সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ : সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা এক শিল্পী

রফিকউল্লাহ খান

বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর পরিণতি অনেকটা মিখাইল বাখতিনের মতো। বিশ শতকের তিরিশের দশকে বাখতিন যখন তার তত্ত্ব প্রকাশ করেন, প্রায় তিন দশক পরে তার সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার বর্ণনামূলক সাহিত্য-ভাবনার ক্ষেত্রে এক বিপ্লবাত্মক রূপান্তরের তত্ত্ব-দর্শন হয়ে ওঠে। বাখতিন জন্মগ্রহণ করেছিলেন পূর্ব ইউরোপের এক সংগ্রামশীল সমাজ পটভূমিতে, যেখানে যৌবনের উদ্দাম মুহূর্তগুলোতে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন রুশ বিপ্লবের রক্তাক্ত ও আলোকোজ্জ্বল ঘটনাপ্রবাহ।
সঙ্গত কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার পর পুঁজিবাদী বিশ্ব থেকে রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক নৃ-তাত্তি্বক ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে বাখতিনের সাহিত্য ভাবনা ও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কেও পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘকাল বঞ্চিত থাকে। বিশ শতকের তিরিশ, চলি্লশ ও পঞ্চাশের দশকের অনেক সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও সাহিত্যতত্ত্বের ব্যাখ্যার সূত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিল্প বিবেচনার মানদণ্ড হিসেবে বাখতিনের তত্ত্ব কতটা নিবিড় ও গভীরভাবে ছায়ার মতো প্রভাব বিস্তার করেছে ওইসব তত্ত্বের ওপর। বাখতিনের জন্ম ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। মৃত্যু ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্যারিসে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক ঔপনিবেশিক সমাজ কাঠামোতে, যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রাম রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে এক ইতিবাচক দিক লাভ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যৌবনের উদ্দাম সময়গুলোতে তাকে দেখতে হয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মন্বন্তর, মহামারী এবং ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের মতো একটি আরোপিত মধ্যযুগীয় বর্বর রাজনৈতিক সত্য প্রতিষ্ঠা। এবং তিনি দেখে যেতে পারেননি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
মিখাইল বাখতিনের অভিনবত্ব তার তত্ত্ব-দর্শন, সাহিত্যের অবয়ববাদী ব্যাখ্যা এবং উত্তর-আধুনিকতার আদি প্রবক্তাদের অন্যতম হিসেবে। জীবনের শেষ দিনগুলোতে বাখতিন তার তত্ত্বের আবিশ্ব গ্রহণ ক্ষমতায় হয়তো কিছুটা অভিভূত হয়ে থাকবেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার জীবদ্দশায় কোনো দিক থেকে গভীরতর অর্থে ইতিবাচক মূল্যায়নের সৌভাগ্য লাভ করেননি। দুই-একজন সমালোচক তার উপন্যাস ও ছোটগল্পের বিষয় ও আঙ্গিকের অভিনবত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করলেও শতধারায় বিভক্ত বাঙালি পাঠকের পক্ষে তার মূল্যায়ন অনেকটা দুরূহ ছিল। বিশ শতকের চলি্লশ ও পঞ্চাশের দশকে বাংলাভাষী ভূখণ্ডের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে যে বহুমুখী সংকট দেখা দেয় মানব অস্তিত্ব সন্ধানী যে কোনো সংবেদনশীল লেখকের জন্যই তা অত্যন্ত বেদনা-করুণ হয়ে উঠতে বাধ্য। উনিশশ' সাতচলি্লশের