শামিম আহমেদ-এর গল্প : চাঁদসিতারা অথবা এক অলৌকিক ঘোড়ার গল্প



শৈশবে বেণুর পেশা ছিল রাখালি করা। সে মনিবের বাড়িতে গরুর দেখভাল করত। তিন মণ ধান আর চল্লিশ টাকার বাৎসরিক মাইনেতে তার কেটেছে বহু কাল।রাখাল তো আসলে রক্ষাকর্তা, গরুর রক্ষক। কিন্তু বেণুর কোনও রক্ষাকর্তা ছিল না। বাপ মারা যায় সেই কোন ছেলেবেলায়, তা আর তার মনে পড়ে না। সেই হিসাবে সে ছিল নিরাখাল। মা বলত, দুঃখ করিস না বাপ; নিরাখালের খোদা রাখাল।


বড় রাগ হত তার, ঠিক আজ যেমন হচ্ছে। দিন কয়েক আগে সে বিয়ে করেছে। তা মাস তিনেক তো হবেই। বাপ তো বহু কাল আগেই মারা গিয়েছে। মাও গত বছর দুলালী বিবির উরসের পরের দিন কবরে ঢুকল। বাড়িতে একা-একা তার আর ভাল লাগছিল না। রান্নাবান্না করার লোক নেই। সে তো সারা দিন গরু নিয়ে মাঠে থাকে। তবে মনিবের গরু নয়, এখন সে নিজেই গরুর মালিক। চার-চারটে গাই-গরু আছে তার। তাদের মধ্যে দুটোর দুধ পালা করে সম্বৎসর পাওয়া যায়। গরু চরিয়ে বাড়ি ফিরে ভাত রান্না করার ইচ্ছে কিংবা শরীর কোনওটাই আর থাকে না। তা ছাড়া দেহের খিদে তো শুধু এক প্রকারের নয়, তার বয়সী কোনও ছেলেই এই গ্রাম-দেশে আর আইবুড়ো নেই। অবশেষে তবাই ঘটকের দয়ায় তার একটা কিনারা হল। পাশের গ্রাম মহেশপুরে ক দিন আগেই তার বিয়ে হয়ে গেল। বরযাত্রী গিয়েছিল জনা পাঁচেক। মৌলবি ছিল, ছিল কাজি; আর ছিল গোটা তিনেক সাক্ষী।তার পর মৌলবি বিয়ে পড়িয়ে দিলে কাজি টিপছাপ নিলে মেয়েরা তাকে নিয়ে গেল আলমতালায়। আল্লা রে আল্লা, সে এক কাণ্ড হয়েছিল বটে। ‘ক্ষীর খাও বানেরা’ বলে মেয়েদের সেই উদ্দাম গীত আর ছ্যাবলামো দেখে তার সারা শরীর শুকিয়ে গিয়েছিল। বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। ফিরেই সে সোজা ঢুকে পড়েছিল গোয়াল ঘরে। পাশের বাড়ির ময়না সেখের বউকে বলেছিল দুপুরে গরুদের জাবনা দিতে, কিন্তু তার গরু অন্য লোকের হাতে জাবনা খাবে কেন! বুঝেছিল কিনা কে জানে! গরুগুলোকে দেখে বেণুর মনে হল, ওরা বোধ হয় টের পেয়ে গিয়েছে, তাদের ভালবাসায় থাবা বসাতে আর একজন এসেছে।

গোয়ালে ঢুকে বেণু গরুদের গলকম্বলে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে তাদের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই অন্ধকারেও বেণু তা ঠাহর করতে পারে।

বেণু গোয়াল থেকে বেরোতে চায় না। এ দিকে তার নতুন বউ বেণুর অপেক্ষায় বসে থাকে। বউয়ের সঙ্গে বউয়ের পাড়াতুতো নানি না দাদি কে একটা এসেছে, সেই বুড়ি এসে গোয়াল ঘরে বেণুকে বলে যায়, “ভাই, শাদি করিচিস কি গোয়াল ঘরে কাটাবার লেগে? বিবি তো তুর লেগেই বসে আছে! যা, চাঁদমুখ দ্যাখ গিয়া!’’

আবার মুখ দেখবু কি বুড়ি! এ বার তো......

বেণুর রসিকতা শুনে সেই নানি অথবা দাদির বেশ ভাল লাগে। কিন্তু বেণুর গোয়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসার কোনও লক্ষণ না দেখতে পেয়ে সে বলে বসে, “তাহলে ওই চারপেয়েদের সাথেই বাসর রাত কাটা রে বেণু। খোদা যার কপালে যেমুন লিখেচেন! হায় রে আল্লা, এই এই রাখাল-বাখালের সাতে শাদি মানুষে দেয়! ওদের মানুষের উপর নয়, গরুর উপরেই পিরিত!’’

