And li po also died drunk
He tried to embrance a moon
in the yellow river
Ezra pound ; Epitaph
কোথায় কবে যেন রিমন পড়েছিল কবরেরও আছে শ্রেণিচরিত্র। কথাটি মিথ্যে নয় একেবারে। শ্রেণি ও অবস্থানভেদে কবরেরও ধরণ নির্ধারিত হতে তো দেখা যায় সমাজে। কারো কপালে থাকে ‘নিজস্ব পারিবারিক গোরস্থান আবার কারো বা অখ্যাত-অবজ্ঞাত পথপ্রান্তে মেলে অনন্তকালীন আশ্রয়। তবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে মুহূর্তে-‘জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করেনা’।
কিন্তু জীবিতজন কেইবা তা মানে! শোক প্রকাশের বিচিত্ররকম চর্চা রিমন দেখে আসছে চারপাশে তবে সবচেয়ে তাকে স্পর্শ করে এপিটাফগুচ্ছ। এপিটাফ তো কতো ভাবেই এসেছে পশ্চিমের প্রিয় কবিদের বিষয় হয়ে আর বাঙালি কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ কবিতা করেছেন এপিটাফকে ; এই যেমন আহসানুল হাকিম টুটুল ভাই গত শীতে তাকে বললেন “জানো-আমার স্ত্রী নাসিমা সুলতানা কবিতা লিখতো। এত সুন্দর সব কবিতা লিখেছে বছর চল্লিশের আয়ুতে তবে সবচেয়ে ভালো লাগে ‘একজন নাবিকের স্মৃতিফলক’ কবিতাটি--
ইনি জল ভালবাসতেন
ভালবাসতেন বেলাভূমি আর বালিহাঁস
বাতাস কেটে কেটে লাল রোদে পাড় ভেঙে যাওয়া পাখিদের শিস্
শীৎকার
তাকে শিশুর মতো ছুঁড়ে দিতো আকাশে
ইনি জল ভালবাসতেন
তাই এর সমস্ত হৃদয় জুড়ে ছিল ভীষণ দাবদাহ।”
কবিতাটি পড়তে পড়তে আবিষ্ট হয়ে রিমন ভাবে হ্যাঁ, জীবনজুড়ে তো মানুষ স্মৃতিফলকই বয়ে বেড়ায়। না হয় নাসিমা সুলতানার শোক বহন করে একলা একা টুটুল ভাই এই শীতে নিজেই কেমন এপিটাফের বিষয় হয়ে যান... বুকে থাকা ভীষণ দাবদাহ ... জল ... সবই কেমন গুলিয়ে গিয়ে এই শীতের মিহি-ঘন কুয়াশা হয়ে ঝরে পড়ে রিমনের মনের মহলে।
বছর দুই আগে বন্ধুরা মিলে চট্টগ্রাম যুদ্ধসমাধি দেখতে গিয়েছিল রিমনরা। শম্পাই বলল ‘দ্যাখ-দ্যাখ রিমন’ একটা এপিটাফ...’ অকালগত এক সৈনিকের স্ত্রী লিখেছে ‘শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকো, পুনর্বার দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত’। ঘুম। সোনালি-রূপালি-হীরাভ ঘুম। রিমনের হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগে যেন এমন একটা এপিটাফ পাওয়ার লোভে। আধো ঘুম-আধো জাগরণে রিমন ভাবে নির্বাসিত মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কথা; স্বদেশের বুকে দু’গজ মাটি না পাওয়ার হাহাকার রেঙ্গুনে যার কবরে খোদাই করা কিংবা সম্রাজ্ঞী নূরজাহান যেমন বলে গেছেন―
গরীব গোরে দীপ জ্বেলো না
ফুল দিয়ো না কেউ ভুলে
শামা পোকায় না পোড়ে পাখ
দাগ না পায় বুলবুলে।
হ্যাঁ, কবে যেন হিজিবিজি এক কবিতায় রিমন লিখেছিল-- কোথায়ও দাসীর সঙ্গে রাজমাংসও পচে। পচে-গলে মাটি ফের সমতা প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীতে। রুশোর কথাই ঠিক হয়তো-- প্রকৃতি কোনো অসমতা সহ্য করে না। কিন্তু রাজরাজাড়ার চেয়েও রিমনকে আকৃষ্ট করে প্রিয় লেখক-শিল্পীদের এপিটাফ। এই যেমন সাদত হোসেন মান্টো বলেন ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমুদয় লেখনশৈলীও সমাহিত এখানে। আর সেই দুর্মুখ কথাকার খুশবন্ত সিং যেমন অবলীলায় আগাম লিখে গেছেন তাঁর এপিটাপ--
Here lies one who spared neither man nor God. Waste not your tears for him. He was a sod, writhing nasty things he regareded as great fun, thnak the lord he is dead, this son of a gun.