ভারত বিভাগ এবং বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের পাকিস্তান নামক নয়া ঔপনিবেশিক ও সামন্তবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি বাঙালির সামগ্রিক সাহিত্যসাধনা ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বাঙালি জীবনের সেই চরম দুঃসময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটকগুলো রচনা করেন। সমকালীন সংকট চেতনাকে তিনি এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, তার মর্মার্থ অনুধাবনের জন্য বাঙালি পাঠককে কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। ওয়ালীউল্লাহর প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ 'নয়ন চারা' ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় এবং প্রথম উপন্যাস 'লাল সালু'র প্রকাশকাল ১৯৪৮ এবং প্রথম নাটক 'বহ্নিপীর'-এর রচনাকাল ১৯৫৫ ও প্রকাশকাল ১৯৬০। বিশ শতকের সাহিত্যের প্রধান তিনটি ধারায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর এই আত্মপ্রকাশ বাংলা সাহিত্যের বিষয় ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে নবধারার সৃষ্টি করে। আর্থ-উৎপাদন কাঠামো লালিত মানব অস্তিত্ব, তাদের সংগ্রাম এবং অভাবনীয় অথচ বাস্তবসম্মত রূপায়ণ তার এসব রচনাকে বিশিষ্ট করেছে। রোমান্টিসিজমের বহু বর্ণিল ও বাস্তাবাতিরেক শিল্পাদর্শকে তিনি যৌবনেই পরিত্যাগ করেছিলেন বাঙালির জীবনায়নের গভীর অভিজ্ঞতায়। জীবনকে তিনি পাঠ করেছেন বহুকৌণিক দৃষ্টি দিয়ে। অস্তিত্ব নিহিত সংগ্রাম, যন্ত্রণা ও রক্তক্ষরণের রেখা, রং ও টোনের সূত্র ধরে তিনি কেবল মানুষের কান্না দেখেননি কিংবা ব্যর্থতা রূপায়ণ করেননি, দেখেছেন জীবনের মর্মার্থ। বাইরের দিক থেকে জীবন একটি চলমান রেখামাত্র। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, সংগ্রাম, মৃত্যু এগুলো হচ্ছে সেই জীবনরেখার অনিবার্য একেকটি অংশ। কিন্তু একজন অস্তিত্ববাদী, মানবীয় সম্ভাবনায় আস্থাশীল শিল্পীর পক্ষে জীবনের এ কাঠামো মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। জীবন তার কাছে কেবল বস্তু প্রত্যক্ষণ ও তার অবভাস মাত্র নয়। প্রতিটি ঘটনা ও পরিস্থিতির কার্যকারণ ব্যাখ্যা তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পঞ্চাশের মন্বন্তর (১৯৪৩) নিয়ে বেশকিছু গল্প রচনা করেন। তার মধ্যে অন্যতম 'নয়ন চারা' গল্পগ্রন্থের নামগল্প। এই গল্পে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা বাস্তব ঘটনাক্রম তার কাছে তাৎপর্য পায়নি, বরং দুর্ভিক্ষের প্রতিক্রিয়া সমগ্র মানবজীবন ও অস্তিত্বকে কতটা আলোড়িত, শিহরিত, বিপন্ন ও উদ্বেগাকুল করে তুলতে পারে, তারই একটি আখ্যান তুলে ধরেছেন অসাধারণ বর্ণনাভঙ্গির মধ্যদিয়ে। একটি সাহিত্য রূপ তখনই চিরকালের শিল্প হয়ে ওঠে, যখন সত্যস্পর্শী জীবন সত্য অনিবার্য তত্ত্বলগ্ন হয়ে প্রকাশ পায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রথম পর্যায়ের রচনায় যদি ভাবমুখ্য মানবধর্মকে (ঝঁনলবপঃরাব ঐঁসধহরংস) গ্রহণ করতেন, তীব্র, কঠোর, রূঢ় বাস্তবতাকে পরিহার করতেন অথবা দুইয়ের মধ্য একটি সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করতেন তাহলে তার কোনো রচনাই সমকালের এবং পরবর্তীকালের প্রাজ্ঞস্বর পাঠকের কাছে এতটা গ্রহণযোগ্যতা পেত না। তার 'মৃত্যুযাত্রা' (নয়ন চারা) গল্পটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও