সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র গল্প : স্তন

আবু তালেব মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন সাহেব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মাঝে-মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ করাটা পারিবারিক ফরজ হিসেবেই দেখেন। যতদিন দুনিয়াদারির কাজে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন ততদিন সে-কর্তব্যটি ইচ্ছানুযায়ী পালন করতে পারেন নি। আজ তাঁর দায়িত্বের ভার অপেক্ষাকৃতভাবে লঘু হয়েছে বলে সে-কর্তব্য পালনে বাধাবিপত্তি কমেছে।

সালাহ্উদ্দিন সাহেব যখন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যান তখন তার পূর্ব-আয়োজনটি রীতি মতো সফরের আয়োজনের মতোই মনে হয়। বিনা খরচে ঝট করে কারো বাড়িতে তিনি উপস্থিত হন না। দেখা করতে আসবেন বলে আগাম খবর পাঠান দিনকয়েক আগে। সময়-প্রহর জানান, সঙ্গে-সঙ্গে এ-কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি চা-মিষ্টি কিছুই গ্রহণ করেন না, পান-দোক্তা তামাকের অভ্যাসও তাঁর নেই। তাছাড়া ডাক্তারের কড়া নির্দেশে পথ্য করেন বলে খানার দাওয়াতও গ্রহণ করেন না। বস্তুত এক গ্লাস পানি ছাড়া অন্য কিছু তাকে দেওয়া সম্ভব হয় না। তবু অসিদ্ধ পানিটা রোগ-ব্যাধির ভয়ে পান করেন না বলে তাও ক্বচিৎ স্পর্শ করেন।

তাঁর আত্মীয়স্বজনের চক্রটি বড় কম নয়। শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত সে-পরিবারের লোকসংখ্যা অগুনতি মনে হয়। তবু তাঁর বয়সের জন্যে এবং তাঁর সমৃদ্ধিসম্পন্ন আর্থিক অবস্থার জন্যে তিনি নিজেকে তাদের সকলেরই মুরব্বি বলে মনে করেন এবং পদ্ধতিক্রমে বছরের মধ্যে একবার দু-বার দেখা করে আসেন তাদের সঙ্গে।

তবে আত্মীয় স্বজনের চক্রটি বৃহৎ বলে তাঁকে একটা সীমারেখা টানতে হয়। যারা সে চক্রের বহির্ভূত, নিয়মিতভাবে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতটা করেন না। সবকিছুতেই কোথাও-না-কোথাও একটা সীমারেখা টানতেই হয়।

অতএব সেদিন অপরাহ্ণে বিনাখবরে সালাহ্উদ্দিন সাহেব যখন দেখা-সাক্ষাতের চক্রের বহির্ভূত দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় কাদেরের বাড়িতে উপস্থিত হন, তখন ঘটনাটি নেহাতই বিস্ময়কর মনে হয়। তিন দিন আগে কাদেরের ষষ্ঠ সন্তান জন্মগ্রহণ করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে বলে তিনি যে দুঃখ প্রকাশের নিমিত্ত এসেছেন তা মনে করা সম্ভব হয় না। সালাহ্উদ্দিন সাহেব নিজেই গভীর শোকগ্রস্ত। প্রায় একই সময় তিন দিন আগে প্রসবকালে তাঁর অতি আদরের ছোট মেয়ে খালেদার মৃত্যু ঘটে।

ক্ষুদ্র বৈঠকঘরের একমাত্র পিঠখাড়া-চেয়ারে আসন গ্রহণ করে সালাহ্উদ্দিন সাহেব লাঠির মাথায় তাঁর হাত দুটো জড়ো করেন। একটু দূরে শীতলপাঠি-বিছানো চৌকিতে কাদের মিঞা বসে। তার মুখে কৌতূহলের স্পর্শ। ঘরে কয়েক মুহূর্ত নীরবতা বিরাজ করে।

