সুবোধ ঘোষ এর গল্প উচলে চড়িনু




তেঁতুলিয়া মাঠের ঘাসের রঙ বার মাস সবুজ। অনেক দিন আগে ভোরবেলা ঘুম ভেঙে বাইরে আসতেই দিনেশ বড় সুন্দর একটা দৃশ্য দেখেছিল। তেঁতুলিয়া মাঠে লাল কৃষ্ণচূড়ার ভাঙা ভাঙা ডালপালা ছড়িয়ে রয়েছে। ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিল কোথা থেকে। আজ আবার ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে — তেঁতুলিয়া মাঠের সবুজে হঠাৎ কোন উত্তুরে হাওয়ায় রক্তিম তুষারের ফুল কতকগুলি এসে ছড়িয়ে পড়েছে। একদল ইরানী বেদের মেয়ের — মাঠের এককোণে পড়েছে তাদের তাঁবু।


পরনে খাট খাট লাল ঘাগরা, হাঁটবার সময় কেঁপে দুলতে থাকে। মন হয় ওটা বুঝি ওদের গায়ের পালক। নিটোল খালি পা — গোলাপী মোমের প্রলেপ দেওয়া। রুক্ষ বেণীগুলি কোমর পর্যন্ত ঝোলে। গায়ে বেগুণী রঙের জামা, চুড়িদার আস্তিন কব্জি পর্যন্ত। মাথায় কপাল চেপে রুমালের ফেট আর তার নিচে লালচে মুখ, টিকালো নাক আর তার দুপাশে জোড়া জোড়া চোখ যেন কাস্পিয়ান নীলিমায় টলমল।

মাঠের অন্যদিকে হল্লা আর হর্রা চলছে খুব। বেদিয়া যুবকেরা ছোট ছোট জুয়ার বৈঠক বসিয়েছে। বাজারের বহু উত্সাহী জুয়াড়ী সেই ব্রাহ্মমুহূর্তেই এসে ভীড় করেছে গন্ধে গন্ধে — ভাগ্যের সঙ্গে প্যাঁচ কষে নিচ্ছে এক হাত। অথবা রাত্রেই শুরু হয়েছিল — হারজিতের টানাপোড়েনে মাত করে আর মার খেয়ে দেখতে দেখতে ভোর হয়ে গেছে।

সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। দত্ত কোম্পানীর অফিসে এতক্ষণ ধর্ণা দিয়ে ঘরে ফিরেছে দিনেশ। মাত্র পাঁচটা টাকা অ্যাডভান্স, তাও চেয়ে পাওয়া যায়নি। তবে শুধু খালি হাতে ফিরতে হয়নি।

পথে ফিরতে বিলাসী কোত্থেকে এসে তার হাতে গুঁজে দিয়ে গেছে কয়েকটা টাকা — ‘ধারই দিলাম বাবু। যখন পার শোধ করে দিও।’

খনির মজুরণী বিলাসী, এ বয়সেই পাঁচবার সাঙ্গা তালাক করেছে। নামকরা নেশাড়ী সুপেশল কালো কঠিন চেহারা। মুখ ও বুকের ছাঁদে নারীত্বের কোমলতাটুকু অটুট আছে। গতরভাঙা পরিশ্রমে পুরুষ মজুর ওর কাছে হার মানে।

বিমর্ষ দিনেশ ঘরের বাইরে দাওয়ার ওপর বসে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে হিস্টিরিয়ার মতো শরীরে একটা তীব্র কম্পন আর অবসাদ নেমে আসে। কিসের বিরুদ্ধে যেন তার একটা অভিযোগ পুঞ্জীভূত হয়ে আছে।

বছর দু’এক আগের কথা, কলেজের বার্ষিক উত্সবে দিনেশ তার রোমান রিংয়ের খেলা দেখিয়েছে। বাঘের চামড়ায় আঁটসাঁট জাঙ্গিয়া, খোলা গা। দোলায়মান রিংয়ের ওপর কসরত। লীলায়িত পেশীপুঞ্জের রক্তরাগে ফুটে ওঠে প্রাণের সম্মানলিখা। করতালির বরষা আর শত শত দর্শকের বিমুগ্ধ আশীর্বাদ। গ্যালারি থেকে কনভেন্টের মেয়েদের রুমালের উত্ক্ষেপ আর হর্ষের কাকলি। কোথায় মিলিয়ে গেল সে ছবি!

বাঙালী সমাজে কানা খোঁড়ার জীবনেও বিয়ের ফুল ফোটে। ভবিষ্যপুরুষের ধমনীতে তারা সঁপে দিয়ে যায় শুধু কতকগুলি পঙ্গু বীজাণুর প্রবাহ। তাতেও দোষ নেই। যত বিচার আর ব্যতিক্রম শুধু দিনেশের অদৃষ্টে। বিয়ের সম্বন্ধ আসে আর ভেঙে যায়। পাত্রের যা রোজগার — এক সপ্তাহের পেটের খোরাক যোগাতেই নিঃশেষ। কন্যাপক্ষ আতঙ্কে পিছিয়ে যায়।

এদিকে দত্ত কোম্পানী আবার মাইনে কাটে। দিবারাত্রি দু’দফা সিফট চলে। খনি হাতড়ে মাল ওঠে না। এটাও যেন তারই অপরাধ। এর চেয়ে সাত সাগর ছেঁচে মুক্তো আনাও বোধহয় সহজ।

দিনেশের অন্তরাত্মা হিংস্র হয়ে ওঠে। তার চেয়ে ভাল ফ্যাকাসে তোবড়া একটা মুখের ভেতরে দু’পাটি পোকাপড়া দাঁত — সোনা দিয়ে বাঁধানো। অস্থিসার একটা নড়বড়ে শরীরে অজীর্ণ আর অম্লশূল — কাশ্মীরী শালে ঢাকা। যে কোন ঘটক দেখলেই খুসিতে আটখানা হয়ে যাবে। যেন ঐ সোনা আর শালের ঔরসে জন্ম নেবে জাতিধর আর বংশধরের দল।

আরো মুশকিল হয়েছে ভদ্রলোক হয়ে লেখাপড়া শিখে। জীবনের দুর্ধর আবেগ টেনে নিয়ে যায় পাতালের দিকে। বিলাসীকে নিয়ে যে জনরব গড়ে উঠেছে তার সম্বন্ধে সেটা সত্য হয়ে উঠতে চায়। কিন্তু রুচিতে বাধে। পদে পদে ভদ্রয়ানার নিষেধভীরুতা। অভাবে স্বভাব নষ্ট হবে, এ হতে পারে না।

