সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-র ছোটগল্প

আহমেদ বাসার

বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক ধ্যান-ধারণায় দীক্ষিত হওয়ার বয়স খুব বেশি নয়। মূলত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ (১৯২৬) ও তার মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকা বাঙালি মুসলমানদের আত্মঘাতী ধর্মান্ধতা থেকে বের করে এনে মুক্ত পৃথিবীর আবহাওয়ায় মুক্তি দেয়ার যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তারই সুফল ভোগ করেছে পরবর্তী সাহিত্য ও সাহিত্যিকরা। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সাহিত্যের যে মূলধারা, তার মর্মমূলেও প্রবহমান সেই অবিনাশী স্রোতধারা।
সীমাবদ্ধ ধর্মীয় গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নির্মোহ দৃষ্টিতে জীবনকে পর্যবেক্ষণের প্রয়াস বাংলাদেশের যে কজন মুসলমান সাহিত্যিকের মধ্যে লক্ষ করা যায়, তাদের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অগ্রগণ্য। ধর্মের খোলসে নিনাদিত জীবনের আর্তি তাঁর সাহিত্যকর্মের একটি মৌল প্রবণতা। ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত পরিসরেও ওয়ালীউল্লাহ্ মানুষের বাহ্যিক জীবনাচারের অন্তরালে মানব-মনের বিচিত্র গতিবিধিকে অনুপুঙ্খভাবে পর্যবেক্ষণের প্রয়াস পেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি ‘জন্ম’ ও তার বিপরীত প্রান্তে অবস্থিত ‘মৃত্যু’কে তুলে এনেছেন শিল্পিত নির্লিপ্ততায় এবং দেখিয়েছেন তারই মাঝামাঝি দোদুল্যমান জীবনের অন্তর্লোক; যেখানে আছে ভয়, শঙ্কা; আছে ক্ষুধা কিংবা জিঘাংসা। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে আছে যাপিত জীবনের প্রতি এক উন্মুখ অভীপ্সা।

২.

ডিলান টমাসের (১৯১৪-১৯৫৩) একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থের নাম ‘ডেথ অ্যান্ড এন্ট্রাসেস’ অর্থাৎ ‘মৃত্যু ও প্রবেশ দুয়ার’। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্পেও আমরা দেখি মৃত্যুর ছায়ার জাগ্রত জীবনের নৃত্য। তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পেই (উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) মৃত্যু তার হিমশীতল শরীর নিয়ে উপস্থিত। বেশ কিছু গল্পের নামের মধ্যেও আছে মৃত্যু-ছায়া — ‘মৃত্যু-যাত্রা’, ‘খুনী’, ‘রক্ত’, ‘নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা’, ‘মৃত্যু’ প্রভৃতি। তবে মৃত্যুর কালো ছায়া যতই দীর্ঘ হোক না কেন, তাঁর গল্পে জীবনের প্রতি পক্ষপাতই প্রবল। তাই ‘মৃত্যু-যাত্রা’ গল্পে জীবনের দিকে যাত্রার আকাঙ্ক্ষাই বড় হয়ে ওঠে। এই গল্পের পটভূমিতে আছে তেতাল্লিশের মন্বন্তর। ক্ষুধাতুর মানুষের একটি দল, যার মধ্যে আছে তিনু, করিম, আসগর, তোতা, হাজুর বাপ ও মা প্রমুখ একমুঠো খাবারের আশায় গঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করে। পথেই হাজুর মা ও বাপের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু তাদের সহযাত্রীরা মৃতদেহগুলোকে ফেলে রেখেই চলে যায় পাশের গাঁয়ের এক চৌধুরী সাহেবের বাড়ির দিকে, যেখানে হয়তো পাওয়া যাবে দুমুঠো খাবার, যা তাদের বাঁচিয়ে দেবে মৃত্যুর করাল থাবা থেকে। ফলে এখানে প্রকৃতপক্ষে জীবন-যাত্রারই নামান্তর।