অবশেষে উচ্চৈঃস্বরে গলা সাফ করে সালাহ্উদ্দিন সাহেব একনজর তাকান কাদেরের দিকে। তারপর অল্পক্ষণের জন্যে তাঁর চোখ ক্ষুদ্র ঘরের চতুর্দিকে ঘুরে বেড়ায়। স্বল্পবেতনের কেরানি মানুষ কাদেরের বাড়িতে সর্বত্র দারিদ্র্যের ছায়া। ঘরে আসবাব বলতে নড়বড়ে চেয়ারটি এবং চৌকিটি ছাড়া আর কিছু নেই। ছাতা-পড়া দেওয়ালে শোভার খাতিরে একটি ক্যালেন্ডার টাঙানো। তাতে নদীর বুকে রক্তিম সূর্যাস্তের ছবি। তাতে সেটি দু-বছরের পুরোনো। অপরাহ্ণের সূর্যের তির্যক আলোয় তাতে জমে-থাকা ধুলা নজরে পড়ে। ওপাশে, ভেতরের দরজার কাছে মাটিতে বসে একটি বছর চারেকের মেয়ে বাটি থেকে মুড়ি খাওয়ায় রত। মুড়ি মুখে যতটা না যায় ততটা ছড়িয়ে পড়ে তার চারপাশে। গায়ে তার একটি অপরিচ্ছন্ন ফ্রক। মুখেও সর্বত্র ময়লার স্পর্শ।

সালাহ্উদ্দিন সাহেব যা দেখেন তাতে তিনি নারাজই হন। যে-প্রস্তাবটি নিয়ে তিনি কাদেরের বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন সেটি উত্থাপন করা সমীচীন হবে কি না সে-বিষয়ে ক্ষণকালের জন্যে তাঁর মনে একটা সন্দেহ জাগে। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, সেটি উত্থাপন না করে উপায় নেই।

আবার গলা সাফ করে সোজা তাকিয়ে এবার তিনি বলেন, আপনার কাছে একটি কথা নিয়ে এসেছি। আমার নাতিকে দুধ দেবার কেউ নেই।

এইটুকু বলেই তিনি থামেন। তাঁর কথাটির মর্মার্থ বুঝতে কাদেরের বিলম্ব হয় না। তবু সালাহ্উদ্দিন সাহেব তাঁর বক্তব্য শেষ করেন নি বলে সে নীরবে অপেক্ষা করে।

প্রস্তাবটি খুলে বলতে সালাহ্উদ্দিন সাহেব সময় নেন। কাদেরের স্ত্রীকে তিনি কখনো দেখেন নি। তবে শুনেছেন, সে বড়ই স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। পাঁচ ছেলেমেয়ের মা, তবু কখনো রোগ-ব্যাধিতে ভোগে নি। তাছাড়া বুকের দুধ দিয়েই সে পাঁচটি ছেলেমেয়েকে হাঁটতে শিখিয়েছে, তাদের মুখে কথা ফুটিয়েছে। ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্যও ভালো। দরজার কাছে বসে-থাকা মেয়েটি অতিশয় নোংরা হলেও রোগাপটকা নয়। তাছাড়া কাদেরের স্ত্রী সম্বন্ধে এ-কথাও শুনেছেন যে, সে নাকি অতিশয় দয়ালু মানুষ; পরের জন্য তার দয়া-মায়ার শেষ নেই। এ-সব অতি উত্তম কথা। তবু কাদের এবং তার স্ত্রীর বর্তমান শোকের কথা ভেবেই তিনি কথাটা খোলাখুলিভাবে বলতে দ্বিধা করেন। তবে সে দ্বিধা দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

শুনেছি আপনার স্ত্রীর স্বাস্থ্য খোদার ফজলে ভালোই। ভাবছিলাম, আমার মা-হারা শিশু-নাতিকে তার বুকের দুধ দিতে রাজি হবেন কি? হলে বাচ্চাটিকে এখুনি নিয়ে আসি। সালাহ্উদ্দিন সাহেব একবার চোখ বন্ধ করেন কেবল খুলবার জন্যেই। একটু হুকুমের কণ্ঠে বলেন, আপনার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে আসবেন?