আবার মনে হয় ,সমাজ সংসার মিছে সব। এই জঙ্গল আর পাথরের চটান। চুনা পাথরের ধস নেমে গেছে নদীর গড়খাই পর্যন্ত — অগণ্যকোটি কীটের চূর্ণাস্থি। এই সেই গণ্ডোয়ানা ভূমি যেখানে গলিত প্রস্তরের নিশ্বাস শূন্যে মিলিয়েছে একদিন। যে পরমাণুর যজ্ঞে সৃষ্টি হলো হীরা, পান্না, পেখরাজ, নীলা, পদ্মরাগ। প্রথমে প্রেমে মরণাহত কত অতিকায় গোধিকার চুম্বন আঁকা আছে এই পাষাণে পাষাণে। দিনেশের ইচ্ছে হয়, অর্বাচীন বিংশ শতাব্দীর এই সংকুচিত জীবনের জঞ্জাল ঠেলে দিয়ে বিলাসীর পাশে গিয়ে দাঁড়ায় আত্মনাশের আনন্দ।

কিন্তু তা হয় না।

ঘরে চোর ঢুকেছে। দিনেশের ঘুম ভেঙে গেল। খু্টখাট শব্দ।

বড় ভুল করেছে চোর। দিনেশ ভাবতে গিয়ে নিজেই লজ্জিত হলো। এ ঘরে চুরি করার মতো কিছু নেই। কি নেবে চোর ? পাশের ঘরে আছে একটা রুটি সেঁকার তাওয়া, বেলুন, চাকি, খুন্তি আর এলুমিয়ামের ডেকচি। বারান্দায় আছে এঁটো থালা আর গেলাসটা। উঠোনে একটা পাইখানা যাবার পেতলের গাড়ু। পশ্চিমের ঘরে শুধু একটা এনামেলের গামলা — ছোলা ভেজান আছে। এর মধ্যে কোন্ জিনিসটা চোরের পক্ষে লোভনীয় হতে পারে ?

একটু দূরেই তো ছিল দত্ত কোম্পানীর অভ্রের স্টোর। হাঁপানী রুগী কুঁজো মুকুটধারী সিং বন্দুক ঘাড়ে পাহারায় রয়েছে। চোর যদি তার সামনে গিয়ে একটু জোরে কাশে তবে বন্দুক খসে পড়বে হাত থেকে নির্ঘাত! তারপর কাঠের বাক্সগুলি ভেঙে ফেললেই হলো — হাজার পাঁচ তো পাবেই। কিন্তু গবেট চোরগুলোর চোখে সোজা রাস্তা তো পড়ে না। এসেছে ওভারম্যান দিনেশের ঘরে।

আরও ভুল করেছে চোর। সে জানে না এখানে থাকে দিনেশ চৌধুরী — যে সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা, পুরো দম টানলে যার বুকের বেড় বেলুনের মতো ফুলে আচল্লিশ ইঞ্চি হয়, আধ ইঞ্চি পুরু ও আড়াই ইঞ্চি চওড়া লোহার পাত যে চিটেগুড়ের মতো দুমড়ে মুচড়ে দেয়। দৈবাৎ যদি চোরের হাত দিনেশের ঐ লোহার পাঞ্জায় ধরা পড়ে, কি হবে পরিণাম ? এক হ্যাঁচকা টানে কাঁধ থেকে ছিঁড়ে খুলে আসবে না কি ?

সত্য চোর ঢুকেছে, এ ব্যাপার জেনেও দিনেশ আবার গায়ে চাদরটা টেনে নিল। ঘুমের আরামটুকু নষ্ট করে লাভ নেই। চোরের যা সাধ্যি থাকে করুক।

কিন্তু মনে পড়লো বড় আয়নাটা, রূপোর ফ্রেমে বাঁধা; ঘরে দেওয়ালে টাঙ্গান আছে। কমিশনার সাহেবের মেম কসরৎ দেখে খুশি হয়ে এ উপহার দিয়েছিলেন। পঁচিশজন গুরুভার মানুষে বোঝাই একটা গরুর গাড়ির চাকা ঘাড়ের উপর দিয়ে পার করেছিল দিনেশ, যার জন্যে আজও একটা ঘাড়ের রগ মাঝে মাঝে টনটন করে।