‘খুনী’ গল্পের কেন্দ্রেও আছে একটি মৃত্যু, অতঃপর জীবনের জন্য এক নির্মম আর্তি। চর আলেকজান্ডার সোনাভাঙা গ্রামের মৌলভীদের বাড়ির ছেলে রাজ্জাক একদিন ঝোঁকের মাথায় খুন করে বসে কজু মিঞাদের বাড়ির ছেলে ফইন্যাকে। এরপর সে আর কিছুতেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে না। অথচ স্বাভাবিক জীবনের প্রতি তার তৃষ্ণা দুর্নিবার। ফলে সে আবেদ দর্জির হারানো ছেলে মোমেনের পরিচয়ে তার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। মোমেনের স্ত্রী জরিনা বিবিকে বিয়ে করে সংসার জীবন-যাপনেরও স্বপ্ন দেখে। অকস্মাৎ একদিন আবেদ দর্জির ছেলে মোমেন ফিরে এলে রাজ্জাকের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অতঃপর তার অন্তরময় ঝলকে ওঠে তীক্ষ্ন বেদনা ফজু মিঞাদের বাড়ির ছেলে ফইন্যার জন্যও রাত্রির অন্ধকারে তার চোখ বেয়ে অশ্রু নেমে আসে। অশ্রু তো মানবিক অনুভূতিরই নির্যাস। মৃত্যুকে ব্যঙ্গ করে জীবন এখানে বিজয়ীর ভূমিকায় মাথা তুলে দাঁড়ায়।

‘নয়নচারা’ গল্পে আমু কিংবা ভুতনি ও ভুতোর যে শহরমুখী অভিযান তাতেও আছে মৃত্যুকে হটানোর নিরন্তর সংগ্রাম। তেতালি্লশের মন্বন্তর এ গল্পের পটভূমিতেও ক্রিয়াশীল। শহরের মায়া-মমতাহীন রুক্ষতায় আমুদের একমুঠো অন্নের জন্য হাহাকার জীবনের অন্য এক ব্যঞ্জনা তৈরি করে। ‘গ্রাম’ ও ‘শহরের’ প্রেক্ষাপট এখানে ‘জীবন’ ও ‘মৃত্যু’র প্রতিবিম্ব নিয়ে উপস্থিত। শহর রুক্ষ, নির্মম, প্রাণহীন; পক্ষান্তরে গ্রাম সজীব, সজল, প্রাণবন্ত। ফলে শহরের ‘জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটা’ ও কল্পনায় ময়ূরাক্ষী নদী হয়ে ওঠে। নদী তো জীবনের মতোই প্রবহমান, শহরের কালো পিচঢালা মৃত্যুর মতোই স্থবির।

‘নিষ্ফল জীবন নিষ্ফল যাত্রা’ গল্পে বৃদ্ধ সদরউদ্দিন যখন মৃত্যু-শয্যা ছেড়ে ‘বন্ধু-মিত্র-শত্রুর’ নিকট মাফ চাওয়ার অদ্ভুত মনোবাসনা নিয়ে পথে নেমে আসে তখন লেখক আমাদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ‘যে-মানুষ মৃত্যুর দ্বারে পৌঁছেও উগ্রসূর্যের তলে পথে-পথে এমনভাবে হাঁটতে পারে, সে আর মৃত্যুর ক্রীতদাস নয়।’

