গল্প বিষয়ক গদ্য
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
গল্পের জীবনকথা
গল্পস্রোতের প্রক্রিয়ায় নিমজ্জিত থাকে মানবসম্প্রদায়। এক অর্থে সভ্যতার তীক্ষè প্রকাশই গল্প, জীবন মানেই কতিপয় গল্পের সমাহার। এমন জীবন কি আছে যেখানে গল্প নেই? এমন আলো-বাতাস, জল-হাওয়া, নিসর্গ, ছোঁয়াছুঁয়ি কোথায় আছে যেখানে গল্পের মিনিমাম পরশ নেই? গল্পেই জয়, গল্পেই লয়, আবার গল্পেই ক্ষয়। গল্প’র ইতিহাস বলে, গল্প কার্যত নিজের থাকে না; ধর্মে, মিথে, রূপকথায়, শৈশবের স্মৃতিতে তা এক কার্যকর পদ্ধতি হয়ে বিরাজ করে।
জীবন কিন্তু গল্পের এই ধারদেনার ভিতর দিয়েই বাড়তে থাকে। অতঃপর মানুষের ভিতর আলাদা আলাদা গল্প সৃজিত হয়। জীবনের প্রকাশে, অপ্রকাশে, সরবে, নীরবে, আমাদের প্রাত্যহিক অস্তিত্বে, গল্প মিশে থাকে। কখনও কখনও গল্প নৈঃশব্দ আর নির্জনতার সাথী হয়, তখন বলা যায়, জীবনের গল্প কখনও কখনও কে না গোপন করতে চায়।
আমরা যে প্রযোজিত গল্পের কথা বলি, তাতে আধুনিক প্রযুক্তির দাপট, দায়িত্ব, তৎপরতা আছে। ইলিয়াস যে গল্প মরে যাওয়ার হতবিহ্বল অনুভূতি জানিয়েছেন তা নিতান্তই প্রযুক্তি-সুবিধা-পাওয়া একধরনের শৈল্পিক ব্যবস্থাপনার সঙ্কটজনিত বহির্প্রকাশের নাম। গল্প সম্পর্কীয় তার এ ভাবনা মূলত একধরনের উৎপাদন ব্যবস্থাপনার যান্ত্রিক সঙ্কটেরই অংশ। তবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, যে গল্প মানুষের সভ্যতা নির্মাণের সমান বয়েসি তা মরে যাওয়ার কোনো সিস্টেমেই পড়ে না। কাজেই তার আশঙ্কার সাথে একমত হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন দেখি না।
যে গল্পভাবনা আমরা নির্মাণ করতে চাই, বা, বাসনা রাখি, তাও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার ভিতর এক কাঠামোকেন্দ্রিক আয়োজনই। এখানে গল্পভাবনার সাথে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপালিত বা অ-পালিত ভাষা, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, সাংবিধানিক আয়োজনও চৈতন্যে রাখার প্রয়োজন আছে। আমরা যখন একটা সনাতন রীতিকে স্বীকৃতি দেবো বা এর আচারনিষ্ঠাই নিজেকে সঁপে দেবো, তখন সমাজ-রাষ্ট্রের যাবতীয় বদমাইশি, লুচ্চামি, অব্যবস্থাপনারও অংশ হয়ে যাব। একটা শান্ত-সুশীল রাষ্ট্রও তাই কামনা করে। রাষ্ট্রের যত শাখা (নান্দনিক, অ-নান্দনিক, শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর অংশীদারিত্ব) আছে এর সবই বাসনার ভিতর তা-ই রাখতে চায়। রাষ্ট্রের পালিত চিন্তাবিদ, চাকুরে, ভাষাবয়নের প্রফেসরসকল তাই হাড়ে হাড়ে কার্যে পরিণত করেন। এর ভিতর একজন গল্পকারের ভাবনা কী ধরনের হতে পারে? উত্তর অতি সহজ-- যে ধরনের বাসনা তিনি লালন করেন তাই তার গল্পভাবনার বিষয়। সেই ভাবনায় শুধু গল্প তৈরির কাঠামো, ভাষার প্রয়োগ বা ম্যাসেজই বিষয় নয়, গল্পকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় সেটাও বিষয়।
মানিক, কমলকুমার, ইলিয়াস, হাসান, কায়েস, মাহমুদুল হক, সুবিমল, বাসুদেব, জহির, মনিরা, কাজল, সেলিম, মামুন--এরা গল্পথ্রোতে ম্লান-মলিন, অথচ আগ্রাসী রাষ্ট্রের সাথে, সমাজে প্রচলিত ধারণার সাথে সতত একটা বোঝাপড়া করতে থাকেন। কথাসাহিত্যের মাধ্যমে তা আমাদের মনোজগতে একধরনের প্রতিক্রিয়া তারা ভ্রাম্যমাণ রাখতে পেরেছেন। আসলে এ কাজের ভিতর, ধারণার বা একধরনের অসহিষ্ণুতার ভিতরই নানামাত্রার নান্দনিক প্রয়াস চলে। তাহলে গল্পকারের মূল বোঝাপড়া তার আশপাশে দেখা জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র-এর সাথেই হয়, যা একধরনের ক্রিয়া চালু রাখে। মননে তারই ছায়া-প্রতিচ্ছায়া ফেলে যেতে থাকে। একজন গল্পকার তো এই জগতের, এই চারপাশেরই মানুষ। তার যে মানসিক ক্রিয়ার প্রকাশ তা তো সবকিছু দেখার ভিতর থেকেই জারি হয়? নাকি এর ভিতরে, বাইরে, আড়ালে, সামনে কোনো অহি নাযেল হওয়ার ফলে মানবজাতিকে (অন্তত শিক্ষিত সাহিত্যপিপাসু পাঠকের সামনে) তা উপহার দেন? না, ফলত তিনি যা করেন, বা, করতে সচেষ্ট হন, তা তার চারপাশে দেখা বিষয়-আশয় থেকেই উঠে আসে-- তাতে তিনি অবগাহন করতে বাধ্য হন।
সুশান্ত মজুমদার একবার গল্পনির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনার শিরোনামই দিলেন 'হাত বাড়ালেই গল্প মেলে'! তার এ উদ্ভাসিত শিরোনামে আমি বড়োই বিমোহিত হয়েছিলাম। আরেকবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল- লোকাল বাসে চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটের দিকে যাচ্ছি, যাচ্ছি তো যাচ্ছিই; কিন্তু মানুষের গরমে, ভিড়ে ক্রমাগত ঘেমে-নেয়ে উঠছি আমি। এর ভিতর দুই-তিনজন দৌড়তে দৌড়তে কোনো রকমে বাসে উঠছিলেন। এদের একজন বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছেন। বাসের ভিতরের একজন বলছেন, ওই হালার পুত, সাবধানে থাহিস, হাত ছুটলে কিন্তুক ভর্তা অইয়া যাইবি। পাশের জন বলছেন, আরে দুরু, মাঙ্গির পুতের কিচ্ছু অইতো না; এরে আল্লাই চাইনিজ কুড়াল দে কুবাইয়া কুবাইয়া বানাইছে। এই বেজান দুঃসময়েও আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম! এই দেশ, এই মাটি, এই চলমানতায় কী ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর বাস্তবতার গাঘেঁষে চলি আমরা, এখানকার সৃষ্টিকর্তাও (!) যেন আলাদা। এরই তাপে আমি আরও ঘামছি, শূয়রের মতো ঘাম ছুটছে আমার শরীরে, যেন ঘামের রায়ট বয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু যেন নীরবে আমার অস্তিত্বে বাসা বাঁধছে। এরই ফলে আমার চৈতন্যে এক আঁধার নামে, সেই আঁধার থেকে বাঁচার মানসেও গল্প হয়। এই যে জীবন আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, জীবন বদলে যাচ্ছে, ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়ছে, তা গল্পের কোন্ স্থলে জায়গা দেবো? আমরা যে গল্পের ধারাক্রমের ভিতর আছি তা কি এই জীবনকে পষ্টাপষ্টিভাবে দেখছি তা কি ধারণ করতে পারছে বা করছে? যে জীবন আমাদের কথকতার ভিড়ে চালু আছে, তা নির্মাণের জন্য নতুন প্রকরণ, ভাষাভঙ্গি বা নীরবতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। কলকাতার উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতিতে জারনকৃত যে শিক্ষিত সজ্জনের ভাষায় আমরা আমাদের প্রাত্যহিকতা নির্মাণে ব্রতী হই, তার ঘষামাজা দরকার। গল্পশৈলীর পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। একটা সময়ে ধরে নেয়া হতো, কাব্যিকতায় সাহিত্যের মৌলস্বর, কিন্তু তা স্থলে যে গদ্য আমরা পেলাম তা কিন্তু সাধুভাষায় চালু থাকল। পরবর্তী সময়ে চলিত ভাষার কাঠামো গদ্য, পদ্যের জায়গা-জমিন দখল করতে থাকল। এতে আবার উপনিবেশ, আভিজাত্য, উচ্চবর্ণীয় হিন্দুত্ব আসন গেড়ে বসে। জীবনকে একেবারে জীবনের রূপ-রস-গন্ধে দেখার জন্য এই ভাষায় আর কাজ হয় না, যেন ভাষার এক কম্পেক্টনেস আমাদের সহজতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখছে।
এই যে জীবনকে চেখে চেখে দেখে গল্পনির্মাণের প্রচেষ্টা, তা কি চাইলেই হয়ে যায়? এর জন্য নেশা, শ্রম, বিপুল আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে। নিজেকে ক্রমাগত নান্দনিক-ঘষামাজার একটা বিষয় এখানে অবশ্যই আছে। এখন আমরা যে জীবন দেখছি-- হুলস্থূল লুটপাটের এক মহড়া, দখলের রাজত্ব, হামলা-মামলার সংস্কৃতি চালু করে রাষ্ট্রীয় জীবন নির্মাণের যে প্রয়াস দৃশ্যমান হচ্ছে, তাতে একজন সৃজনশীল মানুষ হিসাবে, একজন গল্পকার কিভাবে ফেইস করবেন? অবশ্যই তিনি এর সমগ্র বিষয়কে একেবারে ভিতর থেকে চিনেই তার কথনকে প্রবহমান রাখবেন। এই যে কর্পোরেট পুঁজির দাপট আমরা দেখছি; মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে রুরাল ইকোনোমিকে আয়ত্তে রাখার এক মহাযজ্ঞ এনজিও নামের বিশাল দানব চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে গল্প নামের সাহিত্য মাধ্যমটি কিভাবে তা মোকাবেলা করবে? এই ক্ষেত্রে আবারও ফিজিক্যাল স্টোরির কথা মনে পড়ে। এ গল্প দানবের বিপরীতে প্রত্যক্ষভাবে যেন প্রতিদানব তৈরি করবে!
গল্পের সৃজনশীলতা একজন গল্পকারের নিজস্ব ব্যাপার। তবে এইটুকু বলা যায়, আমাদের সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, বা সামাজিক ইতিহাস এখন আর প্রথাগত পুতুপুতু কাহিনী নির্মাণের জায়গায় নাই। ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার কলাকৌশল সেই কবেই সমাপ্ত হয়েছে বলে আমি ধারণা রাখি। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো প্রাণই ছোট নয়, কোনো ঘটনাই ছোট নয়, আর শেষ হয়েও হইল না শেষ ধরার কোনো কারণ নাই। জীবনের প্রবহমানতা এত তীব্র যে শেষ অশেষের পার্থক্য করা মুশকিলই। আরেকটা কমন অভিেেযাগ, এখনকার গল্পে গল্প থাকে না। কথা হচ্ছে, গদ্যকবিতায়ও যেমন ছন্দের একটা ব্যাপার কোনো না কোনো থাকেই, তেমনি গল্পহীন গল্পেও গল্পের একটা রূপ থাকেই। এ-ক্ষেত্রে কোনো একজন গল্পকার যদি খামখেয়ালি করে-টরে যাচ্ছেতাই লিখে যান তার কথা বাদ দিলে সব গল্পেই একটা গল্প অবশ্যই থাকে। একজন পাঠকের সৃজনশীলতায় যেমন আমাদের আস্থা আছে, তেমনি পাঠকের যুতসই প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার কিন্তু থাকা উচিত। কাজেই পাঠক-লেখক সমস্যার সমাধানে একজন পাঠকের দায়বদ্ধতাও কম নয়।
রাষ্ট্রের নিজস্ব গল্প থাকে, থাকে ভাষা, ভাষাবিদ, ভাষার কারিগর-প্রতিষ্ঠান। আছে রাষ্ট্রপালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাঙলা একাডেমী, নানান প্রতিষ্ঠান, হেনতেন... এর বুদ্ধি থাকে, থাকে গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী। কিন্তু জীবনেরও জীবন থাকে, সৃজনের থাকে পুনঃসৃজন। প্রতিষ্ঠানের পণ্যসাহিত্য যেমন থাকে, এর পাল্টাসাহিত্যও থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের কারও কারও গল্পভাবনায় তা আছে। সেই ভাবনারই লালন কেউ কেউ করেন। আমরা সেই লালনকরণকেই স্মরণে রাখি। একজন গল্পকার গল্প কেন লেখেন; এ বিষয়ে খুবই সহজ ধারণায় বলা যেতে পারে, এর সঙ্গে গল্পকারের একটা মানসিক আয়োজন নিশ্চয় থাকে-- মানবিক আকাঙ্ক্ষা তাতে মিলমিশ খায়। এ নিয়ে অনেক ধরনের ভাবনার কথা বলা যায়। গল্পকার মানসিক অস্থিরতা থেকে রিলিফ নেয়ার জন্যই হয়ত-বা শব্দের পর শব্দ বসাতে থাকেন। একজন গল্পকারের কাজটি কী, কথিত বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চাই তিনি শুধু করবেন? পাঠকের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক গড়ে তুলে সামাজিক বোধও তো তিনি তৈরি করবেন। নাকি গল্প-গল্প খেলায় ক্রিয়েটিভ জার্নালিজমের অংশীদার হবেন তিনি? আধুনিকতার উত্তরণের নামে চলমান সাহিত্যকে অস্বীকার করারও কোনো জো নেই। অনেককিছুর পরেও এ কথাটিই বলা যায়, একজন প্রগতিশীল লিখিয়ে অনবরত লেখক-পাঠকের সঙ্গে তার প্রগতিশীল বোধের বিনিময় ঘটাবেন। এটাই হতে পারে একজন শুদ্ধতম গল্পকারের প্রধান কাজ।
একটা স্বপ্ন তো সবার ভিতরই, বিশেষত, সৃজনশীল মানুষের ভিতর লালন করা হয়। একটা সময়ে আমার গল্প ঘামে ভিজে ভিজে, রক্তাক্ত হতে হতে বন্ধননহীন কিংবা কামের মুক্তচিত্ততামুখর অগাধ সাগর পাড়ি দিতে চাইত। গল্পের সারাশরীরে ছিল লাল ঝাণ্ডার মাখামাখি। এখনও এমন স্বপ্নময় স্বপ্ন আমার আছে। প্রগতিশীলতায় রক্তজ তাড়নায় তা বেগমান করার বাসনাও আছে। রাষ্ট্র এক নিপীড়নকামী দ্বন্দ্বের সামষ্টিক প্রয়াস। রাষ্ট্র মানেই কোনো না কোনো দিকে নিপীড়নের একটা ক্রিয়া বজায় রাখেই। এমনকি সমাজবাদের রাষ্ট্রীয় আয়োজন সর্বহারার একনায়কতন্ত্রেও তা কোনো না কোনো ফর্মে চলু থাকে। ফলে মনে হয় গল্পের শরীরে সর্বহারার গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার সাধ রাখা বাঞ্ছনীয়। গণতন্ত্রের একটা ধরন না থাকলে, অন্তত সমাজবিকাশের এক স্তর পর্যন্ত তা না-থাকলে স্বৈরাচারের বিস্তার অতি সহজ ঘটনা সেখানেও দৃশ্যমান হয়। তা কিন্তু আমরা প্রগতিশীল রাষ্ট্রনৈতিকতার ক্ষেত্রে এমনটি দেখেছি।
রাষ্ট্র কতক রুল জারি করবেই। আমার স্বপ্নে আমার গল্প এমন এক রাষ্ট্রের সহায়ক (অতি ক্ষীণ আকারে হলেও) যেখানে পুলিশ, র্যাব, মিলিটারি বলতে কিছুই থাকবে না, স্বতঃস্ফূর্ত খাদকও তার সহজাত কর্মের বিনিময়ে সুষম খাবার পাবে, সবচেয়ে বিজ্ঞানমুখর জ্ঞান থাকবে তার একেবারে নাগালের ভিতরে, নান্দনিক সমস্ত আয়োজনের সে হবে গণতান্ত্রিক অংশীদার, সৃজনশীলতার প্রতিবন্ধক বলতে কিছুই থাকবে না, যৌনতার প্রতিভাময় বিকাশ হবে নাগরিকের স্বভাবজাত অধিকার, প্রতিটি উপাসনালয় হবে বিজ্ঞান আর সৃজনমুখরতার পাঠাগার, রাষ্ট্র ক্রমশ রাষ্ট্রহীন হওয়ার প্রবণতায় লিপ্ত হবে, সমকালে আগামীকাল দেখার কামনা জারি হবে। এই ব্যবস্থার সহায়ক হিসাবে, ভাষাগত পরিবর্তনে, লৌকিক দিক থেকে, গল্প হবে নিত্যউদ্ভাসিত এক কর্ম।
গল্প কখন লেখা হবে, কেন লেখা হবে, গল্প না লিখলেই বা কী হয়! কার জন্যই বা সৃজনব্যবস্থাপনার এসব প্রশ্ন অনবরত ঘুরপাক খায়? প্রথমত একজন গল্পকার সম্পূর্ণ নিজের জন্যই লিখে থাকেন। কারণ লেখাটির ভিতর দিয়েই তিনি প্রমাণ রাখেন, তিনি এক ক্রিয়ার ভিতর থাকেন-- এটি না লিখে তিনি যেন পারছেন না। কারণ এটি তার জন্য একটা সৃজনউন্মুখ কাজ। দ্বিতীয়ত, কার জন্য লেখেন, তাও নিজের জন্যই তিনি লিখে থাকেন। কারণ এর প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠকও তিনিই। অন্তত এটি লেখার কালে এর পাঠক তো গল্পকার নিজেই। তারও পর এটি কার জন্য লেখা হয়, তখন আসে পাঠকের প্রশ্ন। কারণ তিনি তো এটি সমাপান্তে বালিশের তলায়, আলমারিতে বা ট্রাঙ্কে গচ্ছিত রাখেননি। এবং তিনি যখন তা সর্বমহলে প্রকাশ করলেন তখন তিনি আর এটির সর্বময় স্বত্ব দাবি করতে পারেন না। এমনকি এর ভিতর গচ্ছিত বা চলমান সৃজনশীলতার একক দাবিদারও আর তিনি থাকেন না। তখন পাঠকের ক্ষমতায়, পাঠে, এমনকি এর স্বাধীন প্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধাও ওই লিখিয়ের প্রকাশ করা উচিত।
গল্পটি তখনই লেখা হয় যখন আর এটি না লিখে একজন সৃজনশীল মানুষটি হয়ত থাকতে পারেন না। এটি লেখকের প্রকাশের একটা অন্যতম বা অতি দরকারি মাধ্যম বলেই তিনি তা লিখে থাকেন। নিজের তাড়না, প্রেরণা বা চৈতন্যকে তিনি প্রকাশ করেন, অন্যকে প্রভাবিত করেন বা না-ই করেন, তা তিনি করে যান এবং তার ভিতর দিয়ে মানসিক শুদ্ধতার বিকাশ ঘটান। একটি গল্পপাঠে একজন পাঠক যখন আর স-ভাবনায় থাকেন না, বা থাকতে পারেন না, তখনই একটা গল্প সার্থক গল্প হয়ে ওঠে।
গল্পের মরণ-জীয়ন
গল্প'র মরা-বাঁচা নিয়ে ইদানীং ম্যালা কথা শোনা যায়। এর করণকৌশল, থিম, প্লট, শিল্পরূপ ইত্যাদি কেমন হচ্ছে বা হওয়া উচিত--সেসবের গবেষণার শেষ নেই। তারচেয়েও অধিক শোনা যায় গল্পের ভাষাটা আসলে কেমন হবে? এ নিয়েও তো কথাবার্তার শেষ নেই। গল্প মরা-বাঁচার বিষয়টা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না, কারণ জীবনের সমান যার প্রসারত্ব ওই গল্প নিয়ে অত ভাবাভাবির কী থাকতে পারে! জীবনকে উচ্ছ্ব্াসবহুল, রোদনমুখর কিংবা টেনশনবহুল, রক্তাক্ত হাহাকারে ভরিয়ে দেয়ার বিষয়াবলী জীবনের সর্বাঙ্গের সাথে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। তবু এ নিয়েও কথা হতেই পারে। হাজার ঢঙে বক্তিমা দেয়া যায়। গল্পের ভাষা কেমন হবে, এর ব্যাপকতা বা বিশালতা কী করে প্রকাশ পাবে তা নিয়েও তো তুমুল কথাবার্তা চলতেই পারে।