বেণু এ সব কথা শুনে রাগ করে না। বলে, “তা আমার বিবিকে এই গোয়ালেই পাঠিয়েই দাও নানি। আমার তো একখান ঘর, আমি সেই ঘরে ঘুমালে তুমি শুবা কুথা?”

নানি এ বারে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “আরে নামুনি, আমি কুথা শুবো, তাতে তুর কি রে হারামি! তু যখুন বি করেচিস, মাগিটো কি একা-একা থাকবে, না গোয়ালে এসে গরুর লাথ খাবে!’’

বেণু একটু ভয় পায়। না, নানিকে নয়, নানির কথাকেও নয়। চিৎকারকে। পাশের বাড়ির লোকে শুনতে পেলে তার মান-ইজ্জত সব ধুলোয় মিশে যাবে। অগত্যা সে নানির কথা শুনে বউয়ের কাছে যায়। আরে, এ মেয়ে তো আলমতলার সেই মেয়ে নয়। তবে কি তার বউ পালটে গেল! আলমতলার মেয়েটা কেমন যেন বিচ্ছিরি মতো দেখতে ছিল! হ্যারিকেনের আলোটা একটু উশকে দিয়ে বেণু ভাল করে দেখে। যাঃ বাবা! এ শালা জিন-ফিনের পাল্লায় পড়েনি তো সে! বিকেলে দেখল আলমতারা! এখন অমনি হয়ে গেল চাঁদসিতারা।

“তুর নাম কী রে বিবিজান?’’

ক্যানে, আলমতারা! তবে আপনি যদি চাঁদসিতারা বুলেন, আপনাকে আমি গোভূতের যাদু দেখাবো, ঘেঁটুপুজোর দিন! বুলেন, দ্যাখবেন?

“শুন বউ, তুই মানষ, না জিন? যদি শয়তান জিন হস তো পালা! আর মানুষ হলে বিছান পাত, শুই।’’ বেণু জোরে জোরে জিন তাড়ানোর মন্ত্র পড়তে লাগলঃ

“মাং বাদশাহ সব বাদশা হোকে সফেদ ঘোড়া

সফেদ পাখরজিসপর চড়া

জিন্নোকে বাদশাহ বর হকোস আগাড়ি

বারহ কোস পিছাড়ী

জোকুছ কাম কহুঁব জালাবে

মেরি ভক্তি গুরু কি শক্তি

ম্যায় অর চাচা খুদায়ো নে বাচা।’’

আলম তারা ওরফে চাঁদ সিতারা বিবি সেই মন্ত্র শুনতে শুনতে খেজুর- পাতার তালাই বিছিয়ে তার উপর পিঁপড়ে- কাঁথা পেতে ফেলল। বালিশে চাঁদ-তারা আঁকা গিলাফ পরাতে গেলেই বেণু তার হাত চেপে ধরে। “ছ্যাঁচা কতা বুল বিবি, তুই জিনের বিটি লস?’’

চাঁদসিতারা বলে, ক্যানে বারে বারে এ কতা বুলচ, বল দিকিনি?

“আলমতালায় দ্যাকলাম এক মেয়ে, আর শালা ঘরে নিয়ে অ্যালাম আর এক আওরত! এ কেমুন ভেলকি রে বাপ!’’

তা আলমতালার মেয়েটো ভাল ছিল, নাকি আমি বেশ-ই সোন্দর? শুনো, আমি জিন হলে তুমার জিন তাড়ানোর ফুস-মন্তরে পালাতাম গো! তবে আমি জাদু জানি। এসো, শুবা চলো। জাদু দ্যাখাবো তুমাকে!