মূলত সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ গল্পের কোনো চরিত্রই মৃত্যুর ক্রীতদাস নয়। তাদের মৃত্যু-উপলব্ধি জীবনোপলব্ধিরই আরেক রূপ। মৃত্যু-চেতনা তাদের জীবন-চেতনাকেই প্রগাঢ়তা দেয়। ‘মৃত্যু’ গল্পে সেকেলে মানুষ খান সাহেব বদরুদ্দিনের রোগা স্ত্রী আমেনা খাতুন ‘এলোপাতাড়ি দিশেহারা দিনগুলো কাটিয়ে এক শান্ত অপরাহ্নে পৌঁছে হঠাৎ তিনি যেন দুনিয়া আবিষ্কার করলেন, তিনি নিজেকে খুঁজে পেলেন, বাঁচার প্রয়োজন ও জীবনের অর্থও যেন তার কাছে প্রতিভাত হলো মামুলি ধরনে। সেদিন এ পরিবারে একটি স্মরণীয় দিন। খান সাহেব বদরুদ্দিন (তখন তিনি সবেমাত্র খান সাহেব হয়েছেন) তাঁর কালো রংচটা ছেঁড়া আচকান পরে কোর্ট-অভিমুখে রওনা হচ্ছেন, এমনি সময়ে তাঁর স্ত্রী আমেনা খাতুন তাঁর মাথায় এক পাতিল ডাল ফেলে দিয়েছিলেন।’ কিন্তু ঘটনাটির মর্মার্থ উপলব্ধি করতে পারেনি তাঁর উকিল স্বামী। বস্তুত বছর বছর ‘চোখ-বোজা মাংসের পি-’ জন্ম দিলেও আমেনা খাতুন স্বামীর ভালোবাসাহীন উদাসীনতাকে হঠাৎ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর এ উপলব্ধিই তাঁকে স্বামীর প্রতি ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তারপর একদিন আমেনা খাতুন স্বামীকে ক্ষমা করে দিয়ে ‘মারা গেলেন’। তখন তাঁর চোখে ছিল না সেই সর্বগ্রাসী আগুন, ‘যে আগুনকে তাজিয়ে রাখবার জন্য তিনি চেষ্টা করেছেন দিনের পর দিন’ এখানে মৃত্যুর চেয়ে বড় তাঁর জীবন-সচেতনতা যে জীবন শুধু যান্ত্রিকভাবে বাঁচা নয়, তার চেয়ে বেশি কিছু।

৩.

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোট গল্পে স্নেহ-মায়া-মমতার জন্য এক নিষ্করুণ মানবিক আবেদন ঝঙ্কৃত হয়ে ওঠে। শহরের দেয়াল-কঠিন নির্মমতায় তাঁর গল্পের চরিত্ররা অনাবিল স্নেহের পরশ খুঁজে বেড়ায়। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান থাকায় তাঁর চরিত্ররা কল্পনার এক জটিল জাল রচনা করে নিজস্ব গহ্বরেই ঘুরপাক খায়। ফলে ওয়ালীউল্লাহ্র গল্পে ঘটনা থাকে না, ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় চরিত্রের মনোজাগতিক উত্থান-পতনই এখানে মুখ্য হয়ে ওঠে। ‘নয়নচারা’ গল্পে তেতাল্লিশের মন্বন্তর নয়, আমুর মনোজাগতিক উন্মোচনই প্রধান। গ্রাম ও শহর এখানে সমান্তরালভাবে অবস্থান করে। তবে একটি স্বপ্নে, অন্যটি বাস্তবতায়। ফুটপাতে শুয়ে আকাশের তারার দিকে তাকিয়ে আমু ভাবে, ‘ওই তারাগুলোই কি সে বাড়ি থেকে চেয়ে-চেয়ে দেখত? কিন্তু সে-তারাগুলোর নিচে ছিল ঢালা মাঠ, ভাঙা মাটি, ঘাস, শস্য আর ময়ূরাক্ষী। আর এ তারাগুলোর নিচে খাদ্য নেই, দয়ামায়া নেই, রয়েছে শুধু হিংসা-বিদ্বেষ, নিষ্ঠুরতা, অসহ্য বৈরিতা।’ এই গল্পে শহরের রুঢ়তার ওপর প্রলেপ ছড়িয়েছে নয়নচারা গ্রামের স্নিগ্ধ প্রশান্তি। লালপেড়ে শাড়ি পরা একটি মেয়ে কখন দুটি পয়সা দিয়ে চলে যায় তখন আমু ভাবে মেয়েটির সাজানো চুল আসলে ‘নয়নচারা গাঁয়ের মেয়ে ঝিরার মাথার ঘন কালো চুল’। শহরের বন্ধ দরজাগুলোর সামনে ঘুরে ঘুরে একটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমু ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার করে উঠলে ‘অবশেষে দরজার প্রাণ কাঁপল, কে একটা মেয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল, এসে অতি আস্তে-আস্তে অতি শান্ত গলায় শুধু বললেন: নাও। আর তাৎক্ষণিকভাবে আমুর চকিত জিজ্ঞাসা — ‘নয়নচারা গায়ে কি মায়ের বাড়ি?’ নয়নচারা গ্রাম এখানে স্নেহ-মমতার প্রতীকী শরীর নিয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