গল্প'র জলজ্যান্ত-রূপ নিয়ে কথার অন্যতম কারণ হচ্ছে জীবনের লাগাতার দ্বন্দ্বময়তার সাথে এর সম্পর্ক কি হবে এর প্রকাশ্য রূপ কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় তা জানা; এও বলা হয়, গল্প ক্রমাগত এক নির্মাণের নাম। হয়ত তা প্রখরতারও নাম, নির্জনতার নামও হতে পারে; যাতে ব্যক্ত হয়, কিংবা শোনা, বলা, দেখা যায় নিজের, সমাজের এমনকি রাষ্ট্রের বাস্তবতাকেই। গল্পনির্মাণ বা কথ্যগল্প চালু থাকা এক চলমান প্রক্রিয়া, এখানে গল্প বাঁচার বা মরার প্রশ্নই নয়। আমরা যে গল্প মরে যাওয়ার কথা বলি, বা যার ভাবে-ভাবে জারিত হই, তা আসলে মুদ্রিত গল্পের বাঁচা-মরা নিয়ে কথা বলাবে অন্যকিছু নয়। এর সাথে জীবনের সামগ্রিকতা প্রকাশ পায় না, সেই সামগ্রিকতার গল্পও অনুপুঙ্খভাবে থাকে না, থাকে না মধ্যবিত্তের সর্বময় চালচিত্রও। গল্প নানান ভাবে জীবনের সাথে মিশে আছে। নানান সময়, সামাজিক বিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থা, ধর্মীয় আবহন ইত্যাদি নিয়েই গল্পের ঘর-সংসার-গেরস্থালি চালু আছে, চালু থাকবে। ধর্মীয় গল্পগাথার কথাই একটু না হয় দেখা যাক-- এখানে গল্পকার অনেক, গল্পগ্রন্থও অনেক। গল্পকার কর্তৃক সেই গল্প গ্রন্থিত হয়, তা মানবজীবনে প্রচার করেন প্রেরিত পুরুষগণ (প্রেরিত নারীর কোনো খবর আমার জানা নেই, সনাতন ধর্মের নারীরাও দেবতাগণের আশীর্বাদের অংশ মাত্র।)। এই গল্পকারগণ নানান ভাষায় তাদের গল্পগ্রন্থ সাজান। একজনের ভাষা অন্যজনের বোধে আসে না, বুঝেনও না। কারণ আরবি, সংস্কৃত, হিব্রু, পালি ভাষা সৃষ্টিকর্তারূপী এসব গল্পকারগণ পরস্পর বুঝবেন কি করে? গল্পকারদের বড়ো দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা। ধর্মের এই গল্প শেষ হবার কথা কি? ইলিয়াস যে গল্পের মরে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন তা কিন্তু গল্পের যে প্রায়োগিক রূপ মাত্র তা বলা যায়। এর বাইরে কিংবা অভ্যন্তরে আছে জৈবিক রূপ। এই রূপই গল্পের মাতৃকারূপটি বহন করে। গল্পের এই ধরন, কথকতা বা আকার-প্রকার নির্ধারণে মধ্যবিত্তের বোধের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। তবে কথা হচ্ছে, মানুষের বিশাল জীবন তো শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের এই থরথর কম্পনযোগে গঠিত নয়। নানান শ্রেণীর নানান কথকতা, কথার বিচিত্ররূপ এখানে প্রকাশ পাবেই। কাজেই গল্পের কথা প্রসঙ্গে এই প্রশ্নই অর্থহীন যে, এভাবে একটা শিল্পচৈতন্যের বিনাশ ঘটবে। জীবনকে দেখার যেমন শেষ নেই, তা নিয়ে কথা বলা বা গল্প করারও শেষ নেই।
গল্প বলা, শোনা বা তা লেখার দীর্ঘমেয়াদী এক ইতিহাসই আমরা বহন করি। এমনকি এর প্রখরতা, সজীবতা কিম্বা নীরবতার অংশ হয়ে আছি। গল্প জীবনের সাথে মিশে থাকা এমনই জান্তব বিষয় যে এর থেকে যেমন আমরা বাইরে থাকতে পারি না, তেমনি এর গায়েবানা জানাজা পড়াও সম্ভব নয়। কারণ গল্পের প্রবহমানতা জীবনযাপনের মতোই সত্য বিষয়। সাহিত্যের অন্যসব বিষয়-আশয়ের মতো গল্পও কবে থেকে শুরু হল, এ প্রশ্নও অবান্তর। আকস্মিকভাবে তো শিল্পমাধ্যম হিসেবে তা পূর্ণতা পায়নি। গল্পের কথন, অকথনের নানান রূপ যেমন আছে, তেমনি আছে এর ইতিহাস-ঐতিহ্য। সমাজে, রাষ্ট্রে এর প্রবহমানতার ধরন যেমন আছে তেমনি আছে নানান বাঁকে এর বেড়ে ওঠার ইতিহাস। গল্প যখন মানুষের মুখে মুখে চলাচল করত তখন এর ভিতর যাপিতজীবনের অনুষঙ্গ আর রূপকথার আদলটাই ছিল মুখ্য। এসবের সাথে লোকজীবন একেবারে মিলেমিশে থাকত। একটা ইতিহাস তৈরি হয়। সেই গল্পকথার ইতিহাস তো আছেই। তবে সেই গল্প-আখ্যায়িকা এক্কেবারে অলিখিত পর্যায়ে এর বি¯তৃতি নির্দিষ্ট এলাকার নির্দিষ্ট জীবন-ভাবনার স্বরূপ থেকেই গড়ে ওঠে। নদ-নদী জল-জংলা ব্যাপৃত বঙ্গদেশের এ অঞ্চলে গল্পবিস্তৃতির মূল প্রেক্ষাপট আসে মানুষের উদার জমিন-নদী-ঝোপঝাড়ের জীবনঘেঁষে; কখনও আবার বৈদিকতার পরশে, এমনকি গ্রামীণ লোকায়ত ভাবনা-কৃষিজ-গার্হস্থ্য জীবনাচার থেকে। এও আমাদের স্মরণ রাখতে হয়, পূর্ববঙ্গের লোকায়ত ধরন অন্য অঞ্চল থেকে নিশ্চয় ভিন্নধাঁচের। গল্পে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে।
গল্পচর্চার সর্বময়-সার্বভৌম বিষয়টা এখনও অমীমাংসীতই। বলা যায়, এক অজানা বা জানা কিংবা অজানা-জানার এক গোলকধাঁধার ভিতরই আমরা গল্পের এক কাল অতিক্রম করছি। গল্পের চর্চা ঠিক কখন থেকে শুরু হ'ল তা নিয়ে অনেকধরনের অনেক কথা আমরা চালু রাখি। এ তো চালু থাকারই বিষয়। নিখুঁতভাবে এ প্রশ্নের মীমাংসায় আসাটা বেশ মুশকিল। এর সাথে আমরা পাই কথার ইতিহাস, মানুষের অঙ্গভঙ্গিযোগে ভাষা তথা গল্প চালু রাখার ইতিহাসও। তবে আধুনিক মানবসমাজে এর প্রায়োগিক রূপটির বিকাশ হয় ভিন্ন ধরনেরই। কারণ এর সঙ্গে মুদ্রণযন্ত্র চালু হওয়ার এবং এ শিল্পমাধ্যমটির সঙ্গে লেখাজোখার বিষয়-আশয় জড়িয়ে থাকার বিষয়টাও আছে। আধুনিক মানবকূলের কাছে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলেই গল্প তার প্রায়োগিক আর একধরনের পরিপক্ব রূপ নেয়া শুরু করে। এর সাথেই বলতে হয় লেখ্যভাষায় নানান বাঁকের নানান কল্পনার বিষয়। শব্দের পর শব্দ বসালেই তো আর হচ্ছে না, এর গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকে নৈঃশব্দ, দুটি শব্দের ভিতর নির্জনে পড়ে থাকা নীরবতার ভাষাও একজন গল্পকার কর্তৃক পাঠককে ভাবনায় ফেলতে পারে-- এমনকি অন্য লেখকের বোধেও তা নাড়া দিতে পারে। তবে এ কাজে বিবিধ যতিচিহ্ন, বাক্যের কারুকাজ, শব্দের প্রবহমানতা, এর তাল-লয় সবকিছু পাঠকের বিবেচনায় থাকাটা বাঞ্ছনীয়। তাহলে এ প্রশ্নও করা যায়-- সংস্কৃতিতে জীবনের ব্যাপকতার এইসব পরিবর্তন কী করে হ'ল? কথাসাহিত্যচর্চার বহুবিধ আচারনিষ্ঠাই-বা কী করে এল! সমাজের বিবর্তনই শুধু ভাবনায় রাখলে গল্পকথার সবকিছু বোধের ভিতর আসে বলে মনে হয় না। অন্য অনেক অনুষঙ্গের মতো নদ-নদীর এ দেশটার নানান সময়ের নানান রক্তের অনুপ্রবেশকেও ভাবনায় রাখা সমীচীন বলে মনে হয়।
গল্পের নানানদিকে বিকাশের স্তরে স্তরে এ প্রশ্নটাও অবধারিত ভাবেই আসে গল্পের কাজ কী? গল্পের ঘর-গেরস্থালির সামগ্রিক ইতিহাসের ভিতরই হয়ত এর জবাবটিও পাওয়া পায়। মানুষ তার প্রয়োজনেই এর নানানধরনের চর্চা করে। এর সঙ্গে জীবনের প্রবহমানতা, সামাজিক বিন্যাস আর দর্শনের নানাবিধ ইতিবৃত্ত কী করে যোগ হয় তাও দেখার বিষয়। এখানে এ প্রশ্নও করা যায় যে, কী করে জীবনের সার্বিক লালিত্য বা পীড়নকে একটা গল্প ধারণ করে? ছোটগল্প নিশ্চয় মুগ্ধতার স্মৃতিকে নিরন্তর ঝালাই-বাছাই করে। তবে এ প্রশ্নটিও স্বাভাবিকভাবেই আসে, গল্প তো মানবজীবনকেই কেবল বর্ণনা করে না; মানবসভ্যতার বিকাশের প্রতি একধরনের দায়িত্ববোধ প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে তো জীবনকেই ক্ষণে ক্ষণে পাঠ করা। নয় কি?
কথাশিল্পের ধারা
আমরা এই সময় কথাসাহিত্যবিষয়ক প্রগতিশীলতার নানান ধারণা একটু দেখে নিতে পারি। সাহিত্যের আইডিয়া নির্মাণের ব্যাপারে যার নামটি অধিক শোনা যায় তিনি হচ্ছেন হাঙ্গেরির সাহিত্যতাত্ত্বিক গেওর্গে লুকাচ। তাঁর মতে সাহিত্যে সমাজজীবনের সরাসরি প্রতিফলন থাকবে। কিন্তু এর সাথে থাকবে সামাজিক বস্তুনিষ্ঠ দ্বন্দ্বমুখরতা। যাপিতজীবনের চিত্রময় রূপের সাথে মিশতে হবে নিজস্ব ধারণার বাস্তবতা। এভাইে সাহিত্যের আঙ্গিক সৃষ্টি হতে পারে। তার মানে তার মত অনুসারে দর্পণ বা ক্যামেরার মতো বাস্তবের প্রতিফলন প্রকৃত সাহিত্য হতে পারে না। একজন লেখকের মানসিক ক্রিয়াশীলতা সেখানে থাকা জরুরি। ফরাসি প্রগতিশীল সাহিত্যভাবুক পিয়েরে মাশেরে সাহিত্যকে দেখতে চান উৎপাদনশীলতার প্রাপ্তি হিসেবে। তাঁর কথা হচ্ছে, সাহিত্যও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের বদৌলতে তৈরি হয়ে থাকে। এও তার দৃষ্টিতে জীবনের রুপান্তরের মতই এক ব্যাপার। সাহিত্যের নন্দনভাবনায় শুধু জীবনের প্রতিফলন নয় সামাজিক বিভিন্ন অনুষঙ্গও আসবে । এখানে একজন গল্পকার তার মেধাকে উৎপাদনশীলতার সমার্থক মনে করতে পারেন। তবে এ প্রশ্নও আসতে পারে, তাহলে শ্রেণিহীন সমাজে তো মানিক-ইলিয়াস-হাসান-কায়েস কিংবা অন্যসব সৃজনশীল কথাশিল্পীরা রাষ্ট্রীয় জীবনধারারই অংশ হয়ে যাবেন! তখন সৃজনশীলতার ধরনটা কেমন হবে? এ প্রশ্নও কেউ কেউ করতে পারেন, তখন আদৌ কি সৃজনশীল শিল্পচর্চার ক্রিয়াশীলতা সহজাত সৃজনশীলতায় বজায় থাকবে? সাহিত্যে নন্দনভাবনার জৈবিক রূপটি হতে পারে অধিক প্রাণবন্ত। এতে সামাজিক উপরিকাঠামো অর্থাৎ শ্রেণিদ্বন্দ্বময় সমাজের উপাদান-- অর্থনীতির সঙ্গে মিথ, উপকথা, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, ইতিহাসও সাহিত্যে মিলমিশ খায়। লুসিয়েন গোল্ডম্যান প্রবর্তিত এ ভাবনায় সাহিত্যে অর্থনীতিবাদী যান্ত্রিকতার প্রভাব থেকে ক্রিয়াশীল মানুষেরা অনেকটাই ভিন্ন আলোবাতাস পেতে পারেন। এখানে সামাজিক চেতনা সাহিত্যিক-আঙ্গিক নিয়ে অগ্রসর হয়। সামাজিক শ্রেণির থাকবে সামাজিক বিশ্ববীক্ষা। এভাবে সমাজভিত্তিক জীবনধারা বিকাশের ধরনটিই তার ভাবনায় ঘুরপাক খায়। তাঁর স্বাচ্ছন্দবোধটাও এখানেই। তবে তিনি তাঁর ভাবনায় লেখকের ব্যক্তিগত প্রয়াসকে অস্বীকার করতে চাননি মোটেই। আবার অ্যাডরনো মনে করতেন, শিল্প আর বা¯তবতা একে অন্য থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকে। এভাবেই শিল্পসাহিত্যের বিকাশও হতে পারে। তার ভাবনায় থাকে জীবনের শিল্পিত উদ্দেশ্য আর বাকপ্রতিমাকে তুলে ধরার প্রয়াস। জীবনকে দেখার দ্বৈত-বাস্তবতাকে তিনি এভাবেই জানাতে চান। সাহিত্যচর্চায় সামাজিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই। গল্পের সাথে রাষ্ট্রের একটা বোঝাপড়া কি নাই? অবশ্যই আছে। রাষ্ট্র একটা বড়ো প্রতিষ্ঠান, বলা যায়, সব প্রতিষ্ঠানের বাপ। আর সেই বাপের সাথে গল্পের মোলাকাত বা বোঝাপড়ার বিষয়টা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক। যে কোনো প্রতিষ্ঠানই তার সুবিধামতো নিজের নিয়ম-নীতি, আচরণ নির্ধারণ করে। প্রতিষ্ঠান গল্পকে, বিশেষত এর ভাষাকে, এর সার্বিক চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ তো করতেই চাইবে। কিন্তু প্রগতিশীলতায় ঋদ্ধ গল্প এই আচরণকে নিশ্চয়ই দ্বান্দ্বিকতায় নিয়ে যাবেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বজায় রাখবেন। রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণ যখন নিরন্তর পেষণের ভূমিকাই নামে, সশস্ত্র হয় অনবরত, মানবিক মূল্যবোধ ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে, রাষ্ট্র মানুষের জীবনের সহজ চলাচল নির্ধারণ করে দেয়, শব্দের শরীর থেকে রক্ত-ঘাম ঝরে স্বতত: তখন গল্পের শরীর থেকেও যেন রক্ত ঝরে। জাদুবাস্তবতা, স্বতঃস্ফূর্ত-প্যারালাল বাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতা, এমনকি প্রতীক-উপমা ব্যবহার এসবের ভিতর কোনটা কি করবে তার নির্ধারণ হতে পারে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিষয়-আশয়কে ঘিরেই।
গল্পের ভাষা, উপমা, প্রতীক আর এর প্রয়োগকৃত সমকালীন ভাবনাও অধিক গুরুত্ব নিয়েই আলোচনা হতে পারে। এর নন্দনভাবনায় প্রগতিশীলতার ধরন নিয়ে তা বিবিধ মত চালু আছেই। এটা ঠিক যে, একটা গল্পের প্রাথমিক পাঠক হচ্ছেন এর লেখক। তিনি বহুবার গল্পটির ভিতর চর্চিত হন। এর ভাষা, রচনাশৈলী, চরিত্রনির্মাণ, ম্যাসেজ সবই লেখককে কেবলই ভাবায়। একজন গল্পকার সেই গল্পেরই নিমগ্ন, নীরব, সরব, সরস কিংবা নিষ্ঠুর ধারণকারী। তিনি কখনও যেমন আন্দোলিত হন, রক্তাক্ত হন এমনকি হিম-ঠাণ্ডা স্পর্শে জর্জরিত হন; খা খা রোদ্দূরে কিংবা কুয়াশায় ভিজেন তেমনি জবিনঘেঁষা একধরনের নিমগ্নতা পান। এভাবেই গল্পনির্মাণের প্রক্রিয়াও চলে। জল-কাদার এই দেশে, খুনে-সন্ত্রাসের কালে, ধর্মীয় নানান নিপীড়নের ভিতর একজন গল্পকারকে মননশীল, রোদনময়, বেদনাঘন গল্প লিখতে হয়।
কেন যে গল্পসাধনা
আমরা এ প্রশ্ন করতে পারি, কিংবা এ প্রশ্নের সর্বাঙ্গে নিজেদের জারিত করতে বাধ্য হই যে, একজন গল্পকার গল্প কেন লিখে থাকেন, এ বিষয়ে খুবই সহজ ধারণায় বলা যেতে পারে, এর সঙ্গে একজন প্রায়োগিক গল্পকারের একটা মানসিক আয়োজন নিশ্চয় থাকে। স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা জিইয়ে তোলা আকাক্সক্ষা মিলমিশ খায়। এ নিয়ে অনেক ধরনের ভাবনার কথা বলা যায়। গল্পকার তার জীবনের নানান বাঁকবদলের ভিতর দিয়েই চলা একজন প্রাণী। ফলে তার মানসিক অস্থিরতা থেকে রিলিফ নেয়ার জন্যই শব্দের পর শব্দ বসাতে থাকেন হয়ত-বা। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত ধারণারও বিষয়। পাঠকের সঙ্গে একধরনের মানসিক সম্পর্ক তার গড়ে ওঠে। এর সাথে ব্যক্তির কথকতা, সামাজিক বোধ, রাষ্ট্রীয় বিষয়ে নিজেকে লিপ্ত রাখার আচরণও নির্ণিত হয়। এ তো গেল একদিক, আবার গল্প-গল্প নেশায় তার মত্ততার বিষয়ও তো থাকতে পারে। থাকতে পারে সৃজনমুখর সাংবাদিকতার অংশীদার হওয়ার বাসনা। তবে প্রতিষ্ঠানের সাথে, বিশেষ করে রাষ্টের সাথে তার সম্পর্কটিও এর থেকে উঠে আসে। উপনিবেশ, আধুনিকতা, সমাজ-বিন্যাসের সাথে তার বোঝাপড়াটাও এ থেকে বোঝা যায়। আধুনিকতার উত্তরণের নামে চালু সাহিত্যকে অস্বীকার করারও কোনো জো নেই। অনেককিছুর পরেও এ কথাটিই বোধ করি বলা যায়, একজন গল্পকার অনবরত লেখক-পাঠকের সঙ্গে তার বোধের বিনিময় ঘটাবেন। এটাই হতে পারে একজন গল্পকারের মৌল-তাড়না। এর সাথে আরও অনেক কথা উঠে আসে। মধ্যবিত্তের শিল্পচর্চা বলে কথা! কারও কারও সামাজিক অবস্থানজনিত অহং স্পষ্ট হয়ে যাওযার বিষয় এর সাথে মিশে যাচ্ছে কিনা তাও দেখার বিষয়। আবার এমন ধারণাও কারও কারও গল্পপাঠে বা চর্চায় মনে জন্ম নিতে পারে--আলগা কিছু করে-টরে দেখানোর জন্যই যেন তারা গল্প লেখাজোখার এই কর্মটি চালিয়ে যান। একজন লেখক আরাম-পিয়াসী কিছু মধ্যবিত্তকে, আরাম-আয়েশকে উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যও এতে থাকে! বায়বীয় মুগ্ধতাকে দেখার জন্যও হয়ত লেখালেখি করতে পারেন কেউ। ভুল পুঁজির ততোধিক ভুল স্বপ্ন ভরাট করার জাগতিক স্পৃহাও কারো থাকতে পারে হয়ত। মানবকল্যাণমুখী শিল্পিত ভাবনার বিষয়-আশয় কিভাবে কথাসাহিত্য তার জায়গা-জমিনে নিজের অবস্থানটি পাকাপোক্ত করতে পারে তা ভাবনায় রাখাটাও বোধ হয় জরুরি। এ তো আর নতুন করে বলারও অবকাশ রাখে না যে আমাদের কথাসাহিত্যে এমন এক শক্তিশালী ধারা আছেই। দ্বান্দ্বিক বা¯তবতা সাহিত্যে তার অবস্থান সরাসরি স্পষ্ট করতে পারে। জীবনের সমগ্রতায় এর একটা প্রভাব নিশ্চয় থাকতে পারে। এখানে কথাশিল্পীর ভাবনাও জারিত হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে সাহিত্যচর্চা তো কায়িক শ্রম নয় নিশ্চয়, এটা তো শিল্পসম্মত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই। তাহলে একজন কথাসাহিত্যিক কলমপেষা মজুর হিসেবে বোধ সৃষ্টি করবেন কী উপায়ে তা ভেবে দেখার বিষয় নিশ্চয়ই আছে। লেখার উপসর্গ যেমন সমাজে থাকে, তেমনি লেখক তো তাই জড়ো করেন। শিল্পপতি তার শ্রমহীন জীবন দিয়ে সবকিছুই যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে, সেইরকম একজন লেখকও কি তার মেধার ওপর ভর করেই নিজেকে সমাজের আলাদা দাপুটে ব্যক্তি করছেন? গল্পকথায় এ প্রশ্নও এখানে আসাটা জরুরি যে, এসব লেখালেখির প্রয়োজনই-বা কেন? সাহিত্য কি উৎপাদনমুখী কোনো বিষয়? সাহিত্য তো এক অর্থে বাজারও খোঁজে। এক-একজন সাহিত্যিক তো নিজস্ব মতের পূজারি। নিজেকে রূপান্তরও করেন তিনি। তিনি কী ব্যাপক সংখ্যক পাঠকের সঙ্গে ভাবনাবিনিময়কারী মাত্র! গল্পকার তো শুধু সমাজ বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলছেন না। তাহলে ব্যক্তির উন্মেষটা এখানে কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে হবে তাও দেখার বিষয়। সমাজ বিকাশে এ ব্যক্তি নিজেকে খুঁজে পাবেন কী করে; প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য চর্চার মানবিক বাস্তবতায় এর একটা মীমাংসাও জরুরি। পুঁজিবাদী সমাজে সমস্ত শিল্পকর্মকেই পুঁজির সাহায্যকারী করার মানসিকতা থাকে। প্রগতিশীলতার দায়বদ্ধতা নিশ্চয় পারে এ পীড়নের যথার্থ রূপ ফুটিয়ে তুলতে। এর জন্য আলাদা ধরনের ভাষাকৌশলের প্রয়োজনীয়তাও কেউ কেউ অনুভব করেন। লোকায়ত জীবন কিংবা নাগরিক জীবনের ধারণাপ্রসূত সাহিত্যে জীবন-লগ্নতা নিশ্চয়ই থাকা দরকার। সমাজবা¯তবতা থেকেই সাহিত্যে তার যথার্থ জায়গা করে নিবে। এ ক্ষেত্রে এ প্রশ্নও মনে উদয় হয়, লেখক কি প্রেরিত পুরুষ? তার ওপর ঐশ্বরিক কিছু নাজেল হয় না নিশ্চয়ই; অন্যদের মতো হয়েও কোথায় যেন কেউ কেউ আলাদা একধরনের বৈশিষ্ট্য লালন করেন।