ভাবা যায়! এমন সত্যভাষণ মজ্জাগত মধ্যবিত্তের পক্ষে লেখা সম্ভব না ; বেঁচে থাকতেও না, মরে যাবার পরও না। রিমনের বন্ধু মিনার ঠিক বলেছিল, এক একটি এপিটাফ এক একটি গল্প। মৃতের কবরগাত্রের এপিটাফে আসলে জীবনের গল্পই খোদাই করা থাকে। কতদূর মহাযুদ্ধের নিহত সৈন্যের সমাধিতে লেখা আকৃষ্ট করে আমাদের-- ‘তোমাদের আগামীর জন্য আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছি’ কিংবা ‘সে মৃত্যুকে বেছে নিল যেন আমরা বাঁচতে পারি।’ কিন্তু তার চেয়েও গভীর করে অনুভবে আসে আর্মেনিয়ান চার্চের দুটো এপিটাফ। পারস্যের কারমেনে জন্ম নিয়ে ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের চাঁদপুরে প্রয়াত ম্যাক. এস. ম্যাকারটিকের কবরে তার প্রিয়তমা লিখেছে-- ‘তাঁকে ভীষণ ভালোবাসতাম বলেই তার না থাকা আমার কাছে গভীর দুঃখের। তবু সে আছে স্মৃতিতে আমার। নীরব রোদনে তাকে অনুক্ষণ ভালোবাসি, মনে রাখি, পেতে চাই একান্ত আপন করে।’ আর ম্যাকারটিকের কাল্পনিক উত্তরও তার প্রিয়তমা খোদাই করে গেছেন এইভাবে ‘আমার জন্য কেঁদো না, প্রিয়তমা। মৃত নই, আমি এখানে ঘুমিয়ে আছি মাত্র। আমি তো তোমার ছিলাম, ছিলাম ঈশ্বরেরও। তিনিই হয়তো আমাকে ভালোবাসতেন বেশি। তাই তোমার কাছ থেকে ডেকে নিয়ে গেছেন তার নিজস্ব ঘরে।’
রিমনের এপিটাফ-উৎসাহী বন্ধু মিনারই মুনতাসীর মামুনের বইপত্র ঘেঁটে বের করলো যে ১৭৯১-এ স্থাপিত পুরান ঢাকার আর্মানিটোলার এ চার্চের প্রাঙ্গণে অষ্টাদশ শতকের বহু পুরনো কবর আছে। কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে আনা পাথরে মৃতের এপিটাফগুলো জীবন পেয়েছে।
আর্মানি গির্জার গেট সবসময় প্রায় বন্ধই থাকে। এই দেশ থেকে আর্মেনিয়রা এখন বিলুপ্তপ্রায়। এই সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তিটি এখন শুধু জীবিত আছে। তার স্ত্রী-পরিজনের কবর এখানে আর সন্তানেরা থাকে সুদূর কানাডায়। আর্মেনিয়ান সিমেট্রির পাহারাদার শংকরের সহায়তায় একদিন এখানে ঢুকে শেষ আর্মেনীয় বৃদ্ধ মিনাস মার্টিরোসেন সিরকো-কে জিগ্যেস করলো ‘কেন আপনি এখানে আছেন একলা একা?’ সিরকোর উত্তর ‘মহিমান্বিত ঈশ্বরের অভিশপ্ত সন্তান হিসেবে এই কবরের স্মৃতিবাহক হয়ে ধুঁকে ধুঁকে যেন বেঁচে আছি আমি।’