এখন মাসের শেষ। একটা গামছা দিয়ে ঢাকা আছে আয়নাটা। খোরাকের কমতি পড়েছে এখন, তাই ডন বৈঠক মেহন্নতও বাদ পড়েছে। এখন চলছে শুধু ঝিঙের তরকারি আর ভাত। এই খোরাকে এক্সারসাইজ করলে ক্ষতি হয় শরীরের-দম ঢিলে হয়ে আসে, পেশিগুলো রুক্ষ হয়ে কুঁচকে যায়। একটুতে ক্লান্তি বোধ হয়।
পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনে। তবু মাসের প্রথম ক’টা দিন প্রতি নিঃশ্বাসে, মাংসপেশীর প্রতি লীলায়িত নৃত্যের মধ্যে দিনেশ প্রাণের আস্বাদ পায়। পেট ভরে রুটি-তরকারি, একপো ঘিয়ের ফোঁড়ন দেওয়া অড়হরের ডাল, একটু সুরুয়াদার মাংসের কারি, সকালের দিকে মোষের দুধ, বিকেলে বাদামের সরবত। ডনবৈঠক আর বারবেল ভাঁজার পর তেলে মাজা শরীরে স্নান সেরে দিনেশ এই আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়, আয়নার বুকে সেই অপার স্বাস্থ্য মহিমার প্রতিচ্ছায়ার পায়ে তার মন অনুরাগের আবেশে নুয়ে পড়ে।
আয়নাটা গেলে ক্ষতি হবে। দিনেশ বিছানা ছেড়ে উঠলো।
দিনেশের পায়ের শব্দে একটা চোরের ছায়ামূর্তি ঘরের ভেতর থেকে ছিটক বারান্দায় এসে পড়লো — সঙ্গে সঙ্গে জড়িয়ে পড়লো দিনেশের লোহার মতো দু বাহুর পাকে। মুহূর্তে মধ্যে চোরের শরীর নরম নতুন বালিশের মতো চেপ্টে যেন এতটুকু হয়ে গেল।
দুড় মুড় আওয়াজ। আরও ক’জন  চোর উঠোনের পাঁচিল ডিঙিয়ে খিড়কির দোর খুলে পালিয়ে গেল।
বন্দী চোর হাপাচ্ছে। দিনেশের কানের কাছে চোরের কাতর স্বর বেজে উঠলো, অতি করুণ এক আবেদন — ‘উঃ, গায়ে ফোড়া আছে, বড় লাগছে।’
আচম্কা শিথিল হয়ে পড়লো দিনেশের বাহু বন্ধন। দ্বার খোলা পিঞ্জরের পাখীর উল্লাসের মতো চোর একবার মরীয়া হয়ে ছটফটিয়ে উঠলো মুক্তির জন্যে। কিন্তু দিনেশ তার ভুল বুঝে সামলে নিল।
আর একবার কেঁপে উঠলো দিনেশ। চোর তার বুকের উপর বসিয়ে দিয়েছে হিংস্র কামড় — নির্বিষ সাপের ছোবলের মতো একটু চিন্ চিন্ করে উঠলো শুধু। স্প্রিংয়ের মতো পেশিতে দাঁত বসাতে পারে না — চামড়াটা শুধু ছড়ে যায় সামান্য। দিনেশ আর একবার কষে দিলে নিদারুণ আলিঙ্গন গ্রন্থি। নিপিষ্ট চোরের দম ফেটে এক পরম হতাশায় আক্ষেপ ফুঁপিয়ে বেজে উঠলো।
কিন্তু ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসছে দিনেশের হাত অলস অবসাদে। রেশমের মতো নরম চুলেভরা চোরের মাথা দিনেশের চিবুকে ঘষা খেল একবার। ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিতেই চোরের মাথার বেণীটা চাবুকের মতো দিনেশের কাঁধের ওপর সাপটে পড়লো। তার ওপর মিঠে ফুলের গন্ধ, বেণীতে গোঁজা ফুল, টাটকা সুলতান চাঁপা।
একটা স্বেদাক্ত মসৃণ মুখ মাছরাঙা পাখীর মতো হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েছে দিনেশের মুখের ওপর। জেলির মতো কোমল দুটি অদৃশ্য অধরের বিহ্বল চুম্বন। আগোচরের এই স্পর্শ তিলে তিলে গ্রাস করে নিচ্ছে তার পরিচয়। শরীরের প্রতি কণিকা যেন চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কাঠিন্য হারিয়ে।
বাইরের অন্ধকার থেকে মৃদু ঝড়ের স্রোতে ভেসে আসছে অতি করুণ একটা শব্দের কম্পন — ফাটা বাঁশির আওয়াজের মতো। শত শত সাপ যেন ফনা তুলে শিষ দিয়ে ডাকছে সঙ্গিনীকে। দিনেশের হাত দুটি ঝুলে পড়লো।
এক মিনিট মাত্র। অবসাদের ঘোর কাটিয়ে উঠে দিনেশ দেশালাই জ্বালালো। হাতে চকচকে ছুরি — একটা ইরানী বেদে মেয়ে — হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুলছে। এরাই এসেছে তেঁতুলিয়া মাঠে।
বাইরে আর একবার সাপের শিষের ঝড় শিউরে উঠলো একসঙ্গে। চোর খিড়কির দরজা দিয়ে চকিতে পার হয়ে চলে গেল।
দত্ত কোম্পানীর অভ্রের খনি। ওভারম্যান দিনেশ ডিউটি দিতে নেমে চললো সুড়ঙ্গের পথে। হাতে টর্চ আর বেঁটে একটা লাঠি। চওড়া ঢালু পথ নেমে গেছে — গাছের ডাল দিয়ে সিঁড়ি করা, পা ঠেকা দেবার জন্যে। মাথার ওপরটা যেন এক বিরাট পাষাণের চন্দ্রাতপ — গাঁইতার মারে চেঁচেছুলে খিলান করে দেওয়া হয়েছে। তবুও মাঝে মাঝে ফাটল — ভূভারের আক্রোশ যেন ভ্রূকুটি করে রয়েছে। কাঁচা গাছের তক্তা দিয়ে খিলানটা এক প্রস্থ তালি মারা হয়েছে — পচে ছিঁড়ে গেছে আর্ধেক কাঠ। তারই ফাঁকে চুঁয়ে পড়ছে ভুস্কো মাটি, কাদাজল আর কাঁকর। একটা শিমূলের শেকড় সাপের লেজের মতো ঝুলছে। ঢালু সিঁড়িটা শেষ হয়েছে যেখানে — ছাতটা সেখানে পাকা ফোড়ার মতো ফুলে উঠেছে। এক ভয়ংকর পরিণামের আশঙ্কায় টনটন করছে জায়গাটা। দুর্বল আশ্বাসের মতো কয়েকটা কাঠের খুঁটি দিয়ে ঠেকা দেওয়া হয়েছে।
নামতে নামতে দিনেশ এসে দাঁড়ালো ঢালুর শেষে — জায়গাটা প্রায় সমতল। দুধে মাটির কাদায় পা ডুবে যায়। দুপাশে স্তরে স্তরে কেওলিন গলে রয়েছে। এখানে দাঁড়িয়ে আর কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা খাড়া চানকের মুখ মাথার অনেক ওপরে, বহিঃপৃথিবীর আলোয় রাঙা দিনমানের একটা বুদ্ধুদের মতো ভেসে রয়েছে।
এখান থেকে তিন দিকে তিন সুঁদ চলে গেছে। দু’পায়ে গুঁড়ি মেরে আর দু’থাবায় হেঁটে দিনেশ চললো — টর্চের আংটাটা দাঁতে কামড়ে। ধারালো কোয়ার্সের নুড়িতে হাঁটু ছড়ে যায়। ঘাড় টাটিয়ে উঠলেও মাথা তোলা যায় না। মাথার ওপরে এবড়ো খেবড়ো পাথর — পাতাল দানবেরা দাঁত মেলে পড়ে আছে। বেসামাল হলেই মাথার খুলি ঠুকে যায়, ভেঙে যেতেও পারে। সরীসৃপের মতো পাকিয়ে পাকিয়ে বুকে হেঁটে দিনেশ চলেছে ডিউটি দিতে — পঁয়ত্রিশ টাকার চাকরি।
নুড়ি ভরা পথটা শেষ হয়েছে। তারপর হঠাৎ একটা ঢালু। দিনেশ ঝুপ করে পড়ে গেল।
যেন একটা স্প্রিংযের গদি। একটা রামার গদি। খনিকরের উপেক্ষিত কালো অভ্র রামা। রামা কালো বলেই অকেজো, কেউ ছোঁয় না। এ জায়গাটা তবু একটু সুপরিসর — চার দিক ঠাহর করা যায়। নইলে সুঁদের পথে একবার ঢুকলে মনে হয় — এ জগৎ যেন আয়তনতত্ত্বের বাইরে। দৈর্ঘ্য প্রস্থ বেধ — উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। শুধু অশরীরী একটা প্রাণ অচরিষ্ণু পাথরের স্তর দীর্ণ করে এগিয়ে চলে — চাকরি করতে।