আমরা মোটামুটি তিনধরনের গল্পলিখিয়ের সাথে পরিচিত হই। একধরনের গল্পকার শুধু তাদের নির্বাচিত লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে থাকেন। তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে এভাবে সাহিত্যসাধনাকে একটা টোটাল ব্যাপার মনে করে থাকেন। তারা সাহিত্যের বৌদ্ধিক জায়গাকেই টার্গেট করে। এই জন্যই তারা সাহিত্য সাময়িকী বা তাদের নৈতিকতার বাইরের কোনো ছোটকাগজে একটা অক্ষরও লেখেন না। এটা একধরনের সাধনা নিশ্চয়ই। আরেক ধরনের সাহিত্যজন আছেন যারা ছোটকাগজকে কোনো হিসাবের ভিতরই আনেন না। তারা সাহিত্যসাধনা বলতে বড়ো কাগজে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য কাগজকেই বুঝে থাকেন। তারা অতিশয় আরামপ্রিয় সাহিত্যমোদী। এদের অনেকেই জীবনের নিগূঢ়তার ধার ধারেন না। তারা তাদের মনোবাসনাযুক্ত পাঠককে লালন করেন। তার সাহিত্যকর্মে পাঠককে হাতছাড়া করার ভয়ে ক্ষীণতম রিস্কও নিতে রাজি থাকেন না তিনি। জীবনের নানান তীক্ষè-তীব্র, জটিল রূপ পর্যবেক্ষণে কোনো উৎসাহই বোধ করেন না তারা। মনোজাগতিকতার নিবিড় বিষয়কে তারা সততই না দেখার ভান করেন। এমনকি হয়ত বউ আর শালীর সাথে সঙ্গমের যে মনোজাগতিক সূক্ষতাতিসূক্ষ পার্থক্য আছে তাও যেন বোধের ভিতর ধরাতে চান না। সবক্ষেত্রে একটা উচ্ছ্বাসমুখর কলতান বজায় রাখতে চান এরা। তারা তাদের পাঠককূলকে আরাম সরবরাহ করতেই তৎপর থাকেন। আরেক ধরনের সাহিত্যজন ছোট ও বড়োকাগজ, এই দুই ক্ষেত্রেই তাদের সাহিতকর্মটি চালিয়ে থাকেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, সাহিত্যসাধনা মানে একধরনের নৈতিকতা নির্মাণ করে যাওয়া। আর এই কাজে যেখানে আমার স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায় সেখানেও আমার সাহিত্যকর্মটি প্রকাশ পেতে পারে। এ তো সত্যি যে, রাষ্ট্রই সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান যেখানে তার নিজস্ব অবস্থানটি বজায় রাখতে চায়। অর্থাৎ শিল্পসাহিত্যের মানবকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বড়ো শত্রু হচ্ছে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র তো অনির্দিষ্ট বায়বীয় ব্যাপার নয় যে এর অপশাসনের কথা বললেই সব শেষ হয়ে যায়। এর অঙ্গ হচ্ছে রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক সীমানা-- সেই সীমানাকে ঘিরে বজায় থাকে কতিপয় আকাক্সক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষাকেই বহাল রাখে সংবিধান, রাষ্ট্রসভা, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পড়াশোনার ধরন। এর সবই রাষ্ট্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বকে জিইয়ে রাখে। যে কোনো পত্রিকাও তো এক-একটা প্রতিষ্টান। তো কথা হচ্ছে, আমরা পত্রিকা নামের প্রতিষ্ঠানকে কি একটা সহজ নিয়মে ফেলেই বিচার করব? আমি বলতে চাচ্ছি, সব কাগজের চেহারা, আচরণ, রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক কি এক? তা তো নয়। সংগ্রাম বা ইনকিলাবের সাথে কি সমকাল, কালের কণ্ঠ, ভোরের কাগজ, সংবাদ, প্রথম আলো বা যুগান্তরকে এক করে দেখব? তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাথে সব পত্রিকা তো এক আচরণ করছে না। কোনো কোনো পত্রিকাকে তো অনেকটাই স্বাধীন এবং মানবকল্যাণমুখী-প্রগতিশীল আচরণ করতে দেখা যায়। এখন কথা হচ্ছে, আমি যদি আমার আকাক্সক্ষাকে কোনো পত্রিকার সাহিত্যপাতায় আমার মতো করে প্রকাশ করতে পারি তাহলে সেই কাগজে লিখতে সমস্যা কোথায়? আমি আমার সাহিত্যসামগ্রীযোগে পণ্যসামগ্রি হয়ে যাব কিনা সেটা তো আমার ব্যাপার। কাজেই আমার মতো করে আমার সাহিত্যকর্মটি যদি প্রকাশ করতে পারি, তাহলে সেই কাগজে গল্প লিখতে কোনো অসুবিধা তো দেখি না। লিটলম্যাগের গল্পলিখিয়েগণ অতিরিক্ত পরিমাণে বুদ্ধিবৃদ্ধিক অবস্থানেই থাকতে চান। তারা জ্ঞানযোগী, বুদ্ধিনির্ভর শিল্পবোদ্ধা। তারা সরস্বতীবাদী। তারা মূলত মেধাবহুল কথকতাযোগে সমাজ-রাষ্ট্রকে ঝাঁকি দেয়ার নানান পদ্ধতি নিয়ে সারাক্ষণ উত্তেজনা বজায় রাখেন। প্রথাভাঙার দুর্দদমনীয় স্পৃহা তাদের আছে। তবে তা মাঝে মাঝে নির্দলীয় নিরপেক্ষ, অনেকটা অবয়বমুক্ত উত্তাপে ভরপুর থাকে। কথাক্রমে জানাতে হয়, সনাতনধর্মের বিশ্বাসমতে ব্রহ্মজ্ঞান থেকে ব্রাহ্মণের পয়দা। মানুষের সর্বাঙ্গ চিন্তা করলে এর মাথা, হাত, ধড়, পা থেকে যথাক্রমে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, শূদ্র। সেই হিসাবে লিটল ম্যাগের গল্পলিখিয়েরা ব্রাহ্মণ্যবাদী। কিন্তু হাত, ধড় আর পদযুগল ব্যতীত মানুষ পূর্ণ হয় কি করে? তারা যতই প্রথা, চলতি রীতি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলুক, এসবকে টোটাল ব্যাপার বলে চিন্তাফাল্লা বা গালিগালাজ করুক, আমরা অতি সাধারণ পাঠকরা কিন্তু সেই টোটালিটিকে কোনেদিন চিনতে পারব না। জ্ঞানযজ্ঞের সাথে কর্মযজ্ঞ যোগ না হলে শিল্পউদ্যোগের সামগ্রিকতা তৈরি হবে বলে মনে হয় না। আর জ্ঞানযোগিতা কোনো স্বাধীন বিষয় বলেও ধারণা করা যায় না। এর ধারাবাহিকতা নিশ্চয়ই আছে। যেমন, এই লেখাটি কমপ্লিট করতে আহমদ শরীফ-এর বাঙালি চিন্তার বিবর্তনধারা, আনন্দ ঘোষ হাজরার অবয়ববাদ : উত্তর-অবয়ববাদ ও উত্তর-আধুনিকতা আর জাকির তালুকদার-এর মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্ব : প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে নামের লেখার কাছে ঋণস্বীকার করতেই হয়। এমনকি কম্পিউটারের জাদুবলে আমারই লেখা গল্পের কথকতা, আর রাষ্ট্রের ভাষা, গল্পের মালিকানা নামের লেখা তিনটি থেকে লাইনের পর লাইন তুলে দিয়েছি।
মধ্যবিত্তই প্রায়োগিক গল্পের মূল চালিকাশক্তি। এ তো জানা বিষয় যে, গল্পের সামগ্রিক বিষয়টা মধ্যবিত্তের বিষয়-আশয়ই হয়ে আছে। এর লেখকও মধ্যবিত্ত আর পাঠকও একহিসেবে মধ্যবিত্তই। ছোটগল্পের কথকতায় এ মধ্যবিত্তকেই অধিকতর চেনা দরকার। ছোটগল্পের ঘরগেরস্থিতে মধ্যবিত্তকেই আলোচনা করা যেতে পারে। এ মধ্যবিত্ত কোনো স্বাধীন শ্রেণি নয়। ব্যাপক অর্থে এ আসলে চিত্তনির্ভর সামাজিক প্রবহমানতা মাত্র। এ শ্রেণীটি অন্ত্যজ শ্রেণিকে যেমন কাছ থেকে দেখতে পারে, তেমনি উচ্চবিত্তে পৌঁছে যাওয়ার আকাক্সক্ষাও খুব দ্রুতই তাদের পেয়ে বসে। এই প্রবহমানতা গল্পের জায়গা-জমিন-মানুষ অনেকটাই দখল করে ফেলে। এটাও ঠিক রাষ্ট্র-আশ্রিত-পণ্যের-আদলে একসময় প্রতিষ্ঠান মধ্যবিত্তকেও লালন করতে থাকে। এর ভিতরে পরজীবী ভাব আজন্মই আছে। এখনকার মধ্যবিত্তকে দেখলে মনে হতে পারে, এত ইরেস্পন্সিবল এরা আর কখনও ছিল না। রাষ্ট্র এ মধ্যবিত্তকে আর কোথায় নিয়ে যাবে! এ মধ্যবিত্ত তাবিজ-কবজেই কেবল নিমগ্ন হচ্ছে না, দেশি-বিদেশি বড়ো বড়ো পুঁজিবহুল মোড়লের কাছে শুধু সমর্পন করছে না নিজেকে, এর যে দাঁড়ানোর অন্তর্গত সত্তাও থাকতে পারে তাই বেমালুম ভুলে যাচ্ছে যেন। এ মধ্যবিত্ত এত প্রশ্নহীন, উদাসীন, এলোমেলো যে, মনে হবে এর কোনো দৃঢ়-গতিময় ইতিহাসই নেই। পরিকল্পনা দূরে থাক কোনোকিছু জানার দেখার আগ্রহই নেই। কত যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, কত যে দিশাহীন রাষ্ট্রীয় আচার দেখা যায়, যা মানুষকে তার সীমানাকে পাঁপড়-ভাজার মতো দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে।
গল্পের প্রাতিষ্ঠানিকতা, ফর্ম, সনাতন ধারণা, বাস্তবতার প্রয়োগ, প্যারালাল বা¯তবতাকে শব্দময় করা, প্রতিকল্পের শব্দচিহ্ন বানানো, গল্পে জাদুবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা বা চেতনাপ্রবাহের বিস্তৃতি সবই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে বা মেজাজে আসে। গল্পে এসবই নিরন্তর ভাবনার বিষয়-আশয়। কথা হচ্ছে কালের দাবিতে দ্রোহ, রোমান্টিকতা, বাস্তব-বিভ্রম, প্যারালাল বাস্তবতা নিসর্গের আবহ বদলে যেতে পারে। প্রতিগল্প বা মেটাফিকশন ইত্যাদি সমকালের দ্রোহও। তবে এর ভিতর পুঁজির ফাঁপা শ্লোগান কতটুকু আছে তা নিখুঁতভাবে দেখা দরকার। আধুনিকতার ব্যাপকতায় বা কদ্দূর, আধুনিকতার উত্তরণের প্রকৃত ধরনটা কী, তাও ভেবে দেখার বিষয়। আধুনিকতা উত্তরণের নামে সীমিত-খণ্ডিত-অস্পষ্ট-ম্লান চেতনা যেন গল্পের শরীর গ্রাস না-করে। গল্প নিয়ে বহুমাত্রিক আলাপ হওয়া দরকার। এর শুদ্ধতম মানবিক চর্চার জন্যই এসবের প্রয়োজন। আলো আসবে চারদিক থেকেই। একজন গল্পকারের কাজটি হতে পারে সেই আলোয় যদি অন্ধকার লেগে থাকে তা দেখানো, ধূলাবালি আর স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলায় ভরপুর সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে মানুষের ভিতর প্রগতিশীল বোধ তৈরি করা। গল্প বা আখ্যান কোনোকালেই বাঁধাধরা কোনো নিয়মে আবদ্ধ ছিল না।
গল্পের যত চিহ্ন, যত যে ভাষা
গল্পের ভাষা জীবনের মতোই এক চিহ্নবাদী অধ্যায়। ভাষা এক জাগতিক বিষয়, এই ভাষাই আধুনিক গল্প বহন করে। ভাষা যখন অলিখিত, অমনোযোগের এমনকি বুঝহীন এক বিষয় ছিল, তখনও যে গল্প ছিল তা ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে। গল্পের জাগতিকতা স্বতত প্রবহমাণ এক বিষয়। একে রুদ্ধ করার কোনো পথ নাই। কখনও কখনও একে বাঁধ দিয়ে, ফর্মান দিয়ে ক্ষণিকসময়ের জন্য থামানো যায়, কিন্তু রুদ্ধ করার কোনো কৌশল অবশেষে রাষ্ট্রেরও থাকে না।
শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে রাষ্ট্রের বড়ো কাজ হচ্ছে, ভাষাকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, প্রথামুখর করতে চায়, নিজের চলার পথকে ঝামেলামুক্ত রাখতে চায়। যারফলে ভাষার বিকাশ কখনও কখনও তার চলমানতাই উচ্ছকিত থাকে না। মানুষ জন্মের পরই একটা ভাষা নিয়েই জন্মায়। এই ভাষা দেয় তার মা-বাবা, পরিবেশ, সমাজ। এই নিয়েই পারিবারিক, সামাজিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবন চলে। কিন্তু ভাষার সাথে মানুষের সারাজীবনের সম্পর্কটি এত উদার থাকে না। কারণ তার এই মাতৃভাষার সাথে রাষ্ট্রের বোঝাপড়াটা হয় অন্যভাবে। রাষ্ট্র একটা ভাষা ঠিক করে রাখে। এটি মান-ভাষা। মানুষকে একটা নির্দিষ্ট পথে শুদ্ধতার আবেশে জড়াতে চায়। রাষ্টের সাথে মানুষের সম্পর্কটা দ্বন্দ্বমুখরই হয়। কারণ তার যখন একাডেমিক শিক্ষা শুরু হয়, তখন তার বোঝা হয়ে যায়, মাতৃভাষার সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত ভাষার উপর যে আঘাতটা করে তার নাম মান-ভাষা। এই মান ভাষা সদাসর্বদা চর্চিত হয়, এর বিকাশের জন্য তামাম শিক্ষিত মানুষ চেষ্টা-তদ্বির চালায়। এমনকি মিনিমাম প্রথামুক্ত হওয়াও মান-ভাষা তথা রাষ্ট্রের আচরণ সহ্য করে না। কারণ রাষ্ট্র নীরিহ ভাবটা খুব পছন্দ করে, ভাষাকেও পোষ মানায়।
কথাক্রমে বলতে হয়, এটা ঠিক গল্পে সৃজিত মানুষের ভাষার স্টাইল প্রত্যেকেরই আলাদা। এমনকি পিঠাপিঠি সহোদর বা সহোদরার ভাষাও আলাদা হয়। সেই আলাদা ব্যাপারটা তার কণ্ঠে বিরাজ করে, সচলতা, নীরবতা, অঙ্গভঙ্গিতেই প্রকাশ পেতে থাকে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব ভাষা থাকে। সেটা জাতি-ধর্ম, অঞ্চল, বয়স ভেদেও আলাদা হয়। স্বরধ্বনিরও পার্থক্য হয়। সেই ধ্বনি কখনও উচ্চ, নিচু, মধ্যম বা গড়মানের হয়ে থাকে। ভাষার অপভ্রংশ বা লৌকিক কিংবা প্রাকৃত রূপও আলাদা হয়। প্রাকৃত রূপও অশোক, গান্ধারী এমনকি সাহিত্যিক রূপেও আলাদা আলাদা চেহারা-সুরত প্রাপ্ত হয়। ভাষার স্বতস্ফূর্ত আচরণ কিংবা রোদনময় চিৎকারও ভাষার নানান রূপে নানান হয়।
ভাষা নানাভাবে গল্পপ্রবাহে মিশে যায়। কখনও সরবে, কখনও নীরবে এর প্রবহমানতা লক্ষণীয়। মানুষ যখনই নগর চেনে, অক্ষরের ভিতর ঢুকে যেতে থাকে. তখনই বহুরকমের নিয়ম বা পদ্ধতিতে আটকা পড়তে থাকে সে। রাষ্ট্রই তাকে নানান জাতের কায়দা শেখায়। সেও রাষ্ট্রের অচেনা সমাজের নিয়মনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে। যে মানুষ গ্রামীণ সহজাত জীবনে থাকে, একটা মাতৃভাষা নিয়ে বড়ো হওয়া শুরু করে, সেই মানুষই অক্ষরজ্ঞান নিয়ে আলাদা একটা জগৎ নির্মাণ করতে থাকে। সেই জগতের রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে আলাদা জীবনপ্রবাহ চেনে। সেই চেনার ভিতর গ্রামীণ বা প্রাথমিক জীবনের পরিচিত মানুষটা আর পাওয়া যায় না। সে তার নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে ভুলে যায়, কিংবা ভুলে থাকতে হয়। আরেক আলোকিত বা আন্ধাজগতে নিজেকে সঁপে দেয়। তার মানে জীবনযাপনের শুরু থেকেই একধরনের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তার ভিতরে বাড়তে থাকে। কে চেনায় সেই জগৎ? রাষ্ট্রই চেনায়। একটা রাষ্ট্রের অনেক কাজের ভিতর অনেক প্রয়োজনীয় কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আকাক্সক্ষায় মানুষকে গড়ে তোলা। পুঁজিবিকাশের রাষ্ট্র পছন্দ করে একজন মানবসন্তান সারাজীবনই কাদামাটির মতো নরম মোলায়েম হয়ে থাক। শক্ত -দৃঢ় মানুষ, আপন জগৎ তৈরি করা মানুষ রাষ্ট্র পছন্দ করে না। তার পুলিশ, তার মিলিটারি, তার স্কুল-কলেজ, তার অফিস-আদালত ভিন্ন মানুষ মানে ভিন্ন ধারণা লালন করতে থাকা মানুষ বরাবরই অপছন্দ করে। সেই অপছন্দের ধরনটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে-কর্মে, শাসনে-ত্রাসনে বোঝাতে থাকে।
আমরা যদি বিরামচিহ্ন ব্যবহারের ইতিহাস দেখি, ব্যাকরণে পাঠ নিই, ব্যাকরণবিদদের লক্ষ করি, তা হলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিরামচিহ্ন ব্যবহারে সৃজনশীল সাহিত্যের জন্য যেন কোনো নিয়ম নেই, এর কোনো বিধিবদ্ধ বাসনা নেই, যা আছে তার নাম একাডেমিক কিছু কায়দা-কানুন। সেই স্থানে সৃজনশীলতার বিষয়টাকে চৈতন্যেই রাখা হয়নি। আচ্ছা, সৃজনশীলতার সাথে প্রতিষ্ঠানের কোনো কাইজা-ফ্যসাদ আছে? সৃজনশীলতাকে বেজন্মা কোনো অস্তিত্ব মনে করা হয় না তো! এই প্রশ্নটি কেন আসছে, আসছে এ জন্য যে ভাষাচর্চার সবচেয়ে বড়ো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলা একাডেমী, সেখানে তো সৃজনশীলতার মৌলিকত্বের কোনো স্থানই নেই! এমনকি একে বলা হয় জাতির মননশীলতার প্রতীক! এই যে আমরা এখানে বিরামচিহ্ন নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে চাই, তা যে পু¯তকে সবচেয়ে শৃঙ্খলার ভিতর আলোচনা করা হয়েছে এর নাম প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ। এখানে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধের আকারে দুই খণ্ডের প্রমিত ভাষার একটা ব্যাকরণগ্রন্থ সঙ্কলিত করা হয়েছে। আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি, ওইখানকার লেখকদের ভিতর তেমন সৃজনউন্মুখ জনও নেই। আমি এখানে এ আলোচনা করব না যে ব্যাকরণের যে সমাজ-সত্য নিয়ম ব্যক্তির নামে হয়, সেখানে কয়েকজনের চেষ্টাই তা হয়নি; অনেকজনের কাজকে সমন্বয় করে একটা ব্যাকরণ গ্রন্থ বলে বাজারজাত করা হয়েছে। এটা আমার চৈতন্যে আসে না। আলাদা আলাদা ব্যক্তির সার্বভৌম প্রয়াসকে সমন্বয় কী করে করা যায়! তাতে কি ব্যক্তিসাধনা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না। যাই হোক, যতিচিহ্ন ব্যবহারের একটা ঐতিহ্যও আছে। একসময় ব্যাকরণ নিয়ে প্রথাগত কাজ করেছেন কয়েকজন। তবে একটা সময় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবিঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখরা ব্যাকরণে আধুনিক রূপ আনতে চেয়েছেন, একে সংস্কৃত-ইংরেজি-ফারসি-উর্দু-পর্তুগিজ প্রভাবমুক্ত করার কথা বলেছেন।