কাদের চলে গেলে লাঠির মাথায় হাত জড়ো করে বসেই তিনি মূর্তির মত স্তব্ধ হয়ে থাকেন। তবে প্রথমে আরেকবার ঘরটির চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করেন, নোংরা মেয়েটির দিকেও একবার ক্ষিপ্রভাবে তাকান। তাঁর মুখে আবার অসন্তুষ্টির ভাবটি জাগে। প্রস্তাবটি করে ভাল করেছেন কি? অনিশ্চয়তার একটি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। তবে তিনি বোঝেন, প্রস্তাবটি যখন একবার করেই ফেলেছেন, তখন সে-কথা ভাবার কোনো অর্থ নেই।

কাদের প্রত্যাবর্তন করলে তিনি উদ্বিগ্নভাবে তাকান তার দিকে। তার মুখের ভাব দেখে পর মুহূর্তেই তিনি নিশ্চিন্ত হন। লাঠিটা মেঝেতে দু-একবার ঠুকে তিনি উঠে দাঁড়ান। এ-বয়সেও তার পিঠ বিস্ময়করভাবে ঋজু।

দরজার নিচেই আধা পাকা রাস্তা। সেখানে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে তিনি কী ভাবেন। তারপর যে-ব্যাখ্যা প্রথমেই দেয়া উচিত ছিল সে-ব্যাখ্যাটি এখন দেন অযাচিতভাবে।

ডাক্তার অবশ্য বোতলের দুধ দিতে বলে। ওসব আধুনিক পন্থায় আমার বিশ্বাস নেই। দুধের শিশু বুকের দুধ খাবে, প্রকৃতির রীতিই তাই।

তারপর আচম্বিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি পর মুহূর্তেই নিজেকে সংযত করেন। গভীর শোকেও তিনি এমন সংযম দেখাতে পারেন, তার কারণ দীর্ঘ জীবনের ওপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝঞ্জা বয়ে গেছে। তিনি এ কথা শিখেছেন যে, মানুষের জীবনে যখন নিদারুণ দুঃখকষ্ট নাবে তখন মানুষকে তার কর্তব্যের কথাই প্রথমে ভাবতে হয়। তখন ভেঙে পড়লে চলে না।

এ-সময়ে জামাইর কথা মনে পড়তে তিনি ভ্রুকুটি করে ওঠেন। শোকে সে দুর্বল তৃণের মতো ভেঙে পড়েছে। তিনি কী করেন? তাঁকেই সব কথা ভাবতে হয়, যা করবার তা করতে হয়।

গাড়িতে চড়বার আগে বলেন, বাচ্চার সঙ্গে একটি দাই আসবে।

সেদিন সন্ধ্যার পরে সালাহ্উদ্দিন সাহেব তাঁর শিশু-নাতিকে নিয়ে আসেন। সঙ্গে দাই। দাই শিশুকে ভিতরে নিয়ে গেলে তিনি বৈঠক ঘরে বসে কান খাড়া করে রাখেন। কাদেরের স্ত্রীর মতটি ইতিমধ্যে বদলায় নি-তো? শোকগ্রস্তা মেয়েমানুষের কথা বলা যায় না। তারপর একটু পরে দাই এসে ভেতরের দরজার পাশে নিঃশব্দে এক পাটি কালো দাঁত দেখিয়ে দাঁড়ালে তিনি বুঝতে পারেন, কাদেরের স্ত্রী শিশুটিকে প্রত্যাখ্যান করে নি। অবশ্য সন্দেহের কোনো কারণ ছিল না। দুধের শিশুকে কেউ কি ফেলতে পারে? যে-মানুষ সদ্য সন্তান-হারিয়ে শোকাপ্লুত, সে-ও পারে না।

গাড়িতে চড়তে গিয়ে ক্ষণকালের জন্যে দাঁড়িয়ে সালাহ্উদ্দিন সাহেব বলেন-- আপনার স্ত্রীর ওষুধ-পথ্যের দরকার হলে ডাক্তার পাঠিয়ে দেব।

তাঁর কণ্ঠে গভীর তৃপ্তির আভাস। এত গভীর শোকের মধ্যেও একটু সার্থকতার, একটু আনন্দের একটু সুকীর্তিজাত সন্তোষের অবকাশ আছে। সব খোদারই অসীম মেহেরবানি, তিনি ভাবেন।

গাড়িতে চড়ে তিনি ঋজু হয়ে বসেন, দৃষ্টি সম্মুখ দিকে।

কাদেরের স্ত্রী মাজেদার সত্যিই উত্তম স্বাস্থ্য। মানুষটি ছোটখাটো হলেও তার দেহ কোথাও অসম্পূর্ণ নয়। পাঁচ ছেলের মা বটে, তবু সে-দেহ আঁটসাঁট, সামান্য মেদবহুল হলেও তাতে কোথাও ঢিলে-ঢালা ভাব নেই।