বেণু চুপচাপ শুয়ে পড়ে। কিন্তু তার ঘুম আসে না। ও দিকে নয়ন, না সিতারা, নাকি চাঁদ সব্বাই ঘুমিয়ে কাদা। এমনকি ওই বুড়িও উসারার এক কোণে ঘুমিয়ে জড়সড়ো। তবে যে তারা জাদু দেখাবে বলেছিল! গোয়াল-ঘরে গরুদের হুটোপাটির আওয়াজে কিনা কে জানে, বেণু উঠে পড়ে, তার পর দরজা খুলতে এগিয়ে যায়। এমন সময় ঘটে গেল সেই অলৌকিক কাণ্ড। কিসের বশে কে জানে, নয়নতারা টের পেয়ে গিয়েছিল, বেণু তার সতীনদের দড়ি ঠিক আছে কিনা দেখতে যাচ্ছে। ঠিক তখনই সেই মেয়ে তাকে বেঁধে ফেলে জিনেদের বানানো আগুনের দড়ি দিয়ে। হ্যারিকেনের উপরে সে সন্ধ্যে থেকেই একটা আগুনের সাপ দেখতে পাচ্ছিল। এখন বুঝল, ওটা সাপ ছিল না, ছিল রশি। আর সেই দড়ি সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর! নয়নতারা তাকে জাদু করে পাতালে নিয়ে চলে গেল! আর ওই বুড়ি, নানি নাকি দাদি, খালাও হতে পারে; সে শুয়ে থাকে উসারার এক কোণে। নয়নতারা, না, চাঁদসিতারা বেণুকে পাতালের ভিতরে এক কুঠুরিতে বন্দী করে ফেলে। বেণু এত দিন জানত, জিনেরা আকাশ পথে ভ্রমণ করে, কেননা তারা আগুন দিয়ে বানানো। আর পানি দিয়ে তৈরি গোভূতেরা পাতালে থাকে। কিন্তু আজ ওই জিনের লেড়কি তাকে জানিয়ে দিল, পানিতেও আগুন থাকে। বেণু সারা জীবন গরু চরালো, তার আর কত জ্ঞানগম্যি!

“ও বউ, বাড়ি, যাবি না?’’

তুমি কি খ্যাপা হলা বেণু-বাঁশি! এই তো আমাদের বাড়ি। দূরে ডান দিকে ওই যে নয় জন ফেরেশতা দেখতে পাও, ওদের সালাম দিয়ে এসো, যাও! আর চাঁদের বুড়ির আঠাশ জন নাতনি চরকাতে সাদা সুতো আর কালো সুতো কাটে, নানির কষ্ট দূর করবে বলে, ওদেরও সালাম জানাও। তারপর একটা আলিশান ঘোড়া আসবে, সেটার পিঠে চড়ে আমরা তারাপীঠ যাব, বেশি দূরে না, কাছেই।

বেণু কাঁচুমাচু করে বলে, “আমি যে ঘোড়ায় চাপতে পারি না। ফেলে দিলে মরে যাব রে বিবিজান, তুই বেওয়া হবি!’’

চুপ রও, খামোশ, বেতমিজ! জিনের লেড়কির কথা অমান্য করো তুমি!

বেণু এবার বুঝে যায়, নয়নতারা ওরফে চাঁদসিতারা এমন ভাষায় কথা বলতে পারে না! একে সবক শেখাতে হবে। তাই সে সিতারার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর অমনি নয়নতারা বলে ওঠে, তুমার গায়ে মোষের মুতুন জোর। আমার লাগে না বুঝি!

বেণু বুঝতে পারে, এই তা হলে সেই পাতাল ঘর! যেখানে একটু আগে নয়নতারা পিঁপড়ে-কাঁথার বিছানা পেতেছিল! বেণুর খুব লজ্জা-লজ্জা করে।



সকাল হলে বেণু উঠে পড়ে। আজ খুব মেঘলা। এমন দিনে আকাশের মুখ ভার থাকলেও তার ইচ্ছে করে গরুর পাল নিয়ে মাঠে যেতে। সেই কবে রাখাল-তিথিতে একবার মেঘ করেছিল। সেটা ছিল কার্তিক মাস। আকাশে বেশ বড় চাঁদ উঠেছিল, মেঘ কেটে গেলে। সরকার বাড়ির কর্তা বলেছিলেন, আজ কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বাদশী, এই দিনে গোপাল রাখাল হয়েছিলেন। সরকারদের বাড়িতে সেই রাখালের ছোটবেলার একটা ছবি দূর থেকে দেখেছিল বেণু। রাখাল-রাজা হামা টানছেন। কি সুন্দর সেই সুরত! তারা রাখাল-পূজার দিন গোপালের নামে শপথ করে রাখাল-ফোঁটা নিত। গরু হাঁকানোর লাঠি, যাকে তারা পাঁচন বলে থাকে, তার এক প্রান্ত দিয়ে ঘষে ঘষে কপালের মাঝখানের অংশটার গোল করে চামড়া তুলে দিতে হত। খুব ব্যথা থাকত কয়েক দিন, তার পর সেই জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে যেত। তারা কালো হয়ে ঝরে গেলে কপালের মাঝে ফুটে উঠত রাখাল-তিলক, সাদা তার রঙ। বেণুর সেই তিলক আজও আছে। তবে অনেকটা ফিকে।