প্রায় ঐতিহ্যনির্ভর একাডেমীমুখী একটা ধারণা আমরা বাংলা একাডেমির প্রমিত ভাষার ব্যাকরণে পাই। এমনকি প্রথম আলো আর আনন্দবাজার প্রকাশনা'র (তাদের এ সংক্রান্ত প্রকাশনার কাজকে কার্যত সাংবাদিকতার কাজকে মনে রেখেই করা হয়েছে) যে নিয়ম-বিধির নমুনা পাই সেখানেও যতিচিহ্ন ব্যবহারের কোনো সৃজনশীল রূপ আমরা পাই না। কেন পাই না? এর কোনোই প্রয়োজন নাই! অবশ্যই আছে; এবং আছে বলেই এরই ধারাক্রমে কিছু কথা বলতে চাই। এসব স্বভাবতই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপের সমাহার হবে না; বরং বিরামচিহ্ন নিত্যব্যবহারে কী ধরনের অনুভূতি, মেজাজ, আবহের সামনে দাঁড়াতে হয় তাই বলে যাবো।
নৈঃশব্দ্যের যেমন ইতিহাস আছে, নিজেকে বদলে বদলে একটা ফর্মে দাঁড় করানোর ইতিবৃত্ত আছে, তেমনি বিরামচিহ্নেরও ইতিহাস আছে। বিরাম শুধু শব্দের ভিতর, বাক্যের শেষেই নাই; প্রতিটি শব্দ এমনকি ধ্বনির গহ্বরে থাকে। আমরা যাবতীয় ধ্বনি বা শব্দ তো একনাগাড়ে উচ্চারণ করি না। তাতে গ্যাপ দিই, যাতে তার ভিতর অর্থ থাকে। ধ্বনির অর্থময়তার সমষ্টিতেই তো ভাষার সৃজন হয়। এই ভাষাব্যবহারের কৌশলেই মনুষ্যপ্রজাতি মানব হয়ে উঠেছে। মানুষতা তাহলে ভাষার ভিতর দিয়ে লালন করা এক সত্তার নাম! ভাষা আমরা ব্যবহার করি নিজেকে পূর্ণ করে-করে জীবন যাপিত করার জন্য। নিজেকেও যথার্থ করে ব্যবহার করার জন্য। ভাষার ভিতর দিয়ে আচরণকে আমরা বহন করি। আমরা কিছু করতে চাই, মানুষের সাথে, প্রকৃতির সাথে, এমনকি সৃজনকর্তার সাথে একধরনের রিলেশন আমরা গড়তে চাই। আমরা মানুষতা বহন করতে চাই। এই চাওয়াকে পরিপূর্ণ করে শব্দ বা ধ্বনির ভিতর চালু থাকা নীরবতা বা বিরামচিহ্নের ব্যবহার। যত কথা আমরা সরবে বলি, তারচেয়ে অনেক বেশি বলি নির্জনে। সেই ভাষাও বিরামচিহ্ন ব্যতীত হয় না।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে গাঙের ঢেউয়ের মতো সম¯ত বিরামচিহ্ন একই তালে কবুল কবুল বলে বাক্যের অন্তর্জগতে ঠাঁই নিয়েছে। ভাবনাকে বহন করার জন্যই এরা একে একে শব্দের ভিতরে ভিতরে জায়গা করে নিচ্ছে। যখন মুদ্রিত শব্দের ভিতর পয়ারের অন্তর্জগতে বিরামচিহ্নের ব্যবহার আমরা দেখি তখন শুধু দাঁড়ি (।) আর ডাবল দাঁড়ি (॥) ছিল। ডাবল দাঁড়িতে সাধারণত প্রশ্ন আর বিস্ময়কেই ধারণ করত। সেই ডাবল দাঁড়ি কিন্তু দুইটা দাঁড়ির চেহারা নিয়ে অবস্থান করত না; অনেকটা দাঁড়ির ছলনার মতো, গাঙের মতো বা রমণীর প্যাঁচানো শরীরের মতোই এঁকেবেঁকে চলত। তখন মনে করা হত সাহিত্য মানেই পদাবলীর ভিতর বিরাজ করা কাব্যজগৎ। সেই সময় বদলে যাওয়ার ফলে ইংরেজি সাহিত্যঘেঁষা ভাষাকৌশল প্রত্যক্ষ করতে থাকি। নানান বিরামচিহ্ন আমাদের সাহিত্যজগতে ভিড় করতে থাকে। প্রশ্নচিহ্ন (?), বিস্ময়চিহ্ন (!), কমা (,), সেমিকোলন (;), কোলন (:), ড্যাশ (--), হাইফেন (-), কোলন-ড্যাশ (:-), সেমিকোলন-ড্যাশ (--) বন্ধনী (({[]})), ক্রমাগত-বিন্দু (...), ডট (.). বিকল্পচিহ্ন (/), উদ্ধৃতিচিহ্ন (''/''), ঊর্ধ্বকমা বা অ্যাপস্ট্রফি ('), টীকাচিহ্ন (*) ব্যবহার করে থাকি। এখন আবার কম্পিউটারে কম্পোজের সুবাদে যন্ত্রের কিছু আব্দার গ্রহণ করি। এর ভিতর সবচেয়ে ব্যবহার্য ধারণা হচ্ছে, ইটালিক, বোল্ড, নিম্নরেখা। আবার ব্লগ বা ফেসবুক নামের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সাঙ্কেতিক ভাষাও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
এ প্রশ্ন অতি স্বাভাবিকভাবেই আসে যে এইসব চিহ্ন কিভাবে কোথায় কেন ব্যবহার করতে হবে তা তো ভাষার নানাধরনের প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থ বা দপ্তরে নিত্য দেখা যাচ্ছে। তবে এর সবকটিই হয় একাডেমিক কাজের ধরনে নয়তো সংবাদপত্র বা বিভিন্ন মিডিয়াই একেবারে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন একাডেমী তো তাদের গৎবাঁধা ফর্মুলায় তা ব্যবহার করছে। আর প্রিন্ট বা ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার লক্ষই থাকে তার পাঠক বা দর্শকের চোখের আরামকে আরও সৌকর্যমণ্ডিত করা। পাঠকের মন-মেজাজকে অতি-সরলীকরণে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিরামচিহ্নের অতি সরল ব্যবহারই তাদের কাম্য। কিন্তু সবচেয়ে যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বা নিত্যআবিষ্কারের ধরনে যা ব্যবহার করা হয়, সেই ক্ষেত্র হচ্ছে সৃজনশীলতার প্রকৃত-জায়গা। সেই জায়গাতেই বিরামচিহ্নকে ব্যবহার করার বাসনা কিভাবে জাগতে পারে তাই নিয়ে আমাদের কিছু কথাবার্তা হবে।
বিরামচিহ্নের প্রথাগত নিয়মের বাইরে বিকল্প ব্যবহারের কিছু বিষয়ে আমি উদাহরণসহ উল্লেখ করব। কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রার প্রারম্ভেই তিনি নিজে একটা ভূমিকার ধরনে কথাবার্তা বলেছেন-- এর প্রথম প্যারাগ্রাফটি এরকম-
'এই গ্রন্থের ভাব বিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্য বিগ্রহ রামপ্রসাদের। রামপ্রসাদ আমাদের শুদ্ধ মন আনিয়া দেন॥ মা আমারে দয়া করে শিশুর মতো করে রেখো॥ অথবা॥ যে দেশে রজনী নেই মা॥ অথবা॥ কেলে সর্ব্বনাশী আমায় সন্ন্যাসী করেছে॥-- এ সকল কাব্যে তিনি ব্যক্ত।'
উপরের বাক্যসমূহে আমরা বিরামচিহ্নের ব্যবহার দেখে চমকে উঠছি। কারণ চমকে উঠায় আমাদের অধিকার আছে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠানই আমাদেরকে অর্পণ করেছে। ডাবল দাঁড়ি আর প্রলম্বিত ড্যাশ (ড্যাশ আবার তিনজাতের হতে পারে, ১. স্বল্পায়ু--যা হাইফেনের প্রায় দ্বিগুণ হয়, ২. মধ্যআয়ু-- যা হাইফেনের প্রায় চার গুণ হয়, ৩. দীর্ঘায়ু --যা হাইফেনের প্রায় ছ'গুণ হয়।) যেভাবে তিনি বিরামচিহ্নের ব্যবহার করলেন তা সময়কে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে তেমনি ব্যাকরণ সম্মতও হয়নি। অন্তত অতি সম্প্রতি বাংলা একাডেমী প্রযোজিত প্রমিত ভাষার ব্যাকরণ তাই সাক্ষ্য দেয়। তাহলে এখন কেউ যদি কমলের ভাবকে বহন করতে চায়, তার নামে কি রুল-নিশি জারি হবে? তাকে কি কোর্ট-কাছারির মোকাবেলা করতে হবে! অথবা আমরা যদি কমলকুমারের সুহাসিনীর পমেটম পাঠ করি, তাতে আরও ক্ষিপ্ত হতে পারি। সেই ক্ষিপ্ততার অধিকার তো আমাদের আছে। কারণ সারাটি গ্রন্থে তেমন কোনো বিরামচিহ্নই ব্যবহার করা হয়নি। তাহলে এমনতর প্রথামুখর চরিত্রহীন গ্রন্থ নিয়ে কী করব! সেখানে দৃশ্যত কোনো বিরামচিহ্নই নেই, তবে আমাদের ধারণা, অভ্যাসবশত আমরা কতিপয় চিহ্ন প্রয়োগ করে-করেই এটির পাঠ সমাপণ করি। এখানে পাঠকের সৃজনশীলতা রচিত হল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কেন পাঠককে এমন অদ্ভুত স্বাধীনতা দিবেন! সৃজনশীল সাহিত্যের আমার তো সবচেয়ে ঘাতক মনে হয় দাঁড়িকেই। মনে হয় আমার সৃজনশীলতাকে কখনও কখনও বেকায়দায় এ চিহ্নটি। এমনকি আমার ইচ্ছা করে সৃজনশীল সাহিত্যজগতে একে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করি। কারণ ভাবনাকে খণ্ডিত, ম্লান, বিধ্ব¯ত করার ব্যাপারে এর ষড়যন্ত্রের শেষ নাই। চিহ্ন নিয়ে অনেকেরই অনেক ধরনের নেশা আছে-- যেমন, মামুন হুসাইন তো ই-প্রত্যয়ের আগে হরহামেশাই একটা হাইফেন বসান। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ প্রমিত রীতির ক্রিয়া, যেমন : করে, বনে, ধরে, ইত্যাদির ঘাড়ে ক্রমাগত উর্ধ্বকমা চড়ান।
আমি যে চিহ্নটিকে ব্যববহারে সবচেয়ে ক্লান্ত-হতচকিত এমনকি বিরক্ত হই, সেটি হচ্ছে কোলন। এটিকে রাখার কোনো জায়গাই আমি করতে পারি না বা করতে যেন চাইও না। বিস্ময়চিহ্নই আমার প্রিয় চিহ্ন। আর যে চিহ্নটি ব্যবহারে সবচেয়ে আরাম পায় সেটি হচ্ছে ড্যাশ। মাঝারি মাপের, অবয়বে মাঝ-আকৃতির ড্যাশ, যেটি হয়ত মধ্যবিত্তের চলনও বহন করে, সেটিই বেশি মাত্রায় ব্যবহারের বাসনা হয় আমার। কিন্তু তা তো হয় না, কারণ এর চরম প্রতিদ্বন্দ্বী সেমিকোলন আর কমা প্রায়শই এর জায়গাটি নিয়ে নেয়। প্রথাগত নিয়ম হচ্ছে ড্যাশ-এর ডানে বায়ে খালি জায়গা না-রাখা। কিন্তু আমার তা ভালো লাগে না, এর ডানপাশে একটা স্পেস দিতেই আরাম পায়। একে দুইপাশ থেকে অন্য বর্ণ কর্তৃক ঠেসে ধরলে আমার কেবলই মনে হয় যেন এর দম আটকে মারাই যাবে!
প্রশ্নচিহ্নকে যুক্তিবিদ্যা আর দর্শনের একান্ত দোসরই মনে করতে পারি। কারণ প্রশ্নবিনে দর্শন আর তর্কের মন ভরে না। অথচ কার্যত আমরা দেখি, প্রশ্নচিহ্ন প্রায়ই ব্যবহার হয় অজানাকে জানার পরিধীতে এনে একটা আরামদায়ক দাঁড়ি বসিয়ে দেয়াতে। আমাদের বেশির ভাগ পাঠকই নিরীহ-আরামপ্রিয়-বিলাসি দাঁড়িতে খুব মজা পায়। আমরা দাঁড়িতে সুখ খুঁজে নেয়া জাতি; প্রশ্ন বা বিস্ময়বোধকে নিজের কব্জায় আনার ভিতরই যাবতীয় মজা খুঁজি। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নমুখরতাকে তো ভালোবাসতেই চাই, সবচেয়ে পছন্দ করি বিস্ময়বোধকে। এই যে একটা বিস্ময়চিহ্ন এর ভিতরই যাবতীয় সৃজনশীলতার ক্ষেত্র খুঁজতে চাই। এই একটা চিহ্ন যার সদরে অন্দরে সৃজনশীলতার অনেক দায়ভারকেই সহ্য করতে হয়। এর উপর মানুষের মন-মেজাজের চাপও পড়ে বেশিই। বিস্ময় তো আছেই, আনন্দ, বিষাদ, কান্না, দ্বিধা, লাজ-শরমের অনেককিছুই একে বহন করতে হয়। বাংল্ভাাষার এই চিহ্নের উপর দিয়ে যত ঝড়-তুফান যায়, তা আর কোথাও কিন্তু নাই। এই চিহ্নের স্বাধীনতা, উদ্মুক্ততা যত বাড়বে আমাদের বলায়, পড়ায়, লেখনে এমনকি সৃজনে সৃজনশীলতাকেই আমরা দেখে নিতে পারব। এর পর যে চিহ্ন আমায় ভাবায় তা হচ্ছে, ড্যাশ আর সেমিকোলন। আমার লেখাজোকায় বিশেষত কথাশিল্পের জমিনে রীতিমতো সংশয়ে থাকি এর ভিতর থেকে কোন চিহ্নটি ব্যবহারে আমার বাক্যের শক্তি সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পাবে। কমা আর সেমিকোলনের ভিতরও কোন চিহ্নটি ব্যবহার করব তা নিয়ে মাঝে মাঝে দর-কষাকষি চালাই আমি। বাক্যের কমা, সেমিকোলন, ড্যাশ ইত্যাদির ভিতর ট্রাডিশনাল ভুলে-ভরপুর-চিহ্ন আমি প্রায়ই হয়ত ব্যবহার করি। আসলে কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ, এ বিচারের ভার আর ক্রিয়েটিভিটির উপরই ছেড়ে দিতে পছন্দ করি। আমার চিহ্নপ্রেম আমিই বহন করতে চাই, সাজাতে চাই, এর প্রয়োগ চাই। আমার এ চাওয়ায় কোনো ধরনের মাতব্বরি আমি নিতে চাই না। আমার সৃষ্টিশীলতা নিয়ন্ত্রণকারি কেউ থাকুক, চিহ্ন ব্যবহারের প্রাতিষ্ঠানিক মাস্টারি কেউ করুক তা আমি চাইও না।
কম্পিউটারে কম্পোজ করা, ইন্টারনেট সাহিত্য, ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদিতে কিছু চিহ্ন ইদানীং অটোমেটিকই ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন, ইটালিক, বোল্ড, নিম্নরেখা, শব্দকে ছোট-বড়ো করা, নানাধরনের জাস্টিফাইডকরণ আমরা এখন লক্ষ করি। সুবিমল মিশ্র বাক্য বা শব্দ ব্যবহারে যে ক্যারিশমা দেখাতেন, আলাদা করে নিজেকে প্রকাশের দায়িত্ব নিতেন, এখন যেন তাই একধরনের ফ্যাশন হয়ে যাচ্ছে। পাঠকের সাথে লেখকের রিলেশনের ধরনটাও নতুন কৌশল পাচ্ছে। লেখা কালো রঙের ইম্প্রেশন পার্সেন্টেজ কমিয়ে-বাড়িয়ে চোখের আরাম বা বেআরাম পয়দা করা হচ্ছে। এসব বিরামচিহ্নের জায়গাটিকে আরও বি¯তৃত করে দিচ্ছে।
গল্পে যে কী চাই
তাহলে আমি চাই কী! এই যে এই মাত্র ব্যবহৃত বাক্যে আমি বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহার করলাম তা কিন্তু প্রশ্নচিহ্নের দাবিই অধিক। আবার এই যে প্রশ্নচিহ্নের ঘাড়ে একটা অ্যাপস্ট্রফি বসিয়ে দিলাম তা কিন্তু প্রথাগত ব্যাকরণ মানবে না। এটি প্রশ্নচিহ্নের বা প্রশ্নচিহ্ন-এর হতে পারে। কিন্তু ইদানীং এইধরনের উর্ধ্বকমা ব্যবহারের মানসিক প্রস্তুতি আমার আছে। এটি ভুল কি শুদ্ধ তা চিহ্নিতও করছি না। এই আমার সৃজনশীল ভুল, আমার ভুলের খেসারত আমি দিতে প্রস্তুত আছি। সৃজনশীলতার কোনো চুলছেঁড়া মীমাংসা চলে না, রাষ্ট্র-ধর্ম-সমাজ-পরিবার আমায় ক্রমাগত হুঙ্কার দিক তাই আমি চাই না। বিরামচিহ্ন ব্যবহারে নৈরাজ্যিক, মুক্ত-স্বাধীন মত প্রকাশের পূজারি আমি।
এ-ক্ষেত্রে এও বলতে হয়, ব্যক্তির মৌলিক সাংস্কৃতিক আবহ একটা বড়ো ব্যাপার। সাহিত্য আসলে ব্যক্তিকে প্রকাশ করার একটা পথ। সেখানে যা প্রকাশ করে তাই হচ্ছে মূল কথা। তাহলে সে যদি একটা অঞ্চলকে, ভাষাকে, ভাষাজনিত জ্ঞানব্যবস্থাকে আলাদা ভাষাভিত্তিক কাঠামো দিয়ে প্রকাশ করতে না চায়; তা দিতেই বহুজন বিবেচ্য একটা ভাষিক প্রবহমানতা বজায়ের চেষ্টা হতে পারে। তবে অতি অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার, তাতে যেন ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক কোনো মনোপলি তৈরি না হয়। অঞ্চলভিত্তিক পেষণও যেন দৃষ্টিকটুভাবে কোনো এলাকাকে বহন করতে না হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, পুঁজির দাপটে ভাষার দুই রূপ বহাল আছেই। এক হচ্ছে, জীবনের স্বয়ম্ভূ রূপ অন্যটি হচ্ছে রাষ্ট্রের আচরণগত অফিসিয়াল রূপ। এরই ভিতরই জীবনের নান্দনিকতাকে জানার, লোকজ জীবনপ্রবাহকে বুঝতে পারার একটা পথ বের করার চেষ্টা নিশ্চয়ই রাখতে হবে। কারণ গল্পভাষার যে রূপটি এখন সাহিত্যিক-আচরণের সাথে জড়িয়ে আছে তা প্রায়শই রক্তহীন ব্যর্থ মনে হয়। এতে এক রক্তময় প্রবহমানতা আনা জরুরি। গল্পের প্রাকৃত লৌকিক স্বরকে খোঁজা দরকার। এবং তার ভিতর মাটিঘেঁষা আমেজ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা লালন করার বিকল্প নাই। তাতে গদ্য শুধু নয়, পদ্যে এমনকি কবিতায় একধরনের দেশজ সুর স্পন্দিত হবে। শিল্পসাহিত্যের নবতর সুর সেখানে জায়মান থাকবে। ভালোলাগার স্পষ্ট অবয়ব গঠিত হবে। শব্দের ভিতর হয়ত লুকোচুরি খেলা যেমন থাকবে, তেমনি ভাষার সাজানো-গোছানো ভাব, শব্দ বা বাক্যের পরজীবীসুলভ তটস্থ প্রবণতার ভিতর থেকে দেশজ মাধুর্য ফুটে ওঠবে।
সময়ের সাথে সাথে অনেককিছুই পাল্টায়। গল্পও পাল্টায়, পাল্টাচ্ছেও। এর প্রায়োগিক বিন্যাস বদলে যাচ্ছে। শব্দের, বাক্যের,, চিহ্নের সহজাত বিস্তার অচেনা হতে থাকে। এটাই তো স্বাভাবিক--সমাজের, রাষ্ট্রের আচরণ অনেককিছুই বদলে দেয়। বাক্যের সহজাত মাধুর্য, বিষণ্ণতা, শব্দের নিপুণ কম্পন তছনছ হবার দশা। গল্পের স্বতঃস্ফূর্ত সৌকর্যও বদলে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের চেহারাও বদলে যাচ্ছে। উদার বুর্জোয়ার স্থলে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতাঘেরা বদ্ধজীবনের আবেশ গড়ে ওঠছে। মৌলবাদঘেঁষা ফ্যাসিজিমই সমাজের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে যাচ্ছে। এখন তো একেশ্বরবাদের হিংস্র রক্তজ স্রোতে শব্দের স্রোত নষ্টভ্রষ্ট কালোর আবহে ভরে যাচ্ছে। শব্দের শরীর একধরনের জাগরণমূলক স্পৃহা জাগ্রত করতে না পারলে সমাজের প্রগতিমুখর আর সহজাত সৃজনশীল বিকাশ সম্ভব বলে ধারণা করা মুশকিল। প্রগতিশীলতার উন্মোচন রহিত হতেই পারে। তবে গল্প মরে যাবার বিষয় নয়, এর রূপান্তর ঘটবে। ঘটছেও। গল্পে এককিসিমের সামন্ত প্রলেপ বাড়বে বলে ধারণা রাখা যায়। শুধু ভাষা নয়, নয় শুধু ভাষার জাগতিক রূপ; জীবনের কল্যাণকর শুভবোধকে নষ্ট করার পূর্বশর্তসমূহ জীবনের সমাজের রাষ্ট্রের চৈতন্যরূপকে পাল্টে দিচ্ছে। নৈঃশব্দের বিচিত্ররূপ জীবনকে বদলে দিচ্ছে; আমাদের প্রয়োজন সেইসব স্থানে যথার্থ শব্দ, ইঙ্গিত, ভাবময়তা ছড়িয়ে দেয়া। এখন প্রয়োজন ফিজিক্যাল স্টোরি-- যা গল্পের প্রতিষ্ঠানবিধ্বংসী রূপ ভয়ংকর যাতনাশ্রয়ী ধরনের গল্পকে প্রতিহত করবে, তাই একধরনের মূর্ত স্পৃহা হওয়া বাঞ্ছনীয়। গল্পের এমন দুর্দিনে গল্পকে নিয়ে নতুন যাত্রা করতে হবে, সেই নতুন মাত্রার নতুন যাত্রা শুরু করা দরকার। প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতার কায়দাকৌশল ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেয়ার চৈতন্য উদয় হওয়া দরকার, ভাষামুক্তির নবতর অঙ্গন তৈরি করতে না-পারলে গল্পের মুক্তি সম্ভব নয়।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর
