সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প : সিঁড়িতে

তুমি কেমন আছ?
--ভালো আছি।

উত্তরটা দেওয়ার সময় মনীষা মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়েছিল, ঠোঁটে লেগেছিল পাতলা কুয়াশার মতন হাসি। দশবছর পর দেখা হল মনীষার সঙ্গে। নেমতন্ন বাড়িতে। শুনেছি ওর স্বামী তার স্ত্রীর অন্য কারুর সঙ্গে মেলামেশা পছন্দ করেন না। মনীষার স্বামী নামকরা ডাক্তার, নিজে তিনি কতক্ষণ স্ত্রীর সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ পান জানি না।

আমি উঠছিলাম, সিঁড়ি দিয়ে নামছিল মনীষা, এক মুহুর্তের জন্য স্থির চোখাচোখি। আমার বুক কাঁপছিল। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও আমার বুক কাঁপে। তবে গত দশ বছর কাঁপেনি। একটু আগে সিঁড়ির নীচে আমি পঞ্চাশজনের সঙ্গে পঞ্চাশ রকমভাবে হেসে ও কণ্ঠস্বর বদলে কথা বলেছি। মাঝখানে মনীষার সঙ্গে চোখাচোখিতে আমার গলা শুকিয়ে এল। এই সব মুহূর্তে নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পায়।

--তুমি কেমন আছ?

--ভালো আছি।
মনীষার স্বামী সিঁড়ির দু-তিন ধাপ নেমে গেছেন, মনীষা আর দাঁড়াল না, নেমে গেল, আমি ওপরে উঠে এলাম। উঠছি তো উঠছি। সিঁড়ির কি আর শেষ নেই? এটা কি কুতুব মিনারের ঘোরানো সিঁড়ি?

একটু বাদে খেয়াল হল, আমি তো সিঁড়ির সেই ধাপেই দাঁড়িয়ে আছি। একবার মনে হল, সমস্ত সিঁড়িটা ফাঁকা, খাঁ-খাঁ করছে। আলো নাবনো, আমি সেখানে একা। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলুম, ভিড়ের নেমতন্ন বাড়িতে অনবরত নারীপুরুষ আমাকে ঠেলে ঠেলে উঠছে নামছে। আমি শুনতে পাচ্ছি, পুরুষদের রাজনীতি আলোচনা, মেয়েদের সিল্কের শাড়ির সপসপ শব্দ। মনীষা নেই।
দশ বছর বাদে মাত্র দুটি শব্দ, ভালো আছি, এর মানে কী? মনীষার ঠোঁটে ওই পাতলা কুয়াশার মতন হাসিটুকু লেগেছিল কেন? এর মানে জানতে না পারলে সারা জীবনে আর কী কখনও আমি কোনও সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারব?
দুদ্দাড় করে লোকজন ঠেলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। মনীষা কোথায়? নেই। দশ বছর পর মাত্র দুটি শব্দ, ভালো আছি—এর মধ্যে অনেক কথা লুকিয়ে আছে। আমাকে জানতে হবে। মনীষা তো জিজ্ঞেস করল না, আমি কেমন আছি?
একজন চেনা লোক, জিজ্ঞেস করলাম, অমুক ডাক্তার আর স্ত্রীকে দেখেছেন? এইমাত্র তো বেরিয়ে গেল, বাইরে সাদা গাড়ি...। সাদা গাড়ি, সাদা গাড়ি কোথায়? সদ্য স্টার্ট নিয়েছে, জানালার কাছে মনীষার মুখ। দাঁড়াও, একটু দাঁড়াও। গাড়ি দাঁড়াল না। আমি ছুটতে লাগলাম, পঁয়ত্রিশ বছরেও একবার চক্ষুলজ্জাহীন হয়ে ছুটতে দ্বিধা লাগে না।
সাদা গাড়ি মিশে গেল অনেক কালো গাড়ির মধ্যে। বৃষ্টি নামল। আমি কত রাস্তায় ঘুরেছি জানি না, নিঃশব্দে চিৎকার করলাম বহুবার--, মনীষা, তুমি জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেমন আছি?



হঠাৎ নিঃশব্দ গানের মতন বেজে উঠল গীর্জার ঘণ্টা। সেই শব্দ যেন সমস্ত শহরের সব কিছু ঢেকে দিল। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম গির্জার সেই মন খারাপ ধ্বনির মধ্যে মনীষার গলা। আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. কবিতা।

    -সাধন দাস

    উত্তরমুছুন
  2. ভীষণ গভীর অনুভবের গল্প। পড়ার পরেও ভাবায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নয়। সুনীল সাগর। তাঁর তল খোঁজার সাধ্য আমাদের নেই।

    উত্তরমুছুন