স্মৃতিবাহকের কথাতেই রিমনের অতঃপর মনে আসে মেরি আপার কথা। না, অঞ্জন দত্তের মেরি অ্যান না, রিমনের মফস্বল-কৈশোরে ফেলে আসা মেরি আপা। বিমল মিত্রের প্রতি ছিল যার অন্ধ মুগ্ধতা, বলতেন- তোর আছে ওয়েস্টার্ন থ্রিলার-- আমার আছে কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম। স্কুল টিচার মেরি আপা একাই থাকতেন রিমনদের বাড়ির পাশে, ভাড়া বাসায়। তার কোনো পূর্বাপর জানতো না কেউ, একদিন হঠাৎই এসে জয়েন করলেন স্কুলে আর সব দেবশিশুদের প্রিয় শিক্ষিকা হয়ে উঠলেন তিনি। তার কোনো দুঃখের কথা জানতো না কেউ কিন্তু তার বাসাটা রিমনদের বাড়ির লাগোয়া হওয়ায় গভীর রাতে শোনা যেতো নূরজাহানের দুঃখশ্বাসময় সব গানের কলি। রিমন নূরজাহানের সঙ্গে মেরি আপাকেও শুনতো যেন। গহন রাতের কালো তারা হয়ে মেরি আপা যেন শূন্যের জলসায় বিস্তার করতেন তার ভালোবাসা-হারাবার বিষাদঘন আলাপ। মেরি আপার নৈঃশব্দ্যের শ্রোতা আর নিভৃতির দর্শক হিসেবেই রিমনকে মানাতো বেশি। একদিন মেরি আপাই নিয়ে গেলেন শহরের পুরনো খ্রিস্টান গোরস্থানে। বললেন এখানেই তিনি রোজ আসেন, এই গোরস্থানকেই মনে করেন তার সংসার। প্রতিদিন এখানে এসে জীর্ণ-ক্ষয়ে যাওয়া এপিটাফগুলো ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন। এপিটাফের মর্ম তখনো ভালো করে বুঝে ওঠেনি রিমন। তাই তার প্রশ্ন ছিল ‘কী হয় এইসব এপিটাফে?’ উত্তরে নিজের দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে মেরি আপা বললেন ‘কবরে এপিটাফ থাকলে মনে হয় এই সমাধিবাসীর কেউ একজন অন্তত আছে এই পৃথিবীতে। একদম একা নয় সে। নির্জন-নিরালা কবরে তাই আমি স্বেচ্ছায়-সানন্দে এপিটাফের দেখভাল করি।’
২
এরপর বাবার বদলির চাকরিসূত্রে সেই মফস্বল শহর ছেড়ে রিমনরা চলে এলো ঢাকায়। মেরি আপার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না অনেকদিন। একদিন হঠাৎ পুরনো শহরের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলো মেরি আপা আর নেই তবে তিনি রিমনের জন্য একটা চিরকুট রেখে গেছেন ‘আমার কবরে তুই কোনদিন আসিস না রিমন। এপিটাফও লিখিস না কারণ আমি ভাবতে চাই বেঁচে থাকতে যেমন আমার কেউ ছিল না, মৃত্যুর পরও কেউ নেই আমার। ভালো থাকিস, তোকে অনেক ভালোবাসতাম ; তোর বেঁচে থাকা আর ভালো থাকাই পৃথিবীতে একমাত্র এপিটাফ আমার।’
না, মেরি আপার জন্য আর মন খারাপ হয়না রিমনের। শুধু তাকে বলতে ইচ্ছে করে-- কেবল মৃত্যুস্মারকেই নয়, মাঝে মাঝে কারো জীবনেও ছড়িয়ে থাকে গাঢ় এপিটাফের ঘ্রাণ...