গল্পের জীবনকথা
গল্পস্রোতের প্রক্রিয়ায় নিমজ্জিত থাকে মানবসম্প্রদায়। এক অর্থে সভ্যতার তীক্ষè প্রকাশই গল্প, জীবন মানেই কতিপয় গল্পের সমাহার। এমন জীবন কি আছে যেখানে গল্প নেই? এমন আলো-বাতাস, জল-হাওয়া, নিসর্গ, ছোঁয়াছুঁয়ি কোথায় আছে যেখানে গল্পের মিনিমাম পরশ নেই? গল্পেই জয়, গল্পেই লয়, আবার গল্পেই ক্ষয়। গল্প’র ইতিহাস বলে, গল্প কার্যত নিজের থাকে না; ধর্মে, মিথে, রূপকথায়, শৈশবের স্মৃতিতে তা এক কার্যকর পদ্ধতি হয়ে বিরাজ করে।
জীবন কিন্তু গল্পের এই ধারদেনার ভিতর দিয়েই বাড়তে থাকে। অতঃপর মানুষের ভিতর আলাদা আলাদা গল্প সৃজিত হয়। জীবনের প্রকাশে, অপ্রকাশে, সরবে, নীরবে, আমাদের প্রাত্যহিক অস্তিত্বে, গল্প মিশে থাকে। কখনও কখনও গল্প নৈঃশব্দ আর নির্জনতার সাথী হয়, তখন বলা যায়, জীবনের গল্প কখনও কখনও কে না গোপন করতে চায়।
আমরা যে প্রযোজিত গল্পের কথা বলি, তাতে আধুনিক প্রযুক্তির দাপট, দায়িত্ব, তৎপরতা আছে। ইলিয়াস যে গল্প মরে যাওয়ার হতবিহ্বল অনুভূতি জানিয়েছেন তা নিতান্তই প্রযুক্তি-সুবিধা-পাওয়া একধরনের শৈল্পিক ব্যবস্থাপনার সঙ্কটজনিত বহির্প্রকাশের নাম। গল্প সম্পর্কীয় তার এ ভাবনা মূলত একধরনের উৎপাদন ব্যবস্থাপনার যান্ত্রিক সঙ্কটেরই অংশ। তবে এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, যে গল্প মানুষের সভ্যতা নির্মাণের সমান বয়েসি তা মরে যাওয়ার কোনো সিস্টেমেই পড়ে না। কাজেই তার আশঙ্কার সাথে একমত হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন দেখি না।
যে গল্পভাবনা আমরা নির্মাণ করতে চাই, বা, বাসনা রাখি, তাও রাষ্ট্রব্যবস্থাপনার ভিতর এক কাঠামোকেন্দ্রিক আয়োজনই। এখানে গল্পভাবনার সাথে রাষ্ট্র, রাষ্ট্রপালিত বা অ-পালিত ভাষা, সমাজব্যবস্থা, ধর্ম, সাংবিধানিক আয়োজনও চৈতন্যে রাখার প্রয়োজন আছে। আমরা যখন একটা সনাতন রীতিকে স্বীকৃতি দেবো বা এর আচারনিষ্ঠাই নিজেকে সঁপে দেবো, তখন সমাজ-রাষ্ট্রের যাবতীয় বদমাইশি, লুচ্চামি, অব্যবস্থাপনারও অংশ হয়ে যাব। একটা শান্ত-সুশীল রাষ্ট্রও তাই কামনা করে। রাষ্ট্রের যত শাখা (নান্দনিক, অ-নান্দনিক, শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর অংশীদারিত্ব) আছে এর সবই বাসনার ভিতর তা-ই রাখতে চায়। রাষ্ট্রের পালিত চিন্তাবিদ, চাকুরে, ভাষাবয়নের প্রফেসরসকল তাই হাড়ে হাড়ে কার্যে পরিণত করেন। এর ভিতর একজন গল্পকারের ভাবনা কী ধরনের হতে পারে? উত্তর অতি সহজ-- যে ধরনের বাসনা তিনি লালন করেন তাই তার গল্পভাবনার বিষয়। সেই ভাবনায় শুধু গল্প তৈরির কাঠামো, ভাষার প্রয়োগ বা ম্যাসেজই বিষয় নয়, গল্পকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় সেটাও বিষয়।
মানিক, কমলকুমার, ইলিয়াস, হাসান, কায়েস, মাহমুদুল হক, সুবিমল, বাসুদেব, জহির, মনিরা, কাজল, সেলিম, মামুন--এরা গল্পথ্রোতে ম্লান-মলিন, অথচ আগ্রাসী রাষ্ট্রের সাথে, সমাজে প্রচলিত ধারণার সাথে সতত একটা বোঝাপড়া করতে থাকেন। কথাসাহিত্যের মাধ্যমে তা আমাদের মনোজগতে একধরনের প্রতিক্রিয়া তারা ভ্রাম্যমাণ রাখতে পেরেছেন। আসলে এ কাজের ভিতর, ধারণার বা একধরনের অসহিষ্ণুতার ভিতরই নানামাত্রার নান্দনিক প্রয়াস চলে। তাহলে গল্পকারের মূল বোঝাপড়া তার আশপাশে দেখা জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র-এর সাথেই হয়, যা একধরনের ক্রিয়া চালু রাখে। মননে তারই ছায়া-প্রতিচ্ছায়া ফেলে যেতে থাকে। একজন গল্পকার তো এই জগতের, এই চারপাশেরই মানুষ। তার যে মানসিক ক্রিয়ার প্রকাশ তা তো সবকিছু দেখার ভিতর থেকেই জারি হয়? নাকি এর ভিতরে, বাইরে, আড়ালে, সামনে কোনো অহি নাযেল হওয়ার ফলে মানবজাতিকে (অন্তত শিক্ষিত সাহিত্যপিপাসু পাঠকের সামনে) তা উপহার দেন? না, ফলত তিনি যা করেন, বা, করতে সচেষ্ট হন, তা তার চারপাশে দেখা বিষয়-আশয় থেকেই উঠে আসে-- তাতে তিনি অবগাহন করতে বাধ্য হন।
সুশান্ত মজুমদার একবার গল্পনির্মাণ সংক্রান্ত আলোচনার শিরোনামই দিলেন 'হাত বাড়ালেই গল্প মেলে'! তার এ উদ্ভাসিত শিরোনামে আমি বড়োই বিমোহিত হয়েছিলাম। আরেকবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল- লোকাল বাসে চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটের দিকে যাচ্ছি, যাচ্ছি তো যাচ্ছিই; কিন্তু মানুষের গরমে, ভিড়ে ক্রমাগত ঘেমে-নেয়ে উঠছি আমি। এর ভিতর দুই-তিনজন দৌড়তে দৌড়তে কোনো রকমে বাসে উঠছিলেন। এদের একজন বাদুড়ঝোলা হয়ে যাচ্ছেন। বাসের ভিতরের একজন বলছেন, ওই হালার পুত, সাবধানে থাহিস, হাত ছুটলে কিন্তুক ভর্তা অইয়া যাইবি। পাশের জন বলছেন, আরে দুরু, মাঙ্গির পুতের কিচ্ছু অইতো না; এরে আল্লাই চাইনিজ কুড়াল দে কুবাইয়া কুবাইয়া বানাইছে। এই বেজান দুঃসময়েও আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে রইলাম! এই দেশ, এই মাটি, এই চলমানতায় কী ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর বাস্তবতার গাঘেঁষে চলি আমরা, এখানকার সৃষ্টিকর্তাও (!) যেন আলাদা। এরই তাপে আমি আরও ঘামছি, শূয়রের মতো ঘাম ছুটছে আমার শরীরে, যেন ঘামের রায়ট বয়ে যাচ্ছে, মৃত্যু যেন নীরবে আমার অস্তিত্বে বাসা বাঁধছে। এরই ফলে আমার চৈতন্যে এক আঁধার নামে, সেই আঁধার থেকে বাঁচার মানসেও গল্প হয়। এই যে জীবন আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি, জীবন বদলে যাচ্ছে, ভয়াবহতা ক্রমশ বাড়ছে, তা গল্পের কোন্ স্থলে জায়গা দেবো? আমরা যে গল্পের ধারাক্রমের ভিতর আছি তা কি এই জীবনকে পষ্টাপষ্টিভাবে দেখছি তা কি ধারণ করতে পারছে বা করছে? যে জীবন আমাদের কথকতার ভিড়ে চালু আছে, তা নির্মাণের জন্য নতুন প্রকরণ, ভাষাভঙ্গি বা নীরবতার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। কলকাতার উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতিতে জারনকৃত যে শিক্ষিত সজ্জনের ভাষায় আমরা আমাদের প্রাত্যহিকতা নির্মাণে ব্রতী হই, তার ঘষামাজা দরকার। গল্পশৈলীর পুনর্বিন্যাস প্রয়োজন। একটা সময়ে ধরে নেয়া হতো, কাব্যিকতায় সাহিত্যের মৌলস্বর, কিন্তু তা স্থলে যে গদ্য আমরা পেলাম তা কিন্তু সাধুভাষায় চালু থাকল। পরবর্তী সময়ে চলিত ভাষার কাঠামো গদ্য, পদ্যের জায়গা-জমিন দখল করতে থাকল। এতে আবার উপনিবেশ, আভিজাত্য, উচ্চবর্ণীয় হিন্দুত্ব আসন গেড়ে বসে। জীবনকে একেবারে জীবনের রূপ-রস-গন্ধে দেখার জন্য এই ভাষায় আর কাজ হয় না, যেন ভাষার এক কম্পেক্টনেস আমাদের সহজতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখছে।
এই যে জীবনকে চেখে চেখে দেখে গল্পনির্মাণের প্রচেষ্টা, তা কি চাইলেই হয়ে যায়? এর জন্য নেশা, শ্রম, বিপুল আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে। নিজেকে ক্রমাগত নান্দনিক-ঘষামাজার একটা বিষয় এখানে অবশ্যই আছে। এখন আমরা যে জীবন দেখছি-- হুলস্থূল লুটপাটের এক মহড়া, দখলের রাজত্ব, হামলা-মামলার সংস্কৃতি চালু করে রাষ্ট্রীয় জীবন নির্মাণের যে প্রয়াস দৃশ্যমান হচ্ছে, তাতে একজন সৃজনশীল মানুষ হিসাবে, একজন গল্পকার কিভাবে ফেইস করবেন? অবশ্যই তিনি এর সমগ্র বিষয়কে একেবারে ভিতর থেকে চিনেই তার কথনকে প্রবহমান রাখবেন। এই যে কর্পোরেট পুঁজির দাপট আমরা দেখছি; মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে রুরাল ইকোনোমিকে আয়ত্তে রাখার এক মহাযজ্ঞ এনজিও নামের বিশাল দানব চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে গল্প নামের সাহিত্য মাধ্যমটি কিভাবে তা মোকাবেলা করবে? এই ক্ষেত্রে আবারও ফিজিক্যাল স্টোরির কথা মনে পড়ে। এ গল্প দানবের বিপরীতে প্রত্যক্ষভাবে যেন প্রতিদানব তৈরি করবে!
গল্পের সৃজনশীলতা একজন গল্পকারের নিজস্ব ব্যাপার। তবে এইটুকু বলা যায়, আমাদের সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, বা সামাজিক ইতিহাস এখন আর প্রথাগত পুতুপুতু কাহিনী নির্মাণের জায়গায় নাই। ছোট প্রাণ ছোট ব্যথার কলাকৌশল সেই কবেই সমাপ্ত হয়েছে বলে আমি ধারণা রাখি। প্রথম কথা হচ্ছে, কোনো প্রাণই ছোট নয়, কোনো ঘটনাই ছোট নয়, আর শেষ হয়েও হইল না শেষ ধরার কোনো কারণ নাই। জীবনের প্রবহমানতা এত তীব্র যে শেষ অশেষের পার্থক্য করা মুশকিলই। আরেকটা কমন অভিেেযাগ, এখনকার গল্পে গল্প থাকে না। কথা হচ্ছে, গদ্যকবিতায়ও যেমন ছন্দের একটা ব্যাপার কোনো না কোনো থাকেই, তেমনি গল্পহীন গল্পেও গল্পের একটা রূপ থাকেই। এ-ক্ষেত্রে কোনো একজন গল্পকার যদি খামখেয়ালি করে-টরে যাচ্ছেতাই লিখে যান তার কথা বাদ দিলে সব গল্পেই একটা গল্প অবশ্যই থাকে। একজন পাঠকের সৃজনশীলতায় যেমন আমাদের আস্থা আছে, তেমনি পাঠকের যুতসই প্রস্তুতিরও একটা ব্যাপার কিন্তু থাকা উচিত। কাজেই পাঠক-লেখক সমস্যার সমাধানে একজন পাঠকের দায়বদ্ধতাও কম নয়।
রাষ্ট্রের নিজস্ব গল্প থাকে, থাকে ভাষা, ভাষাবিদ, ভাষার কারিগর-প্রতিষ্ঠান। আছে রাষ্ট্রপালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাঙলা একাডেমী, নানান প্রতিষ্ঠান, হেনতেন... এর বুদ্ধি থাকে, থাকে গৃহপালিত বুদ্ধিজীবী। কিন্তু জীবনেরও জীবন থাকে, সৃজনের থাকে পুনঃসৃজন। প্রতিষ্ঠানের পণ্যসাহিত্য যেমন থাকে, এর পাল্টাসাহিত্যও থাকা বাঞ্ছনীয়। আমাদের কারও কারও গল্পভাবনায় তা আছে। সেই ভাবনারই লালন কেউ কেউ করেন। আমরা সেই লালনকরণকেই স্মরণে রাখি। একজন গল্পকার গল্প কেন লেখেন; এ বিষয়ে খুবই সহজ ধারণায় বলা যেতে পারে, এর সঙ্গে গল্পকারের একটা মানসিক আয়োজন নিশ্চয় থাকে-- মানবিক আকাঙ্ক্ষা তাতে মিলমিশ খায়। এ নিয়ে অনেক ধরনের ভাবনার কথা বলা যায়। গল্পকার মানসিক অস্থিরতা থেকে রিলিফ নেয়ার জন্যই হয়ত-বা শব্দের পর শব্দ বসাতে থাকেন। একজন গল্পকারের কাজটি কী, কথিত বিশুদ্ধ সাহিত্যচর্চাই তিনি শুধু করবেন? পাঠকের সঙ্গে মানসিক সম্পর্ক গড়ে তুলে সামাজিক বোধও তো তিনি তৈরি করবেন। নাকি গল্প-গল্প খেলায় ক্রিয়েটিভ জার্নালিজমের অংশীদার হবেন তিনি? আধুনিকতার উত্তরণের নামে চলমান সাহিত্যকে অস্বীকার করারও কোনো জো নেই। অনেককিছুর পরেও এ কথাটিই বলা যায়, একজন প্রগতিশীল লিখিয়ে অনবরত লেখক-পাঠকের সঙ্গে তার প্রগতিশীল বোধের বিনিময় ঘটাবেন। এটাই হতে পারে একজন শুদ্ধতম গল্পকারের প্রধান কাজ।
একটা স্বপ্ন তো সবার ভিতরই, বিশেষত, সৃজনশীল মানুষের ভিতর লালন করা হয়। একটা সময়ে আমার গল্প ঘামে ভিজে ভিজে, রক্তাক্ত হতে হতে বন্ধননহীন কিংবা কামের মুক্তচিত্ততামুখর অগাধ সাগর পাড়ি দিতে চাইত। গল্পের সারাশরীরে ছিল লাল ঝাণ্ডার মাখামাখি। এখনও এমন স্বপ্নময় স্বপ্ন আমার আছে। প্রগতিশীলতায় রক্তজ তাড়নায় তা বেগমান করার বাসনাও আছে। রাষ্ট্র এক নিপীড়নকামী দ্বন্দ্বের সামষ্টিক প্রয়াস। রাষ্ট্র মানেই কোনো না কোনো দিকে নিপীড়নের একটা ক্রিয়া বজায় রাখেই। এমনকি সমাজবাদের রাষ্ট্রীয় আয়োজন সর্বহারার একনায়কতন্ত্রেও তা কোনো না কোনো ফর্মে চলু থাকে। ফলে মনে হয় গল্পের শরীরে সর্বহারার গণতন্ত্র চাপিয়ে দেয়ার সাধ রাখা বাঞ্ছনীয়। গণতন্ত্রের একটা ধরন না থাকলে, অন্তত সমাজবিকাশের এক স্তর পর্যন্ত তা না-থাকলে স্বৈরাচারের বিস্তার অতি সহজ ঘটনা সেখানেও দৃশ্যমান হয়। তা কিন্তু আমরা প্রগতিশীল রাষ্ট্রনৈতিকতার ক্ষেত্রে এমনটি দেখেছি।
রাষ্ট্র কতক রুল জারি করবেই। আমার স্বপ্নে আমার গল্প এমন এক রাষ্ট্রের সহায়ক (অতি ক্ষীণ আকারে হলেও) যেখানে পুলিশ, র্যাব, মিলিটারি বলতে কিছুই থাকবে না, স্বতঃস্ফূর্ত খাদকও তার সহজাত কর্মের বিনিময়ে সুষম খাবার পাবে, সবচেয়ে বিজ্ঞানমুখর জ্ঞান থাকবে তার একেবারে নাগালের ভিতরে, নান্দনিক সমস্ত আয়োজনের সে হবে গণতান্ত্রিক অংশীদার, সৃজনশীলতার প্রতিবন্ধক বলতে কিছুই থাকবে না, যৌনতার প্রতিভাময় বিকাশ হবে নাগরিকের স্বভাবজাত অধিকার, প্রতিটি উপাসনালয় হবে বিজ্ঞান আর সৃজনমুখরতার পাঠাগার, রাষ্ট্র ক্রমশ রাষ্ট্রহীন হওয়ার প্রবণতায় লিপ্ত হবে, সমকালে আগামীকাল দেখার কামনা জারি হবে। এই ব্যবস্থার সহায়ক হিসাবে, ভাষাগত পরিবর্তনে, লৌকিক দিক থেকে, গল্প হবে নিত্যউদ্ভাসিত এক কর্ম।
গল্প কখন লেখা হবে, কেন লেখা হবে, গল্প না লিখলেই বা কী হয়! কার জন্যই বা সৃজনব্যবস্থাপনার এসব প্রশ্ন অনবরত ঘুরপাক খায়? প্রথমত একজন গল্পকার সম্পূর্ণ নিজের জন্যই লিখে থাকেন। কারণ লেখাটির ভিতর দিয়েই তিনি প্রমাণ রাখেন, তিনি এক ক্রিয়ার ভিতর থাকেন-- এটি না লিখে তিনি যেন পারছেন না। কারণ এটি তার জন্য একটা সৃজনউন্মুখ কাজ। দ্বিতীয়ত, কার জন্য লেখেন, তাও নিজের জন্যই তিনি লিখে থাকেন। কারণ এর প্রাথমিক পর্যায়ের পাঠকও তিনিই। অন্তত এটি লেখার কালে এর পাঠক তো গল্পকার নিজেই। তারও পর এটি কার জন্য লেখা হয়, তখন আসে পাঠকের প্রশ্ন। কারণ তিনি তো এটি সমাপান্তে বালিশের তলায়, আলমারিতে বা ট্রাঙ্কে গচ্ছিত রাখেননি। এবং তিনি যখন তা সর্বমহলে প্রকাশ করলেন তখন তিনি আর এটির সর্বময় স্বত্ব দাবি করতে পারেন না। এমনকি এর ভিতর গচ্ছিত বা চলমান সৃজনশীলতার একক দাবিদারও আর তিনি থাকেন না। তখন পাঠকের ক্ষমতায়, পাঠে, এমনকি এর স্বাধীন প্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধাও ওই লিখিয়ের প্রকাশ করা উচিত।
গল্পটি তখনই লেখা হয় যখন আর এটি না লিখে একজন সৃজনশীল মানুষটি হয়ত থাকতে পারেন না। এটি লেখকের প্রকাশের একটা অন্যতম বা অতি দরকারি মাধ্যম বলেই তিনি তা লিখে থাকেন। নিজের তাড়না, প্রেরণা বা চৈতন্যকে তিনি প্রকাশ করেন, অন্যকে প্রভাবিত করেন বা না-ই করেন, তা তিনি করে যান এবং তার ভিতর দিয়ে মানসিক শুদ্ধতার বিকাশ ঘটান। একটি গল্পপাঠে একজন পাঠক যখন আর স-ভাবনায় থাকেন না, বা থাকতে পারেন না, তখনই একটা গল্প সার্থক গল্প হয়ে ওঠে।
গল্পের মরণ-জীয়ন
গল্প'র মরা-বাঁচা নিয়ে ইদানীং ম্যালা কথা শোনা যায়। এর করণকৌশল, থিম, প্লট, শিল্পরূপ ইত্যাদি কেমন হচ্ছে বা হওয়া উচিত--সেসবের গবেষণার শেষ নেই। তারচেয়েও অধিক শোনা যায় গল্পের ভাষাটা আসলে কেমন হবে? এ নিয়েও তো কথাবার্তার শেষ নেই। গল্প মরা-বাঁচার বিষয়টা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় না, কারণ জীবনের সমান যার প্রসারত্ব ওই গল্প নিয়ে অত ভাবাভাবির কী থাকতে পারে! জীবনকে উচ্ছ্ব্াসবহুল, রোদনমুখর কিংবা টেনশনবহুল, রক্তাক্ত হাহাকারে ভরিয়ে দেয়ার বিষয়াবলী জীবনের সর্বাঙ্গের সাথে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। তবু এ নিয়েও কথা হতেই পারে। হাজার ঢঙে বক্তিমা দেয়া যায়। গল্পের ভাষা কেমন হবে, এর ব্যাপকতা বা বিশালতা কী করে প্রকাশ পাবে তা নিয়েও তো তুমুল কথাবার্তা চলতেই পারে।