ক্রমাগত মৃত্যু অভিজ্ঞতা চারপাশের মানুষকে কতটা অস্তিত্বহীন, দিশাহীন ও অবসন্ন করে দেয় তারই একটি নির্মম চিত্র এই গল্পে প্রত্যক্ষ করা যায়। একটি জীবনের জন্য একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ও গোষ্ঠীগতভাবে মানুষ যখন দূরের ও নিকটজনের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে ক্রমাগত, তখন এক ধরনের অবশ নির্লিপ্তি জীবিত মানুষগুলোকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাদের আচরণ ও উচ্চারণের মধ্যে ভয়ঙ্করভাবে অক্রিয় স্বভাব দেখা দেয়। মৃত্যু এবং ক্ষুধার পরস্পরবিন্যাস (ঔঁীঃধঢ়ড়ংবফ) কতটা মর্মভেদী হতে পারে তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে_
'_কী আবার হবি, মাথা হবি, মুণ্ডু হবি।' তিনু এবার গর্জে উঠল। এবং হয়তো তার সে জ্বলন্ত ক্রোধকে চাপা দেবার জন্যই করিম উঠে গিয়ে বুড়ির ছিন্ন ময়লা আঁচল দিয়ে তার বীভৎস মুখটা ঢাকা দিয়ে এলো। তারপর কে যেন রসিকতাও করল,
_ সবুর কর, বুড়োটা মরলে পরে দুটোকে এক সাথে গোর দেয়া যাবি_
গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে এখনো বুড়ো তেমনিভাবে চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে রয়েছে।
ক্রমে ক্রমে একটি অধৈর্যের চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়তে লাগল সবার মধ্যে। একটিমাত্র মৃতদেহের জন্য তাদের এই আগ্রহাতিশয্যময় যাত্রা ঠেকে থাকছে, অথচ একদিকে শূন্য পেট করাত কাটা হচ্ছে। মন তাদের ছুটছে গঞ্জে-গঞ্জে, না দেখা শহরের আনাচে কানাচে, কল্পিত খাদ্যে রসালো হয়ে উঠেছে জিহ্বা। বেঁচে থেকেও ঝুনো বুড়ি তাদের পদে পদে জ্বালিয়েছে। মরেও যেন মুক্তি দিচ্ছে না।'
সংলাপের গভীর অর্থবহতার কথা বাখতিনের তত্ত্ব সূত্রে আমরা জানি। উদ্ধৃত অংশে দুটি সংলাপ মৃত্যু-বাস্তবতার এমন পরিস্থিতিকে তুলে ধরেছে যা পরবর্তী বর্ণনাংশকেও কেমন যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং যে বৃদ্ধকে আমরা মৃত্যুমুখে দেখেছিলাম, তার মৃত্যু হতেও সময় লাগে না। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমাণ সেই ঘন অন্ধকার মৃত্যু শেষ পর্যন্ত নেমে আসে বৃদ্ধের জীবনে, যার চেয়ে মৃত্যুকে আরও গভীরভাবে দেখার কোনো পরিবেশ পরিস্থিতি, শব্দ ও ভাষার দৃষ্টান্ত আমাদের জানা নেই : যেমন_
'তারপর সন্ধ্যা হলো, হাওয়া থামল, ক্রমে ক্রমে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে উঠল এবং প্রান্তরের ধারে বৃহৎ বৃক্ষের তলে তার গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে বুড়োর মৃতদেহ বসে রইলো অনন্ত তমিস্রার দার্শনিকের মতো।'
যেসব গল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মানুষের বাস্তবজীবনের প্রচ্ছদ উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, সেখানে আবেগ, প্রেম, মোহ মানবসম্পর্কের সংবেদনশীল কোনো দিক গুরুত্ব পায়নি। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শিল্পের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করলে চিরকালের সাহিত্যই এই ধাঁচ বা চধৎধফরমস অবলম্বন করে। 'মতিন উদ্দিনের প্রেম' গল্পে নিম্নবিত্ত জীবনের অনেক অনুষঙ্গ আছে বটে। কিন্তু যে অর্থে সাহিত্যে প্রেম উপস্থাপন করা হয়, তার ক্ষীণতম অবভাসও সেখানে দেখা যায় না।