দ্র বানাবেন না: অনেক লেখক উক্তিকে তথ্যকেন্দ্র বানিয়ে ফেলেন। যেমন: আপনি তো জানেন, মিস্টার পলাশ একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তাই আমি হৃদয়য়কে নিয়ে যাচ্ছি ওখানে। উনি প্রয়োজনীয সব ব্যবস্থা নেবেন। আপনাকে আর টেনশন করতে হবে না।---এমনটা করা কি ঠিক?



২. খুব সাধারণ উক্তি যুক্ত করুন: সে বলল, তিনি বললেন, তারা বলল এই ধরণের কিছু সাধারণ উক্তি ব্যবহার করুন। উক্তি সাধারণ হলেও ব্যবহারে হতে পারে অসাধারণ।

৩. আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ উক্তির সাহায্য নিতে পারেন। আপনার নায়ক ভালবাসি বোঝে, কিন্তু বলতে পারে না, তাহলে বলান। আপনার নায়ক ব্যথা পায়, কষ্ট পায় কিন্তু বোঝাতে পারেনা, তাহলে তাকে বোঝানোর সুযোগ দিতে তার মুখে উক্তি যোগ করুন।

৪. কখনও কখনও ভাবার চাইতে বলাটা জরুরি হয়ে পড়ে। তখন উক্তি যোগ করতে পারেন।

৫. সতর্ক হোন: উক্তি তো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ব্যবহার করার আগে একটু সতর্কতা জরুরি। আর একজন স্বার্থক, দায়িত্বশীল লেখক হিসেবে এটা আপনার দায়িত্বও বটে।



লেখক পরিচিতি
সাজেদা হক
ঢাকা। বাংলাদেশ।
অনুবাদক। প্রবন্ধকার। সাংবাদিক।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