গল্প'র জলজ্যান্ত-রূপ নিয়ে কথার অন্যতম কারণ হচ্ছে জীবনের লাগাতার দ্বন্দ্বময়তার সাথে এর সম্পর্ক কি হবে এর প্রকাশ্য রূপ কেমন হওয়া বাঞ্ছনীয় তা জানা; এও বলা হয়, গল্প ক্রমাগত এক নির্মাণের নাম। হয়ত তা প্রখরতারও নাম, নির্জনতার নামও হতে পারে; যাতে ব্যক্ত হয়, কিংবা শোনা, বলা, দেখা যায় নিজের, সমাজের এমনকি রাষ্ট্রের বাস্তবতাকেই। গল্পনির্মাণ বা কথ্যগল্প চালু থাকা এক চলমান প্রক্রিয়া, এখানে গল্প বাঁচার বা মরার প্রশ্নই নয়। আমরা যে গল্প মরে যাওয়ার কথা বলি, বা যার ভাবে-ভাবে জারিত হই, তা আসলে মুদ্রিত গল্পের বাঁচা-মরা নিয়ে কথা বলাবে অন্যকিছু নয়। এর সাথে জীবনের সামগ্রিকতা প্রকাশ পায় না, সেই সামগ্রিকতার গল্পও অনুপুঙ্খভাবে থাকে না, থাকে না মধ্যবিত্তের সর্বময় চালচিত্রও। গল্প নানান ভাবে জীবনের সাথে মিশে আছে। নানান সময়, সামাজিক বিবর্তন, ভৌগোলিক অবস্থা, ধর্মীয় আবহন ইত্যাদি নিয়েই গল্পের ঘর-সংসার-গেরস্থালি চালু আছে, চালু থাকবে। ধর্মীয় গল্পগাথার কথাই একটু না হয় দেখা যাক-- এখানে গল্পকার অনেক, গল্পগ্রন্থও অনেক। গল্পকার কর্তৃক সেই গল্প গ্রন্থিত হয়, তা মানবজীবনে প্রচার করেন প্রেরিত পুরুষগণ (প্রেরিত নারীর কোনো খবর আমার জানা নেই, সনাতন ধর্মের নারীরাও দেবতাগণের আশীর্বাদের অংশ মাত্র।)। এই গল্পকারগণ নানান ভাষায় তাদের গল্পগ্রন্থ সাজান। একজনের ভাষা অন্যজনের বোধে আসে না, বুঝেনও না। কারণ আরবি, সংস্কৃত, হিব্রু, পালি ভাষা সৃষ্টিকর্তারূপী এসব গল্পকারগণ পরস্পর বুঝবেন কি করে? গল্পকারদের বড়ো দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা। ধর্মের এই গল্প শেষ হবার কথা কি? ইলিয়াস যে গল্পের মরে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন তা কিন্তু গল্পের যে প্রায়োগিক রূপ মাত্র তা বলা যায়। এর বাইরে কিংবা অভ্যন্তরে আছে জৈবিক রূপ। এই রূপই গল্পের মাতৃকারূপটি বহন করে। গল্পের এই ধরন, কথকতা বা আকার-প্রকার নির্ধারণে মধ্যবিত্তের বোধের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। তবে কথা হচ্ছে, মানুষের বিশাল জীবন তো শুধুমাত্র মধ্যবিত্তের এই থরথর কম্পনযোগে গঠিত নয়। নানান শ্রেণীর নানান কথকতা, কথার বিচিত্ররূপ এখানে প্রকাশ পাবেই। কাজেই গল্পের কথা প্রসঙ্গে এই প্রশ্নই অর্থহীন যে, এভাবে একটা শিল্পচৈতন্যের বিনাশ ঘটবে। জীবনকে দেখার যেমন শেষ নেই, তা নিয়ে কথা বলা বা গল্প করারও শেষ নেই।
গল্প বলা, শোনা বা তা লেখার দীর্ঘমেয়াদী এক ইতিহাসই আমরা বহন করি। এমনকি এর প্রখরতা, সজীবতা কিম্বা নীরবতার অংশ হয়ে আছি। গল্প জীবনের সাথে মিশে থাকা এমনই জান্তব বিষয় যে এর থেকে যেমন আমরা বাইরে থাকতে পারি না, তেমনি এর গায়েবানা জানাজা পড়াও সম্ভব নয়। কারণ গল্পের প্রবহমানতা জীবনযাপনের মতোই সত্য বিষয়। সাহিত্যের অন্যসব বিষয়-আশয়ের মতো গল্পও কবে থেকে শুরু হল, এ প্রশ্নও অবান্তর। আকস্মিকভাবে তো শিল্পমাধ্যম হিসেবে তা পূর্ণতা পায়নি। গল্পের কথন, অকথনের নানান রূপ যেমন আছে, তেমনি আছে এর ইতিহাস-ঐতিহ্য। সমাজে, রাষ্ট্রে এর প্রবহমানতার ধরন যেমন আছে তেমনি আছে নানান বাঁকে এর বেড়ে ওঠার ইতিহাস। গল্প যখন মানুষের মুখে মুখে চলাচল করত তখন এর ভিতর যাপিতজীবনের অনুষঙ্গ আর রূপকথার আদলটাই ছিল মুখ্য। এসবের সাথে লোকজীবন একেবারে মিলেমিশে থাকত। একটা ইতিহাস তৈরি হয়। সেই গল্পকথার ইতিহাস তো আছেই। তবে সেই গল্প-আখ্যায়িকা এক্কেবারে অলিখিত পর্যায়ে এর বি¯তৃতি নির্দিষ্ট এলাকার নির্দিষ্ট জীবন-ভাবনার স্বরূপ থেকেই গড়ে ওঠে। নদ-নদী জল-জংলা ব্যাপৃত বঙ্গদেশের এ অঞ্চলে গল্পবিস্তৃতির মূল প্রেক্ষাপট আসে মানুষের উদার জমিন-নদী-ঝোপঝাড়ের জীবনঘেঁষে; কখনও আবার বৈদিকতার পরশে, এমনকি গ্রামীণ লোকায়ত ভাবনা-কৃষিজ-গার্হস্থ্য জীবনাচার থেকে। এও আমাদের স্মরণ রাখতে হয়, পূর্ববঙ্গের লোকায়ত ধরন অন্য অঞ্চল থেকে নিশ্চয় ভিন্নধাঁচের। গল্পে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে।
গল্পচর্চার সর্বময়-সার্বভৌম বিষয়টা এখনও অমীমাংসীতই। বলা যায়, এক অজানা বা জানা কিংবা অজানা-জানার এক গোলকধাঁধার ভিতরই আমরা গল্পের এক কাল অতিক্রম করছি। গল্পের চর্চা ঠিক কখন থেকে শুরু হ'ল তা নিয়ে অনেকধরনের অনেক কথা আমরা চালু রাখি। এ তো চালু থাকারই বিষয়। নিখুঁতভাবে এ প্রশ্নের মীমাংসায় আসাটা বেশ মুশকিল। এর সাথে আমরা পাই কথার ইতিহাস, মানুষের অঙ্গভঙ্গিযোগে ভাষা তথা গল্প চালু রাখার ইতিহাসও। তবে আধুনিক মানবসমাজে এর প্রায়োগিক রূপটির বিকাশ হয় ভিন্ন ধরনেরই। কারণ এর সঙ্গে মুদ্রণযন্ত্র চালু হওয়ার এবং এ শিল্পমাধ্যমটির সঙ্গে লেখাজোখার বিষয়-আশয় জড়িয়ে থাকার বিষয়টাও আছে। আধুনিক মানবকূলের কাছে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হলেই গল্প তার প্রায়োগিক আর একধরনের পরিপক্ব রূপ নেয়া শুরু করে। এর সাথেই বলতে হয় লেখ্যভাষায় নানান বাঁকের নানান কল্পনার বিষয়। শব্দের পর শব্দ বসালেই তো আর হচ্ছে না, এর গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকে নৈঃশব্দ, দুটি শব্দের ভিতর নির্জনে পড়ে থাকা নীরবতার ভাষাও একজন গল্পকার কর্তৃক পাঠককে ভাবনায় ফেলতে পারে-- এমনকি অন্য লেখকের বোধেও তা নাড়া দিতে পারে। তবে এ কাজে বিবিধ যতিচিহ্ন, বাক্যের কারুকাজ, শব্দের প্রবহমানতা, এর তাল-লয় সবকিছু পাঠকের বিবেচনায় থাকাটা বাঞ্ছনীয়। তাহলে এ প্রশ্নও করা যায়-- সংস্কৃতিতে জীবনের ব্যাপকতার এইসব পরিবর্তন কী করে হ'ল? কথাসাহিত্যচর্চার বহুবিধ আচারনিষ্ঠাই-বা কী করে এল! সমাজের বিবর্তনই শুধু ভাবনায় রাখলে গল্পকথার সবকিছু বোধের ভিতর আসে বলে মনে হয় না। অন্য অনেক অনুষঙ্গের মতো নদ-নদীর এ দেশটার নানান সময়ের নানান রক্তের অনুপ্রবেশকেও ভাবনায় রাখা সমীচীন বলে মনে হয়।
গল্পের নানানদিকে বিকাশের স্তরে স্তরে এ প্রশ্নটাও অবধারিত ভাবেই আসে গল্পের কাজ কী? গল্পের ঘর-গেরস্থালির সামগ্রিক ইতিহাসের ভিতরই হয়ত এর জবাবটিও পাওয়া পায়। মানুষ তার প্রয়োজনেই এর নানানধরনের চর্চা করে। এর সঙ্গে জীবনের প্রবহমানতা, সামাজিক বিন্যাস আর দর্শনের নানাবিধ ইতিবৃত্ত কী করে যোগ হয় তাও দেখার বিষয়। এখানে এ প্রশ্নও করা যায় যে, কী করে জীবনের সার্বিক লালিত্য বা পীড়নকে একটা গল্প ধারণ করে? ছোটগল্প নিশ্চয় মুগ্ধতার স্মৃতিকে নিরন্তর ঝালাই-বাছাই করে। তবে এ প্রশ্নটিও স্বাভাবিকভাবেই আসে, গল্প তো মানবজীবনকেই কেবল বর্ণনা করে না; মানবসভ্যতার বিকাশের প্রতি একধরনের দায়িত্ববোধ প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে তো জীবনকেই ক্ষণে ক্ষণে পাঠ করা। নয় কি?
কথাশিল্পের ধারা
আমরা এই সময় কথাসাহিত্যবিষয়ক প্রগতিশীলতার নানান ধারণা একটু দেখে নিতে পারি। সাহিত্যের আইডিয়া নির্মাণের ব্যাপারে যার নামটি অধিক শোনা যায় তিনি হচ্ছেন হাঙ্গেরির সাহিত্যতাত্ত্বিক গেওর্গে লুকাচ। তাঁর মতে সাহিত্যে সমাজজীবনের সরাসরি প্রতিফলন থাকবে। কিন্তু এর সাথে থাকবে সামাজিক বস্তুনিষ্ঠ দ্বন্দ্বমুখরতা। যাপিতজীবনের চিত্রময় রূপের সাথে মিশতে হবে নিজস্ব ধারণার বাস্তবতা। এভাইে সাহিত্যের আঙ্গিক সৃষ্টি হতে পারে। তার মানে তার মত অনুসারে দর্পণ বা ক্যামেরার মতো বাস্তবের প্রতিফলন প্রকৃত সাহিত্য হতে পারে না। একজন লেখকের মানসিক ক্রিয়াশীলতা সেখানে থাকা জরুরি। ফরাসি প্রগতিশীল সাহিত্যভাবুক পিয়েরে মাশেরে সাহিত্যকে দেখতে চান উৎপাদনশীলতার প্রাপ্তি হিসেবে। তাঁর কথা হচ্ছে, সাহিত্যও সামাজিক ক্রিয়াকলাপের বদৌলতে তৈরি হয়ে থাকে। এও তার দৃষ্টিতে জীবনের রুপান্তরের মতই এক ব্যাপার। সাহিত্যের নন্দনভাবনায় শুধু জীবনের প্রতিফলন নয় সামাজিক বিভিন্ন অনুষঙ্গও আসবে । এখানে একজন গল্পকার তার মেধাকে উৎপাদনশীলতার সমার্থক মনে করতে পারেন। তবে এ প্রশ্নও আসতে পারে, তাহলে শ্রেণিহীন সমাজে তো মানিক-ইলিয়াস-হাসান-কায়েস কিংবা অন্যসব সৃজনশীল কথাশিল্পীরা রাষ্ট্রীয় জীবনধারারই অংশ হয়ে যাবেন! তখন সৃজনশীলতার ধরনটা কেমন হবে? এ প্রশ্নও কেউ কেউ করতে পারেন, তখন আদৌ কি সৃজনশীল শিল্পচর্চার ক্রিয়াশীলতা সহজাত সৃজনশীলতায় বজায় থাকবে? সাহিত্যে নন্দনভাবনার জৈবিক রূপটি হতে পারে অধিক প্রাণবন্ত। এতে সামাজিক উপরিকাঠামো অর্থাৎ শ্রেণিদ্বন্দ্বময় সমাজের উপাদান-- অর্থনীতির সঙ্গে মিথ, উপকথা, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতি, ইতিহাসও সাহিত্যে মিলমিশ খায়। লুসিয়েন গোল্ডম্যান প্রবর্তিত এ ভাবনায় সাহিত্যে অর্থনীতিবাদী যান্ত্রিকতার প্রভাব থেকে ক্রিয়াশীল মানুষেরা অনেকটাই ভিন্ন আলোবাতাস পেতে পারেন। এখানে সামাজিক চেতনা সাহিত্যিক-আঙ্গিক নিয়ে অগ্রসর হয়। সামাজিক শ্রেণির থাকবে সামাজিক বিশ্ববীক্ষা। এভাবে সমাজভিত্তিক জীবনধারা বিকাশের ধরনটিই তার ভাবনায় ঘুরপাক খায়। তাঁর স্বাচ্ছন্দবোধটাও এখানেই। তবে তিনি তাঁর ভাবনায় লেখকের ব্যক্তিগত প্রয়াসকে অস্বীকার করতে চাননি মোটেই। আবার অ্যাডরনো মনে করতেন, শিল্প আর বা¯তবতা একে অন্য থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকে। এভাবেই শিল্পসাহিত্যের বিকাশও হতে পারে। তার ভাবনায় থাকে জীবনের শিল্পিত উদ্দেশ্য আর বাকপ্রতিমাকে তুলে ধরার প্রয়াস। জীবনকে দেখার দ্বৈত-বাস্তবতাকে তিনি এভাবেই জানাতে চান। সাহিত্যচর্চায় সামাজিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই। গল্পের সাথে রাষ্ট্রের একটা বোঝাপড়া কি নাই? অবশ্যই আছে। রাষ্ট্র একটা বড়ো প্রতিষ্ঠান, বলা যায়, সব প্রতিষ্ঠানের বাপ। আর সেই বাপের সাথে গল্পের মোলাকাত বা বোঝাপড়ার বিষয়টা অবশ্যই দ্বান্দ্বিক। যে কোনো প্রতিষ্ঠানই তার সুবিধামতো নিজের নিয়ম-নীতি, আচরণ নির্ধারণ করে। প্রতিষ্ঠান গল্পকে, বিশেষত এর ভাষাকে, এর সার্বিক চলাচলকে নিয়ন্ত্রণ তো করতেই চাইবে। কিন্তু প্রগতিশীলতায় ঋদ্ধ গল্প এই আচরণকে নিশ্চয়ই দ্বান্দ্বিকতায় নিয়ে যাবেন। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বজায় রাখবেন। রাষ্ট্রীয় আচার-আচরণ যখন নিরন্তর পেষণের ভূমিকাই নামে, সশস্ত্র হয় অনবরত, মানবিক মূল্যবোধ ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে, রাষ্ট্র মানুষের জীবনের সহজ চলাচল নির্ধারণ করে দেয়, শব্দের শরীর থেকে রক্ত-ঘাম ঝরে স্বতত: তখন গল্পের শরীর থেকেও যেন রক্ত ঝরে। জাদুবাস্তবতা, স্বতঃস্ফূর্ত-প্যারালাল বাস্তবতা কিংবা পরাবাস্তবতা, এমনকি প্রতীক-উপমা ব্যবহার এসবের ভিতর কোনটা কি করবে তার নির্ধারণ হতে পারে সামাজিক-রাষ্ট্রীয় বিষয়-আশয়কে ঘিরেই।
গল্পের ভাষা, উপমা, প্রতীক আর এর প্রয়োগকৃত সমকালীন ভাবনাও অধিক গুরুত্ব নিয়েই আলোচনা হতে পারে। এর নন্দনভাবনায় প্রগতিশীলতার ধরন নিয়ে তা বিবিধ মত চালু আছেই। এটা ঠিক যে, একটা গল্পের প্রাথমিক পাঠক হচ্ছেন এর লেখক। তিনি বহুবার গল্পটির ভিতর চর্চিত হন। এর ভাষা, রচনাশৈলী, চরিত্রনির্মাণ, ম্যাসেজ সবই লেখককে কেবলই ভাবায়। একজন গল্পকার সেই গল্পেরই নিমগ্ন, নীরব, সরব, সরস কিংবা নিষ্ঠুর ধারণকারী। তিনি কখনও যেমন আন্দোলিত হন, রক্তাক্ত হন এমনকি হিম-ঠাণ্ডা স্পর্শে জর্জরিত হন; খা খা রোদ্দূরে কিংবা কুয়াশায় ভিজেন তেমনি জবিনঘেঁষা একধরনের নিমগ্নতা পান। এভাবেই গল্পনির্মাণের প্রক্রিয়াও চলে। জল-কাদার এই দেশে, খুনে-সন্ত্রাসের কালে, ধর্মীয় নানান নিপীড়নের ভিতর একজন গল্পকারকে মননশীল, রোদনময়, বেদনাঘন গল্প লিখতে হয়।
কেন যে গল্পসাধনা
আমরা এ প্রশ্ন করতে পারি, কিংবা এ প্রশ্নের সর্বাঙ্গে নিজেদের জারিত করতে বাধ্য হই যে, একজন গল্পকার গল্প কেন লিখে থাকেন, এ বিষয়ে খুবই সহজ ধারণায় বলা যেতে পারে, এর সঙ্গে একজন প্রায়োগিক গল্পকারের একটা মানসিক আয়োজন নিশ্চয় থাকে। স্বতঃস্ফূর্ত কিংবা জিইয়ে তোলা আকাক্সক্ষা মিলমিশ খায়। এ নিয়ে অনেক ধরনের ভাবনার কথা বলা যায়। গল্পকার তার জীবনের নানান বাঁকবদলের ভিতর দিয়েই চলা একজন প্রাণী। ফলে তার মানসিক অস্থিরতা থেকে রিলিফ নেয়ার জন্যই শব্দের পর শব্দ বসাতে থাকেন হয়ত-বা। এটা একটা প্রতিষ্ঠিত ধারণারও বিষয়। পাঠকের সঙ্গে একধরনের মানসিক সম্পর্ক তার গড়ে ওঠে। এর সাথে ব্যক্তির কথকতা, সামাজিক বোধ, রাষ্ট্রীয় বিষয়ে নিজেকে লিপ্ত রাখার আচরণও নির্ণিত হয়। এ তো গেল একদিক, আবার গল্প-গল্প নেশায় তার মত্ততার বিষয়ও তো থাকতে পারে। থাকতে পারে সৃজনমুখর সাংবাদিকতার অংশীদার হওয়ার বাসনা। তবে প্রতিষ্ঠানের সাথে, বিশেষ করে রাষ্টের সাথে তার সম্পর্কটিও এর থেকে উঠে আসে। উপনিবেশ, আধুনিকতা, সমাজ-বিন্যাসের সাথে তার বোঝাপড়াটাও এ থেকে বোঝা যায়। আধুনিকতার উত্তরণের নামে চালু সাহিত্যকে অস্বীকার করারও কোনো জো নেই। অনেককিছুর পরেও এ কথাটিই বোধ করি বলা যায়, একজন গল্পকার অনবরত লেখক-পাঠকের সঙ্গে তার বোধের বিনিময় ঘটাবেন। এটাই হতে পারে একজন গল্পকারের মৌল-তাড়না। এর সাথে আরও অনেক কথা উঠে আসে। মধ্যবিত্তের শিল্পচর্চা বলে কথা! কারও কারও সামাজিক অবস্থানজনিত অহং স্পষ্ট হয়ে যাওযার বিষয় এর সাথে মিশে যাচ্ছে কিনা তাও দেখার বিষয়। আবার এমন ধারণাও কারও কারও গল্পপাঠে বা চর্চায় মনে জন্ম নিতে পারে--আলগা কিছু করে-টরে দেখানোর জন্যই যেন তারা গল্প লেখাজোখার এই কর্মটি চালিয়ে যান। একজন লেখক আরাম-পিয়াসী কিছু মধ্যবিত্তকে, আরাম-আয়েশকে উসকে দেয়ার উদ্দেশ্যও এতে থাকে! বায়বীয় মুগ্ধতাকে দেখার জন্যও হয়ত লেখালেখি করতে পারেন কেউ। ভুল পুঁজির ততোধিক ভুল স্বপ্ন ভরাট করার জাগতিক স্পৃহাও কারো থাকতে পারে হয়ত। মানবকল্যাণমুখী শিল্পিত ভাবনার বিষয়-আশয় কিভাবে কথাসাহিত্য তার জায়গা-জমিনে নিজের অবস্থানটি পাকাপোক্ত করতে পারে তা ভাবনায় রাখাটাও বোধ হয় জরুরি। এ তো আর নতুন করে বলারও অবকাশ রাখে না যে আমাদের কথাসাহিত্যে এমন এক শক্তিশালী ধারা আছেই। দ্বান্দ্বিক বা¯তবতা সাহিত্যে তার অবস্থান সরাসরি স্পষ্ট করতে পারে। জীবনের সমগ্রতায় এর একটা প্রভাব নিশ্চয় থাকতে পারে। এখানে কথাশিল্পীর ভাবনাও জারিত হয়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে সাহিত্যচর্চা তো কায়িক শ্রম নয় নিশ্চয়, এটা তো শিল্পসম্মত বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাই। তাহলে একজন কথাসাহিত্যিক কলমপেষা মজুর হিসেবে বোধ সৃষ্টি করবেন কী উপায়ে তা ভেবে দেখার বিষয় নিশ্চয়ই আছে। লেখার উপসর্গ যেমন সমাজে থাকে, তেমনি লেখক তো তাই জড়ো করেন। শিল্পপতি তার শ্রমহীন জীবন দিয়ে সবকিছুই যেমন নিয়ন্ত্রণ করছে, সেইরকম একজন লেখকও কি তার মেধার ওপর ভর করেই নিজেকে সমাজের আলাদা দাপুটে ব্যক্তি করছেন? গল্পকথায় এ প্রশ্নও এখানে আসাটা জরুরি যে, এসব লেখালেখির প্রয়োজনই-বা কেন? সাহিত্য কি উৎপাদনমুখী কোনো বিষয়? সাহিত্য তো এক অর্থে বাজারও খোঁজে। এক-একজন সাহিত্যিক তো নিজস্ব মতের পূজারি। নিজেকে রূপান্তরও করেন তিনি। তিনি কী ব্যাপক সংখ্যক পাঠকের সঙ্গে ভাবনাবিনিময়কারী মাত্র! গল্পকার তো শুধু সমাজ বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তুলছেন না। তাহলে ব্যক্তির উন্মেষটা এখানে কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে হবে তাও দেখার বিষয়। সমাজ বিকাশে এ ব্যক্তি নিজেকে খুঁজে পাবেন কী করে; প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্য চর্চার মানবিক বাস্তবতায় এর একটা মীমাংসাও জরুরি। পুঁজিবাদী সমাজে সমস্ত শিল্পকর্মকেই পুঁজির সাহায্যকারী করার মানসিকতা থাকে। প্রগতিশীলতার দায়বদ্ধতা নিশ্চয় পারে এ পীড়নের যথার্থ রূপ ফুটিয়ে তুলতে। এর জন্য আলাদা ধরনের ভাষাকৌশলের প্রয়োজনীয়তাও কেউ কেউ অনুভব করেন। লোকায়ত জীবন কিংবা নাগরিক জীবনের ধারণাপ্রসূত সাহিত্যে জীবন-লগ্নতা নিশ্চয়ই থাকা দরকার। সমাজবা¯তবতা থেকেই সাহিত্যে তার যথার্থ জায়গা করে নিবে। এ ক্ষেত্রে এ প্রশ্নও মনে উদয় হয়, লেখক কি প্রেরিত পুরুষ? তার ওপর ঐশ্বরিক কিছু নাজেল হয় না নিশ্চয়ই; অন্যদের মতো হয়েও কোথায় যেন কেউ কেউ আলাদা একধরনের বৈশিষ্ট্য লালন করেন।