‘জাহাজী’ গল্পে বৃদ্ধ করিম সারেঙের সুদীর্ঘ জাহাজী জীবনের নৈঃসঙ্গ্য অনবদ্য ভাষারূপ পেয়েছে। সমুদ্রের নীল জলে ঘুরে ঘুরে তার জীবনে কোনো গ্রন্থি পড়েনি। ফলে ছেলেদের বয়সী লস্কর ছাত্তারকে দেখে তার মধ্যে পিতৃত্বের হাহাকার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জীবনে গ্রন্থি পড়লে হয়তো ছাত্তারের মতোই একটি সন্তান তার সামনে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। তাই তার কাছে নারীবান্ধবহীন ‘অতিক্রান্ত দীর্ঘ জীবন অদ্ভুতভাবে শূন্য ও ব্যর্থ ঠেকছে কঙ্কালের চোখের মতো।’

রক্ত গল্পেও রূপায়িত হয়েছে সংসার জীবনের জন্য তৃষ্ণার্ত এক খালাসির মর্মবেদনা। অসুস্থ খালাসি আবদুল, আক্কাসের সংসার-জীবনের সংস্পর্শে এসে নিজের শূন্যতাকে প্রবলভাবে উপলব্ধি করে। তার শুষ্ক হৃদয় আর্তনাদ করে ওঠে — ‘কোথায় স্নেহের উৎস?’ আবদুলের অসুস্থ শরীর-মন তীব্রভাবে কামনা করে কোনো রমণীর হাতের পরশ, একটু মমতার আশ্রয়। আক্কাসের বাসায় রাত্রিযাপনের সময় শেষরাতে আবদুলের মুখ দিয়ে কাঁচা রক্ত বেরোতে থাকে। এই রক্ত যেন আবদুলের রিক্ত হৃদয়ের উগরে দেয়া নির্যাস। আহ! প্রায় অচেতন অবস্থায়ও আবদুল আক্কাসের বিবিকে খুঁজে বেড়ায়। তার ব্যাকুল জিজ্ঞাসা বার বার প্রতিধ্বনিত হয়ে ওঠে, ‘বিবি, তোমার বিবি কই?’ কিন্তু বিবির উপস্থিতি উপলব্ধি করার ক্ষমতা তখন তার ছিল না। তাই ‘তীক্ষ্নতম ব্যর্থতায় এবার তার হৃদয়ে যে-ক্ষত হলো, সে-ক্ষত দিয়ে ঝরতে লাগল রক্ত, ঝরতে লাগল গলগলিয়ে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তর তার চেয়ে আরো অন্ধকার ভবিষ্যৎকে প্রদীপের শেষ-কম্পনের মতো শুধাল : এমন দিন কি কখনো আসবে যখন নিবিড় স্নেহমমতায় ডুবে গিয়ে সে বলতে পারবে যে বিগত কোনো একদা স্নেহভালোবাসা শূন্য শুল্ক প্রান্তরে তার নিঃস্ব রিক্ত হৃদয় দিয়ে গলগলিয়ে রক্ত ঝরেছিল, রক্ত?’ হয়তো আসবে না। কারণ সময় ও পরিবেশ তার অনুকূলে নয়। আর তাই তার রিক্ত হৃদয়ের আশাবাদ আমাদের এতটা স্পর্শ করে।