দাই ঘরে এসে মাজেদা প্রথমে নিস্তেজ দৃষ্টিতে দাইয়ের কোলে কাপড়ের বান্ডিলের দিকে তাকায়। সে বান্ডিলের মধ্যে একটি ক্ষুদ্র মুখ। শিশুর চোখ গভীর ঘুমে নিমীলিত। তমিশ্রাময় গর্ভের নিদ্রা তার এখনো শেষ হয়নি। তারপর মাজেদার চোখ জ্বলজ্বল করতে শুরু করে। হঠাৎ সে হাত বাড়িয়ে অধীরভাবে বলে, দাও, আমাকে দাও।

আজ কাল থেকে মাজেদা বুঝতে পারে, তার স্তন যেন ভারি, স্ফীত হয়ে উঠেছে। তার সন্দেহ থাকে না যে কুচাগ্রের পশ্চাতে রহস্যময়ভাবে বিন্দু-বিন্দু তরল পদার্থ জমছে নতুন এক জীবনের জন্যে। তাই যে-শোকটা তিন দিনে কিছু স্তিমিত হয়ে এসেছিল, সে-শোকটা আবার তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কার জন্যে তার স্তন এমন ভারি হয়ে উঠেছে? তার গর্ভের সন্তানটি-তো আর বেঁচে নেই। প্রকৃতি কি এতই অন্ধ? সে কি কিছুই দেখতে পায় না? শুধু তাই নয়, প্রকৃতি যেন শোকাপ্লুত মায়ের প্রতি বিদ্রূপ করছে। এক সময়ে তার মনে হয়, এ অন্যায়, অতি নিষ্ঠুর। মনে হয় সে তার দুধভারে স্ফীত স্তন যেন সহ্য করতে পারবে না। তারপর সালাহ্উদ্দিন সাহেব প্রস্তাবটি নিয়ে এলে সহসা সে তার ভারি স্ফীত স্তনের মধ্যে একটি গুপ্ত নির্দেশ দেখতে পায়। না, প্রকৃতি খোদার সৃষ্টি বলে তার সহস্র চোখ : মানুষ যা দেখে না বোঝে না তাও সে দেখে, বোঝে।

বুকের কাছে ধরে মাজেদা নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শিশুটির পানে, একটা অদম্য আবেগে তার সমগ্র দেহ কেঁপে ওঠে বারবার। শীঘ্র শিশুটি চিৎকার করে প্রথমে মাজেদা চমকে ওঠে। বান্ডিলের শিশুটি-যে কাঁদতে পারে সে-কথা সে যেন ভাবে নাই। তার সন্তান একটু শব্দ না করেই যে-অন্তহীন অন্ধকার থেকে সে এসেছিল, সে-অন্ধকারেই প্রত্যাবর্তন করেছিল। মাজেদা কি ভেবেছিল, সে তার মৃত সন্তানকেই কোলে নিয়েছে? অদূরে মেঝেতে বসে দাই কোমরের কাপড়ের ভাঁজ থেকে পান-দোক্তা খুলে মুখে ভরে। সে বলে- বাচ্চার ভুক লেগেছে দুধ দাও।

মাজেদার চোখ আবার জ্বলজ্বল করে ওঠে, অস্পষ্ট কোমল হাসির রেখা জাগে। হ্যাঁ, সে দুধ দেবে বৈকি। তার উন্নত স্ফীত স্তনে ঝরনার মতো আওয়াজ করেই যেন দুধ জমেছে। তার স্তনে সঞ্চিত দুধের বেদনা। সে-বেদনা জীবনেরই বেদনা; বুকে যা-জমেছে দৃষ্টির অন্তরালে তা স্নেহ-মমতার সুধা। মনে আছে তার অন্যান্য সন্তানের বেলায় যখনই শিশুর কান্না তার কানে পৌঁছুত, তখন কুচাগ্র দিয়ে দুধ বেরিয়ে আসত, পেটের নিচে কেমন সঙ্কোচন-প্রসারণ শুরু হতো। তার এখন মনে হয়, কোলের শিশুটির কান্নার আওয়াজে কুচাগ্র যেন তেমনি সিঞ্চিত হয়ে উঠেছে, তেমনি সঙ্কোচন-প্রসারণও শুরু হয়েছে পেটের তলে। শিশুটি যে তার নয়, তাতে বাধা পড়ে নি।

দাই আবার বলে- বাচ্চাটা কেঁদে কেঁদে হয়রান হয়ে গেল। মা-হারা শিশুকে দুধ দেবে না?