আমরা মোটামুটি তিনধরনের গল্পলিখিয়ের সাথে পরিচিত হই। একধরনের গল্পকার শুধু তাদের নির্বাচিত লিটল ম্যাগাজিনেই লিখে থাকেন। তারা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার নামে এভাবে সাহিত্যসাধনাকে একটা টোটাল ব্যাপার মনে করে থাকেন। তারা সাহিত্যের বৌদ্ধিক জায়গাকেই টার্গেট করে। এই জন্যই তারা সাহিত্য সাময়িকী বা তাদের নৈতিকতার বাইরের কোনো ছোটকাগজে একটা অক্ষরও লেখেন না। এটা একধরনের সাধনা নিশ্চয়ই। আরেক ধরনের সাহিত্যজন আছেন যারা ছোটকাগজকে কোনো হিসাবের ভিতরই আনেন না। তারা সাহিত্যসাধনা বলতে বড়ো কাগজে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য কাগজকেই বুঝে থাকেন। তারা অতিশয় আরামপ্রিয় সাহিত্যমোদী। এদের অনেকেই জীবনের নিগূঢ়তার ধার ধারেন না। তারা তাদের মনোবাসনাযুক্ত পাঠককে লালন করেন। তার সাহিত্যকর্মে পাঠককে হাতছাড়া করার ভয়ে ক্ষীণতম রিস্কও নিতে রাজি থাকেন না তিনি। জীবনের নানান তীক্ষè-তীব্র, জটিল রূপ পর্যবেক্ষণে কোনো উৎসাহই বোধ করেন না তারা। মনোজাগতিকতার নিবিড় বিষয়কে তারা সততই না দেখার ভান করেন। এমনকি হয়ত বউ আর শালীর সাথে সঙ্গমের যে মনোজাগতিক সূক্ষতাতিসূক্ষ পার্থক্য আছে তাও যেন বোধের ভিতর ধরাতে চান না। সবক্ষেত্রে একটা উচ্ছ্বাসমুখর কলতান বজায় রাখতে চান এরা। তারা তাদের পাঠককূলকে আরাম সরবরাহ করতেই তৎপর থাকেন। আরেক ধরনের সাহিত্যজন ছোট ও বড়োকাগজ, এই দুই ক্ষেত্রেই তাদের সাহিতকর্মটি চালিয়ে থাকেন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, সাহিত্যসাধনা মানে একধরনের নৈতিকতা নির্মাণ করে যাওয়া। আর এই কাজে যেখানে আমার স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পায় সেখানেও আমার সাহিত্যকর্মটি প্রকাশ পেতে পারে। এ তো সত্যি যে, রাষ্ট্রই সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান যেখানে তার নিজস্ব অবস্থানটি বজায় রাখতে চায়। অর্থাৎ শিল্পসাহিত্যের মানবকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বড়ো শত্রু হচ্ছে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র তো অনির্দিষ্ট বায়বীয় ব্যাপার নয় যে এর অপশাসনের কথা বললেই সব শেষ হয়ে যায়। এর অঙ্গ হচ্ছে রাষ্ট্রটির ভৌগোলিক সীমানা-- সেই সীমানাকে ঘিরে বজায় থাকে কতিপয় আকাক্সক্ষা, সেই আকাঙ্ক্ষাকেই বহাল রাখে সংবিধান, রাষ্ট্রসভা, আমলাতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থা, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পড়াশোনার ধরন। এর সবই রাষ্ট্রের এই প্রাতিষ্ঠানিক অবয়বকে জিইয়ে রাখে। যে কোনো পত্রিকাও তো এক-একটা প্রতিষ্টান। তো কথা হচ্ছে, আমরা পত্রিকা নামের প্রতিষ্ঠানকে কি একটা সহজ নিয়মে ফেলেই বিচার করব? আমি বলতে চাচ্ছি, সব কাগজের চেহারা, আচরণ, রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক কি এক? তা তো নয়। সংগ্রাম বা ইনকিলাবের সাথে কি সমকাল, কালের কণ্ঠ, ভোরের কাগজ, সংবাদ, প্রথম আলো বা যুগান্তরকে এক করে দেখব? তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সাথে সব পত্রিকা তো এক আচরণ করছে না। কোনো কোনো পত্রিকাকে তো অনেকটাই স্বাধীন এবং মানবকল্যাণমুখী-প্রগতিশীল আচরণ করতে দেখা যায়। এখন কথা হচ্ছে, আমি যদি আমার আকাক্সক্ষাকে কোনো পত্রিকার সাহিত্যপাতায় আমার মতো করে প্রকাশ করতে পারি তাহলে সেই কাগজে লিখতে সমস্যা কোথায়? আমি আমার সাহিত্যসামগ্রীযোগে পণ্যসামগ্রি হয়ে যাব কিনা সেটা তো আমার ব্যাপার। কাজেই আমার মতো করে আমার সাহিত্যকর্মটি যদি প্রকাশ করতে পারি, তাহলে সেই কাগজে গল্প লিখতে কোনো অসুবিধা তো দেখি না। লিটলম্যাগের গল্পলিখিয়েগণ অতিরিক্ত পরিমাণে বুদ্ধিবৃদ্ধিক অবস্থানেই থাকতে চান। তারা জ্ঞানযোগী, বুদ্ধিনির্ভর শিল্পবোদ্ধা। তারা সরস্বতীবাদী। তারা মূলত মেধাবহুল কথকতাযোগে সমাজ-রাষ্ট্রকে ঝাঁকি দেয়ার নানান পদ্ধতি নিয়ে সারাক্ষণ উত্তেজনা বজায় রাখেন। প্রথাভাঙার দুর্দদমনীয় স্পৃহা তাদের আছে। তবে তা মাঝে মাঝে নির্দলীয় নিরপেক্ষ, অনেকটা অবয়বমুক্ত উত্তাপে ভরপুর থাকে। কথাক্রমে জানাতে হয়, সনাতনধর্মের বিশ্বাসমতে ব্রহ্মজ্ঞান থেকে ব্রাহ্মণের পয়দা। মানুষের সর্বাঙ্গ চিন্তা করলে এর মাথা, হাত, ধড়, পা থেকে যথাক্রমে সৃষ্টি হয়েছে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈশ্য, শূদ্র। সেই হিসাবে লিটল ম্যাগের গল্পলিখিয়েরা ব্রাহ্মণ্যবাদী। কিন্তু হাত, ধড় আর পদযুগল ব্যতীত মানুষ পূর্ণ হয় কি করে? তারা যতই প্রথা, চলতি রীতি আর প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলুক, এসবকে টোটাল ব্যাপার বলে চিন্তাফাল্লা বা গালিগালাজ করুক, আমরা অতি সাধারণ পাঠকরা কিন্তু সেই টোটালিটিকে কোনেদিন চিনতে পারব না। জ্ঞানযজ্ঞের সাথে কর্মযজ্ঞ যোগ না হলে শিল্পউদ্যোগের সামগ্রিকতা তৈরি হবে বলে মনে হয় না। আর জ্ঞানযোগিতা কোনো স্বাধীন বিষয় বলেও ধারণা করা যায় না। এর ধারাবাহিকতা নিশ্চয়ই আছে। যেমন, এই লেখাটি কমপ্লিট করতে আহমদ শরীফ-এর বাঙালি চিন্তার বিবর্তনধারা, আনন্দ ঘোষ হাজরার অবয়ববাদ : উত্তর-অবয়ববাদ ও উত্তর-আধুনিকতা আর জাকির তালুকদার-এর মার্কসবাদী সাহিত্যতত্ত্ব : প্রাসঙ্গিকতা প্রসঙ্গে নামের লেখার কাছে ঋণস্বীকার করতেই হয়। এমনকি কম্পিউটারের জাদুবলে আমারই লেখা গল্পের কথকতা, আর রাষ্ট্রের ভাষা, গল্পের মালিকানা নামের লেখা তিনটি থেকে লাইনের পর লাইন তুলে দিয়েছি।
মধ্যবিত্তই প্রায়োগিক গল্পের মূল চালিকাশক্তি। এ তো জানা বিষয় যে, গল্পের সামগ্রিক বিষয়টা মধ্যবিত্তের বিষয়-আশয়ই হয়ে আছে। এর লেখকও মধ্যবিত্ত আর পাঠকও একহিসেবে মধ্যবিত্তই। ছোটগল্পের কথকতায় এ মধ্যবিত্তকেই অধিকতর চেনা দরকার। ছোটগল্পের ঘরগেরস্থিতে মধ্যবিত্তকেই আলোচনা করা যেতে পারে। এ মধ্যবিত্ত কোনো স্বাধীন শ্রেণি নয়। ব্যাপক অর্থে এ আসলে চিত্তনির্ভর সামাজিক প্রবহমানতা মাত্র। এ শ্রেণীটি অন্ত্যজ শ্রেণিকে যেমন কাছ থেকে দেখতে পারে, তেমনি উচ্চবিত্তে পৌঁছে যাওয়ার আকাক্সক্ষাও খুব দ্রুতই তাদের পেয়ে বসে। এই প্রবহমানতা গল্পের জায়গা-জমিন-মানুষ অনেকটাই দখল করে ফেলে। এটাও ঠিক রাষ্ট্র-আশ্রিত-পণ্যের-আদলে একসময় প্রতিষ্ঠান মধ্যবিত্তকেও লালন করতে থাকে। এর ভিতরে পরজীবী ভাব আজন্মই আছে। এখনকার মধ্যবিত্তকে দেখলে মনে হতে পারে, এত ইরেস্পন্সিবল এরা আর কখনও ছিল না। রাষ্ট্র এ মধ্যবিত্তকে আর কোথায় নিয়ে যাবে! এ মধ্যবিত্ত তাবিজ-কবজেই কেবল নিমগ্ন হচ্ছে না, দেশি-বিদেশি বড়ো বড়ো পুঁজিবহুল মোড়লের কাছে শুধু সমর্পন করছে না নিজেকে, এর যে দাঁড়ানোর অন্তর্গত সত্তাও থাকতে পারে তাই বেমালুম ভুলে যাচ্ছে যেন। এ মধ্যবিত্ত এত প্রশ্নহীন, উদাসীন, এলোমেলো যে, মনে হবে এর কোনো দৃঢ়-গতিময় ইতিহাসই নেই। পরিকল্পনা দূরে থাক কোনোকিছু জানার দেখার আগ্রহই নেই। কত যে মূল্যবোধের অবক্ষয়, কত যে দিশাহীন রাষ্ট্রীয় আচার দেখা যায়, যা মানুষকে তার সীমানাকে পাঁপড়-ভাজার মতো দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে।
গল্পের প্রাতিষ্ঠানিকতা, ফর্ম, সনাতন ধারণা, বাস্তবতার প্রয়োগ, প্যারালাল বা¯তবতাকে শব্দময় করা, প্রতিকল্পের শব্দচিহ্ন বানানো, গল্পে জাদুবাস্তবতা, অধিবাস্তবতা বা চেতনাপ্রবাহের বিস্তৃতি সবই ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে বা মেজাজে আসে। গল্পে এসবই নিরন্তর ভাবনার বিষয়-আশয়। কথা হচ্ছে কালের দাবিতে দ্রোহ, রোমান্টিকতা, বাস্তব-বিভ্রম, প্যারালাল বাস্তবতা নিসর্গের আবহ বদলে যেতে পারে। প্রতিগল্প বা মেটাফিকশন ইত্যাদি সমকালের দ্রোহও। তবে এর ভিতর পুঁজির ফাঁপা শ্লোগান কতটুকু আছে তা নিখুঁতভাবে দেখা দরকার। আধুনিকতার ব্যাপকতায় বা কদ্দূর, আধুনিকতার উত্তরণের প্রকৃত ধরনটা কী, তাও ভেবে দেখার বিষয়। আধুনিকতা উত্তরণের নামে সীমিত-খণ্ডিত-অস্পষ্ট-ম্লান চেতনা যেন গল্পের শরীর গ্রাস না-করে। গল্প নিয়ে বহুমাত্রিক আলাপ হওয়া দরকার। এর শুদ্ধতম মানবিক চর্চার জন্যই এসবের প্রয়োজন। আলো আসবে চারদিক থেকেই। একজন গল্পকারের কাজটি হতে পারে সেই আলোয় যদি অন্ধকার লেগে থাকে তা দেখানো, ধূলাবালি আর স্যাঁতসেঁতে শ্যাওলায় ভরপুর সমাজ-রাষ্ট্র সম্পর্কে মানুষের ভিতর প্রগতিশীল বোধ তৈরি করা। গল্প বা আখ্যান কোনোকালেই বাঁধাধরা কোনো নিয়মে আবদ্ধ ছিল না।
গল্পের যত চিহ্ন, যত যে ভাষা
গল্পের ভাষা জীবনের মতোই এক চিহ্নবাদী অধ্যায়। ভাষা এক জাগতিক বিষয়, এই ভাষাই আধুনিক গল্প বহন করে। ভাষা যখন অলিখিত, অমনোযোগের এমনকি বুঝহীন এক বিষয় ছিল, তখনও যে গল্প ছিল তা ইতোপূর্বেই বলা হয়েছে। গল্পের জাগতিকতা স্বতত প্রবহমাণ এক বিষয়। একে রুদ্ধ করার কোনো পথ নাই। কখনও কখনও একে বাঁধ দিয়ে, ফর্মান দিয়ে ক্ষণিকসময়ের জন্য থামানো যায়, কিন্তু রুদ্ধ করার কোনো কৌশল অবশেষে রাষ্ট্রেরও থাকে না।
শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে রাষ্ট্রের বড়ো কাজ হচ্ছে, ভাষাকে তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, প্রথামুখর করতে চায়, নিজের চলার পথকে ঝামেলামুক্ত রাখতে চায়। যারফলে ভাষার বিকাশ কখনও কখনও তার চলমানতাই উচ্ছকিত থাকে না। মানুষ জন্মের পরই একটা ভাষা নিয়েই জন্মায়। এই ভাষা দেয় তার মা-বাবা, পরিবেশ, সমাজ। এই নিয়েই পারিবারিক, সামাজিক, এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবন চলে। কিন্তু ভাষার সাথে মানুষের সারাজীবনের সম্পর্কটি এত উদার থাকে না। কারণ তার এই মাতৃভাষার সাথে রাষ্ট্রের বোঝাপড়াটা হয় অন্যভাবে। রাষ্ট্র একটা ভাষা ঠিক করে রাখে। এটি মান-ভাষা। মানুষকে একটা নির্দিষ্ট পথে শুদ্ধতার আবেশে জড়াতে চায়। রাষ্টের সাথে মানুষের সম্পর্কটা দ্বন্দ্বমুখরই হয়। কারণ তার যখন একাডেমিক শিক্ষা শুরু হয়, তখন তার বোঝা হয়ে যায়, মাতৃভাষার সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত ভাষার উপর যে আঘাতটা করে তার নাম মান-ভাষা। এই মান ভাষা সদাসর্বদা চর্চিত হয়, এর বিকাশের জন্য তামাম শিক্ষিত মানুষ চেষ্টা-তদ্বির চালায়। এমনকি মিনিমাম প্রথামুক্ত হওয়াও মান-ভাষা তথা রাষ্ট্রের আচরণ সহ্য করে না। কারণ রাষ্ট্র নীরিহ ভাবটা খুব পছন্দ করে, ভাষাকেও পোষ মানায়।
কথাক্রমে বলতে হয়, এটা ঠিক গল্পে সৃজিত মানুষের ভাষার স্টাইল প্রত্যেকেরই আলাদা। এমনকি পিঠাপিঠি সহোদর বা সহোদরার ভাষাও আলাদা হয়। সেই আলাদা ব্যাপারটা তার কণ্ঠে বিরাজ করে, সচলতা, নীরবতা, অঙ্গভঙ্গিতেই প্রকাশ পেতে থাকে। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের নিজস্ব ভাষা থাকে। সেটা জাতি-ধর্ম, অঞ্চল, বয়স ভেদেও আলাদা হয়। স্বরধ্বনিরও পার্থক্য হয়। সেই ধ্বনি কখনও উচ্চ, নিচু, মধ্যম বা গড়মানের হয়ে থাকে। ভাষার অপভ্রংশ বা লৌকিক কিংবা প্রাকৃত রূপও আলাদা হয়। প্রাকৃত রূপও অশোক, গান্ধারী এমনকি সাহিত্যিক রূপেও আলাদা আলাদা চেহারা-সুরত প্রাপ্ত হয়। ভাষার স্বতস্ফূর্ত আচরণ কিংবা রোদনময় চিৎকারও ভাষার নানান রূপে নানান হয়।
ভাষা নানাভাবে গল্পপ্রবাহে মিশে যায়। কখনও সরবে, কখনও নীরবে এর প্রবহমানতা লক্ষণীয়। মানুষ যখনই নগর চেনে, অক্ষরের ভিতর ঢুকে যেতে থাকে. তখনই বহুরকমের নিয়ম বা পদ্ধতিতে আটকা পড়তে থাকে সে। রাষ্ট্রই তাকে নানান জাতের কায়দা শেখায়। সেও রাষ্ট্রের অচেনা সমাজের নিয়মনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে। যে মানুষ গ্রামীণ সহজাত জীবনে থাকে, একটা মাতৃভাষা নিয়ে বড়ো হওয়া শুরু করে, সেই মানুষই অক্ষরজ্ঞান নিয়ে আলাদা একটা জগৎ নির্মাণ করতে থাকে। সেই জগতের রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে আলাদা জীবনপ্রবাহ চেনে। সেই চেনার ভিতর গ্রামীণ বা প্রাথমিক জীবনের পরিচিত মানুষটা আর পাওয়া যায় না। সে তার নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে ভুলে যায়, কিংবা ভুলে থাকতে হয়। আরেক আলোকিত বা আন্ধাজগতে নিজেকে সঁপে দেয়। তার মানে জীবনযাপনের শুরু থেকেই একধরনের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ তার ভিতরে বাড়তে থাকে। কে চেনায় সেই জগৎ? রাষ্ট্রই চেনায়। একটা রাষ্ট্রের অনেক কাজের ভিতর অনেক প্রয়োজনীয় কাজ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় আকাক্সক্ষায় মানুষকে গড়ে তোলা। পুঁজিবিকাশের রাষ্ট্র পছন্দ করে একজন মানবসন্তান সারাজীবনই কাদামাটির মতো নরম মোলায়েম হয়ে থাক। শক্ত -দৃঢ় মানুষ, আপন জগৎ তৈরি করা মানুষ রাষ্ট্র পছন্দ করে না। তার পুলিশ, তার মিলিটারি, তার স্কুল-কলেজ, তার অফিস-আদালত ভিন্ন মানুষ মানে ভিন্ন ধারণা লালন করতে থাকা মানুষ বরাবরই অপছন্দ করে। সেই অপছন্দের ধরনটা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে-কর্মে, শাসনে-ত্রাসনে বোঝাতে থাকে।
আমরা যদি বিরামচিহ্ন ব্যবহারের ইতিহাস দেখি, ব্যাকরণে পাঠ নিই, ব্যাকরণবিদদের লক্ষ করি, তা হলে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে বিরামচিহ্ন ব্যবহারে সৃজনশীল সাহিত্যের জন্য যেন কোনো নিয়ম নেই, এর কোনো বিধিবদ্ধ বাসনা নেই, যা আছে তার নাম একাডেমিক কিছু কায়দা-কানুন। সেই স্থানে সৃজনশীলতার বিষয়টাকে চৈতন্যেই রাখা হয়নি। আচ্ছা, সৃজনশীলতার সাথে প্রতিষ্ঠানের কোনো কাইজা-ফ্যসাদ আছে? সৃজনশীলতাকে বেজন্মা কোনো অস্তিত্ব মনে করা হয় না তো! এই প্রশ্নটি কেন আসছে, আসছে এ জন্য যে ভাষাচর্চার সবচেয়ে বড়ো স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলা একাডেমী, সেখানে তো সৃজনশীলতার মৌলিকত্বের কোনো স্থানই নেই! এমনকি একে বলা হয় জাতির মননশীলতার প্রতীক! এই যে আমরা এখানে বিরামচিহ্ন নিয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে চাই, তা যে পু¯তকে সবচেয়ে শৃঙ্খলার ভিতর আলোচনা করা হয়েছে এর নাম প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ। এখানে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধের আকারে দুই খণ্ডের প্রমিত ভাষার একটা ব্যাকরণগ্রন্থ সঙ্কলিত করা হয়েছে। আমি খুব খেয়াল করে দেখেছি, ওইখানকার লেখকদের ভিতর তেমন সৃজনউন্মুখ জনও নেই। আমি এখানে এ আলোচনা করব না যে ব্যাকরণের যে সমাজ-সত্য নিয়ম ব্যক্তির নামে হয়, সেখানে কয়েকজনের চেষ্টাই তা হয়নি; অনেকজনের কাজকে সমন্বয় করে একটা ব্যাকরণ গ্রন্থ বলে বাজারজাত করা হয়েছে। এটা আমার চৈতন্যে আসে না। আলাদা আলাদা ব্যক্তির সার্বভৌম প্রয়াসকে সমন্বয় কী করে করা যায়! তাতে কি ব্যক্তিসাধনা প্রশ্নবিদ্ধ করা হয় না। যাই হোক, যতিচিহ্ন ব্যবহারের একটা ঐতিহ্যও আছে। একসময় ব্যাকরণ নিয়ে প্রথাগত কাজ করেছেন কয়েকজন। তবে একটা সময় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রবিঠাকুর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখরা ব্যাকরণে আধুনিক রূপ আনতে চেয়েছেন, একে সংস্কৃত-ইংরেজি-ফারসি-উর্দু-পর্তুগিজ প্রভাবমুক্ত করার কথা বলেছেন।