He tried to embrance a moon
in the yellow river
Ezra pound ; Epitaph
কোথায় কবে যেন রিমন পড়েছিল কবরেরও আছে শ্রেণিচরিত্র। কথাটি মিথ্যে নয় একেবারে। শ্রেণি ও অবস্থানভেদে কবরেরও ধরণ নির্ধারিত হতে তো দেখা যায় সমাজে। কারো কপালে থাকে ‘নিজস্ব পারিবারিক গোরস্থান আবার কারো বা অখ্যাত-অবজ্ঞাত পথপ্রান্তে মেলে অনন্তকালীন আশ্রয়। তবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে মুহূর্তে-‘জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করেনা’।
কিন্তু জীবিতজন কেইবা তা মানে! শোক প্রকাশের বিচিত্ররকম চর্চা রিমন দেখে আসছে চারপাশে তবে সবচেয়ে তাকে স্পর্শ করে এপিটাফগুচ্ছ। এপিটাফ তো কতো ভাবেই এসেছে পশ্চিমের প্রিয় কবিদের বিষয় হয়ে আর বাঙালি কবিদের মধ্যেও কেউ কেউ কবিতা করেছেন এপিটাফকে ; এই যেমন আহসানুল হাকিম টুটুল ভাই গত শীতে তাকে বললেন “জানো-আমার স্ত্রী নাসিমা সুলতানা কবিতা লিখতো। এত সুন্দর সব কবিতা লিখেছে বছর চল্লিশের আয়ুতে তবে সবচেয়ে ভালো লাগে ‘একজন নাবিকের স্মৃতিফলক’ কবিতাটি--
ইনি জল ভালবাসতেন
ভালবাসতেন বেলাভূমি আর বালিহাঁস
বাতাস কেটে কেটে লাল রোদে পাড় ভেঙে যাওয়া পাখিদের শিস্
শীৎকার
তাকে শিশুর মতো ছুঁড়ে দিতো আকাশে
ইনি জল ভালবাসতেন
তাই এর সমস্ত হৃদয় জুড়ে ছিল ভীষণ দাবদাহ।”
কবিতাটি পড়তে পড়তে আবিষ্ট হয়ে রিমন ভাবে হ্যাঁ, জীবনজুড়ে তো মানুষ স্মৃতিফলকই বয়ে বেড়ায়। না হয় নাসিমা সুলতানার শোক বহন করে একলা একা টুটুল ভাই এই শীতে নিজেই কেমন এপিটাফের বিষয় হয়ে যান... বুকে থাকা ভীষণ দাবদাহ ... জল ... সবই কেমন গুলিয়ে গিয়ে এই শীতের মিহি-ঘন কুয়াশা হয়ে ঝরে পড়ে রিমনের মনের মহলে।
বছর দুই আগে বন্ধুরা মিলে চট্টগ্রাম যুদ্ধসমাধি দেখতে গিয়েছিল রিমনরা। শম্পাই বলল ‘দ্যাখ-দ্যাখ রিমন’ একটা এপিটাফ...’ অকালগত এক সৈনিকের স্ত্রী লিখেছে ‘শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকো, পুনর্বার দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত’। ঘুম। সোনালি-রূপালি-হীরাভ ঘুম। রিমনের হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছে জাগে যেন এমন একটা এপিটাফ পাওয়ার লোভে। আধো ঘুম-আধো জাগরণে রিমন ভাবে নির্বাসিত মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের কথা; স্বদেশের বুকে দু’গজ মাটি না পাওয়ার হাহাকার রেঙ্গুনে যার কবরে খোদাই করা কিংবা সম্রাজ্ঞী নূরজাহান যেমন বলে গেছেন―
গরীব গোরে দীপ জ্বেলো না
ফুল দিয়ো না কেউ ভুলে
শামা পোকায় না পোড়ে পাখ
দাগ না পায় বুলবুলে।
হ্যাঁ, কবে যেন হিজিবিজি এক কবিতায় রিমন লিখেছিল-- কোথায়ও দাসীর সঙ্গে রাজমাংসও পচে। পচে-গলে মাটি ফের সমতা প্রতিষ্ঠা করে পৃথিবীতে। রুশোর কথাই ঠিক হয়তো-- প্রকৃতি কোনো অসমতা সহ্য করে না। কিন্তু রাজরাজাড়ার চেয়েও রিমনকে আকৃষ্ট করে প্রিয় লেখক-শিল্পীদের এপিটাফ। এই যেমন সাদত হোসেন মান্টো বলেন ‘আমার সঙ্গে সঙ্গে আমার সমুদয় লেখনশৈলীও সমাহিত এখানে। আর সেই দুর্মুখ কথাকার খুশবন্ত সিং যেমন অবলীলায় আগাম লিখে গেছেন তাঁর এপিটাপ--
Here lies one who spared neither man nor God. Waste not your tears for him. He was a sod, writhing nasty things he regareded as great fun, thnak the lord he is dead, this son of a gun.