দিনেশ উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পাগুলো একবার নেড়ে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যেন মেরুদণ্ডের আশ্রয়ে বসিয়ে দিল। সুঁদের পথ এবার আরো গভীরে ডানদিকে ঘুরে খাড়া নেমে গেছে। গুমোট বড় বেশি — কাছে কোন চানক নেই। টর্চ জ্বালালেও পথ পরিস্কার দেখা যায় না। কোটি কোটি অভ্ররেণু স্তব্ধ ঝড়ের মতো পথ জুড়ে রয়েছে।
অনেকটা ঝুলে ঝুলে নামতে হয়। একটা দড়ি খুঁটোয় বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, গতির বেগে দেহের ভার যেন আয়ত্তের বাইরে না চলে যায়। পাশে একটা চওড়া খুপরি। রেড়িব তেলের একটা পিদিম নিভে রয়েছে। একটা শূন্যগর্ভ তাড়ির ভাঁড় — কয়েকটা ভাঙ্গা গালার চুড়ি। নামার পথে দিনেশ এখানে রোজই একবার জিরিয়ে নেয়।
এই খুপরিটা যেন পাতালপুরীর একটা পান্থশালা। শুধু মুনাফা শিকারী ব্যবসায়ী মানুষের নখের আঁচড় নয় — প্রাণময় মানুষের কামনার শিলালিপিও লেখা রয়েছে এখানে।
দড়ি ধরে ধরে দিনেশ নিচে নেমে চললো। এই ধুলি ধাতু ও পাষাণের সংসারে সেও যেন পরমাণুর মতো লঘু হয়ে আসছে। মর্তলোকের যত পাপ পুণ্যের সংস্কার এই অতল অন্ধকারের শাসনে খসে পড়েছে একে একে। মৃত্যু এখানে কত ঘনিষ্ট — তাকে প্রাণের মতই এখানেই অনুভব করা যায়।
গন্ধকের ধোঁয়ার গন্ধ। দিনেশের চাকুরির আস্তানা এগিয়ে আসছে। সুঁদের একটা সংকীর্ণ বাঁক — একটা কুঁয়োর মতো গর্তের মুখে এসে শেষ হয়েছে। হুম হুম হুম — একটানা একঘেয়ে একটা শব্দের গমক। পাষাণের হৃদ্পিণ্ডটা যেন অন্ধকারের নিঃশ্বাস ছাড়ছে। আবার মনে হয়, লক্ষ দীর্ঘনিঃশ্বাসের একটা ঘূর্ণি পাথরের পেটে বন্দী হয়ে আছে — ক্ষেপে ফেটে পড়তে চায়।
কুঁয়োর মুখে এসে ঝুঁকে তাকাতেই এই শব্দ তাণ্ডবের যেন একটা ছন্দোবদ্ধ অর্থ পাওয়া গেল। খনিমজুর বানিয়াতিদের গান। মেয়েকুলি ধা়রিদের কলহাস্য। খান হাতুড়ির আছাড়ের আওয়াজে গুরু গুরু ধ্বনি। নুড়ির স্তূপের ওপর ছপ ছপ করে বেলচার টান পড়ছে। একেবারে নীচে একটা পিদিম — একটা আলোদানার চক্ষু যেন নিষ্প্রভ হয়ে রয়ছে।
সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দিনেশ অন্ধ অজগরের মতো লাফিয়ে পড়লো হাত তিনেক নীচে — সাত নম্বর দরজা, দিনেশের ডিউটিস্থল।
বানিয়াতিদের গান আর খান ছেনির উদ্দাম সংঘর্ষ বন্ধ হলো। পিদিমে আরও খানিকটা তেল ঢেলে সলতে উস্কে দেওয়া হলো। জেলেকনাইটের ধোঁয়া আর ঘোলা আলোর সেই নীহারিকার মধ্যে দিনেশের চোখে প্রথম ধরা দিল একটা হাসি হাসি মুখ — প্রতীক্ষমান এক জোড়া চোখের সার্থক দীপ্তি — বিলাসী।
বিলাসী একটা বেলচা কোলের কাছে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। — ‘আজ বড় দেরি হলো বাবু ?’
বিলাসীর দিকে একবার তাকালো দিনেশ — হ্যাঁ, পাতালপুরীর মেয়েই বটে। ধূলায় রুক্ষ চুলের ওপর অজস্র অভ্রের কুচি চিকচিক করছে — যেন একটা চুমকির জালি দিয়ে ঘেরা। নোংরা শতছিন্ন কালো রঙে ছাপানো একটা ধূলিকীর্ণ শাড়ি — রসাতলের এক তপস্বিনীর মূর্তি! ওরা হাড় দিয়ে পাথর ভাঙে। মর্ত্যলোকের নারীর মতো ওদের দেহ লালিত্যে লতিয়ে ওঠেনি। ধরিত্রীর এই তমসাবৃত জঠরলোকে ওদের অয়স্কান্তির কঠিন লাবন্য কত নয়নাভিরাম তা এখানে না এলে কেউ বুঝবে না। এই পাষাণের ছন্দে ওদের যৌবন বাঁধা। যে কোন ক্লিওপেট্রাকে এখানে কুত্সিত প্রেতিনীর মতো মনে হবে।
কিন্তু দিনেশের মন আজ ছন্দ হারিয়েছে। বিলাসীর কথার উত্তর না দিয়ে কাজের হিসেব নিতে মন দিল।
দুটো মেয়ে ধারি বেলচায় মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে আর ঘুমের ঘোরেই থুথু ফেলছে মাঝে মাঝে। মেয়ে দুটোর কণ্ঠনালি রবারের থলির মতো এক-একবার ফুলে উঠছে — বমির তোড় আটকাচ্ছে দাঁতে দাঁত দিয়ে।
বীভত্স! দিনেশ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিলাসী এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। দিনেশ সরে গেল।
বানিয়াতি লোটন বললো, ‘ওদের আজ হুঁস নাই বাবু। মানা করলাম তবুও শুনলো না। নেশা করেছে।’
দিনেশের মেজাজ রুক্ষ হয়ে উঠলো, ‘আর কে কে  ? নাম বল তো।’
‘— আর চমন। একবার ঐদিকে তাকিয়ে দেখ বাবু।’ লোটন হেসে ফেললে।
চমন পাথরের গায়ে একটা খুপরির মধ্যে হাত-পা গুটিয়ে রেখে চোখ বুজে ধীর স্থির হয়ে বসে আছে। পাতালপুরীর কোন ভাস্কর যেন এক অলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব মূর্তি রেখেছে খোদাই করে।
তিনজনের হাজরি কেটে দিয়ে দিনেশ আবার কাজের কথাই পাড়লো, ‘একি ? এতখানি ছাড় রেখে বাঁধ দিয়েছিস কেন ?’
লোটন মুচকি হেসে বললো, ‘বাবু, আর একজনের হাজরি কাটতে হয় তা হলে।’
দিনেশ — ‘আর কে ?’
বিলাসীর মাথাটা নেশায় দুলছিল। দিনেশের মেজাজী গলার স্বর শুনে, মুখে আঁচল চাপা দিল ভয়ে। লোটন তেমনি মুচকি হেসে কাজের কথার উত্তর দিল, ‘ওটা বাজা পাথর বাবু। বিঁধে কিছু হবে না। মিছা বারুদ নষ্ট হবে।’