এবার ক্ষিপ্রভঙ্গিতে জীর্ণ, কিন্তু ঘর্মাক্ত কড়া-লাল-রঙের ব্লাউজের বোতাম খুলে মাজেদা একটা স্তন উন্মুক্ত করে। কুচাগ্রটি ক্রন্দনরত শিশুটির কাছে ধরলে অধীরভাবে সে তা মুখে ধরে।

কিছুক্ষণ পর শিশুটি হঠাৎ তীক্ষ্ণকণ্ঠে চিৎকার শুরু করে। সে চিৎকার বঞ্চনা-নিষ্ফলতাই ঘোষণা করে। দাই ভ্রুকুটি করে মাজেদার দিকে তাকায়। যে-দৃশ্যটি সে দেখে তাতে তার ভ্রুকুটি আরও গাঢ় হয়। মাজেদা সামনের দিকে তাকিয়ে কেমন নিস্পন্দ হয়ে বসে, কোলের শিশুটির কান্নায় তার কান নেই যেন।

কী হল? দাই প্রশ্ন করে।

মাজেদা সহসা উত্তর দেয় না। তারপর তার শুষ্ক ঠোঁট একটু কেঁপে ওঠে। ক্ষুদ্র কণ্ঠে সে বলে- দুধ জমে গেছে।

শিশুটি এক ফোঁটা দুধ পায়নি। মাজেদার মনে হয়, তার স্তন দুটি জমাদুধে হঠাৎ পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠেছে।

পরদিন ফজরের নামাজের পরই সালাহ্উদ্দিন সাহেব খবর নিতে আসেন। কাদের বৈঠকখানায় এলে তিনি অন্যদিনের মতো লাঠির মাথায় হাত জড়ো করে বসে তার দিকে একবার তাকান, কিন্তু সরাসরি কোনো প্রশ্ন করেন না। প্রশ্ন করার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না। শিশুটির ক্রন্দন শোনার জন্য কান খাড়া করেন একবার। ভেতর থেকে কো নো শব্দ না এলে নীরবতার অর্থ শিশুটির ভোজনতৃপ্তি হিসেবেই গ্রহণ করেন। কাদের তার স্ত্রীর দুধ দেবার ব্যাপারে অক্ষমতার কথা এখনো ভালো করে বোঝে নি বলে সে-ও কিছু বলে না।

সালাহ্উদ্দিন সাহেব লাঠিটা একবার সশব্দে ঋজু করেন। আজ তিনি আর বসবেন না। উঠি-উঠি ভাব করে কাদেরের দিকে না তাকিয়ে বলেন- ফজরের নামাজের পর ওজিফা খুলব এমন সময় একটি কথা মনে হল। মুন্সীর হাটে আমার কিছু জমি আছে। ধান-ফসলের জমি। তার একটি অংশ আপনার স্ত্রীর নামে লিখে দিতে চাই। আশা করি তিনি গররাজি হবেন না।

কথাটা বলেই কাদেরকে কোনো উত্তর দেবার সুযোগ না দিয়ে তিনি উঠে দাঁড়ান। রাস্তার গাড়ির ইঞ্জিন জীবন্ত হয়। শীঘ্র জ্বলা-পেট্রোলের ঝাঁঝালো-মিষ্টি গন্ধে বৈঠকখানা ভরে যায়।

গাড়িতে উঠবার আগে অকারণেই লাঠিটা আকাশের দিকে তুলে তিনি বলেন- কদিন মাছ-গোশত, শাক-সবজিটা আমার বাড়ি থেকে আসবে। দাই ভালো রাঁধতে জানে।

অপরাহ্ণের দিকে ক্রন্দনরত শিশুকে নিয়ে দাই পিছনের সরু বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে, মুখে তার দুশ্চিন্তার ছাপ। আজও বারবার চেষ্টা করেও মাজেদা শিশুকে দুধ দিতে সক্ষম হয় নি। আজ শিশুর চতুর্থ দিন। জন্ম হবার পর থেকে তার পেটে এক ফোঁটা দুধ পড়ে নি। দাই তাকে চামচে করে পানি দিয়েছে কিছু, কিন্তু পানিতে ক্ষিদে যায় না। অবশ্য সে জানে, নবজাত শিশু না-খেয়ে কয়েকদিন দিব্যি সুস্থ দেহেই বেঁচে থাকতে পারে। তবু চার দিনেও শিশুর মুখে একটু দুধ না পড়লে তা চিন্তারই কথা।