ভাবা যায়! এমন সত্যভাষণ মজ্জাগত মধ্যবিত্তের পক্ষে লেখা সম্ভব না ; বেঁচে থাকতেও না, মরে যাবার পরও না। রিমনের বন্ধু মিনার ঠিক বলেছিল, এক একটি এপিটাফ এক একটি গল্প। মৃতের কবরগাত্রের এপিটাফে আসলে জীবনের গল্পই খোদাই করা থাকে। কতদূর মহাযুদ্ধের নিহত সৈন্যের সমাধিতে লেখা আকৃষ্ট করে আমাদের-- ‘তোমাদের আগামীর জন্য আমরা আমাদের বর্তমানকে উৎসর্গ করেছি’ কিংবা ‘সে মৃত্যুকে বেছে নিল যেন আমরা বাঁচতে পারি।’ কিন্তু তার চেয়েও গভীর করে অনুভবে আসে আর্মেনিয়ান চার্চের দুটো এপিটাফ। পারস্যের কারমেনে জন্ম নিয়ে ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের চাঁদপুরে প্রয়াত ম্যাক. এস. ম্যাকারটিকের কবরে তার প্রিয়তমা লিখেছে-- ‘তাঁকে ভীষণ ভালোবাসতাম বলেই তার না থাকা আমার কাছে গভীর দুঃখের। তবু সে আছে স্মৃতিতে আমার। নীরব রোদনে তাকে অনুক্ষণ ভালোবাসি, মনে রাখি, পেতে চাই একান্ত আপন করে।’ আর ম্যাকারটিকের কাল্পনিক উত্তরও তার প্রিয়তমা খোদাই করে গেছেন এইভাবে ‘আমার জন্য কেঁদো না, প্রিয়তমা। মৃত নই, আমি এখানে ঘুমিয়ে আছি মাত্র। আমি তো তোমার ছিলাম, ছিলাম ঈশ্বরেরও। তিনিই হয়তো আমাকে ভালোবাসতেন বেশি। তাই তোমার কাছ থেকে ডেকে নিয়ে গেছেন তার নিজস্ব ঘরে।’
রিমনের এপিটাফ-উৎসাহী বন্ধু মিনারই মুনতাসীর মামুনের বইপত্র ঘেঁটে বের করলো যে ১৭৯১-এ স্থাপিত পুরান ঢাকার আর্মানিটোলার এ চার্চের প্রাঙ্গণে অষ্টাদশ শতকের বহু পুরনো কবর আছে। কলকাতার ওয়েলেসলি স্ট্রিট থেকে আনা পাথরে মৃতের এপিটাফগুলো জীবন পেয়েছে।
আর্মানি গির্জার গেট সবসময় প্রায় বন্ধই থাকে। এই দেশ থেকে আর্মেনিয়রা এখন বিলুপ্তপ্রায়। এই সম্প্রদায়ের শেষ ব্যক্তিটি এখন শুধু জীবিত আছে। তার স্ত্রী-পরিজনের কবর এখানে আর সন্তানেরা থাকে সুদূর কানাডায়। আর্মেনিয়ান সিমেট্রির পাহারাদার শংকরের সহায়তায় একদিন এখানে ঢুকে শেষ আর্মেনীয় বৃদ্ধ মিনাস মার্টিরোসেন সিরকো-কে জিগ্যেস করলো ‘কেন আপনি এখানে আছেন একলা একা?’ সিরকোর উত্তর ‘মহিমান্বিত ঈশ্বরের অভিশপ্ত সন্তান হিসেবে এই কবরের স্মৃতিবাহক হয়ে ধুঁকে ধুঁকে যেন বেঁচে আছি আমি।’