টর্চের আলো ফেলে দিনেশ চারদিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। কোন দিকে কোন ভরসার চিহ্ন নেই। আজ সাত দিন ধরে কাজ হচ্ছে, দশ সের মালও ওঠেনি। জেলেকানাইটের করাল বিস্ফোরণে এই অন্ধ পাথরের বুক ফেটে এক-আধটু ধূলো চাপড়া ঝরে পড়েছে শুধু। মালিকের পয়সা নষ্ট হচ্ছে, এর পরিনাম কি হবে তা সেই জানে। এই পাতাল ঘেঁটে তাকে বার করতে হবে কোথায় অভ্রের রেতি — রত্নকায় সরীসৃপের মতো কোয়ার্সের বুকে লুকিয়ে আছে। নইলে মাইনে ও মজুরী মুন্সীজীর খাতায় কালির আখরেই লেখা থাকবে, হাতে আর আসবে না।
দিনেশের মেজাজ ধারি ও বানিয়াতিদের কাছে আজ একটু অন্যরকম লাগলো। হুমকি হুকুমবাজি তো এখানে অচল। তা ছাড়া দিনেশবাবু অতি দিলদার লোক। ধারি বানিয়াতি আর ওভারম্যানের ধর্ম এখানে একই সঙ্গে সমাহিত ছিল পাতালিক প্রীতি বন্ধনে। আজ এই ব্যতিক্রম কেন ?
আর বিলাসী ? সে তো বেশ ভাল ফাকনিক কাজ জানে, কারখানায় বসে অভ্র কাটলে রোজগার অনেক বেশি হতে পারে। তবু ধারি হয়ে ঝুড়ি ও বেলচা নিয়ে নেমেছে এই মৃত্যুময় অভ্রমরীচিকার গহনে। যে সিফ্ট যত নম্বর দরজায় ওভারম্যান দিনেশের ডিউটি থাকে, বিলাসীও সেখানে থাকবে। খনিমহলে কথাটা আরও অবিদিত নেই। প্রত্যেক শ্রমিক ও শ্রমিকের কাছে ঐ দুজনের গল্প অনেকটা রূপকথার মতো, আলোচনা করতে বেশ মজাই লাগে। এর মধ্যে কিছুই অশোভন, কিছুই অসুন্দর নেই।
সেই দিনেশবাবু আজ কেমন যেন বিসদৃশ হয়েছে। বিলাসীর সঙ্গে একটা কথাও হলো না। লাঠি ও টর্চ হাতে দিনেশ আবার সিঁড়ির তলায় এসে দাঁড়ালো। ‘ — তোরা আবার একটা বিঁধ দিয়ে আওয়াজ কর। দেখ, কপালে যদি কিছু থাকে। আমি ওপাশের ছোট গাড়াটা একবার দেখে আসি।’
সিঁড়ি ধরে একটু ওপরে উঠে আসতেই দিনেশ পেছনে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। বিলাসী।
‘— একি ? তুই আসছিস কোথায় ?’
‘— তোমার সঙ্গে।’
‘— না, নিজের কাজে যাও।’
বিলাসী সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল নিথর অভিমানের শিলীভূত মূর্তির মতো।
‘— তালা নেবে। খুব সস্তা; খুব মজবুত। চোরে ভাঙতে পারে না, বউ পালাতে পারে না।’
দিনেশ চমকে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখলো — একটা ইরানী বেদে মেয়ে, যাদের তাঁবু পড়েছে তেঁতুলিয়া মাঠে। একটা বড় চামড়ার পেটি ঝুলছে কাঁখের ওপর — রকমারী পণ্য সামগ্রীতে পরিপূর্ণ।
‘— দেখছো কি ? তালা নেবে কিনা বল ?’ মেয়েটা সরাসরি দাওয়ায় উঠে একেবারে দরজার মুখে এসে দাঁড়ালো।
দিনেশ তাকিয়েছিল। হ্যাঁ, এই মেয়ে। সেই রেশমী চুলের বেণী — মাথায় সুলতান চাঁপা গোঁজা। হতভম্ব হয়ে ধরা গলায় দিনেশ আস্তে আস্তে বললো, ‘কত দাম ?’
মেয়েটা এদিক ওদিক দু’বার তাকালো। ভুরু কুঁচকে কি ভাবলো। ছোট একটা পেতলের তালা তুলে ধরে বললো, ‘দাম দশ টাকা।’
ফ্যাল ফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দিনেশ আর কোন কথা না বলে দরজা বন্ধ করে দিল। বাইরে থেকে মেয়েটা ওর একবার চেঁচিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, পাঁচ টাকা। না হয়, দু’টাকা। জিনিস চেন না বেকুব ?’
দিনেশের কানে কোন কথাই পৌঁছল না।
দুপুরের রোদ মাথার ওপর তেতে উঠেছে। দিনেশ তবু দাওয়ায় বসে আছে। আজকাল রোজই এইরকম হয়। বসে বসে দেখে তেঁতুলিয়া মাঠের চারদিকে তাতারসি কাঁপে — তৃষ্ণার ছবির মতো। বেদে মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে রোজই এ পথে তাঁবুতে ফেরে। — ‘পেলে টাকা ?’ যাবার সময় জিজ্ঞাসা করে যায়।
দিনেশের ইচ্ছে হয় একবার ডেকে প্রশ্ন করে নামধামগোত্র। কেমন এই পথিক মানুষের দল, মেরুমরালের পাখার মতো পথের প্রেমে যাদের স্নায়ু শিরা সতত চঞ্চল। মহাদেশের গিরিদরিবন ধরে যায় আর আসে। ভাষা গান উত্সব সবই পথ থেকে কুড়িয়ে নেয়। যেখানে পায় তুলে নেয় নতুন পাপপুণ্য, নতুন রক্তে, নতুন ব্যাধি। দিনেশের জানতে ইচ্ছে হয়, ওরা কাঁদতে জানে কিনা। না শুধু হাসির ফুত্কারে জীবন উড়িয়ে নিয়ে যায় আয়ুর সীমানায়, ডাকতে সাহস হয় না দিনেশের।
‘— আচ্ছা, এক টাকা। সস্তা করে দিলাম। এইবার রাজি হয়ে যাও।’ নির্লিপ্তভাবে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলি বলে মেয়েটা চলে যায়। দিনেশও আর বড় বিচলিত হয় না। যায়াবরীর এই নিত্য চতুরালি গা সহা হয়ে আসছিল।
গলায় চুনীর মালা ঘাঘরার শব্দে দিনেশকে সচকিত করে মেয়েটা এক দিন সামনে এসে ভালমানুষের মতো চুপ করে বসলো। মুখ ঘুরিয়ে নিল দিনেশ। শীগ্গির চলে গেলে হয়। এ সব অপ্রাকৃতিক জীব — ঘনিষ্ট না হওয়াই ভাল। কিন্তু বড় সুন্দর।
‘— কি ? তাকাতে ভয় পাচ্ছ বুঝি ? কোন ভয় নেই,যত খুশি তাকাও।’
কথার মধ্যে কোন আবেগ নেই, তবু মোহ এসে পড়ে। দিনেশ তাকালো লজ্জা সত্ত্বেও।
‘— একটু ঠাণ্ডা জল খাওয়াতে পার মেহেরবান!’ মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
ক্লান্ত হবার কথা। দু’পায়ে পুরু ধূলোর ঢাকা পড়েছে। এই রৌদ্রে কতদূর ঘুরে এসেছে কে জানে। দিনেশ ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো জলের জন্য। এক দুরন্ত বনহরিণী দোরে এসে তৃষ্ণার জল চাইছে তার কাছে।