এমন মেঘলা দিনে সেই সব কথা মনে পড়ে, গরু নিয়ে মাঠে যেতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু কী যেন একটা তাকে পেছন থেকে আটকে রাখে। সেই দড়ি ছিঁড়ে সে বেরিয়ে পড়তে পারে না। গরুগুলোকে জাবনা দিয়ে আবার ফিরে আসে ঘরের মধ্যে। মাথার মধ্যে পিঁপড়ে-কাঁথারা ঘুরে বেড়ায় আর শরীরের মধ্যে জড়িয়ে থাকে ঘুম। সারা রাত পাতাল-ভ্রমণের ধকল তো কম হয়নি! কাল রাতে শ্বশুর বাড়ি থেকে দেওয়া লুচি-তরকারি আর মিষ্টি খেয়েছিল তারা। আজ সকালে পান্তা নেই। আলমতারার নানি বলে, চাল বের কর নাতনি, আর আলু। এই বেলা ভাত আর কাঁচা মরিচ দিয়ে আলু-ভর্তা করি।

চাল ছিল ঘরে। বেণু আলু আর মরিচ কিনতে বাইরে যায়। মুদির দোকানে আলু পেলেও কাঁচা মরিচ মেলে না। সে শুকনো লাল-মরিচ নিয়ে আসে। তাই দিয়ে নানি আর আলমতারা আলুর ভর্তা বানায়। আহা! খাবারের যে এমন সোয়াদ, তা বেণু এত দিন জানত না। সে বলে, “ও বউ, দুফরে কি রাঁধবি? নানি আর কত দিন থাকবে!’’

বেণুর বউ বলে, তুমি যতদিন না আট-মোগলা গাইতে যাবা, তত দিন থাকবে নানি।

“কবে যাব রে বউ?”

কাল চলো।

বেণু বলে, “আমার গরুগুলাকে কে দেখবে তখন?”

ক্যানে, ময়না ভাবি! আমার সাতে কতা হয়ে গেচে গো।

বেণু বলে, “আট দিন গরুগুলাকে আমি চোখের দেকাও দেকতে পাব না!”

ক্যানে আমাকে দ্যাখবা! আমাকে তুমার পসন্দ লয়!

“চুপ বিবিজান! নানি শুনতে পাবে।’’

নানি কানে খাটো, তুমি জান না!

বেণু বলে, “তুই আমার কামধেনু।’’

সিটো আবার কী? গাল দিলা না তো!

“তুকে গাল দিতি পারি আমি, আমার বুকের কয় খান পাটা? কামধেনু খুব ভাল গরু, অনেক দুধ দেয়!’’

তুমি খুব অসব্য। আমি ক্যানে গরু হব, আমার কি চারটে ট্যাং? দুফরে খিঁচুড়ি খাবা?

বেণু কোনও কথার জবাব না দিয়ে তার বউকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে। তার পর বলে, “বের কর তোর পিঁপড়ে-কাঁথা!”

বউ বলে, ছিঃ! দিনের বেলা! তুমি গোয়ালে যাও, গরুদের জাবনা দাও। আমি খিঁচুড়ি বানাই।

চাঁদসিতারা চলে গেলে বেণুর ভীষণ পাতাল-ঘরে যেতে ইচ্ছে করে। এ সে কোন আগুনের মেয়ের পাল্লায় পড়ল! তার তো আর সংসারের দিকে মন নেই। গরুগুলোর কাছেও আর যেতে ইচ্ছে করে না। তাদের জন্য খড়-কাটা কিংবা ঘাস কেটে আনতেও ইচ্ছে করছে না। বেণু জানে, এ হল মহাপাপ। অবলা জীবদের এমন অবহেলা করতে নেই। তবু তার পা ওঠে না। সে খেজুর পাতার তালাই বিছিয়ে শুয়ে পড়ে, তার পর বেবাক ঘুম।

যখন সে ওঠে ঘুম থেকে তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকেল। ধোঁয়া-ওঠা খিঁচুড়ির থালা তার সামনে। কিন্তু তার গোসল হয়নি। বেণু তাড়াতাড়ি উঠে গামছা নিয়ে বাড়ির পাশের পুকুরে একটা ডুব মেরে আসে। তার পর খিঁচুড়ি খায়। অপেক্ষা করে, কখন সন্ধ্যা ঘনাবে। সে আবার জিনের মেয়ের সঙ্গে পাড়ি দেবে অন্য দুনিয়া।