ভেতরে দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মাজেদা নিথর হয়ে থাকে। তার চোখ নিমীলিত : ঠোঁট শুষ্ক। একটু আগে শিশুকে আবার দুধ দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সে ব্লাউজের বোতাম দেয় নাই। উন্মুক্ত স্তন এখন তার কাছে পাথরের মতো ভারি মনে হয়। এ-বিষয়ে তার মনে এখন কোনোই সন্দেহ নাই যে, স্ফীত স্তনে দুধ জমে গেছে বলেই কিন্তু নিঃসৃত হচ্ছে না। কিন্তু কেন তার স্তনের এই অবস্থা হয়েছে? একি সম্ভব যে, যে-দুধ তার সন্তানের জন্যেই এসেছিল, তার সন্তানটি আর নেই বলে সে-দুধ এমনভাবে জমে গেছে?

কথাটি মনে হতেই তারই অজান্তে একটি বিজয়ের ভাব রক্তের মতো তার ধমনীতে স্রোতশীল হয়। কিন্তু ক্ষণকালের জন্যেই মাত্র। কথাটি-যে অতিশয় নির্মম তা তার বুঝতে দেরি হয় না। তাই শীঘ্র একটি তীব্র অনুশোচনার জ্বালা সে বোধ করে। কী করে সে এমন নির্মম কথা ভাবতে পেরেছে? শিশুটি নিজের গর্ভের না হোক, তবু সে শিশু। তাছাড়া মা-হারা অসহায় শিশু। এমন শিশুকে কেউ কখনো দুধ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। নিষ্ঠুর মানুষও পারে না। তাছাড়া কথাটি-যে সত্য নয়, তার প্রমাণ সে নিজেই দেখতে পায়। শিশুটিকে স্তন দেবার জন্যে সে মনে-প্রাণে-দেহে একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে। শেষ আকাঙ্ক্ষা কি ভুল হতে পারে?

কিন্তু শক্ত- কঠিন স্তন ভারি হয়ে থাকে। বাইরে শিশুটির কান্নাও শোনা যায়।

কেন তবে তার বুকে এমনভাবে দুধ জমে গেছে?

এবার আরেকটি নির্মম, আরো নিষ্ঠুর সম্ভাবনার কথা তার মনে জাগে। তার মনে হয়, শিশুটিকে স্তন পান করাবার জন্যে সে যে একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করে, সেটি আসল সত্যটি ঢাকবার জন্যে তার মনেরই একটি কৌশল মাত্র। আসল সত্যটি এই যে, তার নিজের সন্তানের মৃত্যু হয়েছে বলে সে চায় না যে, পরের শিশু বেঁচে থাক। সে-জন্যেই তার বুকভরা দুধ এমন জমে পাথর হয়ে গেছে।

কথাটি কিন্তু তার সমগ্র অন্তর তীক্ষ্ণভাবে ক্ষত-বিক্ষত করে। ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয়, বুঝি শ্বাসরোধ হবে। একটি অদম্য কান্নার বেগে তার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে ওঠে।

কাদের আপিস থেকে ফিরেছে কি অমনি বাইরে সালাহ্উদ্দিন সাহেববের গাড়ির শব্দ শোনা যায়। আজ সে-শব্দ কানে আসতেই একটা গভীর আতঙ্কে মাজেদার ক্লান্ত মন ভরে ওঠে। শিশুর কথা না ভেবে আজ সালাহ্উদ্দিন সাহেবের কথাই সে সর্বপ্রথম ভাবে। সে যে তাঁর শিশু-নাতিকে এক ফোঁটা দুধ দিতে পারে নাই, সে-কথা তিনি এখনো জানেন না। দাই এখনো কথাটা প্রকাশ করে নি কিন্তু সে কতক্ষণ আর কথাটা প্রকাশ না করে পারে? কাদের তার অক্ষমতার কথাটা এখন জানলেও সে-ও তা প্রকাশ করে নি। কিন্তু তার পক্ষেও বেশিক্ষণ নীরব থাকা সম্ভব নয়। কথাটা জানতে পেলে সালাহ্উদ্দিন সাহেব কী ভাববেন? তাছাড়া তিনি যদি শিশুকে ঘরে নিয়ে ফিরে যান তবে সে কি লজ্জায় মরে যাবে না?