গেলাসে জল নিয়ে বাইরে আসতেই দিনেশ দেখলো মেয়েটা নেই। রাস্তা ধরে নিজের মনে চলে যাচ্ছে। পেছন ফিরে একবার তাকাতেই খিলখিল করে হেসে উঠল।
দিনেশ সেদিন প্রতিজ্ঞা করে বসে আছে আজ ডেকে ওর পরিচয় নেবেই। রবিঅভ্রের মতো অমন সুন্দর চেহারা। ওর মধ্যে মানুষীর হৃদয় থাকবে না, এ কি করে হয় ?
‘— এই শোন, কাজের কথা আছে ?’ দিনেশ সহজস্বরে ডাকলো।
নকল ত্রাসে চোখদুটো বড় বড় করে মেয়েটা বললো, ‘ওরে বাবা, যাব না। জুলুম করবে।’
দিনেশের প্রতিজ্ঞাটা যেন কিসের সংকোচে এলোমেলো হয়ে গেল, কিন্তু প্রত্যুত্তরে তৈরী হবার আগেই মেয়েটা সটান চলে এল। বললো, ‘আমার নাম সারা, তুমি একটাও তালা কিনলে না। কত করে বললাম।’
হাসি মুখেই দিনেশ বললো, ‘তোমার তালা কিনবার মতো লিয়াকৎ আমার নেই। আমি গরীব।’
সারার উদ্ধত দৃষ্টি যেন নরম হয়ে আসে। জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কি কর। রোজগার কর না ?’
‘— অভ্রের খাদে কাজ করি।’
‘— খাদে ? ভেতরে নাম তুমি ?’
‘— হ্যাঁ, রোজই।’
‘— তুমি আদমি নও। তুমি সাপ, নইলে গর্তে ঢোক কি করে ?’
সত্যি এদের কথাবার্তার চালচুলো নেই। দিনেশ একটু বিরক্ত হয়েই চুপ করে গেল। কতক্ষণ আনমনা হয়েছিল দিনেশ জানে না। হঠাৎ চোখে পড়লো সারা একাগ্রে দৃষ্টি দিয়েই দেখছে — দুটি শান্ত মেয়েলী চোখের দৃষ্টি। দিনেশ খুসি হলো। সরার কণ্ঠস্বরে সত্যই মমতার আমেজও ফুটে ওঠে। বললো, — ‘তোমার বিবি নেই ?’
‘— না।’
‘এমন নওজোয়ান তুমি। বিবি নেই ? আজব তোমার কাণ্ড!’
দিনেশের হাসি বেড়েছে, ‘তুমি বিবি হবে!’
‘— হব। বুড়ো হলে কিন্তু পালিয়ে যাব।’
‘— আর তুমি বুড়ি হবে না বুঝি ?’
সারা ততক্ষণ উঠে ঝোলাঝুলি পিঠে তুলে তরতর্ করে নেমে গেছে দাওয়া থেকে। ভুরু কুঁচকে মুচকি হেসে বলে গেল, — ‘এত দিল্লগী ভাল নয়। সাপ কাঁহাকা।’
আর একদিন সারা বললো, — ‘তোমার সঙ্গে বসে শুধু গল্প আর গল্প। আর পারবো না। আমার রোজগার খারাপ হয়ে গেছে। মালিক আমায় জবাই করে ছাড়বে, যদি জানে.......।’
দিনেশ — ‘কি ?’
সারা — ‘যদি জানে তোমার সঙ্গে মোহব্বৎ হয়েছে।’
দিনেশ চমকে উঠলো।  — এ কি কথা বলে ? মোহব্বতের কথা যাযাবরীর মুখে ? হিমনদের মতো নিরাবেগ যাদের জীবনে হাসি কান্না উষ্মা অভিমান। পথে তুলে নেওয়া আর পথে ফেলে যাওয়া যাদের আনন্দ ?
সারা — হ্যাঁ, মালিকদের কানে পৌঁছে গেছে। আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। এ বেইমানীর সাজা কি জান তো ? নেড়া করে তাড়িয়ে দেবে দল থেকে। বলবে — ‘যা তোর মাশুকের কাছে যা!’ ওকে তো চেন না, একটা কুর্দকসাই।’
সারার চোখ ছলছল করছে। হিমনদের গহনে অন্তঃশীল প্রবাহের কলক্রন্দন। সারা মুখ ফিরেয়ে নিল।
কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতার পর সারাই কথা বললো। গলাটা যেন একটু ধরে এসেছে। ওদের ভাষায় মিনতি নেই, চোখে দেখে বুঝে নিতে হয়। — ‘তুমি চল।’
‘— কোথায় ?’
‘— আমার কাছে, আমার তাঁবুতে।’
‘— তারপর ?’
‘— তারপর আর কি ? থাকবে, ঢোলক বাজাবে।’
প্রস্তাব শুনে দিনেশ হেসে চুপ করলো। সারা বিস্ময়ের সুরে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, ‘এ কি হাসছো ? জবাব নেই ?’
দিনেশ তেমনি একটা ভারিক্কি হাসি হেসে বললো, ‘আচ্ছা সে হবে হবে।’ যেন কোন দোজবরে বাঙ্গালী স্বামী তার দ্বিতীয় পক্ষের একটা ছেলেমানুশী বায়না মিষ্টি কথায় ঠাণ্ডা করছে।
সারার দৃষ্টিও প্রখর হয়ে এল। আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি, জবাব দিলে না ?’
আবার সেই লেদারে ভালমানুষী হাসি। দিনেশ শুধু বললো, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয় জবাব দেব।’
সারা মাঠের পথে নেমে পড়লো।
সারা ভালবেসেছে। এতদিন পরে সত্যিকারের ট্রফি লাভ হয়েছে দিনেশের। জীবনের সবচেয়ে বড় বঞ্চনার ক্ষতে এতদিনে যেন একটু জ্বালাহর প্রলেপ পড়লো। তার পৌরুষের তোরণে এসে ইরাণী যাযাবরীর চিত্ত সকল উদ্ভ্রান্তি ঘুচিয়ে শান্ত হয়ে গেছে। নতুন করে যেন মধ্য এশিয়া জয় করলো সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত।
মনে পড়লো বিলাসীর কথা। ওর ওপর মমতা হয়। দু’দিকের দুই আহ্বান। বিলাসী ডাকে মৃত্যুর গহনে, আর সারা ডাকছে জীবনের খরস্রোতে। সাসার নীল চোখের দিকে তাকিয়ে এক স্বর্গঙ্গার কলরোল শুনতে পায় দিনেশ, শুধু ভেসে চলে যাবার আহ্বান। কিন্তু বিলাসীর কালো চোখ তাকিয়ে আছে নিঃসঙ্গ ভোগবতীর অতল থেকে, যেন ডুব দিয়ে তলিয়ে যেতে ডাকছে বার বার।
সারা এসে বিষণ্ণভাবে বললো, ‘কেমন আছ ? আমাদের দিন ফুরিয়ে এল। এবার তাঁবু উঠবে। আর কি ? এবার একদিন এসে শেষ সেলাম জানিয়ে যাব।’
দিনেশের বিমূঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে সারা কোন মতে হাসি চেপে রাখলো।
একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে দিনেশ সেদিনের মতো ঘরোয়া কথা পাড়লো, যার ঘর নেই তার সঙ্গে। ‘ — তোমার বাড়ি কোথাও একটা ছিল তো ? সে কোথায় ? ইরাণ ?’
‘— আমি ইরাণী নই। আমি জহান-কি রানী।’ খিলখিল করে হেসে উঠলো সারা।
তারপর সহজভাবে ভাটের ছড়ার মতো নিরর্গল কথার স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চললো দিনেশকে। ‘আমি তাজিকের মেয়ে, বাবা আমাকে বেচে দেয় এক খোরাসানী সদাগরের কাছে। হিন্দুস্থানে আসতে আজাদ এলাকার তোচিখেল বদমাসেরা আমাদের লুঠ করে। বড় বেইজ্জত হয় আমার। আমাকে তারা ধরে নিয়ে যায়। তারপর পেশোয়ার বাজার।’
সারার চোখের তারা দুটো স্থির হয়ে গেছে। ঘাঘরার ধূলোর মতো সমস্ত স্মৃতিভার সে যেন ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছে কথা বলে বলে।
— পেশোয়ারে বাজারে আমাকে তারা বেচে দিলে পাঁচ আফগানীর বদলে — মিয়াঁওয়ালী বেদিয়াদের কাছে। তারপর কানপুর। অসুখে ভুগে খোঁড়া হয়ে গেলাম। মিয়াঁওয়ালীরা বেচে দিল কঞ্চরহাটিদের কাছে — একটা মুর্গীর দামও তারা পায়নি। রোগা শুকনো খোঁড়া মেয়েমানুষ, কিই বা তার দাম হতে পারে ? সেই থেকে আমি এই কাঞ্চরহারি তাঁবুতে। তারা নাচিয়ে নাচিয়ে আমার খোঁড়ামি ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। আর ভাল লাগে না, তবে বেইমানি করে চলে যেতেও পারি না। ভাল লোক যদি কেউ আবার কিনে নিত!’
একটা আপসোসের শব্দ করে সারা চুপ হলো।
‘— তুমি আমায় কিনে নাও। যতদিনের জন্য ইচ্ছে কিনে নাও। যেদিন খুশি ছেড়ে দিও। কিছু টাকা দিলে মালিককে দিয়ে তোমার কাছে চলে আসি।’ উত্তেজনায় রাঙা হয়ে উঠলো সারার মুখ।
এ প্রখর অনুরোধের আঘাতে দিনেশের নিরেট ভালমানুষী ভীরুতা একটু নাড়া খেল যেন। অধৈর্যে কাতর সারার গলার স্বর।  — ‘তবু তুমি ভাবছো ? না হয় পরে আমায় আবার বেচে দিও। এমন নওজোয়ান মরদ, টাকা জোগাড় করতে পার না ? ইচ্ছে করলে এক রাত্রে তুমি হাজার টাকা আনতে পার। আমি চললাম। সেলাম।’
সারা উঠতেই দিনেশ তাকে ধরে বসাতে গেল। সারা দু’পা পিছিয়ে বললো — ‘ব্যাস, ছুঁয়ো না। আমাকে ছোঁবার কোন হক্ নেই তোমার ?’
দিনেশ — ‘এই তোমার মোহব্বত ?’
সারার গলার স্বর যেন কাতরতায় আকুল হয়ে উঠলো — ‘তুমি বোঝ না অন্ধ। এই মোহব্বতের জন্য আমায় সাজা পেতে হবে। প্রাণ যেতেও পারে। রোজগার নষ্ট করে তোমার সঙ্গে দোস্তি করেছি। মালিক সব কথা জানে। আমায় বাঁচাও।’
‘— ভয় নেই সারা। আমি টাকা আনছি দু’তিন দিনের মধ্যেই। পাকা কথা দিলাম।’
‘— জিতা রহো মাশুক মেরা! আমায় উদ্ধার করো। মালিকের দেনা শোধ করে দিয়ে আমি চলে আসি তোমার কাছে।’
সারার মুখ কৃতার্থতার হাসিতে দীপ্ত হয়ে উঠেছে। আজ বিদায় নেবার সময় দিনেশকে একটা ছোট সল আদাব জানিয়ে গেল। পথে নেমে চামড়ার ঝোলা থেকে বার করলো একটা নাসপাতি। গুন গুন করে চাপা গলায় গান ধরে, নাসপাতি খেতে খেতে তেঁতুলিয়া মাঠের পথে হেলে দুলে চলে গেল।
টাকা চাই। কন্যাপণ। এই পরম নির্বন্ধের জন্যই দিনেশের যৌবন অপেক্ষায় বসে ছিল শুধু। বরপণের দেশে তাইতো যে পুরুষের মর্যাদা পায়নি।
ভালই হয়েছে। বীর্যশুল্কা যাযাবরীর চিত্তজয়ের আমন্ত্রণ এসেছে তারই কাছে। মধ্যযুগের ক্ষত্রপ প্রেমিকের মতো আত্মপ্রসাদে দিনেশ যেন অস্থির হয়ে ওঠে।
বিলাসী এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। সেদিনের আচরণের কথা স্মরণ করে দিনেশ অনুতপ্ত।
‘— আয় বিলাসী, তোকে ছাড়া কাজ চলবে না আমার। একটা শক্ত কাজ আছে।’
এই আহ্বানের জন্যই বিলাসীর অন্তরাত্মা উদ্গ্রীব হয়ে থাকে। অনেকদিন আগেই এ আহ্বান শোনার দাবী ছিল তার। যার সঙ্গে ছায়া হয়ে মিশে থাকতে চায় সে, তারই কাছে। আর কারো কাছে নয়। যার হাত ধরার জন্য রোজগার, কুলমান, কুটীরসুখ ও আলো-বাতাসের মায়া ছেড়ে নেমে এসেছে এই অতলতার অমারাজ্যে, যেখানে মরণ ও মিলন মিশে রয়েছে একাকার হয়ে।
যে সিঁড়ির কাছে সেদিন বিলাসীকে থামিয়ে দিয়েছিল দিনেশ, সেখান থেকেই আজ আবার শুরু হলো যাত্রা। কোথায় কোন্ লক্ষ্যে, বিলাসী তা জানে না। তার জানবার প্রয়োজন নেই।
দিনেশের প্ল্যান ঠিক ছিল। বেলচা, শাবল, গুল্লা টোপ আর রেড়ির তেলের পিদিম নিয়ে তারা অগ্রসর হলো।
ছোট বড় নানা সুঁদের বাঁক ঘুরে ঘুরে একটা ছোট খাদের কাছে এসে দিনেশ ও বিলাসী দাঁড়ালো। টর্চের আলো ফেলে ধীরে ধীরে চারিদিকে দেখে নিল। বিলাসীর বেলচা দিয়ে দিনেশ ক’বার আঘাত দিতেই একটা ফাটল ধরা পাথরের চাপ খসে পড়লো ঝুপ করে।
উত্কট উল্লাসে দিনেশ চেঁচিয়ে উঠলো — ‘দেখছিস বিলাসী ?’
— ‘হ্যাঁ।’
বিলাসী দিনেশের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল। ওর চোখের তারা দুটো তারই দিকে স্থির নিবদ্ধ, লুব্ধক জ্যোতি জ্বল্জ্বল্ করছে।
‘— এই দিকে একবার তাকিয়ে দেখ।  খুব সাবধান বিলাসী। কেউ যেন না জানে। মাত্র তিন বিঁধে খসে পড়বে হাজার টাকার মাল। পশ্চিমের চানক দিয়ে তুই মাল পার করে দিবি। ওপরের জঙ্গলে খদ্দের দাঁড়িয়ে থাকবে। উপায় নেই বিলাসী, করতেই হবে, আমার টাকার দরকার।’