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আমরা প্রধানত তার ৩টি উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করি। তার জীবন গ্রহণ, জীবন রূপায়ণ বিষয় ও আঙ্গিকের অসাধারণত্ব আমরা স্বীকার করে নেই। তার ছোটগল্পের মধ্যে বিশ শতকের চলি্লশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাঙালি জীবনের এমন খণ্ড বিচূর্ণ, বিদীর্ণ ও বাস্তবাশ্রয়ী রূপ অঙ্কিত হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্তি্বক স্বাতন্ত্র্য, সম্প্রদায়গত অবস্থান, সাংস্কৃতিক পশ্চাদপদতা ও অস্তিত্ব সংগ্রামের যথার্থ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে।

২.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যে লেখকদের লেখক ছিলেন, তা পরবর্তীকালে অনেকেই স্বীকার করেছেন। কেউ সমালোচনার মাধ্যমে আবার কেউ কেউ তাদের রচনারীতির মধ্য দিয়ে। কয়েক দশক ধরে জাদুবাস্তবতার যে তত্ত্ব ও অনুশীলন লাতিন আমেরিকার অধ্যয়ন সূত্রে বহুল চর্চার উপজীব্য হয়ে উঠেছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনারীতি সেই নতুন ধারার গদ্যেরও পথপ্রদর্শক। একটি নতুন শিল্পকে দাঁড় করাতে গেলে একইসঙ্গে বিষয়বস্তু রচনারীতি ও ভাষাভঙ্গি সৃষ্টি করতে হয়। এক্ষেত্রে রচনারীতি হচ্ছে আধুনিক সাহিত্যের জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালের লেখকরা বিষয় উপস্থাপনের জন্য নতুন নতুন ভাষারীতি সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে ওঠেন। সেসব লেখকের মধ্যবিত্ত জীবনকেন্দ্রিক রচনা রবীন্দ্রনাথের শব্দসম্ভার অতিক্রম করতে সমর্থ হয়নি। যারা নিম্নবর্গ ও প্রান্তিক জীবনের প্রভিজ্ঞতাকে কথাশিল্পে অকপট রূপ দিয়েছেন, তাদের মধ্যেই এই নতুন ভাষারীতির প্রকাশ আমরা লক্ষ্য করি। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই দু'জন লেখকের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায় এবং সেই দর্শনশিল্পীর নির্লিপ্ততা কতটা বিক্ষিপ্ত করতে পারে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শেষদিকের রচনা এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন পর্যায়ের রচনা তার দৃষ্টান্ত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কোন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়। মনুষ্যত্ব কিংবা মানব ধর্ম কিংবা মানবতা_ এ শব্দগুলো তার তত্ত্বচিন্তা বা সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। জ্যাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদী দর্শন তার জীবন-জিজ্ঞাসাকে প্রভাবিত করেছিল এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। চলি্লশ-পঞ্চাশের দশকের ফরাসি এবং স্পেনের 'নব্য উপন্যাস' আন্দোলনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেও তিনি কাছে থেকে দেখেছিলেন। অবয়ববাদ ও উত্তর-অবয়ববাদকে তিনি দেখেছিলেন ক্রমঅগ্রগতির চঞ্চল ধাবমানবতায়। তার নিজ সমাজ ও আর্থ উৎপাদন কাঠামোমুখী শিল্পীমন একটি জীবনকেই সমগ্র অবয়বে প্রত্যক্ষ করেছে এবং সাহিত্যের বিভিন্ন আঙ্গিকে রূপদান করেছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে যে মূল্যায়ন সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো তিনি বাংলাদেশের লেখক। বাংলাভাষার হাজার বছরের ধারাক্রমে বিশ শতকের চলি্লশের দশকের সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহই প্রথম বাংলা কথাসাহিত্যের উপকরণ, বিষয় ও শিল্পরীতির চারিত্র কী হতে পারে তার স্বরূপ নির্দেশ করেন। আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জীবন রূপায়ণের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল থেকেই একটা অপূর্ণতা ছিল, তা হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বসত্তার রূপায়ণ। বাঙালি মুসলমানের জীবন নিয়ে দেশ বিভাগের আগেও অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে। কিন্তু বিশ্বমানের জীবন-জিজ্ঞাসা ও শিল্পরূপ সেগুলোতে অনুপস্থিত। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহই প্রথম নির্দেশ করেন বাংলাদেশের উপন্যাসের ধারা, বাংলাদেশের উপন্যাসের সংলাপের ধরন কী এবং মধ্যবিত্তের অবচেতনকে কোন অনিবার্য শব্দ শৃঙ্খলায় উপস্থাপন করতে হবে, তার স্বভাবধর্ম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লাল সালু' (১৯৪৭), 'চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪) এবং 'কাঁদো নদী কাঁদো' (১৯৬৮) ক্রমগ্রসরতার বিষয়বস্তু ও শিল্পরূপের সাম্যবাহী। অন্যদিকে তেমনি তিন দশকের বাঙালি জীবনের অন্তর ও বহির্বাস্তবতার রূপায়ণ, মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের বাস্তবতার একটা দৃশ্যমান চরিত্র বিদ্যমান থাকে আর আমরা সাধারণত সেই বাস্তবকেই সহনীয় ও গ্রহণযোগ্য মনে করি। মৃত্যু, বিনয়ী আত্মবিশ্বাস, আত্মবিচ্যুতি এ বিষয়গুলোকে বর্ণনাত্মক শিল্পে উপস্থাপন করলেও অনিবার্য চরিত্র ও ভাষারীতির অভাবে তার গ্রহণযোগ্যতা অল্পকালের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। উপন্যাসে একটি কালকে ধারণ করাই হলো তার সমাজ বাস্তবতা, চরিত্র বাস্তবতা এবং ভাষা ও সংলাপগত যথার্থতা সৃষ্টি করা। রবীন্দ্র-পরবর্তীকালের খুব কম লেখকের মধ্যে এই ত্রিবিধ বৈশিষ্ট্য শিল্পসম্মতভাবে রূপ লাভ করেছে। একটি চরিত্রের বহির্বাস্তবতা এবং অন্তর্জীবন যেমন অভিন্ন নয়, তেমনি তার সরলরৈখিক বহির্বাস্তবতা প্রকাশের ভাষারীতি এবং বহুরৈখিক, দ্বন্দ্বময় ও জটিল অন্তর্জীবন উন্মোচনের ভাষাও অভিন্ন হতে পারে না। ভাষা ব্যবহারে এই মহাজ্ঞান বা সত্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার গল্প, উপন্যাস ও নাটকে প্রয়োগ করেছেন। অজস্র বাঙালি লেখকের তুলনায় তার রচনা সংখ্যাবিচারে অত্যন্ত কম। তিনটি উপন্যাস, চারটি নাটক, দুটি গল্পগ্রন্থ ও প্রায় অর্ধশত গল্প নিয়ে তার সাহিত্যভুবন গড়ে উঠেছে। কিন্তু তত্ত্ব, উপকরণ, বিষয় ও আঙ্গিক বিচারে তার স্বল্পসংখ্যক রচনাই বাঙালি সাহিত্য সমালোচনার বাঁক পরিবর্তনের দিকনির্দেশক হয়ে উঠেছে। কেবল সাহিত্যের তত্ত্ব ব্যাখ্যা ও সমালোচনাই নয়, অনেক সৃষ্টিশীল লেখকও তাদের বর্ণনাভঙ্গিকে ওয়ালীউল্লাহর ছাঁচে ফেলে বিষয় ও আঙ্গিকের নিত্যনতুন পরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করছেন। চেতন-অবচেতনের ভাষা দ্বৈরথ কীভাবে প্রান্তিক জীবন থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জীবন রূপায়ণের মাধ্যম হতে পারে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার উপন্যাস ও ছোটগল্পে অত্যন্ত নিপুণভাবে তা দেখিয়েছিলেন। বাংলাভাষায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মূল্যায়নে যে ধরনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দর্শনজ্ঞান ও যুদ্ধ-উত্তর সাহিত্য ভাবনার অঙ্গীকার প্রয়োজন, তার পথ সন্ধানই এ অসাধারণ প্রতিভার ঋণ স্বীকারের একমাত্র পথ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