ক্ষিপ্রগতিতে উঠে বসে মাজেদা তার স্বামীকে ডাকে। গভীর উৎকণ্ঠায় তার মুখ বীভৎসভাবে রক্তশূন্য দেখায়। কাদের এলে সে রুদ্ধকণ্ঠে বলে, ওকে এখনো বোলো না, বুঝলে? শিশু আজ রাতেই দুধ পাবে। আমি জানি। বুকের ব্যথাটা বড় বেড়েছে। আর দেরি হবে না।

কাদের স্ত্রীর অনুরোধটি রক্ষা করে। তবে সে সালাহ্উদ্দিন সাহেবকে বলে, মাজেদাকে একটু ডাক্তার দেখানো দরকার।

সালাহ্উদ্দিন সাহেব ঈষৎ শঙ্কিত হন। কেন?

তার শরীরটা তেমন ভালো হচ্ছে না।

সেদিন সন্ধ্যার পর মাজেদাকে পরীক্ষা করে দেখে ডাক্তার একটি অপ্রত্যাশিত খবর দেয়। সে বলে, মাজেদার দুধ এখনো আসে নি। সেটা নাকি বিচিত্র নয়। আকস্মিকভাবে গভীর আঘাত পেলে দুধ আসতে দেরি হয়। মাজেদার খেয়ালটার কোনো ভিত্তি নেই। সে-কথাও সে বলে। দুধ ব্যতীত স্তনের স্ফীতির কারণও ডাক্তার দুর্বোধ্যপ্রায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।

ডাক্তারের আবিষ্কার মাজেদাকে গভীরভাবে বিচলিত করে। দুধ একেবারে আসে নি সে-কথাটি দুধ-জমে-যাওয়ার চেয়েও অধিকতর ভীতিজনক মনে হয় তার কাছে।

ভীতির কারণ আছে বৈকি। এবার সে বুঝতে পারে, তার মনের নির্মম কথাটি সে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। এবার মনের প্রান্তে একটি নির্লজ্জ কণ্ঠধ্বনি স্পষ্টভাবেই সে শুনতে পায়। সে কণ্ঠ বিজয়ীর সুরে বলে, নিজের সন্তান মরে গেছে-- তো, বুকে আর দুধ আসবে কেন?

অবশ্য কথাটি পূর্বের মতো এবারো তার অন্তর ক্ষত-বিক্ষত করে।

অবশেষে মাজেদাকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হয়। সে জানে তার সময় নেই। ডাক্তারের কথা শুনে সালাহ্উদ্দিন সাহেব আর দেরি করবেন না। এবার তাঁর শিশু-নাতিকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। মা-হারা অসহায় শিশুকে বুকের দুধের জন্যে তার কাছে নিয়ে এসেছিলেন কিন্তু তিনি নিরাশ হয়েই ফিরে যাবেন।

অবশ্য মাজেদা এবার পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারে যে, সবটাই তার জন্যে একটি পরীক্ষা মাত্র। তার সন্তানের মৃত্যু, সালাহ্উদ্দিন সাহেবের শিশু-নাতি নিয়ে আসা, এমনকি ডাক্তারের মত-- সবই পরীক্ষা। এবার তার চোখে তার সন্তানের মৃত্যু অসত্য রূপ ধারণ করে, সালাহ্উদ্দিন সাহেবের আবির্ভাব গূঢ় উদ্দেশ্যে রূপান্তরিত হয়, এবং ডাক্তারের মতটি ধোঁকাতে পরিণত হয়। ধোঁকা নয় তো কী? তার যে স্তনভরা দুধ, সে কথা কি সে জানে না? আজ সন্ধ্যায় তার স্তন আরো স্ফীত হয়ে উঠেছে। দুধ যেন আর ধরে রাখা যাবে না। তাছাড়া তার স্তন আর তেমন শক্ত-কঠিন নয়। তাতে দুধ আর জমে নেই। বরঞ্চ তরল দুধে স্তন টলমল করছে।