সারি সারি গোরিয়া পাথর যেন ভরসার স্তরের মতো এখানে এসে পৌঁছেছে। দেখা যাচ্ছে কাজরা পাথরের চাপ — তিল-চিহ্নখচিত সুলক্ষণা গোরী ললনার গালের মতো। তারপর এই যোগিনিয়া পাথরের তিলকুট — রাঙা পাষাণীর কটাক্ষে রত্নলোকের ইসারা ফুটে উঠেছে স্পষ্ট হয়ে। ‘ — এই নে গুল্লা টোপ। বিঁধে ফেল্ বিলাসী।’ দিনেশ পকেট থেকে জেলেকনাইটের মোড়কটা নামালো।
শাবল দিয়ে একটা জায়গা বিঁধে আওয়াজ করবার ব্যবস্থা হয়েছে। ফিউজের বাতিটা ধীরে ধীরে পুড়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। একটা ভূমিকম্পের বীজ যেন ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে মহাপরিণামের দিকে।
দিনেশ ডাকলো, ‘আমার কাছে সরে আয় বিলাসী। এবার আওয়াজ হবে।’
প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। আর্ত প্রস্তরপুঞ্জের শিহর আর ধোঁয়ার উত্পাত থামলো। দশটা মিনিট দিনেশ আর বিলাসী কাটালো মূহ্যমান অবস্থায়। দিনেশ উঠে দাঁড়াতেই তার হাতটায় টান পড়লো। বিলাসী ধরে আছে।
আস্তে আস্তে হাতটা সরিয়ে নিয়ে দিনেশ বিঁধের দিকে তাকালো — দুই চোখে তীব্র ঔত্সুক্যের জ্বালা। দিনেশের গলা থেকে আর একটা উন্মাদ আনন্দের বিস্ফোরণ ফেটে পড়লো। ‘ঐ দেখ্ বিলাসী।’
কাজরা পাথরের একটা চাপ খুলে গিয়ে অভ্রের কিরি ঝক্ ঝক্ করছে — প্রাক্ পুরাণিক কোন কুবেরের রত্নীভূত পাঁজর সাজানো রয়েছে স্তরে স্তরে।
‘— চললাম বিলাসী। আজ সন্ধেয় চানকের মুখে খদ্দের দাঁড়িয়ে থাকবে। তুই অন্তত দুটো বোঝা পার করে দিস্। আমি বন্দোবস্ত করতে চললাম।’
বিলাসী দাঁড়িয়ে রইলো নির্বোধের মতো। দিনেশ সত্যিই চলে যায় দেখে ডাকলো. ‘বাবু!’
‘— কি ? না আর দেরি করিস্নি।’
‘— ও চানক পার হব কি করে বাবু!’
‘— খুব পরিষ্কার রাস্তা। খাড়া উঠে যাবি।’
দিনেশের টর্চের আলো সুঁদের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
‘— ও চানকে গ্যাস আছে বাবু।’ কিন্তু বিলাসীর এই আর্তস্বরের আবেদন দিনেশের কানে পৌঁছল না।
টাকার তোড়াটা তোরঙ্গে রেখে দিনেশ ঘরের বাইরে একবার পায়চারি করে গেল। তেঁতুলিয়া মাঠে ঢোলকের বাজনা মেতে উঠেছে। লণ্ঠনগুলোতে ঝড়ের আঁচ লেগে দপ দপ করছে, যেন কতগুলি আগুনের কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছ।
বিলাসী গ্যাস লেগে জখম হয়েছে খুব। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাকে হাসপাতালে পাঠান হয়েছে। হয়তো এই শেষ, আর চোখ মেলে তাকাবে না বিলাসী। এ খবর শুনেছে দিনেশ, খুব সহজভাবেই গ্রহণ করেছে। এটা যেন অবধারিত সত্য ছিল।
দুঃখ পেয়ে গেল বিলাসী নিজের দোষে। ওর অন্ত্যজ অনুরাগের মধ্যে যেন একটা সহমরণের তৃষ্ণা লুকিয়ে ছিল। বিংশ শতাব্দীর রুচিমান দিনেশ চৌধুরী এত নীচে নামতে পারে না। নিশ্চিহ্ন হতে পারে না। বিলাসীর জন্যে দুঃখ হয়, অন্য সময় হলে বোধ হয় কান্নাও আসতো।
কিন্তু সব দুঃখ ছাপিয়ে নেশার মতো একটা সুখাবেশ স্নায়ুজালে জড়িয়ে ধরেছে আজ। বাহিরের মৃদুঝড়ে বাসক রাত্রি উদ্বেল হয়ে উঠেছে। সারার আসবার সময় হলো। মুক্তির মুহূর্ত আসছে এগিয়ে। প্রতি দণ্ড পল অনুপল শুনছে দিনেশ!
খুটখাট শব্দ। চোর এসেছে। ঘস্ ঘস্ ঘাঘরার শব্দ। চুণীর মালাটা বেজে উঠছে ঘুমন্ত পাখীর কলালাপের মতো। দিনেশের কায় মন প্রাণ সার্থক হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বিছানার ওপর নিস্পন্দ হয়ে বসে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে — নিস্পলক চোখে।
চোরের আবছায়া মূর্তিটা ঘরে ঢুকলো — মার্জারীর মতো পদশব্দহীন। তোরঙ্গের ডালাটা কঁকিয়ে উঠলো একবার। চকচক করে উঠলো টাকার তোড়াটা। দিনেশ চোখ দুটো একবার রগড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
বাইরে অনেকগুলি সাপের শিষের সংকেত তীব্র শব্দের শিহর তুলে বেজে উঠলো একসঙ্গে। চোরের আবছায়া মিলিয়ে গেল ধোঁয়া হয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