প্রায় ঐতিহ্যনির্ভর একাডেমীমুখী একটা ধারণা আমরা বাংলা একাডেমির প্রমিত ভাষার ব্যাকরণে পাই। এমনকি প্রথম আলো আর আনন্দবাজার প্রকাশনা'র (তাদের এ সংক্রান্ত প্রকাশনার কাজকে কার্যত সাংবাদিকতার কাজকে মনে রেখেই করা হয়েছে) যে নিয়ম-বিধির নমুনা পাই সেখানেও যতিচিহ্ন ব্যবহারের কোনো সৃজনশীল রূপ আমরা পাই না। কেন পাই না? এর কোনোই প্রয়োজন নাই! অবশ্যই আছে; এবং আছে বলেই এরই ধারাক্রমে কিছু কথা বলতে চাই। এসব স্বভাবতই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপের সমাহার হবে না; বরং বিরামচিহ্ন নিত্যব্যবহারে কী ধরনের অনুভূতি, মেজাজ, আবহের সামনে দাঁড়াতে হয় তাই বলে যাবো।
নৈঃশব্দ্যের যেমন ইতিহাস আছে, নিজেকে বদলে বদলে একটা ফর্মে দাঁড় করানোর ইতিবৃত্ত আছে, তেমনি বিরামচিহ্নেরও ইতিহাস আছে। বিরাম শুধু শব্দের ভিতর, বাক্যের শেষেই নাই; প্রতিটি শব্দ এমনকি ধ্বনির গহ্বরে থাকে। আমরা যাবতীয় ধ্বনি বা শব্দ তো একনাগাড়ে উচ্চারণ করি না। তাতে গ্যাপ দিই, যাতে তার ভিতর অর্থ থাকে। ধ্বনির অর্থময়তার সমষ্টিতেই তো ভাষার সৃজন হয়। এই ভাষাব্যবহারের কৌশলেই মনুষ্যপ্রজাতি মানব হয়ে উঠেছে। মানুষতা তাহলে ভাষার ভিতর দিয়ে লালন করা এক সত্তার নাম! ভাষা আমরা ব্যবহার করি নিজেকে পূর্ণ করে-করে জীবন যাপিত করার জন্য। নিজেকেও যথার্থ করে ব্যবহার করার জন্য। ভাষার ভিতর দিয়ে আচরণকে আমরা বহন করি। আমরা কিছু করতে চাই, মানুষের সাথে, প্রকৃতির সাথে, এমনকি সৃজনকর্তার সাথে একধরনের রিলেশন আমরা গড়তে চাই। আমরা মানুষতা বহন করতে চাই। এই চাওয়াকে পরিপূর্ণ করে শব্দ বা ধ্বনির ভিতর চালু থাকা নীরবতা বা বিরামচিহ্নের ব্যবহার। যত কথা আমরা সরবে বলি, তারচেয়ে অনেক বেশি বলি নির্জনে। সেই ভাষাও বিরামচিহ্ন ব্যতীত হয় না।
এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে গাঙের ঢেউয়ের মতো সম¯ত বিরামচিহ্ন একই তালে কবুল কবুল বলে বাক্যের অন্তর্জগতে ঠাঁই নিয়েছে। ভাবনাকে বহন করার জন্যই এরা একে একে শব্দের ভিতরে ভিতরে জায়গা করে নিচ্ছে। যখন মুদ্রিত শব্দের ভিতর পয়ারের অন্তর্জগতে বিরামচিহ্নের ব্যবহার আমরা দেখি তখন শুধু দাঁড়ি (।) আর ডাবল দাঁড়ি (॥) ছিল। ডাবল দাঁড়িতে সাধারণত প্রশ্ন আর বিস্ময়কেই ধারণ করত। সেই ডাবল দাঁড়ি কিন্তু দুইটা দাঁড়ির চেহারা নিয়ে অবস্থান করত না; অনেকটা দাঁড়ির ছলনার মতো, গাঙের মতো বা রমণীর প্যাঁচানো শরীরের মতোই এঁকেবেঁকে চলত। তখন মনে করা হত সাহিত্য মানেই পদাবলীর ভিতর বিরাজ করা কাব্যজগৎ। সেই সময় বদলে যাওয়ার ফলে ইংরেজি সাহিত্যঘেঁষা ভাষাকৌশল প্রত্যক্ষ করতে থাকি। নানান বিরামচিহ্ন আমাদের সাহিত্যজগতে ভিড় করতে থাকে। প্রশ্নচিহ্ন (?), বিস্ময়চিহ্ন (!), কমা (,), সেমিকোলন (;), কোলন (:), ড্যাশ (--), হাইফেন (-), কোলন-ড্যাশ (:-), সেমিকোলন-ড্যাশ (--) বন্ধনী (({[]})), ক্রমাগত-বিন্দু (...), ডট (.). বিকল্পচিহ্ন (/), উদ্ধৃতিচিহ্ন (''/''), ঊর্ধ্বকমা বা অ্যাপস্ট্রফি ('), টীকাচিহ্ন (*) ব্যবহার করে থাকি। এখন আবার কম্পিউটারে কম্পোজের সুবাদে যন্ত্রের কিছু আব্দার গ্রহণ করি। এর ভিতর সবচেয়ে ব্যবহার্য ধারণা হচ্ছে, ইটালিক, বোল্ড, নিম্নরেখা। আবার ব্লগ বা ফেসবুক নামের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সাঙ্কেতিক ভাষাও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
এ প্রশ্ন অতি স্বাভাবিকভাবেই আসে যে এইসব চিহ্ন কিভাবে কোথায় কেন ব্যবহার করতে হবে তা তো ভাষার নানাধরনের প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থ বা দপ্তরে নিত্য দেখা যাচ্ছে। তবে এর সবকটিই হয় একাডেমিক কাজের ধরনে নয়তো সংবাদপত্র বা বিভিন্ন মিডিয়াই একেবারে তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন একাডেমী তো তাদের গৎবাঁধা ফর্মুলায় তা ব্যবহার করছে। আর প্রিন্ট বা ভিজ্যুয়াল মিডিয়ার লক্ষই থাকে তার পাঠক বা দর্শকের চোখের আরামকে আরও সৌকর্যমণ্ডিত করা। পাঠকের মন-মেজাজকে অতি-সরলীকরণে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য বিরামচিহ্নের অতি সরল ব্যবহারই তাদের কাম্য। কিন্তু সবচেয়ে যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বা নিত্যআবিষ্কারের ধরনে যা ব্যবহার করা হয়, সেই ক্ষেত্র হচ্ছে সৃজনশীলতার প্রকৃত-জায়গা। সেই জায়গাতেই বিরামচিহ্নকে ব্যবহার করার বাসনা কিভাবে জাগতে পারে তাই নিয়ে আমাদের কিছু কথাবার্তা হবে।
বিরামচিহ্নের প্রথাগত নিয়মের বাইরে বিকল্প ব্যবহারের কিছু বিষয়ে আমি উদাহরণসহ উল্লেখ করব। কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রার প্রারম্ভেই তিনি নিজে একটা ভূমিকার ধরনে কথাবার্তা বলেছেন-- এর প্রথম প্যারাগ্রাফটি এরকম-
'এই গ্রন্থের ভাব বিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্য বিগ্রহ রামপ্রসাদের। রামপ্রসাদ আমাদের শুদ্ধ মন আনিয়া দেন॥ মা আমারে দয়া করে শিশুর মতো করে রেখো॥ অথবা॥ যে দেশে রজনী নেই মা॥ অথবা॥ কেলে সর্ব্বনাশী আমায় সন্ন্যাসী করেছে॥-- এ সকল কাব্যে তিনি ব্যক্ত।'
উপরের বাক্যসমূহে আমরা বিরামচিহ্নের ব্যবহার দেখে চমকে উঠছি। কারণ চমকে উঠায় আমাদের অধিকার আছে। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠানই আমাদেরকে অর্পণ করেছে। ডাবল দাঁড়ি আর প্রলম্বিত ড্যাশ (ড্যাশ আবার তিনজাতের হতে পারে, ১. স্বল্পায়ু--যা হাইফেনের প্রায় দ্বিগুণ হয়, ২. মধ্যআয়ু-- যা হাইফেনের প্রায় চার গুণ হয়, ৩. দীর্ঘায়ু --যা হাইফেনের প্রায় ছ'গুণ হয়।) যেভাবে তিনি বিরামচিহ্নের ব্যবহার করলেন তা সময়কে যেমন অস্বীকার করা হয়েছে তেমনি ব্যাকরণ সম্মতও হয়নি। অন্তত অতি সম্প্রতি বাংলা একাডেমী প্রযোজিত প্রমিত ভাষার ব্যাকরণ তাই সাক্ষ্য দেয়। তাহলে এখন কেউ যদি কমলের ভাবকে বহন করতে চায়, তার নামে কি রুল-নিশি জারি হবে? তাকে কি কোর্ট-কাছারির মোকাবেলা করতে হবে! অথবা আমরা যদি কমলকুমারের সুহাসিনীর পমেটম পাঠ করি, তাতে আরও ক্ষিপ্ত হতে পারি। সেই ক্ষিপ্ততার অধিকার তো আমাদের আছে। কারণ সারাটি গ্রন্থে তেমন কোনো বিরামচিহ্নই ব্যবহার করা হয়নি। তাহলে এমনতর প্রথামুখর চরিত্রহীন গ্রন্থ নিয়ে কী করব! সেখানে দৃশ্যত কোনো বিরামচিহ্নই নেই, তবে আমাদের ধারণা, অভ্যাসবশত আমরা কতিপয় চিহ্ন প্রয়োগ করে-করেই এটির পাঠ সমাপণ করি। এখানে পাঠকের সৃজনশীলতা রচিত হল। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কেন পাঠককে এমন অদ্ভুত স্বাধীনতা দিবেন! সৃজনশীল সাহিত্যের আমার তো সবচেয়ে ঘাতক মনে হয় দাঁড়িকেই। মনে হয় আমার সৃজনশীলতাকে কখনও কখনও বেকায়দায় এ চিহ্নটি। এমনকি আমার ইচ্ছা করে সৃজনশীল সাহিত্যজগতে একে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করি। কারণ ভাবনাকে খণ্ডিত, ম্লান, বিধ্ব¯ত করার ব্যাপারে এর ষড়যন্ত্রের শেষ নাই। চিহ্ন নিয়ে অনেকেরই অনেক ধরনের নেশা আছে-- যেমন, মামুন হুসাইন তো ই-প্রত্যয়ের আগে হরহামেশাই একটা হাইফেন বসান। সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ প্রমিত রীতির ক্রিয়া, যেমন : করে, বনে, ধরে, ইত্যাদির ঘাড়ে ক্রমাগত উর্ধ্বকমা চড়ান।
আমি যে চিহ্নটিকে ব্যববহারে সবচেয়ে ক্লান্ত-হতচকিত এমনকি বিরক্ত হই, সেটি হচ্ছে কোলন। এটিকে রাখার কোনো জায়গাই আমি করতে পারি না বা করতে যেন চাইও না। বিস্ময়চিহ্নই আমার প্রিয় চিহ্ন। আর যে চিহ্নটি ব্যবহারে সবচেয়ে আরাম পায় সেটি হচ্ছে ড্যাশ। মাঝারি মাপের, অবয়বে মাঝ-আকৃতির ড্যাশ, যেটি হয়ত মধ্যবিত্তের চলনও বহন করে, সেটিই বেশি মাত্রায় ব্যবহারের বাসনা হয় আমার। কিন্তু তা তো হয় না, কারণ এর চরম প্রতিদ্বন্দ্বী সেমিকোলন আর কমা প্রায়শই এর জায়গাটি নিয়ে নেয়। প্রথাগত নিয়ম হচ্ছে ড্যাশ-এর ডানে বায়ে খালি জায়গা না-রাখা। কিন্তু আমার তা ভালো লাগে না, এর ডানপাশে একটা স্পেস দিতেই আরাম পায়। একে দুইপাশ থেকে অন্য বর্ণ কর্তৃক ঠেসে ধরলে আমার কেবলই মনে হয় যেন এর দম আটকে মারাই যাবে!
প্রশ্নচিহ্নকে যুক্তিবিদ্যা আর দর্শনের একান্ত দোসরই মনে করতে পারি। কারণ প্রশ্নবিনে দর্শন আর তর্কের মন ভরে না। অথচ কার্যত আমরা দেখি, প্রশ্নচিহ্ন প্রায়ই ব্যবহার হয় অজানাকে জানার পরিধীতে এনে একটা আরামদায়ক দাঁড়ি বসিয়ে দেয়াতে। আমাদের বেশির ভাগ পাঠকই নিরীহ-আরামপ্রিয়-বিলাসি দাঁড়িতে খুব মজা পায়। আমরা দাঁড়িতে সুখ খুঁজে নেয়া জাতি; প্রশ্ন বা বিস্ময়বোধকে নিজের কব্জায় আনার ভিতরই যাবতীয় মজা খুঁজি। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্নমুখরতাকে তো ভালোবাসতেই চাই, সবচেয়ে পছন্দ করি বিস্ময়বোধকে। এই যে একটা বিস্ময়চিহ্ন এর ভিতরই যাবতীয় সৃজনশীলতার ক্ষেত্র খুঁজতে চাই। এই একটা চিহ্ন যার সদরে অন্দরে সৃজনশীলতার অনেক দায়ভারকেই সহ্য করতে হয়। এর উপর মানুষের মন-মেজাজের চাপও পড়ে বেশিই। বিস্ময় তো আছেই, আনন্দ, বিষাদ, কান্না, দ্বিধা, লাজ-শরমের অনেককিছুই একে বহন করতে হয়। বাংল্ভাাষার এই চিহ্নের উপর দিয়ে যত ঝড়-তুফান যায়, তা আর কোথাও কিন্তু নাই। এই চিহ্নের স্বাধীনতা, উদ্মুক্ততা যত বাড়বে আমাদের বলায়, পড়ায়, লেখনে এমনকি সৃজনে সৃজনশীলতাকেই আমরা দেখে নিতে পারব। এর পর যে চিহ্ন আমায় ভাবায় তা হচ্ছে, ড্যাশ আর সেমিকোলন। আমার লেখাজোকায় বিশেষত কথাশিল্পের জমিনে রীতিমতো সংশয়ে থাকি এর ভিতর থেকে কোন চিহ্নটি ব্যবহারে আমার বাক্যের শক্তি সবচেয়ে বেশি প্রকাশ পাবে। কমা আর সেমিকোলনের ভিতরও কোন চিহ্নটি ব্যবহার করব তা নিয়ে মাঝে মাঝে দর-কষাকষি চালাই আমি। বাক্যের কমা, সেমিকোলন, ড্যাশ ইত্যাদির ভিতর ট্রাডিশনাল ভুলে-ভরপুর-চিহ্ন আমি প্রায়ই হয়ত ব্যবহার করি। আসলে কোনটা ভুল আর কোনটা শুদ্ধ, এ বিচারের ভার আর ক্রিয়েটিভিটির উপরই ছেড়ে দিতে পছন্দ করি। আমার চিহ্নপ্রেম আমিই বহন করতে চাই, সাজাতে চাই, এর প্রয়োগ চাই। আমার এ চাওয়ায় কোনো ধরনের মাতব্বরি আমি নিতে চাই না। আমার সৃষ্টিশীলতা নিয়ন্ত্রণকারি কেউ থাকুক, চিহ্ন ব্যবহারের প্রাতিষ্ঠানিক মাস্টারি কেউ করুক তা আমি চাইও না।
কম্পিউটারে কম্পোজ করা, ইন্টারনেট সাহিত্য, ব্লগ, ফেসবুক ইত্যাদিতে কিছু চিহ্ন ইদানীং অটোমেটিকই ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন, ইটালিক, বোল্ড, নিম্নরেখা, শব্দকে ছোট-বড়ো করা, নানাধরনের জাস্টিফাইডকরণ আমরা এখন লক্ষ করি। সুবিমল মিশ্র বাক্য বা শব্দ ব্যবহারে যে ক্যারিশমা দেখাতেন, আলাদা করে নিজেকে প্রকাশের দায়িত্ব নিতেন, এখন যেন তাই একধরনের ফ্যাশন হয়ে যাচ্ছে। পাঠকের সাথে লেখকের রিলেশনের ধরনটাও নতুন কৌশল পাচ্ছে। লেখা কালো রঙের ইম্প্রেশন পার্সেন্টেজ কমিয়ে-বাড়িয়ে চোখের আরাম বা বেআরাম পয়দা করা হচ্ছে। এসব বিরামচিহ্নের জায়গাটিকে আরও বি¯তৃত করে দিচ্ছে।
গল্পে যে কী চাই
তাহলে আমি চাই কী! এই যে এই মাত্র ব্যবহৃত বাক্যে আমি বিস্ময়চিহ্ন ব্যবহার করলাম তা কিন্তু প্রশ্নচিহ্নের দাবিই অধিক। আবার এই যে প্রশ্নচিহ্নের ঘাড়ে একটা অ্যাপস্ট্রফি বসিয়ে দিলাম তা কিন্তু প্রথাগত ব্যাকরণ মানবে না। এটি প্রশ্নচিহ্নের বা প্রশ্নচিহ্ন-এর হতে পারে। কিন্তু ইদানীং এইধরনের উর্ধ্বকমা ব্যবহারের মানসিক প্রস্তুতি আমার আছে। এটি ভুল কি শুদ্ধ তা চিহ্নিতও করছি না। এই আমার সৃজনশীল ভুল, আমার ভুলের খেসারত আমি দিতে প্রস্তুত আছি। সৃজনশীলতার কোনো চুলছেঁড়া মীমাংসা চলে না, রাষ্ট্র-ধর্ম-সমাজ-পরিবার আমায় ক্রমাগত হুঙ্কার দিক তাই আমি চাই না। বিরামচিহ্ন ব্যবহারে নৈরাজ্যিক, মুক্ত-স্বাধীন মত প্রকাশের পূজারি আমি।
এ-ক্ষেত্রে এও বলতে হয়, ব্যক্তির মৌলিক সাংস্কৃতিক আবহ একটা বড়ো ব্যাপার। সাহিত্য আসলে ব্যক্তিকে প্রকাশ করার একটা পথ। সেখানে যা প্রকাশ করে তাই হচ্ছে মূল কথা। তাহলে সে যদি একটা অঞ্চলকে, ভাষাকে, ভাষাজনিত জ্ঞানব্যবস্থাকে আলাদা ভাষাভিত্তিক কাঠামো দিয়ে প্রকাশ করতে না চায়; তা দিতেই বহুজন বিবেচ্য একটা ভাষিক প্রবহমানতা বজায়ের চেষ্টা হতে পারে। তবে অতি অবশ্যই খেয়াল রাখা দরকার, তাতে যেন ধর্ম-সম্প্রদায়ভিত্তিক কোনো মনোপলি তৈরি না হয়। অঞ্চলভিত্তিক পেষণও যেন দৃষ্টিকটুভাবে কোনো এলাকাকে বহন করতে না হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, পুঁজির দাপটে ভাষার দুই রূপ বহাল আছেই। এক হচ্ছে, জীবনের স্বয়ম্ভূ রূপ অন্যটি হচ্ছে রাষ্ট্রের আচরণগত অফিসিয়াল রূপ। এরই ভিতরই জীবনের নান্দনিকতাকে জানার, লোকজ জীবনপ্রবাহকে বুঝতে পারার একটা পথ বের করার চেষ্টা নিশ্চয়ই রাখতে হবে। কারণ গল্পভাষার যে রূপটি এখন সাহিত্যিক-আচরণের সাথে জড়িয়ে আছে তা প্রায়শই রক্তহীন ব্যর্থ মনে হয়। এতে এক রক্তময় প্রবহমানতা আনা জরুরি। গল্পের প্রাকৃত লৌকিক স্বরকে খোঁজা দরকার। এবং তার ভিতর মাটিঘেঁষা আমেজ ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা লালন করার বিকল্প নাই। তাতে গদ্য শুধু নয়, পদ্যে এমনকি কবিতায় একধরনের দেশজ সুর স্পন্দিত হবে। শিল্পসাহিত্যের নবতর সুর সেখানে জায়মান থাকবে। ভালোলাগার স্পষ্ট অবয়ব গঠিত হবে। শব্দের ভিতর হয়ত লুকোচুরি খেলা যেমন থাকবে, তেমনি ভাষার সাজানো-গোছানো ভাব, শব্দ বা বাক্যের পরজীবীসুলভ তটস্থ প্রবণতার ভিতর থেকে দেশজ মাধুর্য ফুটে ওঠবে।
সময়ের সাথে সাথে অনেককিছুই পাল্টায়। গল্পও পাল্টায়, পাল্টাচ্ছেও। এর প্রায়োগিক বিন্যাস বদলে যাচ্ছে। শব্দের, বাক্যের,, চিহ্নের সহজাত বিস্তার অচেনা হতে থাকে। এটাই তো স্বাভাবিক--সমাজের, রাষ্ট্রের আচরণ অনেককিছুই বদলে দেয়। বাক্যের সহজাত মাধুর্য, বিষণ্ণতা, শব্দের নিপুণ কম্পন তছনছ হবার দশা। গল্পের স্বতঃস্ফূর্ত সৌকর্যও বদলে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের চেহারাও বদলে যাচ্ছে। উদার বুর্জোয়ার স্থলে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতাঘেরা বদ্ধজীবনের আবেশ গড়ে ওঠছে। মৌলবাদঘেঁষা ফ্যাসিজিমই সমাজের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করতে যাচ্ছে। এখন তো একেশ্বরবাদের হিংস্র রক্তজ স্রোতে শব্দের স্রোত নষ্টভ্রষ্ট কালোর আবহে ভরে যাচ্ছে। শব্দের শরীর একধরনের জাগরণমূলক স্পৃহা জাগ্রত করতে না পারলে সমাজের প্রগতিমুখর আর সহজাত সৃজনশীল বিকাশ সম্ভব বলে ধারণা করা মুশকিল। প্রগতিশীলতার উন্মোচন রহিত হতেই পারে। তবে গল্প মরে যাবার বিষয় নয়, এর রূপান্তর ঘটবে। ঘটছেও। গল্পে এককিসিমের সামন্ত প্রলেপ বাড়বে বলে ধারণা রাখা যায়। শুধু ভাষা নয়, নয় শুধু ভাষার জাগতিক রূপ; জীবনের কল্যাণকর শুভবোধকে নষ্ট করার পূর্বশর্তসমূহ জীবনের সমাজের রাষ্ট্রের চৈতন্যরূপকে পাল্টে দিচ্ছে। নৈঃশব্দের বিচিত্ররূপ জীবনকে বদলে দিচ্ছে; আমাদের প্রয়োজন সেইসব স্থানে যথার্থ শব্দ, ইঙ্গিত, ভাবময়তা ছড়িয়ে দেয়া। এখন প্রয়োজন ফিজিক্যাল স্টোরি-- যা গল্পের প্রতিষ্ঠানবিধ্বংসী রূপ ভয়ংকর যাতনাশ্রয়ী ধরনের গল্পকে প্রতিহত করবে, তাই একধরনের মূর্ত স্পৃহা হওয়া বাঞ্ছনীয়। গল্পের এমন দুর্দিনে গল্পকে নিয়ে নতুন যাত্রা করতে হবে, সেই নতুন মাত্রার নতুন যাত্রা শুরু করা দরকার। প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতার কায়দাকৌশল ভেঙে-গুঁড়িয়ে দেয়ার চৈতন্য উদয় হওয়া দরকার, ভাষামুক্তির নবতর অঙ্গন তৈরি করতে না-পারলে গল্পের মুক্তি সম্ভব নয়।
0 মন্তব্যসমূহ