স্মৃতিবাহকের কথাতেই রিমনের অতঃপর মনে আসে মেরি আপার কথা। না, অঞ্জন দত্তের মেরি অ্যান না, রিমনের মফস্বল-কৈশোরে ফেলে আসা মেরি আপা। বিমল মিত্রের প্রতি ছিল যার অন্ধ মুগ্ধতা, বলতেন- তোর আছে ওয়েস্টার্ন থ্রিলার-- আমার আছে কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম। স্কুল টিচার মেরি আপা একাই থাকতেন রিমনদের বাড়ির পাশে, ভাড়া বাসায়। তার কোনো পূর্বাপর জানতো না কেউ, একদিন হঠাৎই এসে জয়েন করলেন স্কুলে আর সব দেবশিশুদের প্রিয় শিক্ষিকা হয়ে উঠলেন তিনি। তার কোনো দুঃখের কথা জানতো না কেউ কিন্তু তার বাসাটা রিমনদের বাড়ির লাগোয়া হওয়ায় গভীর রাতে শোনা যেতো নূরজাহানের দুঃখশ্বাসময় সব গানের কলি। রিমন নূরজাহানের সঙ্গে মেরি আপাকেও শুনতো যেন। গহন রাতের কালো তারা হয়ে মেরি আপা যেন শূন্যের জলসায় বিস্তার করতেন তার ভালোবাসা-হারাবার বিষাদঘন আলাপ। মেরি আপার নৈঃশব্দ্যের শ্রোতা আর নিভৃতির দর্শক হিসেবেই রিমনকে মানাতো বেশি। একদিন মেরি আপাই নিয়ে গেলেন শহরের পুরনো খ্রিস্টান গোরস্থানে। বললেন এখানেই তিনি রোজ আসেন, এই গোরস্থানকেই মনে করেন তার সংসার। প্রতিদিন এখানে এসে জীর্ণ-ক্ষয়ে যাওয়া এপিটাফগুলো ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন। এপিটাফের মর্ম তখনো ভালো করে বুঝে ওঠেনি রিমন। তাই তার প্রশ্ন ছিল ‘কী হয় এইসব এপিটাফে?’ উত্তরে নিজের দিকেই নির্নিমেষ তাকিয়ে থেকে মেরি আপা বললেন ‘কবরে এপিটাফ থাকলে মনে হয় এই সমাধিবাসীর কেউ একজন অন্তত আছে এই পৃথিবীতে। একদম একা নয় সে। নির্জন-নিরালা কবরে তাই আমি স্বেচ্ছায়-সানন্দে এপিটাফের দেখভাল করি।’
২
এরপর বাবার বদলির চাকরিসূত্রে সেই মফস্বল শহর ছেড়ে রিমনরা চলে এলো ঢাকায়। মেরি আপার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না অনেকদিন। একদিন হঠাৎ পুরনো শহরের বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলো মেরি আপা আর নেই তবে তিনি রিমনের জন্য একটা চিরকুট রেখে গেছেন ‘আমার কবরে তুই কোনদিন আসিস না রিমন। এপিটাফও লিখিস না কারণ আমি ভাবতে চাই বেঁচে থাকতে যেমন আমার কেউ ছিল না, মৃত্যুর পরও কেউ নেই আমার। ভালো থাকিস, তোকে অনেক ভালোবাসতাম ; তোর বেঁচে থাকা আর ভালো থাকাই পৃথিবীতে একমাত্র এপিটাফ আমার।’
না, মেরি আপার জন্য আর মন খারাপ হয়না রিমনের। শুধু তাকে বলতে ইচ্ছে করে-- কেবল মৃত্যুস্মারকেই নয়, মাঝে মাঝে কারো জীবনেও ছড়িয়ে থাকে গাঢ় এপিটাফের ঘ্রাণ...
0 মন্তব্যসমূহ