‘সূর্যালোক’ গল্পে মানুষের ক্রোধ ও হিংস্রতার বিপরীতে স্নেহ মায়া ভালোবাসার জয় ঘোষিত হয়েছে। এই গল্পে ফালু তুচ্ছ একটা ঘটনা নিয়ে তার সহযাত্রীর ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হঠাৎ তার স্মৃতিলোকে একটি অশ্বত্থগাছের চিত্র ভেসে আসে যার খোদলে ছিল শকুনের বাসা। শকুনের বাচ্চার কান্নার কথা মনে এলে তার হৃদয় স্নেহাদ্র হয়ে উঠল। ‘তার ইচ্ছে হলো কাঁদতে-থাকা শকুনের বাচ্চাটিকে বুকে নিয়ে চুমো খেতে। সে জানে যে সে-বাচ্চাগুলো কেমন কুৎসিত হয় দেখতে, কিন্তু কেমন করে যে কাঁদছে, সেটি, আহা…’ তার হঠাৎ-জেগে ওঠা এই স্নেহবোধ সহযাত্রীর দিকেও ধাবিত হয় তাৎক্ষণিকভাবে। ফলে কালু নিঃসংকোচে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। তবে লেখক এখানে বাস্তবতা-বিস্মৃত হন না। তিনি প্রশ্নাতুর ভঙ্গিতে জানিয়ে দেন — কোত্থেকে এল এই স্নেহের জোয়ার? এল মানুষের অন্তর থেকে, যার স্রোত মানুষ আটকে রাখে বাঁধ তুলে : দুনিয়ায় বাঁচতে হলে সে-স্রোতের বন্যা ক্ষতিকর।’ একসময় কালু অশ্রু ছলছল চোখ তুলে তাকায় অন্ধকারের পানে, ‘যে-অন্ধকার স্নেহ-মমতাকে বিদ্রূপ করে না আলোর মতো।’ কিন্তু আমরা দেখি গল্পের শেষে সূর্যালোক জেগে ওঠে। এবং রাত্রির কাব্য মিছে হয়ে মুছে যায় সূর্যালোকে। এই গল্পে আলো-অন্ধকারের প্রথাগত যে প্রতীকী প্রয়োগ না ভেঙে পড়ে আলো এখানে অশুভ ও হিংস্রতারই প্রতীকী ব্যঞ্জনা তৈরি করে।

৪.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের চরিত্ররা প্রায়শ মানস ভ্রমণের আশ্রয় নয়। ফলে গল্পে ‘Stream of Consciousness’-এর একটি আবহ তৈরি হয়, ‘নয়নচারা’, ‘খুনি’, ‘গ্রীষ্মের ছুটি’ প্রভৃতি গল্পের কথা এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়। কখনো কখনো তার গল্পে চরিত্ররা মনোলোগ-এরও আশ্রয় নেয়। ‘মতিনউদ্দিনের প্রেম’ গল্পে মেদমাংসশূন্য ক্ষীণ কাঠামোর ক্ষুদ্র আকৃতির মানুষ মতিনউদ্দিন যখন এক স্বপ্নে দেখা নারীর প্রেমে পড়ে সংসার ও স্ত্রী সম্পর্কে উদাসীন হয়ে ওঠে তখন তার হতবিহ্বল স্ত্রী খালেদা স্বামীকে প্রশ্ন করার সাহস না-পেয়ে নিজের সঙ্গেই কথোকথনে লিপ্ত হয়।