রাত হয়। বেণু দুপুরের বেঁচে যাওয়া বাকি খিঁচুড়ি খেয়ে চাঁদসিতারার পাশে শুয়ে পড়ে। আবার তার ঘুম আসে না।

ও দিকে নয়নতারা ওরফে চাঁদসিতারা মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে কাদা। বুড়ি নানিও বোধহয় চাঁদের বুড়ির সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছে। আলমতারা কি আজ ঘরের মধ্যেই জাদু দেখাবে! আজ গোয়াল-ঘরে গরুদের হুটোপাটির কোনও আওয়াজ নেই। তবু বেণু উঠে পড়ে, তার পর এগিয়ে যায় গোয়াল-ঘরের দিকে। গরুগুলো চুপচাপ শুয়ে জাবর কাটছে। তাকে দেখেও না দেখার ভান করল সেই সব অবলা জীবেরা। ওরাও বুঝে গিয়েছে, নয়নতারা এসে সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে,বেণুর জীবনে এখন শুধুই নয়নতারা! বেণুও ভাবে, গরুগুলো তাকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে নিল। ওরা কি টের পেয়ে গিয়েছে, বেণুকে এখন জাদু-টোনা করেছে জিনের মেয়ে! বেণু গোয়াল ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, খানিকটা দুঃখেই। তার পর বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে এক আশ্চর্য মোজেজা, যাকে ফু-মন্তরের খেলা বলে।

হাতে একটা লম্ফ নিয়ে এক সুন্দরী নারী এসে বেণুকে জাপটে ধরে। তার পর সেই লম্ফের আগুনে তারা দু জনেই ঢাকা পড়ে যায়। গরুগুলো গোয়ালের বাইরে আগুন দেখতে পেয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। বেণুর মনে হয়, ওই আগুনের জন্যই সে অপেক্ষা করেছিল বহু দিন। তার পর সেই সব আগুনের গোলার সঙ্গে লড়াই করে ওই রমণীকেও সে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসে নিজের ঘরে। স্পষ্ট দেখতে পায় সে, একটা আগুনের সাপ হিসহিস করে আওয়াজ করছে। ভয়ঙ্কর মনোহর তার রূপ! সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করল বেণুর। নয় জন ফেরেশতা এসে বেণুকে বলে, আমরা হলাম মাস। দূরে ডান দিকে ওই যে চাঁদের বুড়ির আঠাশ জন নাতনি চরকাতে সাদা সুতো আর কালো সুতো কাটে, ওরা হল দিন। সাদা মানে সুখ আর কালো হল দুঃখ। তোমার দুঃখের দিন শেষ বেণু। ওই যে আলিশান ঘোড়া দেখতে পাও, ওটার পিঠে চড়ো; ওই হল মহাকাল। ওঠো, ওটার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াও।

বেণু কাঁচুমাচু করে বলে, “আমি যে ঘোড়ায় চাপতে পারি না। ফেলে দিলে মরে যাব বাপজানেরা, আমার বিবিজান বেওয়া হয়ে যাবে!’’

চুপ রও, খামোশ, বেতমিজ! আমাদের কথা অমান্য করো তুমি! তোমার বিবিকে নিয়ে এক্ষুনি ঘোড়ায় ওঠো।

“কোথায় আমার বিবি?”

ওই যে যাকে আগুনের সাপ ভেবে ধরে এনেছো, ওই তোমার বিবি।

বেণু দেখে, চাঁদসিতারা তাকে ভয়ে আর ভালবাসায় জাপটে ধরে আছে।

ফেরেশতাদের কথায় তারা দু জনে সেই ডানাওয়ালা ঘোড়ার পিঠে চেপে আসমান-জমিন আর পাতাল ঘুরে বেড়াতে থাকে। তাদের আর খিদে পায় না, তেষ্টাও না। ঘোড়ার পিঠেই পিঁপড়ে-কাঁথার বিছানা পাতে চাঁদসিতারা, বালিশে পরায় চাঁদ-তারা আঁকা গিলাফ।



সেই অলৌকিক বিছানায় শুয়ে আলমতারা আদর করলেই বেণুর খুব লজ্জা-লজ্জা করে।

লেখক পরিচিতি
শামিম আহমেদ

জন্ম ১৯৭৩। মুর্শিদাবাদের সালারে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের ছাত্র।
পেশা বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশন মহাবিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক।
গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ মিলিয়ে এযাবৎ প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ১০ টি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