তবে কুচাগ্রে কী যেন আটকে আছে বলে দুধটা সরছে না। বোতলের গলায় ছিপি আটকে গেলে যেমন কিছু সরে না, এও তেমনি হয়েছে।

মাজেদা হঠাৎ ধীরস্থিরভাবে উঠে বসে। তার মুখে একটা বিচিত্র শান্তির ভাব। সে জানে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেই তার মাতৃত্বের দাবি স্থাপিত হবে, তার মৃত সন্তানও ফিরে আসবে।

মাজেদা আর দেরি করে না। তার সময় নেই। দৃঢ় হাতে সে ব্লাউজের বোঠিক খুলে প্রথমে ডান স্তন, তারপর বাম স্তন উন্মুক্ত করে। এবার বালিশের নিচে থেকে একটু হাতড়ে একটি সরু দীর্ঘ মাথার কাঁটা তুলে নেয়। তারপর নিষ্কম্প হাতে সে কাঁটাটি কুচাগ্রের মুখে ধরে হঠাৎ ক্ষিপ্রভাবে বসিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ একটি সুতীক্ষ্ণ ব্যথা তীরের মতো ঝলক দিয়ে ওঠে। সহসা চতুর্দিক নিবিড় অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়। তবে সে টু-শব্দটি করে না। একটু অপেক্ষা করে পূর্ববৎ দৃঢ় নিষ্কম্প হাতে একবার শুধু স্পর্শের সাহায্যে ওই নিশানা ঠিক করে সে দ্বিতীয় কুচাগ্রেও কাঁটাটি বিদ্ধ করে। আবার সে-মর্মান্তিক ব্যথাটি জাগে। ক্ষণকালের জন্যে তার মনে হয় সে চেতনা হারাবে। কিন্তু অসীম শক্তিবলে সে নিজেকে সুস্থির করে। দেহে কোথাও মর্মান্তিক ব্যথা বোধ করলেও সে বুঝতে পারে, তার স্ফীত সুডৌল স্তন দুটি থেকে তরল পদার্থ ঝরতে শুরু করেছে। স্তনের নালায় যে-বাধাটি ছিল, সে-বাধা দূর হয়েছে। স্তন থেকে দুধ সরতে আর বাধা নাই।

বাইরে এবার সালাহ্উদ্দিন সাহেবের গাড়ির আওয়াজ শোনা যায়। মাজেদা সেই আওয়াজে এবার আতঙ্ক বোধ করে না। তার স্তন থেকে যখন দুধ ঝরতে শুরু করেছে, তখন আতঙ্কের আর অবকাশ নেই। তার স্তন থেকে দুধ ঝরে, অশ্রান্তভাবে দুধ ঝরে। তবে সে-দুধের বর্ণ সাদা নয়, লাল।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

6 মন্তব্যসমূহ

  1. সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আগে পড়িনি কেনো?

    উত্তরমুছুন
  2. অসাধারাণ গল্প। বাংলা ছোটগল্পে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্‌ হলেন এমনই স্থপতি, যাঁর স্থাপত্যকর্ম যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনই স্থাপন প্রক্রিয়াটিও উপভোগ্য, দাবি করে মনোযোগ। কোনও একটিকে বাদ দিলে ঠিক আস্বাদ মেলে না। তাই ওয়ালীউল্লাহ্-র গল্পের পুনঃকথন সম্ভব হয় না। সংক্ষিপ্তভাবে বলা যায় না, প্রতিটি শব্দ পড়তে হয়। গল্পের ভেতরের নিউক্লিয়াসকে তেমন করে আলাদা করা যায় না। আবার নির্মাণভঙ্গিমাটিকে আলাদাভাবে দেখতে চাইলেও গল্পের প্রাণটি নষ্ট হয়। ওয়ালীউল্লাহ্-র গল্প মানে তাই আগাগোড়া পাঠ এবং সচেতন পাঠ।

    উত্তরমুছুন
  3. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  4. অসম্ভব রকমের ভালোলাগা একটি গল্প৷ পড়ে অবশ্য বেশ কষ্ট পেয়েছি৷

    উত্তরমুছুন
  5. সাদাত হাসান মান্টোর ‘আওলাদ’ গল্পের নকল ‍ভার্শন

    উত্তরমুছুন