চরিত্রের মানস-ভ্রমণ আন্তন চেখভের (১৮৬০-১৯০৪) গল্পেও লক্ষ করা যায়। ‘চুম্বন’ গল্পের হ্রস্বকায় গোল কাঁধ, চশমা চোখে, বিড়ালের মতো গোঁফওয়ালা অফিসার স্টাফ ক্যাপ্টেন রিয়াবোভিচ সেনাপতি ফন রেকেবের বাড়িতে গিয়ে একটি অন্ধকার কক্ষে এক অদেখা নারীর অপ্রত্যাশিত একটি সশব্দ চুম্বন পেয়ে যায়, যা তার জীবনকে আমূল বদলে দিয়েছিল। এরপর থেকেই শুরু হয় তার নিরন্তর মানস পরিক্রমা। বাস্তবতা তার কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। ওয়ালীউল্লাহর মতো চেখভের গল্পও ঘটনাবিহীন। দুজনই চরিত্রের মনোজগতের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। কিন্তু দুজনের জীবনবোধ ও শিল্প-জিজ্ঞাসা ভিন্ন। আন্তন চেখভ চরিত্রের মনোজগতকে বিশ্লেষণ করেন তার হীনতা, ক্ষুদ্রতা ও অসহায়তাকে চিহ্নিত করেন এবং এর জন্য দায়ী সামাজিক কারণগুলোর দিকে তিনি তর্জনী তুলে ধরেন। ‘কেরানির মৃত্যু’ গল্পে ইভান দমিত্রিচ চেরভিয়াকভ এক চমৎকার সন্ধ্যায় অপেরার অভিনয় দেখায় সময় হঠাৎ সামনের সারির একজন ভদ্রলোকের গায়ের ওপর ‘হ্যাঁচ্চো’ করে ফেলেন। প্রথমদিকে তার কোনো প্রতিক্রিয়াই হয় না। কারণ ‘কোনোখানেই কারোরই তো হাঁচতে মানা নেই। চাষি মরদেরা হাঁচে, পুলিশ কর্মকর্তারা হাঁচেন, এমনকি মাঝে মাঝে গোয়েন্দা উপদেষ্টারাও হাঁচেন।’ কিন্তু চেরভিয়াকভ যখনই জানতে পারে যে, সামনের সারির সেই ভদ্রলোকটি পরিবহন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের স্টেট জেনারেল ব্রিজালভ তখনই এক অজানা ভীতি ও শঙ্কা তাকে গ্রাস করে নেয়। চেরভিয়াকভ বার বার ব্রিজালভের কাছে অযাচিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে। অবশেষে ব্রিজালভ বিরক্ত হয়ে তাকে প্রচ- এক ধমক দেন। এবং তারপর, ‘চেরভিয়াকভের পেটের মধ্যে কী যেন ছিঁড়ে গেল। কিছু না দেখে, কিছুই শুনতে না পেয়ে তিনি দরজার দিকে এগোলেন, রাস্তায় বেরিয়ে এলেন এবং হোঁচট খেতে খেতে চলতে লাগলেন... যন্ত্রের মতো বাড়ি ফিরে এসে, ফ্রককোটকি না খুলেই ডিভানের ওপর শুয়ে পড়লেন এবং... মরে গেলেন।’ মানুষের এই হীনতা, কীটতুল্য ক্ষুদ্রতার জন্য কারা দায়ী, কার স্বার্থে মানবতার এই বিকৃতি? এই প্রশ্নই এখানে বড় হয়ে ওঠে। কিন্তু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্পের নিয়তি-চেতনাই মুখ্য। যদিও সামাজিক সমস্যাকে তিনি অস্বীকার করেননি। ওয়ালীউল্লাহর গল্পের চরিত্ররা এক অজানা ভয়, শঙ্কা ও অস্তিত্বের অনিশ্চয়তাবোধ দ্বারা তাড়িত। এই বৈশিষ্ট্যগুলো অস্তিত্ববাদী সাহিত্যেরও অন্যতম লক্ষণ।

গল্প সাহিত্যের প্রথম দার্শনিক Brander Matheu ছোটগল্প সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘The short story by its effect, a certain unity of impression which sit it apart from other kinds of fiction.’ সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ছোটগল্প সম্পর্কেও একই কথা বলা যায়। ওয়ালীউল্লাহ তাঁর মেধা, মনন ও সাধনার দ্বারা গল্পের এমন এক ধারা তৈরি করেছেন, যা নিঃসন্দেহে অভিনব এবং যাকে নির্দ্বিধায় ‘peculiar product’ আখ্যা দেয়া যায়।
বাংলাদেশের সমসাময়িক ছোটগল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রভাব গভীর, গভীরতর। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রসর ছিলেন। ফলে তাঁর রচিত সাহিত্য পাঠকের বোধের দুয়ারে কড়া নাড়তে কিছুটা সময় নিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখক থেকে শুরু করে সম্ভাবনাময় তরুণ লেখকের মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমানভাবে সক্রিয়। এটি তার সৃজনী-সচলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এবং এ সত্যও আজ অবিসংবাদী যে, বাংলাদেশের আধুনিক গদ্য সাহিত্যের ভিত নির্মাণে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এক স্তম্ভপ্রতীম কথাশিল্পী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. A fantastic review on the works of S. Waliullah... Thanks much to the writer. ..

    উত্তরমুছুন
  2. হেমায়েত হোসেন তুহিন২২ জুন, ২০২২ এ ১:২৮ PM

    সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ কে আপনি সুন্দর এবং সাবলিল ভাবে উপস্থাপন করেছেন।।।
    যেমন উপস্থাপন করেছেন লেখক তার গল্পে মানুষের জীবনের প্রকৃতি কে

    উত্তরমুছুন
  3. হেমায়েত হোসেন তুহিন২২ জুন, ২০২২ এ ১:৩০ PM

    ধন্যবাদ আপনাকে

    উত্তরমুছুন